ভালোবাসার গল্প - তাকে ফিরে পেলাম | লিখেছেন তাসফি আহমেদ

ভালোবাসার গল্প - তাকে ফিরে পেলাম | লিখেছেন শাকের আহমেদ তাসফি

ভালোবাসার গল্প - তাকে ফিরে পেলাম | লিখেছেন শাকের আহমেদ তাসফি

ভালোবাসার গল্প - তাকে ফিরে পেলাম | লিখেছেন শাকের আহমেদ তাসফি



  

ভালোবাসার গল্প - তাকে ফিরে পেলাম | লিখেছেন শাকের আহমেদ তাসফি

 
ভূমিকাঃ ভালোবাসার গল্পবিষাদ, তিক্ততার গল্প, ফিকশন, নন-ফিকশন, ভৌতিক, রহস্যময় থ্রিলার গল্পে সমৃদ্ধ আমার এই ছোট্ট ব্লগটি। বাংলা ছোট গল্পের এই অনন্য-অসাধারণ জগতে আপনাকে স্বাগতম। ভীষণ অপূর্ণতায় ভরপুর আমার গল্প গুলো। তাও লিখি। লিখলে মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত এক প্রশান্তি মিলে। বিশেষ করে ভালোবাসার গল্প গুলো। কারণ এই ভালোবাসার গল্প গুলোতে আমার এক প্রেমিকা থাকে। কাল্পনিক প্রেমিকা। তারে ভীষণ ভালোবাসি আমি।  


ভালোবাসার গল্প - তাকে ফিরে পেলাম

লেখকঃ তাসফি আহমেদ


 -সাদিক একটা ট্যুর প্ল্যান করেছে। আমি যাবো ভাবছি৷ কী বলো?
কথাটা বলে আমি মিহিনের দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকালো না৷ আয়নায় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকল৷ কথাটা শুনল বলেও মনে হয় না৷ আমি তাকে ডাকলাম,
-মিহিন?
এবারও তার মাঝে কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না৷ সে দু'ভ্রয়ের মাঝে টিপ দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত৷ এমনটা নয় যে তার টিপ দেওয়ার ব্যাপারটা শেষ হয়ে গিয়েছে৷ তা শেষ হচ্ছে না। মিহিন ইচ্ছে করেই তা শেষ করছে না হয়তো৷ সে টিপটা বার বার দু'ভ্রুয়ের মাঝ বরাবর রাখছে আর তুলে নিচ্ছে৷ সেটাকে পরছে না৷ আমি আবারও বললাম,
-তুমি কি আমার কথা শুনতে পাওনি?
প্রতিবারের মতো সে এবারেও প্রশ্নটার জবাব দিলো না। আমি বললাম,
-তুমি কি এখনও আমার উপর রেগে থাকবে?
মিহিন নিরুত্তর। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। তার আগেই সে আমার দিকে ফিরে কঠিন স্বরে বলল,
-ডোন্ট ট্রাই টু টাচ মি!
আমি থেমে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না আর। মিহিন চোখেমুখে তীব্র রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী তীক্ত তার বদন। আমায় নিয়ে এতো বিষাদ কেন তার মাঝে? হঠাৎ তার এতো কঠোরতা আমাকে নীরব করে দিল যেন! আমি যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
মিহিন বেশ কিছু সময় আঙ্গুল উঁচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আমার খানিকটা খারাপই লাগলো৷ এতোটা কঠোরতা কখনই এই মেয়েটার থেকে আশা করিনি আমি৷ সে কখনও এমন করেওনি৷ ইদানীং বেশি করছে৷ তার বেশি করাটা কেমন জানি বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে৷ আমি যেন ঠিক নিতে পারছি না৷ সামান্য একটা ব্যাপারকে সে খুবই গভীর ভাবে নিচ্ছে। এতোটা গভীর ভাবে না নিলেও পারতো৷
মেয়ে জাতিটাই বড় অদ্ভুত। যেখানে সিনক্রিয়েট করার কথা সেখানে করে না৷ যেখানে অপ্রয়োজনীয় কিংবা না করলেও চলে সেখানে ঠিক সিনক্রিয়েট করে বসে। এদের মন মানসিকতা বোঝাটা ভীষণ কঠিন৷ কখন কখন এরা রেগে যাবে সেটা তারা নিজেরাও ঠিক জানে না৷
আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম৷ রুমটায় কেমন দমবন্ধকর একটা ভাব চলে এল। কেমন অস্বস্তিকর একটা মূহুর্ত আচমকাই তৈরী হয়ে গেল। আমি ছাদের দিকে এগোলাম৷
মিহিনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। তার প্রতি আমার আলাদা একটা দূর্বলতা আছে৷ তাকে নিয়ে আমার আলাদা একটা জগৎ আছে। খুবই অচেনা অথচ তীব্র প্রেমের আদলে তৈরী হওয়া এক আনন্দঘন জগৎ। কী মুগ্ধতা সেই জগতের প্রতিটা কোণে কোণে! আমি সেই মুগ্ধতায় বেঁচে থাকা একমাত্র প্রাণ। ওই জগতের একমাত্র বাসিন্দা। আমার এই মুগ্ধতাটা কি বোঝে না তার অবহেলা এই ক্ষুদ্র বাসিন্দাটাকে কী ভীষণ পীড়া দেয়?
মিহিনের সাথে আমার প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয়। তবে সেটা দ্রুত মিটে যায়৷ দূরত্ব আমারা দু'জনেই যেন একসাথে অনুভব করতে পারি। একাকিত্ব যেন আমাদের দু'জনকে একই ব্যাথা দেয়৷ সেই ব্যাথা, সেই অনুভব আমাদের বেশিক্ষণ দূরে থাকতে দেয় না৷ কীভাবে যেন কাছে টেনে নেয়৷ আমরা আবার আগের মতো হয়ে যাই৷
অথচ সেদিনের ঘটনার পর আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, মিহিন এখনও আমার উপর রেগে আছে৷ আমার সাথে কথা বলছে না৷ আমাকে ইগনোর করছে৷ অথচ সেদিনের সেই ঘটনাতে এতোটা রাগার কিছুই ছিল না৷ এরচে মারাত্মক ইস্যু নিয়ে আমাদের মাঝে বিবাদ হয়েছিল। সে তখন এতোটা রিয়েক্ট করেনি৷

ভালোবাসার গল্প - নিশিরাত ৷ লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ

সেদিন আমি কেবল বলছিলাম, "ওর সাথে এতোক্ষণ কী করছিলে তুমি?" ব্যস। এরপর থেকে সব কিছু বিষাদ হয়ে গেল৷ সমস্তই যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেল। আমি আমার তৈরী জগতেরই তীক্ততা হয়ে গেলাম।
সেদিন দাওয়াত ছিল মিহিনদের বাসায়৷ তার চাচাতো বোনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে৷ সে উপলক্ষেই আমাদের সেখানে যাওয়া। মিহিনের সাথে নাকি তার সেই চাচাতো বোনের খুবই চমৎকার সম্পর্ক। সে হিসেবে দাওয়াত পাই৷ বেশ খুশি মনেই সেখানে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু যখনই ওখানে সোহান ছেলেটাকে দেখলাম তখনই আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। আমি ভাবলাম এখান থেকে চলে যাই৷ এখানে আর এক মূহুর্তও থাকা যাবে না৷ মিহিন থাকুক৷ আমি থাকব না৷ আমি থাকলে কিছু না কিছু ঘটবে৷ অবশ্যই ঘটবে৷ কারণ এই ছেলেটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না৷ একে দেখলে আমার মেজাজটা মাত্রাতিরিক্ত গরম হয়ে যায়৷ এতোটা গরম হয় যে আমি নিজেকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না৷ রাগটা চলে আসে।
আমার এতোটা রেগে যাওয়ার একটা কারণ অবশ্যই আছে৷ কারণটা হচ্ছে ছেলেটা মিহিনের বেস্ট ফ্রেন্ড৷ ওদের বাসার পাশেই বাসা৷ সে হিসেবে ছোট থেকেই জানাশোনা৷ এটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে এই ছেলেটা মিহিনের পেছনে অনেক ঘুরেছে তার সাথে প্রেম করার জন্যে৷ এমনকি আমাদের যখন প্রেম চলছিল তখনও ছেলেটা এমন কাজ করেছে৷ খুব চেষ্টা করেছে যাতে আমাদের প্রেমটা না টিকে। আমি মূলত এ জন্যেই ছেলেটাকে দেখতে পারিনা। তাছাড়া সে কথায় কথায় মিহিনের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে৷ এটা দেখলেই আমার গা জ্বলে যায়৷ রাগটা মাথায় চড়ে যায়৷ বেটা আমার বিয়ে করা বউ৷ তুই কেন তার গায়ে হাত দিবি? বন্ধুবান্ধবের পর্ব শেষ৷ মেয়েটা এখন বিবাহিত। তার সাথে এখন চাইলেও ঠিক আগের মতো মেশা যাবে না৷ কিছুটা দূরত্ব অবশ্যই মেনটেইন করতে হবে৷ অথচ ছেলেটা সেটা করে না৷ সে নিজের মতোই চলে। বরং মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ছেলেটা আমাকে জ্বালানোর জন্যেই এমন করে৷ সে যেন চায় আমি সিনক্রিয়েট করি৷ করেছিলামও বেশ কয়েকবার৷ এ জন্যে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে৷
আমি মাঝে মাঝে নিজেও নিজেকে ঠিক বুঝি না৷ বুঝতে পারি না৷ আমি কেমন জানি এককেন্দ্রিক। আমি সেই ছোট বেলা থেকে যে ব্রান্ডের কলম দিয়ে লিখে এসেছি এখনও সেই ব্রান্ডটাই ইউজ করছি৷ আমি কেন জানি মায়া ছাড়তে পারি না৷ এই ব্রান্ডের উপর মায়া জমে গেছে তো আমি কেবল এই ব্রান্ডটাই ইউজ করছি। অন্য আরো ভালো ব্রান্ড এলেও আমি কেবল এটা নিয়েই চলে এসেছি। আমি আমার মায়াটাকে বাঁচিয়ে রাখি৷ এই মায়াটাকে ছাড়তেও যেন ভীষণ মায়া লাগে আমার৷ এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ। তবে এই ব্যাপারটা আমার জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমি ইউজ করে এসেছি৷ জানি না এটা করা ঠিক নাকি বেঠিক!
আমার কেবল মিহিন মেয়েটাকেই ভালো লেগেছে৷ আমি তাকে চেয়েছি৷ একদম সম্পূর্ণ আমার করে চেয়েছি৷ আমার চাওয়া পূর্ণ হয়েছে৷ যেহেতু এই মিহিনই আমার একমাত্র, আমার অবশিষ্ট, তাই তার ব্যাপারে আমি একটু বেশিই সিরিয়াস। বেশি কনসার্ন। আমি বেশ পজেসিভ একটা ছেলে। মিহিন আমার মানুষ৷ তাকে ছোঁয়ার অধিকার কেবল আমার৷ তার সুখ দুঃখ, প্রতিটা ক্ষেত্রের অধিকার কেবল আমার৷ এগুলোতে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করলে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়৷ আমি তখন নিজের কন্ট্রোলে থাকি না৷ আমার রাগ আমাকে কন্ট্রোল করে যেন৷
আমি জানি এই ব্যাপারটা ঠিক না৷ এতোটা পজেসিব হওয়াটাও ঠিক যায় না৷ কিন্তু আমি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না৷ মন থেকে এটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারি না৷ ব্যাপারটা যেন আপনা আপনি চলে আসে৷ আমাকে রাগান্বিত করে ফেলে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি এটা থেকে মুক্তি পাবার৷ কিন্তু আমি প্রতিবারই আশাহত হয়েছি৷
সেদিন সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল৷ শুধু ঠিক ছিল না সোহান ছেলেটা৷ সে মিহিনকে দেখা মাত্রই তার পেছনে পড়ে গেল। তাকে নিয়ে নানান গল্পে মেতে উঠলো৷ আমার অসহ্য লাগছিল। আমি কেবল জড়সড় হয়ে বসে ছিলাম সেখানে৷ প্রয়োজনে একটু আধটু হেসেছি৷ ব্যস৷
ততোক্ষণ পর্যন্ত কিছুই ঘটেনি৷ ঘটনা ঘটল বিকেলের দিকে। লাঞ্চের পর খানিকটা চোখ লেগে এসেছিল। মিহিন আমার কোলের কাছেই শুয়েছিল৷ কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পর দেখলাম সে নেই। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। মেয়েটাকে পেলাম না৷ তার খবর নিতে পাঠালাম এক পিচ্চিকে৷ পিচ্চি এসে জানালো মিহিন ছাদে আছে৷ সোহানের সাথে গল্প করছে৷ এটা শোনার পর স্বভাবতই আমার বেশ রাগ হয়েছে৷ তবে আমি কোনো বাজে কান্ড করিনি৷ আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম বিছানায়৷ নিজেকে স্থির করছিলাম। এতো রাগা যাবে না৷ ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে হবে৷ ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড৷ অনেক দিন পর দেখা হলে একটু গল্প গুজব করতেই পারে৷ এতো রাগার কিছু নেই৷ আমি নিজেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম৷ নিজেকে বোঝালাম, এবার যদি কোনো বাজে কান্ড করি তবে মিহিন খুব রাগবে৷ কারণ এই ব্যাপারটা নিয়ে আগ থেকেই আমাদের মাঝে বেশ কয়েকবার ঝগড়া হয়েছিল৷ শেষবার মিহিন প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যে আমি যেন এমন আর না করি৷ করলে সে কী করবে সেটা সে নিজেও জানে না৷ আমাকে সে জন্যে হলেও চুপ থাকতে হবে৷ মিহিনকে রাগতে দেওয়া যাবে না৷ কোনো ভাবেই যাবে না৷ আমি বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম৷ তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেলাম৷ সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম৷ দেখলাম তারা দু'জন রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন আলাপ করছে। খুবই গভীর আলাপ যেন! আমি অবাক হলাম৷ এদের মাঝে এতো গভীর আলাপের কী ঘটলা আবার৷ আমি তাদের দেখলাম কিছু সময়। এরপর ভাবলাম চলে যাই৷ ওদের বিরক্ত করে লাভ নেই৷ অথচ ভেতরে ভেতরে আমার মন চাচ্ছিল আমি মিহিনকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে আসি৷ এনে বলি "এই ছেলের সাথে এতো আলাপ কিসের তোমার হু?"
আমি চলে যাওয়ার পথ ধরলাম। তখনই মিহিন আমাকে ডাকল। দেখে ফেলেছে হয়তো৷ বলল,
-এই? ঘুম ভাঙ্গল কখন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-এই তো খানিক আগে৷
-নিচে যাও। মিলিকে চা করে দিতে বলো৷ আমি আসছি।
আমি আবারও হাসলাম। কিছু বললাম না৷ নিচে নেমে এলাম।
মিহিন নিচে নেমে এলো সন্ধ্যার পর৷ আমি রুমেতেই বসেছিলাম৷ সে রুমে এসে বলল,
-চা দিয়েছে?
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। ঠিক পারলাম বলে মনে হয় না৷ বললাম,
-নাহ৷ চা চাইনি আমি৷
মিহিন কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ বলল,
-কী ব্যাপার! তোমার মুড খারাপ নাকি?
-নাহ৷
-মুখ কালো করে আছো কেন?
-এমনি।
-সত্যি করে বলতো কী হয়েছে?
-কিছু হয়নি।
মিহিন কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে৷ হঠাৎ সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ এই দীর্ঘশ্বাসটাকে আমি জানি৷ সে বুঝতে পেরেছে৷ আমি কেন রেগে আছি সে ঠিক বুঝতে পেরেছে৷ মিহিন বলল,
-তোমার এই ব্যাপারটা গেল না আর!
আমি ভ্রু কুচকে, তবে শান্ত স্বরে বললাম,
-ওর সাথে এতোক্ষণ কী করছিলে তুমি? আমি সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি।
-কী করছি মানে? তুমি দেখোনি কী করছিলাম?
-তাই বলে এতোক্ষন? তোমাদের এতো কথা কিসের?
-কেন? আমাদের কথা থাকতে পারে না?
-তা পারে! তাই বলে আমাকে বসিয়ে রেখে তুমি তার সাথে আলাপ করবে তা তো হয় না! তাও আবার এতোক্ষণ!
-তোমার সমস্যাটা কোথায় বলতো?
-আমার সমস্যা একটাই। তুমি ছেলেটার থেকে দূরে থাকবা৷ ব্যস৷
-কেন? ওর থেকে দূরে থাকবো কেন? তুমি যে তোমার বন্ধুদের সাথে এতো আড্ডা দাও আমি কি কিছু বলি তোমাকে? বলো বলি?
-ওদের তো আর গায়ে পড়ার স্বভাব নেই৷
-অ্যাই! বাজে কথা বলবে না একদম। গায়ে পড়ার স্বভাব বলতে কি বুঝিয়েছো তুমি? কী বোঝাতে চাও তুমি তাসফি?
-আমার ওকে সহ্য হয় না মিহিন। ওর কথা বলার ধরণ আমার অপছন্দ৷
-তোমার সহ্য না হলে আমি কী করব? শোনো, তোমার এসব ন্যাকামো তোমার কাছেই রাখো। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷ ওর সাথে আমি যেমন ইচ্ছে তেমন মিশব। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবো৷ তুমি আর তোমার ন্যাগেটিভ মাইন্ড এই দুটাকে আমাদের থেকে দূরে রাখবা৷ আর কখনই আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবানা বলে দিলাম৷ তোমার এসব অসহ্য লাগে আমার।
-এভাবে কেন বলছো? আমি যদি কোনো মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলি তখন তো তুমি বেশ রেগে যাও৷ চিল্লাচিল্লি করো। এখন আমি করলাম বলেই দোষ!
-আমি তোমার মতো এতো বেশি বেশি করি না। আমি লিমিটের মধ্যেই করি।
-তুমি বলতে চাচ্ছো আমি লিমিট ছাড়া করতেছি?
-তুমি অতিরিক্ত করতেছো।
-বাহ! বেশ তো! আমাকে বসিয়ে রেখে আপনি অন্য কারো সাথে দীর্ঘ আলাপালোচনায় লিপ্ত থাকবেন আর আমি কিছু বললেই সেটা অতিরিক্ত হয়ে যাবে? আমি কিছু বলতেও পারবো না?
-না! তুমি কিছুই বলতে পারবে না আর৷ আমাদের নিয়ে তোমার আর কোনো কথা বলার অধিকার নেই। আমি তোমার থেকে সেই অধিকারটা ছিনিয়ে নিলাম।
-মিহিন, তুমি ওই ছেলেটার জন্যে আমার সাথে এমন বিহ্যাভ করছো?
-তুমি আরো বাজে বিহ্যাভ ডিজার্ব করো৷ তোমার ভাগ্য ভালো যে তোমার প্রতি আমি দয়া করেছি।
-দয়া? কি দয়া করছো শুনি?
-তোমাকে সবার সামনে অপমান করিনি এটা কি দয়া নয়?
-দয়াই বা কেন করছো। এটাও করে ফেলতে! তোমার কাছে তো আমার কোনো অযুতই রইলো না। এখন আর অপমানিত হলেও আমার কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয় না৷
মিহিন আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
-নিজের অযুত টিকিয়ে রাখতে শিখো আগে৷ তাহলে এভাবে আর অপমানিত হতে হবে না৷
কথাটা বলেই সে হাঁটা ধরলো। আমি পেছন থেকে বললাম,
-তুমিও তোমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শেখো৷
সে কথাটা শুনলো বলে মনে হয় না৷ চলে গেল!
কথা-কাটাকাটির অনেকক্ষণ পরেও মিহিন আমার কাছে এলো না। আমি উঠে তৈরী হয়ে নিলাম৷ এখানে থাকার কোনো মানেই হয় না৷ মিহিনের বাবার সাথে কিছু সময় কথা বললাম। তারপর উনার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। বাসায় এসে মিহিনের ফোনের অপেক্ষা করলাম। সে ফোন দিল না৷ পরেরদিনও অপেক্ষা করলাম। তার দিক থেকে কোনো রেস্পন্স পাইনি৷ মিহিন আমাকে ফোন দেওয়াই ছেড়ে দিয়েছে হয়তো। আমার আর মন মানছিল না৷ আমি নিজেই ফোন দিলাম। ভাবলাম সরি বলি। যা হবার হয়ে গেছে। এগুলো মনে রেখে লাভ নেই৷ আমি আসলে মেয়েটা বেশ মিস করতে শুরু করি। তার সাথে কথা বলাটা মিস করি৷ আমার বুকের ভেতর শূন্যতারা দলা বাঁধে। আমার মনে হয় ভুলটা আমিই করেছি৷ এভাবে সিনক্রিয়েট না করলেও হতো৷ আমি বেশিই রেগে গিয়েছি। এভাবে ওকে কথা গুলো বলা উচিৎ হয়নি৷ ওকে হয়তো প্রশ্নটা করাই উচিৎ হয়নি৷ আমি তাকে ফোন দেই৷ সে ফোন ধরে না৷ মেসেজ দেই৷ তার রিপ্লাই আসে না৷ কী এক অসহ্য যন্ত্রণা! মেয়েটা আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? তার তো অন্তত একটা রিপ্লাই দেওয়া উচিৎ। রেগে আছি এমন কিছু অন্তত বলা উচিৎ। নাহ! সে কিছু বলেনি৷
কাল সে নিজেই বাসায় ফিরে এলো৷ আমাকে ফোন দিয়ে বলেওনি যে সে আসবে৷ একা একা এসেছে৷ আমি জানতাম না। অফিসে ছিলাম। বাসায় এসে দেখি মিহিন। সোফায় বসে টিভি দেখছে। কী তীব্র এক আনন্দ আমাকে আঁকড়ে ধরলো চট করেই। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম,
-কখন এলে?
মিহিন জবাব দিলো না৷ আমি বললাম,
-ফোন-মেসেজ কোনো কিছুরই রিপ্লাই করোনি৷ খুব বেশি রেগে আছো তুমি?
মিহিন ভ্রু কুচকে বলল,
-ফ্রেশ হয়ে নাও৷ ঘামের স্মেলটা অসহ্য লাগছে!
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
 
ফ্রেশ হয়ে এসে মিহিনকে নিজের রুমেই পেলাম। চট করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম,
-মহারানী কি খুব রেগে আছেন?
মিহিন জবাব দিলো না৷ আমি তার ডান হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নিলাম। সে চট করেই সেটা ছাড়িয়ে নিলো। আমি তার হাতটা আবার ধরতে চাইলাম। সে এক ঝাটকায় হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিলো৷ বলল,
-হাত ধরবা না।
-কেন?
-ভালো লাগছে না আমার।
-কী হয়েছে?
-তুমি বোধহয় জানো না কী হয়েছে?
আমি খানিকটা সময় চুপ থাকলাম। তারপর মিহিনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-শোনো।
সে তাকালো না। আমি আবার বললাম,
-শোনো না!
সে পাথরের মতো হয়ে বসে আছে। আমি বললাম,
-আ'ম সরি মিহিন! এক্সট্রিমলি সরি৷ আমার আসলে তখন কথাটা বলা ঠিক হয়নি৷ আমি কী করব বলো? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না আমি৷ এই ঈর্ষা ভাবটা আমার মাঝে হুট করেই চলে আসে।
-আমি তোমাকে অনেক ম্যাচিউর ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি এতো ইম্যাচিউর কাজ করবে তা ভাবতেও পারিনি৷
-সরি! আর করব না এমন৷ প্রমিজ!
-তোমার কাছে প্রমিজ এবং সরি শব্দ দুটো খুব কমন হয়ে গিয়েছে৷ এই দুইটা শব্দ এতোটা কমন হয়ে গেলে এগুলোর মূল্য থাকে না আর৷ যেমনটা তোমার কাছে আর নেই৷
-প্লীজ মিহিন৷ এভাবে বলো না৷ আমি ভেতর থেকে সরি ফিল করছি বলেই বলছি!
-আমার তোমার সরি চাই না৷
-বেশ! কী চাও তবে! কী করলে তোমার রাগ কমবে?
মিহিন খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-কী সিদ্ধান্ত?
-যতোদিন না আমার রাগ আপনা আপনি পড়ে যাবে ততোদিন তুমি আমার সাথে মেশার চেষ্টা করবে না৷ আমার থেকে দূরে থাকবে৷ তুমি আমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টাও করতে পারবে না৷ এটা তোমার শাস্তি৷ তুমি মানো কিংবা না মানো, এটা তোমার জন্যে বরাদ্দ থাকলো!
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-আমাকে খুন করে ফেললেও তো পারতে!
বলে হাসলাম। আবার বললাম,
-রাগ ভাঙ্গানোর সুযোগটা অন্তত দাও আমাকে৷
-মোটেও না৷ এটা তোমার জন্যে একটা শিক্ষা হবে৷ জীবনে আর দ্বিতীয়বার যেন এমন না হয়!
-আমি তোমাকে ছাড়া থাকবো কী করে?
মিহিন কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো৷ আমি বললাম,
-তুমি পারবে থাকতে?
মিহিন এই প্রশ্নটার জবাব দিলো না৷ ধীর পাঁয়ে উঠে চলে গেল। আমি বিছানায় বসে থাকলাম। বিন্দুমাত্র নড়চড়ের ইচ্ছে হলো না আমার৷ বারবার মিহিনের কথা গুলো কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। কেমন জানি লাগছিল। কেমন অস্বস্তিকর কষ্টময় এক অনুভূতি।
.
এতো কষ্ট-ক্লেদ, ব্যাথা-বেদনা, বিষাদ আমার গলার কাছে কেমন কাটার মতো বিধে আছে৷ আমি কাউকেই আমার ব্যাথার গল্প বলতে পারছিলাম না৷ আমার ভেতরের বিষাদ পাহাড়টা যেন বেশিই ভারি হয়ে গিয়েছে৷ কিংবা হয়তো আমিই বেশি বেশি ভাবছি। মিহিনের রাগ একদিন না একদিন পড়ে যাবেই৷ ততোদিন ঠিক ভাবে অপেক্ষা করলেই হয়৷ এরমাঝে আমি আর কোনো বেড়াজালে পড়তে চাই না৷ সে জন্যেই সাদিককে ট্যুরের কথা বললাম। কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে এলে মনের ভেতর প্রশান্তি মিলবে। ক্লান্ত প্রাণ তাজা হবে৷ এছাড়া আমাদের ঘুরতে যাওয়া হয় না অনেকদিন৷ তাই ভাবলাম ঘুরেই আসি৷ ততোদিনে মিহিনের রাগটা পড়ে যাক৷ এমন একটা প্ল্যান ছিল আমার। কিন্তু মিহিনের আজ সকালের ব্যাবহারটা একটু বেশিই দুঃখ দিয়ে ফেলল। সে আমাকে স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারতো যে সে আমাকে নিষেধ করেছিল তাকে ছুঁতে৷ এভাবে আঙ্গুল উঁচিয়ে কঠিন গলায় না বললেও পারতো৷ তার অন্তত এটা বোঝা উচিৎ আমি তার মাঝে অভ্যস্ত৷ তাকে নিয়েই আমার নিত্য রুটিন। তাই হঠাৎ সেই রুটিন পরিবর্তন হলে কিছুটা অনিয়ম হবেই। এর জন্যে এতোটা কঠিন না হলেও পারতো সে।
.
-কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছিস নাকি?
দুপুরের খাওয়ার সময় তখন। আমি প্লেটে ভাত নিচ্ছিলাম৷ ঠিক তখনই আম্মা কথাটা বললেন। আমি বললাম,
-হ্যাঁ।
-কই যাবি?
-বান্দরবান।
-যাওয়ার প্রয়োজন নেই৷
-কেন?
-কেন মানে? আমি যেতে নিষেধ করেছি তাই যাবি না৷ ব্যস৷ এখানে আবার কেন আসছে কোত্থেকে?
আমি চুপ করে রইলাম৷ মিহিন আমার প্লেটে তরকারি বেড়ে দিলো। আমি খাওয়া শুরু করলাম। আম্মা আবার বললেন,
-নিশিতার বিয়ের কথাবার্তা এগোচ্ছে৷ ওরা হয়তো এ'কদিনের ভেতরেই ডেট দিয়ে ফেলবে৷ মিহিনকে যেতে হবে সেখানে৷ তোকে ওর সঙ্গে যেতে হবে৷
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-আমাকে কেন যেতে হবে সেখানে?
আম্মা বেশ কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে৷ আমি কিছু বললাম না আর৷ চুপ হয়ে গেলাম। আম্মা বললেন,
-গাধার মতো প্রশ্ন করিস না৷ তুই সে ঘরের জামাই৷ তোর দ্বায়িত্ব কর্তব্য ভুলে যাস না৷
আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ মিহিন পাশ থেকে বলল,
-ওর যাওয়ার দরকার নেই মা৷ আমি একাই যেতে পারবো৷ ওখানে গিয়ে একা একা বোর হবে ও৷
আম্মা বললেন,
-নতুন বউদের একা একা কোথাও যাওয়াটা শোভা পায় না৷
কথাটা বলে আম্মা একটু থামলেন৷ আবার বললেন,
-তোমাদের মাঝে কী হয়েছে না হয়েছে এসব আমি জানি না৷ জানতেও চাই না৷ আমি চাই যতো দ্রুত সম্ভব তোমরা আগের মতো হয়ে যাও। এভাবে পর পর আচরণ তোমাদের মানায় না এখন। যা বলি কান দিয়ে শোনো৷ মনমালিন্য যা হয়েছে সব ভুলে যাও৷ এমন অনেক কিছুই ঘটবে৷ সব ভুলে যেতে হবে৷ এসব মাথায় রেখে লাভ নেই! আমি জানি দোষটা এই গাধাটারই হবে৷ যতো সব আকাজ ওর দ্বারাই সম্ভব। তার জীবনে সে কাজের কাজ কেবল একটাই করেছে৷ সেটা হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করাটা৷ বাকি তার সকল কাজই দেখবা আকাজ ছাড়া কিছু না৷ এই ছেলেটাকে আমি মানুষ করতে পারলাম না!
ছোটবেলা থেকেই আম্মার এই ডায়লগটা শুনে বড় হয়েছি। আমাকে গাধা প্রমাণিত করে এই মানুষটা কী মজা পায় কে জানে! কিছু থেকে কিছু হলেও সব আমার দোষ৷ আমি গাধা বলেই নাকি এমন হয়েছে! ছোটবেলায় সেসব মানা যেত৷ কিন্তু এখন আমি যে বড় হয়েছি সেটা যেন তিনি দেখেনই না৷ কোনো না কোনো প্রসঙ্গে তিনি গাধা শব্দটা টেনে আনবেনই৷ ব্যাপারটা বড় অসহ্যকর লাগছে। এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই! তারউপর মায়ের মুখে গাধা শব্দটা শোনার পর মেজাজটা যেন আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে। শব্দটা বিষের মতো কাজ করছে যেন৷ আমি উঠে গেলাম৷ আম্মা চট করে বললেন,
-উঠছিস কেন?
আমি বললাম,
-খাওয়া শেষ৷
-কই? প্লেটে তো ভাত রয়ে গেছে৷
-খেতে ইচ্ছে করছে না আর৷
-তুই বললেই হবে নাকি? ভালোয় ভালোয় বসে পড়। খেয়ে নে৷
আমি বেসিনের দিকে এগোলাম! আম্মা আবার বললেন,
-আমার কথা অমান্য করিস না বলে দিলাম।
আমি হাতমুখ ধুয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। খেতে ইচ্ছে না করলে জোর কেন করবো? আর কতো জোর করব? ভালো লাগে না আর৷ অসহ্য লাগে!
.
বেশ কিছু সময় পর মিহিন এলো। আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম। সে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো৷ তারপর বলল,
-মায়ের সাথে এমন করলে কেন?
আমি পাশ ফিরে শুলাম৷ কিছু বললাম না৷ মিহিন আবার বলল,
-তাসফি, তুমি দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছো কেন?
আমি মনে মনে হাসলাম। আমি কেন এমন হচ্ছি সেটা তিনি বোধহয় জানেন না৷ কী অদ্ভুত প্রশ্ন! মেয়েটা পারেও বটে৷ সে আবার বলল,
-মা বেশ রাগ করেছেন! তিনি না খেয়ে উঠে গিয়েছেন৷
আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। বললাম,
-এখানে ঘুমানো যাবে না বোধহয়!
বিছানা থেকে নেমে আমি বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। আম্মার রুমে গেলাম। দেখলাম মা গাল ফুলিয়ে বসে আছেন বিছানার কাছে৷ রাগে তার রক্তবর্ণ চেহারা। আমি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আম্মা চিৎকার দিয়ে বললেন,
-খবরদার তুই আমার কাছে আসবি না। আমার কাছে এলে তোকে খুন করবো আমি। খাইয়ে খাইয়ে আমি একটা বেয়াদব পেলেছি! বেয়াদব তুই এদিকে আসবি না বলে দিলাম।
আমি মায়ের কথা গুলো ঠিক কানে নিলাম না৷ সোজা গিয়ে মায়ের কোলের কাছে মাথা রাখলাম। দু'হাত দিয়ে উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আম্মা দু'চারটা থাপ্পড় দিলেন৷ সেগুলো আমার গায়ে লাগলো বলে মনে হয় না৷ আমি বললাম,
-এই অবস্থায় তুমি আমাকে খুন করে ফেললেও আমি তোমাকে কিছু বলব না৷ তোমার যা ইচ্ছে তুমি তাই করো। আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবোই৷
আমার মা রাগ করলে আমি ঠিক এমনটাই করি৷ তিনি ভীষণ রেগে থাকলেও আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখি৷ যতোক্ষণ না তার রাগ কমবে ততোক্ষণ আমি তাকে ছাড়ি না৷ রাগ কমলেই তবে ছাড়ি৷ কারণ এছাড়া রাগ ভাঙ্গানোর জন্যে কোনো অভিনব পদ্ধতি আমার জানা নেই৷
.
এর প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা, মিহিনের সাথে ততোদিনে আমার একটি অদেখা দূরত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছে। আমরা দু'জন কাছাকাছি থাকলেও আমাদের মন আমাদের কাছে নেই৷ মিহিনের কথা বলতে পারি না৷ তবে আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি যে আমি যথার্থ দূরত্ব রেখে তার সাথে চলেছি। তার সাথে তার বাবার বাসায় গিয়েছি৷ নিশিতার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে৷ সে জন্যে শপিং করতে হবে৷ আমি তার সাথে শপিং করতে গিয়েছি৷ আমাদের সাথে সোহান ছেলেটাও গিয়েছে৷ আমি একটা শব্দও করিনি৷ বেশিরভাগ সময় তারা দু'জন এক সাথে চলেছে। তারা হাসছে৷ গল্প করছে। আমি সয়ে নিয়েছি৷ মানিয়ে নিয়েছি৷ প্রয়োজনে হেসেছি৷ তাও কিছু বলিনি৷ যে যেভাবে খুশি থাকতে পারে সে সেভাবেই খুশি থাকুক৷ ক'জনেই বা এমন খুশিতে থাকতে পারে! আমি তাদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণই এড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার আচরণে পরিবর্তন দেখে মিহিন অবাক হয়৷
আমি তার অবাকভাবকে উপেক্ষা করি৷ আমি নিজেই তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি৷ একাকী সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করি৷ শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে আমার খুবই চমৎকার সময় কাটে৷ মাঝে মাঝে নিশিতার সাথে গিয়ে গল্প করে আসি৷ এরপর কিছুই করার না থাকলে ছাদে উঠে বসে থাকি৷ আকাশ দেখি। তারা গুনি৷ অন্ধকারে কষ্ট বিলাই৷ মন্দ নয়। সময় ভালোই কাটে৷
.
আজ নিশিতার গায়ে হলুদ৷ মিহিন শাড়ি পরেছে৷ হলুদ শাড়ি৷ কপালে টিপ৷ চোখে কাজল। মুখে হালকা মেকাপের প্রলেপ। আমি প্রথমে তাকে দেখে চমকে উঠলাম খানিক৷ চোখ সরিয়ে নিতে চাইলাম। পারলাম না৷ মিহিন যেন চোখ দুটোকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়৷ কী অসাধারণ! কী অনিন্দ্য সে৷ তার চুল, চোখ, টিপে কী মুগ্ধতা বয়ে বেড়ায়! কী মায়া খেলা করে চেহারার মাঝে! আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে৷ গা ভর্তি সেই শীতল শিহরণ। আমি সেখান থেকে সরে গেলাম। তার থেকে দূরে থাকলাম। আড়াল হলাম। যেখান থেকে তাকে দেখা যাবে অথচ সে আমাকে দেখতে পাবে না৷
.
হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হবার অল্প কিছু আগেই পাত্র পক্ষ থেকে কয়েকজন মেহমান আসে৷ ছেলের ছোট বোনসহ তার কয়েকজন বান্ধবী৷ তাদের আসার কথা ছিল৷ আমি তাদের রিসিভ করতে যাই৷ সেখানেই ঐশিকে দেখি৷ গাড়ি থেকে নেমেই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ আমিও তাকে দেখে হাসলাম। সে এগিয়ে এসে আমাকে হালকা জড়িয়ে ধরলো৷ আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। এই মেয়েটা হঠাৎ জড়িয়ে ধরবে কে জানতো! ভাগ্য ভালো তেমন কেউ ছিল না পাশে৷ থাকলে আজ মানসম্মান সব যেতো৷ ঐশি বলল,
-কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
-ভালো আছি৷ তোমার মুখ কেমন কালো হয়ে আছে যে৷ ঘটনা কী?
আমি হাসলাম। বললাম,
-আর কোনো প্রশ্ন পেলে না, না?
-আরেহ সত্যিই বলছি! তোমাকে কেমন জানি লাগছে!
-কেমন? অসুন্দর?
-তোমাকে অসুন্দর বলবে কে!
-তবে?
-ঠিক জানি না! মনে হচ্ছে তোমার চেহারায় কিছু একটা নেই। কিছু একটা যেন মিসিং।
আমি হেসে বললাম,
-কিছুই মিসিং না৷ এসব তোমার মনের ভুল৷ বাদ দাও তো! বাসার খবর বলো। সব ঠিকঠাক?
-হ্যা। ঠিকঠাক।
-বেশ৷
-বাড়িটা বেশ সাজিয়েছে বলতে হয়!
-এক মাত্র মেয়ের বিয়ে৷ ধুমধামে না হলে হয়!
-আচ্ছা ভাবি কেমন আছে?
-ভালো আছে৷
-কই উনি?
-ছাদে আছে৷
-আমাকে পরিচয় করিয়ে দিও কেমন?
-দিবো।
-তোমার কি মন খারাপ?
-না৷
-শরীর?
-না তো!
-তোমাকে কেমন জানি লাগছে।
-কেমন?
-ওই যে আগে যেমন বললাম তেমন।
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷ বলার প্রয়োজনই পড়েনি৷ কারণ আমরা তখন ছাদে উঠে গিয়েছিলাম। ছাদ ভর্তি মানুষজন৷ সেই মানুষজনের আড়ালে প্রশ্নটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কে জানে! ঐশি এসেই নিশিতার আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো৷ তাদের মাঝে বেশ কিছু সময় আলাপালোচনা হলো। একে একে ঐশির সাথে সকলেই পরিচিত হলো৷ তার বান্ধবীদের নিয়ে এসে স্টেজের সামনে বসানো হলো৷ আমি তাকে ডেকে নিলাম৷ তাকে নিয়ে মিহিনের কাছে গেলাম৷ মিহিনকে ডাকলাম,
-মিহিন?
সে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো৷ আমি বললাম,
-অল্প কিছু সময় হবে?
সে কিছু বলল না৷ এগিয়ে এলো খানিক। আমি বললাম,
-ঐশির সাথে পরিচিত হও৷ ও হচ্ছে ঐশি৷ নিলয়ের ছোট বোন৷ আর ঐশি, এ হচ্ছে মিহিন। তোমার মিহিন ভাবি৷
বলে হাসলাম। ঐশি এগিয়ে এলো৷ হাত বাড়িয়ে বলল,
-হ্যালো, আমি ঐশি। ঐশি রহমান৷
-আমি মিহিন চৌধুরী৷
-ভাবি আপনাকে চমৎকার লাগছে৷
মিহিন হাসলো৷ বলল,
-নিজেকে আয়নায় দেখেছেন? দেখলে আমাকে এই কথাটা বলতেন না৷
ঐশি হাসলো৷ বলল,
-তাসফি, আমাদের একটু সময় দাও৷ ভাবীর সাথে কিছু কথা আছে আমার৷ উনার রূপের রহস্য না জেনে ছাড়ছি না আজ৷
আমি হাসলাম। তারা চলে খানিকটা দূরে গেল! কী এক আলাপে মশগুল হয়ে গেল! আমি সেখান থেকে সরে এলাম৷ সব কিছু থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।
.
-তোমার কিছু একটা হয়েছে নিশ্চিত।
আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঐশি দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি বললাম,
-খাওয়াদাওয়া শেষ?
-নাহ! শেষ না। সবাই খাচ্ছে৷
-তুমি খাওনি যে!
-আমি কারো অপেক্ষা করছিলাম।
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷ ঐশি এগিয়ে এসে বলল,
-তোমার সাথে খেতে বসবো।
-আমার খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই৷
-তোমার কি মন বেশি খারাপ?
আমি চুপ থাকলাম। ঐশি আরেকটু এগিয়ে এলো৷ রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো৷ বলল,
-ভাবীর সাথে কিছু হয়েছে?
-এই একটু কথা-কাটাকাটি আরকি৷
-জাস্ট কথা-কাটাকাটিই?
-হ্যাঁ৷
-সে জন্যেই মন খারাপ?
-বলা যায়৷
-কোনো কিছু স্পষ্ট করে বলো না কেন?
-স্পষ্ট করে বলেই বা লাভ কী!
-ভাবীর সাথে কথা বলব?
-প্রয়োজন নেই৷
-বলে দেখি। কী বলো!
-সে অন্য কিছু বুঝবে।
-অন্য কিছু?
আমি হাসলাম। বললাম,
-ঐশি, জীবনে কখনই কাউকে খুব বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলবে না৷ ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে৷ তুমি যে মানুষটাকেই বেশি গুরুত্ব দিবে ঠিক সে মানুষটাই তোমাকে বেশি আঘাত দিবে। তোমার গুরুত্বটা তোমার আঘাতে পরিণত হবে৷ এ জন্যেই আসলে কাউকে নির্দিষ্ট কিংবা একমাত্র করে ফেলা উচিৎ নয়।
-মনে হচ্ছে বেশ ভালোই ঝগড়া হয়েছে তোমাদের মাঝে।
আমি মেকি হাসলাম। বললাম,
-সম্পর্কে আজ সন্দেহ বাসা বেধেছে।
-সন্দেহ?
-হু?
-আশ্চর্য! ভাবি তোমাকে সন্দেহ কেন করছে?
-কারণটা শুনলে হার্টফেল হবে তোমার। তাই শোনার প্রয়োজন নেই৷
ঐশি খানিকটা হেসে বলল,
-না বলে তুমি যাবে কই?
-যেখানেই যাই না কেন, আমি তোমাকে বলছি না৷
-বলতে তো তোমাকে হবেই। বলো না প্লীজ!
আমি মৃদু হাসলাম। চুপ করে রইলাম। ঐশি আবার বলল,
-এখানে কোনো ভাবে কি আমি জড়িত?
আমি এবারেও চুপ থাকলাম। ঐশি আবার বলল,
-বাই এনি চান্স, উনি আমাকে আর তোমাকে নিয়ে সন্দেহে আছে নাকি?
আমি হাসলাম। বললাম,
-আজ অবাক হবে খানিক।
-কেন?
-এই যে চট করেই তোমার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম!
-তার মানে ভাবী আমাকে আর তোমাকে নিয়েই সন্দেহ করেছে৷
-সিক্স সেন্স খুব স্ট্রং তোমার৷
-কিন্তু আমাদের মাঝে সন্দেহের কোনো কিছুই তো ঘটেনি।
-ঘটেনি বলল কে?
-কী ঘটেছে?
-এই যে রেস্টুরেন্টে গিয়ে এতো আলাপালোচনা করলাম সেগুলোই কি যথেষ্ট নয়?
-আশ্চর্য ব্যাপার! সে সব তো নিলয় আর নিশিতার বিয়ের ব্যাপারে ছিল৷ আমি তোমার থেকে জাস্ট তাদের ফ্যামিলি ইনফরমেশন গুলো নিচ্ছিলাম। ব্যস৷
-এখন এই কথা তাকে কে বোঝাবে?
-কেন? তুমি বোঝাবা!
-আমার সাথে তো কথাই বলে না৷ তাছাড়া সে সন্দেহ করছে জানার পর থেকে আমার মনমানসিকতা অন্য রকম হয়ে গিয়েছে৷ এতো দিনের সম্পর্ক অথচ সে আজ আমাকে সন্দেহ করছে? তাও আবার তার বেস্ট ফ্রেন্ডের বানানো কোনো গল্পে বিশ্বাস করে! এটা জানার পর থেকে আমি নিজেই তার থেকে দূরে থাকছি৷ সেদিন কী দেখলাম জানো! দেখলাম সে আমার ফোন চেক করছে। চিন্তা করো তার মনের ভেতর কথাটা কী তীব্র ভাবে গেঁথে গেছে।
-তার এই বন্ধুটা কে?
-এই বন্ধুটার নাম হচ্ছে সোহান৷ দেখলে চিনবা৷ সে মিহিন আর আমার সাথে সেই প্রথম থেকেই লেগে ছিল। অনেক কিছুই এ যাবত করেছে৷ আমাকে মিহিনের সম্পর্কে বেশ কিছু বাজে কথা বলেছে ৷ মিহিনের ফ্রেন্ডদের সাথের ছবি গুলো এনে দেখিয়ে বলতো এটা হচ্ছে মিহিনের ক্রাশ৷ এই ছেলের সাথে মিহিনের ক'দিন প্রেম ছিল। এর সাথে বেশ কিছুদিন ফোনে কথা বলেছে। ব্লা ব্লা ব্লা! আমি এসব কিছুই মিহিনকে বলিনি৷ বলার প্রয়োজনবোধ করিনি৷ ছেলেটা ঠিক যেমন আমার কাছে এসব নিয়ে আসতো মিহিনের কাছে তেমন নিয়ে যেত৷ আমার নামে নানান গল্প বলতো! আর মিহিন এসব বিশ্বাস করে এসে আমাকে ধরতো৷ কিছুদিন আমাদের মাঝে এসব মনমালিন্যতা থাকতো৷ এভাবেই ছেলেটা প্রথম থেকে এমন করে এসেছে৷ এই যে তোমাকে নিয়ে মিহিনের এতো সন্দেহ! এটার বুননশিল্পী কিন্তু সেই ছেলেটাই৷ অথচ আমি যখন ছেলেটার সম্পর্কে কিছু বলতে যাই তখন আমি খারাপ হয়ে যাই৷ ছেলেটাকে সহ্য করতে পারি না৷ আমি ইম্যাচিউর। আমার কান্ডজ্ঞান নেই ইত্যাদি বিশেষণ প্রাপ্ত হই৷ এ জন্যেই বলা ছেড়ে দিয়েছি। তারা তাদের মতো থাকুক৷ এই যে দেখো না! না খেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই৷ জানেও না হয়তো যে আমি না খেয়ে আছি৷ সেই বন্ধুকে নিয়ে ঠিকই খেতে বসে গেছে! কী আর করার। কিছু বলতেও পারি না৷ কিছু সইতেও পারি না৷
ঐশি খানিকটা চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-ভালোই ফেঁসে গেছো দেখছি!
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-এ জন্যেই বলি কাউকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলো না৷ যতো বেশি প্রাধান্য দিবে ঠিক ততোটাই পস্তাবে৷
ঐশি কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই কারো এগিয়ে আসার শব্দ হলো৷ আমি সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম মিহিন এগিয়ে আসছে৷ আমি কিছু বললাম না৷ ঐশির দিকে তাকালাম। বললাম,
-তোমাকে আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশি সুন্দরী লাগছে!
ঐশি লজ্জা পেয়ে গেল। মুখ নামিয়ে বলল,
-সত্যি বলছো নাকি ভাবীকে জ্বলানোর জন্যে বলছো?
-কাউকে জ্বলানোর উদ্দেশ্যে আমি কিছু বলি না৷ তুমি জানো নিশ্চয়ই।
-তা জানি। আচ্ছা৷ মানলাম সত্যিই বলছো৷ তবে তোমাকে ধন্যবাদ দিবো না আমি।
মিহিন ততোক্ষণে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল৷ আমি তাকে উপেক্ষা করলাম,
-কেন? আমি কি ধন্যবাদ প্রাপ্য নই?
-অবশ্যই না৷ এটা তোমার আরো আগে খেয়াল করা উচিৎ ছিল। কী বলেন ভাবী? উচিৎ ছিল না?
মিহিন কেমন ফ্যাকাসে হাসি দিলো৷ বলল,
-ঐশি, আপনাকে খেতে ডাকছে।
ঐশি হাসলো৷ বলল,
-বেশ৷ চলুন। একসাথে খেতে বসি৷
-আমার আসলে ওর সাথে কিছু কথা আছে৷ আপনি এগোন৷ আমরা আসছি!
-আচ্ছা আচ্ছা৷ আপনারা কথা বলুন তাহলে। আমি যাচ্ছি।
ঐশি চলে যেতে থাকলো৷ আমি আমার জায়গায় ঠিক দাঁড়িয়ে থাকলাম। মিহিন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। মিহিন বলল,
-উনাকে আগ থেকেই চিনতে?
-কাকে?
-ঐশি আপুকে।
-তুমি নিশ্চয়ই জানো চিনতাম নাকি চিনতাম না৷
মিহিন চুপ করে থাকলো৷ কিছু বলল না৷ আমি বললাম,
-তুমি কিছু বলবে?
-তাড়া আছে নাকি তোমার?
-অযথা দাঁড়িয়ে থাকাও নিশ্চয়ই কাজের কিছু নয়!
-আমার সঙ্গটা এখন অযথা হয়ে গেল?
আমি হাসলাম৷ বললাম,
-এ ধরনের কথা এই মূহুর্তে তোমার মুখে মানাচ্ছে না৷
মিহিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ চট করেই কিছু বলে ফেলল না৷ আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছু সময় পর সে বলল,
-নিশিতার ব্যাপারে ঐশি আপুকে তুমি বলেছো?
-হ্যাঁ।
-কই উনি তো একবারও কথাটা বলেননি।
-বলতে বলিনি বলেই বলেনি৷
-বলতে বলোনি কেন?
-আমার ইচ্ছে হয়নি তাই৷ এভাবে থার্ড পারসন হয়ে বিয়ের মতো একটা জটিল ব্যাপারে আমি জড়াতে চাইনি৷ সে আমার অফিস কলিগ৷ সে হিসেবে আমার থেকে নিশিতার ব্যাপারে জানতে চেয়েছে৷ কারণ তার বড় ভাই নিশিতাকে পছন্দ করেছে৷ আমি কেবল তাদেরকে জানিয়েছি৷ নিশিতাকে আমার দৃষ্টিতে কেমন দেখি সেসব জানিয়েছি৷ ব্যস৷ এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই৷
-আমি তোমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা চাইনি৷ কেবল জানতে চেয়েছি।
-তা বোঝাই যাচ্ছে৷
-তুমি বেশি বেশিই বুঝে ফেলো।
-হ্যাঁ৷ আমার কাজই হচ্ছে বেশি বেশি বোঝা৷ থাকো তুমি। আমি গেলাম।
-শোনো।
মিহিন চট করে আমার ধরে ফেলল। টেনে ধরে রাখলো৷ বলল,
-যেও না৷ প্লীজ৷
-আমি এখানে থেকে কী করব?
-আমার পাশে দাঁড়াও৷
-দাঁড়ালে কী হবে?
-বেশি কথা বলো না। দাঁড়িয়ে থাকো কেবল।
আমি কিছু বললাম না৷ দাঁড়িয়ে থাকলাম কেবল৷ মিহিন আমার হাতটা ধরে রাখতে চাইলো৷ আমি সেটা ছাড়িয়ে নিলাম। সে আবার ধরতে চাইলো৷ আমি বললাম,
-হাত ধরতে চাচ্ছো যে?
-ধরতে সমস্যা কোথায়?
-তুমি নিজেই সমস্যা সৃষ্টি করে বলছো সমস্যা কোথায়?
আমি দু'হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রাখলাম৷ মিহিনকে হাত ধরার সুযোগ দিলাম না৷ সে বলল,
-তাসফি?
আমি জবাব দিলাম না৷ সে আবার ডাকলো৷ আমি এবারেও জবাব দিলাম না৷ সে বলল,
-আমার সাথে কি তোমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না?
আমি চুপ করে থাকলাম। মিহিন মাথা নিচু করে রাখলো৷ বলল,
-আমাকে কি আজ সুন্দর লাগছে না?
আমি এবারেও চুপ থাকলাম৷ মিহিন আবার বলল,
-সবাইই বেশ প্রশংসা করলো৷ এই যে তোমার চোখে যাকে আজ সুন্দরী লাগছে সে নিজেও প্রশংসা করে গেল। অথচ আমি যার জন্যে সাজলাম সে আমাকে একটা কথাও বলল না৷ আমাকে চোখ তুলেও দেখলো না৷
-এই কথা তুমি আমাকে কেন বলছো? যার জন্যে সেজেছো তাকে গিয়ে বলো?
মিহিন মাথা নিচু করেই রাখলো৷ খানিকটা ফুঁপিয়ে উঠলো যেন সে৷ ভারী স্বরে বলল,
-আমি তোমার জন্যে সেজেছি তাসফি৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-বেশ অবাক হলাম!
-কেন?
-এই যে তুমি বললে আমার জন্যে সেজেছো। এটা তো মহা অবাকর ঘটনা৷
-এভাবে বলো না প্লীজ৷ আমার কষ্ট হয়৷
-সরি। ক্ষমা করবেন৷ আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি৷
-তাসফি, তুমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছো৷ দূরে দূরে চলে যাচ্ছো যেন! কেমন অচেনা অচেনা বিহ্যাভ করছো৷
-তুমি তো তাই চাচ্ছিলে। চাওনি?
-আমি ভুল ছিলাম!
-ভুল?
-হ্যাঁ ভুল৷ কজ আমি জানতাম না সোহান তোমার কাছে আমার নামে নানান কিছু বলে এসেছে!
-এখন জানো?
-সব জানি। আমি তোমাদের সব কথা শুনে ফেলেছি। তুমি এই ব্যাপারটা আমাকে একবারও বলার প্রয়োজনবোধ করোনি? জাস্ট একবার বলতে। আমি তখনই সোহানকে কয়েকটা চড় দিয়ে ঠিক করে ফেলতাম!
-হাহাহা! তুমি কখনই এমনটা করতে না৷ কারণ তোমার বন্ধুর প্রতি তোমার অন্ধ বিশ্বাস ছিল৷ বরং আমাদের দু'জনের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যেতো৷
-একবার বলে তো দেখতে!
-সামান্য বলেই বেশ আক্কেল হয়েছে আমার৷
মিহিন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার চোখে চোখ রাখলো৷ বলল,
-শোনো।
আমি চুপ থাকলাম। সে আবার বলল,
-আমার চোখে চোখ রাখো৷
আমি তার দিকে মুখ ফেরালাম না৷ সে বলল,
-দেখো আমায়৷
আমি নিশ্চুপ থাকলাম। সে বলল,
-দেখো না প্লীজ৷
আমি তাকালাম না৷ সে আমাকে জোরে করে তার দিকে ফেরালো৷ আমার গালের কাছে হাত রাখলো৷ আমি সেটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
-ন্যাকামো করবে না প্লীজ৷
মিহিন চট করেই ফুঁপিয়ে উঠলো৷ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-এমন করো না প্লীজ৷
আমি চুপ করে থাকলাম। সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো৷ বলল,
-বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললাম তোমাকে?
আমি চুপ করে রইলাম। মিহিন আমার গায়ের সাথে মিশে গেল এবার। বলল,
-তোমার এড়িয়ে যাওয়াটা নিতে পারছিলাম না আমি৷
-এমনটা তো তুমিই চাইছিলে।
-আমি ভুল ছিলাম। বলেছি তো!
-এটা ভুল? এতো বড় ভুল? তুমি আমায় সন্দেহ করা শুরু করেছো। আমার ফোন ঘেটেছো।
মিহিন চট করেই আমায় জড়িয়ে ধরলো৷ এবং আশ্চর্যরকম ভাবে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে তীব্র রকম কান্না করতে শুরু করলো৷ ভেজা স্বরে বলল,
-আ'ম সরি তাসফি৷ আমি আমার বোকামীর জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে৷ আমাকে প্লীজ ক্ষমা করে দাও।
আমি হাসলাম। তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম৷ বিশেষ লাভ হলো বলে মনে হয় না৷ মেয়েটা শরীরের সকল শক্তি দিয়ে যেন জড়িয়ে ধরেছে আমায়৷ আমি বললাম,
-ছাড়ো আমায়৷
-উহু৷
-এটা কোন ধরনের ন্যাকামো বুঝলাম না।
-তুমি বুঝবে না৷
-কী আশ্চর্য ব্যাপার! এসবের মানে হয়? তুমি নিজেই দূরে থাকতে চেয়েছো অথচ এখন এসে জড়িয়ে ধরে বলছো তুমি ভুল ছিলে৷ ব্যস৷ এতেই হয়ে যাবে? এই যে এতো গুলো দিনরাত আমি তীব্র যন্ত্রণায় কাটিয়েছি তার সবটাই কি একটা সরির মধ্যমে মিটে যাবে? তাহলে আমি যে তোমাকে সেদিন এতো গুলো সরি বললাম কই সেগুলো তো দাম পেল না? আমার কথা তো তুমি কানে নিলেই না৷ বরং যাচ্ছেতাই ব্যাবহার করলে৷ সেগুলো ভুলে যাওয়া এতো সহজ?
-আমি সে জন্যে ক্ষমা চেয়েছি। আমি ক্ষমা চাচ্ছি৷
-আমি যে তখন ক্ষমা চাইলাম তখন তুমি ক্ষমা করেছো? বলো ক্ষমা করেছো?
মিহিন কিছু বলল না৷ সে কান্না করে গেল। আমি তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-প্লীজ ছাড়ো আমায়৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে৷
মিহিন মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো৷ বলল,
-এখন দম বন্ধ লাগছে?
-তুমি বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছো আমায়৷
-যতোক্ষন না তুমি আমায় ক্ষমা না করছো ততোক্ষণ আমি তোমাকে ছাড়বো না।
-তাহলে হয়তো পুরোটা রাত তোমাকে জড়িয়ে রাখতে হবে৷
-আমি পুরোটা রাত জড়িয়ে ধরে রাখব৷
-তাতেও লাভ হবে না৷
-যতোক্ষন না লাভ হবে ততোক্ষণ আমি এভাবেই থাকবো৷
-পাগলামি করছো তুমি।
-এমনিতেই তো পাগলের মতো বিহ্যাভ করছি আমি। তা না হলে তোমার সাথে এমনটা করতাম না আমি।
-তুমি আমার থেকে খুব সহজে ক্ষমা পাবে না মিহিন৷
মিহিন আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিলো৷ বলল,
-যতোটা কঠিন হয় হোক! আমি ক্ষমাটা ছিনিয়ে নিবোই।
-তুমি পারবে না৷
-আমি পারবো৷
-বেশ৷ পারলে তখন বলিও৷ আপাতত আমাকে ছেড়ে দাও৷
-আমি তোমাকে ছাড়ব না৷
-তুমি কিন্তু জোর করছো৷
-আমার অধিকার আছে জোর করার৷
-কীভাবে অধিকার চাচ্ছো?
মিহিন ফের মাথা তুলে তাকালো। বলল,
-চাইতে পারি না?
-অধিকার চাইতেও অধিকার লাগে।
-তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে চাইছো?
-যেমনটা তুমি করেছো।
-আমি সহ্য করতে পারবো না তাসফি৷
-তোমাকে সহ্য করে নিতে হবে৷
-ইম্পসিবল৷ তুমি এ'কদিন আমার সাথে ছিলে না৷ আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। এই যে তুমি আমাকে এমন এড়িয়ে যেতে, অবহেলা করতে শুরু করেছো, বিশ্বাস করবে না তখন মনে হচ্ছিল বুকের উপর পাথর জমা হয়েছে৷ কেমন হাসফাস লাগতে শুরু করেছিল। আমার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল তাসফি।
-এসব সেরে যাবে৷ ব্যাপার না।
-না। সারবে না৷ আমি পারব না৷
-তুমি পারবে।
-আমি বলেছি আমি পারব না।
-তর্ক করবে না৷
-করব৷
-আমার রাগ উঠছে মিহিন৷
-উঠুক।
-আমি বাজে কিছু করে ফেললে পরে কিন্তু আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না৷
-তুমি আমাকে খুন করে ফেললেও তোমাকে কিছু বলব না আমি৷
-প্লীজ! এমন করো না৷ আমার সত্যিই রাগ উঠছে৷
-আমি তোমাকে ছাড়ব না৷
-তোমাকে ছাড়তে হবে৷
-ছাড়ব না৷
-মিহিন, আমি তোমার থেকে আমার উপর সকল অধিকার কেড়ে নিলাম।
মিহিন কান্না করে দিলো৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-তুমি বললেই হবে না৷
-আমি বললেই হবে। তুমি বললেই যদি হয় তবে আমি বললেই কেন হবে না?
-আমি এসব মানি না৷
-তোমাকে মানতে হবে।
-অসম্ভব৷
আমি কিছু বললাম না৷ একটু জোর দেখালাম। তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সে তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমি ব্যাথা পাচ্ছি।
আমি চট করেই থেমে গেলাম। বললাম,
-তোমাকে আগেই বলেছি৷ ব্যাথা পাবে তুমি। ছেড়ে দাও আমাকে৷
মিহিন ভেজা স্বরে বলল,
-আমি তোমাকে ছাড়ব না৷ আমাকে তুমি মেরে ফেললেও না।
-তুমি সব সময়ই আমার উপর জোর খাটিয়ে গিয়েছে৷ আমি জোর করতে গেলেই যতো অনাচার হয়৷
-আমি আর কখনই এমন করব না৷
-তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি।
-তোমার আমাকে বিশ্বাস করতে হবে৷
-তুমি আমাকে ছাড়ো৷
-ছাড়ব না।
-কেউ আসছে এদিকে৷
-আসুক৷
-আশ্চর্য ব্যাপার৷ তুমি আমার মানসম্মান খাবে নাকি?
-আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো৷
-ছাড়ো প্লীজ৷ কেউ আসছে এদিকে৷
-তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো এমনটা তোমাকে বলতে হবে৷
-আচ্ছা বললাম।
-কী বলেছো?
-তোমাকে ক্ষমা করেছি৷
ঠিক সে সময়েই আমার শ্বশুরের স্বর ভেসে এলো৷ তিনি বললেন,
-মিহিন?
মিহিন আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-বলো বাবা।
-তোকে এখানে কেন পাঠিয়েছি?
-আসছি৷
-মেহামান চলে যাচ্ছে৷
-চলে যাক।
-তোরা দেখা করবি না।
-না৷
-ঐশি দেখা করতে চাচ্ছে৷
-তাকে বলো যে তাসফি ব্যস্ত আছে৷
আমি পাশ থেকে বললাম,
-কই? ব্যস্ত নই তো। দেখা করি আসি ওর সাথে৷
-কোনো প্রয়োজন নেই৷ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। বাবা তুমি যাও এখান থেকে৷ ওদিক ম্যানেজ করো৷
কথাটা বলে সে আমার দিকে ফিরলো৷ ফিসফিস করে বলল,
-আমি এটাকে আগে ম্যানেজ করে নেই৷
শ্বশুর সাহেব আমাদের বকতে বকতে চলে গেলেন। আমি তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মিহিন বলল,
-কী? তার জন্যে বুক ফেটে যাচ্ছে না?
-আমার বুক এতো সস্তা না।
-কতোটা সস্তা তা বেশি জানি আমি।
-তুমি যদি মনে করে থাকো তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি তবে সেটা তোমার ভুল ধারণা।
-হোক! ভুল ধারণা হোক! তুমি মুখ দিয়ে বলেছো তো!
-মুখে বলা আর মন থেকে বলা ভিন্ন ব্যাপার।
-আমি সেটা ম্যানেজ করে নিবো৷
-কী ম্যানেজ করবে?
-তোমাকে। তোমার মনকে।
-এতো সহজ না৷ তোমার উপর আমি এখনও বেশ রেগে আছি।
-তোমার রাগ কমানোর ঔষধ আমার কাছে আছে৷
-সেটা এখন কাজে লাগবে না৷
আমার বুকের ভেতরের শূন্য কষ্টটা সেটা কখনই মুছে ফেলতে পারবে না৷
-সেটা তোমাকে চরম ঘোরে ফেলে দিতে পারবে তাসফি৷ তুমি বুঝতেও পারবে না তুমি কোথায় আছো৷ কী করছো।
-আমার এমন ঘোর চাই না৷
-মনের কষ্ট তো দূর করতে চাও৷
-তাও চাই না৷
-তুমি না চাইলে কী হবে? আমি তো চাই৷ আমার কষ্ট নিবারণ করতে হবে৷ আমি এতো কিছু জানি না৷
-তোমার আবার কিসের কষ্ট?
-বারে! আমি বোধহয় আপনার থেকে দূরে থাকিনি৷ আমিও তো দূরে থেকেছি৷ আপনার স্পর্শের অভাবে রাতভর কেঁদেছি৷ যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাই সে বুকটাই যদি ওপাশ ফিরে শোয় তবে আমার ঘুমানোর উপায় কী?
-এই নিয়তি কি তোমার কর্মের ফল নয়?
-বেশ আক্কেল হয়েছে৷ এমন কর্ম আর করব না৷ প্রমিজ। এই কান ধরেছি৷
আমি কিছু বললাম না৷ সে কান ধরেই বলল,
-সোহানের সাথে আর কথা বলব না৷ কান ধরে বললাম।
আমি মাথা নিচু করে নিলাম। সে বলল,
-এদিকে তাকাও৷
আমি তাকালাম না৷ সে আবার বলল,
-আমার চোখে চোখ রাখো প্লীজ!
আমি মাথা তুলে মেয়েটার দিকে তাকালাম। চোখে চোখ রাখলাম। সে আমার আরেকটু কাছে এলো৷ আমার গায়ের সাথে মিশে গেল৷ ফিসফিস করে বলল,
-চোখ পড়তে পারো?
-পারি।
-কী দেখো?
-অনেক কিছুই।
-অনেক কিছু কী?
-বলব না৷
-বলো৷
-পারব না৷
-আমার কোমরের কাছে হাত রাখ৷
-কেন?
মিহিন কেন'র জবাব দিলো না৷ সে আমার হাত দুটো টেনে তার কোমরের কাছে নিয়ে গেল। বলল,
-হাত সরাবা না৷
আমি চুপ করে রইলাম৷ সে তার মুখটা আরেকটু এগিয়ে আনলো৷ দুহাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। বলল,
-চোখে কি প্রেম দেখো?
-দেখি না৷
-ভালোবাসা দেখো?
-না৷
-তুমি আমাকে ভালোবাসো?
-না।
-আমাকে কি সুন্দর লাগছে?
-লাগছে না৷
-কেমন লাগছে?
-পেত্নীর মতো।
-এই পেত্নীটাকে কি তুমি একটা চুমু খাবে?
-না।
-সে ভীষণ তৃষ্ণার্ত।
-তার পানি খাওয়া উচিৎ।
-সে পানি খেতে চায় না৷
-কী খেতে চায়৷?
-চুমু৷
-তুমি কাঁদছো কেন?
-এমনি।
-তোমার চোখে এতো জল কেন বলো?
-তুমি আমাকে পেত্নী বলেছো তাই৷
-পেত্নীকে পেত্নী বললে সে কাঁদে না৷ সে খুশি হয়৷
-আমি খুশি হচ্ছি না৷
-কেন হচ্ছো না?
-জানি না৷
-কী জানো তুমি৷
-ভালোবাসি৷
-আর?
-কারো চোখ।
-আর?
-চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
আমি হাসলাম। তাকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নিলাম। বললাম,
-ঘোরে ফেলবেন?
-হু।
-এই যে কাজল মেখে এতো মায়া করো তা হয় না?
-হয় না৷ আমি ঠোঁটের মায়াও করতে চাই৷
-এটা আবার কেমন মায়া?
-দাঁড়াও৷ দেখাচ্ছি৷
মিহিন আমার গলার কাছটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ নিজের মুখটা একদম আমার মুখের কাছে নিয়ে এলো৷ তার নিঃশ্বাসের উত্তপ্ততা আমায় কেমন ব্যকুল করে তুলছে৷ সে তার ডান হাত দিয়ে আমার গালে হাত বুলালো৷ বলল,
-তোমার মাঝে অদ্ভুত এক ঘোর আছে তাসফি৷ আমি এই পর্যন্ত এলে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকি না৷ তোমার ঘোর যেন আমায় নিয়ন্ত্রণ করে।
কথাটা বলে মেয়েটা আর অপেক্ষা করলো না৷ দু'ঠোঁটের পরস্পর অনুভূতি আদানপ্রদান শুরু হয়ে গেল৷ কী দীর্ঘ সেই ক্ষণ৷ কী চমৎকার সেই অনুভূতি। কী অনিন্দ্য সেই মুগ্ধ শীতল শিহরণ। আমি যেন সুখের কোনো এক অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকলাম। মিহিনের ঘোর বেশ চেপে ধরলো আমায়৷
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।
গুগলে ব্লগটি সার্স করুনঃ Google

আমার সব গুলো গল্প পড়ুন এখান থেকেঃ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url