গল্পঃ জোকার | প্রথম পর্ব | লেখক - তাসফি আহমেদ


bangla-golpo-joker-by-tasfi-ahamed-tasfis-blog



গল্পঃ জোকার | প্রথম পর্ব | লেখক - তাসফি আহমেদ



গল্পঃ জোকার

প্রথম পর্ব
লেখক - তাসফি আহমেদ



ঘটনা- ১
.
মনির মেজাজ খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর মা পেছন থেকে ডাকলেন একবার। মনির কিছুদূর গিয়ে রাগি চোখে তাকালো মায়ের দিকে। খুব বাজে একটা গালি দিল। বলল,
-তুই আমার কেউ না। তোর মুখে আমার নাম আর শুনলে খুন করমু তোরে। আর তোর বুইড়া জামাইরে কইয়া দিস, কাল যদি টাকা না পাই তাইলে ওর কিডনি বিক্রি কইরা দিমু। কইয়া দিলাম।
মনির হনহন করে চলে গেল। আশপাশের সবাই তাকিয়ে থাকল। পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা কৌতুহল চোখ গুলো ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেবল। কেউ কিছু বলল না। বলতে পারল না। মনিরের মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন ভেজা চোখ নিয়ে। সন্তানেরা শত কষ্ট দিলেও মায়ের মনে তাদের জন্যে মায়া বিন্দুমাত্র কমে না। তারা কেবল এই সময়ের অপেক্ষা করেন, কখন তাদের সন্তান তাদের দিকে হাসিমুখে তাকাবে। হাসিমুখে মৃদুমন্দ কথা বলবে। স্রষ্টা যেন মায়েদের মনে সন্তানদের প্রতি অসংখ্য মায়ার কারখানা গড়ে রেখেছেন। মনির প্রায়ই এমন করে। কেবল আজ নয়। টাকা চায়। নেশা করে। বাজে ভাষায় কথা বলে। অথচ মনির এমন ছিল না। যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র ছিল সে।
-রানুর মা? শুনছো?
রাহেলা বেগমের স্বামী ডাক দিলেন ভেতরের ঘর থেকে। তাঁর নাম মনজুর আলি। তিনি একটা প্রাইমারী স্কুলের পিয়ন। ইদানীং অর্থ সংকটে তাঁর চেহারা প্রায়ই বিবর্ণ হয়ে থাকে। সংকট তেমন বিশেষ নয়। ছেলেটা বড় জ্বালায়। রাহেলা ভেতরের ঘরে এলেন। তার ভেজা চোখ দেখে মনজুর আলি বললেন,
-তোমার ছেলে বলেছে আমার কিডনি নিয়ে যাবে। সে আসলে তাই-ই করবে। কিডনি নিয়েই যাবে। যে ছেলে নিজের বৃদ্ধ বাবার গায়ে হাত তুলতে পারে, তার কাছে সেই বাবার কিডনি খুলে নেয়াটা তেমন কঠিন কিছু নয়।
কথা সত্য। টাকা নেয়া নিয়ে মনির এ যাবত বেশ কয়েকবার তার বাবার গায়ে হাত তুলেছে। মাকেও মেরেছে। সেদিন তো চাকু দিয়ে আঘাত করেছিল। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন মনজুর আলি। তাই কিডনি খুলে নেয়া তার কাছে তেমন কোনো ব্যাপার হবে বলে মনে হয় না। মনজুর আলির অর্থ সংকট এমনি এমনি হয় না। যা বেতন পান তা দিয়েই তাদের দুজনের সংসার বেশ আনন্দেই কেটে যেত। অথচ মনিরের কারণে তা সম্ভবই হচ্ছে না। দেনা বাড়ছে। আয় অনুযায়ী ব্যয় হচ্ছে বেশি। রাহেলা বেগম কিছু বললেন না। বিছানার এক পাশে বসে কাঁদতে থাকলেন। মনজুর আলি ভ্রু কুচকে বললেন,
-এ আমার কোন পাপের ফল আল্লাহই ভালো জানে।
তারপর রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কাঁদো ক্যান? খুব তো ছেলে সন্তানের জন্যে হাহাকার করছিলা। এখন সখ মিটছে?
রাহেলা ভেজা স্বরে বললেন,
-তুমি মনে হয় চাওনি? আর কে জানতো যে ও এমন হয়ে যাবে? ছেলে তো ভালোই ছিল। কলেজে উঠার পরই তো সব সর্বনাশ শুরু হলো।
দশম শ্রেনী পর্যন্ত মনির ভালো স্টুডেন্ট নামে বহুল পরিচিত ছিল। কিন্তু একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেনী ওর জন্যে কাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ইন্টারও পাশ করতে পারেনি। বাজে ছেলেদের সাথে মিশে নিজেকে একেবারে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেল। আজ থাকত অনার্স তৃতীয় বর্ষে। কী সুন্দর একটা জীবন হতে পারতো। অথচ সঙ্গ দোষে তার সমস্ত শেষ করে দিল। মনজুর আলি কিছু বললেন না। নিঃশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন। উনাকে বড় ক্লান্ত দেখালো। যেন ছেলের এমন অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছেন না। তারউপর এলাকার সকলে নানান রকম নালিশ নিয়ে হাজির হয় প্রায়ই। কেউ আসে মারামারি কেস নিয়ে তো কেউ আসে ইভটিজিং এর কেস নিয়ে। দু একবার জেলেও গেছে মনির। কিন্তু দু'দিনের মাথায় ঠিকই বেরিয়ে এলো। কীভাবে আসে কে জানে। ছেলেটা ইদানীং মেয়ে লোভী হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ রানু ডুকল ঘরে। ঘরে ডুকেই বুঝতে পারলো কী ঘটেছে। রানু মনিরের বড় বোন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্নই ছিল যে বড় মেয়েকে ইন্টার পাশের পরই বিয়ে দিয়ে দিলেন মনজুর আলি। তা না হলে আজ পর্যন্ত হয়তো মেয়ের বিয়েই হতো না। মনজুর আলি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রানুর এই বাসায় আশা নিষেধ। ওর শশুর বাড়ির লোকেরা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে এখানে যে রানুর মা বাবা থাকে সেটা যেন সে ভুলে যায় অথবা ডিভোর্স নিয়ে যেন সে একেবারে বাপের বাড়িতে চলে আসে। এর কারণটা নিশ্চয়ই আর বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। রানু এসে মায়ের পাশে বসল। বলল,
-আবার ঝগড়া হয়েছে?
রাহেলা মেয়ের কাঁধে কপায় ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মনজুর আলি বলে উঠলেন,
-আমার মৃত্যু হয়তো ঘনিয়ে এসেছে রে।
রানু বলল,
-মানেহ? কী বলছো?
-তেমন কিছু না। তা তুই কী মনে করে এলি?
-তোমাদের দেখতে ইচ্ছে হলো। লোকমুখে শুনলাম মনিরা নাকি বেশ জ্বালাতন করছে?
-হ্যাঁ রে মা। ভয় হয়। রাতে ঘুমালে মনে হয় সকালটা হয়তো আর দেখা হবে না। রাতে মাতাল হয়ে এসে কী যে অবস্থা করে! কী আর বলব! ওর জন্যে কোথাও দুটো কথা বলতে পারি না। সবাই আড় চোখে দেখে। দোয়া করি, স্রষ্টা এমন সন্তান কাউকে না দেন।
বৃদ্ধ মনজুর আলির গাল বেয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়ে গেল। রানু বলল,
-শান্ত হও বাবা। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
তিনি কিছু বললেন না। চুপ থাকলেন। রাহেলা বেগম চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
-রানু, চা খাবি?
-তুমি বসো মা। আমি বানিয়ে আনছি। বাবা, তুমি আজ স্কুলে যাবে না?
মনজুর আলি বললেন,
-যাবো। এই তো বের হচ্ছিলাম। তার আগেই...। তা একটা কথা বলি। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি মনিরের ব্যাপারে। সিদ্ধান্তটা আসলেই আমি তোমাদের না জানিয়েই নিয়েছি এবং তোমরা কেউ না মানলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো।
মনজুর আলির চোখ মুখ শক্ত করে কথাটা বললেন। তাকে বড় কঠোর দেখালো। রাহেলা বসে পড়লেন বিছানায়। রানু ভ্রু কুচকে বলল,
-কী সিদ্ধান্ত বাবা?
মনজুর আলি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। দুই জোড়া উৎসুক দৃষ্টি উনার দিকে চেয়ে থাকল। অনেকটা সময় পাথরের মতো চুপ করে থেকে তিনি বললেন,
-আমি একজন লোককে ঠিক করেছি। মনিরকে খুন করার জন্যে।
রানু বলে উঠল,
-কীহ! কী বলছো?
রাহেলার মাথা ঘুরিয়ে উঠল যেন। উনি বেশ ধীরে ধীরে রানুর গায়ে এলিয়ে পড়লেন।
.
ঘটনা- ২
.
রাত তখন বারোটা আটত্রিশ বেজে গিয়েছে। মনিরকে একটা গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেল চৌরাস্তার মাথায়। সেখান থেকে হেঁটে বাসায় আসতে হবে। ওকে বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে মন মেজাজ বেশ ভালো। মুখে স্পষ্ট প্রশান্তির ছাপ। আজ মদ খায়নি সে। খাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। রিমা মেয়েটা আজ বিছানায় বেশ সুখ দিয়েছে। ও ভাবছে মেয়েটাকে কাল নিজেদের বাসায় নিয়ে আসবে। একা একা অনেকটা সময় কাটাবে দুজনে। ভাবতেই আনন্দ লাগে ওর। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে হাঁটতে থাকে ও। অল্প কিছু দূরে যেতেই লাইট গুলো বন্ধ হয়ে যায়। মনির গায়ে মাখল না। এ আর এমন নতুন কী। প্রায়ই তো এমন হয়। মনির মোবাইল বের করে লাইট জ্বালালো। নিচের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকল। হঠাৎই কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগে ওর। তাল সামলে লাইট সামনের দিকে ধরতেই দেখে জোকারের মতো একজন লোক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে লোকটা। রাস্তায় পড়ে যায় মনির। চিৎকার করে উঠে। জোকাররূপি মানুষটা এবার ওর তল পেটে আঘাত করে। দু হাঁটুর উপর দুটো বাড়ি মারে লোহার রোল দিয়ে। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে মনির। তার আর্তনাদ আশপাশের গুটি কয়েক মানুষের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। সবাই ভাবে মাতালটা আজ আবার মাতলামি শুরু করেছে। কেউই গায়ে মাখে না। চুপচাপ শুয়ে থাকে। মনিরের কাঁধ বরাবর আঘাত করা হয় এবার। প্রচণ্ড ব্যাথায় চিৎকার দিয়ে উঠে ও। কান্না করতে থাকে। লোকটা আবার মনিরের মাথায় আঘাত করে। মনির জ্ঞান হারায় দ্রুত। রক্ত পড়ে জমা হয় রাস্তায়। তা দেখে বড় আনন্দ হয় জোকারটার। সে হাসতে থাকে। তারপর মনিরের পাঁ ধরে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারে কোথাও।
.
ঘটনা- ৩
.
ফজরের আযান দিয়েছিল কিছুক্ষন হবে।ইসমাইল সাহেবর ঘুম ভাঙল। উনি শোয়া থেকে উঠে বসলেন। ঠিক তখনই উনার স্ত্রী মরিয়ম বেগম ওযু করে বের হলেন ওয়াশরুম থেকে। তিনি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
-তাড়াতাড়ি করে উঠো। তা না হলে জামাত পাবে না। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে মিজানকে উঠিয়ে দিয়ো।
ইসমাইল সাহেব কিছু বললেন না। চুপচাপ থাকলেন। কিছুক্ষন চোখ কচলে নিলেন। তারপর বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেলেন। ওযু শেষ করে নামাজের জন্যে তৈরী হয়ে মিজানের রুমে গেলেন। মিজানকে ডাকতেই সে উঠে গেল। ওর ফজরের নামাজ কাযা হয় না। মিজান মাদরাসায় পড়ে। মেশকাত জামাত। মাদ্রাসার বোর্ডিংয়ে থাকে। ওই ঘটনাটা ঘটার পরই বাসায় চলে আসে সে। এখনও যায়নি মাদ্রাসায়। যেতে ইচ্ছে হয় না। তার বোনের জন্যে বেশ মায়া হয়। বোনকে ভুলতে পারছে না। ইসমাইল সাহেব উনার বড় ছেলে সাদিকের রুমে গেলেন। বেশ কয়েকবার ডাকলেন। সাদিক উঠল না। একটু শব্দও করল না। মৃত মানুষের মতো ঘুমাতে থাকল। নিজের রুম থেকে মরিয়ম বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,
-ওকে ডেকে লাভ হবে না। বেশ রাত করে ফিরেছে। ঘন্টা দুয়েক হবে ঘুমিয়েছে।
ইসমাইল সাহেব ডাকলেন না আর। ফিরে এলেন। অন্য সময় হলে উনি জোর করতেন। উঠিয়েই ছাড়তেন। কিন্তু আজ তা করলেন না। এ ক'দিন মন-দিল ভালো যাচ্ছে না। কিছুই করতে ইচ্ছে করে না উনার। তিনি মারিয়ার রুমে গেলেন একবার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কেবল। অগোছালো খাট,বই ভর্তি টেবিল, সাজিয়ে রাখা ড্রেসিং টেবিল, সবই আছে। কেবল মারিয়াটা নেই। মারিয়াহীন শূন্য রুমটা দেখে বুকের ভেতর তীব্র একটা ব্যাথা অনুভব করলেন তিনি। বুকের ভেতর কুকড়ে উঠল তাঁর। চোখে জল জমলো দ্রুত। উনি চোখ মুছে নিলেন। ততক্ষনে মিজান তৈরী হয়ে এসেছে। বাবা-ছেলে নামাজ পড়তে যাবে মসজিদে। ইসমাইল সাহেব দরজার ছিটকিনি টেনে খুললেন। দরজা মেলতেই দেখলেন মেজেতে কারো শরীরবিহীন মাথা পড়ে আছে। দেখতেই উনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন। পড়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় মিজান উনাকে ধরে ফেলে। তিনি চোখ বড় বড় করে মাথাটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সিড়ির রুমের লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন মাথাটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে; একদম উনার চোখ বরাবর। গলার নিচের দিকে থেকে রক্ত ঝরে সেগুলো সিড়ির দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন কিছুক্ষন আগে মাথাটা এখানে রেখে গিয়েছে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ইসমাইল সাহেব জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। মিজান চিৎকার দিয়ে তার মাকে ডাকল।
.
ঘটনা- ৪
হৃদয় বেশ সাবধানে বেরিয়ে এলো। আশপাশটা ভালো করে দেখে নিল। না, কোথাও কেউ নেই। একদম নীরব। কুয়াশা পড়ছে ভীষণ। ল্যাম্পপোস্টটার আলো গাছের ফাঁক গলে এদিকে আসছে। ফাঁক গলে আশা আলোটা পথ দেখতে সাহায্য করছে ওকে। হৃদয় ধীর পাঁয়ে বাংলোর গেটের কাছে চলে এলো। গাছের ছায়ার আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। মনের ভেতর খানিকটা ভয় কাজ করছে। মনিরের খুনের চারদিন হয়ে গেল। অথচ খুনিকে এখনও খুঁজে পাওয়া গেল না। মনিরের শরীরটাই পাওয়া যায়নি এখনও। কেবল মাথাটা পাওয়া গিয়েছে। সাধারণত হৃদয় এসব ভয় পায় না। সাহসী ছেলে। কিন্তু মনিরের সাথে যা ঘটল সেটা কল্পনা করতেই গা শিউরে উঠে ওর। ভয় ভয় লাগে। তাছাড়া এতো নির্মম ভাবে খুনটাই বা করল কে? হঠাৎই গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেল ও। কালো মার্সিডিজ গাড়িটা বেশ ধীরে ধীরে এসে থামল গেটের কাছে। হৃদয় এগিয়ে গেল। ওকে দেখতেই গাড়ির গ্লাস নামিয়ে কেউ একজন দুটো ব্যাগ বের করে দিলো। বেশ গম্ভীর স্বরে বলল,
-আজ রাত এবং কাল পুরো দিনের খাবার আছে এখানে। খেয়ে নিস।
হৃদয় সেগুলো নিতে নিতে বলল,
-ভাই, মনিরের কেসটার কোনো খবর পাওয়া গেল?
গম্ভীর স্বরটা বলল,
-না।
হৃদয়কে খানিকটা চিন্তিত দেখালো। বলল,
-আমরা আর কয়দিন এভাবে লুকিয়ে থাকবো ভাই? রুমে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি।
-যদি তোর মরে যেতে ইচ্ছে হয় তাহলে তুই চলে যা! আঁটকাচ্ছে কে?
কথাটা বলেই লোকটা ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আদেশ দিলো। কালো মার্সিডিজটা ঠিক যেভাবে ধীরে ধীরে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে মৃদু আওয়াজ করে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। হৃদয় ফিরতি পথে হাঁটা ধরল। শব্দকে করে গালি দিল সেই খুনিকে। নিজে নিজেই বলে উঠল,
-শালা কে তুই? তোর সাহস কতো বড় যে তুই আমাদের সাথে খেলছিস? একবার পাই তোকে। তখন দেখাবো এই হৃদয় কী জিনিস।
কথাটা বলে সামনের দিকে তাকাতেই দেখল কেউ একজন ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোটা গাছের ফাঁক দিয়ে একদম লোকটার মুখের উপর পড়ছে। হৃদয় দেখল একজন জোকার ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা একদম সাদা, ঠোঁট আর নাকের ডগাটা লাল রঙ করা, চোখ দুটোর চারপাশ কালো করে রাখা এবং কপালে লাল রঙের রেখা আঁকা। জোকারটা হাসছে মনে হয়। নাকি কাঁদছে? হৃদয় বুঝতে পারল না। ও কিছু বলতে যাবে ঠিক তার আগেই জোকারটা ওর মাথার উপর ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করল। তীব্র একটা চিৎকার দিয়ে ঘাসের উপর পড়ে যায় হৃদয়। বাংলোর ভেতরে থাকা ওর বাকি বন্ধু গুলোর মাঝে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয় মূহুর্তে। তারা চুপচাপ দম বন্ধ করে পড়ে থাকে। একটু শব্দও করে না।
.
ঘটনা- ৫
ওসি নুরুজ্জামান চুপচাপ বসে আছে। কেসটা নিয়ে সে এমনিতেই একটা প্রেশারে ছিল। এখন আবার আরেকটা উটকো ঝামেলা এসে কাঁধে বসল। নুরুজ্জামান খানিকটা বিরক্ত হলো। বিরক্তিটা কি আসলে নিজের উপর নাকি সামনে বসে থাকা শিশির আহমেদ নামক গোয়েন্দা অফিসারের উপর তা ঠিক অনুমান করতে পারছে না সে। তরুণ এই পুলিশ অফিসার এই যাবত যতগুলো কেস হাতে পেয়েছে, সব গুলোই বেশ নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করেছে। আসামিরা তার ভারী দৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়নি। কেবল এই কেসটাই তার ঘাম ঝরিয়ে ছাড়ছে। তার উপর আজ সকালে ডি আই জি স্যার নিজে আসলেন থানায়। গোয়েন্দা অফিসারকে দিয়ে গেলেন ওর কাছে। তার মানে বুঝাই যাচ্ছে কেসটা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
-ডি আই জি স্যার নিজে এই থানায় আসলেন। তার মানে বুঝতেই পারছেন কেসটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
নুরুজ্জামানের ভাবনায় ছেদ ফেলে কথাটা। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর কথাটা বলে উঠে গোয়েন্দা অফিসার শিশির আহমেদ। নুরুজ্জামান বলল,
-জ্বী। সেটাই ভাবছি।
-দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিন। চা যেন বেশ গরম হয়।
নুরুজ্জামান বিরক্ত হলো। কনস্টেবলকে ডেকে বলল,
-দু'কাপ চা পাঠাও। চা যেন বেশ গরম হয়।
শিশির চসমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখল। বলল,
-চলুন, একটু ঘুরে আসি অতীত থেকে। আপনারা একটা মাথা পান। শরীর ছাড়া মাথা। তাই তো?
নুরুজ্জামান বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,
-জ্বী। আমরা মোট দুটো মাথা পাই। দুটি ভিন্ন যায়গায়।
-পরের মাথাটার কথা এখন বাদ দিন। প্রথমটার কথা বলুন। ফরেন্সিক রিপোর্ট কী বলে?
-মাথায় ভারী কিছু দ্বারা আঘাত করা হয়। এছাড়া লাশকে যে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় তা নিশ্চিত হয়। যদিও আমরা ভিক্টিমের দেহ এখনও পাইনি,তবে ওই মাথাটার রিপোর্টে তাইই লিখা ছিল। মৃত্যুর আগে ব্যক্তিটিকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়।
-দুটো মাথার রিপোর্ট কি একই?
-হ্যাঁ।
-আচ্ছা বলুন তো, মাথা গুলোকে নির্দিষ্ট দুটো বাসার দরজার সামনে কেন রেখে আশা হয়। এমন খুন ইতিহাসে বিরল। কেউ খুন করে মাথাটা কারো দরজার সামনে রেখে আসবে কেন?
নুরুজ্জামান চট করেই কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। শিশির একটু মনযোগ দিয়ে দেখল নুরুজ্জামানকে। এই যুবক অফিসারটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে ওর। এর সাথে কাজ করে বেশ মজা পাওয়া যাবে। ভাবলো শিশির। নুরুজ্জামান বলল,
-সেটা আসলে বলতে পারছি না।
শিশির হাসল। বলল,
-কিছু লুকাবেন না প্লিজ। আমরা দু'জনই আইনের লোক। লুকানোর কিছু নেই।
-নাহ। কী লুকাবো।
নুরুজ্জামান মেকি হাসল। শিশির বলল,
-আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কিছু লুকাচ্ছেন। আর লুকালেও লাভ হবে বলে মনে হয়ে না। আমি সেই কারণটা অবশ্যই খুঁজে বের করব। এতে আমার তেমন বেগ পেতে হবে না আশা করি।
নুরুজ্জামান তখনও চুপ করে থাকল। শিশিরও তাড়া দিলো না। নুরুজ্জামানকে ভাবতে দিল। ঠিক তখনই চা নিয়ে এলো কনস্টেবল। সে চা দিয়ে চলে গেল। নুরুজ্জামান বলল,
-কথাটা বলা ঠিক হবে কী না জানি না। আমি তেমন নিশ্চিতও নই। কিন্তু আমার অনুমান এটাই বলছে এটার সাথে ওই কেসের সম্পর্ক আছে।
-চা চলে এসেছে। জলদি করে বলে ফেলুন। এতো কিছু ভাববেন না। আমাদের হাতে সময় কম। বলুন, কোন কেসটা?
.
প্রথম পর্ব।
গল্পঃ জোকার
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url