গল্পঃ অরিক - অন্তর্দৃষ্টি | লেখক - তাসফি আহমদে | Tasfis Blog
গল্পঃ অরিক - অন্তর্দৃষ্টি | লেখক - তাসফি আহমদে
ক'দিন ধরেই এই পথাটায় চলাচলে কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে অরিকের৷ এতোকাল এই পথ দিয়েই বাসায় ফিরতো৷ কিন্তু কখনোই এতো বিচলিত হতে হয়নি ওকে। কিন্তু ইদানিং হচ্ছে৷ আজও তাই৷ কেমন গা চিমচিমে অবস্থা। চারপাশ দারুণ অন্ধকার। ওর হাতে নিভু নিভু টর্চ। টর্চের ব্যাটারিটা গেছে সম্ভবত। সারাদিন চার্জে থাকে৷ কিন্তু আলো বেশিক্ষন দেয় না৷
অরিক এগোয়৷ অল্প পথ। সামনেই একটা পরিত্যক্ত ভিলা। ভিলার অপজিটেই তাদের বাসা৷
সামান্য এগোতেই ওর হাতের টর্চটা নিভে গেল৷ অরিক চটজলদি টর্চে থাপড়ানো শুরু করলে টর্চটা সামন্য জ্বলে আবার নিভে গেল। অরিক দেরি করলো না৷ অন্ধকারে এগোতে থাকলো। ওর গা কেমন ভার হয়ে এলো৷ অস্বস্তির মাত্র কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। ও দৌড়ানো শুরু করলো। দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না৷ ওর মনে হচ্ছে ও একই জায়গায় স্থির আছে। দৌড়াচ্ছে বটে, এগোচ্ছে না। টর্চটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো। ঠিক জ্বলে উঠা না৷ কাঁপা কাঁপা ভাবে জ্বলা। আলোর মাত্র নিতান্তই স্বল্প। ও আবারো টর্চের পেছনে থাপড়ানো শুরু করলো৷ আশ্চর্যজনক ভাবে টর্চটা বেশ আলোকিত ভাবেই জ্বলে উঠলো এবং টর্চের আলো যেখানে গিয়ে স্থির হলো, অরিক দেখলো সেখানে বিশালাকার কেউ একজন যেন দাঁড়িয়ে আছে৷ অদ্ভুত চেহারা! ভয়ানক। গায়ের রঙ অসম্ভব কালো৷ দেখে মনে হচ্ছে একটা কালো বিড়াল। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। কেমন সবুজাভ চোখ। এর চেহারা দেখতে বিড়ালের মতো কিন্তু মানুষের মতো তার দেহের গড়ন। সে হঠাৎ অরিকের দিকে চেয়ে হাসলো। ভয়ানক হাসি৷ চোয়ালের বড় দাঁত গুলো কেমন বের হয়ে আছে৷ লম্বা দাঁত দুটো যেন লালচে। যেন কেবল কারো গলা চেপে এসছে। সে বিড়বিড় করে কিছু যেন বলো। ফের আবার তার অট্টহাসি। কি অদ্ভুত হাসির স্বর তার৷ অরিকের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। বুকের ভেতরের ধুপধুপ শব্দটা যেন প্রতিযোগিতা করে বেড়ে চলছে। সে লাইট ফেলে দিলো। দু'হাতে কান চেপে ধরলো। হাসির শব্দটা ভয়ানক। অরিক নিতে পারছিলো না। ওর যন্ত্রণা হচ্ছিলো ভীষণ। দানবটা অরিকের দিকে চেয়ে বললো,
-তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি পেয়েছি৷ খুঁজে পেয়েছি তোমায়। আমি আগেই বলেছিলাম! তোমাকে আমি খুঁজে বের করবোই৷ যতো যা-ই হোক। বের করবোই। এবং আমিই তোমাকে নিজ হাতে শেষ করব৷ যেই প্রথা তোমার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছিলো, আমি তা গোড়া হতেই উপড়ে ফেলবো!
অরিক স্তব্ধ হয়ে রইলো! ওর চোখ জোড়া অস্বাভাবিক রকম গোল হয়ে আছে৷ চোখ দুটো যেন অক্ষিগোলক ছেদ করে বের হয়ে আসব৷ সে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলো! অথচ গলা দিয়ে কোনো শব্দ আসছে না৷ সে যেন বোবা হয়ে গিয়েছে৷ যেন সে জীবনেও কথা বলেনি৷ কথা বলা শেখেনি।
দানবটা হিংস্র হয়ে গেল কেমন৷ দু'কদম এগোতেই অরিক অনুভব করলো তার কানের কাছ দিয়ে শোঁ শব্দ করে কি যেন ছুটে গেল। দু'পাশ থেকেই কি যেন ছুটে গেল। এরপর মূহুর্তে সব ঠিক হয়ে গেলো। ও লক্ষ্য করলো ওর টর্চটা হাতে ধরে আছে৷ টর্চে নিভু নিভু আলো জ্বলছে। কিছুটা পথ আলোকিত হয়ে আছে। গায়ের ভার ভাবটা নেই৷ কোনো অস্বস্তিকর অনুভূতি নেই। ওর খুব স্বাভাবিক অনুভব হলো। কপালে হাত দিতেই দেখলো ঘেমে আছে৷ ঘামে টিশার্টটা ভিজে গেছে। ও কয়েকটা ঢোক গিললো। হাত দিতে কপাল মুছলো। কেমন অবচেতন হয়ে কিছুটা এগোলো। খানিক এগোতেই পেছন থেকে কেমন খচখচ শব্দ এলো। ও দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। টর্চের আলো ফেলতেই দেখলো বিশালদেহী একটা নেকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। চেহারায় আনুগত্য ভাব৷ চোয়ালের দিকের অংশ কেমন কালো হয়ে আছে৷ টর্চের আলোয় তা জ্বল জ্বল করছে৷ মনে হচ্ছে রক্ত৷ কিন্তু রক্ত কি কালো হয়? এতো কালো? অরিক দৌড়ানোর চেষ্টা করলো! কিন্তু পায়ে কোনো বল পেলো না৷ শরীরটা অসাড় হয়ে এলো। কেমন ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে৷ মূহুর্তেই চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো তার৷
.
অরিকের ঘুম ভাঙ্গলো৷ এসি চলছে৷ তাও সে ঘেমে আছে৷ এমন প্রায়ই হয়। পুরনো ঘটনাটি স্বপ্ন হয়ে তাড়া দেয়৷ সে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঘটনাটি পুরাতন হলেও কৌতূহলটা ঠিক সতেজই রয়ে গেল। যখন এটি ঘটে, তার বয়স তখন ষোলো। কিন্তু এর কোনো সমাধান হয়নি পরে আর৷ সেদিন যে সে অজ্ঞান হয়ে গেল, জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলো বিছানায়। পাশেই অস্থির হয়ে বসে ছিল তার মা৷ চেহারায় কৌতূহল, জানতে চায় অনেক কিছু। অরিক মায়ের দিকে তাকালে বলে,
-কী হয়েছে রে বাবা? ঘরের সামনে এসেই অজ্ঞান হয়ে পড়লি? বেশি খারাপ লেগেছিলো?
অরিক ভ্রু কুচকে বলে,
-ঘরের সামনে?
-হ্যাঁ তাই তো! দরজায় শব্দ হলো৷ খুলতেই দেখি তুই মাটিতে পড়ে আছিস।
-কি জানি! সম্ভবত ক্লান্ত ছিলাম অনেক।
-তা তো থাকবিই। এতো পরিশ্রম করছিস। আমি কতো করে বলি যে এতো পড়ার দরকার নেই, শরীর-স্বাস্থের দিকে নজর দে, কথা শুনিস আমার?
অরিক মায়ের কথার জবাব দেয় না৷ সে আবার চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। তার ক্লান্ত লাগছে৷
.
অরিক ফ্রেশ হয়ে নিলো। চুলোয় চা বসালো। দুটো বিস্কুট একটা ছোট থালায় নিয়ে টেবলের উপর রাখলো। এক ফাঁকে ঘড়ি দেখলো সে। সাতটা বাজে৷ খালার এখনই আসার কথা৷ যদিও সময়ের প্রতি খালারা খুব একটা সদয় নন। অরিক চা আর বিস্কুট নিয়ে সোফায় বসলো। চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলো চারপাশ। এতো বড় বাসা। অথচ সে থাকে একা৷ একা অবশ্য না৷ একটা ছোট্ট বিড়ালও থাকে ওর সাথে৷ ব্যস৷ আর কেউ নেই।
অরিক চা হাতে উঠে দাঁড়ালো। দরজার কাছে ছোট্ট একটা ঝুড়ি রাখা৷ তাতে কালো খামে একটা চিঠি পড়ে আছে৷ অরিক চেয়ে থাকলো কিছু সময়৷ তার জীবনে সে এতো কালো পেপার আর দেখেনি৷ অদ্ভত। চিঠি আসার বিষয়টা শুরু হয়েছে মাস তিনেক আগ থেকে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সে ভাগ্যক্রমে একটি হলে জায়গা পায়৷ মেধাবি হওয়ায় তার জন্যে হল পাওয়াটা খানিকটা সহজতরই ছিল। তার হলের বয়স কেবল মাস দুয়েক হলো। এর মধ্যেই প্রথম চিঠিটা আসে৷
এই যুগে চিঠি আসার বিষয়টা কিছুটা অদ্ভুত হলেও অরিকের জন্যে চিঠি আসার বিষয়টা অতিরিক্ত অদ্ভুতের৷ কারণ তার মা ছাড়া আত্মীয় কেউই নেই। থাকলেও তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। সে হিসেবে তার নিকট চিঠি আসার প্রশ্নই আসে না৷ আবার এমনও না যে অরিককে কেউ পছন্দ করে চিঠি লিখেছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সে লক্ষ্য করছে যে তার সহপাঠীরা তাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না৷ খুব একটা যে পছন্দও করছে তাও না৷ পছন্দ যে করবে, তার কারণও যে রয়েছে এমন না৷ অরিক ক্লাসে এলে না কথা বলে, না আড্ডা দেয়৷ তার কোনো বন্ধুও নেই। ওই দু'মাসে ও কারো সাথেই কথা বলেনি৷ এমনকি টিচাররা দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলে সে শুধু বলে, জানি না স্যার৷ এ ছাড়া আর কিছুই বলে না৷ শিক্ষকরাও এতে খানিকটা বিরক্ত। তবে বিরক্তির মাত্রা ছড়াচ্ছে না এই কারণে যে তার সিটির রেজাল্ট ভালো৷ প্রথম সেমিস্টারেও তার রেজাল্ট দৃষ্টিগোচর করার মতো নয়৷ প্রথম তিনজনের একজন সে৷
চিঠির কথা শুনে অরিক যারপরনাই অবাক। সে রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং-এ গেলো। সেখানে দেখলো একজন বৃদ্ধ লোক বসা৷ কালো স্যুট-কোট পরে বসে আছেন৷ দেখতে বেশ অভিজাত পরিবারের মনে হচ্ছে৷ চেহারার এক প্রকার আনন্দ এবং প্রাণবন্ত ভাব৷ বৃদ্ধ বলে যে জুবুথুবু হবে, এমন না৷ বেশ ফিট। অরিক অবাক হলো। এই লোককে সে চিনে বলে মনে হয় না। সে এগিয়ে গেল। লোকটা অরিককে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা এগিয়ে এসে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো। অরিক আনমনে হ্যান্ডশেক করলো৷ লোকটা অরিকের হাত্র মৃদু চাপ দিয়ে এক গাল হেসে বলল,
-আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লেগেছে। আপনার দেখা পাবার ইচ্ছে ছিলো অনেক৷ ভেবেছিলাম এই জন্মে হয়তো সম্ভব না। কিন্তু আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
লোকটা মুখের হাসিটা স্থির রাখলো। অরিক অবাক হয়ে চারপাশে চোখ বুলালো। কেউই নেই৷ পুরো ডাইনিং ফাঁকা। কেমন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা এখানে। অথচ এটা কোনো স্বাভাবিক দৃশ্য না৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলো এতো নিস্তব্ধ হবে, তা ভাবাই দায়! অরিক লোকটাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সে বলে উঠলো,
-আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না, তাই তো?
অরিক মাথা নাড়লো আনমনে। লোকটা হাসলো৷ আবার বলল,
-এবারর?
অরিকের চোখ এবার লোকটা পেছনে গেল৷ অদ্ভুত! ওই নেকড়েটা৷ সেই যে ছোট বেলার দেখেছিলো! সেই নেকড়েটা দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার পেছনে৷ কিছুটা দূরে৷ সেই আনুগত্য চাহনি, স্থির দৃষ্টি তার। নেকড়েটা এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে। একদম লোকটার কাছ ঘেঁসে দাঁড়ালো! সে নেকড়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তার অরিকের দিকে চেয়ে বলল,
-উই আর দ্য সেভিয়র!
অরিক ভ্রু কুচকে বলল,
-মানে? সেভিয়র?
-আমি জানি আপনার মনে অনেক প্রশ্ন। অনেক কৌতূহল। আপনি অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন না৷ নিজেকে খানিকটা সময় দিন৷ সবই বুঝে যাবেন৷ আপনার এই রহস্য কিন্তু আপনাকেই সমাধান করতে হবে?
অরিকের ভ্রু কুচকে এলো। এসব কি বলছে লোকটা? তিনি কি অসুস্থ? নাকি অরিক অসুস্থ? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? লোকটা বলল,
-দুঃখিত আমি নিজের নামটাই এখনো জানাইনি। আমার নাম রাইসুল। রাইসুল আবেদিন। আপনার নাম অরিক আহমেদ, তাই তো?
-জি।
-এই খামটি রাখুন। এখানে কিছু টাকা দেওয়া আছে৷ সাথে একটা এড্রেস৷ আজকেই এই এড্রেসে পৌঁছে যাবেন। এখন থেকে ওটাই হবে আপনার বাসা। কিছু কন্ডিশন লিখা আছে৷ সেটাও দেখে নিবেন। আমার গাড়িটা এখানেই থাকবে৷ ড্রাইভার আপনাকে পৌঁছে দিবে।
-আপনাকে আমি চিনি না৷ জানি না৷ অথচ আপনি বললেন আর আমি রাজি হয়ে যাব? আর এসব কী হচ্ছে না হচ্ছে এসব কিছুই আমি বুঝতে পারছি৷ আপনি কে? কেন আমাকে এতো রেস্পেক্ট করছেন? আমার এতো মূল্য কেন? কেনই বা আমি অদেখাকে দেখতে পাই? কেন?
-আমি জানি আপনার অনেক প্রশ্ন। প্রশ্ন গুলোর জবাব আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে৷ আমি কেবল এতোটুকু বলতে পারি যে আপনি যদি হল ছেড়ে না যান, তবে বছর তিনেক আগে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি আবারো ঘটতে পারে। এবার হয়তো বেঁচে ফেরাটাই টাফ হয়ে যাবে৷ কারণ এবার যে আসবে, তাকে আমরাও রোখাতে পারব কি না সন্দেহ।
অরিক অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো৷ কিছুই বলতে পারলো না৷ রইসুল নামক লোকটা খামটা হাতে ধরিয়ে চলে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরই অরিক লক্ষ্য করলো সে ডাইনিং এর চেয়ারে বসে আছে৷ তার হাতে কচকচে কালো একটা খাম।
.
অরিক চা হাতে এগিয়ে এলো। খামটা নিলো। খুলতেউ ভেতরে একটা ছোট্ট কাগজ পেল। এই চিঠি গুলো অদ্ভুত হয়৷ পেপার হয় কালো৷ আর তাতে সাদা কলমে লিখা থাকে অক্ষর গুলো৷ অক্ষর গুলোও টানাটানা করে লিখা। দেখতেই কেমন ভৌতিক লাগে৷
অরিক কাগজটা খুললো,
"অরিক,
বাহিরে আপনার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে। পশ্চিমের আলমারিটায়, যেটা আপনি অনেকবার খোলার চেষ্টা করেও খুলতে পারেননি, আজকে আবার চেষ্টা করবেন৷ তাতে আপনার জন্যে একটা স্যুট রাখা আছে৷ পরে নিবেন৷ এটি আপনার প্রথম কাজ। ঘাবড়াবেন না৷ ভয় পাবেন না৷ আপনি অলরেডি যথেষ্ট দেখেছেন এবং আপনি জানেন কীভাবে এমন সমস্যা সমাধান করতে হয়। আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন৷ এবারের ভিক্টিম একটা মেয়ে। তার নাম এমিলি। আপনি চোখ বন্ধ করে তার নামটা একবার উচ্চারণ করবেন৷ এবং অবশ্যই এটি সোফায় বসে করবেন৷ আপনার জন্যে শুভকামনা।"
অরিকের বিষ্ময়ের সীমা রইলো না৷ এই বাসায় কেউই থাকে না৷ তারপরও প্রেরক কীভাবে জানলো যে সে আলমারিটা খোলার চেষ্টা করেছে? আর এসব কিসের কাজ? কিসের ভিক্টিম?
অরিকের ভ্রু কুচকে এলো৷ সে চোখ বন্ধ করে বলল "এমিলি"।
সাথে সাথেই একটা মিরাকল ঘটলো৷ অরিক দেখলো, সুন্দরী একটা মেয়ে হাঁটাছে৷ বাগানের পথ ধরে৷ খোলা চুল। বাগানটা সুনসান। মৃদু বাতাস বইছে৷ মেয়েটা গুনগুনিয়ে গান গাইছে৷ এর কিছু পরেই অরিক আরো কিছু লক্ষ্য করলো৷ একটা অদ্ভুত বাতাস৷ যেটাকে স্পেসিফাই করা যায়৷ এমন বাতাস অরিক আরো দেখেছে৷ অনেকবার৷ এই বাতাস অস্পষ্ট ধীরে ধীরে একটা অবয়ব হয়। একটা পূর্নাঙ্গ রূপ নিয়ে পারে। অরিক লক্ষ্য করলো মেয়েটার পেছন পেছন অবয়বটা হেঁটে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে এটি একটি আকারে ফিরছে। অদ্ভুত আকার। দেখতে কেমন আঁশযুক্ত। মাছের গন্ধ ছড়ালো যেন৷ মেয়েটা বুঝতে পারে৷ সে গন্ধ নেবার চেষ্টা করে৷ উৎস খুঁজতেই সে পেছন ফিরে তাকায়৷ তাকাতেই দেখে বিশালদেহী একটা দানব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ মেয়েটা মূহুর্তে চিৎকার দেয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপরই ওর সহপাঠীরা ছুটে আসে৷ এমিলিকে তুলে নিয়ে যায়। শেষ দিকে অরিক দেখলো মেয়েটা একটা রুমে বন্দী৷ তার চেহারা শুষ্ক। দেহে রক্ত নেই যেন! যেন কিছু একটা ভেতর থেকে তাকে ছুষে খাচ্ছে৷ শুকিয়ে মেয়েটা কাঠ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই মেয়েটা যেন অরিকের দিকে চাইলো৷ চিৎকার দিয়ে বলল,
-এই তুই কে? কে তুই? কেন তাকায় আছিস আমার দিকে? কে তুই??
এটা বলে এমিলি একটা ভয়ানক রূপ ধারণ করে এক প্রকার উড়ে এলো অরিকের দিকে। অরিক চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। সে কিছুটা ছিটকে গিয়ে পড়লো খানিক দূরে। কপালে ঘাম৷ সে জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে৷ ঠিক সেই সময়ে বিড়ালটার শব্দ শোনা গেল,
"মিয়াও"
.
রূপগঞ্জ ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়। দশম শ্রেনীর কম্বাইন ক্লাস চলছে। বাংলা প্রথম পত্র পড়াচ্ছেন স্যার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত৷ সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে৷ অরিকও। এই বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রী সকল ক্লাস মিস দিলেও সুধীন্দ্রনাথ স্যারের ক্লাস মিস দেয় না৷ স্যার বেশ গোছানো, আবৃত্তি স্বরে, কাব্যিকতা নিয়ে প্রতিটি ক্লাস নেন, ছোট্ট ছোট্ট বিষয় গুলো ঠান্ডা মাথায় এতো দারুণ ভাবে বুঝিয়ে দেন, ছাত্রছাত্রীরা মনোমুগ্ধ হয়ে তা শুনে, বুঝে।
সেই ক্লাসেই আচমকা পুরনো সেই অস্বস্তি বোধটা অনুভব করলো অরিক। আবারো যেন সেই গা চিমচিমে ভাব, শরীরটা কেমন ভারী ভারী হয়ে আসছে। অরিক অবাক হলো।
ইদানিং বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে তার সাথে। কেউ কখনো বাতাস দেখিনি৷ ইদানিং সে তা দেখছে৷ দলা ধরা বাতাস৷ কোথায় যেন উড়ে যায় সেসব৷ সে বুঝতে পারে না৷ বিস্মিত হয়৷ এসব তার দেখার বিষয় না৷ তাও সে দেখছে৷ কেন? তার জবাব নেই তার কাছে৷ তার মাকেও বলতে পারছে না। কারণ মা এমনিতেই বলে এই বাসাটা ভালো না৷ এখানে ভূতুড়ে উপদ্রব রয়েছে। এসব বললে যে কী হবে, তা ভেবেই কূল পায় না সে। তাছাড়া তাদের আর্থিক অবস্থাও উন্নত নয়৷ এই ভিটে ছাড়া তাদের আর কোনো জায়গা নেই৷ তার মাকে এসব বললে তিনি আর যাই হোক, এখানে আর থাকবেন না৷ তিনি বেশ এক রোখা টাইপের মানুষ।
তাছাড়া অরিকও কেমন নিশ্চুপ ধরনের ছেলে। কোনো কথা বলে না৷ ব্যথা পেলে কাঁদে না৷ কখনো উচ্চস্বরে হাসেওনি সে। খেলতে যায় না৷ গেলেও দূর থেকে দেখে৷ বসে থাকে৷ এখানে সেখানে৷ মাঝেমাঝে ঘন জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যায়৷ গাছে চড়ে বসে৷ পাখিদের ডাক শোনে৷ বাতাস দেখে এবং বাতাস খোঁজার চেষ্টা করে। ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই অদ্ভুত, স্বল্পভাষী এবং বেশ মেধাবী। লোকজন নানান কথা বললেও সে এসব গায়ে মাখে না৷ সবাই তাকে সোসাল হতে বললেও তাতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ কাজ করে না। ক্লাসেও তেমন সে৷ স্যার যা বলে মনোযোগ দিয়ে শুনে। বুঝে৷ ফ্রি সময়ে বই পড়ে৷ সময় মতো নামাজ পড়ে। ব্যস৷ এটাই তার জীবন। তার আবদ্ধ জীবন। এতেই যেন খুশি সে।
অরিকের ঘাড়টা কেমন শক্ত হয়ে এলো৷ কেমন যেন টনটন হয়ে গেল যেন ঘাড়টা৷ সে দ্রুত মাথা এপাশ-ওপাশ করলো। নাহ ঘাড় ঠিকাছে৷ কিন্তু অস্বস্তির মাত্রা বাড়ছে। সে আশপাশে দেখলো। ভালো করে তাকাতেই দেখলো মেয়েটাকে। চোখ জোড়া কেমন লাল হয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে৷ একদম অরিকের দেখো। যেন আস্ত খেয়ে ফেলবে ওকে। অরিক যেন কিছু অনুভব করলো। বুঝতে পারলো। সে ভালো করে দেখলো মেয়েটাকে৷ ওর চেহারায় কিছু ভাসছে যেন৷ সে বুঝতে পারলো। মেয়েটা স্বাভাবিক নেই। তার মাঝে কেউ আছে৷ বা কিছু আছে৷ বাতাস জাতীয় কিছু। অরিক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো৷ মেয়েটার দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করলো। খানিক পর যেন সব নরম্যাল হয়ে এলো। মেয়েটা এখন আর ওর দিকে তাকিয়ে নেই। সে নরম্যাল হয়ে আছে। ক্লাসে মনোযোগ দিয়েছে। এই ঘটনা পর পর তিনবার ঘটলো। এই প্রথমবারের মতো অরিক ভাবলো তার কিছু করা উচিৎ। এবং সে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলো।
.
অরিক রেডি হয়ে বের হলো। বাসার সামনেই গাড়িটা পার্ক করা ছিল। সে জলদি করে গাড়িতে চড়ে বসলো। সত্যি বলতে তার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আগে নিজের রহস্য গুলো সমাধান করবে। তার সাথে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে অথচ এসবের কোনো উৎস সে জানে না। আগে সেসব জানতে হবে৷ এর আগে অন্য কিছু না৷ কিন্তু মেয়েটার কন্ডিশন দেখে ওর মনে হলো এখন দেরি করলে বেশ অন্যায় হয়ে যাবে৷ সম্ভবত মেয়েটাকে বাঁচানোই যাবে না৷ তাই এতোশত না ভেবে সে বেরিয়ে পড়লো। কারণ সে জানে, এসব বেশ রিস্কি এবং বিলম্ব করা উচিৎ নয়।
.
এই বাসায় বেশ লোকজন দেখা যাচ্ছে৷ সবাই বেশ চিন্তিত। কেউ কান্না করছে৷ কেউ সান্তনা দেওয়া চেষ্টা করছে৷ অরিক ড্রইং রুমের সোফায় বসলো। তাকে দেখে একজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এলো। ভদ্রলোকের চোখে পানি। চেহারা ফ্যাকাসে। ইনি সম্ভবত মেয়েটার বাবা। তিনি কাছে এসে বললেন,
-আপনি অরিক?
-জি।
তিনি জোরে বলে উঠলেন,
-সবাই মাঝের ঘরে গিয়ে বসো। জলদি!!
সবাই সে ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে মাঝেঘরে তালা মেরে দিলেন। মূহুর্তে ঘরের মাঝে কেমন নীরবতা নেমে এলো। শুধু একটা ঘর থেকে গুনগুন আওয়াজ আসছে। কেউ যেন গান গাচ্ছে৷ কান্নার স্বরে গান৷
অরিক রুমটার দিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটার বাবা এগিয়ে এসে একটা স্যালাইন ওর একটা চাবি এগিয়ে দিলো ওর দিকে৷ বলল,
-আমাকে বলা হয়েছে যেন এটা রেডি রাখি। আপনি কি এটা সাথে নিয়ে যাবেন?
অরিক কিছু বলল না৷ স্যালাইনের ব্যাগ ও চাবিটা হাতে নিলো। খানিকটা এগোতেই লোকটা আবার বলে উঠলো,
-কিছু না মনে করলে আমি কি আসব আপনার সাথে?
অরিক পেছন ফিরে চাইলো৷ লোকটার চোখে চোখ রাখলো। বলল,
-অফিসিয়ালি এটা আমার প্রথম কাজ৷ কিন্তু এর আগেও আমি পাঁচবার এমন কাজ করেছি। সেখানে চারজনই ছিল মেয়ে৷ সুযোগ ছিল, কিন্তু কখনোই অমন ইনটেনশন আসেনি মনে৷ এবার তো অফিসিয়াল। আমি আমার লিমিট ক্রস করব না৷ চিন্তা করবেন না৷ তবে রুমে আমাকে একাই যেতে হবে৷
লোকটা থ হয়ে গেল। তিনি ভাবেননি, অরিক তার মনের কথাটা এভাবে ধরে ফেলে মুখের উপর জবাব দিয়ে দিবে।
অরিক দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। দেখলো, শুকনো, কাঠের মতো মেয়েটিকে লোহার শিকল দিয়ে আঁটাকে রেখেছে। দু'হাত বাঁধা শিকলে। তালা ঝুলছে। অরিকের উপস্থিতি টের পেতেই রক্ত চোক্ষু নিয়ে চাইলো৷ চোখ বড় বড় করে অরিখের দিকে চেয়ে রইলো। তখনই অরিকের ওই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল।
দশম শ্রেনীর কম্বাইন ক্লাসের মেয়েটা৷ যে তিন দিন টানা ওকে লক্ষ্য করে চক্ষুবান দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। সে মেয়েটাও এমন শুকিয়ে গিয়েছিলো। চেহারা ফ্যাকাসে হয়েছিলো। কেমন উসকোখুসকো ভাব। মেয়েটা স্কুলে আসেনি আর৷ এলাকার সবাই তাকে পাগল, ভূতুড়ে উপাধি দিয়ে দিলো। হাজার হুজুর, ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয়নি। তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলো। এক সময়ে তাকে আলাদা একটা ঘর করে সেখানে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলো। সারাদিন সবই ঠিক থাকতো৷ কেবল রাত গভীর হলেই সেই ঘর থেকে অস্বাভাবিক চিৎকারের আওয়াজ আসতো। যেন কেউ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অথচ মৃত্যুবরণ করছে, এমন হৃদয়বিদারক চিৎকার। অরিক একদিন কায়দা করে ওর ঘরে ঢুকে বসলো। সেখানে ঠিক এমিলির মতোই ওই মেয়েটা বসেছিল। ওকে ঢুকতে দেখতেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো। যেন আস্ত খেয়ে ফেলবে ওকে। সেদিন অরিক ঠিক মেয়েটার অস্বাভাবিকত্ব দূর করে ফেলে। কিন্তু দিন কয়েক পর মেয়েটি মারা যায়, অতিরিক্ত দূর্বলতার কারণ স্ট্রোক করে।
অরিক দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দিলো। স্যালাইনটা এক পাশে রেখে ও ধীরে ধীরে মেয়েটার দিকে আগালো। এমিলি যেন ফুঁসছে। কেমন অদ্ভুত গোঙানোর শব্দ বের করছি সে৷ অরিক কে এগোতে দেখেই সে চিৎকার দিয়ে বলল,
-তোকে আমি দেখেছি! তুমি আমাকে দেখছিলি। দূর থেকে! তুই স্পাই হয়েছিস না? খুব স্পাই হয়েছিস? খুলে দে আমাকে। খালি একবার খুল৷ তোর স্পাইগিরি আমি তোর জায়গা দিয়ে বের করব! আয়! আয় বেটা৷ কিরে বেটা৷ আয়!!!
অরিক বিচলিত হলো না৷ সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। এমিলির নাচানাচি বেড়ে গেল। সে লাফাতে থাকলো। কেমন পুরুষদের মতো লাফাচ্ছে৷ অরিক যখনই ওকে ধরে স্থির করতে যাবে তখন একই আরেকটা মোটা স্বর ভেসে এলো,
-তুই ওকে ছুঁবি না৷ ওকে আমি ছুঁবো কেবল। ও আমার কেবলই আমার। তোর ছোঁয়াও যদি ওর গায়ে লাগে, তবে তোকে খুন করে ফেলবো৷ এখানে, এক্ষুনি খুন করে ফেলবো।
অরিক পাত্তা দিলো না৷ সে এক হাতে শক্ত করে তালাটা ধরলো। অন্য হাত দিয়ে চাবিটা খোলার চেষ্টা করলো। এমিলির অস্থিরতা এদিকে বেড়েই চললো। এক পর্যায়ে সে গালি দিতে শুরু করলো। বিস্রি বিস্রি গালি।
একটা সময় অরিক তালাটা খুলে ফেলতে সফল হয়৷ শিকল ছাড়া পেয়ে এমিলি উন্মাদের মতোন হাসে৷
-পাইসিরে। পাইসি তোরে৷ আজ তোকে জমের বাড়ি পাঠাবো।
এই বলে সে জোরে অরিকের গায়ে লাত্থি দিতে আসে৷ কিন্তু লাত্থি লাগে না৷ উলটো সে ছিটে পড়ে। পড়া থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় সে৷ চারপাশ দৌড়াতে থাকে। চিৎকার করে এবং চক্রাকারে ঘুরতে থাকে৷ আবার এগিয়ে আসে৷ অরিককে মারতে চায়৷ কিন্তু পারে ন৷ কিসের যেন বাধা পায় সে। একটা সময় এমিলি দাঁড়িয়ে যায়৷ ভ্রু কুচকে দেখে অরিককে। বলে,
-কে তুই? সত্যি করে বল কে তুই? তুই এমন কেন? সবার থেকে ভিন্ন কেন?
অরিক শান্ত থাকে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে এমিলির দিকে। এমিলির কী বোধহয় বোঝা মুশকিল। তবে সে এবার অন্য ভাবে ছোটাছুটি করে। বারান্দার দিকে যেতে চায়৷ কিন্তু পারে না৷ দরজা খুলতে চায়। পারে না৷ কয়েক মূহুর্তের মাঝে সে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়৷ ধীরে ধীরে যেন নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে৷ হঠাৎ সে হাঁটু ভেঙ্গে বসে অরিকের সামনে৷ দু'হাত জোড়ো করে বলে,
-আমায় ক্ষমা করে দাও প্লীজ। ক্ষমা করে দাও আমায়৷ আমি আর কখনই এমন করব না৷ কখনোই না৷
অরিক তার হাত চেপে ধরে৷ বলে,
-সব অন্যায়ের ক্ষমা হয় না।
-আমাকে যেতে দাও৷ না হয় আমি একে মেরে ফেলবো। এক্ষুনি মেরে ফেলব!
-যাকে ভালোবাসো, তাকে মেরে ফেলবে?
সে আর কথা বলে না৷ এবার কান্না করতে থাকে। অরিক বলে,
-আমি জানি তুমি কীভাবে ওর মাঝে এসেছো। মানুষের মাঝে তোমরা আসো কেন? কী প্রয়োজন? তোমরা কী এতোই নির্বোধ যে মানুষ এবং তোমাদের মাঝে পার্থক্য করতে পার না?
এমিলি কান্না করে৷ বলে,
-ও আমাদের ওখানে গেছিলো৷ আমার বাগানে হাঁটছিলো। ওর তো ওদিক যাওয়া ঠিক হয়নি?
-মানুষ কই যাবে কি যাবে না, তা তো তোমরা ঠিক করবে না৷ নাকি?
-করব। আমরাই করব? আমার বাসায় তারা আসবে কেন?
-বুঝেছি। তোমাকে শাস্তি দিতে হবে৷
-খবরদার আমাকে কিছু করবে না৷ না হয় আমি মেয়াটাকে মেরে ফেলব৷ এক্ষুনি মেরে ফেলবো।
-মেরে ফেললেও তুমি কিন্তু এখান থেকে পালাতে পারবে না৷ কারণ তুমি এখন আবদ্ধ হয়ে আছো।
-আমি নিজেও মরবো, ওকেও মারবো। দাঁড়া!
অরিক লক্ষ্য করলো এমিলি শান্ত হয়ে গিয়েছে৷ ও নিজের গলা চেপে ধরেছে৷ চোখমুখ লালচে হয়ে আসছে ওর। আর দেরি করা ঠিক হবে না৷ অরিক এমিলির ঘাড় চেপে ধরলো। ঘাড়ের পেছনে চিমটি কাটলো। সেখানে সাদা একটি চুল ভেসে উঠলো। চুলটা ভেসে উঠতেই এমিলি চিৎকার দিয়ে বলল,
-না না না না! আমাকে ছেড়ে দে৷ আমি ওকে এক্ষুনি ছেড়ে দিব৷ আমি তোর গোলাম হবো৷ তোর দাস হবো। আমাকে ছেড়ে দে৷ তুই যা বলবি তাই করব৷ আমায় ছেড়ে দে। ছেড়ে দে৷
অরিক সেসব পাত্তা দিলো না৷ সে আলতো করে সাদা চুলটাকে গোড়া হতে তুলে নিলো। মূহুর্তে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে এমিলি মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। অরিক চুলটার দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছু সময়৷ ঠিক এমনই একটা চুল ওর ক্লাসমেট মেয়েটার থেকেও পেয়েছে৷ ওটা এখনো ওর কাছে আছে৷ ওর ব্যাগে৷ কিন্তু এটা কী করবে? রেখে দিবে?
ঠিক তখনই সে নেকড়েটাকে দেখতে পেলো। এখানে নেকড়ে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ আসার কথাই না৷ এরা আসলে নেকড়ে না৷ এর অন্য কিছু। রূপ ধরে আসে৷ অরিক উঠে দাঁড়ালো। নেকড়েটা এগিয়ে এলো কিছুটা৷ মূহুর্তের মাঝে সে তার রূপ পরিবর্তন করলো। সে মানুষের মতোন হয়ে গেল৷ ঠিক অরিকের মতোই একটা স্যুট পরে ওর সামনে এদে দাঁড়ালো। অরিক দেখলো, নির্বোধ হয়ে চেয়ে রইলো। ভাবলো এটা কে? পরী? সে এতো রূপবতী কেন? কারো চোখ এতো মায়াবি হয়?
মেয়েটা অরিকের দিকে চেয়ে হাসলো। বললো,
-গ্রেট জব অরিক।
অরিকের ভ্রু কুচকে এলো। কিছু বলল না৷ সে আবারো বললো,
-আমার নাম ক্যারিন। দাও, ওটা আমার কাছে দাও।
বলেই মেয়েটা চুলটা নিয়ে নিলো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখে মেয়েটা আবার বলে উঠলো,
-তুমি জানো তোমাকে সবাই কেন এতো পছন্দ করে? শুধু তোমার জন্যে৷ কারণ তুমি স্পেসিফিক এবং স্পেশাল। কিন্তু আমি পছন্দ করি কেন জানো? অনেক কারণেই করি অবশ্য৷ তবে একটা উত্তম কারণ হলো তোমার নামে অর্থ৷ অরিক, মানে শান্তি, অরিক মানে শক্তিশালী। যা তোমার সাথে একদম যায়।
একটু থেমে আবার বলল,
-আবার দেখা হবে! চিন্তা করো না৷ আমাকে দেখার বিস্তর সময় পাবে তখন।
বলেই সে বারান্দার দরজা খুলে বের হয়ে গেল। অরিক ভ্রম ভেঙ্গে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে স্যালাইনটা ফিট করে দিলো। ওর মাথাটা ভনভন করছে৷ ভীষণ ভনভন করছে৷ ও দ্রুত দরজা খুলে বের হলো। এর আগে কখনই এমন হয়নি। আজ হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানে না সে। সে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসলো। ওকে জলদি বাসায় যেতে হবে৷ জলদি। এরা সবাই ওকে চেনে। সাবই জানে ওকে। কেবল ও-ই কিছুই জানে না। এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। ওকে জানতে হবে। সবটা জানতে হবে।
.
গল্পঃ অরিক: অন্তর্দৃষ্টি
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
তাসফি আহমেদ