গল্পঃ মিহিনের গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ

 গল্পঃ মিহিনের গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ

গল্পঃ মিহিনের গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ

গল্পঃ মিহিনের গল্প । লেখক - তাসফি আহমেদ

মিহিন আবারো কলটা কেটে দিল৷ আমি কিছু সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেজাজটা খানিক খারাপই হলো। এতোক্ষন ধরে ফোন দিচ্ছি৷ ফোন ধরছে না কেন? কী সমস্যা ওর? আমি আবারো কল দিলাম। প্রথম কয়েকবার রিং হয়ে গেল। শেষ দিকে এসে খট করে শব্দ হয়৷ কল রিসিভ হয়েছে৷ আমি কানের কাছে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে মিহিনের চিৎকার শুনতে পেলাম,

-এতোবার কেন ফোন দিচ্ছিস? কী সমস্যা তোর? যখন প্রয়োজন হয় তখন ফোন দিস না৷ এখন কেন দিস? হ্যাঁ?
আমি কথা গুলো শুনে গেলাম কেবল। কিছুটা সময় নিয়ে বললাম,
-হয়েছে কী তোমার?
-আমার কী হবে? কিচ্ছু হয়নি। আর আমার কিছু হলেও তোর কী? তুই মেয়ে নিয়ে ঘুর৷ শহরে শহরে ঘুরে বেড়া যা৷
কথাটা বলেই কল কেটে দিল সে। আমি তব্দা খেয়ে বসে রইলাম৷ আরেহ এই মেয়ে দেখলো কীভাবে যে আমি অন্য মেয়ের সাথে ঘুরেছি? ওর তো দেখার কথা না! তাহলে?
আমি অনেকক্ষন চুপচাপ বসে রইলাম। মেয়েটা বেশ রেগেই আছে৷ রাগাটা অস্বাভাবিক না অবশ্য। আজ দু'দিন আমাদের ঠিকভাবে কথা হয় না৷ দেখা করিনি সপ্তাহ হবে৷ এ জন্যে কিছুটা রাগ সে করবে জানতাম। এরপর এই রাগে যে মেয়ে নিয়ে ঘোরার কাহিনী যুক্ত হবে সেটা আমার কল্পনার বাহিরে ছিল। এখন যে মেয়েটা কী পরিমাণ রাগ করে আছে তা বেশ আঁচ করতে পারছি৷
আমি শুয়ে পড়লাম। রাত তখন দশটা বাজে৷ খাওয়ার সময় হয়েছে৷ আমার খেতে ইচ্ছে করলো না। বেশ ক্লান্ত লাগছে৷ এই ক'দিনে বেশ ধকল গিয়েছে আমার উপর দিয়ে৷ এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি, তারউপর মিশু মেয়েটাকে নিয়ে মার্কেটে যাওয়া, জাস্ট বিরক্তিকর ছিল। মেয়ে মানুষের সাথে মার্কেটে যাওয়াটা স্বাভাবিক কাজ না! বেশ অস্বাভাবিক।
আমি চট করেই উঠে বসলাম। আমার ভালো লাগছিল না৷ অস্বস্তি লাগতে থাকলো। মনে যেন প্রশান্তি নেই৷ কেন জানি মনে হয় কিছু একটা নেই! এমন কিছু যার থাকার কথা৷ অথচ নেই! সেখানে কেবল শূন্যতা আছে৷ আর আছে শূন্য অনুভূতি। আমি শার্টটা গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে গেলাম। আমার মিহিনের সাথে দেখা করা উচিৎ। এখনই দেখা করা উচিৎ।
মিহিনদের বাসার নিচে গিয়েই ফোন দিলাম ওকে৷ কল ধরলো না সে৷ বেশ কয়েকবার দিলাম। একটা সময় কল ধরে সে৷ ধরেই কি ঝাড়ি! ফের সেই একই চিৎকার চেঁচামেচি। আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। ও যখন কলটা কেটে দিবে আমি ঠিক তখনই বললাম,
-আমি তোমার বাসার নিচে এসেছি।
ও খানিক চুপ থেকে বলল,
-কী? কোথায় এসেছো?
-তোমার বাসার নিচে৷
-কেন এসেছ? আর এলেও আমার কী? আমাকে আর ফোন দিবা না৷ রাখো ফোন৷
-আসো না একটু!
-চোপ! একদম মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবা না৷ বাসায় যাও৷ এখানে থেকে লাভ নেই।
আমি কিছু বলতে যাব ঠিক তখনই কল কেটে দেয় সে৷ আমি আর কল দেই না৷ ওখানটায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি! আমি জানি সে আসবে৷ যতো রাগই করুক না কেন, সে আসবেই৷
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। মশার আদর উপভোগ করলাম৷ সময় পেরিয়ে গেল৷ মিহিন এলো না৷ তাও আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। অল্প খানিক বাদে ফোনে কল আসে৷ স্ক্রিনে মিহিনের নাম। ধরতেই সে বলল,
-সমস্যা কী তোমার? কথা কী কানে যায় না? হ্যাঁ? বাংলা কথা বোঝো না?
-মশা কামড়াচ্ছে ভীষণ। আসো না একটু!
-চোপ! একদম আসার কথা বলবা না৷ জলদি এখান থেকে বিদায় হও৷ তা না হলে লোকজন ভুলভাল ভাববে৷ পরে গণপিটুনি খাবা৷
-আসো না প্লীজ!
-আমি আসবো না৷ আসবো না বলছি তো আসব না-ই৷ তুমি দাঁড়ায় থাকো ওখানে৷
কল কাটা গেল৷ আমি তাও দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি জানি মিহিন আসবে৷ অবশ্যই আসবে৷
আমি ছোট্ট একটা মেসেজ দিলাম ওকে৷ 'ক্লান্ত লাগছে৷ কাজকর্মের প্রেশারে অবস্থা বেশ বেগতিক৷ একটু জলদি আসা যায় কি বাবু?' মেসেজের কোনো রিপ্লাই আসেনি৷ আসাটাও প্রত্যাশায়ও ছিল না৷
এরপর আধ ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেল। হঠাৎ মিহিনদের বাসার গেট খোলার শব্দ হয়৷ আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি! গেট গলে মিহিন বের হয়৷ এরপর আমার দিকে এগিয়ে আসে৷ আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি কেবল মেয়েটার দিকে৷ আমার মনটা হঠাৎ কেমন প্রসন্ন হয়ে যায়৷ কী অদ্ভুত এক সতেজতা আমাকে আঁকড়ে ধরে৷ আমি স্পষ্ট অনুভব করি, আমার ঠোঁটের কোনে অল্প অল্প লজ্জামাখা হাসি৷
মিহিন আমার কাছে আসে৷ চেহারায় স্পষ্ট রাগ। এতো রাগ আমার উপর, তারপরও খানিকটা সেজে এসেছে সে৷ আমি টিপ পছন্দ করি বলে কপালে টিপ দিয়েছে৷ চোখে কাজল৷ বিশেষ কিছু লাগায় নি মুখে৷ অথচ এতেই ওকে অদ্ভুত মায়াবী লাগছে৷ মেয়েটা এতো অসাধারণ কেন? কী আছে ওর মাঝে? আমার এতো ভালো লাগে কেন?
মিহিন আমার সামনে এসেই কোমরে হাত দিয়ে বলল,
-সমস্যা কী তোমার? কথা বললে শোনো না কেন? আর কেন এসেছ এখানে? কী প্রয়োজন?
আমি ওর দিকে চেয়ে থাকলাম কেবল। কিছু বললাম না৷ আমার মনে হয় পৃথিবীর এই একমাত্র মানবী, যার রাগান্বিত রূপটায় ভয়ংকর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন৷ আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। কিছু বললাম না৷ ওর এবার আরেকটু খেপে গেল। বলল,
-কী সমস্যা তোমার? কথা বলছো না কেন? হ্যাঁ?
আমি বললাম,
-চলো হাঁটি একটু?
-কেন? আমার সাথে কেন হাঁটবা? যাও তো! বাসায় যাও৷ আমি এখানে এসেছি জাস্ট তোমাকে চলে যাওয়ার জন্যে বলতে৷ তোমার সাথে এখানে প্রেমালাপ করতে আসিনি আমি।
-আচ্ছা আসোনি তো কি হয়েছে৷ একটু তো প্রেমালাপ করতেই পারি নাকি?
-না, পারি না৷ তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ চলে যাও এখান থেকে।
কথাটা বলেই বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকলো ও। আমি কেবল দেখলাম ওকে। চোখময় কী তীব্র বিষাদ৷ কী অদ্ভুত মায়াবী এই চাহনি তার৷ আমি তাকিয়ে থাকলাম কেবল। ও আবার বলে উঠলো,
-কী ব্যাপার? যাচ্ছো না কেন? আর এভাবে তাকায় আছো কেন? মেয়ে দেখোনি আগে?
আমি হাসলাম। বললাম,
-এতোটা মায়াবী রূপসী মেয়ে আর দেখেছি বলে মনে হয় না৷
-এতো রূপসী মায়াবী মেয়ে দেখার দরকার নেই! যার সাথে ঘুরেছো তাকে গিয়ে দেখো৷ যাও৷ আমি গেলাম।
ও চলে যেতে চাইলো৷ আমি খপ করেই ওর হাতটা ধরে ফেললাম। বললাম,
-শোনো!
ও রাগান্বিত স্বরে বলল,
-হাত ছাড়ো। ছাড়ো হাত?
আমি ছাড়লাম না। ওর হাত ধরে থাকলাম। বললাম,
-চলো একটু হাঁটি৷ ভীষণ চাঁদের আলো আজ। একটু হাঁটাহাঁটি করলে ভালো লাগবে৷ আসো।
-আমার ভালো লাগার দরকার নেই৷ তুমি আমার হাত ছাড়ো৷
-আসো না প্লীজ! আমি নিজেও বেশ ক্লান্ত। তুমি তো জানোই! একটু থাকো না আমার সাথে। তোমাকে বলি সব কথা!
-আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।
-শুনিও না৷ কিচ্ছু বলিও না৷ একটু হাঁটো আমার পাশে৷
-না৷ পারব না৷
-প্লীজ৷
-উহু৷ তুমি যাও এখান থেকে৷ গিয়ে মেয়েদের সাথে ঘুরো৷ আমার সাথে হাঁটা লাগবে না৷
আমি ওর কথা শুনলাম না৷ ওত হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম৷
আমরা হাঁটছি৷ পিচ ঢালা পথ ধরে৷ বেশ কিছু সময় কেউই কোনো কথা বললাম না৷ আমি ওর হাত ধরে আছি৷ সেই যে ধরেছি, এখনো ছাড়িনি৷ নীরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম,
-মিহিন?
ও কোনো জবাব দিল না৷ আমি বললাম,
-তুমি তো জানোই আমি কেমন ব্যস্ত ছিলাম।
ও চট করেই বলে উঠলো,
-হ্যাঁ এতোই ব্যস্ত থাকো যে আমার একটু খোঁজ নেওয়ার সময় হয়ে উঠে না৷
-আমি আসলেই ব্যস্ত ছিলাম।
ও কিছু বলল না৷ চুপ থাকলো। আমি বললাম,
-ছোট বোনের বিয়ে। তা তো জানোই৷ বাসায় বড় ভাইয়ারা কেউই নেই৷ সব এখন আমার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ এ জন্যেই ব্যস্ততাটা বেশি৷ তুমি কি বেশি মিস করেছো আমায়?
ও জবাব দিল না। আমি আবারো বললাম,
-ওই মেয়েটার নাম মিশু! আমার কাজিন হয়৷ আমার বেশ জুনিয়র। ওকে নিয়ে মার্কেটে গিয়েছিলাম। ওর জন্যে নাকি জামা কেনা হয়নি৷ মার্কেট শেষে ওকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই৷ ওর ক্ষুদা লেগেছিল৷ সেজন্যে৷
কথাটা বলে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। এরপর মিহিনের দিকে ফিরে তার চোখ চোখ রাখলাম। সে চোখ সরিয়ে নেয়৷ আমি বলি,
-তুমি তো জানোই আমি তোমাকে কতো পছন্দ করি৷ জানো না? তারপরও কেন সন্দেহ করো?
ও চট করেই আমার দিকে তাকালো৷ বলল,
-আমি সন্দেহ করছি?
-জেলাস?
-না আমি সন্দেহ করছি। যাও৷ ভাল ব্যাপার। আমি অনেক সন্দেহ করি৷
-আহা! রাগ করে না তো!
-কথা বলবা না৷
-শোনো!
ও কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো৷ আমি ওকে বললাম,
-তাকাও এদিকে।
ও তাকালো না। আমি আবারো বললাম৷ ও তাও দেখলো না৷ আমি ওকে জোর করে আমার দিকে ফেরালাম৷ ওকে দেখলাম কিছু সময়৷ ওর চোখে মুখে মিষ্টি রাগ খেলা করছে৷ আমি তাকিয়ে থাকলাম। খানিকটা সময় নিয়ে বললাম,
-তোমাকে আমি ভালোবাসি মিহিন৷ অসম্ভব ভালোবাসি৷
মিহিন চেয়ে থাকলো আমার দিকে। হঠাৎই তার চোখে অল্প অল্প জল জমতে থাকলো। আমি দেখতে থাকলাম আমার মানুষটাকে৷ আমার মুগ্ধতাকে৷ আমার মনে হলো এই মূহুর্তে ওকে জড়িয়ে ধরা উচিৎ। অবশ্যই উচিৎ। ওকে বেশ নার্ভাস লাগছে৷ আমার শূন্যতা আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম ওর মাঝে৷ আমি আর কিছু বললাম না। খানিক এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরতেই অদ্ভুত এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো! বুকের ভেতরটায় কেমন হালকা অনুভব হলো। যেন ভারী কোনো চাপ মূহুর্তেই গায়েব হয়ে গেছে৷ আমি মিহিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। মিহিন শব্দহীন হয়ে কান্না করলো। তার চোখের জলে আমার কাঁধ ভিজল। তার আঁকড়ে ধরাটা আমার মাঝে তীব্র অনুভব জাগালো যে মানুষটায় আমায় মিস করেছে৷ ভীষণ মিস করেছে৷ ও আমার গলার কাছে চুমু খেয়ে বলে,
-তোমার উপর রাগ করে থাকা যায় না৷ তোমার উপস্থিতিই যেন আমার রাগের মৃত্যু ঘটায়৷ তোমাকে মিস করেছি অনেক। আসলেই মিস করেছি৷ সারাদিন কথা বলো আমার সাথে৷ হঠাৎ এভাবে হাওয়া হয়ে গেলে খারাপ লাগবে না বলো?
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-আমি সব সময়েই তোমার পাশে আছি। তোমার হয়েই আছি।
-অন্য কারো হলে তো খুন করে ফেলব তোমায়৷ তুমি আমার হবা৷ কেবল আমারই হবা৷ আমি আর কিচ্ছু জানি না৷
আমি মৃদু হাসলাম কেবল৷ কিছু বললাম না আর৷ মনে মনে ভাবলাম আজ এই মূহুর্তে এখানে আসাটা কতোটা জরুরি ছিল! মানুষটা আরো একটা রাত বুকের মাঝে তীব্র একটা শূন্যতা নিয়ে থাকতো! আমিও থাকতাম তার সঙ্গহীন হয়ে৷
আমরা মাঝে মাঝে বেশ ব্যস্ত হয়ে যাই৷ আমরা জানি ব্যস্ততা বেশ প্রয়োজনীয় কিছু৷ এই প্রয়োজনের চাপে মাঝে মাঝেই প্রিয় মানুষটার সাথে আমাদের দূরত্ব তৈরী হয়৷ একটা আবছায়া দূরত্ব। যেটা দু'জনকেই কষ্ট দেয়৷ সাময়িক বিচ্ছেদ কখনই সুখ দেয় না বটে, তবে বিচ্ছেদের পরের মিলনটা যে কী অসম্ভব ভালোবাসা জাগায়, সেটা যে সম্পর্ককে কী ভীষণ গাঢ় করে সেটা নিজ থেকে উপলব্ধি না করলে কখনোই বোঝা যায় না৷ মানুষের প্রেমটা গাঢ় হোক৷ আরো গাঢ়! এতোটা যে মৃত্যু ছাড়া আর বাকি কিছুই যেন মানুষ দুটোকে আলাদা করতে না পারে৷
গল্পঃ মিহিনের গল্প
ভুলত্রুটি মার্জনীয়৷
-তাসফি আহমেদ৷

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url