ভালোবাসার গল্প - পারু ভালোবাসা বুঝে না। লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ

ভালোবাসার-গল্প-পারু-ভালোবাসা-বুঝে না-লিখেছেন-তাসফি-আহমেদ
ভালোবাসার গল্প - পারু ভালোবাসা বুঝে না। লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ


ভালোবাসার গল্প - পারু ভালোবাসা বুঝে না। লিখেছেন তাসফি আহমেদ 

ভালোবাসার গল্প, বিষাদ, ফিকশন, নন-ফিকশন, ভৌতিক, রহস্যময় থ্রিলার গল্পে সমৃদ্ধ আমার এই ছোট্ট ব্লগটি। বাংলা ছোট গল্পের এই অনন্য-অসাধারণ জগতে আপনাকে স্বাগতম। ভীষণ অপূর্ণতায় ভরপুর আমার গল্প গুলো। তাও লিখি। লিখলে মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত এক প্রশান্তি মিলে। বিশেষ করে ভালোবাসার গল্প গুলো। কারণ এই ভালোবাসার গল্প গুলোতে আমার এক প্রেমিকা থাকে। কাল্পনিক প্রেমিকা। তারে ভীষণ ভালোবাসি আমি।

ভালোবসার গল্পঃ পারু ভালোবাসা বুঝে না।

লেখকঃ তাসফি আহমেদ

 

 

পারু স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল, 

"মহিলাডা কে?"

আবির পারুর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, 

"বড় ভাইয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী৷ তোমার সতীন।"

পারু হাসলো। সে ভাবল তার ছোট দেবর হয়তো ঠাট্টা করছে৷ এমন ঠাট্টা সে প্রায়ই করে। এ আর নতুন কী! পারু হাসতে হাসতে বলল,

"কী যে কও না।"

"সত্যিই বলছি ভাবী।"

"হুরো! তোমার ঠাট্টা করার অভ্যাসটা গেল না আর না?"

"আমি ঠাট্টা করছি না।"

"তুমি হইলা ঠাট্টা করায় অস্তাদ৷ আমি তোমারে হাড়েহাড়ে চিনি। মাজাক কইরো না৷ হাসা কইরা কও তো কে এই মহিলা?"

"আমি সত্যিই বলছি। বড় ভাইয়া নিজ মুখেই বলেছেন।"

"তুমি হয়তো ভুল হুনছো। তোমার ভাইয়ের পছন্দ এতো খারাপ না। হে কক্ষনই এরাম বুড়ি মার্কা মাইয়া বিয়া করবো না। আমার মনে অয় তুমি ভুল হুনছো। যাও তো! তোমার ভাইয়েরে আবার জিগায়া আও তো!"

"ভাইয়া বাসায় নেই।"

"কও কী! উনি আবার কই গেলেন?"

আবির খানিকটা সময় চুপ থেকে বললো,

"আব্বা ভাইয়াকে বাসাতে ঢুকতে দেননি৷ তাড়িয়ে দিয়েছেন। তুমি কি আব্বার বকাবাদ্য কিছুই শোনোনি?"

"তা হুইনাই তো ঘুম ভাঙ্গল। এক্কেরে কাঁচা ঘুম। মাথা কেমন জানি ভারী হইয়া আছে। তা বকছে ক্যান?"

আবির আবারো কিছু সময় নীরব থাকে। পারুর দিকে তাকিয়ে বলে,

"ভাবী, আমি সত্যিই বলছি৷ ভাইয়া আজ দুপুরেই উনাকে নিয়ে এসেছেন। আমাকে বললেন, তোর নতুন ভাবী৷ ঘরে নিয়া যা। আমি ঘরে নিয়ে আসতেই আব্বা রেগে গেলেন৷ ভাইয়াকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেছিলেন। সেখানে উনাদের তর্কাতর্কি হয়৷ তুমি আরেকটু আগে এলেই দেখতে পেতে।"  

পারু নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে,

"আমার মন মানতেছে না।"

"না মানলে তুমি উনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসো৷ আমি বাবাকে সামলাই।"

আবীর চলে যায়৷ মাঝ উঠোন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পারু৷ সে যেন নড়তে পারে না। কেমন স্থিরতা চেপে ধরেছে তাকে। 

বাড়ির অন্যান্য ঘরের দরজা-জানালা গুলো খোলা। প্রত্যেক ঘরের প্রতিজন কেউ জানালা দিয়ে কিংবা কেউ দুয়ার পেরিয়ে বাইরে এসে উঠোনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পারুর দিকে তাকিয়ে আছে৷ বাড়িময় কেমন থমথমে নীরবতা। ছোটা ছেলেমেয়ে গুলোও কেন জানি কোনো দুষ্টামি করতে আসছে না মাজ উঠোনে।    

চৌধুরী সাহাবের বড় ছেলে শাহেদ আরেক বিয়ে করেছে এমন রচনা বাতাসের গতীতে রচে যায় সমগ্র গ্রামে। পাশের বাড়ি থেকে দু'একজন মহিলা মুখে আঁচল গুঁজে কিছুটা দ্রুত বেগে ছুটে আসছে চৌধুরী বাড়ির দিকে। এরা আসতে আসতে মুখের আঁচল সরিয়ে যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে,

"ও ভাবী/ভাই? হুনলাম চৌধুরীর বড় বেটা নাকি আবার বিয়া করছে? ঘটনা কি সত্য?"

'ঘটনা সত্য' এমনটা কেউ বললে এদের পরবর্তী বাক্য এটা হয় যে,

"আহা! পারু মাইয়াটার কপাল পুড়লো গো! এরাম ভালা মাইয়া আর কুথাও পাইবো নাকি কন তো? মাইয়াটির কপালই মন্দ।"

এরা পরের ব্যাপারে বেশি উৎসাহ পাওয়া জনগন৷ এদের আরেকটি দল আছে৷ তারা বসে চায়ের দোকানে৷ আজকের সন্ধ্যায় মতিন মিয়ার চায়ের দোকান বেশ জমে উঠবে বলাই যায়। মতিন কেতলিতে প্রতিদিনের চেয়ে আজ পানি একটু বাড়িয়েই নিয়েছে। তার ধারণা আজ তার চা যথেষ্ট বিক্রি হবে৷ ছাই সেটা বাকিতে হোক কিংবা নগদে।

সমস্ত স্থবিরতা কাটিয়ে পারু ধীরে পায়ে ঘরটির দিকে এগিয়ে যায়। নতুন ঘর৷ কাউকে না জানিয়ে শাহেদ এই ঘরটি তোলে। নতুন ভিটে। পারু শাহেদের এমন কাজে অবাক হয়। হঠাৎ মানুষটি ঘর কেন তুলছে? সকলেরই এই একটা প্রশ্ন নিয়ে অল্পবিস্তর উৎসাহ ছিল। শাহেদকে যখন পারু প্রশ্নটি করে তখন সে জবাব দেয়,

"আমাগো একটা ঘর লাগবো পারু৷ আব্বা-আম্মা-আবির মিল্ল্যা ওই ঘরে আর থাওন যাইবো না৷ তোমার মাইডাও বড় হইতাছে৷ আমাগো এক্কান ঘর লাগে না? কও? লাগে না?"

"লাগে তো।"

বলে মৃদু হাসে পারু৷ লজ্জাময় হাসি৷ কেমন শীতল এক আনন্দ সেদিন পারুকে খুব আদর করেছিল। পারুর মনে প্রাণে কেমন খুশির জোয়ার বইছিল। মানুষটা তার জন্যে, তাদের জন্যে ঘর করছে এরচে খুশির ব্যাপার আর কী হতে পারে! 

ভালোবাসার গল্পঃ নিশিরাত ৷ লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ

সেই ঘর তৈরী হয়ে গেলে পারু নিজ হাতে মাটি এনে তাদের ভিটেটা লেপে নেয়৷ কী নিপুণ লাগে তার সেই লেপে দেওয়া মেঝেটি৷ পরের দিন খাট আসে৷ নতুন খাট। ঠাকুর হাট থেকে কেনা৷ ভারী কাঠ। বড় টেকসই। দামী৷ পারুর আনন্দ যেন ঝড়ের বেগে বাড়ছে৷ আবেগে তার চোখে সেদিন পানি আসার উপক্রম হয়। সেই খাটটি সেদিনই ঘরটিতে রাখা হয়৷ বিছানা দেওয়া হয়। পারুর নিজের জমানো টাকায় কেনা বিছানা। দুটি বালিশ। বাকিশের গায়ে নতুন পোষাক। কেমন চমৎকার লাগছিল ঘরটিকে। সৌন্দর্যতা চকচক করছিল যেন। সেই চকচক করা ঘরটিতে আজ পারুর শোয়ার কথা ছিল৷ অথচ আজ সেখানে অন্য একটি মানুষ বসে আছি৷ পারুর চেয়ে বড় কোনো এক নারী৷ যাকে সকলেই শাহেদের দ্বিতীয় স্ত্রী বলছে৷ অথচ সেটি পারু কেন জানি বিশ্বাসই করে নিতে পারছে না। 

পারু ঘরটির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়৷ ভেতরে জড়সড় হয়ে মেয়েটি বসে আছে৷ পারু ভেতর ঢোকে। মেয়েটির পাশে বসে৷ তার দিকে তাকায়৷ ভালো করে দেখে৷ বলে,

"তোমার নাম কী গো?"

নতুন বউ মৃদু স্বরে জবাব দেয়,

"রেহানা পারভীন।"

"বাড়ি?"

"নবাব গাঁ।"

"শাহেদ নামের কাউরে চিনো?"

"চিনি।" 

"দেখি কও তো তার পুরা না কী?"

"শাহেদ হোসেন চৌধুরী।"

পারু খানিকটা চুপ থাকে৷ আবার বলে,

"এই লোকটার লগেই তুমার সাদি হইছে?"

"হু।"

"হাসা কইরা কও।"

"আমি মিথ্যা বলি না।"

পারু চুপ হয়ে থাকে। কিছু বলে না৷ কিছু সময় কাটে নীরবতায়। পারুর আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না৷ মেয়েটি সুন্দরী। তারচে বয়সে বড় হবে৷ তবে সুন্দরী। যদিও সুন্দরের দিক থেকে তার বরাবর না৷ তবে তার কণ্ঠ ভারী মিষ্টি। মুগ্ধকর। শুনলেই আবার শুনতে ইচ্ছে করে। যেমনটা এখন পারুর করছে৷ তার মেয়েটির কণ্ঠ আবার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। মেয়েটার কণ্ঠ এতো চমৎকার কেন? শাহেদ কি ঠিক এই কারণটার জন্যেই মেয়েটিকে বিয়ে করেছে? এছাড়া মেয়েটি স্বাস্থ্য ভালো। পারুর মতো রোগাপাতলা না। পারু চট করেই বলে উঠে,

"আপা?"

"হু?"

"আপা কওয়াতে রাগ করছো?"

"রাগ করিনি।"

"তুমি কি শুদ্ধ কথা কইতে পারো?" 

"পারি।"

"আমারে শিখাইবা?"

"শিখাবো।"

"তোমরা সাদি করচো কখন?"

"আজ দুপুরে।"

"আমার স্বামী কি তোমারে ভালোবাসে?"

"বাসে।"

"তোমাদের প্রেম আছিল?"

"হ্যাঁ।"

"কতো দিনের?"

"ছয় মাস।"

"তোমার ঘরে কিছু কয় নাই?"

"আমি পালিয়ে এসেছি।"

"বাসায় জানে না?"

"না।"

"আল্লাহ গো! তুমি এই কাম করছো ক্যাম্নে? ক্যাম্নে পারলা বাপ মারে ফালাইয়া চইলা আইতে?" 

"আমি তাকে ভালোবাসি।"

পারু দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ বলে,

"ভালোবাসা কী আমি বুঝি না আপা।"

"এটা সবাই বুঝতে পারে না।"

"তোমার শাড়িটা বড় সুন্দর? উনি দিয়েছেন?"

"হু।"

"উনি তোমারে খুব ভালোবাসে তাইলে।"

"কেন? তোমারে বাসে না?"

"উহু।"

"কীভাবে বুঝলে?"

"উনি আমারে কিছুই দেয় নাই৷ কখনও কয় নাই, পারু তুমি খাইছো?" 

"উনি একটু চাপা স্বভাবের।"

পারু চুপ থাকে৷ কিছু বলে না৷ মানুষটা কেমন তা বেশ জানা আছে তার৷ তার গায়ের গন্ধটা পর্যন্ত তার চেনা৷ পারু ভালোবাসা বোঝে না৷ তবে সে রাত জেগে মানুষটির ফেরার অপেক্ষা করতে জানে৷ মানুষটি না খেলে তার কেন জানি খেতেই মন চায় না৷ 

  

নিজের বাবার বাড়ি গেলে পারু বেশি দিন থাকে না৷ যে ক'দিন থাকে বড় টেনশনে কাটে তার৷ মানুষটা কি খাচ্ছে না খাচ্ছে এসব নিয়ে তার বড়ই উদ্বেগ৷ সে বেশিদিন থাকতে পারে না৷ মানুষটা তার আশপাশে থাকলেই তার ভালো লাগে৷ আনন্দ লাগে। ব্যস৷ এতোটুকুই৷ এরপরেও পারু জানে না ভালোবাসা কী। ভালোবাসা কেন হয়? কীভাবে হয়। 

পারু বলে,

"আপা, চা খাইবা?"

"নাহ।"

"তোমার ভোগ লাগেনি?"

"লাগেনি।"

"আমার হাতের এক কাপ চা খাও। খাইয়া কইবা কেমন হইছে। কইবা?"

"আমি চা খাবো না।"

"আচ্ছা৷ খাইয়ো না। আমার লগে আসো। পাকের ঘর দেখবা।" 

নতুন বউয়ের বড় অনিচ্ছা৷ তবে সে কেন জানি পারুর কথাটা ফেলতে পারিনি। সে উঠে দাঁড়ায়৷ পারু বলে,

"এগুলা পইরা বের হইবা? পাল্টাইয়া নাও।"

"আচ্ছা। নিচ্ছি। তোমার নাম কী?"

"অভাগিনীর নাম জানতে নেই।"

"অভাগিনী কে?"

"এই যে আমি।"

"তুমি অভাগিনী তা বলল কে?"

পারু মৃদু হাসে৷ বলে,

"মজাক করলাম। আমার নাম পারুলি৷ সক্কলে পারু কইয়া ডাকে।"

"পারু, তুমি কি জানো তুমি কতো লক্ষ্যি একটা মেয়ে।"

পারু ফ্যাকাসে হাসি দেয়৷ কিছু বলে না। সে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়৷ রেহানা ভেতর শাড়ি পাল্টাচ্ছে। 

রেহানা স্বভাবত চঞ্চল স্বভাবের৷ তার মাঝে লজ্জাবোধ খুব একটা নেই৷ তাকে বড় সাহসী নারী বলা যেতে পারে। তার কথাবার্তা বলার ধরনও কিছুটা গাঢ় এবং গোছানো৷ অনেকক্ষন অপেক্ষার পর নতুন বউ নতুন শাড়ি পরে বের হয়। তারপাশে পারুকে বড় বেমানান লাগে৷ যেন চাঁদের পাশে ক্ষুদ্র সুখতারাটি। এদের দু'জনকে একসাথে বের হতে দেখে বাড়ির উৎসাহিত প্রতিজনই যারপরনাই অবাক হয়৷ এরা যেন তাদের জীবনে সবচে বেশি অবাক আজ হচ্ছে এমন অবস্থা৷ তার কারণ অবশই আছে৷ এবং কারণটি যৌক্তিকও বটে। সতীন শব্দটা কেমন অন্য রকম। সেখানে সতীনকে পাশে নিয়ে হাঁটাটা অবাকরই। অন্যান্য কারো ক্ষেত্রে ঘটলে বাড়িময় এতোক্ষণে তুলকালামকান্ড বেধে যেত৷ লড়াই হতো৷ রক্তারক্তি হতো৷ খুনাখুনি হতো৷ চিল্লাচিল্লি করে পাড়ার মানুষ জড়ো করতো৷ অথচ পারু তেমন কিছুই করছে না৷ তাকে যথেষ্ট স্বাভাবিকই লাগছে৷ চেহারাটা খানিক মলিন তবে আচরণ বড়ই স্বাভাবিক। প্রতিদিনকার মতোই। এরচে অবাককর দৃশ্য নিশ্চয়ই আর কিছু হতে পারে না! 

ভালোবাসার গল্প সমগ্র 

 

পারু রেহানাকে নিয়ে রান্নাঘরে যাবার পূর্বে উঠোনে দাঁড়ানো তার চাচি শ্বাশুড়ির কাছে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে বলল,

"আপা, এই হইলো তোমার চাচি শ্বাশুড়ি। উনার এক মাত্র চাচি৷"

রেহানা মাথার কাপড় ঠিক করে কদমবুসি করতে গেলে চাচি শ্বাশুড়ি মরিয়ম আক্তার তীক্ষ্ণ স্বরে বলেন,

"এই? খবরদার আমার পা ছুঁবি না। খবরদার কইয়া দিলাম। তোর ওই নষ্ট হাত আমার শইল্যে লাগাইস না। লাগাইলে তোর হাত কাইটা দিমু বেদ্দপ মাইয়া। লজ্জা নাই শরম নাই কইত্তে আইয়া উঠছে এইখানে!"

পারু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মরিয়ম আক্তারের দিকে। সে যেন ভাবতেই পারেনি এমন কিছু ঘটবে৷ সে কিছু বলার আগেই মরিয়ম আক্তার তার হাত টেনে নিয়ে গেলেন কিছুটা দূরে৷ পারুর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

"পারু, তোর মাথা ঠিকাছে হু?"

"ক্যান?"

"ওরে তাড়ানোর বদলে তুই ওরে লগে লইয়া হাঁটস ক্যান?"

"তো কী করতাম?"

"কী করতাম মানে? ও তোর হতীন। হতীন মানি জানোস? তোর স্বামী এহন আর তোর নাই৷ ওর হইয়া যাইবো।"

"আমার এইহানে কিছুই করার নাই চাচি।"

"এই তোর মাথা টাথা কি গ্যাছে? এহন হতীন লইয়া থাকবি?"

"উনি তারে ভালোবাসে চাচি।"

"গুষ্টিমারি হের ভালোবাসার৷ কুত্তার*** আইজ আহুক৷ হেরে যদি আমি না পিটাইছি তয় আমার নাম মরিয়ম না। এই কয়া দিলাম।..."

মরিয়ম আক্তার চিল্লাতে চিল্লাতে নিজের ঘরে গিয়ে উঠলেন৷ তার চিল্লাচিল্লিতে বাড়িতে খানিকটা উত্তেজিত ভাব ফিরে এলো আবার৷ অন্য ঘর থেকে শাহেদের বাবা আবার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন। যাচ্ছে তাই বলে গেলেন। আবীর সেই ঘরের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে৷ তার মন খারাপ৷ পারু ভাবীর জন্যে তার বড় মন খারাপ হচ্ছে৷ সে বুঝতে পারছে না তার ভাই কেন এমন করলো। হুট করেই এমনটা না করলেও পারতেন তিনি৷ আর যাই হোক, ভাইয়া কখনই পারু আপুর মতো মানুষ পাবেন না। পারু আপুর মতো এতো কোমল হৃদয়ের মানুষ এই পৃথিবীতে আর আছে বলে মনে হয় না! 

ভালো মানুষ গুলোর কপাল এতো মন্দ কেন হয়? স্রষ্টা কেন বারবার এদের এতো কষ্ট দেন? কিসের এতো পরীক্ষা নেন? কেন নেন?

পারু রেহানাকে নিয়ে রান্না ঘরে যায়৷ চায়ের পানি বসায় চুলায়৷ তারা দু'জন গল্প শুরু করে আবার৷ নানান অবান্তর গল্প। গল্পে কেউ খুশি হয়৷ কেউ হয় না৷ কারো দুঃখ মানেই কারো সুখ। গল্পের মাঝে হঠাৎ রেহানা বলে উঠে,

"পারু?"

"হু।"

"তোমার একটা মেয়ে আছে না?"

"আছে।"

"কোথায় সে?"

"নানার বাড়ি।"

নানার বাড়িতে কী করে?"

"বেড়াইতে গেছে।"

"কখন আসবে?"

"এইতো! চইলা আইবো। বেশি দিন নাই।"

"ওরে নিয়ে গেছে কে?"

"আমি।"

"একা একা যাও তুমি?"

"হু।"

"শাহেদ তোমারে দিয়ে আসে না?"

"না।"

"তো তুমি চলে আসলে যে?"

"ওখানে মন টিকে না।"

"তুমি কি শাহেদকে ভালোবাসো?"

"ভালোবাসা কি তা আমি বুঝি না আপা।"

"এই যে আমি এলাম, এরজন্যে কি তোমার মন খারাপ হচ্ছে?"

"আমার কি মন খারাপ করোন উচিৎ?"

"উচিৎ-অনুচিৎ দেখে মন খারাপ হয় না।"

"আমি এসব বুঝি না।"

"তোমাকে কি শাহেদ ভালোবাসে না?"

"জানি না।"

"বুঝো না কিছু? মানে আঁচ করতে পারো না?"

"পারি না।"

"তোমার জন্যে আমার খারাপ লাগছে পারু।"

"আপনার খারাপ লাগতাছে ক্যান?"

"বুঝতে পারছি না।"

"আপায় কি আগে শহরে আছিলা?"

"হু।"

"তোমার কণ্ঠ আমার ভালা লাগে। তুমি গান জানো?"

"জানি।"

"উনি কি তোমার গানের গলার প্রেমে পড়চে?"

"মনে হয়।"

"তুমি কি তারে গান শোনাও?"

"শোনাই।"

"সব সময়?"

"সে যখন চায়।"

"আমি এতো শিক্ষিত নই আপা। শুদ্ধ কইতে পারি না৷ চেশটা করি। এই যে করছি। আপনার কি বুঝতে কষ্ট অয়?"

"হয় না।"

"আপা জানেন আমি গান জানি না।"

"সবাই যে গান জানবে তা তো না।"

"জানলে তারে প্রেমে ফেইলতে পারতাম।"

রেহানা কিছু বলে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পারুর দিকে। বলে,

"পারু?"

"হু।"

"তোমাকে আমি একটা মিথ্যা বলেছি।"

"কী মিথ্যা?"

"খুব মারাত্মক মিথ্যা৷ সেটা বলাটা উচিৎ হয়নি আমার। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। করবে?"

"করব।"

"আমার সাথে শাহেদের প্রেম ছিল অনেক আগ থেকেই। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগ থেকে। আমরা তখন শহরে ছেড়ে গ্রামে আসি। আর্থিক সংকটে পড়েছিলাম।তাই গ্রামে আসি। সে সময় আমি তাকে দেখি। সেও আমাকে দেখে। তখন থেকেই।"

পারু খানিকটা চুপ থেকে বলে,

"তাইলে উনি ক্যান আমারে সাদি করলেন?"

"ও ভয়ে কিছু বলতে পারেনি তখন। ওর বাবা নাকি খুব রাগি। উনার উপরে কিছুই বলা যায় না।" 

পারু কিছু বলল না আর৷ অনেকটা সময় চুপ থেকে বলল,

"তুমি কি এখন আমারে এই বাড়ি থেইকা তাড়ায় দিবা?"

রেহানা বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকে পারুর দিকে। হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে মেঝেতে রাখে। তারপর তার কোমল হাত পারুর গালের কাছে রেখে বলে,

"এমন কথা আর কখনই বলবা না। কখনই না। কেমন?"

পারু হাসে৷ কিছু বলে না৷ সন্ধ্যা হয়৷ রাতের আঁধার চারদিক আঁকড়ে ধরে৷ পারু আর রেহানা গল্প করে। এরমাঝে আরেক ধপা ঝগড়া হয়৷ রেহানাকে খুব অপমান করা হয়৷ তার শ্বাশুড়ি রহিমা খাতুন বাড়িতে ছিলেন না। তিনি গেলেন বোনের বাড়িতে বেড়াতে৷ ছেলের এমন কর্মের খবর পেয়ে বাড়ি এলেন। বাড়ি এসে শুরু করলেন চিৎকার চেঁচামেচি। ভদ্রমহিলা গালিগালাজ করেন ভীষন। রেহানার গালে চড় দিলেন একটা৷ আরো দিতেন। তবে পারু উনাকে বাধা দিলো। তাঁকে ঘরে নিয়ে গেল। তবে এতো কিছুর পরও রেহানাকে তেমন বিচলিত দেখা যায়নি৷ সে স্বাভাবিক ভাবেই তার ঘরে ফিরে যায়৷ সাথে পারুকে নিয়ে যায়৷ পারু তার রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে৷ বিছানা ঠিক করে দেয়৷ রেহানা আবদার করে,

"পারু?"

"হু।"

"তুমি আমার পাশে ঘুমাও।"

"তা হয় না।"

"হবে না কেন?"

পারু মৃদু হাসে৷ প্রাণহীন হাসি৷ বলে,

"উনি আইবেন। রাইত গভীর হইলেও আইবেন৷ আইলে দুয়ারে শব্দ কইরবেন৷ তুমি উইঠা দুয়ার খুইলা দিও।"

"তার আসা লাগবে না। তুমি আমার সাথে ঘুমাবে পারু। এটাই ফাইনাল।"

"আমি ওই ঘর ছাড়া ঘুমামু না আপা। থাও তুমি। আমার ঘুম ধরচে চোখে।"

"চলে যাবা?"

"ঘুমাও তুমি।"

পারু রুম থেকে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পাশের ঘরে যায়৷ শশুর-শ্বাশড়ির সাথে কথা বলে কিছুক্ষণ৷ বারান্দায় এলে দেখে আবীর বসে আছে৷ তার চেহারা বড় কালো। পারু মরিয়ম চাচির ঘরে যায়৷ কথা কিছু সময়৷ এরপর ফিরে আসে সে। নিজের ঘরে যায়৷ দরজা লাগায়৷ চিরচেনা বিছানায় উঠে বসে৷ বিছানায় দুটো বালিশ। একটাতে শাহেদ ঘুমাতো৷ আজ থেকে এখানে হয়তো শাহেদ ঘুমাবে না৷ পারু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। এরপর কী মনে করে জানি হারিকেনটা নিভিয়ে দেয়৷ রুমময় গভীর অন্ধকার।

পারুর উপস্থিতিও বোঝা মুশকিল। সে বসে থাকে। অনেকক্ষন বসে থাকে৷ হঠাৎ তার বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠে৷ কী একটা শূন্যতা তাকে ভীষণ পীড়া দেয়৷ তার অনুভূতিকে খোঁচায়। কেমন জানি যন্ত্রণা দেয়৷ হঠাৎ পারু পাশ থেকে বালিশটা তুলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে। তখনই ফুঁপিয়ে উঠে সে৷ তার কান্না পায়৷ ভীষণ কান্না পায়৷ সে কাঁদতে শুরু করে৷ প্রথমে তার কান্না বোঝা যায়নি৷ ধীরে ধীরে সেটা বোঝা যায়৷ বারান্দায় বসে থাকা আবীর তা স্পষ্ট শুনতে পায়৷ সে শুনতে পায় তার ভাবী কাঁদছে৷ ভীষণ কাঁদছে৷ সে চুপচাপ বসে থাকে৷ তার চোখে ঘেমে উঠে খানিক। ধীরে ধীরেই পারুর কান্নার আওয়াজ বাড়ে৷ একটা সময় সে চিৎকার দিয়ে কাঁদে৷ কান্নার সাথে সে বার বার এই কথাটি বলে, "আমি ভালোবাসা বুঝি না গো। বুঝিনা ভালোবাসা!"

তার কান্নার আওয়াজে সবাই বেরিয়ে আসে। প্রথমে তার শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ি, এরপর মরিয়ম চাচি এবং এরপর বাড়ির অন্যান্যরা বেরিয়ে আসে৷ রেহানা তার ঘরের দরজা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ওদিকে পাঁ বাড়ানোর সাহস হয় না তার৷ পারুর কান্নার বেগ আরো বাড়ে৷ বাড়ির উঠোনে মানুষ জড়ো হয়৷ সবই চেনাপরিচিত মানুষ। পারুর নিত্য বন্ধু৷ অথচ কেউই মেয়েটার রুমের কাছে যেতে চায় না৷ কেউ তাকে শান্তনা দিতে যায় না৷ সবাইই কেবল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আর পারুর চিৎকার শুনলেই কেউ না কেউ ফুঁপিয়ে উঠে৷

মরিয়ম চাচি আসবেন ভাবেন৷ অথচ আসেন না তিনি৷ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকেন৷ আসতে চান। এতো ভালো একটা মেয়ের সাথে এমনটা কেন হতে গেল? কেন তাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো? উত্তর নেই৷ কারো কাছেই উত্তর নেই৷ সবাই আজ স্থির৷ অনড়। আজ সবার চোখেই জল। সবাইই কাঁদছে৷ অথচ কোনো জবাব নেই বলে কেউই কাছে যেতে পারছে না। পারু জানে না, সে যে কাঁদছে, কেবল সে-ই কাঁদছে না। তার পাথরের মতো শক্ত শ্বশুর থেকে শুরু করে বাড়ির নবকিশোরিরা পর্যন্ত কাঁদছে৷ 

পারু আবারও চিৎকার দিয়ে কাঁদে,"আমি ভালোবাসা বুঝি না গো। বুঝিনা ভালোবাসা!" তার কান্নায় সকলে কাঁদে৷ চৌধুরীবাড়ি কেমন কান্নাময় হয়ে যায়। বাড়িটি কান্না বাড়িতে পরিণত হয়৷ কী একটা শূন্য কষ্ট যেন বাড়িটির প্রতিটি কোনায় কোনায় ভেসে বেড়ায়। সেই শূন্য কষ্ট যাকে ধরে তাকেই কাঁদিয়ে ছাড়ে৷ 

সমাপ্ত।

গল্পঃ পারু ভালোবাসা বুঝে না।

 

ভুলত্রুটি মার্জনীয় 

-তাসফি আহমেদ।


আর পড়ুনঃ গল্প প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস 

#বাংলা_গল্প 

#bangla_choto_golpo 

#bangla_golpo


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url