বাংলা গল্পঃ আকাশে মেঘের উত্থান | লেখক - তাসফি আহমেদ | বাংলা গল্প

 বাংলা গল্পঃ আকাশে মেঘের উত্থান | লেখক - তাসফি আহমেদ | বাংলা গল্প

গল্পঃ আকাশে মেঘের উত্থান | লেখক - তাসফি আহমেদ | বাংলা গল্প
গল্পঃ আকাশে মেঘের উত্থান | লেখক - তাসফি আহমেদ | বাংলা গল্প

বাংলা গল্পঃ আকাশে মেঘের উত্থান

লেখক - তাসফি আহমেদ


-কোন জিনিস মানুষকে মানুষ বানায়, বলতে পারবে রায়হান?

রায়হান চুপ থাকলো। কোনো কথা বলল না৷ কেবল চেয়ে থাকলো ছেলেটার দিকে৷ রায়হানের মৌনতা দেখে ছেলেটা মৃদু হাসলো। এগিয়ে এসে রায়হানের কাঁধে হাত রাখলো। বলল,
-জীবনে প্রথম এমন প্রশ্ন শুনছো নাকি? এতো ঘাবড়ে যাবার কী হলো? এটা তো এতো জটিল প্রশ্ন না৷
রায়হান বোকার মতো হাসলো। তার হাসি ফ্যাকাসে৷ হাসিতে রঙ নেই! সে যেন অনেক কিছুর হিসেব মেলাতে পারছি না৷ যেন তার মাথা ঘুলিয়ে গেছে৷ সে ঠিকঠাক কিছুই বুঝতে উঠতে পারছে না৷
ছেলেটা এগিয়ে গেল বিপুলের দিকে। বিপুলের ভ্রু কুচকে আছে। তাকেও বেশ চিন্তিত মনে হলো! ছেলেটা বলল,
-আজ কেমন কালেকশন হলো বিপুল?
বিপুল পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। বলল,
-হইসে মোটামুটি।
ছেলেটা দান বক্সের দিকে তাকালো! পূর্বের সেই বক্সটি৷ যার গায়ে লিখা 'রমজান উপলক্ষে হতদরিদ্রদের সহয়তা করুন। আপনার এক টাকা কারো খুশির কারন হতে পারে।' কারণের বানানটাও সঠিক নয়! ছেলেটা রায়হানের দিকে চেয়ে বলল,
-বানানটা এখনো ঠিক করোনি কেন? এতো গাফেলতি করছো কেন রায়হান? ব্যবসা তো লাটে যাবে!
রায়হানের ভ্রু কুচকে এলো। তাও কিছু বলল না৷ ছেলেটা দান বক্সটা নিজের হাতে নিলো! এরপর সামনে এগিয়ে গেল! রায়হান কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দেখলো ছেলেটাকে৷ সে দেখলো এই গরমে স্যুট-কোট পরা একটা ছেলে একটা দান বক্স নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ কী এক অদ্ভুত দৃশ্য! যে ছেলের থাকার কথা কোনো বিলাসবহুল অফিসের কোন এক কর্নারের বিশাল এসিওয়ালা রুমে, সেই ছেলে কি না পথে পথে দানবক্স নিয়ে ঘুরছে? রায়হান মনে মনে আওড়ালো, 'দুনিয়াটা কি বদলে যাচ্ছে?'
-এই রায়হান? জলদি আসো৷ জ্যাম ধরেছে৷ ভালো কালেকশন করা যাবে৷ আসো।
রায়হান ধীর পায়ে এগিয়ে গেল৷ তার পেছন বিপুল৷ বিপুল চাপাস্বরে বলল,
-ওস্তাদ? ঘটনা কী? এই লইয়া তিনবার হইলো! আমরা যহনই টাকা তুলতে আসি তখনই কোত্থেকে যেন পোলাডা আইসা পড়ে৷ পুলিশ টুলিশ বাকি? আমাগোরে ধইরা লইয়া যাইব?
রায়হান কিছু বলল না৷ সে কেবল এগিয়ে যেতে থাকলো! ব্যাপারটা নিয়ে সে নিজেও বেশ চিন্তিত৷ এই নিয়ে তিনবার! সে দান বক্স নিয়ে টাকা তুলতে এলেই কোত্থেকে যে এ-ই ছেলেটা এসে পড়ে৷ নাম ধাম জানা নেই! সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ! তাও কেন জানি এসে রায়হানকে একই প্রশ্ন করবে, 'কোন জিনিসটা মানুষকে মানুষ বানায় রায়হান?' ব্যাপারটা প্রথমে কাকতালীয় ভাবলো রায়হান। কিন্তু আজ ফের দেখা হওয়াতে খানিক খটকা লাগলো তার৷ ছেলেটা আসলে কে? চায় কী? ওদের সাথেই বা কেন দেখা হচ্ছে ছেলেটার? আরো অনেকেই তো টাকা তোলে। তাদের সাথে কেন হচ্ছে না? তাছাড়া আজ ছেলেটার একটা কথায় খানিকটা টেনশনেই পড়ে গেল সে৷ আজ হঠাৎই ছেলেটা ব্যবসার কথা বললো! গরীবদের জন্যে টাকা উঠানো কি কোনো ব্যবসা নাকি? ছেলেটা এই কথাটা বলল কেন? সে কি কিছু টের পেল?
.
অরুনি জানালার গ্লাসটা উঠিয়ে দিয়ে বেশ বিরক্তি নিয়েই বলল,
-আঙ্কেল, এসিটা চালিয়ে দিন তো! এই জ্যামের যন্ত্রণায় বাঁচলাম না। অসহ্য!
ড্রাইভার আঙ্কেল এসি চালিয়ে দিলেন৷ অরুনি বিরক্তি মাখা চোখে বাইরে তাকালো। তাকাতেই সে ছেলেটাকে দেখলো। অদ্ভুত দৃশ্য৷ এই নিয়ে তিনদিন সে একই দৃশ্য দেখছে৷ একই সময়েই৷ সময়টা ঠিক সন্ধ্যার এক ঘন্টা আগে৷ তবে প্রতিদিন না৷ সে অবাক নয়নে চেয়ে রইলো! সুদর্শন একটা ছেলে! যে কি না এই গরমে জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি গাড়ির নিকট যেয়ে ভিক্ষা চাইছে? অরুনি কিছুটা সময় নিজের ভাবনায় হারিয়ে গেল। ভিক্ষা চাইছে বলাটা কি ঠিক হয়েছে? যদি না হয় তবে তার কী বলা উচিৎ ছিল?
অরুনি বেশ কিছু সময় ছেলেটাকে দেখলো। কেন দেখলো সে জানে না৷ তার যেন কোনো ইচ্ছেই ছিল না দেখার৷ তাও সে দেখলো! সে নিজে নিজেই খানিকটা লজ্জা পেলো! সে জীবনে কোনো ছেলেকে এভাবে দেখেনি! এভাবে আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকেনি! কেন জানি এই ছেলেটাকেই দেখছে৷ এমনকি আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে৷ অদ্ভুতরকম ভাবে ভালো লাগছে৷ অথচ সে কখনই পুরুষ মানুষকে এতোটা গুরুত্ব দেয়নি! বরং তাদেরকে হেয় করেছে৷ তার কাছে সব সময়েই মনে হতো পুরুষ মানুষ হচ্ছে সুবিধাবাদী এবং সুযোগ সন্ধানী। তাদের কেবল প্রয়োজন একটা পরিপুষ্ট নারী দেহ৷ আর কিছু না৷
অরুনি আসলেই কোনো পুরুষকে বিশেষভাবে তোয়াক্কা করে না। সে সব সময়েই এই বিষয়টি এড়িয়ে এসেছে৷ এমনকি তার সাথে কেউ খানিকটা ঘনিষ্ঠতা করতে এলেও সে রেগে যায়। সে একদমই পছন্দ করে না এসব৷ একবার তার অফিসের একজন কর্মি তার সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলতে চেয়েছিলো। একটু ঘনিষ্ঠতা করতে চাইলো এবং পরের দিনই সে অফিস কর্মির চাকরি চলে গেল৷ এরপর থেকে ওর অফিসের কোনো কলিগ ওর সাথে খুব একটা কথাও বলে না৷ বরং তারা চেষ্টা করে কথা যতোটা সম্ভব কম বলার। সেই অরুনি আজ নিজের গাড়ির জানালার এপাশ থেকে একটা ছেলের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকছে, ব্যাপারটা সত্যিই অবাককর৷
অরুনি খানিক চমকে উঠলো! সে যেন খানিকটা ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা ওর গাড়ির জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে৷ জানালায় টোকা দিচ্ছে৷ সে খানিকটা অবাক হলো। আগের দু'দিন এরা ওর কাছে টাকা চাইতে আসেনি। এমনকি ওর গাড়ির কাছেও আসেনি৷ এসে কূল পায়নি হয়তো। কারণ ততোক্ষনে জ্যাম ছেড়ে দিতো! আজ অরুনির গাড়ি একদম প্রথম দিকেই ছিল! তাই-ই হয়তো ওর কাছে দ্রুত এলো ওরা। অরুনি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ছেলেটাকে দেখলো৷ মৃদু হাসলো! বলল,
-কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
ছেলেটা মাথা নামিয়ে আনলো জানালার কাছে৷ অরুনির দিকে চাইলো৷ অরুনিও ঠিক চেয়ে রইলো৷ তাদের সাময়িক চোখাচোখি হলো! ছেলেটা সামান্য হেসে বলল,
-আমরা দরিদ্র মানুষদের জন্যে টাকা তুলছি! এই টাকায় আজ তাদের ইফতার করানো হবে৷ আপনি যদি আমাদের সাথে এই আয়োজনে সামান্য অবদান রাখতেন তবে আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
অরুনি প্রথম কিছু সময় কোনো জবাব দিলো না৷ সে যেন জবাব দিতে পারলো না৷ খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বলল,
-আপনারা যে এই টাকা গরীবদের মাঝেই বিলাবেন তার গ্যারান্টি কী?
-আমরা কথা দিচ্ছি। আমাদের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন৷
-কথা দিলে তো হবে না৷ আমাকে প্রুভ দিতে হবে৷ প্রুভ দিলে আমি অবশ্যই অবদান রাখব এন্ড ট্রাস্ট মি, আমি কখনো কোথাও ছোটখাটো অবদান রাখি না৷
ছেলেটা মাথা তুলে রায়হানের দিকে চাইলো! বলল,
-ম্যামকে প্রমাণ দেখাও রায়হান৷ ভাগ্য ভালো থাকলে আজ তোমার কপাল খুলে যাবে৷
রায়হান লালায়িত চোখ নিয়ে এগিয়ে এলো৷ বলল,
-বিশ্বাস করেন মেডাম! আমরা অনেকদিন ধরেই এই কাজ করছি৷ আমরা এই রমজানে এই যাবত প্রায় দেড়'শতাধিক মানুষকে ইফতার করিয়েছি। তাদেরকে এক বেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি! রোজা রমজানের দিন মেডাম৷ পবিত্র মাস। পবিত্র মাসে কেউ এমন প্রতারণা করবে না৷ আমি নিজেও রোজা রাখসি৷ আমার রোজার কসম! রোজা মুখে মিথ্যা কইলে আমার পাপ হইবো৷ এতো বড় পাপের বোঝা আমি বইতে যাব কেন অযথা? আপনিই বলুন! কেন যাব? তাছাড়া এই ছবি গুলো দেখেন! এগুলোয় দেখবেন আমরা কতো সুন্দর করে ইফতারের আয়োজন করি! কীভাবে তাদেরকে সাহায্য করি৷ দেখেন মেডাম!
রায়হান নিজের ফোনটা অরুনির দিকে বাড়িয়ে দিলো! অরুনি দেখলো কিছুক্ষন৷ তার ভ্রু কুচকে এলো! সে রায়হানের দিকে চেয়ে বলল,
-এই ছবি গুলো আপনাদের?
-জি মেডাম!
অরুনি কিছু বলল না! সে তার মোবাইল বের করলো! এরপর ফেসবুকে ঢুকে কি যেন খুঁজতে লাগলো৷ এর অল্প কিছুক্ষন পরই সে গাড়ির ভেতর থেকে রায়হানকে কষে একটা চড় মারলো! চড়ের শব্দে রায়হান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল! সে গালে হাত দিয়ে বলল,
-কী ব্যাপার মেডাম! মারলেন ক্যান?
অরুনি চিৎকার করে বলল,
-এই শালা! এই প্রতারকের বাচ্চা দাঁড়া তুই! ড্রাইভার আঙ্কেল? নামেন তো! ধরেন এরে৷ কুত্তার*** গুলো ভুলভাল ছবি দেখিয়ে মানুষকে ধোকা দিচ্ছে! প্রতারিত করে টাকা মেরে খায়! দাঁড়া ছবি তুলি তোদের! আমি মামলা দিব তোদের নামে৷ দাঁড়া!
অরুনি ফোন বের করে ছবি তুলতে থাকলো! রায়হান ওর হাত থেকে নিজের ফোনটা নিতে চাইলো! নিতে পারলো না! অরুনি শক্ত করে ফোনটা ধরে রেখেছিলো! রায়হান বেশিক্ষন দেরি করলো না। যখন দেখলো ফোন নিতে পারছে না তখন সে দৌড় দিল! আকাশ এবং বিপুল ততোক্ষন দৌড়ে পালিয়েছে। অন্যান্য গাড়ি থেকে লোকজন ততোক্ষনে নেমেও গিয়েছিলো! কয়েকটা যুবক তাদের পিছন দৌড়ে গেল! অরুনি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো! রায়হানদের গমন পথের দিকে চেয়ে থাকলো আর রাগে ফুলতে থাকলো সে! তার মুখ, নাকের ডগা, কেমন লালচে হয়ে গেল! সে কঠিন স্বরে বলল,
-তোর সবাই এক শালা! তোদের রক্তেই প্রতারণা আছে৷ শালা বাস্টা*।
.
বিপুল একটা চিপা গলির ভেতর ঢুকে নিজেকে আড়াল করে নিলো৷ কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। অসম্ভব হাঁপাচ্ছে সে৷ মনে হচ্ছে তার সকল শক্তি গায়েব হয়ে গেছে৷ শরীরে আর এক ফোটাও বল নেই! সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকলো! খানিক পরই সেখানে রায়হানকে দেখতে পেলো সে৷ দেখতে সে চাপা স্বরে ডাকলো,
-ওস্তাদ?
রায়হান ওকে দেখতেই এগিয়ে এলো৷ কাছে সে বিপুলকে ঠেলে সামনে এগোতে ইশারা করলো৷ তারা দু'জন এই গলিটা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল৷ এটা ওদের পরিচিত গলি। এখান দিয়ে ঠিক সোজা গিয়ে বাঁ'পাশের গলি দিয়ে ঢুকতে পারলেই হলো। আর কোনো রিস্ক নেই! অল্প কিছু পরেই তারা তাদের এরিয়াতে পৌঁছে গেলো! সেখান পৌঁছে দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ হঠাৎ বিপুল চিৎকার দিয়ে উঠলো! সে চট করেই পেছন ফিরে তাকালো! দ্রুত গিয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে তাদের ফেলে আসা পথের দিকে চেয়ে থাকলো! নাহ! নেই! তার চোখ যাকে খুঁজছে সে নেই! নেই তাহলে গেল কই? ধরা খাইলো নাকি? বিপুল দৌড়ে এলো রায়হানের কাছে,
-ওস্তাদ?
রায়হান ততোক্ষনে টং দোকানের পাতা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। সে বিপুলের ডাকে সায় দিলো না৷ চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলো!
-ওস্তাদ! পোলাডা কই?
রায়হানের ভ্রু কুচকে উঠলো! সে চোখ মেলে চাইলো বিপুলের দিকে। এরপর আশপাশে দেখলো! আসলেই তো! ছেলেটা তো এখানে থাকার কথা৷ নেই কেন? গেল কই? ওর স্পষ্ট মনে আছে, বিপুল আর ছেলেটা একসাথে দৌড়াচ্ছিলো! তাহলে? গেল কই? কেউ ধরে ফেললো নাকি? আশ্চর্য ব্যাপার তো! ধরলে তো ওর দেখার কথা৷ কিন্তু রায়হান তো কিছুই দেখলো না৷ রায়হান বলল,
-গলির মুখে যায়ে দেখতো আবার! আসছে কি না! তোর লগেই তো ছিল! দেখিসনি তুই?
বিপুল দৌড়ে গেল গলির মুখে৷ দ্রুত ফিরে এলো শূন্য চোখে, বলল,
-নাই অস্তাদ৷ আমার লগেই তো ছিল! গেল কই? কেউ ধইরা ফেলসে?
রায়হানকে একটু চিন্তিতই লাগলো! সে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলো! আশ্চর্য ব্যাপার। ছেলেটা গেল কই? ধরা খাইলো নাকি? আহারে! বেচারা! অযথাই ওদের সাথে হেঁটে, সাহায্য করতে এসে ধরাটা খেয়ে গেলো! ভালোই হইসে৷ শিক্ষা হবে৷ কে বলল এতো সাহায্য করতে আসতে? রায়হান তো সাহায্য চায়নি৷ তাও কেন এলো৷ তাও আবার তিন তিন বার? ছেলেটা ধরা খেলেও কোনো সমস্যা নেই! রায়হানের আসল পরিচয় জানে না ও৷ তাই পুলিশকে বলে দেওয়ার ভয় নেই! তাও রায়হান ছেলেটাকে নিয়ে ভাবছে৷ কেন জানে না সে, তাও তার একটু মন ভার হচ্ছে৷ আচ্ছা, ছেলেটার জন্যে কি রায়হানের মায়া হচ্ছে? হওয়ার তো কথা না৷ চোর বা প্রতারক, এই ধরনের লোকদের কি কোনো মায়া আছে? মমতা বলতে কিছু আছে? এদের কি কারো জন্যে মায়া লাগে?
.
রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে রায়হান বাসায় ফিরলো৷ তার মন বেজায় খারাপ। মন খারাপের কারণটা স্পষ্ট নয়৷ একবার মনে হচ্ছে ওই ছেলেটার জন্যে মন খারাপ৷ আবার মনে হচ্ছে না, ঠিক ওই ছেলের জন্যে না৷ দান বক্সে যে টাকা গুলো ছিল ওগুলোর জন্যে৷ ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷ সে আনমনে দরজায় টোকা দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল! সে বেশ অবাক হলো! আশ্চর্যজনক ব্যাপার! শারমিন জেগে আছে! এখনো? কীভাবে? এই মেয়ে তো দশটা বাজেই ঘুমিয়ে পড়ে৷ প্রতিদিন রায়হানকে দরজার কাছে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক ডাকাডাকির পর শারমিনের ঘুম ভাঙ্গে৷ তার আবার ঘুম অনেক ভার৷ ডেকে গলা ফাটালেও সহজে ঘুম ভাঙ্গে না৷ আশপাশের প্রতিবেশীরা বিরক্ত হয়৷ পাশেই একটা ঘর আছে৷ মতিন মিয়ার ঘর৷ তার বাবা বৃদ্ধ মানুষ। নাম রতন আলী। রতন আলীর রাতে ঘুম হয় না৷ তিনি নানান রোগে আক্রান্ত। তার মধ্যে একটা রোগ হলো রাতে জেগে থাকা৷ রায়হানকে তিনি রাইন্না বলে ডাকেন৷ রায়হান যখনই বাসায় এসে ডাকাডাকি করে, তখনি তিনি তার রুমের জানালা খুলে দেন৷ খুলেই জোরে হাঁক ছাড়েন,
-ওই রাইন্না, জুডির পোয়া, এতো রাইতে কোত্তে আয়োস? কোন আসরে যাস? তোর বাপের লগে একবার জুয়া খেলছিলামনে! হেয় হারসে৷ টেকা দেওনের কথা ছিল! দেয় না৷ তোর বাটপার বাপ টেকা না দিয়াই মরসে৷ এহন আমার টেকা লাগব! দে, টেকা দে! তুই দিবি টেকা৷ তোর বাপের টেকা এহন তুই দিবি! না দিলে তুরে খুন করে ফেলাম! ওই রাইন্না! এনে আয় কইতাসি!
এই বৃদ্ধের হাঁকাহাঁকিতে মতিনের ঘুম ভাঙ্গে৷ মতিনের বউ বেজায় গোসসা করে৷ সে রায়হানের পরিবারকে দুই চোখেও দেখতে পারে না৷ তাই গালমন্দ শুরু করে।
রায়হানের ছোট্ট ছেলেটা ওদের বাসার দিকে গেলেই চেঁচায় মতিন মিয়ার বউ৷ তার ছেলের সাথে মিশতে দেয় না৷ রায়হানের ছেলে, নাম রুদ্র, তারই সমবয়সী মতিনের ছেলে, নাম লিখন৷ দু'জনেই বেশ ভালো বন্ধু৷ এখানকার প্রায় দেয়ালেই দু'জনের নাম লিখা - রুদ্রলিখন৷ এরা দু'জন একসাথে পুরো বস্তিটা চরে বেড়ায়! যদিও এদের বন্ধুত্ব বড়ই অপছন্দ মতিনের বউয়ের কাছে, তাও তারা আড়াল হয়ে সব দুষ্টামি করেই বেড়ায়!
রায়হান অবাক চোখে চেয়ে থাকলো শারমিনের দিকে৷ সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ সে অবাক স্বরে বলল,
-শারু, ঘুমাওনি এহোনো? জাইগা আছো ক্যান?
শারমিন এগিয়ে আসে। বলে,
-একটু বাইরে আইসা বইবা? আসো! চান্দের আলোয় বসি৷
রায়হান অবাক হলো। শারুর গলার স্বর কেমন ভারী৷ ভেজা ভেজা৷ মেয়েটা কী এতোক্ষন কান্না করছিলো? শারমিন বাইরে এসে বসলো৷ মাটি দিয়ে সিড়ি করা আছে দরজার সামনে৷ সে ওখানে বসলো৷ তার পাশে এসে ক্লান্ত দেহটা ছেড়ে বসলো রায়হান৷ পরিষ্কার আকাশ৷ বিশাল চাঁদ৷ চাঁদের আলোয় সমস্ত বস্তিটা কেমন আলোকিত হয়ে আছে। বস্তিটাকে কেমন রূপালি বস্তি মনে হচ্ছে৷ এমন এক রূপালি বস্তি, যার দাম কল্পনায় অনেক, অথচ বাস্তবে এর অবস্থান এবং এর মানুষ, নিতান্তই মূল্যহীন। রায়হান মতিনের ঘরে দিকে চাইলো! আজ বুড়োটা নেই? জানালা খুলছে না কেন? অন্য সময় তো একটু শব্দ হলেই জেগে যায় লোকটা৷ আজ হঠাৎ কী হলো? রায়হান সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শারমিনের দিকে চেয়ে বলল,
-কি ব্যাপার? রতন আলী কই আইজ? কথাবার্তা নাই যে?
শারমিন জবাব দিলো না৷ সে কেমন রোবটের মতো বসে রইলো! রায়হান কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠলো! সে শারমিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-শারু?
হঠাৎ কি জানি হলো, শারমিন ডুকরে কেঁদে উঠলো! রায়হান একদম হতভম্ব হয়ে উঠলো! সে দ্রুত শারমিনের কাছে এসে বলল,
-এই শারু? কি হইসে তোর? কান্দস ক্যান?
শারমিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না৷ সে রায়হানের বুকের উপর ঝাপটে পড়লো! ওকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকলো৷ সে কি ভীষণ কান্না! রায়হানের অবাকের সীমা রইলো না৷ সে কেবল হতভম্ব হয়ে শারমিনকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলো৷ চাপা স্বরে বলে উঠলো,
-কী হইলো রে তোর?
শারমিন জবাব দিলো না৷ সে কেবল কেঁদেই গেল! রায়হান যেন কিছু আঁচ করতে পারলো। তার গলা বেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো! হঠাৎই কেন জানি, তার চোখ চকচক করে উঠলো! নিজের প্রতি কেমন এক ঘৃণা তৈরী হলো৷ হয়তো সে-ই পৃথিবীর একমাত্র স্বামী, যে তার স্ত্রীকে চুরি করার জন্যে উৎসাহ দেয়৷ জোর করে৷ চুরি না করলে মারার হুমকি দেয়! কিন্তু তারও বা কী করার! তার বিশেষ কোনো রুজি নেই! অর্থের অভাব! তার স্ত্রী একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে৷ সেখান থেকে যা পায় তা দিয়েই চলেই সংসার৷ ঠিক চলে না৷ রায়হানের গরীব দুঃখিদের জন্যে তোলা টাকা দিয়েও সংসারের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ হয় না৷ তারউপর দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দাম! সবই যেন সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো! এদিকে সামনে ঈদ৷ ছেলের নতুন জামাকাপড়ের আবদার! তারউপর সংসারের খরচ! এইসব হিসেব কোনো ভাবেই মিলাতে পারছিলো না রায়হান৷ তাই বলতে গেলে বাধ্য হয়েই রায়হান স্ত্রী'কে চুরি করতে বলল! এবং নিজে রমজান জুড়ে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলো হতদরিদ্রদের নামে। আজ আবার সেখানেও তালা পড়লো! যেই টাকা গুলো উঠলো, সেগুলো তো জলে গেলোই, তারউপর মামলার ভয়ের একটা বাড়তি চাপ আছে তার মাঝে! যদি ওই মেয়েটা সত্যি সত্যি মামলা দিয়ে দেয়? তাহলে? কী হবে? রায়হান আর কিছুই ভাবতে পারলো না। সে আরেকটু শক্ত করে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে৷ দুইটি ব্যর্থ দেহ, একে অপরকে আঁকড়ে ধরে থাকে অনেকক্ষন। অনেকক্ষন তাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না! কেবল দেহের আলাপ চলতে থাকে। দু'দেহে কষ্টের আলাপ চলতে থাকে।
.
অনেকটা সময় পর শারমিন স্বাভাবিক হয়ে আসে৷ সে রায়হানের দিকে চেয়ে দেখে সেও কাঁদছে৷ সে অবাক হয়! স্বামীর চোখে আজ পর্যন্ত কোনো পানি দেখেনি৷ তার বুকের ভেতরটা কেমন মুছড়ে উঠে৷ সে কাছে এসে রায়হানের চোখ মুছে দেয়! বলে,
-তুমি কান্দো ক্যান?
রায়হান কিছু বলে না৷ চেয়ে থাকে তার প্রিয় শারুর দিকে৷ শারমিন বলে উঠে,
-আইজকে কী ঘটছে জানো?
রায়হান জবাব দিলো না! সে কেবল চেয়ে থাকলো! ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকালো শারুর দিকে৷ শারমিন আবার বলে,
-আমি বাসায় ফিরতাছিলাম! ওলির মোড়ে আসতেই মনে হইলো আমার পেছন পেছন কেউ আইতাছে৷ আশ্চর্য লাগলো৷ এমন কহনো হয় নাই! আইজ হঠাৎ ক্যান এমন মনে হইতেসে? আমি পেছন ফিরা চাইলাম। দেখলাম একটা পোলা আমার দিকে আইতাছে৷ আমি বড় ভয় পাইয়া গেলাম! চোখ ফিরায়া যখনই দ্রুত হাঁট ধরছিলাম তখনই পেছন থেইক্কা কেউ ডাক দেয়৷
-শারু?
আমি মেলা অবাক হই! এই নামে কেবল তুমিই ডাকো৷ আর কেউ না৷ কেউ তো জানারও কথা না৷ তাহলে পেছনের লোকটা জানলো ক্যাম্নে? আমি ভাবলাম তুমিই৷ আন্দারে চিনতে পারি নাই৷ আমি পেছন ফিরা চাই৷ দেখি পোলাডা একদম কাছে চইলা আসছে৷ চিনি না৷ অপরচিত। তবে গায়ের জামাকাপড় দেইখা মনে হইলো বড়লোকের পোলা! কিন্তু আমার কাছে হেয় চায় কি? আর শারু নামটাও বা ক্যাম্নে জানলো? ছেলেটা একটু দূর থেকেই কইলো,
-শারু যেয়ো না৷ দাঁড়াও। যা নিয়েছো ফেরত দাও৷
আমি আচমকা দাঁড়ায় গেলাম। কলিজাটা কাঁইপা উঠলো জানো!? গলা যেন শুকিয়ে গেলো নিমিষেই। আমি রোবটের মতো দাঁড়ায় গেলাম! পোলাডা কাছে আইসা বলে,
-শারু, পৃথিবীটা এতোটাও জটিল না৷ এখানে বেঁচে থাকা যায়। এখনো এখানে একটু শান্তিতে বেঁচে থাকা সম্ভব৷ তার জন্যে একটু ধৈর্য্য, ত্যাগ এবং পরিশ্রম লাগে৷ এর সবই সঠিক এবং সত্য উপায়ে হতে হবে৷ শর্টকাট, চুরিচামারি করে যদি বড় লোক হওয়া যেতো তবে কি তোমাদের বস্তিটার চেহারা এমন হতো? বলো আমাকে? সেখানের সবাই কি বড় লোক হয়ে যাওয়ার কথা না?
আমি বেজায় অবাক হইলাম। বললাম,
-মানে কি? কী বলতে চাইতাছেন আপনি?
-আমি বলতে চাচ্ছি সত্য বলো! পরিশ্রম করো! তুমি বেশ উদ্যোমি মেয়ে৷ মেধাবি এবং কাজে ও কথায় পটু৷ তোমাকে সবাই ভালো জানে৷ বিশেষ করে তোমাদের ফ্যাক্টরির সবাই৷
-আমি সত্যই বলি এবং পরিশ্রম করি।
হেয় আমার কথা শুনে হাসে৷ বলে,
-কারো মোবাইল চুরি করাকে তুমি কেমন পরিশ্রম করা বলবে বলো?
আমি অবাক হই৷ হ্যাবলার মতোন চাইয়া থাকি! আমি জানি না কি হইলো আমার, চোখ থেইক্কা অনর্গল পানি পড়তে থাকে। আমি তখন কিছু কইতে পারি নাই! ছেলেটা আবার কয়,
-যাও, সত্য বলো এবং জীবনকে সুন্দর করো৷ তুমি জানো, নিশ্চয়ই সত্য মানুষকে মুক্তি দেয় এবং পরিশ্রম দেয় সুখ৷
আমি কিছু কইতে পারছিলাম না৷ চোখ দিয়া খালি পানি পড়তাসিলো৷ হেয় আবার কইলো,
-আমি যদি চাই তাহলে এই মূহুর্তে তোমাকে আমি ধনী বানিয়ে দিতে পারি৷ তোমাকে বাড়ি গাড়ি সবই দিতে পারি৷ কিন্তু একটা জিনিস জানো কী, নিজের করা, আর অন্যের দানে পেয়ে বসা জিনিস গুলোর মাঝে আকাশপাতাল পার্থক্য। তুমি যদি এভাবেই সব পেয়ে যাও তবে তোমার কাছে পরিশ্রমের মূল্য কমে যাবে৷ তুমি অপেক্ষা করবে আমারই, কিংবা আমার মতো কারোর যে তোমাকে এমনই বিশাল কিছু দান করবে৷ অথচ একটা সময় ঠিকই তুমি বুঝতে পারবে যে তোমার সাথে এমন কিছুই আর হবে না৷ কখনই হবে না৷ তখন বেশ দেরি হয়ে যাবে৷ শোনো, পরিশ্রম করো৷ কিছু করার চেষ্টা করো৷ নিজেদের জন্যে কিছু করো৷ নিজেদের জন্যে না হলেও, তোমার সন্তানের জন্যে করো৷ তার ভবিষ্যতের জন্যে করো৷ টাকা জমাও৷ দোকান দাও! যা ইচ্ছে! জাস্ট কিছু জিনিস খেয়াল রাখবে, ঠকাবে না কাউকে। সত্য এবং সততা অবলম্বন করবে, অন্যায় বা নিষিদ্ধ কাজে জড়াবে না এবং নিজের স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে৷ ভালো থাকো! আবার দেখা হবে কখনো! যদি বেছে নাও ভুল পথ! কারণ আমি কখনই পছন্দ করি না, একজন ভালো মানুষ সামান্য অর্থকষ্টে ভুল পথে সুখ চেয়ে বসুক৷ আমি সৎ মানুষের প্রতিটা ভুলে উপস্থিত হবো৷
শারু থামলো। কিছুক্ষন সময় নিলো সে৷ সে কাঁদছে না এখন আর৷ তবে চোখ ভেজা মনে হচ্ছে৷ রায়হান বলে উঠলো,
-শারু? পরে? পরে কী হয়েছে?
শারমিন একটু সময় নেয়৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-ছেলেটা চইলা যায়! আমার হঠাৎ কী হয় জানি না৷ আমি গার্মেন্টসে ফিরা যাই৷ গিয়ে দেখি হুলুস্থুল অবস্থা৷ সবাই ক্যান জানি এক হয়া দাঁড়ায় ছিল! আমাগো ম্যানেজারও সেখানে ছিল। আমি সোজা তাগো সামনে সায়ে দাঁড়ায়৷ জানো, আমার তহন একটুও ভয় লাগে নাই! ক্যান জানি মনের মইদ্ধ্যে এক শান্তি কাজ করতাসিলো৷ কি অদ্ভুত সুখ। আমি যহন যাচ্ছিলাম, সবাই আমার দিকে চাইয়া ছিলো৷ আমি কিছু কইলাম না৷ মাথা নামায় গেসিলাম। ফোন দুইটা যেগো ছিলো হেগোরে দিয়া মাথা নওয়াইয়া কইলাম,
-আমি জানি আমি ভুল কাজ করতাসিলাম। আমার এমনটা করা ঠিক হয় নাই! কিন্তু কি করমু কন! যেই টেকা পাই, এতে কিসসু হয় না৷ সংসার চলে না৷ তাই বাধ্য হইয়া এই পথে পা বাড়াইলাম৷ কিন্তু আমি ক্যান জানি এইডা করতে পারি নাই৷ আমার বিবেক আমার নিষেধ করতাসিলো! বিবেকটা এক সময় মানুষ রূপ লইয়া আইসা আমারে বুঝাইলো! আমি বুঝলাম, আমি যা করতে যাইতাসিলাম ওটা অন্যায় ছিল৷ আমার আর সাহস হয় নাই! আমি এই অন্যায় থেইক্কা ফিরে আইলাম। ম্যানেজার সাহেব, আমি ক্ষমা চাইতাসি৷ আমারে মাফ কইরা দিবেন। আমার এমন ভুলের জন্য যদি আমার চাকরি চইলা যায় তবে আমি মাথা পাইত্তা নিবো। কিসসু কমু না৷ আমি অন্যায় করসি৷ শাস্তি তো মোরে পাইতে হইবোই৷ যা শাস্তি দিবেন, মাথা পাইতা নিবো৷
সেই সময়ে, আমি যহন কথা কইতেসিলাম, সবাই কেমন নীরব হয়ে ছিলো৷ কেমন এক অস্থিরময় নীরবতা৷ আমি মাথা তুলে চাইলাম তাগরে। দেখালম সবাই আমার দিয়ে চাইয়া আছে৷ সবার মুখে হাসি৷ আমি তাকাতেই সবাই হাতে তালি দিলো৷ সাথে সাথে আমাগো ম্যানেজার বইলা উঠলো, 'দেখো, সৎ মানুষের পক্ষে অসৎ কাজটা একদমই যায় না৷ তারা সেটা করতেই পারে না৷ আবারো সত্যের জয় হলো।'
আমি কি কমু বুঝতে পারতেসিলাম না৷ সবাই মোরে জড়ায় ধরতেসিলো। কইতেসিলো, শারমিন আপা, তোমার মতোন মানুষ অয় না৷ তুমি ঠিক মানুষ না৷ মানুষরূপি ফেরেশতা। আমার তখন কান্দন চইলা৷ আসছিলো৷ আমি ওই জায়গায় ডুকরে কাঁইন্দা উঠলাম! এরপর কী হইসে জানো, আমারে ম্যানেজার তার রুমে নিয়া গেলো! আমার হাতে পঞ্চাশ হাজার টেকার একটা চেক দিয়া কইলো,
-তোমার জামাইকে বলবা যে এই টাকা গুলো যেন সঠিক পথে ব্যয় করে। ভেবে চিন্তে খরচ করতে বলবা৷ তাকে একটা ব্যবসা ধরায় দাও৷ রাস্তার পাশে একটা দোকান দিয়া বসায় দাও৷ ভালো আয় আসবো৷ নাও৷ কাল ব্যাংক থেকে উঠাইতে পারবা৷ সমস্যা নাই!
আমি কি কমু বুঝতে পারতাসিলাম না৷ সব যেন কেমন অদ্ভুত লাগতেসিলো। যেন বিশ্বাসই করতে পারতাছিলাম না যে আমার সাথে এগুলো কী হইতাসে৷ কি আজব ঘটনা৷ আমি তারে জিগাইলাম,
-স্যার, এই টেকা গুলো কি আসলেই আমারে দিতাসেন?
-হ্যাঁ হ্যাঁ৷ তোমার জন্যেই তো!
-ক্যান স্যার?
-এটা তোমার সততার পুরুষ্কার৷ কোম্পানি থেকে দেওয়া হলো! আমরা সাধারণত প্রায়ই অনেক বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানায় টাকা দান করে থাকি৷ এগুলো তেমনই কিছু টাকা৷ যেগুলো কোনো এক এতিমখানায় দেওয়ার কথা ছিল৷ পরে আমি ভাবলাম এতিমখানায় না দিয়ে তোমাকে দেই৷ তুমি নিজেদের লোক৷ এতে যদি তোমার উপকার হয় এবং আমি বিশ্বাস এতে তোমার যথেষ্ট উপকার হবে৷
শারমিন আবার কাঁদছে৷ সে জানে না কেন, তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷ রায়হান বলল,
-ওই ছেলেটা কেমন ছিল? স্যুট-কোট পরা? দেখতে অনেক সুন্দর! এমন?
শারমিন ভেজা গলায় বলল,
-আঁন্ধার ছিলো। ভালো করে দেখি নাই৷ তয় কোট পরাই ছিলো৷ কেন কও তো?
রায়হান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর শারমিনকে সব খুলে বলল৷ বলার পর সে চুপ করে থাকলো৷ শারমিনও তাই৷ হঠাৎ-ই পিনপতন নীরবতা। তারা কেউই কোনো কথা বলছে না৷ খানিক সময় পর শারমিন নড়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে রায়হানের দিকে চাইলো! রায়হান কাঁদছে৷ আবছা আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, রায়হান কেমন পাথর হয়ে কান্না করছে৷ শারমিন রায়হানের হাত ধরলো৷ ভেজা স্বরে বলল,
-আমি জানি না পোলাটা কে! কী তার উদ্দেশ্য। তবে সে যে আমাগো ক্ষতি করতে চায় না, এইডা তো বুঝা যায়, তাই না!? হে আমাগো সাহায্য করতে চাইতাসে৷ হে চাইতাসে না যে আমরা ভুল পথে যাই৷ ভুল করি৷ অন্যায় করি৷
শারমিন এতটুকু বলে থামলো। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারী স্বরে বলল,
-চলো না! এইসব বাদ্দেই৷ নতুন কিছু শুরু করি৷ এই যে টেকা গুলো আছে না! এগুলা দিয়া৷ আর অন্যায় কিছু করমু না৷ সঠিক এবং সৎ পথে চলুম৷ কী কও!
রায়হান কিছু বলল না৷ সে এবার কেবল একটু শব্দ করে কান্না করে উঠলো। শারমিন আর কিছু বলল না৷ সে রায়হানের মাথাটাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো! শারমিনের বুকে মাথা রাখতেই যেন রায়হানের কান্নার বেগ বেড়ে গেল! সে দু'হাতে বাচ্চাদের মতো করে জড়িয়ে ধরলো শারমিনকে৷ দু'জনেই সেভাবে, একেঅপরকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। তাদের এই জড়িয়ে ধরার দৃশ্যের সাথে রূপালি চাঁদের আলোয় আলোকিত রূপালি বস্তির রূপ কেমন অপরূপ হয়ে উঠলো৷ এ যেন এক মায়া নগরীর মায়াময়ী দৃশ্য। ক্লান্ত অথচ ভীষণ সুন্দর৷
.
আশফাক ইজি চেয়ারে বসে আছে৷ রাতে দুটো বাজে৷ তার চোখে ঘুম নেই! পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা সে ঠাস করেই দিয়ে দিলো! একটুও হাত কাঁপলো না৷ কিন্তু যখন চেকটা সরিয়ে নিজের পকেটে নিচ্ছিলো, তখন কেন জানি না সে নিজের হাতে ভীষণ কাঁপন অনুভব করছিলো৷ যেন টেবিল থেকে চেকটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখা দারুণ কঠিন কাজ! সে যেন এই কাজটাই পারছিলো না৷ আশফাক ভাবতে লাগলো, ভালো এবং খারাপ কাজের মাধে পার্থক্যটা কী দারুণ! যেটা সে আজ অনুভব করেছে৷ তার শিক্ষা হয়েছে৷ ভালোই শিক্ষা হয়েছে৷ ঠিক এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো৷ স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার৷ কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,
-আশফাক স্যার! কেমন আছেন?
-ভালো। আপনি?
-ভালো আছি৷ কাজটা কি হলো?
-কোন কাজ? কে বলছেন আপনি?
-আমি! আমাকে চিনছেন না? অসৎ-এ যার রূপ দেখা যায়! আমি, ম্যানেজার সাহেব৷
রায়হান চট করেই সোজা হয়ে বসলো৷ এবং সে দাঁড়িয়েই গেল। নিচু স্বরে সালাম দিয়ে বলল,
-সরি স্যার৷ নাম্বারটা অপরিচিত তো৷ তাই বুঝতে পারিন যে আপনি কল করেছেন৷
-বুঝেছি৷ সমস্যা নেই! কেমন আছো? হাতের কাঁপন কি ফিল করছো না এখনো!
-কি যে বলেন না স্যার! লজ্জা দিবেন না আর৷
-দিচ্ছি না৷ তবে আপনার লজ্জা হওয়া উচিৎ। যে টাকা গরীবদের জন্যে দেওয়া হয়েছে সেই টাকা আপনি কীভাবে নিজের পকেটে চালান করছিলেন?
-আমি সরি স্যার৷ আমি তখনও বার বার করে বলেছিলাম! আমার ভুল হয়েছে৷ আমি আগে কখনই এমন করিনি। আজই প্রথম। ভাবলাম টাকা তো আমার কাছেই আছে৷ কে আর চেক করবে! নিজেই লুফে নেই! ভুলভাল কোনো আশ্রমে দিয়েছি বলে চালিয়ে দিব৷ আমি আমার কর্মের জন্যে সরি স্যার৷ এক্সট্রিমলি সরি!
ফোনের ওপাশ থেকে তীব্র হাসির আওয়াজ এলো৷ কেউ যেন মন খুলে হাসছে৷ হাসতে হাসতে বলল,
-চোর ধরা পড়লে ঠিকই বলে এটাই তার প্রথম! যাই হোক, এটাই শেষ হয় যেন। আমি যদি খোঁজ পাই যে এমনটা দ্বিতীয়বার হয়েছে তবে এর পরিনাম একদমই ভালো হবে না। মনে রাখবেন৷
-জি জি স্যার৷ এই কান ধরলাম। আর কখনোই এমন করবো না৷ কখনোই না৷
-গুড৷ কাজ হয়েছে ওটা?
-জি স্যার। হয়েছে। কিন্তু স্যার, আমার একটা কনফিউশান আছে৷
-কী কনফিউশান?
-স্যার আমার কাছেই যে এই চেকটা আছে এটা আপনি কীভাবে জানলেন বলেন তো?
ওপাশ থেকে আবারো হাসির আওয়াজ এলো৷ বলল,
-যে টাকা দেয় তাকেই যদি বলো যে কে টাকা দিয়েছে, তখন ব্যাপারটা ঠিক কেমন হয়ে যায় না, আশফাক?
-মানে? কী বলেন স্যার? আপনি? আপনিই দিয়েছেন? তার মানে আপনিই এই কোম্পানির...
হঠাৎই কল কাটা যায়! আশফাক হ্যালো হ্যালো করে কয়েকবার৷ লাভ হয় না৷ কল তার আগেই কাটা যায়৷ আশফাক দ্রুত সেই নাম্বারে আবার কল দেয়৷ কিন্তু কল ঢুকে না৷ ওপাশ থেকে কেবল সেই নারী কষ্টটা ভেসে আসে, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। প্লীজ...
.
শীতের সময়! বাহিরে দারুণ ঠান্ডা৷ বিকেল বেলা এতোটা ঠান্ডা পড়ে না সাধারণত। কিন্তু আজ কেন জানি পড়ছে৷ রায়হান শীতের জামা পরে বের হলো৷ দোকানে যাচ্ছে৷ তার একটা দোকান হয়েছে এখন৷ ছোট্ট একটা দোকান! বস্তি থেকে একটু দূরে৷ একটা মাঠের পাশে। সে নানান ধরনের খাবার বিক্রি করে৷ তবে সম্প্রতি সে ফেমাস হয়েছে তেলে ভাজা খাবারের জন্যে৷ সে পেঁয়াজু, চপ, কিছু শীত পিঠা তৈরী করে৷ এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তার এই খাবার গুলো দারুণ বিক্রি হয়৷ মানুষজন বিকেলে হাঁটতে আসে এদিকে। এলে গরম গরম ভাজাপোড়া না খেলে যেন একদমই হয় না৷ তারউপর তা যদি রায়হান ভাইয়ের দোকান হয়, তবে তো কথাই নেই!
রায়হানের একজন এসিস্ট্যান্টও আছে৷ যে ওকে ওর কাজে সাহায্য করে। এসিস্ট্যান্ট এর নাম বিপুল৷ তার প্রতারক পার্টনার। প্রতিদিনের মতো আজ সব কাজ রায়হান সময় মতো শুরু করলো! পেঁয়াজু বানিয়ে সেগুলোকে ভাজতেছিলো৷ ঠিক এমন সময় কেউ একজন এসে বলল,
-রায়হান, কোন জিনিস মানুষকে মানুষ বানায় বলতে পারবে?
রায়হান চট করেই চোখ তুলে চাইলো। কণ্ঠটা কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে৷ কেমন যেন চেনা চেনা৷ কিংবা এমন যে এটা এমন এক কণ্ঠ যেটা শোনার জন্যে ভীষণ অপেক্ষায় ছিলো রায়হান। রায়হান দৌড়ে এলো। এসেই ঝাপটে ধরলো ছেলেটাকে৷ এক প্রকার কান্নাই করে দিলো সে৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আজজ আমার কাছে জবাব আছে ভাই! জবাব আছে আমার কাছে৷ মানুষকে মনুষ্যত্ববোধই মানুষ বানায়৷ আর কিছু না৷ মনুষ্যত্ববোধই।
ছেলেটা হাসলো। কিছু বলল না আজ আর। কারণ আজ রায়হান সঠিক জবাব দিয়েছে৷ চিরন্তন সত্য জবাব দিয়েছে রায়হান৷
.
রায়হানের ওখানে দারুণ ভীড়। ছেলেটা সামান্য নাস্তা সেরে রায়হানকে বিল দিতে গেল৷ রায়হান পন করে বসলো! সে বিল নিবেই না৷ এ নিয়ে খানিক তর্ক হলো৷ তর্ক শেষে রায়হানকে ছেলেটা প্রমিজ করলো যে সে অন্য আরেকবার আসবে এবং তখন সে অবশ্যই টাকা ছাড়া খাবে৷ অনেক বেশি খাবে তখন৷ রায়হান সে কথা আশ্বস্ত হয়ে এবারের টাকাটা নিলো! অথচ রায়হান জানে না, খুব সম্ভবত এই ছেলের সাথে এই জীবনে আর কখনই দেখা হবে না তার। দেখা হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না৷ কারণ এই ছেলেটা এমন একজন মানুষ, যে কেবল প্রয়োজনে প্রদর্শিত হয়৷ সত্য, সততা এবং মনুষ্যত্বের প্রয়োজনে৷
.
-এক্সকিউজমি!
রায়হানের ওখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো কেউ৷ ছেলেটা পেছন ফিরে চাইতেই দেখলো মেয়েটাকে। ওই মেয়েটাকে। যাকে সে কোনো এক রমজানে দেখেছিলো! রায়হানের সাথে টাকা সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময়৷ সে জবাব দিলো,
-জি?
অরু এগিয়ে এলো। বলল,
-আপনি ওই ছেলেটা না যে একদিন আমার কাছে...
ছেলেটা হাসলো৷ অরুকে থামিয়ে বলল,
-হ্যাঁ৷ আমিই সেই ছেলে! সেই প্রতারক!
মেয়েটা লজ্জা পেয়ে গেল! মৃদু হেসে বলল,
-সত্যি বলতে আপনি তখন প্রতারনাই করছিলেন৷ তাই প্রতারক বলতে আমার দ্বিধাবোধ করা উচিৎ না। তাই না?
ছেলেটা বলল,
-মাঝে মাঝে সত্যকে খুড়ে বের করতে হলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়৷ এ অন্যায় কিছু না৷
-তা বটে৷ তবে আমি সবটাই রায়হান ভাইয়ের কাছে শুনেছি৷ সবটাই কেমন ড্রামাটিক ছিল৷ আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না৷
ছেলেটা মৃদু হাসলো। কিছু বলল না৷ মেয়েটা বলে উঠলো,
-আচ্ছা একটা কথা! এই জিনিসটা খুবই অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে৷ আমি এদের সবাইকে আপনার নাম জিজ্ঞেস করলাম। এরা কেউই আপনার নাম বলতে পারলো না৷ কেন বলুন তো?
ছেলেটা এবার মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-নাম দিয়ে কী হবে বলুন! নাম দিয়ে কিছুই যায় আসে না৷ তাই কাউকে বলি না৷ বলতে ইচ্ছে হয় না৷
-তারপরও! নাম তো প্রয়োজন। অন্তত পরিচিতির জন্যে৷
-আমার পরিচিতির প্রয়োজন নেই৷
-আমার সাথেও না?
ছেলেটা খানিক চুপ থেকে জবাব দিলো,
-নাহ! আপনার সাথে আমার পরিচিত হওয়ার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়৷ তাছাড়া আপনি একজন পুরুষবিদ্বেষী নারী৷ সেদিন থেকে চিন্তা করলে জবাব তো না-ই দিতে হবে৷
মেয়েটা যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেলো! চট করেই জবাব দিতে পারছিলো না৷ কিংবা হয়তো এই ছেলেটা সামনে বলেই জবাব দিতে পারছে না৷ অন্য কেউ হলে ঠিকই কঠিন কোনো কথা শুনিয়ে দিতো৷ ছেলেটা কীভাবে জানি তার অস্বস্তিবোধটা টের পেয়ে গেল। সে বলে উঠলো,
-পুরুষ জাতীটা এতোটা খারাপ না৷ আপনি একজন মেধাবী মানুষ। যথেষ্ট বুদ্ধিমান৷ তবে কিছু জায়গায় ভুলে করে বসেছেন৷ ব্যক্তিজীবনে আপনি সফল হলেও মানুষ পরোক্ষে আপনি দারুণ অসফল৷ একটা ভাতকে দিয়ে পুরো হাড়ির ভাতের অবস্থা বুঝা গেলেও একটা মানুষকে দিয়ে গোটা জাতিটাকে বুঝ মুশকিল! আমি জানি আপনাকে স্পষ্ট করে কিছু বলতে হবে না৷ আপনি সবই বুঝবেন৷ কেবল একটু সময় লাগবে৷ নিজেকে একটু সময় দিন। ভাবতে সময় দিম৷ চট করেই জাজ করবেন না৷ চট করেই কাউকে বাস্টার্ড বলে ফেলবেন না৷ কেমন?
অরু কিছু বলল না৷ সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। কিচ্ছু বলল না৷ বলতে পারলো না যেন৷ মেয়েটা ভাবছে৷ সে ভাবছে এই ছেলেটা জানলো কীভাবে ওই মানুষটার কথা! কীভাবে জানলো যে ওই একটা মানুষের জন্যেই আজ ওর এই পরিণতি? এতো কাঠিন্য। এতো তীক্ততা। ছেলেটা কীভাবে জানলো যে অরু মানুষ পরোক্ষে একদমই কাঁচা? তাছাড়া এই বাস্টার্ড শব্দটা ওইদিন যে বলেছে, সেইদিনের কথাইটাই কি বলছে ছেলেটা? কিন্তু সেদিন তো ছেলেটা দৌড়ে পালাচ্ছিলো। তার তো শোনার কথা না তাহলে? ছেলেটা বলে উঠলো,
-আমি ভাবছিলাম আপনি মামলা করবেন৷ কিন্তু করেননি পরে আর৷ এটা দেখে ভালো লাগলো! তাছাড়া আপনি একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। সেদিন রায়হান কে এভাবে না শাঁসালে হয়তো সে আজ এই পর্যন্ত আসতে পারতো না৷ ভীষণ ভয় পেয়েছিলো সেদিন৷ ধন্যবাদ আপনাকে৷ আপনার কাঠিন্যতা কারো উপকারে এসেছে প্রথমবারের মতো, এ জন্যে হলেও আপনি একটু হাসতে পারেন৷ আপনার এখন সামান্য হাসি দেওয়ার একটা ছোট্ট কারণ হয়েছে৷ বুঝতে পেরেছেন মিস অরু?
অরু আনমনে হেসে ফেললো৷ কিছু বলল না যদিও। কেবল মুখের মাঝে হাসিটা ধরে রাখলো৷ তার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হলো। যেন কতোগুলো প্রশ্ন করা বাকি ছেলেটাকে৷ কিন্তু করতে পারছে না৷ কেন জানি সে, একটা কথা বলতে পারছে না৷ ছেলেটা একটু সময় নিয়ে বলল,
-আপনি ভীষণ ভালো মানুষ অরু৷ আপনার মনের অস্থিরতা ঠিক হয়ে যাবে দ্রুত এবং আপনি অতি শিঘ্রাই আপনার সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন৷ আসি তাহলে৷ আবার কখনো দেখা হবে৷ কিংবা কখনো না!
বলে ছেলেটা হাঁটা ধরলো। কিছুদূর যেতেই অরু বলে উঠলো,
-আপনার নামটা?
ছেলেটা পেছন ফিরে চাইলো। উলটো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-আকাশ! অথবা মেঘ! যাতে আপনার স্বাচ্ছন্দ্য হয়!
-আপনাকে আবার পাবো কোথায় আকাশ?
-যেখানে অসৎ এবং মিথ্যা বাসা বাঁধে, সেখানে৷
-মানে?
ছেলেটা কোনো জবাব দিলো না৷ পকেটে হাত গুঁছে বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো৷ এমন কি একবার পেছন ফিরেও চাইলো না৷ চাইলে হয়তো দেখতে পেতো, কেমন এক আক্রোশ, উচ্ছাস নিয়ে এক অতী সুন্দরী রমনী তার গমন পথ চেয়ে আছে৷ কয়েক মিনিট পার হলো৷ আকাশ নামের রহস্যটা দূর দিগন্তে মিশে গেল! অরু ঠায় দাঁড়িয়ে, সেই বিলুপ্তিটা দেখলো। কেন জানি না, তার খানিক কষ্ট অনুভব হলো! অদ্ভুত। চোখেও পানি জমতে চাইলো। কেন?
.

গল্পঃ আকাশে মেঘের উত্থান
-তাসফি আহমেদ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url