গল্পঃ প্রতিশ্রুতি | লেখকঃ তাসফি আহমেদ | Tasfis Blog

গল্পঃ প্রতিশ্রুতি | লেখকঃ তাসফি আহমেদ


-স্যার, আপনার একজন গেস্ট এসেছে। গেস্ট রুমে অপেক্ষা করতে বললাম।
আমি কান থেকে হেডফোনটা খুলে মজিদের দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বললাম,
-কী ব্যাপার মজিদ?
-আপনার গেস্ট আসছে স্যার।
-আমার?
-জি।
আমি খানিকটা অবাকই হলাম। বলল,
-পাঁচ মিনিট বসতে বলো। আসছি আমি।
মজিদ চলে গেল। আমি খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার সাথে অফিসে কেউ দেখা করতে আসবে, তা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। কারণ এমন কেউই নেই যে আসবে। বাসায় আমার মা আর ছোট বোন। এছাড়া এই শহরে আমার আপন বলতে আর কেউই নেই। আমার হাতে খানিকটা কাজ ছিল। একটা ওয়েবসাইটের বেজ ডিজাইন এবং স্কেলেবল আর্কিটেক্ট তৈরী করা। এরপর জুনিয়রদেরকে দিয়ে দিব। এই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ বলেই বেশ মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। কাজের প্রায় শেষ দিকে। এখনই ঠিক উঠতে মন চাচ্ছে না। তাই হেডফোনটা কানে লাগিয়ে কাজে মনোযোগী হলাম। প্রায় বিশ মিনিট পর মজিদ আবার এলো। ওকে দেখতেই আমার মনে পড়ে গেল যে আমার গেস্ট আসছে। কিছুক্ষণের জন্যে ভুলেই গিয়েছিলাম যে কেউ আসছে। আমি হেডফোনটা রেখে হাঁটা ধরলাম। গেস্ট রুমে আসতেই দেখলাম একটা মেয়ে বসা। আমার ভ্রু কুচকে এলো। আমার উপস্থিতি টের পেতেই সে মুখ তুলে চাইলো। এমন ভাবে চাইলো, মূহুর্তে আমার শরীরে যেন একটা শীতল শিহরণ বলে গেল। কেমন প্রশান্তি ভাব চট করেই আমাকে আচ্ছাদিত করে ফেললো। হঠাৎ অনুভব হলো আমার সকল ক্লান্তি গায়েব হয়ে গেছে। আহা! কী চোখ! কী অস্বাভাবিক এই কাজলের মায়া! এমন ভাবে তাকালো, যেন বুকের ভেতরটা নড়ে উঠলো। আমি মৃদু হেসে এগিয়ে গেলাম। বললাম,
-আপনি?
সে উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলল না। আমি বললাম,
-সরি, খানিকটা ব্যস্ত ছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেল। এক্সট্রিমলি সরি। কিছু মনে করবেন না।
সে মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-সমস্যা নেই।
-বসুন। তা হঠাৎ এখানে? ঠিকানাও বা পেলেন কীভাবে?
লিলি খানিকটা ইতস্তত করতে থাকলো। তাকে কিছুটা বিচলিতও লাগলো। আমি এবার চিন্তায় পড়ে গেলাম। ও হঠাৎ এখানে কেন?
লিলির সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো। আমরা একদিন তাদের বাসায় যাই। লিলিকে দেখতে। সবই ঠিকঠাক ছিল। আমি আর লিলি দু'জনই বিয়েতে সম্মতি জানাই। সকল কথাবার্তা ফাইনাল। গ্রাম থেকে আমার মামা আসবেন। উনি এসে বিয়ের ডেট ফিক্সড করবেন। ব্যস। আমি বেশ এক্সাইটেড ছিলাম। সত্যি বলতে লিলিকে আমার বেশ পছন্দ হয়। এতো মায়াবি চেহারা! এতো সুন্দর করে কাজল দিতে জানে সে। সেদিন গোলাপি রঙের শাড়ি পরে এসেছে আমাদের সামনে। এতো সুন্দর করে চুল বেঁধেছিলো! কপালে মুগ্ধমায়া হয়ে ছিল ছোট্ট একটা টিপ। আমি খানিকটা সময় ঘোরেই চলে গিয়েছিলাম যেন। এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম। স্রষ্টার কি মধুর কারুকাজ! এতো পরিপূর্ণ হয় কেউ?
লিলির সাথে সেদিন আমি আমার সোসাল মিডিয়া শেয়ার করি। নাম্বার আদান-প্রদান হয়। পরদিন রাতে ওর সাথে বেশ খানিকক্ষণ কথাও হয়েছে। এর পরদিন হুট করেই লিলির বাবা ফোন দিয়ে বলল উনি মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। উনাদের ছেলেকে পছন্দ হয়নি। আমি যাতে লিলির সাথে আর কোনো যোগাযোগ না করি। ব্যস! সব শেষ। লিলির বাবার একটা ফোন কলে মূহুর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল আমাদের সকল প্ল্যান, ধূলোয় চাপা পড়লো আমার অনুভূতি, টুকরো টুকরো ক্ষতের অনুভব পেলাম আমার হৃদয়ে। সামান্য জ্বলন! এক অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস।
-কফি খেতে খেতে বলি?
আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। মৃদু হেসে জবাব দিলাম,
-আমাদের ক্যানটিনের কফিটা দারুণ। চলুন সেখানে যাই।
-ক্যানটিন না। নিরিবিলি কোথাও। কোলাহল মুক্ত প্লেস।
আমি ওর দিকে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। খানিকটা ভেবে বললাম,
-ঢাকা শহরে কোলাহল মুক্ত প্লেস পাবেন বলে মনে হয় না। এছাড়া আমি এখন অফিস থেকে বেরও হতে পারব না। তবে আপনি সম্মতি দিলে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। যেখানে কোলাহল একদমই নেই। আবার আমারো অফিস থেকে বের হতে হবে না!
লিলিকে খানিকটা ইতস্তত দেখালো। সে যেন বিচলিত বোধ করছে। হয়তো ভাবছে কোথায় না কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমি। আমি খানিকটা হেসে বললাম,
-আমাদের অফিসের ছাদটা বেশ সুন্দর, নিরিবিলি। সবার ওখানে যাওয়ার পারমিশন নেই। জাস্ট আমরা গুটি কয়েক লোকই যাই।
লিলি বিচলিত চেহারা নিয়েই জবাব দিলো,
-চলুন, সেখানেই যাই।
-বেশ। একটু সময় দিন। কফিটা নিয়ে নেই।
-জি আনুন।
ছাদে প্রবেশ করতেই এক ঝাক বাতাস যেন ঝাপটে ধরলো। এতো ঠান্ডা স্নিগ্ধ বাতাস। মুগ্ধকর! লিলি ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমিও তার পাশে। হাতে কফির মগ। মৃদুমন্দ বাতাস। লিলির খোলা চুল! এলোমেলো করে উড়ছে। ও খানিক পরপরই সেগুলো কানে গুঁজে দিচ্ছে। এতো মায়াবী দৃশ্য এটি! বলার মতো না। আমার ইচ্ছে করছে ওর কানের কাছে চুল গুলো গুঁজে দেই। আলত করে ওর গালে হাত রাখি। কিন্তু এই ইচ্ছের কি দাম আছে? সব ইচ্ছের কি দাম হয়?
-কফিটা বেশ! সকাল থেকেই মাথাটা বেশ ভার হয়ে ছিল। প্রথম চুমুকেই যেন সব ক্লান্তিভাব দূর।
-কফি খুব পছন্দ করেন, না?
-মোটামুটি। চায়ের চেয়ে বেশি বলতে পারেন।
-আমার চা পছন্দ।
-বেশ! রং চা?
-না। দুধ চা।
-জেনেশুনে শরীরের ক্ষতি করছেন?
-আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা অলরেডি হয়ে গেছে মিস লিলি। সামান্য চা আর কিইব ক্ষতি করবে।
লিলি মাথা নিচু করে রাখলো। ওর চুল গুলো উড়ে উড়ে সামনে চলে আসছে। খানিক পর সে চুল গুলোকে কানের কাছে গুঁজে দিলো। মুখটা মলিন লাগলো তার। আমার দিকে চাইলো! চেহারাটা আসলেই কেমন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। ও আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকলো কিছু সময়। একদম চোখ বরবার তাকিয়ে আছে। আমার মনে হলো আমি কিছু টের পেয়েছি। কিছু বুঝতে পেরেছি। অবাক বিষয়! আমার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে লিলির চেয়ে দুঃখিনী মেয়ে এই দুনিয়ায় নেই। আমার বুকের ভেতরটা কেমন কোমল হয়ে এলো। এই মেয়ের জন্যে আমার অসম্ভব রকম মায়া জন্মালো। আমি বললাম,
-লিলি?
সে জবাব দিলো,
-জি বলুন।
-কী হয়েছে বলুন তো!
-কিছু হয়নি।
-সত্যিই?
-জি। আপনি বিচলিত হবেন না প্লীজ।
-বেশ! এবার না হয় বলেই ফেলুন কেন এসেছেন?
-অবশ্যই। এমনিতেই আপনার বেশ দেরি করিয়ে ফেললাম। এক্সট্রিমলি সরি তার জন্যে। মাইন্ড করবেন না। কিন্তু আমার মনে হলো আমার আসা উচিৎ। তাই এলাম।
-কি যে বলছেন এসব! মাইন্ড করব কেন। আপনি খানিকটা রিল্যাক্স হোন। এরপর বলবেন। সমস্যা নেই।
-সমস্যা নেই। আমি আসলে আপনাকে সরি বলতে এসেছি।
-সরি? কিসের জন্যে?
লিলি খানিকটা চুপ থাকলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-আসলে আমার বাবা যা করেছেন, একদমই ঠিক করেননি। সব কিছু ঠিকঠাক করে আবার না করে দেওয়াটা একদমই উচিৎ কাজ হয়নি। আমি বাবাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি অনেক। কিন্তু উনি কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছেন না। আবার আমাদেরকে রিজনটাও বলছেন না। খালি আমাকে নিষেধ করলেন যাতে আপনার সাথে যোগাযোগ না করি, আর...
লিলি মাথা নিচু করে কথা গুলো বলছিলো। সে এখন আমার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা একদম স্পষ্ট, অথচ মলিন, নিতান্তই অসহায়। ওকে দেখতে কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে আমার কাছে অভিযোগ দিচ্ছে। আমি কিছু বললাম না। লিলি মাথা নিচু করে বলল,
-আর উনিই আমাকে বলেছেন আমি যেন আপনাকে সব জায়গা থেকে ব্লক দিয়ে দেই। ইভেন উনি নিজে সামনে থেকে আপনাকে ব্লক দেওয়ায়েছেন।
কথাটা বলেই লিলি চাইলো আমার দিকে। কেমন অনুশোচনায় ভরা লিলির চেহারা। আমার মায়া জাগলো। হাঠাৎ-ই সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার মুভিটার একটা সংলাপ মনে পড়লো। আমি তার দিকে চেয়ে বললাম,
-লিলি, আপনার অনুশোচনা হয়?
লিলি আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। অন্যদিকে চাইলো। তার মলিন চেহারা কেমন লালচে হয়ে আসছে। সে কি লজ্জা পাচ্ছে? আমার কেমন আনন্দ লেগে উঠলো। খানিকটা লজ্জাবোধও। জানি না কেন। তবে লাগলো। আমি বললাম,
-এদিক ফিরলে কি অনুশোচনা ধরা পড়ে যাবে?
লিলি মৃদু হেসে চাইলো আমার দিকে। বলল,
-মজা নিবেন না প্লীজ। আমি সত্যিই সরি ফিল করছি। আন্টিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। উনি কি না কি ভাবলেন। কাউকে কথা দিয়ে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া তো একদমই ঠিক না, তাই না? বাবা যে কেন এমন করলেন! জানেন, আমার বাবা একদমই এমন না। এমনকি আপনাকেও উনার বেশ পছন্দ হয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ যে কী হলো!
-সত্যি কথা বলতে আমি আসলে কিছুই মনে করেনি। অবাক লেগেছে বটে। কিন্তু বড়দের আগে কি আর আমরা কথা বলতে পারি বলুন। উনি নিশ্চয়ই আপনার মন্দ চাইবেন না। হয়তো এমন কিছু উনার মাথায় এসেছে যেটা উনাকে বাধা দিচ্ছে। উনার বিষয়টাও তো চিন্তা করতে হবে, তাই না?
লিলি কিছু বলল না। অন্যদিকে ফিরে চাইলো। আমি ওকে চাইলাম কিছুক্ষন। পরিবেশটা বেশ রোমান্টিক! আকাশটা কেমন মেঘলা হয়ে আছে। বাতাসে মিশে আছে কেমন মিষ্টি অনুভূতি। কেমন শীতল এক সুখ। আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার জীবনে দেখা সবচে সুন্দরী নারী। যার সামান্য অবয়বও, আমার হৃদয়কে মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে দেয়। বললাম,
-আমি মাকে বলে দিব। আপনি যে এসেছেন। উনি অবশ্য কিছু মনে করেননি। বরং আপনার জন্যে খানিক আফসোস করলেন।
লিলি কিছু বলল না। মৃদু হাসলো কেবল। আমরা আরো খানিকটা সময় ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কথা বিশেষ হয়নি যদিও। তারপরও দাঁড়িয়ে থাকলাম। সত্যি বলতে ভালো লাগছিলো। অন্য রকম একটা মায়া ঘিরে রেখেছিলো মূহুর্তটাকে।
ডেস্কে এসে পড়লাম আরেক মুসিবতে। যে সময়টুকু ছাদে কাটিয়েছি, তাতেই আমার অফিসে তুলকালাম কান্ড বেধে গেছে। একটা প্রজেক্টের ডেডলাইন ছিল, অথচ সেটা সাবমিট হয়নি এখনো। এদিকে আমি ডেস্কে নেই। তা দেখে তো বস আরো খেপে গেলেন। আমি এসেই সিচুয়েশনটা ম্যানেজ করে নিলাম। টিম লিড হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব যে প্রজেক্টের খুঁটিনাটি সব আপডেট রাখা। এমনকি আমি ভেবেছি আয়াত সেটা করে ফেলতে পারবে। কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে যে একটা ক্রিটিকাল এরোর চলে আসবে, সেটা বোধগম্য ছিল না। সিনিয়র কেউ হলে করে ফেলতে পারতো। মেয়েটা জুনিয়র হওয়ায় শেষ করতে পারেনি। আমি টিমের সবাইকে সব কাজ পজ করে আয়াতকে হেল্প করতে বললাম। আমি নিজেও বসলাম। আয়াতের পুরো কোড বেজটাই বাগে ভরা ছিল। সব গুলো রিসলভ করতে করতে আমাদের সন্ধ্যার পর হয়। ফাইনাল টেস্ট দিয়েই প্রজেক্ট সাবমিট দেই। সব কাজ শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়। এগারোটা বেজে যায়। বাসায় এসেই ফ্রেশ হই। মাকে খাবার দিতে বলি। খাবার টেবিলে লিলির কথাটা মাকে বলি। উনি তো মহা খুশি। আবদার করলেন কেন বাসায় নিয়ে আসিনি। অদ্ভুত আবদার। এই মেয়ের বাবা তার ছেলেকে রিজেক্ট মেরেছে, তারউপর যেইসেই রিজেক্ট না, কঠিন রিজেক্ট, আর উনিই কি না বলছে সেই মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসতে।
যাই হোক, বেশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। ফোনটা হাতে নিতেই দেখি নোটিফিকেশন, কেউ একজন আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছেন। ফেসবুকে ঢুকতেই দেখি লিলির রিকোয়েস্ট। অবাক হলাম। নিজেই ব্লক করে ফের নিজেই রিকোয়েস্ট দিলো? মেয়েটা আসলে চাচ্ছে কী? আমি রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলাম। কিছুক্ষণ ফিড স্ক্রল করলাম। অল্প কিছুই পরেই মেসেঞ্জারের টুং শব্দটা আসে। লিলির মেসেজ। লিখলো,
'এতোক্ষনে সময় হলো! আমি তো ভাবলাম অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে।'
আমি মেসেজটা পড়ে খানিকটা হাসলাম। লিখলাম,
-আমি তো অপেক্ষার অবসান ঘটালাম। কিন্তু আমার অপেক্ষার কী হবে? কে করবে তার অবসান?
ওপাশ থেকে আর।কোনো রেস্পন্স আসেনি। আমিও আর কিছু লিখিনি। অতল ঘুমে ডুব দিলাম।

লিলি দেখা করে যাওয়ার পর থেকেই আমার কেমন জানি অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হতে থাকলো। এমনটা আমি এর আগে কখনই ফিল করিনি। এখন কেন জানি করছি। বার বার চোখের সামনে ওর চেহারা ভেসে উঠছে। ও কেমন মায়া নিয়ে আমার দিকে চেয়ে ছিলো। আমাকে দেখছিলো। চোখে চোখ রেখেছিলো। আমার মনে হয় তখন কিছু একটা হয়েছে আমার। আমি টের পেয়েছি মেয়েটা অসম্ভব দুঃখী। আমার মায়া হয়েছে তার জন্যে। কিন্তু সেই মায়া যে আমাকে এতোটা বিচলিত করে ফেলবে, ভাবিনি। অফিসে আসার পুরোটা পথ আমি কেবল ওকে নিয়ে ভেবেছি। ওর ওই চোখ জোড়া যেন আমাকে অস্থির করে তুলছে। আমার ওকে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওর চোখ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এক যুগ আমি তার চোখের দিকে চেয়ে থাকি। তাকে দেখি। তার অস্তিত্বকে অনুভব করি।
-স্যার?
আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। আয়াত দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলো,
-স্যার, এনিথিং রঙ? আপনাকে বেশ নার্ভাস লাগছে।
আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,
-না তো! সব ঠিক আছে। কী খবর তোমার?
-ফাইন স্যার। সব ঠিকঠাক। আমি আসলে আপনার কাছেই এসেছিলাম।
-আচ্ছা? কোনো প্রয়োজন?
-প্রয়োজন না ঠিক। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। কাল আমাকে এতো হেল্প করলেন। আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি হেল্প না করলে যে কী হতো!
-ব্যাপার না। তুমি তো নতুন। এমন প্রব্লেম হবেই। এগুলো সলভ করাটাই তো আমাদের মূল কাজ।
-আসলে স্যার, জব সার্স করতে করতে কোডিং-এ কিছুটা গ্যাপ পড়ে যায়। তাই খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়। আশা করছি সামনে এমন হবে না আর। আমি আরো কেয়ারফুল থাকবো।
-গ্রেট! আশা করছি সামনে ভালো কিছু করবে। তা বাকি টিম মেম্বারদের থ্যাংকস দিয়েছো?
আয়াত খানিকটা ইতস্তত করে বলল,
-না স্যার। এখনো না।
-তারা প্রত্যেকেই কিন্তু এটা ডিজার্ব করে। সো আমার মনে হয় ইউ শুড থ্যাংকস দেম টু।
-সিউর স্যার। আই উইল!
আয়াত চলে গেল। আমি নিজের কাজে মনোযোগী হলাম। নতুন প্রজেক্টে হাত দেওয়ায় কাজের চাপ বেশ কম ছিল। রিল্যাক্সে কাজ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু কী যে হলো! আমি কোনো ভাবেই যেন কাজে মনোযোগী হতে পারছিলাম না। নিজের ভেতরে কেমন অস্থিরতা অনুভব করলাম। যেন কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। কোনো ভাবেই যেন কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। অদ্ভুত! কী হচ্ছে আমার সাথে?
এভাবে দিন দুয়েক কেটে যায়। আমি এবং আমার মনের গৃহ যুদ্ধ চলছিলো ততোদিন। আমরা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। জানার চেষ্টা করছিলাম যে কেন এমন হলো। কেন আমি এমন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি। বেশি কাজও করতে পারছিলাম না। আজ ভাবলাম আর্লি লিভ নিবো। তাও ঠিক হয়ে উঠলো না। আর্লিটা ঠিক পাঁচটায় ঠেকলো। আমি অফিস থেকে বের হয়ে আনমনে হাঁটতে থাকলাম। অফিসের সামনের রাস্তাটায় অনেক খাবারের দোকান পাওয়া যায়। মানুষজন বিকেল হলেই এখানে ভিড় করে। আমার ভিড় ভালো লাগে না। আমি রাস্তার এক ধার ধরেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ কেউ একজন ডাক দিলো,
-এইযে?
আমি পেছন ফিরে চাইলাম। অবাক দৃশ্য! লিলি দাঁড়িয়ে! আমার ভ্রু কুচকে এলো। চেহারায় অবাক হাসি। সে এগিয়ে এলো। বলল,
-কেমন আছেন?
-ভালো। আপনি?
-এইতো চলছে। অফিস শেষ?
-জি। আজকের জন্যে।
বলে হাসলাম আমি। সেও হাসলো। বললাম,
-হঠাৎ এখানে?
-এখানকার ফুচকাটা এতো দারুণ। আমি তো প্রায়ই এখানে খেতে আসি। আমার ভার্সিটি থেকেও কাছে।
-বাহ! বেশ তো! তা একা এসেছেন?
-না না। একা আসিনি। ওইযে ওখানে আমার বন্ধুরা বসা।
সে আঙ্গুল উঁচিয়ে তিনটা মেয়েকে দেখালো। ওরা আমাদের দিকে চেয়ে আছে। হাসছে। আমি তাদেরকে দূর থেকে হাই বললাম। সে তার হাতটা নামিয়ে নিলো। আমি তার হাতের দিকে লক্ষ্য করলাম। মেহেদী দেওয়া। গাঢ় রঙ হয়েছে। ফর্সা হাতে বেশ মানিয়েছে বলতে হয়। হাতে বেশ কয়েকটা চুড়ি পরা। টুংটাং শব্দ হচ্ছে। থ্রিপিস পরেছে আজ। জামার প্রিন্টটাও দারুণ। ওকে বেশ মানিয়েছে বলতে হয়। চুল গুলো ছেড়ে দাওয়া। স্ট্রেইট করা। আমি অবাক হলাম! এই মেয়ের সমস্ত কিছুই এতো পার্ফেক্ট হয়ে কেন? কেন এমন মনে হয় যে মেয়েটা একদম পরিপূর্ণ, পবিত্র। কোনো খুঁত নেই। এতো নিখুঁত! কী অনিন্দ্য সৃষ্টি! আমি বললাম,
-মেহেদী পরেছেন?
সে হাত উঁচিয়ে আমাকে দেখালো!
-হ্যাঁ। এইযে দেখুন!
ওকে বেশ উচ্ছ্বসিত লাগছে। যেন আমার নোটিস করাতে সে বেশ আনন্দ পেয়েছে। আমি তার হাত জোড়া দেখলাম। নিপুণ কারুকাজ। তারউপর দুহাত ভরা চুড়ি। আমি হেসে বললাম,
-অপূর্ব! আপনাকে দারুণ মানিয়েছে। মেহেদী দিতে পছন্দ করেন?
-কোন মেয়ে মেহেদী দিতে অপছন্দ করে, বলুন!
আমি হাসলাম। ওর দিকে চেয়ে থাকলাম কিছু সময়। সত্যি বলতে আমার ভালো লাগছিলো। আনন্দ লাগছিলো। মনের অস্থিরতাটা যেন চট করেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। কেমন এক প্রশান্তির অনুভব হচ্ছে। বললাম,
-আপনি কি সব সময়েই এমন সেজেগুজে ভার্সিটি যান?
ও মৃদু হাসলো। বলল,
-নাহ! সব সময়ে না। এই কালে ভাদ্রে আরকি।
আমি খানিকটা চুপ থাকলাম। মনে মনে হাসলাম। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম,
-আপনাকে বেশ সুন্দরী লাগছে লিলি।
লিলি হাসলো! মুখটা কেমন লালচে হয়ে এলো ওর। ও মাথা নিচু করে আছে। মিটমিট করে হাসছে যেন। দু'হাতে মাথার সামনে চলে আসা চুল গুলো কানের কাছে গুঁজে দিলো। আমি তাকিয়ে থাকলাম কেবল। কী মসৃণ দৃশ্য! আমার মনে হচ্ছিলো চারপাশ কেমন স্থবির হয়ে আছে। পৃথিবীর সকল মুভমেন্ট মূহুর্তে বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল আমি আর লিলি ছাড়া। লিলি নামের এই অদ্ভুত রূপসী মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা ভর্তি লজ্জা। ঠোঁটের কোণে, লিপস্টিকের আড়ালে কেমন দুষ্টুমিষ্টি হাসি। কাজল ভরা চোখে অসম্ভব স্নিগ্ধতা। মেয়েটির গাল লালচে হয়ে আছে। সে মাথা নিচু করে আছে। একটু পর মাথা তুলে চাইলো! স্পষ্টই সে আমার চোখে চোখ রাখলো। গোল গোল চোখ। চোখের পাড়ে কী অমায়িক কাজলের কারুকাজ। চোখ ভর্তি মায়া। মায়া ভর্তি লজ্জা। আনন্দ! সুখ! এই মেয়েটিকে আজ আমার ভীষণ সুখী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষটি সে।
আমিও খানিক লজ্জা পেলাম। লজ্জা ঢাকতে হাসলাম। ওর তাকিয়ে থাকা দেখে বিড়বিড়ি করলাম,
-এই মূহুর্ত কী কোনো ভাবে চিরস্থায়ী করা যায় না? ইশ! এভাবে যদি আজীবন থাকা যেতো!
-জী? কী বললেন?
আমি চমকে উঠলাম। আমার ঘোর কাটলো যেন। বললাম,
-ক-ক-কই! কিছু না তো!
-আপনি কিছু বললেন মনে হয়! কি চিরস্থায়ী করার কথা বললেন?
-আরেহ কিছুনা। বাদ দিন। আপনি তাহলে ফুচকা ইঞ্জয় করুন!
লিলি কিছুটা ইতস্ততবোধ করলো! কিছু বলতে চায় যেন! কিন্তু বলতে পারছে না। মেয়েদের এই এক সমস্যা! সব কথা সহজ করে বলতেই জানে না। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি যে ও আমাকে ফুচকা খেতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। ইতস্তত করছে। আমি ভাবলাম ওকে একটু হেল্প করি। পরে ভাবলাম না থাক। ওকে দিয়েই বলাই! বললাম,
-ঠিকাছে লিলি! আসি তবে।
লিলি হাসলো। আমিও হাসলাম। হাত উঁচিয়ে টাটা দিলাম। এরপর পেছন ফিরে হাঁটা ধরলাম। সামান্য এগোতেই মেয়েটা ডেকে বসলো,
-শুনেন না!
আমি পেছন ফিরে চাইলাম। আমার মুখে মৃদু হাসি। অন্তরে প্রশান্তির জোয়ার বইছে। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,
-চলুন ফুচকা খাই। আমি জানি আপনার ফুচকা পছন্দ না। তারপরও একটু আসুন। তাছাড়া আপনার এলাকায় এলাম! আপনিই যদি না থাকেন তাহলে কি হয় বলুন!
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। খানিকটা এগিয়ে এলাম। বললাম,
-আমি এই অখাদ্য...
-একদম অখাদ্য বলবেন না এটাকে। আপনি অপছন্দ করেন বিষয়টি ভিন্ন কথা। কিন্তু একদম অখাদ্য বলা যাবে না।
-এটা তো স্বৈরাচারী হয়ে গেল। অপছন্দকেও প্রকাশ করা যাবে না!
-উফফ আপনি এতো কথা বলেন কেন হ্যাঁ? আসুন তো! আসুন!
এই বলে সে আমার হাত ধরলো। টানতে টানতে নিয়ে গেল দোকানের সামনে। আমার মনে হলো আমার শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে। আমি নির্বোধ হয়ে গিয়েছি। আমার সমস্ত দেহে বিদ্যুত গতীতে একটা শীতল তরঙ্গ বয়ে গেল। মনের ভেতর অস্থির এক উত্তাল বইছে। আমার আনন্দ লাগছে। কিন্তু আমি সেটা প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছি না। আমি পুরোটা সময় নির্বোধের মতো সেখানে বসে থাকলাম। ওরা কি বললো না বললো তার কিছুই আমার মনে নেই! আমি কেবল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকলাম।
সেখান থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়। আমি বাসায় ফিরে গোসল করে নিলাম। এরপর বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আমার তখনো নির্বোধ লাগছিলো। আমার ভাবনারা কেবল সচল ছিলো! আমি ভাবছি, মেয়েটা কীভাবে আমাকে ধরে টেনে নিয়ে গেল! আমাকে সেখানে বসালো! কীভাবে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছিলো ও। আমি তাকিয়ে আছি। আমি দেখছি ওকে। আমি আমার জীবনে দেখা পৃথিবীর এক মাত্র সুন্দরী মেয়েটিকে দেখছি।
এরপর কিছু দিন মিশ্র অনুভূতিতে কাটে। এই অস্থিরতা তো এই মুগ্ধতা। আমি এই শান্তি অনুভব করি তো এই অশান্তি। এই পরিপূর্ণ তো এই শূন্যতা। প্রেম কি, প্রেমের অর্থ কি, জানি না। কখনো অনুভবও করিনি। সারা জীবন পড়াশোনায় কেটেছে। পিতামাতার বাধ্যগত ছিলাম। মেয়ে সঙ্গের কখনো লোভও জাগেনি। আমার মনে হয়েছে আমি তো একদিন বিয়ে করব। কেউ একজন আসবে। আমি তাকে সমস্ত উজাড় করে দিব। লিলিকে দেখেতে যেয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মেয়েটিকে আমি ভালোবাসবো। পাগলের মতো করে ভালোবাসবো। কিন্তু ওর বাবার বাধাতে আমি হোচট খাই। তখনো অতটা অনুভব হয়নি। এরপর মেয়েটার সাথে আমার দুইবার সাক্ষাৎ হয়। দুইটি সাক্ষাৎ-ই যেন আমাকে অনেক কিছু বলে দিয়েছে। অনেক কিছু অনুভব করিয়েছে। যা আমি কখনোই অনুভব করিনি। সেদিন অফিসের ছাদে ও যেভাবে আমার চোখে চোখ রাখলো, আমার ভেতরটা কেমন কোমল হয়ে উঠলো! কোনো মেয়ে চোখে চোখ রাখলে হৃদয় কোমল হয়, জানা ছিলো না। আমার সেদিন ঘোর ধরেছে। একটা মেয়ে দেখে ঘোর ধরার মতো ছেলে আমি নই। তাও আমি স্বীকার করেছি। হার মেনেছি। অনুভব করেছি। কিছু একটা। অতিপ্রাকৃতিক কিছু। অদ্ভুত কিছু। যেমনটা আগে কখনো অনুভব হয়নি। কখনোই না। এইযে সে সেদিন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল, আমি যেমন স্থবির হয়ে গেলাম, আমার যে ভেতরে অনুভূতির জোয়ার বইলো, এমনটা আগে হয়নি। কখনোই না। পূর্বে আমার আশা জাগেনি এমন। কখনো প্রত্যাশাও করিনি। এখন করছি। মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা চাই। কিছু একটা প্রত্যাশা করি। আমি অস্থির এই জন্যে যে আমি আমার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পাচ্ছি না। আবার আমি আনন্দিত এই ভেবে হচ্ছি যে আমি কিছু একটা প্রত্যাশা করি এখন। কিছু একটা চাই আমি। নিশ্চিত ভাবেই চাই।
সপ্তাহ কেটে যায়। আমি ভেবেছি এর মধ্যে লিলির সাথে বেশ আলাপালোচনা হবে। হয়নি। কোনো চেটিংই দীর্ঘ হয়নি আমাদের। আমি কেন জানি মেসেজে অনেক কিছু বলতে পারি না। অনেক কথা ব্যক্ত করতে পারি না। এ জন্যেই হয়তো আমাদের কথা আগায় না। দীর্ঘ হয় না। এর মাঝে আমাদের লাস্ট সাবমিট হওয়ার প্রজেক্টের আপডেট চলে আসে। ক্লায়েন্ট আমাদের কাজে অনেক খুশি হয়। একশত ডলার বোনাস পাঠায়। টিম মেম্বাররা তো বেজায় খুশি। খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার টিম নরম্যালি এমন বোনাস পায়ই। তবে বোনাস এলে কাকে দিব সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই। নরম্যালি নতুনদের মাঝেই আমরা এটা ডিস্ট্রিবিউট করার ট্রাই করি। অবশ্যই সিনিয়র কাউকে এভয়েড করে না। টাকার অংকটা যেহেতু বেশি, তাই আমি সেটা দুই ভাগে ভাগ করে একটা অংশ মিড লেভেলের একজন ডেভেলপারকে দেই এবং অন্যটা আয়াতকে দেই। বেচারি যথেষ্ট প্যারা সয়েছে। ওকে অনুপ্রাণিত করার জন্যেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বসকে জানাই। তিনি সেটা ডিস্ট্রিবিউট করে দেন। এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি। প্ল্যান অনুযায়ীই বোনাস দেওয়া হয়। বোনাস পেয়ে আয়াতের খুশি দেখার মতো ছিল। মেয়েটাকে দেখে আমার অতিত মনে পড়ে গেল। আমিও যখন প্রথম কাজে ঢুকি, আমার অবস্থাও এমন হয়। আমার সিনিয়র ছিলে শিমুল দা। উনি সেবার প্রজেক্টের বোনাস মানিটা আমাকেই দিলেন। আমি যা খুশি হয়েছি! বলার মতো না! বোনাস হাতে নিয়ে আয়াত আমাদের টিম মেম্বারদের একটা ঘোষণা দেয়। বৃহস্পতিবার সে আমাদেরকে ট্রিট দিবে। কাচ্চি খাওয়াবে। আমি বেশ অবাকই হই। তবে তার কাজের জন্যে অবশ্যই তার প্রশংসা করতে হয়। ভালো একটা উদ্যোগ নিয়েছি! স্পেশালি কাচ্চির কথা শুনতেই আমার মন গলে জল হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার আসে। অফিসের কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে যাই। বস থেকে বলে হাফ ডে লিভ নিয়ে নেই। লাঞ্চ হয়। আড্ডা হয় অনেকক্ষন। সবাই সবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন নিয়ে আলোচনা করে। ক্যারিয়ার নিয়ে কথা হয়। আমিও সবাইকে কিছু উপদেশ দেই। ফান করি। মাঝে মাঝে এমন জোর করে খাওয়াতেও নিয়ে আসতে বলি। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই চলে যায়। আমিও যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত নিচ্ছিলাম। আয়াত একটা আবদার করে বসে। তাকে নিয়ে মার্কেটে যেতে হবে। আমি ঠিক যেতে চাইলাম না। তাও সে রিকোয়েস্ট করলো বলে রাজি হলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আমরা একটা রিক্সা নেই। দু'জন পাশাপাশি বসা। আমার অস্বস্তি লাগে। আমি যথাসম্ভব একপাশ চেপে বসলাম। শালা রিক্সা গুলোও এতো ছোট যে দু'জন খানিকটা ফাঁকা হয়ে বসবে যে সে অবস্থা নেই! কী মুসিবতে পড়লাম আমি! কিন্তু কিছুই করার নেই! মেয়েটা এদিকে নতুন এসেছে। তাই সব জায়গা তার পরিচিত না। একা যেতে তার ভয় লাগারই কথা। ধানমন্ডি সে কখনই আসেনি শুনে আমি মোটামুটি অবাকই হয়েছি। তাও বলেছে যেহেতু, বিশ্বাস করে নিতেই হবে। নিরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম,
-আমাদেরকে এই অবস্থায় দেখলে অফিসে গন্ডগোল হয়ে যাবে, তা কি জানো?
আয়াত হাসলো। দুষ্টু হাসি। যেন সে আমার এই অবস্থা দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। বলল,
-হোক না! ক্ষতি কি?
-মানে? কী বলছো তুমি?
-আমার বিশ্বাস আমি কী বলেছি তা আপনি স্পষ্টই বুঝতে পেরেছেন।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বলছে কি এই মেয়ে! আয়াত হাসছে। শব্দ করে হাসি। যেন সে মজা পাচ্ছে ভীষণ। আমার এমন একপাশ চেপে বসা দেখে যে তার আনন্দের সীমা রইলো না। মার্কেটের কাছে আসতেই আয়াত বলল,
-চিন্তা করবেন না স্যার। আমি অলরেডি এঙ্গেজড।
বলে সে খিলখিল করে হাসতে থাকলো। হাসতে হাসতে বলল,
-আমি আসলের ওর জন্যেও কিছু মার্কেট করব। আপনাকে নিয়ে এসে একেবারে মন্দ করিনি। আমার উপকারই হলো। আপনাদের দুজনের হাইট সেইম।
আমি হাসলাম। বললাম,
-মানুষের অপকারে আমি সহসা আসি না। উপকারেই আসি।
আয়াত হাসি চেপে বলল,
-স্যার আপনার যা অবস্থা হলো না! আমার এখনো হাসি পাচ্ছে। কেমন জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন!
আমি কিছু বললাম না। লজ্জিত চেহারা নিয়ে মার্কেটে প্রবেশ করলাম।
রবিবার অফিস শেষে আমি আর আমার ফ্রেন্ড শামীম এক সঙ্গে বের হই। কথা বলতে বলতে অফিসের গেট দিয়ে বের হতেই দেখি লিলি দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছে যেন। আমি শামীমকে ইশারা করলাম। ও এক গাল হেসে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলো। আমি লিলির দিকে এগোলাম। না, আজকে সে আহামরি সেজেগুজে আসেনি। কাজল নেই, টিপ নেই! নেই কোনো ভারী মেকাপ! তারপরও কী দারুণ লাগছে তাকে। এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-হাই লিলি! আজকেও ফুচকা খেতে এলেন বুঝি?
লিলি জবাব দিলো না। সে কেমন থমথমে হয়ে আছে। আমি আবারও বললাম,
-একা এসেছেন? ফ্রেন্ডরা কোথায়?
-একা এসেছি।
-কী হয়েছে লিলি? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
লিলি জবাব দিলো না। সে রোবটের মতো আছে। আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার কাছে কেমন যেন গোলমেলে লাগলো। আমি আবারো বললাম,
-আপনি এখানে কখন এসেছেন বলেন তো? কখন থেকে এখানে অপেক্ষা করছেন?
সে কেমন রোবটের মতোন বলল,
-তিনটায়।
-তিনটার দিকে? কীহ? বলেন কী? এতো আগে কেন এলেন?
-আমার ক্লাস আজকে আর্লি শেষ হয়। তাই।
-আর্লি শেষ হলে বাসায় চলে যাবেন। এখানে এসে কেন দাঁড়িয়ে থাকবেন?
লিলি কিছু বলে না। সে আগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে। তার ভ্রু কুচকে আসে। কপালে্র চামড়া দলা ধরে। চেহারা কালো হয়ে আসে। আমি কী বলব ভেবে পাই না। লিলির এই চরিত্রের সাথে আমি পরিচিত নই। একদমই না। সে চাপা স্বরে বলে,
-রিক্সা নিন। লেক পাড়ে যাব। আপনার সাথে কথা আছে।
আমি কিছু বললাম না আর। রিক্সা ডাকলাম।
শেষ বিকেল। সূর্যের আলো মরে আসছে। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। আমরা একটা নিরিবিলি জায়গায় বসলাম। লেকের পাড় ঘেঁষে। আকাশে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। হিম বাতাস বইছে। মেঘ এসেছে আকাশ দখল করতে। অথচ বাতাসের তাড়নায় সেটি স্থিরই হতে পারছে না। আমি আকাশের দিকে চেয়ে থাকলাম। আমিও যে এই মেঘের মতো! স্থির হতেই পারছি না। লিলি বলে উঠে,
-লাস্ট কয়েকদিন ধরে আপনাকে আমি বেশ কয়েকবার মেসেজ দিয়েছি। আপনি রিপ্লাই করেননি। কেন বলুন তো?
আমি অবাক হলাম। ভ্রু কুচকে তাকালাম ওর দিকে। ও কি জানে না আমি কেন রিপ্লাই করছিলাম না? ও আবার বলল,
-আপনি কি চোখে দেখেন না? নাকি আমি মেসেজ দিলেই আপনার চোখ সেটি দেখে না। কোনটা?
-কি যে বলছেন! দেখব না কেন?
-তার মানে দেখেছেন?
আমি জবাব দিলাম না। চুপ করে থাকলাম। লিলি বলল,
-আপনি জানেন এটা কতোটা কষ্টকর যে কেউ আপনাকে রীতিমতো ইগনোর করছে?
আমি চুপ করে থাকলাম। লিলি যেন খানিকটা রেগে গেল। কঠিন স্বরে বলল,
-কী হলো? জবাব দিচ্ছেন না কেন আপনি?
আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়েটা এতোটা রেগে আছে কেন? কী হয়েছে ওর? বললাম,
-আপনি এতো রেগে আছেন কেন বলুন তো?
-আমি রাগব না? আমি রাগবো না তো কে রাগবে হ্যাঁ? আপনি না মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছেন। না কল পিক করছেন। না আমার প্রতি আপনি কোনো রেস্পন্স দেখাচ্ছেন। উল্টো আপনি মেয়েদের সাথে রিক্সায় চড়ে বেড়াচ্ছেন। এসব দেখে কে না রাগ করবে বলেন তো? কই? কথা বলেন না কেন? বলেন? আমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক না?
আমি চট করেই কিছু বললাম না। কিছুটা সময় নিয়ে বললাম,
-রিল্যাক্স হোন। ঘন ঘন শ্বাস নিন। আমি আপনাকে বলছি। সব বলছি। আপনি একটু শান্ত হোন।
লিলি কথা শুনলো। শান্ত হলো! কিন্তু তার চেহারার বর্ন পরিবর্তন হলো না। তার নাকের ডগা, কান, গাল কেমন লালচে হয়ে থাকলো! আমার দিকে তার দৃষ্টি কোমল হলো না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। আমি কিছুটা সময় অপেক্ষা করলাম। ওকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিলাম। বললাম,
-সেদিন আপনার বাবা এসেছেন আমার অফিসে। আমার সাথে দেখা করতে।
লিলির চেহারা সরল হয়ে আসে এখন। কুচকানো কপাল মসৃণ হয়। ভ্রু সরল হয়। চেহারা লালচে থেকে কালো বর্ন ধারণ করে। যেন সে চট করেই কিছু একটা বুঝে ফেলেছে। কন্ঠস্বর যথেষ্ট নামিয়ে বলল,
-বাবা আপনাকে আমার সাথে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছেন, না? এ জন্যেই আপনি রিপ্লাই করছিলেন না?
আমি চুপ করে থাকলাম। ওর দিকে চেয়ে থাকলাম কেবল। ও মাথা নিচু করে নেয়। মুখটা ভীষণ মলিন হয়ে আসে ওর। কেমন ধরে আসা গলায় বলে,
-বাবা তো আমাকেও যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছিলো। তারপরও তো আমি যোগাযোগ করেছি, না? আমি কি আসিনি আপনার সাথে কথা বলতে?
-দেখুন, আপনি এলে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু আমি এলেই সমস্যা হবে। আপনি এলে মামলা হবে না। আইন আদালত হবে না। কিন্তু আমি এলে আইন হবে। আদালত হবে। নারীবাদীরা জেগে যাবে। আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি?
লিলি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলো। কিছু বলল না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আমি বললাম,
-উনি বেশ বাজে বিহ্যাভ করেছেন। মামলার ভয় দেখিয়েছেন। যদিও আমি এসব ভয় পাই না। তারপরও। দেখা গেল আপনাকে জোর করিয়ে আমার নামে মামলা করে দিল। তখন আমার কী হবে?
লিলি জবাব দিলো না। অন্য দিকে ফিরে চাইলো। ও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমাকে দেখছে না। কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। আমাদের মাঝে দমবন্ধকর একটা নীরবতা নেমে আসে। কেউ কিছু না বলে না। আমি বললাম,
-আপনি বললেন আমি নাকি কোন মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি?
লিলি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলো না। খানিকটা সময় নিলো। তার গলা বেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস এলো। আমার খারাপ লাগলো। আমি ওকে কথা গুলো বলতে চাইনি। কিন্তু ওর জোরাজুরিতেই বলতে হলো। লিলি নিজের ফোনটা বের করলো। আমাকে একটা ছবি দেখালো। ছবিতে আমি আর আয়াত হাসছি। আমি রিক্সায় বসে। আয়াত রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। ও আরো কিছু ছবি দেখালো। আমাদের শপিং এর ছবি। মার্কেটে ঘুরে বেড়ানোর। আমি অবাক হলাম। ওর কাছে এই ছবি এলো কোত্থেকে? আমার পেছনে গুপ্তচর লাগালো নাকি? বললাম,
-এই ছবি কই পেলেন?
ও ফোনটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল,
-আমার ফ্রেন্ড মার্কেটে ছিল তখন। সে তুলে পাঠিয়েছে।
আমি আর কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। লিলি খানিকটা সময় নীরব থেকে বলল,
-সত্যি করে বলেন তো? মেয়েটা কে?
-কেন? হঠাৎ ওর ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন?
-বলুন না। কে? পছন্দের কেউ?
আমি কিছু বললাম না। লিলির দিকে চেয়ে থাকলাম। তার মাঝে একটা অস্থিরতা দেখা দিলো। সে কেমন চটপট করছে। জানতে চাচ্ছে কিছু। মলিন চেহারায় অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। ও আমার দিকে ফিরে চাইলো আবার। বলল,
-এই মেয়েটার সাথেই আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে না? ওকেই আপনার পছন্দ হয়েছে, হুম?
আমি চুপ করেই থাকলাম। আমার মজা লাগছিলো আসলে। আমি স্পষ্টই লিলির চেহারায় জেলাসি দেখতে পাচ্ছিলাম। তার মাঝে অদ্ভুত এক জ্বলন দেখা দিলো। আবারো বলল,
-আপনার বিয়ে করার এতো তাড়া?
আমি এবার জবাব দিলাম,
-কী করব বলুন। আর কতোকাল এভাবে একা একা থাকবো। বিয়ে তো করতেই হবে।
ও আমার দিকে চেয়ে থাকলো। স্থির হয়ে চেয়ে থাকলো। যেন ও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। হয়তো শেষ মূহুর্ত অব্দি সে ভেবেছে আমি এটা বলব যে ওই মেয়েটা আমার কেউই না। কিন্তু শেষ কথাটাই অনেকটা বিশ্বাস এনে দেয় যে আমি আসলেই বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমিও ওটাই চাচ্ছিলাম। ও মাথা নিচু করে নিলো। আবারো আমাদের মাঝে এক দল নীরবতা নেমে এলো। আমরা কেউই কোনো কথা বললাম না। আমি লিলির দিকে চেয়ে থাকলাম। মেয়েটাকে দেখছি আমি। কেমন জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। ওড়নার কাছা ধরে টানাটানি করছে। কেমন চিন্তিত মনে হলো তাকে। কিছু সময় পর ও চট করেই আমার দিকে তাকায়। আমি অবাক হই। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। যেন কোনো অঘটন ঘটে গেছে। ঘটেছে বটেই। লিলি কাঁদছে। ওর চোখ ভরা জল। ও আমার দিকে চেয়ে থেকে কেমন ভেজা স্বরে বলল,
-আমি প্রথম দিন থেকেই আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করে ফেলি। আমি জানি না কেন, আপনার প্রতি আমি কেমন টান অনুভব করি। আপনার সাথে আমার এতো মিল। আমাদের অধিকাংশ পছন্দের মিল রয়েছে। এসব কী কাকতালীয়? এ যাবত এতো ছেলে দেখতে এলো! কখনোই কারো সাথে আমার পছন্দের এতোটা মিল পাইনি। কিন্তু আপনি? আপনি আসাতেই সব যেন উলোটপালোট হয়ে গেল। আপনার কথা বলার ধরন, আমার দৃষ্টি, আপনার তাকিয়ে থাকা, আপনার বুঝতে পারার ম্যাচিউরিটি এতোটাই পার্ফেক্ট যে আমার আপনাকে না করার কোনো রিজনই ছিল না। কিন্তু দেখেন! কী হলো আমার সাথে এটা! এতোটা কাছে পেয়েও আমি আপনাকে হারিয়ে ফেললাম। আপনাকে নিজের করে নিতে পারলাম না! আই ট্রাইড। বাট ফেইল্ড। আ'ম সরি আপনাকে এতোদিন বিরক্ত করার জন্যে। আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কি বলব ভেবে পেলাম না। আমার মনে হলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার উপর একটা ঝড় উড়ে গেল। আমার সমস্ত হৃদয় কেমন চুরমার করে দিলো। অন্তরে কেমন হাহাকার! কেমন ভারী একটা অনুভূতি। আমার এতো মায়া হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে! আমি নিতে পারছি না। আশ্চর্য ব্যাপার, লিলি কাঁদবে কেন? ওকে কেন কাঁদতে হবে? ওর মতো এতো রূপসী মেয়েকে কেন এতো কান্না করতে হবে?
লিলি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত গতিতে হাঁটা ধরলো। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ডাকলাম,
-লিলি? এই লিলি? শুনুন! আরেহ শুনুন তো!
লিলি শুনছে না। সে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। চোখ মুছছে। মেয়েটা এখনো কাঁদতেসে। হায় আল্লাহ। এ আমি কী করলাম! আমি দৌড়ে এগিয়ে গেলাম। ঠিক তখনই আমার একটা কল এলো। দৌড় থামিয়ে আমি ফোনটা রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে আমার ছোটবোন বলল,
-ভাইয়া কোথায় তুমি?
-কেন?
-আমরা পৌঁছে গেছি। তুমিও চলে এসো।
আমি আর কিছু বললাম না। কল কেটে দৌড়ে গেলাম। ততোক্ষন লিলি বের হয়ে গিয়েছে পার্ক থেকে। আমি বের হতেই দেখলাম রিক্সায় উঠে পড়েছে। আমিও একটা রিক্সা নিলাম। রিক্সাওয়াল মামাকে বললে লিলির রিক্সাকে ফলো করতে। লিলি আগে আগে, তার পেছন আমার রিক্সা। আমি আর ওকে ডাকলাম না। পেছন পেছন যেতে থাকলাম।
আমাদের দু'জনের রিক্সা একই সময়ে থামলো। স্থান, লিলির বাসার গেট। আমাকে দেখতেই ভ্রু কুচকে এলো তার। মলিন চেহারায় জিজ্ঞসু দৃষ্টি। আমি রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। লিলি অপেক্ষা করলো না। সে ভাড়া মিটিয়ে গেট গলে ঢুকে পড়লো। আমিও ঢুকলাম। ও লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আমিও দাঁড়ালাম। ওর ভ্রু কুচকে আছে। চোখ এখনো ঘোলাটে। কেমন লালচে হয়ে আছে। আমার এতো মায়া হলো ওর জন্যে! আমি বললাম,
-কথা শুনেন না কেন আপনি, হ্যাঁ? এতোবার ডাকলাম তাও সাড়া দিলেন না?
লিলি কেমন ধরে আসা স্বরে বলল,
-এতো ডাকাডাকির কী আছে?
-কিছু না থাকলে তো ডাকতাম না অবশ্যই।
লিলি ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকলো আমার দিকে। লিফট তখন এসে পড়েছে। দরজা খুললো। আমি ওকে আগে ঢুকতে বললাম। এরপর আমি ঢুকলাম। পঞ্চম ফ্লোর সিলেক্ট করলো ও। আমি দরজাটা ক্লোজ করে দিলাম। খানিকটা সময় নীরবতা। লিলি আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাকে দেখছে। আমি বললাম,
-ওর নাম আয়াত। আমার অফিস কলিগ। ও এখানে নতুন এসেছে। জায়গাটা অচেনা বলেই ওকে হেল্প করতে মার্কেটে নিয়ে গেলাম। ওর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ছিল।
-আপনি না বললেন আপনার পছন্দ? বিয়ে করতে চান?
-আমি বিয়ে করতে চাই বলেছি। কিন্তু একবারও আয়াতকে বিয়ে করতে চাই বলিনি। ওকে আমার পছন্দ তাও বলিনি!
লিলি এবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। বলল,
-আপনি তো হ্যাঁ না কিছুই বলিনি।
-কিছুই বলিনি বলে যে আমার উত্তর হ্যাঁ তা তো না।
-নিরব থাকাটাই তো সম্মতির লক্ষণ প্রকাশ করে।
-সব সময়ে না।
-তার মানে আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন?
-জি।
-আমার সাথে গেম খেললেন?
-না হলে তো আপনার মনের কথা গুলো জানতে পারতাম না!
লিলি হাসলো। সামান্য হাসি। লজ্জায় ভরা। কেউ বিশ্বাস করবে না, এই পৃথিবীর কেউই বিশ্বাস করবে না যে এই হাসিটা পৃথিবীর সবচে সুন্দরতম একটি হাসি। অতিমানবীয় একটি দৃশ্য। এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। সকলে দেখতে পায় না। কী অমায়িক! কী অনিন্দ্য! যেন মেঘলা আকাশের মেঘ কেটে মূহুর্তে কটকটে রোদের দেখা মিললো। আমি হাসলাম এবার। আমার শান্তি লাগছে। এই হাসিটুকু দেখে, আমি কেন জানি অস্বাভাবিক প্রশান্তি অনুভব করলাম। লিলি বলল,
-তা আপনি হঠাৎ আমাদের বাসায় কেন? বাবা দেখলে কিন্তু খবর আছে।
লিফট থেমে গেছে। দরজা খুললো। আমি বের হলাম। লিলিও। দরজা বন্ধ হলো। লিলি আমার দিকে চেয়ে আছে। তার জিজ্ঞাসু চেহারা। আমি বললাম,
-আমার মামা গ্রাম থেকে এসেছিলেন। উনি আপনার বাবার সাথে কথা বলেন। একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। শহরে আমাদের আত্মীয় না থাকলেও কিছু শত্রু আছে। আমার এলাকারই। গুটি কয়েক লোক আমাকে পছন্দ করে না। কারণ আমি তাদের বিরুদ্ধে কথা বলি। তাদের অন্যায়কে সবার সামনে তুলে ধরি। তারাই আপনার বাবাকে ভুলভাল বুঝিয়েছে। আপনার বাবা সম্ভবত আমার বিষয়ে খোঁজ নিতে আমাদের এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে উনি ওদের খপ্পরে পড়ে যান। তারা বলে আমার নাকি তাদের বন্ধু এবং আমার আগে বিয়ে হিয়েছিলো। আমার আম্মু ভাল না হওয়ায় আমাদের সংসারে ঝামেলা লেগেই থাকতো। যার ফলে আমাদের ডিভোর্স হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে মামা এই বিষয়টা সমাধান করে নেয়।
আমি থামলাম। লিলি আমার দিকে চেয়ে আছে। যেন ও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কি শুনছে এসব ও? বলল,
-সমাধান করে ফেলছে মানে? কী বলছেন এসব? কী সমাধান করছে? বলুন? প্লীজ বলুন না।
আমি হাসলাম। বললাম,
-বাকিটা বাসায় গেলেই দেখতে পাবেন।
লিলি দেরি করলো না। সে তাদের বাসার দরজার কাছে এলো। দরজায় এতো জুতা দেখে ও নিশ্চয়ই খানিকটা আন্দাজ করে নিয়েছে। তারপরও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কেমন স্তম্ভিত হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বেল বাজলো। দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকতে আমি দেখলাম মামা, মা ও বোন বসে আছে সোফায়। কথা বলছে লিলির বাবার ও মায়ের সাথে। লিলির কি আর কিছু বুঝার বাকি আছে? কি জানি! সে সালাম দিলো সবাইকে। এরপর দ্রুত নিজের রুমের দিকে চলে গেল। আমি হাসলাম ওর চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। আমার বেশ আনন্দ লাগলো। নিজেকে আজ বেশ সুখি মনে হচ্ছে। কেমন অকৃত্রিম এক আনন্দ আমাকে ঘিরে রেখেছে।
আমরা অনেকক্ষন বসে থাকলাম। লিলি তখনো আসেনি। তার অপেক্ষাতেই ছিলাম। লিলির আম্মু হঠাৎ আমাকে ডাকলেন। আমি এগিয়ে গেলাম। বললেন,
-পাগলিটা দরজা খুলছে না। বলছে যে তুমি না গেলে দরজা খুলবে না। তোমার সাথে নাকি কি বোঝাপড়া আছে। এরপর যা হবার হবে।
আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। এবার নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! আমার সাথে ওর আবার কিসের বোঝাপড়া? আমি ধির পায়ে ওর রুমের দিকে এগুলাম। দরজার টোকা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। সাথে সাথেই হেচকা টান। এরপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে নিজেকে একটা অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! হচ্ছে কী এসব? আমি ডাকলাম,
-লিলি? এই লিলি?
এরপর কি হলো আমি ঠিক বুঝে উঠলাম না। কেবল মনে হলো সামনের দিকে থেকে কেউ একজন আমাকে ঝাপটে ধরেছে। দুহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। লিলি আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। সে কাঁদছে। ফোঁপাচ্ছে। কি যেন বিড়বিড় করে বলছে। আমি বুঝতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে এসব। কেন হচ্ছে। কেবল সমস্ত দেহ জুড়ে বেশ কয়েকটা কোল্ড ওয়েব অনুভব করলাম। বুকের ভেতরের কেমন যে অস্থিরতা ছিল, তা যেন মূহুর্তে গায়েব হয়ে গেল। আমি প্রশান্তি অনুভব করলাম। আনন্দ অনুভব করলাম। নিজেকে ভীষণ পরিপূর্ণ অনুভব করলাম।
গল্পঃ প্রতিশ্রুতি
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
তাসফি আহমেদ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url