গল্পঃ কেউ কেউ ফিরে আসে । লেখক - তাসফি আহমেদ

 গল্পঃ কেউ কেউ ফিরে আসে । লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ কেউ কেউ ফিরে আসে । লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ কেউ কেউ ফিরে আসে । লেখক - তাসফি আহমেদ



-কখনো কারো একমাত্র প্রিয়জন হয়েছেন? বা ভালোবাসা?

-একমাত্র?
-হ্যাঁ৷ এমন যে মানুষটা কেবল আপনাকেই চেয়েছে৷ যতোটা কাছে পেলে ভালোবাসতে ভীষণ ইচ্ছে করে, ঠিক ততোটা কাছে পেতে চেয়েছে!
-আপনার ক্ষেত্রে এমন হয়েছে নাকি?
শুভ মৃদু হাসলো৷ বলল,
-প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন?
-আমার কাছে ঠিকঠাক জবাব নেই আসলে।
-ভালোবাসেননি কাউকে?
-বেসেছি তো! এই যে আপনাকে!
-আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
-আর কতোবার বলতে হবে?
-এতো অল্পতেই হাপিয়ে গেলেন নাকি?
-না। তা যাইনি৷
-তবে? এতো বিরক্তি নিয়ে বলছেন যে?
-কারণ আমি আপনাকে বোঝাতে পারছি না৷
-আপনার ভালোবাসা এতো জটিল যে আমি বুঝতেই পারি না৷
-কিংবা এও হতে পারে, আপনি বুঝতে চাইছেন না!
-আবার এও তো হতে পারে, আমার মন বুঝতে চাইছে না৷
-মনের উপর দোষটা চাপিয়ে দিলেন?
-সব ঝামেলা তো এই মনকে নিয়েই৷ তাই না?
-তা ঠিক৷
-হুম৷ গান জানেন আপনি?
-নাহ৷
-কবিতা?
-কখনো তেমন পড়া হয়নি৷ আবৃত্তি তো দূরের ব্যাপার।
-হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?
-না।
-রাতের বেলা আমার হাঁটতে ইচ্ছে হয়৷ পিচ ঢালা পথ, পূর্নিমার চাঁদ, ল্যাম্পপোস্টের আলো, সমস্তই যেন তীব্র মায়ায় ঘেরা৷ আপনাকে বাসায় কিছু বলবে না?
-না।
-আন্টি আঙ্কেল কিছু বলেন না?
-উহু৷ আমি তো বাজে কোথাও আড্ডা দেইনা৷
-তবে মানুষ যা ছড়ায়?
-মানুষের কথায় কান দেইনা আমি৷ আপনি দেন?
-দেই মাঝে মাঝে৷ আবার দেই না৷ ঠিক নেই।
-তার মানে আমাকে নিয়ে আপনার মাঝে প্রশ্ন আছে? ওই মানুষ গুলোর মতো?
-আছে কিছু!
-প্রথম বারেই স্বীকার করে ফেললেন? এভাবে সরাসরি কেউ স্বীকার করে ফেলেনি আজ পর্যন্ত৷
বলে হাসলো অন্তি৷ হাসি মুখেই ফের বলল,
-পেছনে যা তা বলুক, সামনে এলে সবাইই প্রশংসায় ভাসায়। কিন্তু আপনি ভিন্ন।
-আমার কেন জানি মনে হলো আপনি আগেই টের পেয়ে গিয়েছেন, আপনাকে নিয়ে আমি কী ভাবি৷
অন্তির চেহারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে এলো৷ সে হাসিমুখেই তাকালো শুভর দিকে৷ বলল,
-আপনার প্রব্লেমটা কি জানেন?
-আমার কোনো প্রব্লেম ট্রব্লেম নেই।
-আছে৷ খুব মারাত্মক একটা প্রব্লেম আছে আপনার।
-কী সেটা?
-আপনার কাছে কিছু লুকানো যায় না।
-কী বলেন?
-হ্যাঁ। আপনি মনের কথা গুলো কীভাবে জানি টের পেয়ে যান।
-এমন তো কখনো ভেবে দেখিনি৷ পুলিশের হয়ে কাজ করা যেতে পারে৷ আসামী শনাক্ত করার কাজটা৷ কী বলেন?
-আমি মজা করছি না৷
-তাহলে আমার হাসি পেল কেন?
-কারণ আপনি একজন পঁচা মানুষ। মানুষের কথার মূল্য দেন না৷
-তা ঠিক৷ আমি তা স্বীকার করি৷
-স্বীকার করেন মানে? আমি আপনার প্রশংসা করিনি মিস্টার৷
-কোনটা প্রশংসা আর কোনটা প্রশংসা না তা বেশ বুঝতে পারি আমি৷
-আপনি এমন কেন?
-কেমন?
-এই যে কেমন নির্বোধ, অনুভূতিহীন৷
শুভ হাসলো৷ প্যান্টের পকেটে দু'হাত গুঁজে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-কি জানি!
-আপনি কি প্রায় রাতেই হাঁটেন?
-মাঝেমধ্যে। তবে পূর্নিমার রাত মিস দেই না৷
-একা একা?
-এই শহরে আমার খুব পরিচিত কেউ নেই যে।
-এই যে, আমি আছি না?
-আপনি ব্যস্ত মানুষ।
-আপনি বললে সব ব্যস্ততা চুকে যাবে। কেবল একবার বলুন৷
-এসব ডায়লগ ছেলেদের মুখে মানায় বেশি৷
-আমি ডায়লগ মারছি না৷
-শুনে ভালো লাগলো।
-বিশ্বাস হচ্ছে না?
-হচ্ছে।
-সত্যি?
-সত্যি৷
-আমরা কই যাচ্ছি?
-এই তো আর অল্প একটু যাব৷ এরপর ফুটপাত ঘেঁষে বসব খানিক৷
অন্তি কিছু বলল না৷ চুপ থাকল৷ অল্প কিছু সময় পরই সে বলল,
-আপনার হাতটা ধরা যাবে?
শুভ চমকালো৷ বলল,
-কেন?
-জানি না৷ ইচ্ছে হলো ভীষণ।
-দুঃখিত৷
-সমস্যা নেই৷ আমি কিছু মনে করছি না৷ আসলে মূহুর্তটা এমন যে কারো হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে ইচ্ছে হয়৷
শুভ চুপ থাকলো। কিছু বলল না৷ অনেকটা সময় পরও শুভ কোনো কথা বলল না। অন্তি খানিক চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
-আপনি কি রাগ করেছেন?
-না তো৷ রাগ করিনি৷
-তাহলে কথা বলছেন না কেন?
-আমি মাঝে মাঝে ভীষণ নীরব হয়ে যাই?
-কেন?
-স্মৃতির দুয়ার খুলে যায় চট করেই৷ আমার পুরনো স্মৃতি আমাকে খুব নীরব করে ফেলে৷
অন্তি কিছু সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো শুভর দিকে৷ কিছু বলল না৷ কেবল দৃষ্টি দিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করল৷ শুভ চট করেই বলে উঠল,
-চলুন। ওখানটায় বসি৷
তারা দু'জনে ফুটপাতের উপর বসে পড়লো৷ তাদের থেকে খানিক দূরে একটা ল্যাম্পপোস্ট। স্বচ্ছ আকাশে নির্মল চাঁদ স্পষ্ট দেখা যায়৷ গাছের পাতার ফাঁক গলে কিছু আলো তাদের গায়ে পড়ে৷ কিছু আলো পাশ ঘেঁষে যায়। কিছু আলো জমিন ছোঁয়৷ এ এক অসাধারণ দৃশ্য। তবে আপসোস, তাদের কারোই এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হলো না৷
বসার পর প্রথম কথা অন্তি বলল,
-আপনার স্মৃতি আপনাকে নীরব করে ফেলে কেন?
শুভ হাসার চেষ্টা করল। বলল,
-ভাবুন, স্মৃতি কতো তীক্ষ্ণ হলে মানুষ একদম নীরব হয়ে যায়৷
অন্তি তাকিয়ে থাকলো শুভর দিকে৷ তার খানিক মন খারাপ হলো৷ আশ্চর্য, এই মানুষটার ভেতর কী এমন স্মৃতি আছে যেটা তাকে একদম নীরব করে ফেলে? কী আছে সেই স্মৃতিতে? অন্তি বেশ কিছু সময় চুপ থাকলো৷ তারপর চট করেই বলে ফেলল,
-আপনি কি কাউকে ভালোবাসতেন?
শুভ অন্তির দিকে ফিরল না৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে রাইলো৷ যেন সে জানতো, অন্তি ঠিক এই মূহুর্তে এই প্রশ্নটাই করবে৷ অন্তি লক্ষ্য করলো শুভর চেহারা হঠাৎ কেমন মলিন হয়ে আসছে। চোখ দুটোয় হঠাৎ যেন রাজ্যের শূন্যতা ভীড় করেছে৷ অন্তি এবার তাকিয়ে থাকলো কেবল। কিছু জিজ্ঞেস করলো না আর৷ মানুষটা কি আজ তাকে গল্পটা বলবে?
শুভ অনেকটা সময় নীরব থাকলো৷ এরপর মৃদুস্বরে বলল,
-একজনকে ভালোবাসি আমি৷
অন্তি তাকিয়ে থাকলো শুভর দিকে৷ অনেকক্ষণ দেখলো ছেলেটাকে। কিছু বলল না৷ কেন জানি অন্তির চোখে জল জমতে চাইলো৷ তার মনটা কেমন মলিন হয়ে এলো। তার কাঁদতে ইচ্ছে হলো৷ মনের ভেতর বারবার একটা ইচ্ছে ঘুরপাক খেতে থাকলো৷ শুভর বলা এই কথাটা মিথ্যা হোক৷ পৃথিবীর সবচে বড় মিথ্যা হোক৷ শুভ আবার বলল,
-ওর নাম সোমা৷ সোমা চৌধুরী। স্রষ্টার অকৃত্রিম সৃষ্টি গুলোর মধ্যে একটি৷
অন্তি চুপ থাকলো৷ শুভর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অন্য দিকে তাকালো৷ তার কেন জানি এই কথা গুলো শুনতে ভালো লাগছে না৷ কেমন অসহ্য লাগছে৷ অথচ এই কথা গুলো সে নিজেই শুনতে চেয়েছে৷ এখন হঠাৎ অসহ্য লাগার কী হলো? শুভ আবার বলল,
-আমরা একে অপরকে তিন বছর অসম্ভবরকম ভালোবেসেছি৷ পরের পাঁচ মাস নিয়ম করে ঝগড়া করেছি৷ এবং এরপর দিনক্ষণ ঠিক আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে ফেলেছি।
অন্তির ভ্রু কুচকে এলো। বলল,
-ভেঙ্গে ফেলেছি মানে?
-ভেঙ্গে ফেলেছি বললে ভুল হবে। সে ভেঙ্গে চলে গেছে৷ তার আর ভালো লাগছিল না আমার ভুবনে।
-মানে?
শুভ চট করে কিছু বলে ফেলল না৷ সে চুপ থাকলো৷ কী যেন ভাবলো। অন্তি ততোক্ষণে বলে বসলো,
-আপনি কি শুরু থেকে আমাকে গল্পটা বলবেন? একদম শুরু থেকে। যেখানে থেকে দু'জনে এক হোন!
শুভ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-আপনার বলা প্রয়োজন ছিল না৷ আমিই বলতাম। নিজ থেকে। এই গল্পটা আপনার জানা প্রয়োজন।
অন্তির ভ্রু কুচকে এলো৷ ওর জানার প্রয়োজন মানে? মনের প্রশ্নটা আপাতত লুকিয়ে রাখলো সে। সে গল্প শোনায় মনোযোগ দিলো এবার৷
"সোমা! এই মেয়েটার নামটা যতো শান্ত, ঠিক মানুষটাও তেমন। কেমন শান্ত শীতল নীরব। এতো মায়াবী যা বলার মতো না৷ চেহারা ভরা স্নিগ্ধতা৷ মুগ্ধতা। তার চাহনি আমার এতো পছন্দ যে ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি৷
তাকে প্রথম দেখি আমাদের উপজেলার মোড়ে। এরপর আমাদের এখানকার আবাসিক এলাকার একটা বিল্ডিংয়ের বারান্দায়৷ আমাদের ফের দেখা হয় কলেজের পাশের একটা লাইব্রেরিতে৷ আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের একটা বই কিনতে গিয়েছিলাম। সে এসেছিল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান বই কিনতে৷ এরপর থেকে আমি এই মেয়েটাকে প্রায়ই লক্ষ্য করতাম। কেন জানি না বারবার এই মেয়েটাই চোখের সামনে চলে আসতো৷ শহীদ মিনারের সামনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই কিংবা মাঠের পূর্ব পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে আড্ডা দেই, মেয়েটাকে আমি ঠিক সেখানেই আবিষ্কার করতাম৷ বান্ধুবিদের সাথে হাত নেড়ে কথা বলছে। চোখ মুখ অসম্ভব উজ্জ্বল। দেখে মনে হয় এই মেয়েটার চেয়ে অধিক খুশি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই৷
এভাবে নিত্য তার চলাচল আমাকে তার প্রতি খানিক দূর্বল করে ফেললো। আমি তখন প্রায়ই তার কথা ভাবতাম। তার মুখশ্রী নিজের কল্পনার জগতে তুলে ধরে আনমনে হাসতাম। ভাবতাম, এই মেয়েটা স্রষ্টার কী অপরূপ সৃষ্টি! একটা মানুষ এতো মায়াবী কী করে হয়? এতো স্নিগ্ধ? এভাবে ধীরে ধীরে আমার ভাবনারা প্রসস্ত হয়৷ একটা সময় মেয়েটা আমার কল্পনার জগতকে নিজের করে নেয়৷ কল্পনা এবং বাস্তব এই দুটোতেই আমি মেয়েটার তীব্র উপস্থিতি লক্ষ্য করি৷ পাশাপাশি নিজের মানসিক পরিবর্তন এবং কিছু একটা পাওয়ার আশা মনের মাঝে যেন আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে যায়৷
মাস কয়েক গেলে আমি তাকে একদিন আড়াল করে ডেকে আনি৷ তার চেহারায় অবাক ভাব। কেমন ভীতু ভীতু টাইপ। আমি হেসে বললাম,
-ভয় পেয়ো না। একটু শান্ত হয়ে দাঁড়াও৷ কিছু কথা শোনো৷
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো৷ মাঝে মাঝে চোখ তুলে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তাকিয়ে থাকতো৷ সেদিন প্রথম, আমি এতো কাছ থেকে এই মেয়েটার কাজল দেওয়া চোখ দেখেছি৷ চোখ দুটো এতো কোমল, এতো মায়াবী লাগছিল যা বলার মতো না৷ একবার তাকালেই যেন সমস্তা গা শিউরে ওঠে৷ আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম,
-না-না-ম কী তোমার?
-সোমা৷
-এ কলেজেই পড়ো?
-জি না।
-তাহলে তোমাকে প্রায়ই দেখি যে?
-আমাকে দেখেন? আমাকেই?
আমি খানিকটা কাঁপা স্বরে বললাম,
-হ্যাঁ।
-ভালোই।
-ভালোই মানে? তুমি কি আসলেই এই কলেজে পড়ো না?
-কী বোকার মতো প্রশ্ন করছেন! না পড়লে আমাকে এখানে প্রতিদিন দেখতেন?
আমি চুপ করে গেলাম। কী গাধার মতো একটা প্রশ্ন করে বসলাম। ধুরর! সোমা বলল,
-আমি যাই তাহলে?
-না, দাঁড়াও।
-আর কিছু বলবেন?
-হ্যাঁ৷
-বলুন।
আমি আবার চুপ করে গেলাম৷ কী বলব ভেবে পেলাম না৷ সোমা আবার বলল,
-বলবেন? নাকি চলে যাবো?
আমি আরো খানিক চুপ থাকলাম৷ সোমা চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালে আমি চট করেই বলে ফেললাম,
-সোমা?
সে দাঁড়িয়ে গেল। আমার দিকে পেছন ফিরে তাকালো৷ আমি বললাম,
-একটু শোনো প্লীজ!
সে আরো খানিক এগিয়ে এলো৷ আমার চোখে দিকে তাকালো৷ আমি চোখ নামিয়ে নিলাম৷ বললাম,
-অনেক দিন থেকে ভাবছি কথাটা বলব। বাট বলা হয়ে ওঠে না৷
সে চুপ থাকলো৷ কেবল আমার দিকে চেয়ে থাকলো৷ আমার তখন শ্বাসপ্রশ্বাস কেমন ভারী হয়ে আসছে৷ বুকের ভেতর কী অসম্ভব তোলপাড়। ধপ ধপ শব্দটা যেন আমি নিজ কানে শুনছি৷ দু'হাঁটু কেন জানি সেদিন খুব কেঁপেছিল। কপাল ঘেমে যাচ্ছেতাই অবস্থা! কী শ্বাসরুদ্ধকর সময় ছিল সেটা৷ আমি তাকে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলি,
-যা-ই বলি, যদি তোমার পছন্দ হয় কিংবা না হয়, চুপচাপ চলে যেও৷ কলেজের এতো গুলো স্টুডেন্টের সামনে ইজ্জত খেয়ো না প্লীজ৷
সোমা কিছু বলল না। মৃদু হাসল কেবল৷ আমি আবার বললাম,
-তোমাকে আমি বেশ কয়েকদিন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম৷ কেন জানি না, তুমিই আমার চোখের সামনে চলে আসতে। যেখানেই যাই কেবল তোমাকে দেখি৷ এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের কলেজ একই, ক্যাম্পাস একই৷ তাই দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ঝামেলা হলো আমার এই দেখার চাহিদাটা ইদানীং অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে। আমি এখন যতোক্ষণ সুযোগ পাই, তোমাকেই দেখি৷ কেবল তোমার দিকেই তাকিয়ে থাকি৷ কেন জানি না, আমার আজকাল তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগে৷ কেমন জানি একটা প্রশান্তি মেলে৷ কী অদ্ভুতরকম এক অনুভূতি হয় সেটা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না৷ আমার চারপাশটা এখন কেমন জানি তুমি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে৷ ঘুম থেকে উঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, সর্বত্রই তোমার চিন্তাভাবনা আমাকে ঘিরে রাখে। রাতে ঠিক ঘুমও হয় না৷ তোমার কথা ভাবতে ভাবতেই ইদানীং ভোর ঘনায়৷ আমি বুঝতেও পারি না সোমা৷ এমন কেন হচ্ছে? হঠাৎ আমার জীবনটা এমন পরিবর্তন হয়ে গেল কেন? কেন আমি এমন হয়ে গেলাম? আমার আশপাশে সারাটাক্ষন তুমি থাকো কেন? কেন আমি তোমাকে পেতে চাই৷ কেন আমার ইচ্ছে হয়, তুমি আমার হও। আমার পাশ ঘেঁষে বসো৷ আমরা খুব শক্ত করে একে অপরের হাতটা ধরে রাখি! আমার কেন বারবার তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়? কেন তোমার মায়ায় ডুব দিতে ইচ্ছে হয় সোমা? জানো কেন?
সোমা কিছু বলে না৷ সে কেবল তাকিয়ে থাকে আমার দিকে৷ আমি তার দিকে ভালো করে তাকাই এবার৷ তার চোখে চোখ রাখি৷ হঠাৎ কী হলো জানি না, আমি চট করেই বলে ফেলি,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি সোমা! অসম্ভব রকম ভালোবাসি তোমাকে৷ তুমি কি আমার হবে? একান্ত আমার?
সোমা মেয়েটা অনেকক্ষণ আমার দিকে কেমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ আমিও তার সেই কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আমার হঠাৎ ভয় হতে থাকে৷ আশপাশটাকে ভীষণ নীরব মনে হয়৷ বুকের কাঁপনটা স্পষ্ট শুনতে পাই যেন! হাঁটুর কাঁপনটা কেন জানি অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেল। আমি অসহায়ের মতো সোমার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ সোমার কী হলো জানি না, সে চট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে৷ কেন জানি কেঁদে ফেলে সে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি কেবল৷ ঘটনার আকস্মিকতার কিছুই বুঝে উঠলাম না৷ সোমা অল্প কিছু সময় আমায় জড়িয়ে ধরে রাখে৷ এরপর চট করেই ছেড়ে দেয়৷ দৌড়ে পালায় আমার সামনে থেকে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে৷ কী করব ভেবে পাই না৷"
শুভ থামে খানিক। একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অল্প কিছু সময় পর আবার বলা শুরু করে,
"সে রাতেই আমি একটা অচেনা কল পাই৷ তখনও আমি ঘোরে আছি। দুপুরের ঘটনাটা যেন হজম হচ্ছিল না৷ ফোন ধরেই সালাম দিলাম। ওপাশ থেকে মিষ্টি একটা স্বর ভেসে এলো,
-হ্যালো!
হ্যালো বলতেই যেন আমি টের পেয়ে গেলাম এই মানুষটা কে! কেন ফোন দিয়েছে! অবাক হলাম৷ মেয়েটা আমার নাম্বার পেলো কই? বললাম,
-সোমা?
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ এলো। বলল,
-কীভাবে চিনলেন?
-জানি না৷ মনে হলো তুমিই হবে! স্বরটাও কাছাকাছি।
-বাহ! শুনে ভালো লাগলো।
আমি হাসলাম। বললাম,
-নাম্বার পেলে কই?
-তা বলা যাবে না৷
-কেন?
-সিক্রেট!
-তোমার সিক্রেট জানার অধিকার আমার আছে!
-সরি মিস্টার! সব সিক্রেটের উপর অধিকার খাটানো যায় না৷
-বলবে না?
-উহু৷
-আচ্ছা সমস্যা নেই৷ একদিন ঠিক শুনে নেবো৷
-দেখা যাক৷
-তারপর?
-তারপর?
আমি চট করেই হেসে ফেললাম৷ সেও হাসলো৷ এরপর খানিক নীরবতা। মৌনতা ভেঙ্গে সে বলল,
-জানেন, আপনার পেছনে একদল গোয়েন্দা গ্রুপ অলয়েজ কাজ করতো?
-গোয়েন্দা গ্রুপ?
-জি৷ টপ লেবের গোয়েন্দা বলা যায়! এবং তারা সফল হয়েছে!
-বুঝলাম না!
-বুঝবেন৷ সব কিছুই ধিরে ধিরে টের পাবেন৷ আপনার কী ধারণা! আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন? এই যে প্রত্যেক জায়গাতেই যে আমাকে দেখতেন, এসবই কি ন্যাচারাল?
আমি অবাক স্বরে বললাম,
-মানে?
-মানেটা খুব সহজ৷ ইন্টার প্রথম বর্ষ থেকেই আমার আপনাকে পছন্দ হয়ে যায়৷ পছন্দ বলতে কোনো সাধারণ পছন্দ না৷ আমি আপনার প্রতি অনেকটা পাগলের মতো ছিলাম৷ আপনাকে ফলো করা থেকে শুরু করে, আপনি কে, কী করেন, কোথায় থাকেন, বাসায় কে কে আছে, এই সব তথ্য আমার কাছে আছে৷ আপনার কাঠগোলাপ পছন্দ৷ আপনার একজন ক্রাশ আছেন৷ নীল রঙের প্রতি আপনি ভীষণ উইক৷ শীত ঋতু আপনার প্রচণ্ডরকম পছন্দের তাই না?
আমি কেবল অবাক হলাম। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। এই মেয়ে কি আসলেই আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে! আমাদের সে রাতে অনেক কথা হয়৷ আমি অনেক কিছু জানতে পারি৷ তার বান্ধবী নামক গোয়েন্দা গ্রুপ কীভাবে কী কী করলো, কোথায় কোথায় আমাকে দেখতে ওকে ফোন করে জানালো এবং ও পাগলের মতো ছুটে এলো, এমন খুটিনাটি প্রত্যেক গল্পই সে জানালো আমাকে৷ এবং আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই মেয়ের প্রত্যেকটা ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে৷ একদম এ টু জেড সব৷"
শুভ আবার থামলো৷ খানিক থেমে বলা শুরু করলো,
-ভালোবাসার অর্থ আমার বোধগম্য ছিল না৷ আমি জানতাম না এর অনুভূতি কেমন হয়৷ এসবই আমার জন্যে নতুন৷ কিন্তু এই ভালোবাসার জন্যে মেয়েটা যা করলো তা আমার জন্যে অনেক। অনেক মানে অনেক৷ মনে মনে যে কী অসাধারণ ফিল করছিলাম বলার মতো না৷ গাধার মতো এতো কষ্ট করে সেদিন প্রপোজটা না করলেও হয়তো৷ কিছুদিন গেলে মেয়েটা নিজেই প্রপোজ করে বসতো৷ অবশ্য ভালোই হয়েছে! আমাদের সম্পর্কটা একটু আগ থেকেই শুরু হয়ে গেল! অপেক্ষা জিনিসটা বড় কষ্টকর৷ তিনটা বছর আমাদের খুব দারুণ রকম যায়৷ আহা! কী চমৎকার ছিল মোমেন্ট গুলো৷ সেদিন প্রথম যখন মেয়েটার হাত ধরলাম, তুলতুলে হাতটা আমার হাতের ভাঁজে নিতেই যেন সমস্ত গা শিউরে উঠলো আমার৷ এই গা শিউরে ওঠা অনুভূতি গুলো ভোলা যায় না অন্তি৷ মোটেও ভোলা যায় না৷"
"ইন্টারে সোমা দারুণ রেজাল্ট করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত এডমিশন টেস্ট দিয়ে চান্স পায় না৷ আমাদের কলেজেই অনার্সে ভর্তি হয়ে যায়৷ নেক্সট ইয়ার আবার এক্সাম দেওয়ার ইচ্ছে তার৷ আমি তাকে উৎসাহিত করলাম৷ তার প্রতিটা ভেঙ্গে পড়া মূহুর্তে তার সঙ্গ দিলাম৷ তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। যাই করি না কেন, মেয়েটাকে কখনও নিরুৎসাহিত করিনি৷ কখনও ডিমোটিভেট করে পেছনে পড়ে থাকতে বলিনি৷ আমি তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বলেছি! কে জানি! হয়তো তার সুন্দর ভবিষ্যৎ সেখানেই লুকিয়ে আছে৷ সোমা আমাদের কলেজে ভর্তি হওয়াতে আমার জন্যে বেশ উপকার হয় অবশ্য। তাকে এখন খুব কাছে পাওয়া যায় যে!
সময়টা আমাদের দারুণ যাচ্ছিল৷ একে পরের প্রতি কেয়ারিং, ভালোবাসা কোনো কিছুরই কমতি ছিল না৷ সব কিছুই পার্ফেক্ট ছিল৷ শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া৷ ব্যাপার বললে ভুল হবে৷ সমস্যা বলা যায়৷ এই সমস্যাটা আমারই৷ আমি সোমার আশপাশে কখনই কোনো ছেলেকে মেনে নিতে পারি না৷ সে কোনো ছেলের সাথে কথা বললেই আমার খুব হিংসে লাগে৷ রাগ উঠে৷ মেজাজ গরম হয়৷ আমি থাকতে তার কেন অন্য ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে হবে? কেন? এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের ঝামেলা হতো মাঝে মাঝে। কয়েকদিনের জন্যে ব্রেকাপও হয়ে যেতো৷ একদিনের কথা বলি। ইন্সটাগ্রামে ওকে কয়েকটা ছেলে নক দিতো৷ এই ব্যাপারটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম৷ তবুও কিছু বলিনি৷ চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু একদিন পাসওয়ার্ড দিয়ে তার আইডিতে লগইন করতেই দেখলাম যে ও ছেলে গুলোর সাথে কথা বলছে৷ মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে৷ আমার মেজাজটা চড়ে গেল৷ আমি তাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম সে কেন ছেলে গুলোর মেসেজের রিপ্লাই করেছে! সে অবাক স্বরে বলে, করলে সমস্যা কী? আমার রাগটা আরো বাড়ে৷ কথা-কাটাকাটি হয়৷ রাগের মাথায় কী বলি নিজেও জানি না৷ বেশ ঝগড়াঝাঁটির পর আমাদের ব্রেকাপ হয়ে যায়৷ ম্যাসেঞ্জারেও তাকে 'ব্রেকাপ। টেক কেয়ার।' লিখে পাঠাই৷ ও কিছু বলেনি আর৷ মেসেজটা সীন করে রেখে দেয়৷ আমার মেজাজটা আরো খারাপ হয়৷ আমি ওকে ব্লকই করে দেই। যাহ! তুই থাক ওদের সাথে৷ আমার সাথে থাকতে হবে না৷ দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে আমি নিজেই খানিক উপলব্ধি করি, আসলে কাজটা ঠিক করিনি৷ রাগ করেছি ভালো কথা৷ ব্লক কেন করতে গেলাম! তাও চুপচাপ পড়ে ছিলাম৷ ও থাকুক ওর মতো। সেদিন রাত সাড়ে নয়টার দিকে ওর কল আসে। আমি রিসিভ করি না। বেশ কয়েকবার রিং হয়৷ আমি ধরি না৷ তাও রিং হতে থাকে৷ আমি জানি যতোক্ষণ না আমি ফোনটা তুলবো ততোক্ষণ সে এভাবেই আমাকে কল করে যাবে৷ আমি যখন কলটা রিসিভ করলাম তখনই ওপাশ থেকে কান্না মিশ্রিত একটা রাগী স্বর ভেসে এলো,
-তুমি আমায় ব্লক কেন করেছো?
ব্লক আমি করি কিংবা ও করে, একটা সময় আমাদের মিলটা হয়েই যায়৷ আমাদের ফের রাত জেগে কথা বলা শুরু হয়৷ তার আবেগি আবদার, অভিযোগ, অনুযোগ এর পাহাড় তৈরী হয়! কলেজে এলে হুট করেই এদিক সেদিক ঘুরতে চলে যাই আমরা৷ এই যে আমি রাতের বেলা হাঁটি, আমার এই অভ্যাসটাও তার সৃষ্টি। একবার ভরা পূর্ণিমায় সে আমার সাথে হাঁটার জেদ করলো৷ আমি শত নিষেধ করেও তার সেই জেদ দমাতে পারিনি৷ আমাকে তার কাছে যেতে হয়েছে৷ আমরা দু'জনে একসাথে পিচঢালা পথ ধরে, দু'হাত শক্ত করে ধরে অনেকদূর হেঁটেছি৷ ফুটফাত ঘেঁষে বসে গল্প করেছি কতো। সে কাঁধে মাথা রেখে প্রায়ই কবিতা শোনাতো৷ গল্প বলতো! গান গাইতো! কী অসাধারণ গানের গলা ছিল তার! প্রতিটি গানের প্রতিটি লাইন যেন আমাকে নিয়েই গাওয়া৷ আমার জন্যেই গাওয়া। এরপর একেঅপরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা হয়েছে অনেক৷ কতো যে তার চোখের মায়ায় ডুবে ছিলাম! শেষ সময়ে আমাদের ঠোঁটের আলিঙ্গন হয়েছে প্রায়ই৷ প্রথম বার আমাদের দু'জনের খুব কাছাকাছি আসা, দু'হাত শক্ত করে ধরে তাকে চুমু খাওয়া,এমন চিরজীবন্ত অনুভূতিগুলোকে আমি আজও ভুলতে পারিনি৷ এগুলো ভোলা যায় না৷ ভোলা অসম্ভব৷ আচ্ছা আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?"
অন্তি চট করেই কিছু বলে ফেলতে পারলো না৷ সে কেবল শুভর দিকে তাকিয়েছিল৷ গল্পের মাঝে এমন ভাবে ডুবে ছিল যে শুভ হঠাৎ কী বলল সেটা তার ঠিক বোধগম্য হলো না৷ সে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-হু?
-বিরক্ত হচ্ছেন?
-না। না তো! বিরক্ত হচ্ছি না৷ আপনি থামলেন কেন? বলুন! প্লীজ জলদি করে বলুন৷ এরপর কী হয়েছে?
শুভ মৃদু হাসলো। প্রাণহীন হাসি৷ বলল,
-এরপরের গল্পটা ছোট৷ তবে ছোট এই গল্পটুকুই তীব্র বিষাদময়৷ শুনবেন?
-শুনব মানে? শোনার জন্যেই তো বসে আছি।
শুভ মলিন মুখে হাসলো। খানিক থেমে বলা শুরু করল,
"আমাদের সম্পর্কে এমন ছোটখাটো ঘটনা অনেক ঘটেছে৷ এবং সত্যি বলতে আমিই সে ঘটনা কারণ ছিলাম৷ ঘটনা গুলো প্রায় একই ব্যাপার নিয়েই ঘটিত৷ তখন আসলে অতো কিছু মাথায় আসতো না৷ সোমার পাশে কোনো ছেলে দেখেছি তো আমার রাগ মাথায় উঠে গেছে এমন। সোমা মেয়েটা কীভাবে জানি এসব সহ্য করে নিতো৷ আবার আগের মতো স্বাভাবিক সম্পর্ক শুরু হতো আমাদের৷ সবই ঠিকঠাক ছিল৷ দ্বিতীয় বছর সোমা ভার্সিটির এডমিশন টেস্ট দেয়৷ এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যায়৷ আমি অবাক হইনি৷ কেন জানি বিশ্বাস ছিল মেয়েটা পারবে৷ কারণ লাস্ট ছয় সাত মাস সে এতো পরিশ্রম করেছে যা বলার মতো না৷ তার সাথে খানিক আমাকেও খাটতে হয়েছে। রোজ নিয়ম করে তাকে কোচিংয়ে নামিয়ে দিয়ে আসা, আবার তাকে সেখান থেকে পিক করা, সে বোরড হলে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, ম্যান্টলি তাকে ইন্সপায়ার করার মতো কাজ গুলো আমি করেছি। এমনও হয়েছে যে তাকে ভোরে ঘুম থেকে তোলার দায়িত্বটাও আমাকে নিতে হয়েছে। সে এলার্ম দিলেও উঠতে পারে না৷ আমি ফোন দিয়ে তাকে ওঠাতাম। সে উঠতো না৷ বারবার ফোন দিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গাতাম। সে উঠতো৷ পড়তে বসতো৷ আমাকে গুডমর্নিং ম্যাসেজ পাঠাতো৷ আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এতো কিছুর পর আমাদের মাঝে খানিক দূরত্ব তৈরী হয় বটে, তবে তা সয়ে নেই আমি৷ মেয়েটার জন্যে এতটুকু তো করতেই পারি তাই না! সময়টা বেশ ভালোই গেল তখন৷ সোমা উপহার হিসেবে চবিতে চান্স পেয়ে গেল। শুরু হলো তার নতুন জীবন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন৷ সে সেখানে হলে উঠেছে৷ নতুন রুমমেট, নতুন জীবন, স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়, হঠাৎ যেন মেয়েটার জীবনে খুশির একটা জোয়ার চলে এলো৷ তাকে আমি কখনই এতো খুশি দেখিনি৷ এতো প্রানবন্ত হতে দেখিনি৷ আমার নিজেরও যেন কেমন খুশি হতে থাকলো৷ সোমার জীবনের অত্যাধিক কোনো আনন্দের ঘটনার একটু সামান্য অংশ হতে পেরে।
সোমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঁচ মাস কীভাবে যেন পার হয়ে গেল৷ তার সাথে আমার বেশ দূরুত্ব হয়েছে বটে, তবে আমাদের সম্পর্কে সামান্য চোট পর্যন্তও আসেনি৷ আমাদের প্রেম যেন আগের চেয়ে বেশ প্রাণবন্ত হয়ে চলতে শুরু করলো। প্রেমের গভীরতা বাড়লো যেন।
সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী জানি হয়ে গেল! সোমার ফেসবুকে ছেলেদের ভীড় জমে গেল। ক্লাসমেট ধরে সিনিয়র ভাইয়েরা পর্যন্ত তাকে মেসেজ দিতো৷ আমি তার আইডিতে লগইন করে মেসেজ গুলো দেখতাম। মেয়েটা প্রথম প্রথম কারোই রিপ্লাই করতো না তেমন। কিন্তু সময় গড়ালে সে ঠিকই তাদেরকে রিপ্লাই করা শুরু করে৷ সবার সাথে সে কি হাসিতামাশা তাদের৷ এসব দেখে আমার গা জ্বলে যেতো৷ রাগ হতো৷ রাগ হলে ঝগড়া হতো৷ এরপর ধীরে ধীরে সেই ঝগড়ার পরিমাণটা বৃদ্ধি পেতো! সবই যেন হঠাৎ হয়ে গেল। হঠাৎ কেমন সমস্তই পরিবর্তন হয়ে গেল৷ আমি সেই পরিবর্তনটা সামলে নিতে পারিনি৷ আমি মানতে পারিনি সেখানে সোমার বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া সোহান ছেলেটাকে৷ তাদের কথোপকথন আমার পছন্দ হয়নি৷ আমি সোমাকে তাকে ব্লক করতে বলি৷ সোমা তাকে ব্লক করে না৷ আমার মেজাজ খারাপ হয়৷ রেগে যাই৷ বাজে বিহ্যাভ করি৷ তাও সোমা অনড়৷ আমাকে খুব করে রিকোয়েস্ট করে আমি যাতে তার উপর বিশ্বাস রাখি৷ সোহানকে জাস্ট বন্ধু ভাবি৷ এরচে বেশি কিছু না৷ সে সোহানের নানান গুণগানও গাইলো৷ ছেলেটা যতোই ভালো হোক, সত্যি বলতে আমি তার প্রতি কোনো পজিটিভ থিংক আনতে পারিনি মাথায়৷ এবং আজও, আমি ওই ছেলেটাকে পছন্দ করি না৷ তাকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যায়৷ তখন তো আরো বেশি জ্বলতো৷
শেষমেশ রাগের মাথায়, আমি মানুষটা এতো নিচে নেমে যাই যে, সোমার আইডিতে লগইন করে ছেলেটাকে ব্লক করে দেই৷ সাথে এও জানাই যে আর জীবনেও সোমাকে মেসেজ না দেই। ব্যস৷ এতটুকুই করলাম আমি। এরপর সব চেঞ্জ হয়ে গেল৷ সোমা আমার থেকে এমন কিছু আশা করেনি বলে একটা সুদীর্ঘ মেসেজ পাঠালো৷ ফোন দিয়ে আমাকে বলল আমি কতোটা ঘৃন্য একটা কাজ করেছি। তার লাস্ট একটা কথা আমার এখনও খুব মনে আছে,
-সব কিছুর একটা লিমিট থাকে শুভ৷ মানুষের সহ্যেরও একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে। তুমি আমার সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করেছ৷ আমার বন্ধুর কাছে আমাকে ছোট করেছো! এতোবছরের একটা সম্পর্কের পর, তোমার থেকে এমন কিছু আশা করিনি আমি৷ মোটেও আশা করিনি৷
আমার এমন পাগলামোর ফলাফল স্বরূপ আমাদের ব্রেকাপ হয়ে যায়৷ দু'জন তখন দু'মেরুতে৷ সময় গড়ালে আমি ঠিকই বোধ করি, আমি যা করেছি ঠিক করিনি৷ খুব অন্যায় করে ফেললাম। নিজের ভেতর অপরাধী অনুভূতি জাগে৷ তাও চুপ করে থাকি৷ ভাবি মেয়েটা একসময় কল দিবেই৷ সমস্যা কী! অপেক্ষায় প্রহর গড়ায়৷ দিন রাত হয়৷ রাত পেরোয় অবলীলায়। সবই নিত্য নিয়মে চলে৷ অথচ মেয়েটার কোনো মেসেজ আসে না৷ আমি আরেকটু অপেক্ষা করি৷ তাও আমাকে হতাশ হতে হয়৷ নিজ থেকে তাকে মেসেজ পাঠাতে যাই৷ ম্যাসেঞ্জারে আমাকে ব্লক করে রাখা৷ ফোন দিলে বন্ধ বলে। মেসেজও যায় না৷ হোয়াটসঅ্যাপেও দেখলাম ব্লক করে রেখেছে৷ চট করেই আরেকটা ফেক একাউন্ট খুলে সোমার নাম লিখে সার্স করি। মেয়েটার আইডি আসে না৷ মেয়েটাকে পাই না আমি৷ বাসার ফোন থেকে ওকে কল দেই৷ নাম্বারটা সেই বন্ধই বলে। এরপর লাগাতার একটা মাস আমি প্রায়ই ওর নাম্বারে কল দিতাম। ওপাশ থেকে সেই চিরচেনা ভদ্রমহিলার স্বর ভেসে আসে, 'কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
আমি একদম থ হয়ে যাই৷ এমন পরিণতি মোটেও আশা করিনি আমি৷ ভাবনায়ই ছিল না যে এমন কিছু হতে পারে৷ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সোমার বাবা এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে যায়৷ তাদের ফ্যামিলি দ্রুতই আমাদের এলাকা ত্যাগ করে৷ তাকে দেখতে পাওয়ার শেষ যে সুযোগটুকু ছিল তাও হারিয়ে গেল। উধাও হয়ে গেল সে। হঠাৎ, এতো কাছের, এতো কাছের একজন মানুষ চট করেই এমন হারিয়ে গেলে কেমন লাগে জানেন, কেমন কষ্ট বুকের ভেতর চাপা থাকে জানেন? আমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না, সোমা আমার সাথে ব্রেকাপ করেছে৷ আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোনো ভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। রাতের ঘুম যেন আমার জন্যে হারাম হয়ে গিয়েছে৷ সামান্য প্রশান্তিটুকু আমার মনের ভেতর নেই৷ মানুষ হাসে কীভাবে, কেন হাসে সেটাও যেন ভুলে গিয়েছি! কেমন পাথরের মতো হয়ে গেলাম চট করেই৷ পুরোদমে মূর্তিমানব৷ যার সকল সুখ আহ্লাদ কেউ যেন চুরি করে নিয়ে গেছে। তার ভেতরে এখন কিছুই নেই৷ কেবল শূন্যতা ছাড়া! পৃথিবীর সকল শূন্যতা যেন তাকে ঘিরেই বসে আছে! জানেন, আমি ওর সাথে দেখা করার জন্যে ওদের ক্যাম্পাসেও যাই। সেখানে গিয়ে মেয়েটাকে খুঁজে বের করে৷ দেখি সে ঠিকই আছে। সোহানের সাথে বসে প্রতিযোগিতা করে ফুচকা গিলছে। যেমনটা আমার সাথে থাকাকালীন সময়ে করেছে৷ এই চিত্র দেখার পর আমি আর তার সামনে যাওয়ার সাহস পাইনি৷ তাকে যে গিয়ে সরি বলব, সেই সাহসও আমার ছিল না৷ আমি কেমন জানি ভীতু প্রকৃতির হয়ে যাই৷ অন্ধকার আমার অসম্ভব প্রিয় হয়! আমার কাঠগোলাপ গাছটি হয় কথা বলার এক মাত্র সঙ্গি৷ আর রুমটা হয় আমার একমাত্র পৃথিবী। জীবনটা কেমন ছোট হয়ে আসে৷ বুকের বাঁপাশের তীব্র শূন্য যন্ত্রণাটাও কেমন সয়ে আসে৷ মানুষ ততোক্ষণ ব্যাথায় ডুবে থাকে যতোক্ষণ না তার মাঝে ব্যাথা সওয়ার সেই সক্ষমতাটা তৈরী হয়৷ আমার মাঝেও এক সময় সেই ব্যাথা সওয়ার সক্ষমতা চলে আসে। বাবা-মাও আমাকে মানসিক ভাবে খুব সাপোর্ট করে। আমাকে ফের নতুন করে শুরু করতে বলে৷ তারা আমাকে কোথাও ঘুরতে যেতে বলে৷ একটা চাকরির জোগাড় করতে বলে৷ কোথায় খানিক ব্যস্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আমাকে উৎসাহিত করেন৷
একটা সময় ঠিকই সব কিছু সয়ে আসে অন্তি। কিন্তু বুকের ভেতরের সেই শূন্যতাটা কখনোই শেষ হয় না৷ মাঝে মাঝে, নির্দিষ্ট কিছু মূহুর্তে আম ওকে কী পরিমাণ মিস করি বলার মতো না৷ তাকে মিস করার কথা আসলেই আমার ব্যাথা বাড়ে খানিক৷ বুকের ভেতর সেই শূন্য ব্যাথাটা আবার জেগে ওঠে৷ ফের সেই রাত আমাকে জেগে কাটাতে হয়৷ অন্ধকারে চোখের জল ফেলতে হয়। এরমাঝে একজন ডাক্তারও দেখাই৷ তিনি ঘুমের ঔষধ দেন৷ মানসিক প্রশান্তির জন্যে কি ট্যাবলেট দেন যেন! এসব খেলে খানিক ভালো লাগে। কিন্তু ভুল করে একদিন না খেলে আমার চোখে ঘুম ধরে না৷
সব কিছুর পরও কেন জানি না, মেয়েটার প্রতি সামান্য ঘৃণা জন্মাতে পারিনি মনে৷ তার প্রতি ভালোবাসাটা যেন ঠিক আগের মতোই রয়ে গেল। কিছু মানুষ থাকে না এমন, যাদেরকে আমরা খুব ভোলার চেষ্টা করি৷ কিন্তু আদত আমরা তাদেরকে কখনই ভুলতে পারি না৷ সোমা, আমার জন্যে ঠিক তেমনই একজন মানুষ। এবং আমি এখনও তার অপেক্ষা করি৷ এখনও অপেক্ষা করি একটা সুযোগের, একবার সরি বলার সুযোগের।"
শুভ থামে৷ একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস বেয়ে আসে তার গলা দিয়ে৷ দু'হাত দিয়ে চোখমুখ মোছে৷ অন্তি আনমনে একটা টিস্যু বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে৷ শুভ টিস্যুটা নিতে নিতে ফ্যাকাসে স্বরে বলে,
-বুঝি না, কেন জানি চোখে জল চলে আসে। এটাকে নিয়ন্ত্রণই করতে পারি না।
অন্তি কিছু বলে না৷ সে চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। তার এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে থাকার কথা না৷ সে চাইছে শুভকে কিছুটা সিমপ্যাথি দিতে৷ কিন্তু কেন জানি সে সেটা পারছে না৷ তার অসম্ভব কান্না পাচ্ছে৷ কেন কান্না পাচ্ছে তাও জানে না সে৷ কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে এটা সত্য৷ অথচ অন্তি লাস্ট কবে কেঁদেছে সেটা তার মনেই নেই৷ এতো কান্নাকাটির সময় কই তার৷ তার অধিকাংশ সময় কাটে নতুন নতুন ছেলে বন্ধুদের সাথে৷ সোমার চরিত্রে খানিক দোষ আছে। সে কোথাও স্থির হতে পারে না৷ আজ এই ছেলের সাথে ডিনারে গেলো তো দেখা গেলো পরের দিন অন্য ছেলের সাথে৷ তার প্রেমের সংখ্যা অগনিত। একটা প্রেম বেশিদিন টেকে না৷ কে জানি, হয়তো সে টেকাতে জানে না। অন্তি এমন ধরনের মানুষ যার বেশিরভাগ সময় কাটে ডেটিং এবং বন্ধুদের আড্ডায়৷ তার আবার কান্নাকাটির সময় কই! কিন্তু আজ হঠাৎ কী আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো, তার ভীষণ কান্না করতে ইচ্ছে হলো৷ তাও এই ছেলের সামনে না৷ নিভৃতে কোথাও৷ অন্তি চট করেই বলে উঠলো,
-উঠি?
শুভ হাসলো। বলল,
-অবশ্যই৷
তারা দু'জনে উঠে দাঁড়ালো৷ ধীরে পাঁয়ে এগিয়ে চললো গন্তব্যের দিকে৷ কেউ কোনো কথা বলছে না৷ শুভর ইচ্ছে হলো বলবে, আজকের রাতটা এই শহরে তার শেষ রাত৷ সে ফের ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে৷ কিন্তু কেন জানি সে কথাটা বলল না। চুপ থাকলো। বাসার কাছাকাছি এলে হঠাৎ অন্তি বলল,
-আপনি এই গল্পটা বলার আগে বলেছিলেন গল্পটা আমার জানা দরকার৷ এমনটা কেন বলেছেন জানতে পারি?
শুভ মৃদু হেসে বলল,
-উত্তরটা আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন একসময়৷ আমি বলা লাগবে না৷
অন্তির খানিক জোর করার ইচ্ছে হলো। তবে সে তা করলো না। চুপচাপ থাকলো। বাসার গেট দিয়ে দু'জনে একসাথেই ঢুকলো৷ বিরক্তমাখা চেহারা নিয়ে দারোয়ান চাচা তাকিয়ে থাকলো অনেকটা সময়৷ সিড়ি বেয়ে ওঠার সময় শুভ বলল,
-ভোরের দিকে চলে যাচ্ছি৷
-প্রজেক্টের কাজ শ্যাষ?
-হ্যাঁ৷
-চারমাস খুব দ্রুতই পেরিয়ে গেল তাই না?
শুভ হাসলো৷ জবাব দিলো না৷ অন্তি নিজ থেকেই জানতে চাইলো,
-বাসে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ৷
-কয়টার টিকেট?
-টিকেট কাটিনি৷ ওখানে গিয়ে যে বাসটা পাবো সেটাতেই উঠে যাবো৷
-ঢাকায় গিয়ে আমাকে মিস করবেন?
শুভ হাসলো। বলল,
-আপনার জ্বালানোটা মিস করব৷
অন্তি হাসার চেষ্টা করলো। খানিকটা সময় চুপ থাকলো সে। শুভ চট করেই বলে বসলো,
-আপনার কি মন খারাপ?
অন্তি চট করে শুভর দিকে তাকালো৷ শুভ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অন্তির চোখ ভরা জল। কয়েক ফোটা খুব দ্রুত গাল বেয়ে পড়ে গেল। শুভ অবাক হলো। অন্তি ভেজা স্বরে বলল,
-আমার কেন জানি কান্না পাচ্ছে ভীষণ।
শুভ কিছু বলতে পারলো না৷ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো অন্তির দিকে৷ ততোক্ষণে তারা অন্তিদের ফ্ল্যাটের কাছে চলে এসেছে৷ অন্তি বাসার কলিংবেল বাজালো। বাজিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনি কি জানেন, আমিও যে চবি'তে পড়ি?
শুভ ভ্রু কুচকে তাকালো৷ ঠিক তখনই অন্তিদের বাসার দরজা খুলে দিলো কেউ৷ অন্তি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-ভালো থাকবেন৷
এই বলে সে চট করে ভেতরে চলে গেল৷ দরজাটা লাগিয়ে দিল দ্রুত৷ শুভ খানিক দাঁড়িয়ে থাকলো সেখানে। এরপর ধিরে ধিরে নিজেদের ফ্ল্যাটে আসলো৷ নিজের রুমে এসে খানিকটা সময় ভাবলো অন্তিকে নিয়ে৷ মেয়েটা হঠাৎ এই কথা বলল কেন? আর সে যে চবি'তে পড়ে এটা তো তার জানা ছিল। তাও কেন বলল ও? শুভ বিশেষ গা দিলো না৷ এই মেয়েটা প্রায়ই অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে৷ এখানে আসার পর থেকেই সে শুভকে জ্বালিয়ে মারছে। সে নাকি শুভর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ কী অদ্ভুত ব্যাপার৷ এভাবে চট করেই যে কারো প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া যায় সেটা এই অন্তিকে না দেখলে বোঝাই যাবে না৷ এখানে যে চার মাস ছিল ও, এই চারমাসে ওকে প্রায়ই নানান বিষয়ে জ্বালিয়ে গিয়েছে অন্তি৷ কেবল বাড়িওয়ালার মেয়ে বলে কিছু বলতে পারলো না ও৷ পাশাপাশি মেয়েটার বাবা একজন পুলিশ অফিসার৷ তারউপর এখানে আসার পর ওকে নানান গুঞ্জন শুনলো ও। সব মিলিয়ে মেয়েটার থেকে দূরত্ব রাখার অনেক গুলো কারণ ছিল ওর কাছে৷ এই দূরুত্ব রাখাটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো৷ অন্তির সেটা পছন্দ হলো না। সে ভাবতেই পারছে না যে কেউ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে৷ এমনটা নাকি আজ পর্যন্ত হয়নি৷ কোনো ছেলে ওকে এড়িয়ে যেতে পারিনি। না পারাটাই স্বাভাবিক। অন্তির রূপের মাঝে কোনো খুঁত নেই। একদম নিখুঁত বলা চলে৷ সে কারনেই হয়তো ছেলেদেরকে মায়ার জালে ফাঁসাতে পারে সে৷ এতোদিন তাই করে এলো। অথচ শুভর বেলায় তা ঘটলা না৷ এই জিনিসটাই ঠিক মেনে নিতে পারলো না অন্তি৷ তাইই হয়তো এতোদিন ওর পেছন লেগে ছিল। কে জানি! আজ থেকে হয়তো মেয়েটার জ্বালানো আর সহ্য করতে হবে না৷ আর দেখা হবে না উচ্ছ্বসিত চেহারা৷ এই শহরে আর আসা হবে না৷ সোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা হবে না হয়তো আর কোনোদিন৷ কে জানে৷ হতে পারে৷ নাও হতে পারে। শুভ ভাবলো হোটেলে না থেকে খানিক লাভই হয়েছে। এখান থেকে প্রায়ই সোমাকে দেখতে যাওয়া যায়৷ সে গিয়েছেও৷ অন্তিকে বলেছে একদিন৷ অথচ সে সুযোগ পেলেই চলে যেতো সোমাকে দেখতে৷ অনেকটা সময় মুগ্ধ হয়ে দেখতো মেয়েটাকে৷ আড়ালে আড়ালে লক্ষ্য করতে শান্ত শীতল সেই প্রাণবন্ত মানুষটাকে। শুভ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর কখনই এখানে আসবে না৷ অফিসিয়াল সকল কাজ কর্ম তার শেষ৷ নেক্সট প্রজেক্ট গুলোও যদি এখানের হয় তবুও সে এখানে আসবে না৷ আর কখনই না৷ ঢাকাতেই তার স্যাটেল হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে৷
ভোরের দিকে প্রস্তুত হয়ে বের হয় শুভ৷ রুমমেট নিরব ভাইকে জাগিয়ে বিদায় নেয় সে। সাড়ে পাঁচটার দিকে বাস স্টেশন পৌঁছায় ও। টিকেট কেটে দোকানের কাছে এলো কিছু কিনতে। বাসে তার খিদে লেগে যায়৷ তাই কিছু ড্রাইফুড কিনে রাখে সে৷ কেনাকাটা শেষে সে যখন পেছন ফিরে তাকালো তখন তাকে খানিকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হতে হয়৷ তার পেছনে অন্তি দাঁড়িয়ে আছে৷ চোখ দুটো ফুলে কেমন লালচে হয়ে আছে৷ শুভ অবাক স্বরে বলল,
-আপনি এখানে?
অন্তি কেঁদে দিলো৷ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-সরি।
শুভ ভ্রু কুচকে বলল,
-কেন?
অন্তি ভেজা স্বরে বলল,
-ফর এভ্রিথিং!
শুভ কিছু বলল না৷ সে কেবল তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। অন্তি বলল,
-আমি একটা ভুল করে ফেলেছি শুভ৷
-কী ভুল!
-খুবই মারাত্মক একটা ভুল। সোমা মেয়েটাকে আমি চিনি। অনেক আগ থেকেই চিনি৷ ও আমার এক ইয়ার জুনিয়র৷ আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই৷
শুভ যেন আরো খানিক অবাক হলো৷ সে যেন আকস্মিক এই ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না৷ অন্তি বলল,
-আপনি জানেন না, আপনার ব্রেকাপের জন্যে একমাত্র কারণ আমি৷ কেবল আমি৷
শুভ ভ্রু কুচকে বলল,
-আপনি?
-হ্যাঁ। আমি। আমিই আপনাদের ব্রেকাপ করিয়েছি। সোমা মেয়েটা বেশ সহজসরল। তাকে নানান ভুলবাল বুঝিয়েছি আমি৷ আপনি যে পজেসিভ, এসব ভবিষ্যতের জন্যে ভালো না, এমন প্রেম বেশিদিন টিকে না, ও আরো ভালো ডিজার্ব করে, আরো ভালো কাউকে, এমন কথা গুলো বলে আমি ওকে ডিমোটিভেট করেছি৷ আমার সাথে হেল্প করেছে সোহান৷ সেও ওকে কিসব বোঝালো৷ তারপর আপনি ওই সময়ে ওমন রিয়েক্ট করলেন। বিশেষ করে সোহানের সাথে বাজে ব্যাবহার করাটা৷ আমরা আরো সুযোগ পেয়ে যাই৷ মেয়েটাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করি৷ ওর মনে ঘৃণা জন্মাই আরো৷ অবশ্য আপনার এমন কাজের জন্যে তার মনে এমনিতেই ঘৃণা চলে এসেছিল৷ আমরা তা আরো বাড়িয়ে দিলাম। আপনাদের ব্রেকাপ হয়ে গেল। এই ব্রেকাপটা ছিল আমার আর সোহানের মাঝের একটা ডিল৷ সোহান আমার কাজিন হয়৷ সে আমাকে অফার করে, যদি আমি ব্রেকাপ করিয়ে দিতে পারি তাহলে আমার জন্যে স্পেশাল ট্রিট আছে৷ আমি সেই লোভে এসব করি৷ ভার্সিটির সিনিয়র হওয়াতে কাজটা আমার জন্যে আরো ইজি হয়ে যায়৷ এই সব কিছু আমি করেছি৷ আমি! এসবের জন্যে আমি দায়ী৷ আমাকে প্লীজ ক্ষমা করে দিন। প্লীজ!
অন্তি হঠাৎ কেঁদে দিলো৷ কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। শুভ কিছু বলল না। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কেবল। কী বলবে ভেবে পেলো না৷ তার যেন বোধ শক্তি হারিয়ে গেছে৷ সে কেমন অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-সোমা জানতো এসব?
অন্তি মাথা নিচু করে বলল,
-না৷ এসবই ওর অগোচরে হয়েছে৷ এতোদিন মেয়েটা এসব জানতো না৷ আজ জেনেছে৷ এই খানিক আগে জেনেছে। আমি ওকে সবটা বলে দিয়েছি।
-খানিক আগে?
-হ্যাঁ৷ আমি ওকে নিয়ে এসেছি৷ ওই যে, ওদিকে দেখুন। মেয়েটা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে কাঁদছে৷ দেখুন৷ ভালো করে দেখুন৷
শুভ সেদিকে তাকালো। দেখলো খানিক দূরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ অগোছালো চুল৷ নির্ঘুম চাহনি৷ চোখ ভরা জল৷ মেয়েটা কাঁদছে। সোহান কিছুটা এগিয়ে গেল৷ তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো। মেয়েটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে আসছে৷ শুভ চোখ মুছে নিলো। দেখলো মেয়েটা এগিয়ে আসছে। ওর দিকে এগিয়ে আসছে৷ শুভ অনুভব করলো, তার বুকের ভেতর কাঁপছে৷ অসম্ভব কাঁপছে। সেই চিরচেনা কাঁপন৷ সোমা শুভর সামনে এসে দাঁড়ালো৷ ওর চোখে চোখ রাখলো৷ শুভ দেখলো সোমাকে। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলো একে অপরের দিকে৷ যেন কয়েক কোটি বছর এরা একে অপরকে দেখেনি৷ কেমন তৃষ্ণার্ত চাহনি৷ সোমা ভেজা সরে বলল,
-সরি৷
শুভ কিছু বলল না৷ কেবল তাকিয়ে থাকলো। সোমা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আ'ম সরি শুভ৷ আমি ফাঁদে পাঁ দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ভালো ছিলাম না৷ এক মূহুর্তের জন্যে ভালো ছিলাম না৷
শুভ কেমন ধরে আসা স্বরে বলল,
-তুমি আমাকে কীভাবে ভুলে থাকতে পারলে সোমা? আজ কতোদিন তুমি আমায় দেখো না৷ কতোদিন৷ তুমি থাকলে কী করে?
সোমা নিজের ফোনের ওয়ালপেপার দেখালো,
-দেখো, স্ক্রিনে তোমার ছবি৷ এইযে আমার গ্যালারি দেখ, তোমার সব ছবি আমার কাছে আছে। আমি তোমাকে ভুলিনি শুভ৷ তোমাকে ভোলা সম্ভব না৷ কোনো মতেই সম্ভব না৷ আমার ডায়েরি দেখবে? তোমাকে নিয়ে যে কতো কি লিখেছি আমি!
শুভ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-সোমা, তুমি আমায় ভুলে গেছো! ওরা বলেছে তোমাকে ভুলে যেতে৷ তুই তাই ভুলে গিয়েছো৷ তাই না?
-আমি তোমাকে ভুলিনি শুভ৷
-ভুলে গিয়েছো৷ তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছে৷ এমন করে কেন ভুললে? একটা সরি বলার সুযোগ অন্তত দিতে৷ তুমি জানো, অপরাধবোধ মনে নিয়ে বেঁচে থাকা কতো কষ্টকর?
শুভ কেঁদে ফেললো৷ এই প্রথম সে সব্দ করে কাঁদলো৷ কেঁদে কেঁদে বলল,
-আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবেসেছি৷ এটাই কি ভুল ছিল? বলো? ভুল ছিল?
-প্লীজ! কেঁদো না। একদম কাঁদবে না প্লীজ৷ এরা আমাকে এমন ভাবে ফাঁদে ফেলেছে যে আমি বুঝতেই পারিনি আমি কতো বড় অন্যায় করে ফেলেছি৷ আমাকে ক্ষমা করো প্লীজ আমাকে ক্ষমা করো৷ আমি আবার ফিরতে চাই৷ আমি আগের মতো আমার সেই শুভকে চাই৷ আর কিচ্ছু চাই না আমি। আর কিচ্ছু চাই না৷ প্লীজ শুভ, আমাকে নিজের করে নাও৷ আর একটাবারের জন্যে কথা দিলাম, এরপর তোমাকে আর ছেড়ে যাব না৷ কখনই না৷ প্লীজ!
শুভ কেমন মলিন চেহারা, ভেজা দৃষ্টিতে সোমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ কিছু বলল না৷ কেবল তাকিয়ে থাকলো৷ সোমাও খানিক দেখলো শুভকে৷ চোখে চোখে কি জানি কথা হলো৷ কী জানি আদানপ্রদান হলো৷ এই লেনদেনের হিসেব এই পৃথিবীর কারো কাছে নেই৷ কেউ জানে না তারা এই মাত্র কি আদানপ্রদান করলো৷ শুভ বলল,
-এরপর যদি ছেড়ে যাও তবে যাওয়ার আগে আমাকে খুন করে যেও।
সোমা কিছু বলল না৷ চট করেই ঝাপিয়ে পড়লো শুভের বুকের উপর৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-বদ ছেলে৷ এমন কথা আর কখনই বলবে না৷ বললে তোমার খবর আছে৷
শুভ কিছু বলল না। কেমন কান্না মিশ্রিত হাসি দিল সে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সোমাকে৷ হঠাৎই তার কেমন পরিপূর্ণতা অনুভব হলো৷ বুকের ভেতরের সেই অজানা শূণ্যতা যেন চট করেই উধাও হয়ে গেল। কি এক তীব্র প্রশান্তি যে তাকে ঘিরে ধরলো বলার মতো না৷ হঠাৎ যেন তার মাঝে প্রাণ ফিরে এলো৷ নিজেকে সুখি মনে হলো। পৃথিবীর এক মাত্র সুখি মানুষ মনে হলো৷


.
সমাপ্ত।
গল্পঃ কেউ কেউ ফিরে আসে
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়৷
-তাসফি আহমেদ৷

আরো পড়ুন

Next Post Previous Post
1 Comments
  • Dipto Adhikary
    Dipto Adhikary ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ এ ১১:৫২ PM

    না ফিরে আসলেই ভালো লাগতো।
    কিছু কিছু মানুষের ফিরে আসা মেনে নেয়া অনেক অনেক কষ্টের

Add Comment
comment url