গল্পঃ মায়া | তাসফি আহমেদ

 গল্পঃ মায়া | তাসফি আহমেদ 

গল্পঃ মায়া | তাসফি আহমেদ


পেছনে কারো শব্দ পেলাম মনে হয়। ফিরে চাইলাম। খানিকটা চমকাতে হলো। মায়া! এক গাল হেসে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে বললাম,
-হ্যালো, মিস মায়া!
মায়া এগিয়ে এলো। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-বেশ অবাক হলেন মনে হয়?
-হয়েছি বটে।
-কী ভেবেছিলেন? আর দেখা হবে না কখনো?
আমি হাসলাম। কী বলবো খুঁজে পেলাম না। সে একটা বই তুলে চাইলো,
-আপনি বইটই পড়েন নাকি?
-পড়ি টুকটাক।
-কিনলেন ক'টা।
-একটাও না।
সে কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
-আপনি আসলেই বই পড়েন?
যেন মেয়েটার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি বই পড়ি। সে যেন ভীষণ অবাক আমাকে বই মেলার এই স্টলে দেখে। আমি বললাম,
-আপনি কেন এতো অবাক হচ্ছেন বলুন তো? আমি কি বই পড়তে পারি না?
সে হাসলো। বলল,
-পারেন তো! বাট খানিকটা অবাক হলাম আরকি। ছ্যাঁকা খাওয়া মানুষদের বই পড়ারও সময় হয় নাকি? তারা তো অনেক দুঃখে কষ্টে থাকে। মাঝেমধ্যে মেয়ে দেখতে যেয়ে ফিরে এসে নিজেরাই রিজেক্ট করে দেয়?
আমি এখানে থমকে গেলাম। ওর কথার প্রথমাংশে আমাকে খুব সুন্দর করে একটা খোঁচা মারলো। দ্বিতীয়াংশে রিজেক্ট খেয়ে নিজের ইগোতে লেগে যাওয়ায় তার রাগের একটা প্রতিফলন দেখালো। সর্বোপরি তার কথার ভাঁজে খানিকটা প্রতিশোধের আভা পেলাম। আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। হাতের বইটা রেখে স্টল থেকে বেরিয়ে এলাম।
-এইযে মিস্টার! লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া কি আপনার বংশীয় স্বভাব নাকি?
আমি পেছন ফিরেও চাইলাম না। সোজা হাঁটতে থাকলাম। মেয়েটা পেছন ছাড়লো না। সে দৌড়ে এসে আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকলো। ঠিক সেই সময়েই নীলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো,
-কিরে? যাচ্ছিস কই? আমি আরো তোর জন্যে চা নিয়ে এলাম।
মায়া হেসে উঠলো,
-বাব্বাহ! আপনার গার্লফ্রেন্ডও আছে? গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন আবারও বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখতেও যাবেন? হ্যাঁ? এগুলো করেন আপনি? এই আপু? আপনি জানেন যে উনি কয়েকদিন আগে আমাকে দেখতে গিয়েছিলো? বিয়ে করার জন্যে? চিন্তা করে দেখেন? আবার কিছু না জানিয়ে রিজেক্টও করে দিয়েছে? বলে নাকি মেয়ে পছন্দ হয়নি?
আমি যথেষ্ট লজ্জায় পড়ে গেলাম। আশপাশের মানুষজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া একটু জোরেই কথা বলছে। মানুষজন শুনছে। ছিহ। কি বিশ্রী ব্যাপার। সবাই আমাকে কি ভাববে এখন?
নীলা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল! যেন এমন মজার কথা ও ওর জীবনেও শুনেনি। খুবই ফানি কথা বলেছে। ও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মায়া ওর দিকে ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। আর এদিকে আমি মানসম্মান লুটে যাওয়ার ভয়ে মাথা নিচু করে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
অল্প ক'দিন আগের কথা। আমার মা জোরাজুরি করে আমাকে একটা মেয়ে দেখতে নিয়ে গেল। মেয়ের বড় বোন আমার এক কাজিনের বউ। মানে আমার ভাবী হয়। যদিও আমি কখনোই আমার ওই চাচাদের বাড়ি যাইনি। ভাবীর সাথেও দেখা হয়েছে কালেভদ্রে। উনি ক'বার আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন। তখনই দেখা হয়। সমস্যাটা সেখানে না। আমি মেয়েকে দেখতে যাই। সেই মেয়েটিই হচ্ছে মায়া।
আমার পূর্বে একটা রিলেশন ছিল এবং দুর্ভাগ্যক্রমে আমি সেখানে সফলতা পাইনি। যদিও আমি মেয়েটাকে অসম্ভব ভালোবেসেছিলাম, তারপরও হয়তো কোনো কমতি ছিল, যে কারণে আমরা এক হতে পারিনি।
আকাশে এতো মেঘ উড়ে বেড়ায়। সব কি আর বৃষ্টি হয়ে নামে?
আমি মোটামুটি ব্যাচেলর জীবনযাপন করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম। যেমনটা ছ্যাঁকা খাওয়ার পর সকলেই বলে। তবে আমি ঠিক তাদের মতোন না। আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছিই, আমি ব্যাচেলর থাকবোই। দেখি কে আঁটকায়। মোটামুটি সময়কাল আমার ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু সেটা আমার মায়ের পছন্দ হলো না। তিনি আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলেন। আমিও এলাম। ভাবলাম এলেই যে বিয়ে হয়ে যাবে এমন তো আর না। কিন্তু কী হলো? হলো উল্টো। আমি চমকে গেলাম। অস্বাভাবিক রকম চমকে গেলাম। মায়া যখন শাড়ি পরে এসে মাকে সালাম দিলো, এবং আমার পাশের সোফায় বসলো, আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। গোলকধাঁধায় পড়ে গেলাম মনে হয়। ভীষণ নার্ভাস লাগতে থাকলো। এতো নার্ভাস মেবি কয়েক বছর লাগেনি। ফিলই হয়নি। এতো জব ইন্টারভিউ দিলাম। সামান্য নার্ভাস হইনি। একটা কনফিডেন্স আমার অলয়েজ থাকতো। কিন্তু আজ হঠাৎ এতো নার্ভাস হবো, ভাবিনি। আমি অনুভব করলাম আমার হার্টবিট বাড়ছে। খুবই অস্থির লাগছে। আমি অজান্তেই মায়ার দিকে মুখ তুলে চাইলাম। এবং আমার ঠিক মনে নেই, আমি কতোটা সময় হাবলার মতো ওর দিকে চেয়ে ছিলাম। আমি চেয়েই থাকলাম। কি অদ্ভুত! কি মায়া! এতো চমৎকার! আমার মাথায় তখন সেগুলোই ঘুরছিলো। আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। নিচের দিকে চেয়ে থাকলাম। আমার বুক কাঁপতে থাকলো। আমার ভেতরটা হঠাৎই অস্থির হয়ে উঠলো। আমি সারাটা সময় একটুও কথা বলিনি। চুপচাপ বসেই থাকলাম। এক সময়ে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেই। নিজেকে স্থির করি। আমাদেরকে আলাদা একটু সময় দেওয়া হয়। আমরা মায়ার রুমে বসি। সেখানে আমাদের খুব সুন্দর একটা আলোচনা হয়। মায়া কিছু প্রশ্ন করে। আমি জবাব দেই। আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। আমি সেগুলো বলি। আমার কাছে আমাদের ক্যামিস্ট্রিটা খুবই দারুণ লেগে উঠে। আমি ওর সাথে কথা বলে বেশ আনন্দই অনুভব করলাম। কিন্তু শেষ দিকে আমাদের আলোচনা কিছুটা চেঞ্জ হয়ে যায়। আমরা পার্সোনালি একটু ডিপ আলোচনা করি। তখন আমি আমার অতীতের কথা বলি। তখনই দেখলাম মেয়েটা শান্ত হয় যায়। স্পষ্ট তার চেহারায় অনিহা ভেসে উঠে। আমি টের পাই। সে তার কথা বলে। সে কখনো প্রেম করেনি। করতেও চায়নি। সে পড়াশোনা করেছে। এবং পড়াশোনা ও নিজের পরিবারকেই প্রাধান্য দিয়েছে। অন্য কিছুকে না। আমি মোটামুটি বুঝেই ফেলি যে এখানে আর কিছু হবে না। মায়ার আমাকে পছন্দ করা তো দূরে থাক, আমার সাথে দ্বিতীয়বার দেখাও করতে চাবেনা সে। আমি বুঝতে পারি। তবে কিছু বলিনি। শেষ দিকে সে বলে যে সে কখনই চায়নি যে তার হাজবেন্ড এমন কেউ হোক যার একটা বাজে অতীত আছে। ইভেন এসব প্রেম ভালোবাসা ওর অপছন্দও অনেক।
আমি মোটামুটি নিশ্চিতই ছিলাম যে এখানে আসলে কিছু হবে না। মায়ার মতো মেয়ে আমার মতো ছেলেকে মেনে নিবে না এটা খুবই স্বাভাবিক। মেক সেন্স করে। আমি আর আলোচনা দীর্ঘায়িত করিনি। আমরা উঠে আসি।
মাকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার পথে মা জিজ্ঞেস করে মেয়ে কেমন লেগেছে। আমি প্রথমে জবাব দেইনি। পরে বিরক্ত হয়েই বলি যে ওই মেয়ের সাথে কিছু হবে না। তুমি অন্য মেয়ে দেখো। মা কি বুঝলো জানি না। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। দুই একদিন যাওয়ার পর মাকে জিজ্ঞেস করি যে কি অবস্থা ওইদিকের? মায়ারা কিছু বলেছে? মা স্ট্রেইট আমার মুখের উপর বলে,
-আমি ওদেরকে নিষেধ করে দিয়েছি। বলেছি ছেলের পছন্দ হয়নি।
আমি কোমরে হাত দিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে থাকলাম। বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না! আমার পছন্দ হয়নি? সিরিয়াসলি?
আমরা তিনজন বসে আছি। মেলা থেকে খানিক দূরে। নীলা হাসছে এখনো। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। মায়া নীলার চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসে আছে। তার চেহারা এখনো প্রশ্নবোধক। সে কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না। না বুঝাই স্বাভাবিক। নীলা নিজেকে সামলে বলল,
-মায়া আপনি কি ওকে ফলো করছেন? কীভাবে ওকে এখানে খুঁজে পেলেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা কি কোনো কো-ইনসিডেন্স?
মায়া স্পষ্ট জবাব দিলো,
-ওফকোর্স এটা একটা কো-ইনসিডেন্স। আমি কেন উনাকে ফলো করব? উনি এমন কে যে ফলো করতে হবে? আমি জাস্ট স্টল গুলো ঘুরছিলাম। তখনই উনাকে দেখি।
আমি চুপ করেই থাকলাম। নীলা বলল,
-আচ্ছা, বুঝেছি। চলেন কিছু বিষয় পরিষ্কার করি। আমি ওর প্রেমিকা না। ওর মতো গাধার প্রেমিকা আমি হবো? প্রশ্নই উঠে না। আমি ওর বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু। আপনি ওকে যে স্টলে দেখেছেন, আমি ওখানে বসি। আমার সাথে আমার বফও বসে। আর ও আসলেই আপনাকে দেখতে গিয়েছিলো। তবে বিয়ে করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। এটা ট্রু। জাস্ট আন্টির জোরাজোরিতে গেছে। কিন্তু ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে স্যারের বিয়ের বিষয়ে রায়টা কিছুটা শিথিল হয়েছে।
বলে আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হাসি হাসলো নীলা। আমি ওকে চোখ রাঙ্গালাম। মায়া একবার আমাকে দেখছে, আরেকবার নীলাকে। সে বলল,
-উনার বিয়ের বিষয়ের রায় বলতে? বুঝলাম না ঠিক!
নীলা বলল,
-আরেহ বেচারা ছ্যাঁকা খেয়েছে না? সে এরপর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আর প্রেম করবে না। বিয়ে করবে না। লং লাইফ ব্যাচেলর থাকবে। বুঝেন একবার! এসব গাধামি না?
-হ্যাঁ? এ কেমন সিদ্ধান্ত? আপনি এই জন্যে আমাকে রিজেক্ট করেছেন?
মায়া ভ্রু কুচকে আমাকে প্রশ্ন করলো। আমি কিছু বলতে যাব তখনই নীলা বলল,
-এছাড়া আর কি হবে! আপনি জানেনও না আপনি কিসের পাল্লায় পড়লেন।
মায়া ভ্রু কুচকে দেখলো আমায়। নীলা হাসছে। মিটমিট করে হাসছে। যেন বেশ মজা পাচ্ছে ও। এই মেয়েটা হয়েছে একটা পাকনা। সব সময়ে এক লাইন বেশি বুঝবে। ওর দরকার ছিল শেষের কথা গুলো বলার? আমি নীলার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম। নীলা দেরি করলো না। সে উঠে দাঁড়ালো। মায়ার দিকে চেয়ে বলল,
-মায়া আমি উঠলাম। আমাকে যেতে হবে। আপনারা থাকুন। কী করবেন ওকে দেখুন। চেষ্টা করবেন এই গাধার থেকে দূরেই থাকতে।
এরপর আমার দিকে চেয়ে বলল,
-যাওয়ার আগে দেখা করে যাস। আর গাধা থাকিস না। একটু চালাক হ।
এরপর চোখের ইশারায় মায়াকে দেখালো সে। তারপর একটা চোখ মারলো। আমি বললাম,
-তুই বিতাড়িত হ। সব সময়ে বেশি কথা বলিস তুই।
নীলা হাসলো। হাসতে হাসতে চলে গেল। আমি মায়ার দিকে চাইলাম। সে তখনো ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে ছিলো। আমি মুগ্ধ হলাম। এতো দারুণ লাগছিলো ওকে। আমি কিছু বলতে যাব ঠিক তার আগেই ও উঠে দাঁড়ালো। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। কি বলব ভেবে পেলাম না।
মায়া হাঁটা শুরু করলো। আমিও ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটলাম। বললাম,
-চলে যাচ্ছেন?
সে জবাব দিলো না। আমি আবারো বললাম,
-মায়া, আপনি কি রাগ করলেন?
মায়া জবাব দিলো না। গেইট গলে বের হলো। আমিও ওর সাথে বের হলাম। বললাম,
-বাসায় চলে যাবেন? বই নিবেন না?
সে এবার আমার দিকে চাইলো। কঠিন দৃষ্টিতে চাইলো। চেহারায় রাজ্যের রাগ। কেমন লালচে হয়ে আছে। চোখ বড় বড় হয়ে আছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে যেন। যেন আর কিছু বললেই আস্ত গিলে ফেলবে আমাকে। আমি চুপ করে গেলাম। সে রিক্সা ডাকলো। একজন রিক্সাওয়ালা এলো। কিন্তু সে ওদের এলাকায় যাবে না। অন্য আরেকজনকে ডাকতেই সে এলো। সে যেতে রাজি হলো। মায়া রিক্সায় উঠে বসলো। আমার কি হলো জানি না। আমিও উঠে বসলাম। মায়া চিল্লায় উঠলো,
-কি ব্যাপার? আপনি উঠছেন কেন? হ্যাঁ?
-আপনার সাথে একটু কথা ছিল। এই মামা, চলেন তো?
মায়া আমার দিকে রুক্ষ ভাবেই চেয়ে থাকল। বলল,
-কিসের কথা? হ্যাঁ? কিসের কথা আপনার সাথে আমার?
আমি ওর দিকে চেয়ে বললাম,
-একটু শান্ত হোন প্লীজ। সব সময়ে এতো জোরে জোরে চিল্লায়ে কথা বলতে হয় না। আর আমি এমন কেউ না যে আপনাকে কিডন্যাপ করে নিব বা বাজে কিছু করব। আমার আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। আমি সেগুলো বলব। ব্যস। এটাই।
মায়া আমার দিকে চেয়েই থাকলো। তবে তার দৃষ্টি কিছুটা সরল লাগলো আমার কাছে। তাও সে আমার দিকেই চেয়ে ছিল। আমি বললাম,
-প্লীজ, একটু রিল্যাক্স হোন।
মায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অন্য দিকে চাইলো। আমি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নিলাম। রিক্সা চলছে। ধীরে ধীরে। আমি আড় চোখে মায়াকে দেখলাম। সে ঠিকই অন্য দিকেই চেয়ে আছে। আমি বললাম,
-আমি আপনাকে রিজেক্ট করিনি।
মায়া আমার দিকে চাইলো। সেই রুক্ষতা নিয়েই। আমি আবারো বললাম,
-আমি জানতামও না যে আমি আপনাকে রিজেক্ট করেছি।আমি বরং অপেক্ষা করছিলাম। আপনাদের জবাবের। যদিও আমি জানতাম আপনাদের জবাব নেগেটিভ হবে। তাও অপেক্ষায় ছিলাম।
-ওয়েট, কী বললেন? আপনি রিজেক্ট করেননি? তাহলে আপনার আম্মু বলল কেন আপনার পছন্দ হয়নি? আর আপনি জানতেন কীভাবে যে আমাদের জবাব নেগেটিভ হবে? আপনি জ্যোতিষ?
-আস্তে আস্তে, রিল্যাক্স! এতো অস্থির হবেন না। আমি সবই বলছি আপনাকে।
বলে একটু থামলাম আমি। মায়া আমার দিকে চেয়েই থাকলো। আমি বলতে থাকলাম,
-আপনার সাথে যখন কথা বলছিলাম, তখন আপনি আপনার হাজবেন্ড কেমন হবে বলেন। ওগুলো শুনে আমার নিজেকে একদমই ফিট মনে হয়নি। আমি প্রেম করে ছ্যাকা খাওয়া একজন ছেলে। আপনি যেখানে এতো দারুণ, ভালো, ভদ্র একটা মেয়ে। আপনার অমন হাজবেন্ড চাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এছাড়া আপনি প্রেম জিনিসটা বেশ অপছন্দ করেন। সব মিলিয়ে আমার মনে হলো আপনি আসলে আরো বেটার ডিজার্ভ করেন। আমার চেয়ে ভালো। তাই ভেবেছিলাম আপনি স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে রিজেক্ট করে দিবেন। এটা ভেবেই আমার খারাপ লেগেছিল। তখন মা জিজ্ঞেস করছিলেন কেমন লাগে। ওই মন খারাপের বসেই বলেছিলাম এখানে হবে না। অন্য কোথাও দেখো। এটা শুনেই মা আপনাদেরকে নিষেধ করে দেয়।
-নিষেধ করে দেয়? এটাকে নিষেধ করা বলে? উনি তো এটাও বলতে পারতেন যে আমার ছেলেরই সমস্যা। সে বিয়ে করতে চায় না। এটা কি বলা যেত না? আর আপনার কি এমন হয়েছে হ্যাঁ? আপনি কেন বিয়ে করতে চাবেন না? কেন?
-আরে আরে আপনি দেখি আবারও চেঁতে যাচ্ছেন। প্লীজ শান্ত হোন। চেঁতে যাবেন না। আর আমি বিয়ে করতে যে চাইনা এটা একদম ভুল কথা। হ্যাঁ আগে চাইতাম না। কিন্তু এখন চাই। আমি এখন বিয়ে করতে চাই।
মায়া শান্ত হলো। দৃষ্টি সরল হলো। আমার দিকে কোমল দৃষ্টিতে চাইলো এবার। আমি বললাম,
-আমি আসলেই বিয়ে টিয়ে করতে চাইতাম না। ইচ্ছেই কাজ করতো না। কিন্তু সেদিন যে আপনাদের বাসায় এলাম, আপনাকে দেখলাম, আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি অবাক হই। আমি ভাবি একটা মানুষ এতো কোমল কীভাবে হতে পারে। এতো সুন্দরী? এতো মায়াবী? আপনার বাবা মা আপনার নাম মায়া কি এজন্যেই রেখেছে? আমি পুরো থ হয়ে যাই বিশ্বাস করেন! আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই যে আমি বিয়ে করব। আপনাকেই বিয়ে করব। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম আপনি যেন না করে দেন। কিন্তু এরপর...
-এরপর? আমার ওইসব কথা শুনে আপনি ভেবে নিলেন যে আমি আপনাকে রিজেক্ট করে দিব?
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
-হ্যাঁ।
-আপনাকে যে আপনার বান্ধবী গাধা বলে, ভুল বলে না। আপনি আসলেই একটা গাধা।
একটু থামলো সে। অন্যদিকে মুখ করেই বলল,
-মেয়েদের হাজবেন্ড নিয়ে অনেক ফ্যাসিনেশন থাকেই। অনেক ধ্যানধারণা থাকেই। তাই বলে যে সবাই সবটা পাবে, এমন তো না, নাকি? নাহ! সে একদম বিশ্বাসই করে বসে আছে যে আমি রিজেক্ট করে দিব। আজব লোক একদম।
মায়ার চেহারায় দুষ্টমিষ্ট রাগ। সে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো। যেন একটা ছোট্ট বাবু রাগ করে, অভিমান করে অন্য দিকে ফিরে আছে। আমি অবাক হলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। মায়ার চেহারা হঠাৎ পরিষ্কার হতে থাকলো। রুক্ষতা কাটতে থাকলো। আমি বললাম,
-আমি আসলে আপনাকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলছি। আমার আপনাকে অনেক ভালো লেগেছে।
বলে আমি মায়ার দিকে চাইলাম। সে আমার দিকে চাইলো একবার। এরপর চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিছু বলল না। আমিও কিছু বললাম না আর। চুপ করে থাকলাম। মিনিট দুয়েক বেশ নিরবতায় কাটে। হঠাৎ মায়া বলে,
-আমি চট করেই কোনো সিদ্ধান্ত নেই না। আমার সময় লাগে। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেই।
-লাগুক। সময় লাগুক। আমার সমস্যা নেই।
-আমি কিন্তু একটা কথা ক্লিয়ার বলে দেই, আমাকে কন্ট্রোল করা কিন্তু বেশ কঠিন হবে। আমার ভীষণ রাগ। সহজে উঠে না। কিন্তু একবার উঠলে একদম জ্বলে যাবেন। বলে দিলাম।
-জ্বলে যাব। সমস্যা নেই।
-এখন যে হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাচ্ছেন, পরে যদি হ্যাঁ তে না মিলান, তাহলে খবর আছ কিন্তু?
-আপনি যা বলবেন তাই হবে।
-ঠিক তো?
বলে মায়া মৃদু হাসলো। আমি বললাম,
-ঠিক। একদম ঠিক।
মায়া এবার একটু বেশ করে হাসলো যেন। রিক্সা থামলো। মায়া নেমে গেল। আমি বসে থাকলাম। বললাম,
-ভাড়া দিতে হবে না।
মায়া জবাব দিলো না। সে ভাড়া মিটিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি রিক্সায় বসেই থাকলাম। সে বললাম,
-আমি আসলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি অলরেডি।
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
-জানি না। মনে পড়ছে না।
বলে হাসলো সে। কেমন অদ্ভুত একটা হাসি। মায়াবী অথচ বেশ অদ্ভুত। এই হাসি কিছু বলে যেন। কিছু একটা জবাব দেয়। সে গেট গলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আমি রিক্সায় বসে থাকলাম। বিষয়টি যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রিক্সাওয়ালা মামা বলল,
-মামা আপনে যাবেন?
আমি তাকে কই যাব বললাম। রিক্সা চলতে থাকলো। আমি ভাবতে থাকলাম। মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে? কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে? রিক্সা কিছুদূর আগায়। হঠাৎ আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ,
"আপনি আসলেই একটা গাধা। কিচ্ছু বুঝেন না।"
আমি মেসেজটা দেখে স্ক্রিনের দিকেই চেয়ে থাকলাম। কী করব ভেবে পেলাম না। আমি যেন থ হয়ে গেলাম। হাতপা যেন শক্ত হয়ে জমে গেছে। সে আবারও মেসেজ দিলো,
"আন্টিকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন। আর এও বলবেন যে মেয়ে পক্ষের ছেলেকে আগ থেকেই পছন্দ ছিল। শুধু গাধা ছেলেটার বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে। কী আর করার! গাধার পাল্লায় পড়লে যা হয় আরকি।"
আমি মনে হয় জমে গেলাম। শক্ত হয়ে বসে থাকলাম রিক্সায়। আমি ফোনটা লক করে পকেটে নিলাম। শীত লাগছে। কেমন মিষ্টি মিষ্টি শীত। অবশেষে শীত চলেই এলো। আমার কেন জানি খুশি লাগছে অনেক। অনেক আনন্দ অনুভব হচ্ছে। আমার জোরে চিল্লাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি পারছি না। আমি জমে আছি। আমার হাত পা মুভ করছে না আর। আমার অস্থির লাগছে। শান্তি লাগছে। শান্তির অস্থিরতা। মেয়েটা কি আমাকে পছন্দ করে ফেলসে? আসলেই পছন্দ করে ফেলসে?
"আমার মনে হলো, আমার চোখের সামনে থেকে এক গুচ্ছ মেঘ সরে গেছে। সমস্তই যেন ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি তখনই দেখলাম, সেই সুশ্রী, রূপবতীকে। আমি দেখলাম মায়াকে। এক অনিন্দ্য সুন্দরী গোছানো আস্ত মায়াকে। আমার মনে হলো আমি প্রেমে পড়ছি। আমার চরম ভাবে প্রেমে পড়েছি এবার।"
"আমার সমস্তই যেন স্থবির হইলো, আমি আপনাকে দেখিলাম। আমার মনে হইলো আমার আর এই পৃথিবীর রূপ দেখিবার ইচ্ছে নেই। আমি এই পৃথিবীর সমস্ত রূপ আপনাতেই দেখিয়া ফেলেছি।"
গল্প: মায়া
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ
Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url