গল্পঃ আমার ও রুমার গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ । Tasfis Blog

গল্পঃ আমার ও রুমার গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ । Tasfis Blog


গল্পঃ আমার ও রুমার গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ । Tasfis Blog

গল্পঃ আমার ও রুমার গল্প
লেখক - তাসফি আহমেদ


রুমা চলে যাওয়ার পর আমি বেশ একাকিত্ব অনুভব করতে থাকি৷ মেয়েটা যে আমার জন্যে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এতোদিনে। অথচ তার অবর্তমান ঠিক আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তার জায়গা কতোখানি।

বাহিরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে৷ আমি শুয়ে আছি। অনেকক্ষন থেকে ঘুমানোর চেষ্টা করছি৷ কাজ হচ্ছে না৷ চোখে ঘুম ধরে না৷ কী এক অদ্ভুত পীড়া! ঘুমের আবার কী হলো? কেন এমন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আমার থেকে? সবই কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে৷ আমি ঠিক বদলে যাচ্ছি যেন। আচ্ছা একটা মানুষের অনুপস্থিত কি অন্য মানুষকে বদলে দেয়? এতো বেশি? এতো দ্রুত?
শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে খারাপ লাগছে না৷ কি জানি, এসব ভাবছি বলেই হয়তো ঘুম আসছে না৷ আচ্ছা এক বিকেল না ঘুমিয়ে পার করে দেওয়াই যায়৷ আজ না হয় নিয়মের একটু বিচ্ছিন্নতা ঘটুক৷ একটু ভাবা যাক গত হওয়া বিষয়াদি নিয়ে৷ কিন্তু বিষয়টা কী হতে পারে? রুমা? নাদিয়া ফেরদৌসী রুমা কি আজকের চিন্তা জগতের প্রধান অতিথি হতে পারেন? পারেন হয়তো!
রুমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বেশিদিন হয়নি৷ আড়াই মাস হবে হয়তো৷ এই দেড় মাস আমার সামান্যও অনুভব হয়নি মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে৷ বা তার মাঝে আমার প্রতি কোনো আগ্রহ আছে৷ আমার কেবল মনে হতো এই মেয়েটি জোর করে আমার সাথে থাকছে৷ তার এখানে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই৷
আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়৷ আমাদের পরিচয় বলতে দেখতে যাওয়ার পর ওর সাথে আমার দশ মিনিটের একটি নীরব আলোচনা হয়৷ এরচে বেশি কিছু না৷ ওই দশ মিনিটের আলোচনায় আমি কেবল তার রুমটাই দেখে গেলাম। নিখুঁত ভাবে সাজানো৷ এতো সুসজ্জিত লাগছিল না! আমার খুব ইচ্ছে জাগলো, আমি মেয়েটাকে বলি, আপনার রুমটা ঠিক আপনার মতোই অনিন্দ্য৷ গোছালো৷ কিন্তু সে সময়ে আমি কিছুই বলতে পারিনি৷ কারণ এর পূর্বে করা কিছু প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি। সে নিতান্তই নীরব ছিল৷ আমার আর বুঝার বাকি রইলো না যে মেয়েটা আমার সাথে কোনো কথাই বলবে না৷ জাস্ট ফর্মালিটির জন্যে এখানে বসে আছে৷
আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। পুরো সময়টা তার রুমটা দেখায় কাটিয়ে দিলাম৷ আর ফাঁকফোকড়ে তার শক্ত, মলিন মুখটা দেখলাম কয়েকবার৷ এছাড়া আর কিছু না৷ তার রুম দেখেই আমি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলাম তাকে৷ তার পড়ার টেবিলে বই৷ দেখে মনে হচ্ছে প্রতিদিন টেবিলে বসা হয়৷ এর মানে সে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী। টেবিলটা বেশ গোছালো। পাশে একটা বুকশেলফ। ওটাতে অনেক বই রাখা৷ নবম-দশম শ্রেনীর বই গুলোও আছে৷ দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে বই গুলো৷ আমি মনে মনে মেয়েটাকে যত্নশীল ভেবে নিলাম৷ ড্রেসিং-টেবিলটায় নানান সাজ প্রসাধনী। মেয়েটা কি প্রায়ই সেজেগুজে বের হয়? কেমন জানি লাগে ওকে! দেখাতে ইচ্ছে হলো! একটা ওয়ারড্রবও আছে৷ আর বিশাল সুসজ্জিত খাট৷ বিছানার ওপাশে একটা শেলফ আছে৷ কাঠের শেলফ। ওটাতে কিছু উপন্যাসও আছে৷ অধিকাংশ উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদের৷ মেয়েটার কি হুমায়ূন পছন্দ? অধিকাংশ বই পড়ুয়া মেয়েরই হুমায়ূন পছন্দ৷ একটা না একটা বই পছন্দই৷
মেয়েটার চোখের কোণে চাপা একটা রাগ অনুভব করতে পারলাম আমি৷ চেহারাটা বেশ কোমল। খুব ফর্সা না৷ তবে চেহারার গঠন অসম্ভব মায়াবী৷ কী তীক্ষ্ণ চোখ! এই চোখের প্রেমে জানি কতো পুরুষ মজেছে!
মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়৷ বিয়ের পূর্বে আমি মাকে বারবার বলেছি তিনি যাতে নিশ্চিত হয়ে নেন যে রুমা অবশ্যই বিয়ের জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত৷ তার মত থাকাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মা প্রতিবারেই বললেন মেয়ে রাজি বলেই তো কথা আগাচ্ছি৷ আমার মন মানলো না৷ আমি তার নাম্বার নিয়ে কল দিয়েছিলাম! আমাদের তিন মিনিট বাইশ সেকেন্ড কথা হয়৷ আমি তাকে জিজ্ঞেস করি তার মতামত আছে কি না৷ সে স্পষ্টই জানায় আছে৷
অথচ বাসর রাতে আমি যখন তার সাথে কথা বলতে গেলাম, সে আমার একটা কথারও জবাব দেয়নি৷ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো কেবল৷ আমি বেশ আশাহত হলাম৷ যে পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে আমি তাকে বিয়ে করেছি, তার মতামত আছে জেনে আমি যে কী ভীষণ খুশি হয়েছি, সবটাই মূহুর্তে কেমন ফিকে হয়ে গেল৷ অনুভূতি ফিকে হয়ে গেলে যে কেমন যন্ত্রণা করে, তা আমি সেদিনই টের পেলাম।
পরের সময় গুলো আমি কেবল মেয়েটার মন জয়ে লেগে থাকলাম। আমার ধারণা ছিল রুমাকে আমি আমার প্রেমে ফেলতে পারব৷ তাকে আমি ঠিকই আমার করে নিতে পারব। অথচ আমার ধারণা ভুল ছিল৷ আমি কিছুই করতে পারিনি৷ তার মাঝে সামান্য প্রভাবটুকুও ফেলতে পারিনি।
তার এমন আচরণের কারণ খোঁজার চেষ্টা করে আমি দুইটা কারণ খুঁজে পেয়েছি৷ প্রথম কারণটা সত্য হলে আমি এতোদিনে মেয়েটার মন জয় করতে পারতাম। আমি তার মন জয় করতে পারিনি কারণ আমার কাছে দ্বিতীয় কারণটা বেশ পাকাপোক্ত মনে হয়েছে৷
প্রথম কারণটা এমন যে মেয়েটাকে জোর পূর্বক বিয়ে দেওয়ায় সে এমন আচরণ করছে৷ এমনকি মেয়েটা বিয়ের পর এখন পর্যন্ত তার বাবার বাড়ি কেবল একবার গিয়েছে৷ তাও একদিনের জন্যে৷ মেয়ে যখন তার স্বামীকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি যায়, সেখানে অন্তত সে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে৷ অথচ মেয়েটি পরদিন সকালেই আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলল,
-উঠুন৷ আমরা চলে যাব৷
আমি বেশ কিছু সময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরপর উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম৷ নাস্তার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। রুমা বেশ সাবলীল ভাবেই খাচ্ছিল। যেন কিছুই হয়নি৷ কিন্তু ওর বাবা মাকে দেখে মনে হলো আমি ঘুম থেকে ওঠার আগে বাসায় ঝড় বয়ে গেছে। ফেরার সময় রুমার বাবা আমার হাত চেপে ধরলেন৷ ভদ্রলোকের চোখে পানি৷ ভেজা স্বরে বললেন, 'মেয়েটা বেশ জেদী৷ একটু খেয়াল রেখো।'
ওর জেদের কারণেই ও আমার সাথে এমন করছে সেটা আমার কিছু সময়ের জন্যে মনে হয়েছিল৷ কিন্তু যখন দ্বিতীয় কারণ অর্থ্যাৎ তার প্রেমিকের খবর জানতে পারলাম তখন আমার কাছে প্রথম কারণটাকে কোনো কারণই মনে হয়নি৷ লোকমুখে আমি জানতে পারি যে রুমার সাথে তার ফুফাতো ভাই অর্নবের সম্পর্ক ছিল। ছিল কিংবা তাদের মাঝে এমন কিছু আছে! কিন্তু আমার কারণে তাদের মধ্যকার দূরত্বটা বেড়ে যায়। যার কারণে রুমা তার বাবার উপর রেগে আছে এবং তার সেই রাগ, সে আমার উপর ঝাড়ছে৷
তার প্রেমিকের সংবাদ যখন জানতে পারি তখন আমি বেশ আশাহত হই৷ দুঃখ পাই! আমার তখন নিজের প্রেমিক হবার স্বপ্ন দমে যায়৷ আমি তখন ভয়ে থাকি। জীবনে যে শব্দটাকে আমি ভীষণ ভয় করি, সেটার৷ ডিভোর্স। রুমা কি তাই করবে?
বিয়ের পর থেকেই আমি রুমাকে মুগ্ধ করার মিশনে লেগে পড়েছিলাম। কোনদিন তাকে নিয়ে বারান্দায় বসি৷ কফির সাথে নিজেরদেরকে নিয়ে আলোচনা করি৷ নিজেদের বলতে নিজেরই বলা যায়৷ ও কেবল হু, হা করতো৷ কোনো কিছুই বলতো না৷ আমি কেবল বকবক করে যেতাম। কোনদিন ছাদে হাঁটতে গেছি তাকে নিয়ে৷ হেঁটে হেঁটে কথা বলতাম৷ সে যেন বেশ বিরক্ত হতো৷ আমার কেবল এটা মনে হতো আমি কাউকে বিরক্ত করছি৷ জোর করছি। যেমন একটা মানুষ ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে৷ আমি তাকে ডেকে তোলবার চেষ্টা করছি৷ এমন মানুষকে কি জাগানো যায়?
আমি তাকে বই উপহার দিয়েছি৷ একটা বই এবং ছোট্ট একটা চিরকুট। চিরকুটে তাকে নিয়ে আমার একটা কবিতা।
"পাহাড় চেনো?
সটান থাকে।
কষ্ট সওয়ার ক্ষমতা রাখে৷
যেমন রাখে প্রেমিক মানুষ।
প্রেমিক চেনো?"
"কপালে যার মুগ্ধ মায়া,
আমি তাকে ভালোবেসেছি।
আমি ভালোবেসেছি
তার চোখের পাড়ের মায়াকে৷
চোখের এক সমুদ্র ব্যথাকে,
তীব্র রাগ যেখানে জমে থাকে,
আমি তাকে ভালোবেসেছি৷
ভালোবেসে তার ব্যথাকে নিজের করছি।
আমি ভালোবেসেছি তার হাসিকে।
যে হাসির মাঝে লুকিয়ে থাকে,
অজস্র মায়া, প্রেম এবং মুগ্ধতা৷
আমি এই মুগ্ধতাকে ভালোবেসেছি৷
ভালোবেসেছি এই মুগ্ধ মানবীকে৷"
প্রতিটা বইয়ের সাথেই আমি এমন দু'একটা কবিতা লিখে পাঠাতাম। মেয়েটা কখনো সেগুলো খুলে দেখতো! আবার কখনো না৷ যখনই খুলে দেখতো, আমার মন খারাপ হয়ে যেত৷ বুকে ব্যথা লাগতো৷ কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা৷ আমি দেখতাম আমার বইটা টেবিলের উপর বেশ অবহেলিত হয়ে পড়েছি৷ আর চিরকুটটা পড়ে আছে ময়লার ঝুড়িতে।
আমি তখন বেশ হতাশ হতাম! আমার খারাপ লাগতো৷ মনে হতো আমি এমন কেন? একটু কি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না আমি? সামান্যও না?
আমাদের বিয়ের দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে আমি আমার সকল প্রচেষ্টাকে বন্ধ করে দেই৷ আমার তখন মনে হতে থাকে এসবের আর প্রয়োজন নেই। আমার জীবনে রুমার কোনো অবস্থান নেই৷ সামান্যও না৷ তবে সেই ধারণাটা ভুল৷ আমার এমন ভাবা উচিৎ ছিল যে রুমার জীবনে আমার কোনো প্রভাব নেই৷ তার জন্যে আমি কেউ না৷ নাথিং।
সেদিন কলেজ থেকে ফিরে রুমে আসি। ব্যাগ রেখে বিছানার কাছে আসি৷ চোখ যায় টেবিলের উপর। সেখানে একটা ডায়েরি দেখি৷ কার ডায়েরি? কৌতূহল বসত এগিয়ে যাই৷ ওটা তখন খোলা ছিল। পাশে একটা কলম। কেউ মনে হয় লিখতে বসেছে। কে আর লিখবে? রুমা ছাড়া তেমন কেউ নেই আর৷ বুঝতে দেরি হলো না যে ওটা রুমারই লেখা৷ চোখ গেল খোলা পেজটার উপর। সেখানে সুন্দর করে লেখা,
”লোকটাকে আমার একদমই সহ্য হয় না৷ বিরক্ত লাগে৷ তারউপর কিসব কান্ড করে৷ উপহার দেয়৷ সাথে চিরকুট। চিরকুটে অন্য লেখকের লেখা৷ সে আবার নিজেকে একজন লেখক দাবি করে৷ জিজ্ঞেস করলে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে? লেখা তো দূরের ব্যাপার৷ এসব কেন করে? আমি ঠিকই টের পাচ্ছি কেন করছে এসব। বিয়ের এতোদিন হয়ে গেল৷ আমাকে এখনো স্পর্শ করতে পারেনি তো! তাই..."
আমি আর পড়িনি৷ চোখ সরিয়ে নিলাম। বারান্দায় কারো গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ এগিয়ে গিয়ে শুনলাম রুমা কারো সাথে কথা বলছে,
-অর্নব ভাই, আপনাকে আমি ক্ষমা করব না৷ কক্ষনোই না৷ আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার৷
অভিমানী স্বর৷ মেয়েটা কি অর্নবকে খুব মিস করছে?
আমি জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিলাম। রুমা তখন রুমে ঢুকলো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ ডায়েরির কথা মনে হতেই তেড়ে গেল ওইদিকে৷ আমি জামাকাপড় গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে এলাম৷ নিজের তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। আমার তখন মনে হচ্ছিল বাথরুমে ঢুকলেই বাঁচি আমি। এভাবে ওর মুখোমুখি হতে পারবো না৷ ওর চোখে চোখ রাখতে পারব না৷ আমার মনে হচ্ছিল ওর চোখে চোখ রাখলেই আমার চোখে পানি জমে যাবে৷ আমি কান্না শুরু করে দিব৷ আমার তখন খারাপ লাগছিল৷ অসম্ভব খারাপ লাগছিল৷
রুমার সাথে এরপর থেকে আমার কথা বলাটা কমে আসে৷ খাবার টেবিলে বসলে যা টুকটাক কথা হয়৷ তাও মাকে দেখানোর জন্যে৷ রুমে এলে আমি ওর সাথে কথাই বলি না। জানি না৷ কেন জানি ইচ্ছেই হয় না৷ এখন বেশিরভাগ সময় আমি আমার স্টাডি রুমেই কাটাই। ধীরে ধীরে আমার নিজস্ব স্টাডি রুমটাই আমার অসম্ভব প্রিয় জায়গা হয়ে দাঁড়ায়৷ সেই সময়ে রুমার মাঝে খানিক পরিবর্তন অবশ্য লক্ষ্য করেছিলাম৷ আমার সাথে কথা বলতে চাওয়ার সামান্য আকাঙ্ক্ষা। তবে আমার অভিমানের কাছে সেই আকাঙ্ক্ষাটুকু নেহাত ফিকেই ছিল।
আমি একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলি। ভোরে ঘুম থেকে উঠি। দ্রুত নাস্তা সারি৷ আমি যে সময়ে উঠি সে সময়ে রুমা ঘুমে থাকে। আমি একা একা নাস্তা করি৷ মা নাস্তা বানিয়ে দেন৷ রুমার সাথে আমার নাস্তা খাওয়াটা খুব একটা হয় না৷ ছুটির দিনে হয়৷ তবে সেটা খুবই সামান্য৷ নাস্তা করে আমি কলেজে যাই৷ পেশায় আমি একজন শিক্ষিক৷ একটি বেসরকারি কলেজে পাঠদান করি৷ বাংলা পড়াই৷ সাহিত্য নিয়ে আমার টুকটাক আগ্রহ আছে৷ এই ব্যাপারটা অনেকেই জানে না৷ রুমাও না৷ কলেজ শেষ হলে বাসায় ফিরি। ফ্রেশ হয়ে সামান্য নাস্তা করি৷ একটু বিশ্রাম নেই! সন্ধ্যা থেকে আমার সময়টা বই পড়ে কাটে। এরপর রাতের খাবার খেয়ে দ্রুত ঘুম৷ এভাবেই চলতে থাকে৷
আমার এমন পরিবর্তনে রুমার মাঝে যে বিস্তর প্রভাব ফেলবে তা আমি প্রত্যাশা করিনি, তবে চোখে লাগার মতো সামান্য কোনো প্রভাব প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি৷ আমার প্রত্যাশা ধীরে ধীরে কমে আসে৷ আমার মেজাজ খারাপ হতে থাকে৷ রাগ জমে ভেতরে ভীষণ। তবে সেটা কার উপর বুঝতে পারি না৷ তাই বেশ চুপ থাকি! চুপ থাকলেই ঝামেলা কম হয়৷
এভাবে ক'টা দিন কেটে যায়৷ লাস্ট দিন শুক্রবার ছিল৷ আমি নাস্তার টেবিলে বসলাম। দেরি হয়েছে উঠতে৷ রুমা আগেই উঠেছে৷ মায়ের সাথে রান্না ঘরে আছে৷ আমি নাস্তার টেবিলে বসে থাকলাম৷ নাস্তা দেওয়ার কথা৷ দিচ্ছে না৷ মায়ের সাথে কি নিয়ে জানি তর্ক করছে ও৷ মা ওকে বুঝাচ্ছেন কিছু৷ কিন্তু ও সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না৷ নিজের কথাটা বার বার বলেই যাচ্ছে৷ আমি ওদিকে তেমন খেয়াল দিলাম না৷ চুপচাপ বসে থাকলাম। ঘুমের তেজ এখনো যায়নু শরীর থেকে৷ এমন সময় আমি রুমাকে জোরে কথা বলতে শুনলাম। শেষ কথাটা ও এভাবে বলল,
-মা আপনি চুপ করুন তো! কী অযথা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছেন? কী জানেন আপনি? আপনাদের সময়টা আপনারা পার করে আসছেন৷ এখন আর সে সময়টা নেই! এতোটা সহজ হলে চলে না৷ এই যুগটা আর আগের যুগের মতো নেই! আমি অতোশত মানতে পারব না৷ আমি যা বলেছি তাই করবো৷ ব্যস!
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে কিচেনের কাছে গেলাম৷ দেখলাম মা আর রুমা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি রুমার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললাম যে,
-রুমা তুমি মায়ের সাথে চেঁচিয়ে কথা বলেছো?
রুমা আমার দিকে কঠিন চোখে তাকালো৷ কিছু বলল না৷ আমি এবার একটু জোরেই বললাম,
-জবাব দাও রুমা? তোমার সাহস কী করে হয় আমার মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বলার? কোন সাহসে তুমি চেঁচালে? আদব কায়দা কিছু শেখোনি তুমি? এতো বড় হয়েও বেয়াদবি করতে হবে তোমাকে? তুমি জানো না কীভাবে বড়দের সাথে কথা বলতে হয়?
কথা গুলো এমন জোরে বললাম যে রুমা খানিক কাঁপে উঠল। আমার মা আমার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে থাকলো। যেন বেশ অবাক হলেন তিনি। খানিক সময় কিছুটা নিরবতায় কাটলো! আমি বললাম,
-এই ঘরে কোনো বেয়াদবের জায়গা নেই৷ থাকলে ভালো হয়ে থাকো৷ আদব কায়দা শিখে আসো৷
এই বলে আমি চলে এলাম সেখান থেকে৷ মানিব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম বাইরে৷ যখন বাসায় ফিরে আসি তখন দেখি মা সোফায় বসে আছেন৷ চিন্তিত চেহারা৷ আমাকে দেখতেই উঠে এলেন। বললেন,
-কি দরকার ছিল ওর সাথে এভাবে কথা বলার? মেয়েটা এখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরলো। কাজটা কি তুই ঠিক করলি বল?
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ এরপর নিজের রুমে চলে এলাম!
"ঠক ঠক ঠক"
আমি খানিক চমকে উঠলাম। মনোজগতে বিচ্ছিন্নতা ঘটলও। বিছানা থেকে মাথা তুলে তাকালাম। দরজার কাছে মা দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি বললাম,
-ভেতরে এসো মা৷
মা ভেতরে এসে বসলেন। আমার মাথার কাছে৷ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন৷ বললেন,
-যা না বাবা৷ তুমি গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷ যা না একটু।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম৷ বললাম,
-আজ তোমার কী হলো বলো তো? সারাটা দিন আজ একই কথা বলে গেলে। ওকে যায়ে নিয়ে আসতে৷ কেন মা? তোমার এতো দরদ কেন? ওই মেয়েটা তোমার সাথে বেয়াদবি করে গেছে৷ সেই তুমিই কি না তার হয়ে সুপারিশ করছো?
-এই বাসাতে আমার কথা বলার কেউ নেই৷ ওই একটা মেয়েটা-ই ছিল৷ ওর সাথে আমার কতো কথা হতো৷ আমরা নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমার এতো ভালো লাগতো! যা না একটু। নিয়ে আয় ওকে৷ আমার এভাবে একা একা ভালো লাগছে না৷
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-আশ্চর্য ব্যাপার তো৷ আমি কেন যাব? ও নিজেই আসবে৷ নিজে গিয়েছে তো ফের নিজেই ফিরে আসবে৷ যাও তুমি৷ বিশ্রাম করো৷ তোমার শরীরটা এম্নিতেই ভালো না৷ যাও। কোথাকার কোন মেয়ে! তোমার সাথে বেয়াদবি করে গেল। তুমি সেটা নিয়ে ভাবছো না৷ উলটো বসে বসে তাকে মিস করছো৷ কেমন মানুষ তুমি হ্যাঁ?
মা আমার দিকে কঠিন ভাবে তাকিয়ে থাকলেন৷ বললেন,
-কাল সকালে যদি রুমাকে আমি বাসায় না দেখি তবে দেখিস, তোর খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দিব৷ দেখিস তুমি।
আমি বোকার মতো মায়ের দিকে চেয়ে থাকলাম৷ আশ্চর্য ব্যাপার তো! এসব কি হচ্ছে? মা দেখি উলটো আমার উপরই রাগ ঝাড়ছেন?
.
সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ টং দোকানে বসে এক কাপ চা পান করলাম৷ এরপর একটা রিক্সা নিয়ে রুমাদের বাসার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লাম। মাথায় তখন রাজ্যের চিন্তা। ওখানে গিয়ে কী বলব আমি? কী করব? ওর সাথে কথা বলব কীভাবে? কীভাবে চোখে চোখ রাখব? আচ্ছা আমি যাচ্ছিই বা কেন? না গেলে কী হবে? আমি কেন যাব? ও আসবে। ও নিজে গিয়েছে তো নিজেই আসবে৷ আমাকে কেন গিয়ে নিয়ে আসতে হবে? আমার কিসের ঠেকা? এদিকে আবার মায়ের পিড়া! আমার মা'টা এমন করছে কেন? কোথায় তার রাগ করার কথা৷ অথচ তিনি উলটো রুমার চিন্তায় অস্থির৷ আজ দু'দিন হলো! আমাকে জ্বালিয়ে মারছে৷ আজ তো একেবারে থ্রেট দিয়ে দিলো৷
তবে আমি যে সেই ভয়ে যাচ্ছি ব্যাপারটা কিন্তু তেমন না৷ আমি কেন জানি যাচ্ছি আমি জানি না৷ আসলেই জানি না৷ আমার কেবল মনে হচ্ছে আমার বুকের ভেতরটা কাঁপছে৷ কেমন শূন্যতা বিরাজ করছে সেখানে৷ আমার আসলে ভালো লাগছে না৷ কেন ভালো লাগছে না? আমি জানি না সেটা৷ তবে আমার ভালো লাগছে না৷ আসলেই না৷
রিক্সাটা এসে থামলো রুমাদের বাসার সামনে৷ আমি নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম গেটের কাছে৷ এরপর বিসমিল্লাহ পড়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সিড়ি বেয়ে তিন তলায় কখন উঠে গেলাম টেরই পেলাম না৷
এই মূহুর্তে রুমাদের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ রোবটের মতোন হয়ে আছি৷ কেমন জানি গা কাঁপছে আমার৷ বুকের বা পাশে হাত রাখতেই আমার হৃদপিণ্ডের দারুণ ধপধপানি অনুভব করলাম। আমার অস্থির লাগছে৷ শ্বাস কেমন ভারী হয়ে আসছে৷ কেমন জানি লাগছি৷ মনে হচ্ছে বহুল প্রতিক্ষিত কিছু দেখব আজ৷ বহুল আকাঙ্ক্ষিত কিছু।
আমি আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে৷ এরপর কলিং বেল বাজিয়ে দিলাম এবং আশ্চর্যজনক ভাবে বেল বাজানোর কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দরজাটা খুলে গেল৷ আমি কেবল অবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম। দরজা খুলে রুমা দাঁড়িয়ে থাকলো। তার পরনে নতুন শাড়ি৷ বিয়ের রাতে আমি গিফট করেছিলাম। মুখে যত্ন করে দেওয়া মেকাপ প্রসাদনি৷ কপালে টিপ। চোখের পাড়ে কেমন মায়াবী কাজল। ঠোঁটের উপল হালকা করে গোলাপি রঙের লিপস্টিপ। আমি ঠায় তাকিয়ে থাকলাম। নিজেকে হতবিহ্বল মনে হলো। মনে হলো যেন তব্দা খেয়ে বসে আছি৷ কতো রাগ অভিমান নিয়ে এখানে এখন দেখি সেইসব কোথায় চলে গেল৷ উবে গেল৷ সে সব ছাপিয়ে এখন কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে৷ রুমা হালকা করে গলা খাকি দিয়ে বলল,
-ভেতরে আসুন৷
আমি কোনো মতে চোখ নামিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম। রুমা দরজা আঁটকে দিল। এগিয়ে এসে বলল বসুন সোফায়৷ আমি নাস্তা দিচ্ছি৷ আমি বললাম,
-তার প্রয়োজন নেই। বাবা কোথায়?
রুমা কিছু বলল না৷ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর মৃদু হেসে বলল,
-বাসায় কেউ নেই৷ আমি একা।
আমার ভ্রু কুচকে এলো। আশ্চর্য ব্যাপার। বাসায় কেউ নেই মানে? এসব কী? কেউ কেন থাকবে না? আমার তখনই মাথাটা কেমন ঝাকড়ে উঠল৷ আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। সব কি ঠিক আছে এখানে?।
রুমা গেল আর এলো৷ তার হাতে নাস্তার ট্রে৷ ফলফলাদি, ফুডিং, কেক, নুডুলস, রোল, পিঠা ইত্যাদি। ও দুইটা ট্রে এনে রাখল আমার সামনে৷ টি-টেবিলের উপর রাখলো। এরপর পাশের সোফায় বসে পড়লো৷ আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি৷ আশ্চর্য ব্যাপার। এসবই আমার পছন্দের খাবার৷ এগুলো কতোক্ষন কে তৈরী করলো? রুমা কি জানতো আমি আসব? জানলেও সেটা কীভাবে?
আমার চেহারায় চিন্তার ভাঁজ৷ সে সময়ে রুমা বলল,
-একটু এদিকে দেখুন তো৷ বলুন না আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি অন্য দিকে তাকালাম। বললাম,
-আমি আপনাকে দেখার জন্যে আসিনি৷ মা বললেন আমি যেন আপনাকে নিয়ে যাই৷ তা না হলে তিনি আমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিবেন৷ তাই এসেছি।
-আচ্ছা? তাহলে নিজের খাওয়া দাওয়া যাতে বন্ধ না হয়, সে জন্যেই কি এসেছেন?
-ঠিক সেটাও না৷
-তাহলে কী?
-কিছু না৷
-এই আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?
-জানি না৷
-জানি না মানে? আশ্চর্য ব্যাপার তো! জানেন না কেন?
আমি চুপ করে থাকলাম। কিছু বললাম না৷ রুমা বলল,
-আপনি আমাকে কতোদিন একটু ভালো করে দেখেন না জানেন?
আমি চুপ থাকলাম। ও বলল,
-আজ তেইশ দিন হতে চলেছে৷ আপনি আমাকে ইগ্নোর করে যাচ্ছেন৷ কেন বলুন তো? কেন এমন করে যাচ্ছেন? আমাকে এভয়েড করছেন৷ গিফট দিচ্ছেন না৷ চিরকুট দিচ্ছেন না৷ আবার সেদিন আমার উপর চিল্লালেন৷ জানেন আমার কতো খারাপ লাগসে? আমি বাসায় এসে সারাদিন কান্না করেছি৷
-আমার ইগ্নোরও কি আপনার মাঝে কোনো প্রভাব ফেলে?
-ফেলাটা কি স্বাভাবিক না?
-জি না৷ আপনি অন্যের মানুষ৷ তারউপর আমাকে অপছন্দ করেন৷ তাই এসবে আপনার প্রভাব না পড়াই স্বাভাবিক।
-আপনি ওইদিন আমার ডায়েরিটা পড়েছেন তাই না?
আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম৷ রুমাও কিছুটা সময় চুপ করে থাকলো। এরপর বলল,
-ওই লেখা গুলো এখন আর নেই৷ আমি ওই ডায়েরিটা জ্বালিয়ে দিয়েছি। ওটা বিয়ের প্রথম প্রথম সময়ে লেখা৷ আমার আপনাকে তখন পছন্দ ছিল না৷ আমি রেগে ছিলাম। আমার ফ্যামিলির উপর। আমার বাবার উপর৷ তাই তখন রাগের বসে কি না কি লিখেছি। যেদিন আপনি ওই লেখা গুলো দেখলেন, সেদিন আমি ওগুলো জ্বালানোর জন্যেই খুলেছিলাম। পৃষ্ঠাটা ছিড়তে যাব তখনই অর্নব ভাইয়ের কল আসে৷ তখন তার সাথে কথা বলতে যাই আমি। এর ফাঁকে আপনি দেখে ফেলেন লেখা গুলো৷ আম্র আর অর্নব ভাইয়ের কথাও শুনেছেন হয়তো৷ শুনুন, ছোট্ট একটা গল্প আছে৷ যেটা আপনাকে বিয়ের আগেই শোনানো উচিৎ ছিল। কিন্তু আমার বাবা মায়ের কঠিন বিধিনিষেধের কারণে আমি কিছুই বলতে পারিনি৷ আমি প্রেশারে ছিলাম৷ অর্নব ভাইয়ের জন্যে৷ উনি আমার কাজিন৷ আমি এই মানুষটাকে একদমই পছন্দ করি না৷ কিন্তু উনি সেই প্রথম থেকেই আমাকে নানান ভাবে বিরক্ত করে আসছেন৷ প্রেমের ফেলার নানান ফন্দি এঁটেছেন৷ তার ফন্দি গুলো ছিল একদম তার মতোই৷ ফালতু টাইপের৷ আমি ওই মানুষটাকে দুই চোখে দেখতে পারতাম না৷ অথচ দেখুন, উনিই সবার কাছে বলে বেড়ালেন, আমার সাথে উনার অনেক দিনের সম্পর্ক৷ আমরা প্রেম করছি। এখানে সেখানে যাচ্ছি৷ এমনকি তিনি এও বলে বেড়ালেন যে আমরা ট্রেনে করে দূরে দূরে ঘুরতে যেতাম৷ কেবিন ভাড়া করে ঘুরা হতো আমাদের৷

কথাটা বলে থামলো রুমা৷ চুপ করে গেল৷ আমি এবার তাকালাম মেয়েটার দিকে৷ ও মাথা নিচু করে আছে৷ কাঁদছে৷ তার চোখে জল। আমার বুকটা কেঁপে উঠলো৷ হার্টবিট বেড়ে গেল৷ ও আবার ভেজা স্বরে বলতে থাকলো,
-একটা মেয়ের জন্যে এসব কতোটা দৃষ্টিকটু সেটা আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন বলে আশা করি৷ আমার বাবা মা এসবের জন্যে কোনো একশেন নিলেন না৷ উলটো আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এবং কিছু না বলেই৷ সব কিছু এতো দ্রুতই হলো যে আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷ সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল৷ তাই বিয়ের পরবর্তী সময়টা আপনার সাথে ভালোভাবে কাটেনি আমার৷ সত্যি বলতে আমি সেই অবস্থানে ছিলামই না৷ আপনার গিফট দেওয়া, চিরকুট দেওয়া এসব প্রথম প্রথম অসহ্য লাগত। কিন্তু পরে আর লাগেনি৷ আপনার কবিতা গুলো আমার মন জয় করতে থাকবে৷ আমার ভাল লাগতে থাকে৷ আমার খুবই পছন্দের একজন লেখকের লেখার হাতের আভা পাই৷ যে লেখকের বই আমার শেল্ফে এখনো আছে৷ এখনো যার বই আমার মন ভালো করার ঔষধ হিসেবে কাজ করে৷ আপনার কবিতা গুলো বেশ পরিচিত মনে হতে থাকে। তাই একদিন আপনার স্টাডি রুমে ঢুকে পড়ি৷ আপনার পার্মিশন না নিয়েই৷ ওখানেই আমি দেখি গাদাগাদা বই৷ বইয়ের আড়ালে সেই প্রিয় লেখকের বই। সব গুলোই বইয়ের কপি দেখি৷ নাম দেখি। ছদ্মনাম। নিরন্তন৷ কি একটা অদ্ভুত নাম৷ তারপরও সেটা ছদ্মনাম। খুঁজলেও পাওয়া যায় না লেখককে। আবার তিনি বই মেলাতেও আসেন না৷ আড়ালে থাকেন৷ থাকতে পছন্দ করেন মনে হয়৷ আপনার স্টাডি রুমে নিরন্তন সাহেবের বই দেখে আমি মোটেও অবাক হইনি৷ অবাক হয়েছে টেবিলা রাখা পান্ডুলিপি দেখে৷ যেখানে আপনার কবিতা গুলো লেখা আছে৷ যে কবিতা গুলো আপনি আমাকে উপহার স্বরূপ দিতেন৷ সেই সব কবিতা৷ আমি অবাক হই জানেন। ভীষণ অবাক হই। আমার চোখে জল এসে যায়৷ আমি সেখানে বসেই কান্না শুরু করি৷ এতোটা কান্না আমি কখনো করিনি৷ যতোটা সেদিন করেছি৷ নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিও জানেন৷ আবার বোকাও মনে হচ্ছিল। কি করছিলাম আমি? কেন করছিলাম? একটা মানুষ আমার মন জয়ের জন্যে কতো কিছু করে গেল। অথচ আমি তার দিকে তাকিয়ে সামান্য মুচকি হাসি পর্যন্ত দেইনি!

রুমা কান্না করতে থাকে৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আমি অবাক হই৷ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকি৷ আমি কী বলব ভেবে পাই না৷ রুমা আমাকে আবিষ্কার করে ফেলেছে৷ আসলেই আবিষ্কার করে ফেলেছে৷ আচ্ছা মেয়েটা কি আমাকে ভালোবাসে। আসলেই কি বাসে? না বাসলে তো এতোক্ষন বসে এসব বলতো না৷ এতো আয়োজন করতো না৷ তাহলে?

আমি কী করব ভেবে পেলাম না। ওর দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দিলাম। এরপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে মা কে কল দিলাম৷ ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-নাও, মায়ের সাথে কথা বলো৷ যতো যা-ই বলো, তোমার সেদিন ওভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। সরি বলে নাও৷
রুমা চোখ মুছলো। নাক মুছলো। এরপর ফোনটা স্পিকারে দিলো৷ মা ওপাশ থেকে কল ধরতেই রুমা বলল,
-মা আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি খবর তোমার মা? গাধাটার কী খবর?
আমার ভ্রু কুচকে এলো। আশ্চর্য ব্যাপার গাধাটা কে? রুমা মৃদু হাসলো। বলল,
-মা আপনার কথাই ঠিক৷ আপনার ছেলেটা আসলেই একটা আস্ত গাধা৷ সে এখনো বুঝতেই পারছে না যে আমরা প্ল্যান করে এসব করেছি৷ তার আড়ালে যে একটা কঠিন ষড়যন্ত্র হয়ে গেল সেটা সে টেরই পেল না৷
ওপাশ থেকে আমার মা হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন৷ সাথে অন্য কারো কথার আওয়াজও আসছে। তিনি হাসির ফাঁকে ফাঁকে বললেন যে,
-রুমা শোনো, তোমার বাবা মা এখানে এসে পৌঁছেছেন৷ চিন্তা করো না৷ গাধাটাকে একটু টাইট দাও৷ একটু বুঝাও৷ গর্দভটা এতোদিনের বুঝলো না যে তাকে তুমি আসলে কতোটা পছন্দ করো৷ সে নিজেই নিজের মনের খবর বুঝে না, তোমারটা আর কি বুঝবে৷
-চিন্তা করবেন না মা৷ আমি ঠিক বুঝিয়ে দিব৷
-ঠিকাছে৷ থাকো তোমরা৷ কাল কথা হবে৷
-জি মা৷ আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
কল কাটা গেল৷ রুমা হাসছে৷ মুচকি মুচকি হাসছে৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার কপাল কুচকে আছে৷ মাথার ভেতর নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে৷ আমার মা কীভাবে আমার সাথে এমন করতে পারলো তা ভেবে কূল পাচ্ছি না আমি৷ আমি কী বলব ভেবে পেলাম না৷ কেবল চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম রুমার দিকে। রুমা হাসি মুখেই বলল,

-ওইদিন সকালে আমরা আসলে ইচ্ছে করেই অমন করেছিলাম৷ আমাদের কিছুই হয়নি৷ জাস্ট আপনি রিয়েক্ট করবেন৷ সেই রিয়েক্টকে রিজন করে আমি বাসায় চলে আসব৷ আমি নিতে আসবেন৷ এমনই প্ল্যান৷ কিন্তু সেদিন আপনি একটু বেশিই ঝাড়লেন৷ আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।
আমি কিছুই বললাম না৷ কেবল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলাম রুমার দিকে৷ রুমা আবার বলল,
-সাবধান৷ এটা কিন্তু আমার বাসা৷ এখানে কোনো চিল্লাচিল্লি হবে না৷ একদম না৷
আমি আরো কিছুটা সময় চুপ করে থাকলাম। এরপর বললাম,
-তোমরা মেয়েরা এতো জটিল কেন বলো তো? কেন সব কিছু সরাসরি বলতে পারো না? কেন তোমাদেরকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাতে হবে৷ এতো ঘুরাতে হবে কেন? তুমি জানো এটা কতোটা কষ্ট দেয়? তুমি জানো আমি কেমন ছিলাম? কী পরিমাণ কষ্টে ছিলাম? জানো তুমি? সারাদিন আমি তোমাকে মিস করেছি। তোমার শূন্যতা অনুভব করেছি৷ কতোগুলো দিন৷ কেন এমন করলে? সব কিছু তো ওখানেই বলে দিতে পারতে? কেন বললে না? স্পষ্ট করে বললে কী হতো?

রুমা কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। এরপর উঠে এসে নিচু হয়ে আমার ঠোঁটে চুমু খেলো৷ আমার গালে ওর নরম তুলতুলে হাতটা রেখে বলল,
-আপনি কি জানেন আপনি একজন অসাধারণ মানুষ? আপনাকে যে ভালোবেসতে ভুল করবে তার মতো বোকা আর কেউই হবে না৷ কেউই না৷ আর আমি সেই লিস্টে যেতে চাই না৷ আমি এভাবেই থাকতে চাই৷ আপনার হয়ে থাকতে চাই৷ আপনার সারাদিনের চিন্তাভাবনা হয়ে থাকতে চাই৷ আপনার বুকের ভেতর অসম্ভব শূন্যতার কারণ হয়ে থাকতে চাই৷ বলুন লেখক সাহেব, রাখবেন আমাকে? আমাকে কি নিজের করে রাখবেন? বলুন প্লীজ!

আমি এমন কিছুর জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ রোবোট হয়ে গেলাম যেন৷ সোজা হয়ে বসে থাকলাম। ওর দিকে চেয়ে থাকলাম কেবল। কেবল দেখতে থাকলাম আমার সুন্দরী মানুষটাকে৷ আমার প্রিয়তমাকে। রুমা জবাবের অপেক্ষা করলো না৷ কিংবা হয়তো সে তার জবাব পেয়ে গেছে। সে ঠিক আবার ঠোঁটের কাছে নেমে এলো। আলতো করে চুমু খেলো। সেটার ঠোঁটের আলিঙ্গন একটু দীর্ঘ হলো৷ বহুল প্রতিক্ষার পর যেমন দুটো মানুষের আলিঙ্গন হয়, ঠিক তেমন৷

সমাপ্ত

ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।


আমার সব গুলো গল্পের লিংক!

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url