ভালোবাসার গল্প - নিশিরাত ৷ লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ

ভালোবাসার গল্পঃ নিশিরাত ৷ লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ



ভালোবাসার গল্প - নিশিরাত ৷ লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ 


ভালোবাসার গল্পবিষাদ, তিক্ততার গল্প, ফিকশন, নন-ফিকশন, ভৌতিক, রহস্যময় থ্রিলার গল্পে সমৃদ্ধ আমার এই ছোট্ট ব্লগটি। বাংলা ছোট গল্পের এই অনন্য-অসাধারণ জগতে আপনাকে স্বাগতম। ভীষণ অপূর্ণতায় ভরপুর আমার গল্প গুলো। তাও লিখি। লিখলে মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত এক প্রশান্তি মিলে। বিশেষ করে ভালোবাসার গল্প গুলো। কারণ এই ভালোবাসার গল্প গুলোতে আমার এক প্রেমিকা থাকে। কাল্পনিক প্রেমিকা। তারে ভীষণ ভালোবাসি আমি।


ভালোবাসার গল্প - নিশিরাত ৷

লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ


 -হ্যালো।

-কে বলছেন?

-জেনে লাভ হবে না বোধহয়। 

-ফোন দিয়েছেন কেন?

-একটা খোঁজ দিতে৷ 

-কিসের খোঁজ?

ওপাশের মেয়েটি খানিকটা সময় চুপ করে থাকে। কোনো কথা বলে না৷ আমি আবারও বললাম,

-কিসের খোঁজ বলুন?

-আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। 

-আপনার বিয়ে হয়ে গেলে আমি কী করব?

-আপনি কিছু করতে পারলেও এখন কোনো কাজে আসবে না৷ 

-আপনার পরিচয়?

-আমি স্পৃহা। 

-কোন স্পৃহা?

-চিনবেন না৷ 

-পুরো পরিচয় দিন৷ চিনতেও পারি৷ 

-পুরো পরিচয়ের প্রয়োজন নেই৷ 

-তাহলে আপনাকে চিনবো কী করে? 

-চিনে আর লাভ কী?

-জানা শোনায় লাভ লস নেই৷ 

-আমি পরিচয় দিতে ফোন দেইনি৷ 

-কেন ফোন দিয়েছেন?

-শেষ একটু কথা বলতে৷ প্রথমবারের মতো শেষ কথা৷ 

আমি খানিকটা সময় চুপ করে থাকলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না৷ এখন মাঝরাত৷ প্রায় বারোটার বেশি বাজে৷ রাত ক্রমশ ঘন হচ্ছে৷ চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে৷ আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। চাঁদ নেই৷ কী অপরিপূর্ণ আকাশ৷ চাঁদ ছাড়া বিশাল আকাশটাকে কী অপরিপূর্ণ লাগে! ফিকে ফিকে ভাব। মেয়েটি চট করেই বলে উঠল,

-আমি এখন কোথায় জানেন?

-আমার কি জানার কথা?

-তা ঠিক। আপনার জানার কথা না৷ 

-কোথায় আপনি?

-ছাদে৷ ছাদের বাতিটাও বন্ধ করা। ঘন নিশুতি অন্ধকারে আমি দাঁড়িয়ে আছি৷ আপনার তো অন্ধকার পছন্দ৷ পছন্দ না?

-হু৷ আপনি জানেন কী করে?

-আমি আরো অনেক কিছুই জানি৷ 

-আর কী কী জানেন?

-অপ্রয়োজনীয় টপিক। বাদ দিন৷ আপনার সাথে দু'সেকেন্ড কথা বলাটাও আমার জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

-আমি আপনার জন্যে এতো গুরুত্বপূর্ণ? মাঝরাতে ফোন দিয়ে মজা করছেন না তো? 

-আমার কথা শুনে কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি৷ 

-তা হচ্ছে না৷ আপনাকে অনেক সিরিয়াস মনে হচ্ছে৷ সে জন্যেই আসলে অবাক হচ্ছি৷ 

-আপনাকে অবাক করতে পেরেছি তাও আমার জন্যে অনেক৷ 

আমি আবারও খানিকটা চুপ থাকলাম। কিছু বললাম না। বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,

-স্পৃহা?

-হু। 

-আপনি কে?

-আমি অপরিচিত। অপরিচিত প্রেম। অপরিচিত প্রেম বোঝেন?

-বুঝি না৷ 

-বোঝাবো?

-বোঝালে উপকার হয়। 

-অপরিচিত প্রেম হচ্ছে অচেনা কারো প্রেমে পড়া৷ যে মানুষটা খুব দূরে অথচ...

মেয়েটা চট করেই থেমে যায়৷ আমি বলি,

-অথচ?

মেয়েটা একটু চুপ থেকে বলে,

-অথচ ভীষণ কাছে৷ যাকে কল্পনায় হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়৷ এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দেয়া যায়৷ এতোটা কাছে যে প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন প্রতিবার তার নাম নেয়। তাকে মনে করে৷ 

-আমি প্রেম বুঝি না৷ 

-হাসালেন। আপনি লেখক মানুষ। প্রেম-মানুষ বেশ বোঝেন আপনি৷ 

-আপনাকে তো বুঝতে পারিনি৷ 

-মিথ্যা বলছেন।

-মিথ্যা নয়৷ 

-কিঞ্চিত তো বুঝতে পেরেছেন?

-এতোটা বুঝতে পারায় তেষ্টা মেলে না৷ 

-অপ্রাপ্তি যেখানে সেখানে তেষ্টা বেশি৷ 

-আমার মাঝে অপ্রাপ্তিতে ভরপুর। 

-অথচ আপনাকে যখন দেখি, এতো পরিপূর্ণ মনে হয়৷ স্রষ্টার কী অপরিসীম সৃষ্টি আপনি৷ 

-আমায় দেখেছেন আপনি?

-আপনাকে আমি অনুভব করি। দেখি। প্রতিনিয়তই। 

-আপনি বোধহয় আমাকে আগ থেকেই চেনেন৷ 

-অনেক আগ থেকেই৷ কতো দিন আপনি আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন৷ অথচ  একবারও চোখ তুলে তাকাননি। 

-কে আপনি?

-আমি স্পৃহা। 

-আপনাকে আমি চিনতে পারিনি৷ অথচ আপনি আমাকে চেনেন!

-চিনতেই হবে এমন তো কোথাও লেখা নেই৷ এপাশ থেকে না হয় কেবল আমিই চিনে রাখলাম!

-আপনি আমাকে কথায় কথায় কৌতূহল করছেন৷ চেনার আগ্রহ জাগাচ্ছেন৷ অথচ বলছেন চেনার প্রয়োজন নেই? 

-চেনার কি প্রয়োজন আছে?

-অবশ্যই। 

-কিন্তু চিনলেই যে সমস্যা৷ 

-কী সমস্যা?

-আপনি আমাকে আর মূল্য দিবেন না৷ আমার অনুভূতি আপনার কাছে ফিকে হয়ে মারা যাবে৷ 

-আমি কাউকে অবহেলা করি না৷ অনুভূতির খুন তো নিশ্চয়ই নয়৷ 

-অথচ আমার অনুভূতি গুলো যে প্রতিদিন প্রতিবেলাই খুন হয়ে যাচ্ছে? এই যে এতো বেনামি অনুভূতি খুন হয়, এগুলোর দায়ভার কার? 

-আমার নয় নিশ্চয়ই? 

-কে জানে! হয়তো আমারই৷ ভুলের বশে ভালোবেসে ফেলেছি৷ 

-ভালোবাসা?

-আজ কেন জানি বলতে ভয় হচ্ছে না৷ লজ্জা করছে না৷ মনের ভেতর থেকে কেমন জানি সাহস পাচ্ছি। 

-এই সাহসটা যদি আগে দেখাতে পারতেন!

-দেখালে কী হতো?

-হয়তো আপনার বিয়েটা হতো না৷ 

-বিয়ে তো এখনও হয়নি৷ 

আমি চুপ করে গেলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না৷ মেয়েটার কথার ঘোরে ধরেছে আমায়৷ সে কেমন অদ্ভুত ভাবে আমায় মায়ায় ফেলছে৷ আমাকে তার কথার মাধ্যমে তার কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ আমি বারান্দা থেকে রুমে এলাম। নীরবে নিজের রূপ ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হঠাৎ আমার ভীষণ হাঁটার ইচ্ছে হলো। পিচ ঢালা পথে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমি মৃদু পাঁয়ে হেঁটে চলবো৷ যতোদূর চোখ যায় ঠিক ততোদূর আমি হেঁটে চলবো৷ মৃদুমন্দ শীতল বাতাস নির্দ্ধিধায় আমায় ছুঁয়ে যাবে। আশ্চর্য! মেয়েটা কি সত্যিই আমায় তার ঘোরে আবেশ করে ফেলল? মেয়েটার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

-হ্যালো? 

-জি আছি৷ 

-ভয় পেয়েছেন?

-ভয় কেন পাবো?

-কে জানে! মনে হলো ভয় পেয়েছেন৷ 

-আপনার ভুল মনে হচ্ছে স্পৃহা৷ 

-হতেও পারে৷ মন মানসিকতা তো আগের মতো নেই৷ তাই সঠিক মনে হওয়াটাও ঠিক সঠিক নয়। 

-মন মানসিকতা আগের মতো নেই কেন?

-ব্যাথা বেদনায় দিক হারা মন৷ একরকম থাকে কী করে? 

-এতো ব্যাথা কিসের?

-অপ্রাপ্তি বোঝেন?

-বেশ বুঝি। 

-অপ্রাপ্তি মানুষকে চরম ব্যাথা দেয়৷ 

-আপনার এতো অপ্রাপ্তি কিসের?

-আমার তো একটাই অপ্রাপ্তি। 

-সেটা কী? 

মেয়েটা চুপ করে গেল। কিছু বলল না। আমি বললাম,

-অস্বস্তি হলে থাক। 

-আপনি আমার অস্বস্তি নন। 

-তবে?

-আপনি আমার অপ্রাপ্তি। আমার অপরিচিত প্রেম৷ 

-আমি?

-জি৷ 

-আমিই আপনার প্রেম?

-হ্যাঁ৷ আপনি আমার প্রেম। আমার দূরে থাকা একমাত্র ভালোবাসা৷ আপনি আমার অনুভব। খুব কাছের অনুভব। আপনি আমার অপরিচিত অনুভূতি। শিরশিরে গা কাঁপানো প্রেমময় শীতল অনুভূতি আপনি৷ আপনি আমার ঘোর৷ আমার বেলা শেষের মুগ্ধতা৷ ক্লান্ত বিকেলের একমাত্র হাসির ঝলক৷ আপনি হচ্ছে আমার নির্ঘুম রাতের একামাত্র কারণ৷ একমাত্র কল্পিত সঙ্গি৷ আমার প্রেম৷ অধরা ভালোবাসা৷ 

-স্পৃহা, আপনি কি কাঁদছেন?

-কাঁদছি না৷ 

-কান্নার শব্দ এলো৷ 

-ভুল শুনেছেন৷ 

-আপনি কাঁদছেন। এখনও কাঁদছেন৷ 

-হ্যাঁ কাঁদছি। অনেক দিন পর চোখে জল এলো আমার। 

-কান্না কেন করছেন?

-কারণ কথাটা গলার কাছে কাটার মতো বিধে ছিল লেখক! বুকের ভেতর দলাপাকিয়ে বসে ছিল। কথাটা ছিল অপ্রকাশ৷ অব্যক্ত৷ বন্ধি কিছু হঠাৎ মুক্তি পেলে চরম আনন্দ হয়৷ সেই আনন্দ চোখে জল আনে। 

-তাহলে আপনি এখন আনন্দের অস্রু বিসর্জন করছেন? 

-আমার আর আনন্দ বেদনা!

-বিয়ে করছেন কেন?

-উপযুক্ত মেয়েদের বাবারা বেশিদিন বাসায় রাখতে চায় না৷ 

-যেখানে সুখ নেই সেখানে গিয়ে কী লাভ?

-সুখ তো আর কাছে আসেনি৷ দুঃখটাই না হয় আসুক৷ 

-কখনও সুখকে কাছে ডেকেছেন?

-ডাকতে তো চেয়েছি। 

-সেই চাওয়ার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি৷ 

-তাহলে কি চিঠি গুলো পৌঁছায়নি?

-কিসের চিঠি?

-মিথ্যা বলবেন না। চিঠি আপনার কাছে পৌঁছেছে৷ আপনি কোনো জবাব দেননি৷ ইচ্ছে করেই দেননি।

-যে চিঠির পরিচয় পত্র থাকে সে চিঠির জবাব দেয়া যায়৷ পরিচয়হীন চিঠির জবাব দেয়া যায় না৷ 

-আমি বলেছি না, অপরিচিত প্রেম। এই হলো অপরিচিত প্রেম। 

-এতো রহস্য কেন?

-রহস্য করেও তো লাভ হলো না। 

-আমি তেমন মানুষ নই যেমন আপনি চান৷

-আপনি ঠিক যেমন তেমনই চেয়েছি আপনাকে। 

-এখন আর চান না?

-আমার চাওয়া পাওয়ার অনুভূতি মরে গিয়েছে৷ 

-সেই সাথে কি আমিও মরে গিয়েছি? 

-মুছে ফেলতে হয়৷ বুঝলেন! বুকে পাথর রেখে অনেক কিছু মুছে ফেলতে হয়৷ মেরে ফেলতে হয়৷ 

-এক বছর এবং একজন মানুষকে এতো নির্মম ভাবে মুছে ফেলা যায়?

-মেয়েরা সব পারে লেখক। সব পারে৷ আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, কমবেশ অনেক মেয়েই বুকে পাথর চেপে বেঁচে আছে৷ কারণ তাদের বেঁচে থাকাটা অনেককেই বাঁচিয়ে রাখে৷ 

-আপনি ভারী ভারী কথা বলেন৷ কথার আড়ালে রহস্য রেখে যান৷ 

-আমার সকল রহস্য বুঝি জলে গেল!

-সেই সাথে একটা বছর৷ 

মেয়েটা কিছু বলল না৷ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ আমি বললাম,

-কয়েক মাস আগে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। অপরিচিত চিঠি৷ এখন চিঠি লেখার যুগ না৷ তাও কেউ লিখল৷ বেশ অবাক হলাম। ভীষণ কৌতূহল জাগলো৷ কোনো ঠিকানা নেই৷ নেই কোনো নাম। হলুদ খামের ভেতর এক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ৷ কাগজের গায়ে কেউ খুব যত্ন করে লিখেছে 

"প্রিয়"। হঠাৎ "প্রিয়" শব্দটা চোখের সামনে পড়তেই আমি থমকে যাই। এতো পরিচিত শব্দ হঠাৎ কেমন অপরিচিত ঘোরময় লাগে। আমার মূহুর্ত থেমে যায়৷ আমি পুরো চিঠিতে চোখ বুলাই৷ কেমন জানি অনুভব হয়, কেউ চিঠিটা খুব গোপনে আমার জন্যে লিখেছে৷ কেবল আমার জন্যে খুব গুছিয়ে লিখেছে। হঠাৎ কেমন ভালো লাগা কাজ করে। আশ্চর্য রকম এক অনুভূতি। আমি দ্রুত সুন্দর করে ছোট ছোট লেখা গুলো পড়ে যাই৷ একবার পড়ে আবার পড়ি৷ আবার পড়ি৷ আবার পড়ি৷ এরপর চার মাস চলে গেল৷ চিঠিটা এখন মুখস্ত আমার৷ কোথায় দাঁড়ি কোথায় কমা সব জানা। সব। চিঠিটা কি আপনাকে শোনাবো স্পৃহা?

মেয়েটা চুপ করে থাকে৷ ওপাশ থেকে কেমন চাপা একটা স্বর এপাশে চলে আসে৷ মেয়েটার চোখে জল হয়তো৷ কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই। আমি বলি,

"প্রিয় মানুষ, 

আমি অপরিচিতা বলছি৷ আপনার সুস্থতা কামনা করি৷ আপনার সুন্দর সুফল ভবিষ্যৎ কামনা করি৷ আপনি আমায় চিনবেন না৷ আপনার জন্যে আমি অপরিচিত। সেই ভরসায় প্রিয় বলে ফেললাম। যেখানে ভয় নেই, সেখানে প্রিয়কে প্রিয় বলতে দ্বিধা নেই৷ 


অবাক হচ্ছেন তাই না? হুটহাট কে না কে এমন প্রিয় যুক্ত চিঠি লিখল যেখানে কোনো নাম ঠিকানা নেই৷ নেই কোনো পরিচয়। অবাক হবারই কথা৷ আমিও তাই চাই৷ আপনি অবাক হোন৷ আমার ব্যাপারে কৌতূহলী হোন৷ কৌতূহলী হচ্ছেন তো? 


আচ্ছা শুনুন প্রিয় মানুষ, হঠাৎ কী কখনও এমন হয়েছে যে আপনার মূহুর্ত থেমে গিয়েছে৷ আপনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন৷ কাউকে একবার দেখে আপনার মূহুর্ত চুপ হয়ে গিয়েছে? এমনকি হয়েছে যে কাউকে একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে হয়েছে৷ দ্বিতীয় বারের পর তৃতীয়বার, তৃতীয় বারের পর আপনার সারাক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়েছে? ইচ্ছেটা কি কখনও এমন তীব্র হয়েছে যে মানুষটাকে সারাক্ষণ চোখের সামনে বসিয়ে রেখে কেবল তাকেই দেখে যেতে মন চেয়েছে৷ কখনও কি এমন হয়েছে? হয়নি হয়তো৷ 


অথচ আমার হয়েছে৷ রোগাপাতলা গড়নের একটা ছেলে যার গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যার, তাকে একবার দেখার পর আমার বারবার তাকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে। আড়ালে গোপনে আমার কেবল সেই মানুষটাকেই দেখতে ইচ্ছে হয়েছে। 


কেন এমন হলো? চলতি পথে হঠাৎ একদিন দূর থেকে তাকে দেখে চট করেই থেমে যাওয়া, বুকের ভেতর হঠাৎ 'ধক' করে ওটা, যেন মূহুর্ত থেমে গিয়েছে, কী এক আশ্চর্যরকম তোলপাড় শুরু হয়েছে বুকের ভেতর, কেমন চিরচঞ্চল এক তীক্ষ্ণ অনুভূতি, ঠিক যেন বুকের মাঝখানে গিয়ে লেগেছে। হঠাৎ গা কাঁপানো শীতল শিরশিরে অনুভূতি৷ কেন এমন হয়েছে? 


জানি না আমি। কিচ্ছু বুঝতে পারিনি তখন৷ কেমন ঘোর নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। সেই ঘোর আমার এখনও কাটেনি৷ এখনও যেন সে লেপ্টে আছে আমার চোখের মনিতে৷ আপনার হাস্যজ্বল ছবি ছেপে গিয়েছে আমার হৃদয়ে। হৃদয়ের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে।

 

সেই সেখান থেকেই শুরু হয় আমার গোপন গোপন পথ চলা। নতুন অনুভূতির জন্ম৷ কল্পনার জগৎ তখন বিস্তৃত হয়৷ তাকে দেখার নেশা লাগে চোখে৷ তার নেশা ধরে ভীষণ করে৷ ঘুম নেই চোখে৷ অযথা রাত জাগা হয়৷ কেন হয় এমন? হঠাৎ কাউকে একবার দেখার পর এমন যে হতে পারে একদমই জানা ছিল না আমার৷ একদমই না৷ 


শুনুন, আমি দেখেছি তাকে৷ দূর থেকে, কাছে থেকে তাকে দেখেছি৷ তার অগোছালো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে ভীষণ। ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে দু'জন হাতে হাত রেখে একসাথে অনেকটা পথ হাঁটার৷ চোখে চোখ রেখে গোপনে গোপনে কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছে৷ ইচ্ছে হয়েছে তাকে জোরে জড়িয়ে ধরি৷ তীব্র চিৎকার দিয়ে বলি ভালোবাসি আমি৷ ভালোবাসি আপনাকে। আপনাকে ছাড়া আমার হবে না৷ চলবে না৷ আমি বাঁচবো না আপনাকে ছেড়ে এতো অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকতে৷ 


আরো কতো কি বলতে ইচ্ছে হয়েছে! অথচ কিছুই বলা হয়নি৷ তার সামনে গেলেই কেমন সব চুপসে যায় আমার৷ গা কাঁপতে শুরু করে৷ বুকের ভেতর ধপ ধপ শব্দটা যেন তীব্র গতিতে বেড়ে যায়৷ কিছুই বলতে পারিনি আমি। কিছুই না৷ এই ব্যার্থতা আমায় কতো যে পীড়া দিয়েছে! কতো ব্যাথা যে আমার চোখের জল ছিনিয়ে নিয়েছে তার অন্ত নেই৷ রাতের পর রাত কেঁদে গেলাম! অথচ তাকে কিছুই বলতে পারলাম না৷ বুক ফাটল! তবে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হলো না! স্রষ্টা কেন যে মেয়েদেরকে এমন করে বানিয়েছেন! একটু বলার ক্ষমতা দিতেন। চট করেই বলে দিতে পারার ক্ষমতা যাদের আছে তাদের আমার ভীষণ সুখি মানুষ মনে হয়৷ ভীষণ সুখি মানুষ। 


যাই হোক, সব শেষে, মানুষটাকে তো বোঝাতে হবে তাকে আমি চাই৷ তাকেই আমি চাই, প্রতি ক্ষনে, প্রতি মূহুর্তে। আমার জীবনের প্রতিটি প্রহরে৷ 


সে জন্যেই চিঠিটা লেখা৷ 


শুনুন জনাব লেখক সাহেব, আপনিই হচ্ছেন আমার সেই মানুষ। আমার একান্তবেলার এক মাত্র প্রিয় মানুষ। আমার অবুঝ অনুভূতির একমাত্র প্রিয়জন৷ আমি আপনার প্রেমেই পড়েছি৷ ভীষণ ভাবে পড়েছি৷ পত্রের এপাশের এই অজ্ঞাতজন আপনাকে ভালোবাসে৷ তার মন এবং প্রাণের সমস্ত দিয়ে ভালোবাসে৷ আপনি কি পারবেন এই অজ্ঞাতজনকে ভালোবাসতে?”


এতটুকু বলে থামলাম আমি৷ জোরে শ্বাস নিলাম। গরম দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো চোখ দিয়ে৷ ওপাশে ভীষণ নিরবতা। কোনো শব্দ নেই৷ কোনো নড়চড় নেই৷ আমি বললাম,

-স্পৃহা? আছে?

কারো শ্বাস নেওয়ার শব্দ হলো৷ আমি আবার বললাম,

-চিঠিটা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছে৷ একদম প্রতিটা শব্দ আমার মুখস্ত। 

ওপাশ থেকে একটা জড়ো শব্দ এলো,

-বাহ! 

-আপনিই সেই চিঠির অজ্ঞাতজন তাই না? আপনিই সেই অপরিচিতা আমি যার মূহুর্ত চুপের কারণ হয়েছি। 

মেয়েটা এবার কেমন ফুঁপিয়ে উঠলো৷ তার ফোঁপানোর স্বর ভেসে এলো এবার স্পষ্ট ভাবে৷ আমি বলি,

-আপনার প্রথম চিঠি আমাকে যারপরনাই নাই পিড়া দিলো স্পৃহা। ঠিক সে সময়ে দ্বিতীয় চিঠি এলো। সেই চিঠি আরো পিড়া দিল। আরো ধাঁধায় ফেলল। রহস্যের জালে আমাকে জড়িয়ে ফেলল। 

মেয়েটা এবার কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল,

-তাও তো চিনতে পারেননি আমায়৷ খুঁজে বের করতে পারেননি এই অপরিচিতা কে। রহস্য রহস্য হয়েই রয়ে গেল। 

-এ জন্যেই তো এটাকে রহস্য বলে৷ তবে আমি সেই রহস্য ভেদ করতে পেরেছি।

-পারলে অবশ্যই কাছে আসতেন৷ একবারের জন্যে হলেও আসতেন৷ 

-আমি তো আসতে চেয়েছি৷ কিন্তু মুখোমুখি হবার ভয় যে আমারও ছিল। 

-এতোটা কাপুরষ না হলেও পারতেন। 

-এখন আমার কাপুরষ হওয়াটা দোষের হলো?

-আপনি সত্যিই আমাকে চিনেছেন?

-আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?

-হচ্ছে না৷ 

-কী করলে বিশ্বাস হবে?

-বিশ্বাস দিয়েও বা কী হবে। 

-কিছুই হবে না?

-উহু।

-হবু স্বামীর প্রতি এতো প্রেম চলে এলো?

-কথাটা প্রেমের নয়৷ কথাটা হলো সময়ের৷ 

-তার মানে আমি আসতে দেরি করে ফেললাম?

-ভীষণ দেরি। 

-আপনার ফেরার কোনো পথই কি খোলা নেই?

-নেই?

-এতোটা নির্দয় আপনি?

-মাঝে মাঝে কঠিন হতে হয়৷ 

-এতোটা কঠিন?

-প্রয়োজন পড়ে৷ 

-তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন কল?

-ব্যাথাটা নিতে পারছিলাম না আর। 

-চোখে এখনও জল?

-এই জল কেবল এই রাতটির জন্যেই। 

-তাহলে আমার কী হবে? আমি যে অন্ধকারে ছাদের কার্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছি? সাদা সেলোয়ার পরা এই রাত জাগা পেত্নীটার প্রেম যে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে তার কী হবে? আপনার শূন্যতার দায়ভার কে নিবে?

মেয়েটা চট করেই চুপ হয়ে গেল৷ আশপাশ তাকালো যেন৷ আমি আবার বললাম,

-নিচ থেকে মনে হয়ে ওখানে একটা পেত্নী দাঁড়িয়ে আছে! মাঝরাতে পেত্নী সাজার সখ হলো?

সে দ্রুত বলল,

-আপনি কোথায়?

-যেখানে থাকার কথা!

-বলুন না প্লীজ। 

-আপনার চোখের মনিতে৷ 

-মজা করবেন না৷ আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি সাদা সেলোয়ার-কামিজ পরে আছি? 

-কারণ ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে পেত্নীটির অবয়ব ঠিক অনুমান করা যায়৷ 

মেয়েটা এবার চট করেই আমার দিকে ফিরলো৷ আমি বললাম,

-হাউজ নং ১৩৪। চৌধুরী মঞ্জিল। আপনি স্পৃহা চৌধুরী না?

মেয়েটা চট করেই ফোন রেখে দিলো৷ আমি ফোনটা কেটে পকেটে রেখে দিলাম৷ দাঁড়িয়ে থাকলাম ল্যাম্পপোস্টের নিচে৷ সময় যায়৷ মেয়েটি দৌড়ে আসে৷ খুব সাবধানে গেটের তালা খোলে। কয়েক সেকেন্ড পর মেয়েটি গেট গলে বের হয়৷ দৌড়ে আমার কাছে আসে৷ স্থির হয়ে দাঁড়াতে চায়৷ জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। খুব হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। আমি বললাম,

-শান্ত হোন৷ 

মেয়েটি বলল,

-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷ 

-না হলে বিশ্বাস করে ফেলুন৷ 

-তাও হচ্ছে না৷ আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি৷ আপনি আমার চমৎকার একটি স্বপ্ন। 

-আপনি কি আমায় ছুঁয়ে দেখবেন?

-হু। 

আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। মেয়েটি এগিয়ে এসে আমার হাত ছুঁয়ে দেখলো৷ তাৎক্ষনাৎ তার চোখে জল জমে গেল। সে জল ভরা দৃষ্টিতে বলল,

-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না৷ 

-তাহলে কি আমি চলে যাবো? যেহেতু বিশ্বাস হচ্ছে না৷ সো...

-প্লীজ৷ যাবেন না৷ আমি একটু স্থির হয়ে নেই৷ 

-আচ্ছা৷ আপনি স্থির হয়ে নিন৷ 

মেয়েটা এক পাশে দাঁড়ায়৷ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে৷ বেশ কিছু সময় পর সে বলে,

-দেরি করলেন কেন?

-কিসের দেরি?

-আমার মন বলছিল আপনি আসবে৷ একদিন না একদিন ঠিকই আসবেন৷ আপনি এলেন ঠিকই৷ অথচ বড্ড দেরি করে ফেললেন৷ 

আমি খানিকটা চুপ থেকে বলি,

-আপনার চিঠি, আপনার প্রেম নিবেদনের ধরন আমায় মুগ্ধ করেছে স্পৃহা৷ আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি৷ মনে মনে আপনাকে এঁকেছি৷ সেই আঁকা চিত্রের প্রেমে আমি পড়েছি৷ অথচ আপনি বাস্তবিক ভাবে সেই চিত্রের চেয়ে কতো অনিন্দ্য। কতো অসাধারণ। আপনার প্রেমে না পড়ে উপায় নেই৷ জানেন, আপনাকে খুঁজে পেতে কতোটা বেগ পেতে হয়েছে? তাও তো আমি আপনাকে খুঁজে নিয়েছি৷ নিয়েছি না?

-হু। কিন্তু খুঁজে পেলেন কী করে?

-সে এক বিশাল রহস্য৷ 

-আমি তা শুনতে চাই৷ 

-বলব কখনও৷ বিয়ের পর কোনো একদিন৷ 

-বিয়ের পর?

-আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন না?

মেয়েটা মাথা নিচু করে বলে,

-আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে৷ 

-কার সাথে৷ 

-একটা ছেলের সাথে৷ সে গভমেন্ট জব করে। তাকে দেখিনি এখনও৷ 

-দেখেননি কেন? 

-দেখার ইচ্ছে হয়নি। আমার তো তাকে চাই না৷ আমার আপনাকে চাই৷ কেবল আপনাকেই৷

-এই যে আমি এলাম। এবার আমাকে আপনার করে নিন৷ 

-এখন যে কিছুই করার নেই৷ চাইলেও যে পারবো না৷ 

-আপনি কেবল একবার চেয়ে দেখুন৷ আমি আপনাকে নিজের করে নিবো৷ আমার পত্র কন্যাকে আমি আমার মতো করে জয় করে নিবো৷ 

মেয়েটার মাথা নিচু৷ ভারী শ্বাস। চোখে জল৷ সে বলে,

-আমি তো চাই৷ কিন্তু...

-আমার বাবা মা? ফ্যামিলি? 

-ত্যাগ করতে পারবেন না?

-নাহ৷ এদের কষ্ট দিয়ে আমি সুখে থাকতে পারবো না৷ 

-তাহলে?

-ভুগতে হবে৷ 

-কিসের সাজা?

-বিলম্বের। 

-অথচ আমি তো আমাদের দু'জনের ভালোর জন্যেই বিলম্ব করেছি৷ আমি ভেবেছি চাকরি হলে আমি নির্ভয়ে আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো৷ আমার হাত নিজের করে নিতে চাইবো। এটা কি আমার অপরাধ?

-তা আপনার অপরাধ নয়৷ আপনার অপরাধ হচ্ছে আপনি তার আগে আসেননি৷ আমাকে একটি বারের জন্যেও জানাননি আপনি আমায় বুঝতে পেরেছেন৷ চিনতে পেরেছেন৷ অথচ আমি চাতক পাখির মতো কেবল আপনার আসার প্রহর গুণে গেলাম। 

-তবে?

মেয়েটা মাথা নিচু করে নেয়৷ আমি বলি,

-এক বছরের যতো অনুভূতি, চিঠির যতো কথা সব?

মেয়েটার মাথা নিচু৷ সে ফুঁপিয়ে উঠে৷ কান্না করে দেয়৷ আমি বলি,

-এতো ব্যাথা? এতো তিক্ততা? সেই অচেনা পুরুষের সংসার করে সুখ পাবেন? বেঁচে থাকতে পারবেন এতো দায়ভার নিয়ে?

মেয়েটা নীরব হয়ে কাঁদে৷ ভেজা স্বরে বলে,

-বেঁচে থাকতে যে হবে। 

-আপনি না হয় বেঁচে যাবেন৷ আমার কী হবে?

-সয়ে নিবেন। 

-আমার জমানো এতো আবেগ, অনুভূতি বা স্বপ্নের কী হবে?

-জ্বালিয়ে দিন৷ মেরে ফেলুন সব৷ 

আমি খানিকটা সময় চুপ থাকলাম৷ তার দিকে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। তার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,

-আমি পারব না৷ 

মেয়েটা আরেকটু জোরে কেঁদে উঠলো যেন। চাপা কান্না তার৷ আমি বললাম,

-আমার আপনাকেই চাই স্পৃহা৷ কেবল আপনাকেই চাই৷ 

মেয়েটা কিছু বলে না আর৷ নীরবে কেঁদে যায়৷ আমি বললাম,

-চলুন না পালিয়ে যাই? 

মেয়েটা ভেজা স্বরে বলে,

-স্যরি৷ আই কান্ট৷ 

আমি কিছু বললাম না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম কেবল। কী বলব ভেবে পেলাম না৷ ঠিক সেই মূহুর্তে পেছনে কাউকে দেখলাম। ভালো করে তাকাতেই দেখলাম স্পৃহার বাবার দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছেন৷ গভীর রাতে মেয়ের হঠাৎ বাইরে চলে আসাটা হয়তো তিনি কোনো ভাবে টের পেয়ে গিয়েছেন৷ আমার এখন কী করা উচিৎ? দৌড়ে পালানো উচিৎ? আশ্চর্য ব্যাপার৷ আমি পালাতে পারছি না৷ আমার পা দুটো জমে আছে যেন। যেন চিরকালের জন্যে স্থির হয়ে আছে৷ আমি কী করবো ভেবে পেলাম না৷ স্পৃহার বাবা এগিয়ে এসে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললেন,

-স্পৃহা?

স্পৃহা চমকে উঠলো। ভয় পেয়ে গেল মেয়েটা৷ মূহুর্তে তার চেহারা আতঙ্কিত হয়ে গেল। চেহারা ছাই বর্ণ ধারন করলো৷ আঙ্কেল আমার দিকে তাকাতেই বললেন,

-তুমি?

আমি উনাকে সালাম দিলাম। বললাম,

-বাবা ভালো আছেন? 

তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন,

-এইতো৷ তুমি কেমন আছো? বাসার সবাই ভালো আছেন?

-জি বাবা। সবাই ভালো আছেন৷ 

-তা বাবা হঠাৎ এতো রাতে এখানে?

-আপনি সেদিন বললেন না আপনার মেয়ের মন খারাপ! সে ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করছে না৷ সবার সাথে বাজে বিহ্যাভ করছে৷ আমি আসলে সে-সব ঠিক করতে এসেছে৷ তাকে একটু বোঝাচ্ছি৷ 

-বেশ। একটু ভালো করে বোঝাও ওকে৷ এতো মন খারাপ যেন না করে। দেখো না না খেয়ে না খেয়ে চেহারাটার কী হাল বানিয়েছে! 

-জি অবশ্যই। 

-আচ্ছা৷ তা বাসায় আসো৷ বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

-স্পৃহা এখানে কোম্পর্ট ফিল করে বেশি। তাইই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। 

-বাসায় আসো?

-না বাবা৷ এতো রাতে না। অন্য একদিন। আপনি গিয়ে ঘুমান৷ চিন্তা করবেন না। স্পৃহা দ্রুতই চলে আসবে৷ এবং এখন থেকে সে বেশ ভালো ভাবে চলাফেরা করবে৷ আমি কথা দিচ্ছি৷ 

-বেশ। আমি গেলাম তাহলে৷ স্পৃহা মা, আসার সময় তালাটা মেরে চেক করে আসিস৷ ভুলেও গেট খোলা রাখবি না৷ গেলাম আমি৷ 

বাবা চলে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি৷ আমার থেকে অল্প কিছু দূরে স্পৃহা দাঁড়িয়ে আছে৷ সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ যেন ঘটনাটির কোনো কিছুই সে বুঝল না৷ আমি তার দিকে তাকালাম। মৃদু হাসলাম। বললাম,

-আমি ভাবলাম তুমি আমার ছবি দেখে খুশি হবে৷ কিন্তু তুমি আমার ছবি তো দূরের কথা, আমাকেই দেখতে চাওনি৷ সরাসরি বাবা মায়ের মতের সাথে হ্যাঁ মিলিয়ে ফেলেছো৷ ভাবলাব বাসর রাতে সারপ্রাইজটা দেই৷ কিন্তু রাজকন্যার কষ্টের পরিমাণ যে বেড়ে চলেছে! তাই ভাবলাম আজই কিছু একটা করি৷ তা না হলে কোন কান্ড বাধিয়ে ফেলো কে জানে!

স্পৃহা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালো৷ যেন আমাকে আস্ত খেয়ে ফেলবো। তীব্র মেজাজ তার চোখে মুখে৷ রাগে গাল লাল হচ্ছে মেয়েটার৷ সে চট করেই পেছন ফিরে চলে যেতে চাইলো৷ আমি তার হাত টেনে ধরলাম। তাকে টেনে কাছে নিয়ে এলাম। সে ছাড়াতে চাইলো৷ আমি তাকে আরো শক্ত করে ধরে নিলাম। বললাম,

-খুশি হওনি তুমি?

-কথা বলবেন না আপনি৷ 

-এতো রাগ?

-আপনাকে খুন করা উচিৎ। 

-আমার অপরাধ?

-এই যে এভাবে আমায় দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে গেলেন৷ তার জন্যে৷ 

-আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি৷ তাই তো চাকরি পেতেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। 

-এরপর চাইলেই তো একদিন এসে দেখা করে যেতে পারতেন৷ 

-সে যাই হোক৷ তুমি কি খুশি নও৷ 

-উহু৷ 

-তাহলে আর কী করার! বিয়ে ক্যান্সেল... 

-খবরদার! এই ধরনের বাজে কথা যেন আর না শুনি আপনার মুখে৷ 

-তুমি তো বললে তুমি খুশি নও৷ 

-খুশি নই তো খুশি করবেন আমায়৷ বুঝেন না রাগ করে আছি৷ আপনি এখন রাগ ভাঙ্গাবেন আমার। খুব রেগে আছি আপনার উপর।

-আপনার? 

স্পৃহা চুপ করে গেল। মাথা নামিয়ে নিলো চট করেই৷ আমি বললাম,

-এখনও আপনি আপনি বলবে? 

মেয়েটা নিশ্চুপ। চেহারায় কেমন লজ্জা লজ্জা ভাব। আমি বললাম, 

-খুব তো চেয়েছো হাতে হাত রাখতে৷ চোখে চোখ রাখতে৷ অগোছালো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে৷ ভীষণ করে জড়িয়ে ধরতে৷ সেই চাওয়া গুলো কি মারা গেল? 

কথাটা বলে শেষ করার আগেই স্পৃহা আমায় জড়িয়ে ধরলো৷ খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়৷ জড়িয়ে ধরার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেয়েটা কান্না করে দিলো৷ সে কী তীব্র কান্ন তার৷ যেন অনেক দিন পর একটা স্থান পেয়েছে কান্না করার৷ তাই নিজের ইচ্ছেমতো কেঁদে যাচ্ছে৷ আমি কিছু বললাম না আর৷ কারণ ধীরে ধীরে আমার চোখও ঘামতে শুরু করেছে৷ বেশ কিছু সময় জড়িয়ে ধরে রাখার পর স্পৃহা যখন একটু শান্ত হয় তখন আমি বলি,

-তা অজ্ঞাতজন কি এখন আমায় ভালোবাসবে? 

স্পৃহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমাকে আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধরে বলল,

-চলো বিয়ে করি৷ কাজি অফিস খোলা পাবো এখন?

আমি চট করেই হেসে ফেললাম। হঠাৎই কেমন প্রশান্তি অনুভব হলো৷ একঝাক আনন্দ যেন আমাদের মূহুর্তে আবেশিত করে ফেলতে শুরু করলো। আমরা যেন মায়াময় অদ্ভুত কোনো ঘোরে হারিয়ে যাচ্ছি৷ ঘোর ধরা আনন্দে ভেসে যাচ্ছি যেন৷ 

.

সমাপ্ত

.

হাবিজাবি লেখা৷ অনেক দিন পর লেখলাম৷ 

.

গল্পঃ নিশিরাত৷ 

.

ভুলত্রুটি মার্জনীয়

-তাসফি আহমেদ৷

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url