গল্পঃ অনুভূতির শব্দ হয় না৷ লেখক - তাসফি আহমেদ

গল্পঃ অনুভূতির শব্দ হয় না৷ লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ অনুভূতির শব্দ হয় না৷ লেখক - তাসফি আহমেদ


গল্পঃ অনুভূতির শব্দ হয় না৷ লেখক - তাসফি আহমেদ


বাসায় ফেরার পর থেকেই দেখলাম তৃপ্তির কেমন ছন্নছাড়া অবস্থা। বেশ অমনোযোগী। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরলে সে এগিয়ে আসতো সবার আগে৷ কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিতো। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিত৷ মেয়েটা আজ তা করল না। প্রতিদিন এলে নানান প্রশ্ন করতো৷ লাঞ্চ পুরোটা শেষ করিনি কেন তা নিয়ে স্বল্প রাগ দেখাতো। তাকে কল দিতে ভুলে গেলে অভিমানি স্বরে সেই অভিযোগ শোনাতো। সে আজ তেমন কিছুই করছে না৷ কেমন চুপচাপ, অমনোযোগী হয়ে বসে আছে৷ কোনো এক গভীর ভাবনা যেন তাকে বেশ অস্থির করে তুলছে৷ গত কয়েকদিন থেকেই আমি তার এই অস্থির ভাবটা লক্ষ্য করেছি৷ তবে বিশেষ গা দেইনি। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে৷ আশ্চর্য! কী হয়েছে মেয়েটার?


তৃপ্তির সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল নয় মাসের মতো হবে৷ বিয়ের আগে আমাদের পূর্ব পরিচিতি ছিল না৷ এই মেয়েটাকে প্রথমবার দেখতে গিয়েই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছে৷ পছন্দ না হওয়ার অবশ্য কারণ ছিল না৷ যে কেউ তাকে দেখলেই পছন্দ করে ফেলবে৷ এতো মায়াবী চেহারা দেখার পর কার না ভালো লাগবে! তবে আমাকে সবচে যে জিনিসটা বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হচ্ছে এই মেয়ের চোখ! আশ্চর্য রকম ঘোর ধরানো চোখ তার৷ প্রথমবার যখন সে কাজল কালো চোখ দুটো তুলে আমাকে দেখলো, আমার সমস্ত গা শিউরে উঠলো যেন! তার সাথে আমার চোখাচোখি হতেই আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো৷ ভেতরটা যেন চট করেই কেঁপে উঠলো। বারবার মনে হতে থাকলো, "এই মেয়েটার চোখ দুটো এতো অসাধারণ কেন?"


বাসায় ফিরে আমি মাকে স্পষ্টই বলে দিলাম, 'বিয়ে করলে আমি এই মেয়েকেই করবো। তা না হলে বিয়েই করব না।' 


আম্মাকে দেখলাম যথেষ্ট খুশি হয়েছেন৷ খুশি হয়েই তৃপ্তিদের বাসায় জানালেন৷ 'পাত্রি আমাদের পছন্দ হয়েছে।' কিন্তু তৃপ্তির বাসা থেকে যা জানানো হয় তা শুনে আমার কেন জানি ভয় হতে থাকে৷ বারবার মনে হতে থাকে তৃপ্তির বোধহয় আমাকে পছন্দ হয়নি৷ কেন হয়নি? আমি তো দেখতে শুনতে এতো খারাপ না! তাহলে? 


তৃপ্তির বাবা জানালো তারা একটু সময় নিবে৷ মেয়ে আলাদা ভাবে ছেলের সাথে কথা বলবে৷ এরপর মেয়ের মতের উপর নির্ভর করে সামনে আগানো হবে৷ আমি বিশেষ আপত্তি দেখালাম না। তার সাথে আমার তিনবার সাক্ষাৎ হয়৷ তৃতীয় সাক্ষাতেই মেয়েটা আমাকে নিচু স্বরে বলে,

"শুনুন, বাসায় বলে দিন কথাবার্তা আগাতে।" 

সেদিন কথাটা শোনার পর আমি অনেকক্ষন মেয়েটার দিকে চেয়ে ছিলাম। আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ তৃপ্তি আসলেই কথাটা বলেছে? আমি বললাম, 

"কী বললেন?" 

সে কেমন লজ্জাময় হাসি দিলো৷ কিছু বলল না আর। আমি কেবল তার দিকে চেয়ে থাকলাম। আমি দেখলাম মেয়েটার মুখ দ্রুতই কেমন লালচে হয়ে আছে। আমার তখন অসম্ভব খুশি লাগছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটাকে এখনই শক্ত করে জড়িয়ে ধরি৷ কেবল রেস্টুরেন্ট দেখে সেদিন জড়িয়ে ধরা হয়নি৷ 


তৃপ্তি কী দেখে হ্যাঁ বলেছে আমি জানি না৷ আমাদের তেমন আলাপালোচনাও হয়নি বিয়ে কিংবা সম্পর্ক সম্পর্কে৷ এমনিই স্বাভাবিক ভাবে কথা হতো আমাদের। ব্যস৷ একে অপরকে পছন্দ হয়েছে কী না তা নিয়েও বিষদ আলোচনা হয়নি। তবে সে কিসের ভিত্তিতে হ্যাঁ বললো? আমি এই প্রশ্নটার উত্তর জানতে চেয়েছিলাম একদিন৷ মেয়েটা সেদিন হাসিমুখে বলল, "তোমার সাথে থাকলে সিকিউর মনে হতো নিজেকে৷ মনে হতো আমার কিছু হতে দিবে না তুমি৷ আমাকে রক্ষা করবে৷ আমার এই সেফ ফিলিংসটা আসলে আগে কখনই হয়নি৷ কেবল মাত্র তোমার বেলায়ই হলো৷ কেন হলো তা জানি না৷"


তৃপ্তি বেশ শান্ত একটি মেয়ে৷ কোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে বেশ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে৷ বেশ বিচক্ষণ। সংসারী। মায়ের সাথেও এই মেয়েটার কেমন সক্ষতা হয়ে গেল। যেন এমন বিহ্যাভ করছে যে আমার মা তার নিজের মা৷ বেশ অবাক হই এটা ভেবে যে একজন মানুষ এতো সহজে এতো দ্রুত কীভাবে মিশে যেতে পারে৷ 


তৃপ্তি চঞ্চল মেয়ে না৷ তাই সহজে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতো না৷ এবং আশ্চর্যজনক ভাবে আমি যেন মেয়েটাকে বুঝে যেতাম৷ সে কি চাইছে তা যেন চট করেই বলে ফেলতে পারতাম৷ মেয়েটা সহজে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না৷ আবেগটা প্রকাশ করে ফেললে আমি আরো সহজে মেয়েটাকে বুঝে ফেলতে পারতাম। 


তৃপ্তি বেশ গুছিয়ে কথা বলে৷ বাড়তি কথা বলে না৷ সব সময়েই হাসিমুখে কথা বলে৷ এই মেয়েটার সাথে কথা বললেই আপনার ইচ্ছে হবে আপনি তার সাথে আরো কথা বলুন৷ আপনার কথা বলার লোভ যাবে না৷ বারবার তার সাথে কথা বলেই যেতে ইচ্ছে হবে৷ 


সে আমাকে কখনই তেমন জোরালো ভাবে বলেনি 'ভালোবাসি।' আমিও কেন জানি শুনতে চাইনি৷ কখনও আবদার করতো না বৃষ্টিতে ভিজবে; বিকেলে আমার সাথে আকাশ দেখবে; বাইরে ঘুরতে যাবে৷ 


বৃষ্টি এলেই মেয়েটা চাতক পাখির মতো বাইরে তাকিয়ে থাকতো৷ আমি দেখতাম সে লোভনীয় দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে। আমি গিয়ে বলতাম,

-চলো ভিজি৷ 

সে আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলতো, 

-চলো৷ 

বৃষ্টিতে ভিজে সেকি আনন্দ তার৷ ভেজা শরীরে এই মেয়েটা যখন খুব শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরে রাখতো তখন আমার মনে হতো আমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি একজন৷ তার এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকাটা আমাকে খুব গভীর ভাবে অনুভব করাতো সে আমাকে কতোটা ভালোবাসে৷ তার প্রেম কতোটা গভীর৷ আমার ঠোঁটের কাছে নিজের ঠোঁট এনে যখন চুমু খেতো তখন আমি তীব্র ভাবে অনুভব করতাম, আমি এই মেয়েটারই। একান্তই তার ব্যক্তিগত কেউ৷ কিংবা যখন বৃষ্টি হতো, কিন্তু আমি তার পাশে থাকতাম না, সে আমায় ফোন করতো। ফোন দিয়ে খোঁজ নিতো৷ বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি দেখতে দেখতে আমার সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তা বলতো না৷ আমি বুঝতাম৷ চুপ করে থাকতাম৷ সে কথা বলতো৷ আমি জবাব দিতাম৷ বা আমি কথা বলতাম৷ সে জবাব দিতো৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অফিসের কলিগদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো৷ একটু চাপা স্বরে বা আকারে ইঙ্গিতে জানতে চাইতো, অফিসে মেয়ে কলিগ কতোজন৷ সরাসরি এটা বলতো না যে মেয়ে কলিগদের থেকে দূরে থাকবা৷ আমি বুঝতাম৷ হাসতাম৷ বলতাম,

-আমার সমস্তই একজনকে ঘিরে৷ আমি একজনকেই মনেপ্রানে চেয়েছি৷ ভালোবেসেছি৷ আমি এর অতিরিক্ত চাই না আর৷

মেয়েটা হাসতো৷ বলতো,

-আমি জানি৷ বলতে হবে না৷ 


মাঝে মাঝে তার সাথে মায়ের ঝগড়া হতো৷ কিন্তু সেই ঝগড়ার রেশ রাত পোহালেই গায়েব হয়ে যেতো৷ ভোর হলেই বউ শাশুড়ীর রান্নাঘরে সেই ঘুনঘুনিয়ে কথাবার্তা চলতোই৷ এদের বিবাদ বেশিক্ষণ থাকতো না৷ মাঝে মাঝে মা এসে ওকে টেনে নিতেন কিংবা মাঝে মাঝে সে৷ যতো আপদ যায় আমার উপর৷ এই মেয়ে আমার উপর রাগ করলে খুব সহজে সেই রাগ ভাঙ্গানো যায় না৷ আমার উপর যেন এই জিনিসটার বেশ কড়াকড়ি। তাকে মোটেও রাগানো যাবে না৷ রাগালে আমার খবর করে ছেড়ে দেয়৷ 


সব কিছুই বেশ সাবলীল সুন্দর ভাবে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ইদানীং তার আচরনে কেমন পরিবর্তন এসেছে৷ বেশ অমনোযোগী ছন্নছাড়া ভাব৷ এতো বেশি কথা বলে না৷ গাল ফুলিয়ে বসে থাকে৷ কিছু জিজ্ঞেস করলে হাসি মুখেই সব বলে৷ তবে আমি কেন জানি সেই হাসিতে প্রাণ খুঁজে পাই না৷ আমার অস্থির লাগে৷ আশ্চর্য! এই মেয়েটা এমন কেন হয়ে গেলো? 


রাতের দিকে তাকে বললাম,

-আজ অফিস ছুটি দিয়েছে৷ 

-ক'দিন?

-পাঁচদিন?

সে চট করেই হেসে ফেলল। বলল,

-এই ছুটি পেয়েই এতো খুশি?

-খুশি হবো না? মোটে ছুটি পাই না৷ আমি তো অফিস না গেলেই বাঁচি৷ বাসায় এতো সুন্দরী বউ রেখে অফিস যেতে কার ইচ্ছে হয়!

সে হাসে৷ কিছু বলে না আর৷ আমি তাকিয়ে থাকি৷ খুঁজি৷ মেয়েটার ভেতরে প্রশান্তি নেই কেন? তার হাসিতে প্রাণ খুজে পাওয়া  যায় না কেন? আমি বললাম,

-কাল গরু কিনতে যাবো৷ বাবার সাথে কথা হয়েছে৷ 

-বেশ! হাটে গেলে সাবধানে যেও৷ ভীড় থাকে অনেক৷ 

আমি হাসলাম। বললাম,

-তোমার কি মন খারাপ?

সে হাসি মুখে বলল,

-না তো৷ মন খারাপ হবে কেন?

-কে জানে! মনে হলো! চলো খেয়ে আসি৷ রাত হলো অনেক৷ 


আমরা দু'জনেই খেতে যাই৷ অন্যসব দিন গুলোর মতোই খাবারের টেবিলে সময় কাটে৷ আমাদের খাওয়া হয়৷ আমি খেয়ে এসে পিসি অন করি৷ ছোট্ট একটা কাজ বাকি আছে৷ সেটা করলেই আপাতত ক'দিন আরাম করা যাবে৷ 


তৃপ্তি এসে শুয়ে পড়লো। বলল সে শুয়ে যাবে৷ আমি যেন দ্রুত শুয়ে পড়ি৷ আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়। কিছু বললাম না৷ এরপর কাজে মনোযোগী হলাম৷ কাজ করার সময়টায় আমি লক্ষ্য করলাম তৃপ্তি কেমন ছটপট করছে৷ ঘুমাতে পারছে না৷ কেবল এপাশ ওপাশ করছে৷ আমি পিসি অফ করে উঠে গেলাম৷ সোজা বিছানায় এসে তৃপ্তির গা ঘেঁষে শুলাম। পেছনে থেকে মেয়েটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, 

-এবার ঘুমাও। 

সে আমার দিকে ফিরলো৷ আমার বুকের কাছে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলো৷ আমি বললাম, 

-মন খারাপ কেন?

সে ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,

-জানি না৷ 

আমি বললাম,

-সব ঠিক হয়ে যাবে৷ মাঝে এমন মন খারাপ হয়ই৷ এসব ব্যাপার না৷ ঘুমাও৷ 

তৃপ্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! কিছু সময় পরই ঘুমিয়ে পড়লো সে৷ আমার ঘুম এলো না৷ আমি গভীর চিন্তায় ব্যস্ত, আমার বুকের কাছে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা এই রাজকন্যাটার আজ মন খারাপ কেন? 


আমি কাছে ছিলাম বলেই হয়তো তৃপ্তির মন ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকলো৷ তবে ঠিক পরিপূর্ণ ভাবে ভালো নয়৷ কোথাও যেন কোনো অপূর্ণতা ঠিক রয়েই গেছে! মেয়েটা এখনই সম্পূর্ণ খুশি না৷ 


দেখতে দেখতে কোরবানির ইদ চলে এলো৷ ইদের দিন যারপরনাই ব্যস্ততা। বাসার সকলেই বেশ ব্যস্ত সময় পার করলো। তবে সকল ব্যস্ততা আর ক্লান্তির হিসেব চুকে যায় গরম গরম রুটির সাথে মাংস খাওয়ার সময়৷ খাওয়ার পর এক গ্লাস ঠান্ডা কোক যেন দেহের সকল ক্লান্তি আরো দ্রুত মুছে ফেলে৷ দেহে জাগায় নতুন এক সতেজতা। 


তৃপ্তিকে ব্যস্ত দেখলেও মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই দুঃখি লাগছে৷ যেন এই মেয়েটা একদম খুশি না৷ তার ভেতরে কোনো না কোনো অশান্তি রয়েই গেছে৷ ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ অস্থির৷ সে ভালো নেই৷ একদম ভালো নেই৷ আমি কিছু বললাম না৷ বিকেলের অপেক্ষা করলাম৷ 

আমাদের সকল কাজ দুপুরেই শেষ হয়ে গেল। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে বাসায় ফিরলাম। নিজের রুমে আসতেই দেখলাম তৃপ্তি শুয়ে আছে। আশ্চর্য! সে এখন শুয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ নাকি? আমি তাকে ডাকলাম,

-তৃপ্তি? 

সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো! ওপাশ ফিরে চোখের জল মুছল যেন। আমি অবাক হলাম! মেয়েটা কি কাঁদছে? বললাম,

-কি হয়েছে?

সে উঠে বসলো। বলল,

-কই? কী হবে?

আমি তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। তার চোখ কেমন লালচে হয়ে আছে। সদ্য কান্না করলে যেমন লালচে লাগে তেমন। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল খানিক। এই মেয়ে কেঁদে কেঁদে চোখের জল ভাসাবে অথচ আমায় বলবে না তার কী হয়েছে! বেশ! বলতে হবে না। কাঁদুক সে! আমার কী! আমার খানিকটা অভিমান জাগল। সেটা না প্রকাশ করে বললাম,

-এভাবে শুয়ে আছো দেখে মনে হলো! উঠো! খেতে দাও।

ও কিছু বলল না আর। সহজ ভঙ্গিতে উঠে গেল। যেন কিছুই হয়নি।


দুপুরে খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নেবার পর আমি বললাম,

-উঠো তো! 

ও বেশ অবাক হলো৷ বলল,

-কেন? 

-আহা উঠো না?

-কী হয়েছে?

-কিছু না৷ উঠে রেডি হও। আমরা একটু বাইরে যাবো৷ 

-আমার বেশ ক্লান্ত লাগছে। প্লীজ আজ না৷ 

-আজ না মানে? আজ একটা ইদের দিন৷ ঘুরতে না গেলে হয়?

-আমি যাব না৷ 

-না৷ উঠো৷ তোমাকে যেতে হবে৷ 

-এই অসময়ে জ্বালাতন করিও না তো! অসহ্য লাগছে!

-প্লীজ! রিকোয়েস্ট করছি। আজকের জন্যে কেবল।

কথাটা বলে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে কেমন বিরক্তি মাখা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে৷ আমি আবার অনুনয় করে বললাম,

-প্লীজ৷ 

সে কিছু বলল না৷ ক্লান্ত দেহ টেনে উঠে বসলো৷ আমি উঠে গিয়ে আলমারিটা খুললাম। ওর জন্যে কেনা নীল রঙের শাড়িটা বের করে বললাম,

-এটা পরো তো! 

সে চিৎকার দিয়ে উঠল। বলল,

-আমি এখন পাড়ি পরতে পারব না৷ 

আমি হাসলাম। বললাম,

-বেশ! তোমাকে কষ্ট করে পরতে হবে না৷ আমি পরিয়ে দিবো৷ তুমি কেবল দাঁড়িয়ে থাকবা।

সে বেশ ক্লান্ত স্বরে বলল,

-এমনটা না করলে হয় না?

-না৷ মোটেও হয় না৷ 

সে কেমন অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো৷ আমি বললাম,

-জাস্ট আজকের জন্যে!


তৃপ্তি উঠে এলো৷ ফ্রেশ হলো৷ আমি তাকে ধীরে ধীরে শাড়ি পরিয়ে দিলাম। তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে বললাম,

-আমি কাজল মাখতে জানি না৷ তোমার চোখে তুমি কাজল মাখো! তোমার কাজল লাগানোটা একদম পার্ফেক্ট লাগে আমার কাছে। 


তৃপ্তি কাজল মাখল৷ কিছু মেকাপ মাখলো মুখে৷ আমি নিজে তৈরী হয়ে নিলাম। তৃপ্তি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ছিল৷ আমি তার সামনে গেলাম৷ কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম৷ এরপর নিচু স্বরে বললাম,

-এই ঠোটে চুমু না খেলে আজ পাপ হয়ে যাবে আমার৷ 

ও হাসলো৷ বলল,

-খবরদার! লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে৷ 

আমিও হাসলাম। বললাম,

-তুমি আশ্চর্যরকম এক সুন্দরী! আমি যতোই দেখি ততোই মোহে পড়ি! 

ও হাসে৷ লজ্জাময় হাসি৷ ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আসে৷ আমি তার হাত ধরি৷ বলি,

-চলেন মহারানী! 

সে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়৷ আমরা রুম থেকে বের হই। বসার ঘরে বাবা মা বসে আছেন৷ আমরা তাদের সালাম দিলাম। মা বললেন,

-সাবধানে যাস৷ 

এই কথা বলে তিনি আমার দিকে দুটো শপিং ব্যাগ বাড়িয়ে দিলেন৷ এরপর মৃদু হাসলেন৷ আমিও হাসলাম। তৃপ্তি অবাক হলো। বাসা থেকে বের হতেই বলল,

-কী এখানে?

আমি বললাম, 

-গাড়িতে বসে বলব৷ 

-এখন বললে কী হয়?

-কিছু না৷ তুমি আমাকে একটা কিস দাওনি৷ এটা তার শাস্তি৷ 

-হুহ! আসছে শাস্তি দিতে৷ 

আমি হাসলাম৷ কিছু বললাম না৷ 


বাসার নিচে এসেই দেখলাম গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ ড্রাইভারকে দেখলাম সিগারেট ফুঁকছেন৷ আমাদেরকে দেখতেই বললেন,

-ভাই, ভেতরে গিয়ে বসেন৷ সিগারেটটা শেষ করে আসি৷ কী বলেন? 


আমি কিছু বললাম না৷ দু'জনেই গাড়িতে উঠে বসলাম। তৃপ্তি বলল,

-এবার বলো এখানে কী? 

-এখন না৷ গাড়ি ছাড়ুক৷ 

-এখনই বলতে হবে৷ তুমি বলেছো গাড়িতে উঠে বলবে! 

আমি খানিকটা সময় চুপ থাকলাম। এরপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-শ্বশুর বাড়ি যাবো, তাদের জন্যে গিফট না নিয়ে গেলে হয়? 

তৃপ্তি চট করেই কিছু বুঝল না৷ সে বলল, 

-কী?

-আমার তো এখন বাবা মা দু'জন না৷ চারজন৷ এখানে দু'জন আর মিরপুরে দু'জন৷ এখানে যারা আছে, এদের সাথে তো এতোক্ষন ছিলাম৷ বাকি সময়টা অন্য দু'জনের সাথে কাটাবো৷ এটা তো আমার দায়িত্ব তাই না? ইদের দিন বলে কথা! 

তৃপ্তি তাকিয়ে থাকলো৷ তার চোখে জল জমে গেল। সে ভেজা স্বরে বলল,

-তুমি বুঝতে পেরেছো?

আমি হাসি৷ বলি,

-আজ এতোগুলা বছর নিজের বাবা মায়ের সাথে ইদ করেছো! এই প্রথম তুমি তাদের ছাড়া ইদ করছো। স্বাভাবিক ভাবেই মন খারাপ হওয়ার কথা৷ আর তোমার মন খারাপ হলে আমি বুঝতে পারব না তা কি হয়! 

মেয়েটা এবার একদম কান্না করে দিলো৷ তার চোখের কাজল কেমন লেপ্টে যেতে থাকলো। আমি বললাম,

-বলি মন খারাপ হলে অন্তত একটু আধটু তো বলা উচিৎ নাকি? না বললে কীভাবে বুঝব বলো তো? তুমি জানো, এটার খোঁজ লাগাতে কতোটা বেগ পেতে হয়েছে আমাকে? শেষে মা আমাকে হেল্প করলেন৷ বললেন বিয়ের পর একটা মেয়ের জন্যে বাবা-মা বা নিজের ফ্যামিলি ছাড়া ইদ করাটা কতোটা কষ্টকর। তখনই বুঝলাম তোমার আসলে এতো মন খারাপ কেন হয়েছে। তুমি তাদের ভীষণ মিস করছিলে তাই না?

তৃপ্তি কিছু বলল না। কিছু বলতে পারলো না যেন৷ তার চোখের কোনা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো৷ সে ভেজা চোখে কিছু সময় দেখলো আমায়৷ এবং হুট করেই আমার ঠোঁটে চুমু খেলো৷ এরপর খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ জড়িয়ে ধরেই সেকি কান্না তার৷ আমি বললাম,

-তোমার লিপস্টিক নষ্ট হয়ে গেল না? 

সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-রাখো তোমার লিপস্টিক! তুমি জানো না আজ আমি কতোটা খুশি হয়েছি। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটা চাপা যন্ত্রণা চট করেই ভ্যানিশ হয়ে গেছে! এতো প্রাশান্তি লাগছে যা বলার মতো না৷ 

আমি হাসলাম। বললাম,

-তোমার খুশিই আমার জন্যে অনেক৷ এই খুশিটুকুর জন্যেই এতো কিছু করা ম্যাম! 


তৃপ্তি আর কিছু বলল না৷ আমাকে আরেকটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ আমি টিস্যু বের করে ঠোঁট মুছে নিলাম। রঙিন ঠোঁট দেখলে শ্বশুরবাড়িতে ইজ্জত থাকবে না৷ 


ড্রাইভার সাহেব এসে আমাদের এই অবস্থায় দেখে মুচকি মুচকি হাসলেন৷ তবে পেছন ফিরে তাকালেন না৷ গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলেন৷ আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো আমার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে! 

.

গল্পঃ অনুভূতির শব্দ হয় না৷ 

.

ভুলত্রুটি মার্জনীয়

-তাসফি আহমেদ।



আমার সকল গল্পের লিংক। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url