গল্পঃ রিক্সা রহস্য | লেখক তাসফি আহমেদ
গল্পঃ রিক্সা রহস্য | লেখক তাসফি আহমেদ
মোতালেব মিয়া ফিরে চাইলো, মেয়েটি এখনো বসে আছে উনার রিক্সায়। নামছে না। রাত গভীর। উনার ঘুম ঘুম লাগছে। এই অসময়ে কোত্থেকে যে এমন আপদ এসে বসলো! মোতালেব মিয়া বিরক্ত হলেন। মেয়েটি মস্ত একটা গোমটা দিয়ে বসে আছে। যেন আস্ত একটা নতুন বউ।
মোতালেব মিয়া তার বৃদ্ধ স্বরে বললেন,
-আম্মা আপনে কই যাবেন?
মেয়েটি জবাব দিলো না। মোতালেব আবার বললেন,
মেয়েটি এবার জবাব দেয়,
-আপনে আমারে আম্মা কইলেন কোন সাহসে?
খুবই দুর্বল, অথচ স্বরে কঠিনত্ব রেখে বলল মেয়েটি। মোতালেব হকচকিয়ে বলে,
-মাফ চাই। কই যামু কন। মেলা রাইত হইসে।
-সোজা যাবেন। বামে মোড় নিবেন। আমি কমুনে পরে ক্যাম্নে যাইবেন।
মোতালেব কথা বাড়ালেন না। উঠে বসলেন রিক্সায়। প্যাডেলে চাপ দিলেন। রিক্সা বেশ ধীর গতিতেই চলছে। সকালে যতোটা এনার্জি নিয়ে রিক্সা চালানো যায়, দিনের শেষ দিকে এতোটা পারা যায় না। রাতে তো শরীরটা আরো ধরে আসে। মোতালেব মিয়া কাশলেন। শীত পড়ছে। এই সামান্য শীতেই উনার যথেষ্ট কাশি ধরে গেল। কেবল যে কাশি তা নয়। সাথে বুকে কফ জমে একাকার। টান উঠে যায় মাঝে মাঝে। পেছন থেকে হঠাৎ আওয়াজ আসে,
-আপনের রিক্সায় লোক উঠে? সক্কলে তো এখন অটোতে যায়।
মোতালেব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-উঠে না গো। উঠলেও ভাড়া কম। অটোগো দাম মেলা। আইজকাইল কি এই রিক্সার দাম আছে কন!
মেয়েটি জবাব দেয় না আর। হঠাৎ নিরবতা। মোতালেব মিয়া এক মনে প্যাডেল চাপেন। রিক্সা চলে। মোতালেব মিয়া টানা টানা স্বরে বলে উঠেন,
-আপনের শাড়িডা মেলা সুন্দর। আমার বউরে কিন্না দিসিলাম এরুম একটা। মরিয়ম এতো আনন্দ পাইসিলো!
কথাটা বলে তিনি এতো মজা পেলেন! পাঁকা গোঁফ আর দাঁড়ির মাঝখানে উনার ঠোঁটের কোণায় এক প্রচন্ডরকম প্রশান্তির হাসি এসে জমলো। যেন হঠাৎই কোনো এক মুগ্ধকর দৃশ্য তার মন-দেয়ালে এসে ঝাপটে পড়েছে এবং তিনি তা দেখতে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়েছেন। মেয়েটি বলে,
-আপনের বউয়ের নাম মরিয়ম?
-হ।
-হে কি মেলা সুন্দরী?
-হ। শেখের বেটি আছিল। ভালা বংশ। দেমাগি মেয়ে। ক্যাম্নে যে আমার ঘরে আইলো। আমারে এতো নিজ ভাবতো!
-আপনে? আপনে কি ভাবতেন?
মোতালেব হাসতে থাকে। জবাব দেয় না। মেয়েটি আবার বলে,
-আপনের পুলাপান কয়ডা?
মোতালেব মিয়া জবাব দেয় না। সে এক মনে রিক্সা চালায়। মেয়েটি আবারো বলে,
-কয়ডা পুলাপান?
মোতালেব মিয়া রিক্সা চালায়। এবারও জবাব দেয় না। মেয়েটি আবারো বলে,
-জবাব দেন না ক্যান? পুলা কয়ডা? হেগো লগে আলাপ নাই? আপনেরে এই বুড়া বয়সে রিক্সা চালাইতে দেয় ক্যান?
মোতালেব মিয়া নিরুত্তর। যেন তিনি কথা বলতে ভুলে গেলেন। রিক্সাটা একটা গলিতে ঢুকলো। মোতালেব মিয়াকে রাস্তা বলে দিতে হলো না। তিনি যেন বশ হয়ে আছেন। নিজের অজান্তে কোনো এক অজানা গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছেন। তিনি কি তার ভাবনায় এতো বেশি ভাবুক হয়ে গেলেন? তিনি কি ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন?
-মোতালেব মিয়া?
মোতালেব মিয়া হঠাৎ থেমে যান। তার চোখ বড় হয়ে আসে। সে পেছন ফিরে চায়। কণ্ঠটা তার ভীষণ চেনা। তিনি ভাঙ্গা স্বরে বলে উঠে,
-মরিয়ম?
মেয়েটি এবার গোমটা সরায়। মোতালেব লক্ষ্য করেন যে তার স্ত্রী খুব সুন্দর করে সেজেগুজে, পরিপাটি হয়ে বসে আছে। যেন সদ্য বিবাহ করা বউ। মেয়েটি তাকিয়ে আছে মোতালেব মিয়ার দিকে। তার চোখে এক গাদা কষ্ট। তার সমস্ত বদনে থোকায় থোকায় কষ্ট জমে আছে। সে ধরে আসা স্বরে বলে,
-মোতালেব মিয়া, বড় পোলাডা কইসিলো না ফুন দিব? দিসিলো?
মোতালেব মিয়া কান্না করে দেয়। কান্না করতে করতে বলে,
-মরিয়ম? মরিয়ম তুমি ফিরা আইসো?
একটু থেমে আবার বলেন,
-আমি তোমারে বাঁচাইতে পারলাম না রে! তুমি আমারে একা ফেলাইয়া চইলা গেলা ক্যান?
মরিয়ম নামের মানুষটি আবারো বলে,
-ছোডো পোলারে আমার একটা গহনা দিসিলাম। হে কি ওডা ফিরায় দিসে? আমি কইসিলাম না তোমারে? ওরে যায়ে কইলেই তো দিয়া দিতো। তুমি নয়া রিক্সা কিন্না লইতা?
মোতালেব মিয়া হু হু করে কান্না করে দেয়। কান্না করতে করতে উনার কাশি এসে যায়। তিনি কাশি দিতে দিতে বলেন,
-আমি অগো সবডির দুয়ারে গেসিলাম। ভিক্ষা চাইসিলাম। কেউই আমারে একটা ক'ড়িও দিলো না। কেউই না। মরিয়ম আমি টেকার অভাবে চিকিৎসা করাইতে পারলাম না তোমার। আমি পাগল হইয়া গেসিলাম। আমি ভিক্ষা করতে দুবার ভাবি নাই। মনে আছে তোমারে হাসপাতালে রাইখা যে আইলাম, বিশ্বাস করো আমি ঘুরতে আসি নাই। আমি দোকানে দোকানে ভিক্ষা চাইসি। তোমার পোলাগো কাছে গেছি। হেরা আমারে ফিরায় দেয়। তাড়ায় দেন। আমারে য্যান চিনেই না। আমি রিক্সাডা বেচতে যাই। কেউ কিনতেও চায়না। আমি যখন ফিরা আসি, দেখি তুমি ঘুমায় আসো। নড়চড় নাই। কি শান্তির ঘুম! মরিয়ম তুমি আমারে লয়া গেলা না ক্যান তোমার লগে? আমি একা একা কি করুম এই দুনিয়ায়? ও মরিয়ম রেএএএএ।
মরিয়ম দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদে। তার চোখে জল। সে বলে,
-আপনে মেলা ভালো মানুষ। আমি আমার জীবনে আপনের মতোন ভালো মানুষ দেখি নাই। যাইবার আগে এই কথাডা খুব কইতে চাইসিলাম আপনেরে। কিন্তু আপনি তো ছিলেন না। আমার মেলা অভিমান হইসে। আমি যখন দেখসি উনি আইছিলো, ভাবসিলাম আপনে লগে থাকবেন। আপনের হাত ধইরা জান ত্যাগ দিমু। নাহ। আপনে আসেন নাই। আমি উনারে কইসিলাম, একটু থামতে। আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে। উনি অপেক্ষাও করসিলো। কিন্তু আপনি আহেন নাই। আমার মেলা অভিমান হইসে।
মোতালেব মিয়া হু হু করে কাঁদতেই থাকে। তার কান্নার গতি বাড়ে। মরিয়ম কিছুটা থেমে বলে,
-আপনেরে একটা সালাম দেওয়ারও সখ ছিলো। দিতো পারি নাই। এখন দিতাসি। সালামডা নিয়ে। আইচ্ছা?
মোতালেব চোখ তুলে দেখে তার স্ত্রী মরিয়মকে। সে কেঁদে উঠে বলে,
-মরিয়ম রেএএএ! আমারে তুমি ক্ষমা দিও গো।
-ছিহ। স্ত্রী কি স্বামীরে ক্ষমা দিতো পারে? কিযে কন? হুনেন, আমি সালাম দিলাম, আপনে নিয়েন। আমারে আবার যাইতো ওইবো। নিজের সেবা নিয়েন। নামাজ কাযা দিয়েন না। আল্লাহর উপর তাওয়াককুল। আসসেলামুআলাইকুম।
কথা গুলো শেষ করেই মরিয়ম নামের অবয়বটি আড়াল হয়ে যায়। হাওয়ায় মিশে যায় যেন। মোতালেব মিয়া পাগলের মতো চিৎকার করে উঠে।
"ও মরিয়ম রেএএএএএএ, যাইয়ো না গো! আমারে লইয়া যাও"
এতো তীব্র চিৎকার, কেউ শুনে না। কেউ দেখে না। দূরে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে। সে জিভ বের করে মোতালেব মিয়ার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখ ছলছলে। খানিক দূরেই তার চারটা ছানা খেলা করছে। সে ছলছল চোখে একবার পাগলাটে মোতালেব মিয়াকে দেখে, আরেকবার নিজের ছানাদের দেখে। সে ঠিক বুঝে উঠে না, এই দুনিয়ায় মানুষ হওয়া সহজ নাকি কুকুর? কুকুর হয়েও তার মাঝে আনুগত্যের ভাব রয়েছে। তার সামান্যও কি মানুষের মাঝে আছে?
গল্পঃ রিক্সা রহস্য
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
তাসফি আহমেদ
