গল্পঃ আপনাকে ভালোবাসি ভীষণ। লেখকঃ তাসফি আহমেদ

 গল্পঃ আপনাকে ভালোবাসি ভীষণ। 

লেখকঃ তাসফি আহমেদ


গল্পঃ আপনাকে ভালোবাসি ভীষণ। লেখকঃ তাসফি আহমেদ

গল্পঃ আপনাকে ভালোবাসি ভীষণ।




-আবার যদি সুযোগ পান, ভালোবাসবেন?
নিহিন মলিন মুখে হাসলো। বলল,
-ভালোবাসার ভার অনেক। আমার দ্বারা সম্ভব না।
-যদি বলি একই মানুষকে?
নিহিন এবার চট করেই কিছু বলল না৷ চুপ থাকলো খানিক৷ আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-আমাদের অনুভূতির কাছে আমরা কতো অসহায়!
-আমার কোনো অনুভূতি নেই৷ অন্তত ওই একই মানুষকে নিয়ে তো নয়ই৷
-তা বোঝাই যায়৷
-কী বোঝেন শুনি?
-অনেক কিছুই।
-বলুন তো কিছু৷
-বললে আপনি রেগে যাবেন যে!
-না, রাগব না।
-থাক৷ আসলে আমার বলতেই ইচ্ছে করছে না।
-নাকি বলার মতো কিছু নেই?
আমি আবারও হাসলাম। বললাম,
-আপনার কি মনে হয়?
-আমার তো মনে হয় আপনি কিছুই জানেন না৷
-মিথ্যা বলছেন।
-মিথ্যা বলতে যাব কেন?
-তা আপনিই ভালো জানেন৷
-আমি মিথ্যা বলছি না!
-তাহলে 'মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব তীক্ষ্ণ' এই কথাটাকে কি আমি অবিশ্বাস করব?
-তা একান্তই আপনার ব্যাপার৷
-আপনি লুকোচুরি খেলতে পছন্দ করেন তাই না?
-ছোটবেলায় করতাম।
-এখনও তো করেন।
-সেই বয়স আর কই!
-এই লুকোচুরি খেলায় বয়স লাগে না ম্যাম৷ ব্যথা লাগে৷ ব্যথা!
-ব্যথা?
-হ্যাঁ৷ যে ব্যথা অন্ধকার হলেই জেগে উঠে!
-আমার এমন কোনো ব্যথা নেই।
-অস্বীকার করছেন?
-স্বীকার করার মতো কিছু তো না!
-তাহলে আপনার চোখ যে অনেক কিছুই স্বীকার করছে?
-চোখের স্বীকারোক্তি বোঝা যায়?
-কিছু চোখের বোঝা যায়৷ কিছু স্পেশাল চোখ। যে চোখে মায়া থাকে৷ মায়াকে আবদ্ধ করার জন্যে চারপাশে কাজলের মায়াজাল থাকে৷ যে মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে থাকে একগাদা বিষাদ। বিষাদ এবং মায়ার ছন্নছাড়া অবস্থা৷ স্পষ্টই বোঝা যায়।
নিহিন আমার দিকে ফিরলো৷ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো৷ মৃদু স্বরে বলল,
-আপনি সব সময়ে এমন করেন কেন?
-কেমন?
-এই যে, আমার অতীতকে বারবার টেনে আনতে চান!
-কারণ আপনি অতীতকে অস্বীকার করেন৷
-আমি যে স্বীকার করি, সেটাও তো আপনি বোঝেন। বোঝেন না?
-তা বুঝি।
-তাও কেন এতো টেনে আনেন?
-কষ্ট হয়?
নিহিন কিছু বলল না। ভ্রু কুচকে অন্য দিকে তাকালো। আমি বেঞ্চিটাতে সোজা হয়ে বসলাম। বললাম,
-আপনি খুব নির্দয় একজন মানুষ!
নিহিন আমার দিকে ফিরল। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
-সেদিন তো বেশ কোমল হৃদয়ের মানুষ বলে তোশামোদ করে গেলেন৷
-সে বিষয় ভিন্ন৷ আমি তার কথা বলছি না৷
-তাহলে কোন বিষয়ের কথা বলছেন?
-বিচারবোধের কথা৷
-বিচারবোধ?
-হ্যাঁ৷ ভুল বিচার করে বড় অন্যায় করে ফেললেন৷
নিহিন ভ্রু কুচকে বলল,
-কোথায় ভুল বিচার করেছি?
-কোথায় আবার! এই যে আমার সাথে!
-আপনার সাথে?
-হ্যাঁ। আমার সাথেই৷ এই দেখুন না, আমি আপনার এতো কাছে আসতে চাইছি, এতো জানতে চাইছি, খুব করে ভালোবাসতে চাইছি, আর আপনি? আপনি সেই অতীতকে ঘিরে পড়ে আছেন৷ এখনও তাকে অসম্ভব ভালোবেসে যাচ্ছেন৷ আমার বেলায় তা কেবল শূন্য৷ এটা কি অন্যায় নয়? যে নেই তাকে ভালোবাসেন। অথচ যে ভালোবাসার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো তার দিকে ফিরেও চান না!
-আমি তো কাউকে বলিনি আমাকে ভালোবাসতে?
-আপনার অতীতও তো আপনাকে বলেনি তাকে ভালোবাসতে!
-একসময় তো বলতো!
-সে সময়টা অতীত হয়ে গেছে৷
-দেখুন, এতোসব ভাবি না আমি৷ তাছাড়া এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সাথে আমার আগেই আলোচনা হয়েছে৷ আমিই তো বলেছি সম্ভব না৷ তাও আপনি কেন বারবার আসেন? কেন এতো কাকতালীয় ঘটনার নাটক করেন?
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-ঠিক যেই কারণে আপনি এখনও আপনার অতীতে ফিরে যান! আমি ঠিক সেই কারনেই বারবার ফিরে আসি৷ পার্থক্য কেবল আমারটায় কারো আগ্রহ নেই৷ আপনারটায় ছিল এক সময়৷ বা একপাক্ষিক আগ্রহে ভরপুর।
নিহিন চট করেই কিছু বলে ফেললো না৷ খানিক সময় নীরব থেকে বলল,
-যাই আমি।
-উঠে যাবেন?
-বাসায় যেতে হবে৷
-রাগ করে ফেললেন নাকি?
-জি না৷
-তাহলে উঠে যাচ্ছেন যে?
-সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে।
-আমি কি এগিয়ে দিব?
-তার প্রয়োজন নেই৷
-আমি এগিয়ে দিলে সমস্যা কী বলুন তো!
-কোনো সমস্যা নেই৷
-তাহলে?
-আমি চাচ্ছি না৷
-আপনি চাচ্ছেন না কেন?
-এতো কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না৷
-বিরক্ত হচ্ছেন?
-হ্যাঁ।
-সত্যি?
-মিথ্যা বলতে যাবো কেন?
-আচ্ছা বেশ৷ উঠুন।
নিহিন কিছু বলল না৷ উঠে দাঁড়ালো৷ আমিও তার সাথে উঠে দাঁড়ালাম। পার্কের সরুপথ ধরে এগিয়ে গেলাম৷ কিছুদূর যেতেই আমি বললাম,
-প্রশ্নটার জবাব জানতে চান?
নিহিন ভ্রু কুচকে বলল,
-কোন প্রশ্ন?
-কেন বারবার আপনার অতীতকে ডেকে আনি?
নিহিন কিছু বলল না। আমার দিকে একবার চাইলো। এরপর মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে চেয়ে থাকলো৷ আমি বললাম,
-আমি আসলে আপনার অতীতকে একদম সহ্য করতে পারি না৷
নিহিনের মাঝে কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখলাম না৷ কথাটা শুনে স্বাভাবিকই থাকলো। যেন সে আগ থেকেই জানতো আমি যে তার অতীতকে অসহ্য করি। সে পূর্বের মতোই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমি বললাম,
-খুব হিংসে লাগে আমার। ইচ্ছে হয় কোনো এক উপায়ে আপনার মস্তিষ্ক থেকে ওই অতীতটা মুছে ফেলে নিজেকে বসিয়ে দেই৷ আপনি সারাটাক্ষন আমাকে নিয়ে ভাবুন৷ আমাকে ভালোবাসুন৷ আচ্ছা, স্মৃতি মোছার কোনো যন্ত্র আছে? কোনো সার্জারি করে কি মোছা যায়?
নিহিন চট করেই কিছু বলল না৷ খানিক সময় নীরব থেকে বলল,
-আমার অতীত আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেটাকে সারাজীবন মনে রাখতে চাই৷ এমনকি কোনো সার্জারীর মাধ্যমে স্মৃতি মোছার উপায় থাকলেও আমি সেই উপায়কে ঘৃণা করবো।
আমার ভেতর খানিকটা ধাক্কার মতো লাগল। বললাম,
-একটা মানুষ মিথ্যা বলে, ছলনা করে আপনাকে ব্যাথার সাগরে ভাসিয়ে গেলো! আর আপনি কি না সেই সাগরে আজীবন সাঁতরাতে চাচ্ছেন?
-আমার জীবন! আমি সাঁতরাবো! কারো এতো না ভাবলেও তো হয়!
আমাকে হঠাৎ থেমে যেতে হলো। চুপ থাকতে হলো। মনে হলো এবার আমার থেমে যাওয়া উচিৎ। আর কতো! এতোদিন একটা মানুষের পেছনে ঘোরার পর সে যদি এমন কথা বলে তবে স্পষ্টই বোঝা যায়, মানুষটার আকর্ষণ নেই এখানে৷ তাকে তার মতোই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না৷ অনেকটা সময় চুপ থাকলাম। পার্কের গেট গলে বের হয়ে দুজনে দাঁড়ালাম খানিক। অপেক্ষা একটা রিক্সার। কী মনে হতেই বললাম,
-একটা কথা বলব?
-এতোক্ষণ তো পার্মিশন চাননি! পার্মিশন ছাড়াই তো বলে গেলেন। এখনও বলে যান!
আমি ফ্যাকাসে হাসি দিলাম। বললাম,
-যদি কখনও বিয়ে করেন, তবে অবশ্যই এমন একজনকে করবেন যে আপনাকে বুঝবে৷ আপনার অনুভূতিকে বুঝবে৷ আপনার চাওয়া-পাওয়া কিংবা আপনার অতীতকে মূল্য দিবে - এমন একজনকে খুঁজে বিয়ে করে নিবেন৷ এমন কাউকে বিয়ে করবেন না যে কেবল বিয়ে করাটা সামাজিক কিংবা দৈনিক অথবা সাংসারিক প্রয়োজন বলে বিয়ে করে। কিংবা এমন কাউকে না, যে কেবল সৌন্দর্যতা কিংবা অর্থসম্পদ দেখে বিয়ে করে৷ ওরা আপনার মতো একটা মেয়ে ডিজার্ড করে না৷ ওরা কোনো মেয়েকেই ডিজার্ব করে না৷ তাদের থেকে দূরে থাকবেন৷ আপনি অতীতে হেরেছেন বলে নিজেকে স্রোতের জলে ভাসাবেন না৷ অতিতের পর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ থাকে৷ ওই মানুষটা যেমন আপনাকে ঠকিয়ে অনায়াসে হেসেখেলে জীবন পার করছে, আপনিও তাই করুন৷ এভাবে নিজেকে মূল্যহীন ভাবার মতো তেমন কোনো নিম্নঘটনা ঘটেনি আপনার সাথে৷ আপনি মূল্যবান। ইউ অলয়েজ ডিজার্ব বেটার!
নিহিন কিছু বলল না৷ চুপচাপ থাকলো৷ আমিও আর কিছু বললাম না৷ একটা রিক্সা ডেকে তুলে দিলাম তাকে। রিক্সায় উঠেও মেয়েটা আমায় দেখেনি৷ সামান্য বিদায়টুকুও জানায়নি৷ কেমন রোবটের মতো রিক্সায় উঠে চলে গেল! আমি খানিকটা দুঃখ অনুভব করলাম। সত্যিকারের দুঃখ অনুভব। এমন অনুভব হওয়া অন্যায়৷ তাও কেন জানি হচ্ছে!
আমি ফুটপাতের ধার ঘেঁষে বসলাম। বাসায় ফেরার ইচ্ছে হলো না। ফিরলেই বাবা মা নানান প্রশ্ন করবেন৷ যেগুলোর জবাব আমার কাছে নেই! কী বলব তাদের গিয়ে? এছাড়া নিহিনের আজকের ব্যবহারটা অন্য রকম লাগলো৷ সত্যিই অন্য রকম লাগলো।
-মেয়েটি কে ছিল?
আমাকে খানিক চমকাতে হলো। পেছন ফিরতেই দেখলাম রীতা দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হয়ে হাসলাম,
-আরে তুমি?
রীতা মৃদু হাসলো৷ আমার পাশে বসতে বসতে বলল,
-হ্যাঁ আমি!
-এখানে?
-বাসায় বোর হচ্ছিলাম। তাই বের হলাম খানিক!
-একা কেন? আমাদের ভাইসাব...
এতটুকু বলে থেমে গেলাম আমি। বললাম,
-সরি।
রীতি ফ্যাকাসে হাসি দিলো৷ বলল,
-সমস্যা নেই। বাদ দিন৷ মেয়েটা কে ছিল?
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-হবে কেউ একজন!
-কী? গার্লফ্রেন্ড?
-তেমন কিছু না!
-তবে?
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-মাস তিনেক আগে একটা মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলাম। এই মেয়েটি সেই মেয়ে।
-ওই যে আপনার কল্প কন্যা?
আমি একটু শব্দ করে হাসলাম। বললাম,
-বলতে পারো।
-ফের? প্রেম শুরু করেছেন নাকি?
-নাহ! তা আর হলো কই?
-কেন? হলো না কেন?
আমি রীতার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কিছু বললাম না। ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে দেখলাম। বললাম,
-তোমাকে কখনও অফিস থেকে লিভ নিতে দেখিনি। হঠাৎ সাত দিনের লিভ নিলে যে?
-প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছেন?
-তোমার চেহারা দেখে পাল্টাতে হলো।
-চেহারায় কী আছে?
-ক্লান্তি, বেদনার ছাপ। তুমি ভালো নেই রীতি। কিছু একটা তোমাকে অসম্ভব তাড়া করছে৷ তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে৷ তুমি ভীষণ কষ্টে আছো৷ তা বেশ বোঝা যাচ্ছে৷
-কিছু কষ্ট যে আপনার চেহারায়ও ভেসে বেড়াচ্ছে তা কি আপনি জানেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-মাত্রই তোমার থেকে জানলাম।
রীতি কিছু বলল না৷ মলিন মুখে হাসলো। আমি খানিক চুপ করে থাকলাম। অন্যদিকে ফিরে তাকালাম।
রীতির আমার অফিস কলিগ৷ তার সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ বন্ধুসুলভ। যদিও সে আমাকে আপনি করে বলে, বাট তার সাথে আমার একটা ভালো বোঝাপড়া আছে। মাঝে মাঝে কাজ নিয়ে ঝামেলায় পড়লে মেয়েটা আমাকে হেল্প করে৷ আবার সে ঝামেলায় পড়লে আমি তাকে হেল্প করি। এভাবেই আসলে আমাদের মাঝে একটা ভালো বোঝাপড়া হয়ে যায়৷ একে অপরের সম্পর্কে জানতে পারি। জানতে পারি তার প্রেমের কথা। রাশেদের কথা৷ যাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। অথচ ছেলেটা মেয়েটাকে তেমন মূল্যই দেয় না। সময় দেয় না। ওদের সম্পর্কটা আসলে নামের উপর দাঁড়ানো। বস্তুত ওই সম্পর্কে বিশেষ কিছু নেই৷ কেবল রীতার অসম্ভব পাগলামি ছাড়া।
-জানেন শুভ ভাই, মাঝে মাঝে আমরা এমন পরিস্থিতিতে চলে আসি যে আমাদের কিছুই করার থাকে না৷ কেবল কষ্ট পাওয়া ছাড়া৷ আমরা কষ্ট পেয়ে যাবো, অসম্ভব কষ্ট পাচ্ছি, অথচ সেই কষ্ট দূর করার জন্যে আমারা কিছুই করতে পারবো না৷ কোনো কিছুই না৷
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,
-রাশেদ কি আর যোগাযোগ করেনি?
রীতি জবাব দিলো না। কেবল মাথা নাড়লো। যার উত্তর 'না'।
কয়েকদিন আগে রীতির সাথে রাশেদের বেশ ঝামেলা হয়। দু'জনে বেশ ঝগড়া করে। ঝগড়ার ফল স্বরূপ তাদের ব্রেকাপ হয়ে যায়৷ ব্রেকাপটা অবশ্য রীতিই করে৷ সে চেয়েছিল ওকে একটা শিক্ষা দিতে৷ বাট ছেলেটার শিক্ষা হলো বলে মনে হলো না৷ এতোদিন হয়ে গেল! অথচ সে একবারের জন্যেও রীতির সাথে যোগাযোগ করতে চায়নি৷ সামান্য মেসেজ পর্যন্ত দেয়নি৷ ছেলেটা কি গাধা নাকি? রীতির মতো একটা মেয়েকে ইগনোর করে কীভাবে? এই মেয়ে একবার হ্যাঁ বললে শতশত ছেলের লাইন লেগে যাবে৷ আর ভদ্রলোক কি না এই মেয়েটাকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন৷ বললাম,
-চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। জাস্ট একটু সময় দাও নিজেকে। রিলাক্স করো।
রীতি হাসলো। বলল,
-আপনার ঘটনাটা বলেন? কী হয়েছে? তিন মাস পরিচয় বললেন। তাও প্রেম হয়নি?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-মেয়েটা বেশ জটিল। ভালোবাসার সুযোগ দেয় না। চারপাশে কেমন কঠিন প্রাচীর দিয়ে নিজেকে আবদ্ধ রাখে। আসলে ও আগে একজনকে ভালোবাসতো৷ বাট ছেলেটা ওর সাথে চিট করে। ওকে ছেড়ে চলে যায়৷ মেয়েটার ভালোবাসাটা হয়তো গভীর ছিল। যেটা ছেলেটা বুঝতে পারেনি৷ ও এখনও ওই ছেলেটাকে ভালোবাসে। এখনও তাকেই চায়৷
রীতি অবাক হয়ে তাকালো। বলল,
-চিট করে যাওয়ার পরও মেয়েটা ছেলেটাকে ভালোবাসে?
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-রীতি, ভালোবাসা যুক্তি মানে না৷ এটা একটা মানসিক ব্যাধির মতো৷ একবার ধরলেই হলো। আজীবন ভোগাবে।
রীতি কিছু বলল না৷ চুপ থাকলো৷ আমি বললাম,
-ওকে আসলে প্রথমদিনেই আমার পছন্দ হয়ে যায়৷ একবার দেখার পরই মনে হলো, হায়, স্রষ্টার কী অনিন্দ্য সৃষ্টি সে। তার মাঝে এতো মুগ্ধতা কেন? মায়া কেন? মেয়েটা যেন মনের মাঝে জায়গা করে নেয় অনায়াসে৷ কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমাদেরকে ভিন্ন করে কথা বলতে বলা হয়৷ তখনই সে আমাকে তার প্রেমের ব্যাপারে জানায়৷ সে জানায়, আমি চাইলে তাকে বিয়ে করতে পারব৷ সে বিয়েতে রাজি হবে৷ কিন্তু সে কখনই আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। সে ওই মানুষটাকে এতো তীব্র ভাবে ভালোবাসে যে অন্য কারো কথা সে মাথাতেও আনতে পারে না। আমি বেশ অবাক হলাম। আজকালও এমন ভালোবাসার মানুষ আছে পৃথিবীতে? আমাদের আলোচনা তখনও কোনো সমাপ্তিতে আসেনি৷ আমরা বাসায় চলে আসি৷ একদিন গেলে জানতে পারি নিহিনের জন্যে এ যাবত যতোগুলো ছেলে দেখা হয়েছে প্রত্যেককেই সে একই কথা বলেছে এবং ম্যাক্সিমাম ছেলে প্রথমবারেই নিষেধ করে দিয়েছে। দেওয়াটাই স্বাভাবিক। আজীবন গাধার মতো পড়াশোনা করে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা কোনো ছেলেই এমন মেয়ে বিয়ে করবে না৷ সবাইই শান্তি চায়৷ একজন বুঝতে পারা মানুষ চায়৷ ভালোবাসা চায়৷ চাওয়াটাও অন্যায় নয়৷ কয়েকটা ছেলে লাইন মেরেছে ওর পিছু। বাট ও পাত্তা দেয়নি৷ ছেলে গুলো ফের হাল ছেড়ে দেয়৷ আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি! ছেলে গুলো কেন হাল ছেড়ে দিয়েছে!
রীতি চট করেই বলে উঠল,
-কেন? কেন হাল ছেড়ে দিয়েছে?
-বলছি! শোনো, আমি বাসায় গিয়ে দু'দিনে একটা কুইক সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি মেয়েটাকে পটিয়ে নিব৷ এতো দেখাদেখির পর একটা মেয়েকে পছন্দ হলো৷ তাকে তো এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না! আমি মেয়েটাকে নক দিলাম৷ তার কাছ থেকে দু'মাসের সময় নিলাম। বললাম এই দু'মাসে যদি সে কিছু ফিল না করে তবে আমরা কেউই কাউকে আর ডিস্টার্ব করব না৷ যে যার মতো চলবে৷ মেয়েটা হাসি মুখেই তা মেনে নিলো৷ তখন অবাক হলাম এটা ভেবে যে এই মেয়ে এতো ইজিলি মেনে নিলো কেন? এখন আমি সেটা টের পেলাম। আসলে সে কেন মেনে নিয়েছে৷ শোনো, যে ঘুমিয়ে আছে তার ঘুম ভাঙ্গানো যায়৷ কিন্তু যে ঘুমের ভান ধরে আছে তার ঘুম কিভাবে ভাঙ্গাবা তুমি?
-মানে?
-মানে এই মেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আছে যে সে কারো কথাতেই গলবে না৷ কোনো কথাতেই না৷ আমি দু'মাসের সময় নিলাম। ব্যাপারটা তিন মাসে গড়ালো। প্রথম প্রথম এতো কঠিন বিহ্যাভ করতো বলার মতো না। আমি বেশ লজ্জাবোধ করতাম। অপমানবোধ হতো৷ আচ্ছা তুমিই বলো, এখন কি আর মেয়েদের পিছনে ঘোরার সময় আছে? তাও আমি ঘুরেছি৷ তার পাত্তা পাবার অনেক চেষ্টা করেছি৷ নানান কাকতালীয় ঘটনা ঘটিয়েছি৷ যেমন পার্কে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া৷ মূলত হঠাৎ দেখা হওয়া না, আমি জানতাম সে এখানেই আসবে৷ তাই আগ থেকে গিয়ে ওয়েট করা৷ সে যেই যেই শপিংমলে যায় আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। হঠাৎ তার সাথে দেখা হলেই বলতাম, আরে আপনি এখানে? আরো কতো কি যে করলাম! অথচ আজ মেয়েটি জানালো সে আমার উপর বিরক্ত হচ্ছে৷ আরো কী কঠিন বিহ্যাভ! যেন আমি অপরিচিত কেউ! ব্যাপারটা আজ খারাপই লাগলো। সে নিজেকে একটা আবদ্ধ ঘরে আঁটকে রাখছে। একটা ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর৷ সে চাইলেই জানালাটা খুলে দিতে পারে। অথচ সে চায় না আলো ঢুকুক৷ বাতাস আসুক। সে আসলে একলা থাকতে চায়। অন্ধকারে থাকতে চায়৷ এটাই আসলে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য৷ এভাবে আর এগোবে না আসলে৷ সে থাকুক তার মতো৷ তাকে তার মতোই থাকতে দেই৷ কী বলো?
-জিহ৷ তাই ভালো হবে৷ অন্তত আপনি তো চেষ্টা করেছেন। কম করেননি৷ তারপরও যদি এখানে কিছু না হয় তবে সে আসলে আপনার কপালে নেই৷ আপনার কপালে অন্য কেউ আছে৷ ঠিক আপনি যেমন চান, তেমন কেউ৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-চলো উঠি৷ একটু হাঁটা যাক৷ তোমার রাশেদ মিয়াকে একটা টাইট দেওয়ার প্ল্যান করি৷ কী বলো?
-মানে? কি প্ল্যান? কী বলছেন?
-উঠে আসো৷ বলছি৷
.
বাসায় ফিরতে রাত হলো খানিক৷ সবার খাওয়া শেষ তখন৷ আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার টেবিলে বসলাম। মা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন৷ চেহারা তার অসম্ভব কালো৷ আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। মায়ের আবার কী হলো? আমি বললাম,
-কী হয়েছে তোমার? মুখ কালো করে আছো কেন?
মা আমার কথার জবাব না দিয়ে বললেন,
-ডালটা কি এখন দিব? নাকি পরে নিবি?
-রাখো৷ আমি নিবো৷
কথাটা বলার পরই দেখলাম বাবা এসে পাশের চেয়ারে বসলেন৷ তারও চেহারার অবস্থা বিশেষ ভালো না৷ আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। বাবা চট করেই বললেন,
-ওই মেয়ের বাবা ফোন দিয়েছেন৷
-কোন মেয়ের?
-কোন মেয়ের মানে? যার সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে৷
-অহ আচ্ছা৷ নিহিনের বাবা! তা কি বলল শুনি?
বাবা খানিকটা সময় নিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,
-উনারা মেয়েকে বিয়ে দিবেন না৷ নিষেধ করে দিয়েছেন৷
আমি খানিক ধাক্কার মতো খেলাম। নিহিন এতোটা বিরক্ত হয়ে গেল? বাসায় গিয়ে একেবারে নিষেধ করে দিলো৷ আমার দুঃখবোধ বাড়লো৷ খানিকটা মন খারাপের আবরণ পড়ল মনে৷ তবুও মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বললাম,
-এই কারণে তোমাদের মন খারাপ?
মা কিছু বললেন না৷ বাবা বললেন,
-তারা নিষেধ করেছে বলে মন খারাপ না৷ তোর জন্যে খারাপ লাগছে৷ তুই এতো করে চাইলি! আমার তো মেজাজই খারাপ হয়ে গেল! কী পেয়েছি কি মেয়েটা? তোর মাঝে কিসের কমতি আছে যে ও তোকে রিজেক্ট করেছে?
আমি হাসিমুখে বাবার দিকে তাকালাম। এই মানুষটা আমার জীবনের সবচে বড় অনুপ্রেরণা। আমাকে এতো ভালোবাসে! তিনি আমাকে কোথাও নিচু হতে দিবে না৷ তার ছেলে সবার সেরা এটা তিনি মনে প্রাণে মেনে নিয়েছেন৷ বিশ্বাস করেছেন৷ তাই হয়তো আজ এমন রিজেক্টে তিনি খানিক ব্যাথিত। আমি হাসিমুখে বললাম,
-সমস্যা নেই বাবা! এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ব্যাপার না। তোমরা অন্য মেয়ে দেখতে পারো৷ আমার কোনো আপত্তি নেই৷
বলে মায়ের দিকে ফিরলাম। কথাটা শুনতে দেখলাম মায়ের চেহারার কালচে ভাবটা মুছে যাচ্ছে৷ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠার সময় নিচু স্বরে বললাম,
-ড্রামা কুইন একটা!
মা এবার শব্দ করে হাসলেন৷ আমি ঠিক ঠিক টের পেলাম, মা আসলে কেন এতো চিন্তিত ছিল৷ আসলে তিনি ভেবেছেন আমি হয়তো এই মেয়েকে ছাড়া কাউকেই বিয়ে করব না৷ এই মেয়ে রিজেক্ট করলে হয়তো আমি বিয়ের প্ল্যানটা বাদ দিয়ে দিব৷ এই মানুষটা নিশ্চিত ভাবে এই একটা চিন্তাতেই ডুবে ছিল৷ যখনই বললাম এগিয়ে যেতে, কেমন মুচকি মুচকি হাসি দিলো! আমার মায়ের এমন ড্রামাগুলো বেশ ইঞ্জয় করি আমি৷ নিজে কি চাইবে সেটা বলবে না৷ কারো দ্বারা বলিয়ে নিবেন তিনি৷ অথবা চেহারা অন্ধকার করে রাখবেন।
খাবার টেবিল থেকে উঠে এসে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। চারদিকে নিরবতা। এই প্রাণচঞ্চল শহরটিকেও একসময় নিস্তব হয়ে যেতে হয়৷ সেই নিস্তব্ধতার ফাঁক গলে কিছু গাড়ির হর্ণ কিংবা কুকুরের আত্মচিৎকার শোনা যায় মাঝে মাঝে৷ এরপর ফের একই নীরবতা৷ নিস্তব্ধতা। ধীরে ধীরে সব একেইবারে নীরব হয়ে যায়৷ এই নীরব শহরটাকে কেন জানি আজ আমার নিজের মতো মনে হলো! এতো কিছু করেও আমাকে হঠাৎ থেমে যেতে হলো। পরিশ্রমের ফল শূন্য৷ অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়? নাকি আমি ভুল জায়গায় নিজের শ্রম ব্যয় করেছি? আমার হঠাৎ মন খারাপ হলো। অসম্ভব মন খারাপ৷ অন্ধকার কিংবা নিস্তব্ধতা এমন এক জিনিস, যার সংস্পর্শে এলে আপনার মন খারাপ হবে৷ আপনার কাঁদতে ইচ্ছে হবে৷ আপনার অতীত কল্পনা জেগে উঠবে৷ অন্ধকারের সাথে এসবের কী সম্পর্ক কে জানে! কেন এই সময় এলেই মন খারাপ হয়? আচ্ছা নিহিন মেয়েটা কি একবারের জন্যেও আমার কথাটা ভাবেনি? অন্তত নিষেধ করার আগে আমাকে একবার বলতে পারতো! অথচ সে তাও করেনি৷ কেন করেনি? এতোই কি অপছন্দ করে আমাকে? আচ্ছা আমার এতো মন খারাপ হচ্ছে কেন? আমি নিহিনকে মিস করছি কেন?
.
এর বেশ কয়েকদিন পরের কথা। রীতির মানুষটাকে টাইট দেওয়ার কাজ চলছিল তখন৷ কাজটা আসলে বিশেষ কিছু না৷ রাশেদকে জেলাস ফিল করানো৷ জেলাস ফিলটা এমন এক জিনিস যেটাকে কোনো কিছু দ্বারা দমিয়ে রাখা যায় না৷ আপনি যতো শক্ত মনেরই হোন না কেন, আপনি যখন আপনার প্রিয় মানুষটাকে অন্য একটা মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখবেন, আপনি অবশ্যই জেলাস ফিল করবেন৷ যদি না করেন তবে বুঝে নিতে হবে আপনি তাকে ভালোবাসেন না৷ এই যুক্তিতেই আসলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি৷ এবং কিছুটা কার্যকরীতা দেখাই যাচ্ছে৷ প্রথমদিনে আমরা বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিনি৷ আমরা ডিনার করতে গিয়েছিলাম একটা রেস্টুরেন্টে। আমাদের কাছে খোঁজ এসেছে রাশেদ ওখানেই আছে৷ খোঁজ কীভাবে এলো সেটা আমার অজানা৷ রীতি এই ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি৷ আমি জানতে চাইলেও না৷ কেবল বলল, "ও ওখানেই আছে।" আমরা কাপলের বেশে গেলাম। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম। রীতিকে বললাম, 'খবরদার চেহারায় একটু কালো ভাব এনেছো তো! চিল মুডে থাকবা৷ মনে করো যে তুমি আজ অসম্ভব খুশি৷ শুভ ভাইয়ের সাথে ডিনারে এসেছো অথচ খুশি হবা না এমন কি হয়?' রীতি নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো৷ মুখে হাত দিয়ে অনেকক্ষন হাসলো। ফের বলল,
-আপনি পারেনও বটে৷ শুভ ভাইয়ের সাথে ডিনারে আসাটা এতো বিশেষ কিছু না যে এতো হাসব৷
এই বলে আরো খানিক হাসলো সে৷ আমি আড়চোখে দেখলাম রাশেদকে৷ সে কেমন চোখ পাকিয়ে দেখছে রীতিকে। জেলাসে ভরপুর চোখ দেখার মজাই আলাদা৷ দ্বিতীয় দিন অবশ্য রাশেদ আমাদের প্ল্যানে ছিল না৷ সেদিন অফিস শেষে রীতি চা খাওয়াবে বলে টিএসসিতে নিয়ে গেল। সময় তখন সাড়ে আটটা৷ চা'টার অসম্ভব প্রয়োজন ছিল৷ অফিসের কাজের চাপে মাথাটা কেমন হ্যাং হয়ে আছে৷ সে কারণেই চা খেতে যাওয়া। আমরা যখন চায়ে প্রথম চুমুক দিলাম তখনই রাশেদকে দেখতে পেলাম৷ এক মেয়ে বন্ধু নিয়ে এসেছে। উদ্দেশ্য চা খাওয়াই বোধহয়। তখনও সে আমাদের লক্ষ্য করেনি। আমি রীতির দিকে ফিরতেই দেখলাম সে কঠিন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ যেন আস্ত গিলে খাবে রাশেদকে৷ আমি ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
-হ্যালো হ্যালো হ্যালো! এভাবে তাকানো যাবে না রীতি। আমার দিকে তাকাও৷ এই যে আমার দিকে৷ আমার চোখের দিকে। তোমার চোখ দিয়ে যে আগুন বের হচ্ছে সেটা যাতে আর কখনই বের না হয় আমরা সেই ব্যবস্থা করার প্ল্যান করেছি৷ আশা করছি তুমি সেই প্ল্যানটাকে এভাবে তাকিয়ে ভেস্তে ফেলবে না।
রীতি আমার দিকে কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো৷ বলল,
-ওটা ওর কাজিন শুভ ভাই৷ মেয়েটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না৷
-রিল্যাক্স। শান্ত হও৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ ওর দিকে তাকাবা না৷ ওই দিকে ফেরারই দরকার নেই৷ চা'টা চলদি করে শেষ করে নাও৷ আমরা বেশিক্ষণ থাকব না এখানে৷
রীতি শান্ত হলো৷ অন্য দিকে ফিরে তাকালো। আমি চারপাশ দেখতে থাকলাম৷ এক ফাঁকে রাশেদকে দেখে নিলাম। রাশেদকে দেখার পর যা মনে হলো, সে পারে না আমাকে মেরে ফেলে, এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ কী তীক্ষ্ণ মেজাজি তার দৃষ্টি। আমার অবাকই লাগল৷ বেটা তুই ওর জন্যে যদি ফিল করে থাকিস তবে সেটা বলছিস না কেন? কিসের লুকোচুরি খেলা খেলছিস? একটা সরিই তো! বলে দিতে এতো বাধে কেন?
সেদিনের পর আজ প্রায় সপ্তাহ পেরিয়ে গেল রাশেদের খোঁজ নিতে৷ এতোদিন কই ছিল কে জানে! রীতি নাকি ওর কোনো খোঁজ নিতে পারছিল না৷ এ নিয়ে সেও খানিক আপসেট ছিল। ভাবলো আবার কিছু হয়ে গেল নাকি? আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, কিচ্ছু হয়নি৷ চিন্তা করো না৷ এরপর রীতি আর বিশেষ কিছু বলেনি৷ রাশেদের খোঁজ আশা অব্দি আমরা প্ল্যানটা চেপে রাখলাম। তবে এর মাঝে টিএসসিতে গিয়েছি আরেকবার দু'জনে। সেটা অবশ্য প্ল্যানের বাইরেই ছিল। এছাড়া আর বিশেষ কোথাও যাওয়া হয়নি।
আজ শুক্রবার ছিল বলে রেস্টে ছিলাম৷ রাতে ঘুমে খানিক ব্যাঘাত ঘটছে ইদানীং। তাই আজ বিকেলে ঘুমটা একটু তীব্র ভাবেই যেন এলো৷ পুরো বিকেল ঘুমালাম৷ ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যায়৷ রীতির কলে৷ সে আর্জেন্ট ডাক দিলো৷ রাশেদের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে৷ সে কোনো এক রেস্টুরেন্টে আছে। আমাদের জলদি বের হতে হবে৷ আমার উঠতে মন চাচ্ছিল না৷ তাও উঠলাম৷ কষ্ট করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আমরা এই মূহুর্তে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি৷ আমার সামনে এক রূপসী কন্যা বসে আছে৷ এই কন্যাটির নাম রীতা রহমান৷ এই অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটার একটা হাত ধরে আছি আমি৷ তার চোখের দিকে চেয়ে আছি৷ সে আমার চোখের দিকে চেয়ে আছে। তার চেহারা উজ্জ্বল। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি৷ ঠিক এমন সময়ে আমি রীতার পেছনে শাড়ি পরা কেউ একজনকে দেখতে পেলাম। রীতার দিক থেকে আমার দৃষ্টি সরে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ওই মানুষটার দিকে চলে গেল। আমি দেখলাম শাড়ি পরা নিহিন রেস্টুরেন্টে ঢুকছে৷ তাকে ঢুকতে সাহায্য করছে স্যুট-কোট পরা কোনো এক সুদর্শন যুবক৷ আমার হাসি চট করে মলিন হয়ে যেতে থাকলো৷ আমি দ্রুত তা ঠিক করে নিলাম৷ দৃষ্টি সরিয়ে রীতার দিকে ফিরলাম। বললাম,
-রীতা তোমাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে কেন?
রীতার মুখ লাল হয়ে এলো৷ সে কেমন লজ্জামাখা চেহারায় বলল,
-কী বলেন শুভ ভাই?
আমি হাসলাম৷ কিছু বলতে পারলাম না৷ রীতের হাত ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম৷ আড় চোখে দেখলাম নিহিনকে। অবাক হলাম৷ এই মেয়ে এখানে কী করছে? কেন এসেছে? আর এই ছেলেটাইবা কে? আমার মতো কেউ? আমার মনটা হঠাৎই কেমন কেঁপে উঠল৷ হায়! নিহিনের পাশের এই ছেলেটে সহ্য করতে পারছি না কেন? আমার কেন ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটাকে খুন করে ফেলি?
-এই? শোনো? এই?
রীতির ডাকে আমার খানিকটা হুশ ফিরলো যেন৷ আমি কেমন হতভম্ব হয়ে রীতির দিকে তাকালাম৷ রীতি মুচকি মুচকি হাসছে৷ আমি নিজেকে সামলে নিলাম৷ রীতি হাসিমাখা মুখটা সামনে এনে ফিসফিস করে বলল,
-নিজেকে কন্ট্রো করেন শুভ ভাই! সেদিন তো আমাকে ভালোই জ্ঞান দিলেন৷ সেই জ্ঞান নিজের উপর ফলাতে পারেন না কেন?
আমি কিছু বললাম না৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷ খানিক নীরব থেকে বললাম,
-ধাক্কার মতো লাগলো রীতি৷
রীতি আমার হাত ধরে চেহারায় রাজ্যের মায়া মেখে বলল,
-আমি জানি! এই ধাক্কাটাকে আমি খুব কাছ থেকে চিনি! বুঝেছো? সমস্যা নেই! আমি আছি না? সব ঠিক করে দিবো।
আমি মৃদু হাসলাম৷ রীতির হাতে আলতো চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-আমি ভুলেই গেছিলাম এক্টিংয়ের কথা৷
রীতি হাসলো৷ বলল,
-সমস্যা নেই! আমি আছি না! দেখলেন না কীভাবে সামলে নিলাম৷
-তুমি ভালোই এক্টিং জানো কিন্তু৷ আমি তো অল্পের জন্যে ভেবে ফেললাম সত্যি সত্যি বলছো আমাকে সামলে নিবে!
বলে হাসলাম খানিক৷ ফের চারপাশে তাকানোর ছলে নিহিনদের একবার দেখে নিলাম। সেদিকে তাকাতেই নিহিনের সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল৷ সে যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে৷ আমি চোখ সরিয়ে নিলাম৷ এমন একটা ভাব যেন তাকে ঠিক ভালো ভাবে লক্ষ্য করিনি আমি। আমি মনে মনে হাসলাম৷ আল্লাহ চাইলে কী না করতে পারে৷ রীতির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-রীতি, এই যে এই মূহুর্তটা, এটা যে কী অদ্ভুতরকম একটা মূহুর্ত তা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
রীতি মৃদু হেসে বলল,
-বেশ বুঝতে পেরেছি৷ একপাশে রাশেদ অন্য পাশে নিহিন! আমাদের বিপরীত দু'জনেই আজ একই অবস্থানে আমাদের বিপরীতে বসে আছে৷ ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং!
আমি হাসলাম৷ বললাম,
-তা বটে৷
.
রেস্টুরেন্টে বেশ ভালোই মজা হলো৷ খাওয়া শেষে আমরা বাসায় ফিরে এলো৷ রাত দুটোয় রীতি কল দিয়ে সুখবর জানালো। রাশেদ ফোন দিয়েছে৷ তাদের অনেকক্ষন কথা হয়েছে৷ সে ক্ষমা চেয়েছে৷ এমনকি সে নাকি রীতিদের বাসার নিচেও চলে এসেছে! সে নাকি এতোদিন রীতির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। এখন সে কেন জানি সব টের পেয়ে গেল৷ তার চোখ খুলে গেল। হেনতেন৷ আমি বললাম,
-তুমি মাপ করে দিয়েছো নাকি?
রীতি কেমন উচ্চস্বরে বলল,
-মোটেও না৷ ও যে যে কাজ গুলো করলো, এগুলোর প্রত্যেকটার হিসেব নিবো আমি৷ তারপর ওকে মাপ করব৷
-এই না হলো রীতি! ভেরি গুড! একটা শিক্ষা দিয়ে দাও৷ ওর আক্কেল হোক!
-তা তো দিবোই৷ বহুত প্যারা দিয়েছে সে আমায়।
-আচ্ছা৷ ট্রিট দিবা কিন্তু! কতো বড় উপকার করলাম তোমার৷
রীতি হাসলো, বলল,
-সত্যিই শুভ ভাই, আপনার এই উপকার আমি কখনই ভুলব না৷ আজীবন ট্রিট দিয়ে গেলেও আমি যেন পরিপূর্ণ রূপে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব না৷
আমি হাসলাম৷ বললাম,
-আজীবন লাগবে না৷ নেক্সট ফ্রাইডে একটা ট্রিট দিয়ে দিও৷
-জি৷ দিবো অবশ্যই৷
-বেশ৷ রাখো তবে৷ আমি মুভি দেখছি একটা৷ পরে কথা হবে৷
-জি আচ্ছা৷ ভালো থাকবেন ভাই৷
.
শুক্রবারে রীতার ট্রিট পেয়ে গেলাম। বেশ পেট পুরে খাইয়েছে মেয়েটা৷ গরম গরম কাচ্চির স্বাদ যেন এখনও জ্বিবে লেগে আছে৷ আহা! খাওয়ার পর কথার কথায় জানতে চাইলাম,
-রাশেদকে নিয়ে আনোনি যে?
-কেন? তাকে কেন আনবো?
-কী? এখনো ঝামেলা মিটিয়ে নাওনি?
রীতি ফ্যাকাসে হাসি দিলো৷ বলল,
-না৷ কিছুদিন পেছনে ঘুরুক সে।
-শোনো, কিছুদিন পেছনে ঘুরাতে গিয়ে আঘাত দিয়ে ফেলো না আবার৷ অবহেলা খুবই মারাত্মক একটা জিনিস৷ যে অবহেলায় ব্যাথা পায়, সেই ব্যাথা খুব সহজে নিবারণ করা যায় না রীতি৷ অবেহেলা মানুষকে বিমূখ করে ফেলে। এমনও হতে পারে, তুমি মানুষটাকে একেবারের জন্যে হারিয়ে ফেলতে পারো।
রীতি চেহারাটা মলিন হয়ে গেল৷ সে কেমন করে তাকালো আমার দিকে৷ আমি বললাম,
-ওকে কল দাও। ডেকে নাও এখানে৷
রীতি অপেক্ষা করলো না৷ দ্রুত রাশেদকে কল দিলো।
.
রাতে বাসায় ফিরতেই মা বললেন তিনি আমার জন্যে একটা মেয়ে দেখেছেন। মেয়েটা আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে৷ মা নিজেও বললেন, আমরা যাতে আগে নিজেরা দেখে শুনে নেই৷ এরপর দু'জনের পছন্দের মিল হলে পারিবারিক কথাবার্তা আগাবে৷ আমি বললাম,
-কাল পারব না মা৷
-কেন? কেন পারবি না? কাল তো তোর অফ ডে।
-এ ক'দিন বাইরে বেশ ঘোরাফেরা হলো৷ তাই আসলে বাইরে আর যেতে ইচ্ছে করছে না৷ বাসায় থেকে দারুণ একটা ঘুম দিতে ইচ্ছে করছে মা।
-আমি অতোশত জানি না৷ আমি ওদের কথা দিয়ে ফেলেছি৷ তুই কাল যাবি দেখা করতে৷ ব্যস৷
আমি কিছু বললাম না৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে ফিরে এলাম৷ আমার আজকাল কোনো কিছুই যেন ভালো লাগছে না৷ বড় অশান্তি লাগছে৷ মনের ভেতর কোথাও শান্তি নেই যেন! কেবল শূন্যতর কষ্টে বুকটা কী অসম্ভব ভার হয়ে আছে৷ আচ্ছা, নিহিন মেয়েটা কি আমাকে একটুও মিস করে না?
.
পরদিন বিকেলে রেডি হয়ে বের হলাম। মেয়েটা কল দিয়েছে বিকেলেই৷ একটা রেস্টুরেন্টের এড্রেস হোয়াটসঅ্যাপ করেছে। আমি এড্রেসটা দেখে নিলাম। মেয়েটার প্রোফাইল পিকচার দেখার ইচ্ছে হলো না কেন জানি৷ রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কে জানি কেন, আমার হঠাৎ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখলাম নিহিন বা'পাশের একটি টেবিলে বসে আছে৷ কেন জানি না ঢুকতেই চোখটা ওর দিকেই গেল এবং আমি বোকার মতো তার দিকেই চেয়ে থাকলাম। মেয়েটার মাঝে কি জানি একটা মায়া আছে৷ ঘোর আছে৷ তাকালে কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷ চোখ ফেরানো মুশকিল। আমি খানিক অবাকও হলাম৷ আজ আবার এই মেয়ে এখানে কি করছে? শাড়িও পরেছে দেখছি৷ আজও কারো সাথে এলো নাকি? ঠিক এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠল। রিংয়ের শব্দে আমার ঘোর চট করেই কেটে গেল যেন৷ পকেট থেকে ফোন বের করে নিলাম৷ স্ক্রিনে মেয়েটার নাম্বার। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি স্বর ভেসে এলো। স্বরটা কেমন পরিচিত,
-এভাবেই তাকিয়ে থাকবেন নাকি?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অকপটে বলে ফেললাম,
-কী?
-বলেছি এভাবেই কি তাকিয়ে থাকবেন? নাকি এখানে এসে বসবেন?
আমি নিহিনের দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার কানে ফোন৷ তার চোখ ভরা আবেগ। উচ্ছ্বাস। কৌতূহল। আমি তাকে ঠিক বুঝে উঠলাম না৷ বোকার মতো ফের বলে বসলাম,
-মানে?
-মানে আপনার মাথা৷ এখানে এসে বসুন। বলছি সব৷
আমি নিহিনের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ ওর বিপরীতে বসলাম। আমার চেহারায় তখনও হতভম্ব ভাব৷ চোখে চিরবিস্ময়। নিহিন কিছু বলল না৷ কেমন এক মোহময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ আমিও তার দিকে চেয়ে থাকলাম৷ তার চোখ দেখলাম। এই মেয়ের কাজল পরা এতো অসাধারণ কেন? আচ্ছা ও এখানে কী করছে? তাছাড়া আমাকে ও কল দিবে কেন? এই নাম্বার তো ওই মেয়েটার। নিহিনের কাছে কীভাবে এলো? নিহিন বলল,
-তো মিস্টার, মেয়ে দেখতে বলেছে বলে একেবারে দেখতেই চলে এলেন? একবারও নিষেধ করেননি?
আমি হতভম্ব হয়ে হাসলাম। বললাম,
-নিষেধ করব কেন?
-তিন চারটা বিয়ে করার প্ল্যান আছে নাকি?
-সুযোগ পেলে অবশ্যই।
-কিন্তু আমি যে সতিন চাই না? আমি এক হয়ে পুরো রাজ্যটাকে শাসন করতে চাই৷
-সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার৷
-ব্যক্তিগত তো নয়৷ সেটা আপনার আর আমার ব্যাপার৷
-আপনার আর আমার? মজা করছেন?
নিহিন খানিক চুপ থাকলো৷ বলল,
-আপনার কাছে মজা লাগছে?
-আমি অবাক হচ্ছি৷ বুঝতে পারছি না কিছু।
-শুভ, আপনি কি জানেন, আপনি অসম্ভব বোকা একজন মানুষ?
-জানি৷
-এতো বোকা হলে চলে না৷ একটু চালাক হতে হবে যে!
-এতোদিন তো চলে এলাম৷ বাকিটাও চালিয়ে নিবো৷
-আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?
-অপরিচিতদের উপর কিসের রাগ?
-অপরিচিত?
আমি মৃদু হাসলাম। কিছু বললাম না৷ নিহিন বলল,
-আজকের এই নিহিন আর পূর্বের ওই নিহিনের মাঝে কোনো পার্থক্য দেখতে পান?
-ভীষণ পার্থক্য দেখতে পাই৷ আপনাকে যেন চেনা যাচ্ছে না। কিংবা এতো উচ্ছ্বসিত নিহিনকে আমি কখনই দেখিনি৷
নিহিন ফ্যাকাসে হাসি দিলো৷ বলল,
-আমি কেমন পাগল হয়ে গেছি জানেন?
-কেন? কী হয়েছে?
-জানি না৷ কী জানি হয়ে গেল! এক তরফা একটা ব্যাথায় ডুবে ছিলাম৷ প্রাণ যায় যায় ভাব৷ ঠিক সে সময়ে কেউ একজন এলো৷ হাত বাড়িয়ে দিলো৷ আমাকে বাচাতে চাইলো৷ পথ দেখালো৷ পৃথিবীর সৌন্দর্যতা ব্যাক্ষ্যা করলো৷ বাঁচার উদ্দেশ্য শেখালো। সৃষ্টির কারণ জানালো৷ প্রেম কি বোঝালো। ব্যাথা কীভাবে সয়ে নিতে হয় শেখালো। কতো নাটক করে সে আমার সাথে দেখা করতে আসতো৷ কেমন অদ্ভুত এক মানুষ। কেমন করে মায়ায় ফেলে যেন৷ নিজের অজান্তেই আমাকে যেন নিজের করে নিলো। তিন মাস আমার আশপাশে থেকে আমার চারপাশের আবদ্ধ সকল দেয়াল ভেঙ্গে সে আমাকে মুক্ত করে দিল। মুক্ত হওয়া এই প্রাণবন্ত পাখিটিকে সে আর দেখলো না। আমাকে আবার একা করে দিলো৷ সে চলে গেল৷ এতোদিন আমার আশপাশে থেকেও সে আমাকে চিনতে পারলো না৷ বুঝতে পারলো না। তার প্রতি আমার নব্য অনুভূতি গুলোকে সে বুঝতে পারেনি। চলে গেল কেবল! একটু ব্যাথায়৷ এখন আর সে ফোন দেয় না আমাকে৷ রাতে হলে কল দিয়ে বিরক্ত করে না৷ পার্কে, মার্কেটে হঠাৎ তার সাথে আর দেখা হয় না৷ আমি হঠাৎ দেখা হওয়ার অপেক্ষা করি। অথচ আজ পর্যন্ত আমার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেনি। সব কেমন চেঞ্জ হয়ে গেল। কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেল! আমি আবার সেই অন্ধকার তলদেশে যেতে থাকলাম। আমার চারপাশে আবার দেয়াল তৈরী হতে থাকলো৷ এই দেয়াল সেই পূর্বের মানুষটার জন্যে না৷ নতুন কারো জন্যে।
আমি নিহিনের দিকে চেয়ে থাকলাম৷ আমি স্পষ্ট তার চোখে জল দেখলাম৷ তার ফার্স চেহারা হঠাৎ ভীষণ মলিন হতে দেখলাম। নিহিন কাঁদছে৷ আমার জন্যে কাঁদছে? নিহিন কেমন ধরে আসা স্বরে বলল,
-আমি যে সময়টায় আমার অতীতকে ভুলতে চেষ্টা করছিলাম সে সময়ে আপনি আমার অতীত নিয়ে আলোচনা করতেন৷ অথচ আমি সেই বিবর্ণ সময়টাকে ভুলে নতুন কিছু করতে চাচ্ছিলাম। সেই ব্যথা পাওয়ার পর এই প্রথম এমন চাওয়া৷ তাও কেবল আপনার জন্যে৷ আপনি সেটা টের পাননি৷ আমাদের আলোচনায় অতীত নিয়ে আসাটা আমার কাছে অসহ্য লাগতো৷ মুখ ফুটে বলতে পারতাম না৷ আবার সহ্য করতেও পারতাম না৷ তাই সেদিন বিরক্ত হই৷ বাজে ব্যবহার করি৷ রেগে যাই৷ আপনি আমার রেগে যাওয়ার কারণটুকু বুঝতে পারেননি৷ আমি দুঃখ নিয়ে বাসায় ফিরি৷ বাসায় এসে জানতে পারি বাবা আপনার বাবাকে ফোন দিয়ে বিয়ের ব্যাপারটা ক্যানসেল করে দিয়েছেন৷ তিনি আরো ভালো একটা পাত্র পেলেন৷ পাত্র আমার ছবি দেখে পছন্দ করেছে৷ এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না৷ জানার পর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন৷ একটা ব্যথার সাগরে ছিলাম এতো কাল। কেউ আমাকে সেখানে থেকে বাঁচিয়ে তুলে গায়েব হয়ে গেল৷ এরপর আমার ফ্যামিলি আমাকে আবার একই সাগরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমার অসম্ভব খারাপ লাগছিল সেদিন৷ কষ্ট পাচ্ছিলাম ভীষণ। তারউপর বিকেলে আপনার সাথে করা ব্যাবহারের জন্যে সুপ্ত অপরাধ বোধ আমাকে যেন কী এক অশান্ত ব্যথার সাগরে ডুবিয়ে দিলো। আমার সেই ব্যথা চোখের জল হয়ে নেমেছে। এতো কাঁদলাম, অথচ ভেতরের ব্যথা, অস্বস্তি, শূন্যতা, কিছুই কমল না৷
এরপর আর আপনার সাথে কন্টাক্ট করার সাহস হয়নি৷ কিছু বলার সুযোগও হয়নি৷ আমার তখন পাগল প্রায় অবস্থা৷ এক বিকেলে রিল্যাক্স হতে বের হই কাজিনের সাথে৷ পথে আপনার সাথে দেখা৷ একপাক্ষিক দেখা৷ আমি আপনাকে দেখছি৷ অথচ আপনি আমাকে দেখেননি৷ একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে রিক্সায় চড়ে কোথাও যাচ্ছেন৷ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম কেন জানি৷ আমার সেই বিকেলে মাটি হয়ে গেল। সে রাত অসম্ভব কান্নায় ফেরোল৷ কী এক চিনচিনে ব্যাথা! মনে হলো যে আপনাকে আমি হারিয়ে ফেলছি! আপনি আর আমার নেই!
নিহিনের চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি টুপ করে পড়ে গেল৷ আমি কিছু বলতে পারলাম না৷ কেবল হতভম্ব হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকলাম৷ নিহিন বলল,
-বাবা কথা দিয়ে ফেলেছেন৷ তাই উকিল সাহেবের সাথে আমার বাধ্য হয়ে দেখা করতে হয়৷ আমি দেখা করতে যাই৷ হায় কপাল! সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তা ভুলবার মতো না! যাকে অজান্তে ভালোবাসলাম, আমার পথের দিশারি ভেবে মনে মনে যাকে নিয়ে নিত্য কল্পনা আঁকলাম, যে সুপুরুষের জন্যে আমি সমস্তই ত্যাগ করার পণ করেছি, সে আজ একটা মেয়ের হাত ধরে তারদিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে৷ এমন চিত্র দেখার পর কে ভালো থাকবে? সে সুখে থাকবে? কোন মেয়ে রাত জেগে না কেঁদে থাকতে পারবে না?
আমি হঠাৎ বলে উঠলাম,
-এই যে ভদ্রলোক নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসা, এতো সুন্দর করে সাজগোছ করা, এমন চিত্র দেখার পর যে অন্য কারো বুকে ফাটা কান্না আসতে পারে তাও কি আপনি জানেন? তার যে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে কি আপনার লক্ষ্য আছে?
নিহিন চোখ তুলে চাইলো আমার দিকে৷ তার চোখ ভেজা৷ কাজল লেপ্টে গেছে৷ সে চোখ মুছে নিচ্ছে বারবার। কিন্তু চোখের পানি রোখাতে অসম্ভব হিমসিম খাচ্ছে মেয়েটা৷ কেমন ফোঁপাচ্ছে যেন৷ নিহিন বলল,
-আছে৷ বেশ লক্ষ্য আছে৷ লক্ষ্য আছে বলেই তো আমি খোঁজ নিলাম৷ রীতাকে জানলাম। তার থেকে জানতে পারলাম আমাকে নিয়ে আপনার অনুভূতি। আমি আরেকটু শক্ত হলাম। রীতার মাধ্যমে আপনার মায়ের সাথে দেখা করলাম। উনাকে কনভিন্স করলাম। এরপর প্ল্যান করে আপনাকে এখানে নিয়ে এলাম৷ জানেন এই পর্যন্ত আসতে আমার কতোটা কষ্ট হয়েছে? এই যে এই ফোনটা দেখছেন, এটা আমার কাজিনের। কল দেওয়া মেয়েটাই ও৷ ওর নাম অর্না৷ এই রেস্টুরেন্টটাও ওদের। আগামী এক ঘন্টার জন্যে এই রেস্টুরেন্টটা অফ রাখা হয়েছে৷ কেন হয়েছে জানেন? কারণ আজ, এখানে, এই মূহুর্তে ব্যাথার জগতে হোচট খাওয়া কোনো এক মেয়ে তার কাঙ্ক্ষিত সুপুরুষকে প্রেম নিবেদন করবে৷ তাকে জানাবে তার প্রেমের কথা৷ অনুভূতির কথা!
আমি কী করব ভেবে পেলাম না৷ কেমন জানি লাগতে থাকলো সব কিছু৷ কী আশ্চর্য! কী থেকে সব কী হয়ে গেল? আমি দেখলাম নিহিন উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে এলো! আমি আরো অবাক হলাম৷ মেয়েটা কি আমাকে প্রপোজ করবে নাকি? আমি নিজেও উঠে দাঁড়ালাম। টেবিলের টবে থাকা প্লাস্টিকের ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে নিহিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। নিহিন অবাক হলো৷ আচমকা আমাকে এভাবে দেখে সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল৷ তার চোখে জল। মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। আমি ফুলের তোড়াটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-যে দায়িত্বটা আমার, সেটা আমাকে করতে দিন৷ শুনুন মিস নিহিন, সেই প্রথম দিন থেকে, যখন আপনাকে দেখেছি সবে, তখন থেকে, মনের ভেতর কেবল একটা জিনিসই কাজ করছিল, আপনাকে কীভাবে মুগ্ধ করি৷ মায়ায় ফেলি৷ আপনাকে কীভাবে নিজের করে পাই! আমার চাওয়াটা অন্যায় কিছু নয়৷ আপনাকে যে-ই প্রথমে দেখবে,
সেই আপনার মায়ায় হারাবে৷ ডুবে যাবে৷ আমি ডুবে গেলাম। কী এক অসম্ভব মায়া করে ফেললেন আপনি আমাকে! বলে বোঝার মতো না৷ আপনার জন্যে আমার কাছে কোনো বিশেষণ নেই৷ যেগুলো আছে সেগুলো যেন আপনার প্রসংশা সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করতে পারবে না৷ আপনি যেমনই আছেন, তেমনই থাকুন৷ একটু রাগী, মনের কথা সহজে প্রকাশ না করা, অভীমানি, কাজল পরা লম্বাকেশি এমন এক মেয়েকে আমি খুঁজেছি এবং আমি পেয়েছি তাকে৷ আপনিই সেই৷ আপনিই আমার সেই কল্প কন্যা। আমার সেই স্বপ্নবালিকা৷ নিহিন, আমি আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি৷ কতোটা ভালোবাসি তা জানি না৷ তবে এর পরিমানটা গননা করে শেষ করা যাবে না৷ আপনি কি আমার এই তীব্র ভালোবাসাটুকু গ্রহণ করবেন? আমাকে কী একটু ভালোবাসবেন? আপনার ভালোবাসা পাবার ভীষণ লোভ আমার। আপনি কি আমাকে একটু ভালোবাসবেন নিহিন?
নিহিন কিছু বলল না। সে আমার হাত টেনে আমাকে দাঁড় করালো। এরপর ঝাপটে ধরলো আমায়৷ বুকের কাছে মাথা রেখে ভীষণ কাঁদতে থাকলো সে৷ বলল,
-শুভ, আপনি আমাকে সুযোগ দিন আপনাকে ভালোবাসার। কথা দিচ্ছি কখনই কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিব না আপনাকে৷ কারণ আপনি জানেনও না আমি আপনাকে কতোটা ভালোবেসে ফেলেছি। কতোটা আপনার মোহমায়ায় বাধা পড়েছি। শুভ আমি আপনাকে ভালোবাসি৷ ভীষণরকম ভালোবাসি৷
আমি তাকে বুকের কাছে মিশিয়ে নিলাম৷ কিছু বললাম না৷ কেবল চুপচাপ তার আলিঙ্গনকে সমর্থন করে গেলাম। তার কান্নায় সুর মেলালাম। ছেলে হয়েও সে সময়ে নিজের চোখের জল রোখাতে পারলাম না৷ প্রিয় মানুষকে বুকের কাছে আগলে রাখার যে সুখ, সে সুখে চোখ দিয়ে যে জল গড়ায়, সে জল গড়াতে বাধা দেওয়াটা অন্যায়৷ ভীষণ অন্যায়৷
.
গল্পঃ আপনাকে ভালোবাসি ভীষণ।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়৷


সকল গল্পের লিংক।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url