Bangla Glopo: মেয়েটি ৫


 

Bangla Golpo: মেয়েটি 

(পঞ্চম পর্ব)

.

লারাকে দেখে আমাকে চমকাতে হলো। তাকে এভাবে দেখবো ঠিক ভাবিনি৷ নীল একটি শাড়ি পরে সাদা ধবধবে একটা পরী যেন এই ধরনীতে নেমে এসেছে। পরীর চোখ ভর্তি মায়া৷ কাজল কালো মায়া৷ কপালে ছোট্ট একটি কালো টিপ৷ এই বেশে মেয়েটাকে কী অসাধারণ লাগছে! মেয়েটাকে দেখেই আমার ভালো লেগে উঠল৷ অদ্ভুত একটা প্রশান্তির রেশ যেন আমার সমস্ত ছুঁয়ে গেল। লারা গাড়ির কাছে বেশ প্রসন্ন চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে দেখে আমার হকচকিয়ে যাওয়াটাও হয়তো সে আঁচ করতে পেরেছে৷ যার দরুন তার চেহারায় কেমন অমায়িক একটা হাসির রেশ এসে জড়ো হলো। মেয়েটা হয়তো আমাকে হকচকিয়ে দিয়ে বেশ আনন্দ পেয়েছে৷ আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। লারা খানিকটা এগিয়ে এসে আমার ডান পাশে দাঁড়ালো। অনায়াসে আমার ডান হাতটা ধরল। সাদিকের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,

-মিস্টার সাদিক! দায়িত্বটা এবার আমার উপর ছেড়ে দিন৷ আমি তাকে সামলে নিতে পারবো। 

মেয়েটা হাসছে৷ তার হাসি এতো ভালো লাগল আমার! আচ্ছা এই মেয়েটাকে আমার এতো ভালো লাগছে কেন? কেন তার প্রতি কেমন দূর্বলতা অনুভব হচ্ছে? এটা কি ন্যাচারাল? নাকি সত্যি আমার মাঝে কিছু ঘটছে৷ প্রেম জাতীয় কিছু! আশ্চর্য, এমন তো হওয়ার কথা নয়! লারা আমাকে গাড়িতে বসতে সাহায্য করলো। নিজে উঠে বসলো আমার পাশে। বসেই বলল,

-ড্রাইভার আঙ্কেল, চলেন! 

এতো মিস্টি করে বলল কথাটা! তার কোকিল কণ্ঠে আমি মুগ্ধ হলাম যেন। ড্রাইভার চাচাকে এতো সুন্দর করে ডাকা যায় তা হয়তো আমার জানা ছিল না৷ কে জানি। আমার তো অনেক কিছুই জানা থাকে না৷ গাড়ি গলির কাছ দিয়ে যেতেই আমি দেখলাম তমা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা আমায় অবাক করলো৷ আশ্চর্য ব্যাপার। এই মেয়েটা গাছের আড়ালে কী করছে? পরক্ষণে আমার মনে হলো সে আমাদের দূর থেকে দেখছে। লারা যে আমাকে ধরে গাড়িতে বসিয়েছে এই চিত্রটা নিশ্চয়ই সে দেখে ফেলেছে৷ হয়তো এটা দেখার জন্যেই সে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল। আমার চট করেই মন খারাপ হয়ে গেল। অস্বাভাবিক রকম মন খারাপ। কেন হলো তা বুঝতে পারছি না। আমার ইচ্ছে হলো এই মূহুর্তে বাসায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। আমার ভালো লাগছে না৷ ভালো না লাগলে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় আমার৷ 

.

আমরা একটা ক্যাফেতে বসলাম। লারা নানান ধরনের গল্প জুড়ে দিলো। তার গল্প অবশ্য আমার খারাপ লাগছিল না৷ তমার ব্যাপারটা ভুলে যেতে সাহায্য করছে। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো লারা মেয়েটা যে এতো কথা বলে সেটা আমি আগে বুঝতে পারিনি। তাকে দেখে মোটেও তেমন মনে হয় না৷ দেখে মনে হয় বেশ গম্ভীর একটা মেয়ে৷ অথচ তাকে জানতে শুরু করলেই দেখা যাবে সে অতটা গম্ভীর না। বেশ কথা বলতে জানে৷  আচ্ছা আমি কি লারাকে জানতে শুরু করেছি? তার ভেতরটা পড়তে শুরু করেছি? ভেতরটা কীভাবে পড়ে? এটা তো অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ সাদিক এসব ব্যাপার বলে বলে আমার মাথার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে৷ এখন সারাক্ষণ এসব মাথায় ঘোরে। মন টন পড়ার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে কারোরই নেই৷ এসব কথা বানানো। লারা চট করেই বলল, 

-এই? বোর হচ্ছো?

আমি হাসলাম। বললাম,

-কই? না তো! 

-কথা বলছো না যে?

-কী বলব বুঝতে পারছি না। 

-বুঝতে পারছো না নাকি বলতে চাচ্ছো না?

-নাহ৷ তেমন কিছুই নয়৷ আমি একটু কম কথা বলি। 

-তা অবশ্য আমার জানা আছে৷ আচ্ছা, তুমি কি আমার মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখছো? হাসপাতালে দেখা মেয়েটার সাথে এই মেয়েটার একদমই মিল পাচ্ছো না তাই না?

আমি এবারেও হাসলাম। বললাম,

-তা দেখতেই পাচ্ছি। গম্ভীর মেয়েটা কেমন প্রানবন্ত হয়েছে৷ জিন্স ছেড়ে শাড়ি পরেছে। এসব পরিবর্তন স্পষ্টই দেখা যায়৷ 

লারা হাসলো৷ লজ্জাময় হাসি৷ হাসতে হাসতে সে মুখের সামনের চুল গুলো অসাধারণ ভঙ্গিতে কানের কাছে গুঁজে দিয়েছে৷ কানের কাছে চুল গুঁজে দেওয়ার ভঙ্গিমাটাও যে এতো সুন্দর হয় তা আমার জানা ছিল না। আচ্ছা, কারো কাছে এই চিত্রটা এতো ভালো লাগে? নাকি কেবল আমার কাছেই লাগছে? আশ্চর্য ব্যাপার? এসব আমার ভালো লাগছে কেন? আমি চট করেই বললাম,

-লারা?

-বলো?

-তোমাকে সুন্দর লাগছে৷ 

-কেবল সুন্দর লাগছে? 

-না। অসাধারণ বললেও কম হবে। তুমি বুঝতে পারছো না আসলে। ক্যাফেতে যে ছেলেটাই আসছে সে তোমার দিকে কিছু সময়ের জন্যে হলেও তাকিয়ে থাকছে৷ তাদের পাশের মেয়ে গুলো এই নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছে। ব্যাপারটা তুমি লক্ষ্য করোনি৷ আমি করেছি। 

লারা হাসলো। কিছু বলল না৷ লজ্জায় সে লাল হয়ে আছে৷ মেয়েটাকে এই মূহুর্তে অন্য রকম লাগছে৷ একদম অন্যরকম। আমি বললাম,

-আচ্ছা আমরা কি এখানেই বসে থাকবো?

-নাহ৷ বাইরে যাবো৷ একটা পার্কে গেলে কেমন হয়? 

-পার্ক আমার তেমন পছন্দ নয়৷ 

-কেন?

-ওটা কপোত-কপোতীদের জন্যে৷ আমার অস্বস্তি লাগে৷ 

লারা মুচকি হাসি দিলো। বলল,

-আজ চলো। আমি পাশে আছি। অস্বস্তি লাগবে না৷ 

-তুমি থাকলে অস্বস্তি লাগবে না?

-না।

-কেন?

লারা অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো৷ বলল,

-জানি না। 

আমি বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে৷ কী বলবো ভেবে পেলাম না৷


ক্যাফে থেকে বের হয়ে আমরা একটা পার্কে আসলাম। বেঞ্চিটা একটু নিরিবিলি জায়গায়৷ আমরা সেখানে গিয়ে বসলাম। বসার অল্প কিছু পরেই লারা বলল,

-কেমন লাগছে?

-বুঝতে পারছি না৷ 

-বুঝতে পারছো না মানে?

-আমি আমার অনুভূতি গুলো ঠিক ধরতে পারি না৷ 

লারা খানিকটা হেসে বলল,

-অনুভূতিহীন নাকি?

-না৷ অতটা না। তবে কিছু ব্যাপারে আমি বুঝতে পারি না৷ এই যেমন প্রেম কিংবা কেউ আমাকে পছন্দ করছে এই ধরনের কিছু। কিংবা হঠাৎ কোথাও আসলে জায়গাটা কেমন, ভালো নাকি খারাপ তা নির্বাচন করতে পারি না।

-এমনটা কেন?

-বলতে পারছি না৷ আসলে ছোট বেলা থেকেই আমি অন্যরকম একটা পরিবেশে বড় হয়েছি। যেখানে পিতা-মাতার বশেষ কোনো ভূমিকাই ছিল না। দাদুর কাছে ছিলাম। ভালোবাসা যা পেয়েছি দাদুর কাছ থেকেই। তখন কেবল ভালোবাসা ছিল এক মাত্র দাদু আর বই৷ বইয়ের সাথেই বেড়ে উঠা৷ দাদু মারা যাবার পর একা একাই বড় হয়েছি৷ নিজের মতো করতে থাকতে শিখেছি।

-বই পড়েছো অথচ বলছো প্রেম সম্পর্কে জানো না?

আমি ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললাম,

-রোমান্টিক কোনো বই আমার এখনও পড়া হয়নি৷ 

-কে জানি৷ হয়তো অতিরিক্ত পড়াকু কিংবা অনির্দিষ্ট প্রেমে জড়াওনি বলেই তুমি আজ বুয়েটের স্টুডেন্ট৷ পড়ছোও বেশ আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে৷ 

আমি হাসলাম কেবল। লারা বলল,

-তবে তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না যে তোমার কোনো প্রেমিকা নেই৷ 

-তাই নাকি? 

-হ্যাঁ৷ তোমার মতো একটা ছেলেকে সিঙ্গেল পাওয়াটা দুষ্কর। আচ্ছা, তোমাদের ভার্সিটিতে এমন কেউ আছে যে তোমাকে পছন্দ করে?

-জানি না৷ আমি এইসব বুঝি না৷ আর কারো সাথে তেমন মিশিও না৷ 

-এখানেই তো ভুল করো৷ মানুষের সাথে মিশবা না কেন? অবশ্যই মিশবা৷ সবার সাথে একটা বন্ডিং রাখবা৷ 

-আমি পারি না৷ অস্বস্তি লাগে৷ 

লারা একটু শব্দ করে হাসলো৷ বলল,

-আচ্ছা ধরো তোমার ভীষণ ক্ষুদা লেগেছে৷ কিন্তু খাওয়ার জন্যে তোমার কাছে তেমন কিছুই নেই৷ যা আছে তা তোমার ভীষণ অপছন্দ৷ খেতে চাও না৷ এই মূহুর্তে তোমার বাইরে থেকে খাবার নিয়েও আসতে ইচ্ছে করছে না। শরীর অসম্ভব দূর্বল৷ তখন তুমি কী করবে?

আমি বললাম, 

-শরীর দূর্বল হলেও নিচে যাবো৷ যা অপছন্দ তা খাবো কেন? 

লারা এবারেও হাসলো। বলল,

-নিচে যাবে তো? 

-হ্যাঁ৷ 

-কেন যাবে?

-আমার ক্ষুদা পেয়েছে। তাই৷ 

-এটাও তো তোমার এক প্রকার প্রয়োজন তাই না?

-হ্যাঁ। 

-এই তো! এই প্রয়োজন বলেই তোমাকে নিচে যেতে হচ্ছে৷ অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও যেতে হচ্ছে৷ মানুষের সাথে মেশাটাও তোমার এক প্রকার প্রয়োজন৷ অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তোমাকে তাদের সাথে মিশতে হবে৷ তবেই তো তুমি মানুষকে বুঝতে শিখবে। জানতে শিখবে৷ তাই না?

আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম। লারা বলল,

-আমার মনে হয় একা একা থাকার কারণেই তোমার এমন হয়েছে৷ অনুভূতি ভোঁতা হয়ে আছে। মেয়েদের সাথে তেমন মিশো না বোধহয় তাই না?

-হ্যাঁ৷ কারো সাথেই মেশা হয় না৷ এক মাত্র মেয়ে বন্ধু হিসেবে তমাই আছে৷ 

-ওই দিনের মেয়েটা?

-হ্যাঁ৷ 

-উনাকে সকালে দেখলাম বেশ রেগেমেগে বের হলেন৷

আমি মৃদু স্বরে বললাম,

-তার রাগটা আমার উপরই৷

-তোমার উপর? কেন?

আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে বললাম, 

-ও নাকি আমাকে পছন্দ করে৷ 

লারা হাসলো। বলল,

-আমি উনাকে সেদিন দেখেই টের পেয়েছি। 

-তুমি দেখেই টের পেয়েছো?

-হ্যাঁ৷ কেন তুমি বুঝতে পারোনি?

আমি এবারেও কিছুটা সময় নীরব থাকলাম। বললাম,

-আমি তাকে একজন বন্ধুর মতোই ভেবেছিলাম৷ তার প্রতি আমার সকল অনুভূতি একজন বন্ধুর মতোই৷ সে যে আমাকে পছন্দ করে সেটা আমি বুঝতেই পারিনি৷ আমার একবার মনে হয়নি সে আমার হৃদয় ছুঁয়েছে৷ আমি তাকে কখনই অন্যভাবে দেখিনি।

-আমার কী মনে হয় জানো?

-কী মনে হয়? 

-আমার মনে হয় তোমার অনুভূতিরা দিকবিদিক হয়ে আছে৷ কোনো কিছুই স্থির করতে পারছে না৷ তুমি বুঝতে পারছো না তোমার মনের কী প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজন। 

-হতে পারে৷ 

-তোমার নির্দিষ্ট একটা রুটিন আছে৷ তুমি কখনই রুটিনের বাইরে যাওয়া না তাই না?

-হ্যাঁ। তা ঠিক৷ 

-শোনো, সব সময় রুটিন অনুযায়ী চলা ঠিক না৷ মাঝে মাঝে রুটিন ভাঙ্গতে হয়৷ নিয়মকে অনিয়ম করতে হয়৷ ভিন্ন কিছু করতে হয়৷ 

-চেষ্টা করছি৷ 

-গুড৷ তোমার মতো একজন মানুষের নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতর থাকা উচিৎ নয়৷ এতে তোমার অনুভূতি আরো অস্পষ্ট হয়ে যাবে৷ বুঝতে পেরেছো? 

-পেরেছি৷

-এখন বলো তোমার কেমন লাগছে। 

-ভালো লাগছে৷ 

-সত্যি সত্যি ভালো লাগছে?

-হ্যাঁ। 

-আচ্ছা বলতো আমাকে তোমার কেমন লাগে?

-ভালো লাগে৷ 

-কেমন ভালো? 

-জানি না। 

-একটা সত্যি কথা বলবে?

-বলব।

-হাসপাতাল থেকে কেন চলে এলে?

-আমার ওখানে ভালো লাগছিল না৷ 

-সত্যি করে বলো!

-সত্যি করেই বলছি৷ 

-তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি অন্য কোনো কারণে চলে এসেছো?

-তোমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?

-বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে৷ একটা ছেলে কী করে আমাকে এভয়েড করে হাসপাতাল থেকে চলে আসবে? আমি এতো করে বলার পরেও সে থাকলো না?

আমি হাসলাম। বললাম,

-ইগোতে লেগেছে?

-অবশ্যই৷ তুমিই বলো। এটা ইগোতে লাগার মতো না?

-হ্যাঁ। ইগোতে লাগার মতো৷ 

-কেন এলে?

-বলেছি তো আমার ভালো লাগছিল না৷

চট করেই লারার চেহারা বদলে গেল। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এলো৷ বলল, 

-উহু। তুমি মিথ্যা বলছো৷ তোমার চোখ সেটা বলে দিচ্ছে৷ 

-চোখ পড়তে পারো নাকি?

-পারি। তবে সবার না৷ যারা খুব প্রিয় তাদের চোখ পড়া যায়৷ 

-আমি কি তোমার খুব প্রিয়?

লারা মাথা নিচু করে বলল,

-জানি না৷ 

-আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানো?

-কী মনে হচ্ছে?

-তুমিও অনেকটা নির্বোধ৷ অনুভূতিহীন। অনেক কিছুই জানো না৷ বুঝতে পারো না। 

লারা ফ্যাকাসে হাসি দিলো৷ বলল,

-ভুল বলেছো৷ তুমি নিজেই আসলে ঠিক ধরতে পারছো না। তুমি বুঝতে পারছো না সকল "জানি না" আসলেই জানি না নয়৷ সকল "বুঝতে না পারা" আসলেই বুঝতে না পারা নয়৷ 

-তাহলে আমাকে বুঝিয়ে বলো সেটা?

-এসব ব্যাপার এতো সহজে বোঝানো যায় না। খুব কম্পলিকেটেড। তাসফি, তুমি আসলেই অনুভূতিহীন৷ আমি তোমাকে সেই প্রথম থেকে তুমি তুমি করে বলছি৷ আপনি থেকে চট করেই তুমিতে চলে আসা৷ ব্যাপারটা তুমি ধরতে পারোনি। 

আমি চুপ করে থাকলাম৷ আমার কী করা উচিৎ বুঝতে পারলাম না৷ অল্প কিছু পর বললাম,

-লারা?

তার মলিন জবাব,

-হু?

-আমার এখন কী করা উচিৎ? 

-অনিয়ম করো৷ রুটিন ভাঙ্গো। 

-তাহলে কি আমার অনুভূতি সতেজ হবে?

-বলতে পারছি না।

-স্রষ্ঠা আমাকে এমন অদ্ভুত কেন বানালো?

-তুমি অদ্ভুত হয়ে গিয়েছো৷ সংস্পর্শের অভাবে৷

-অথচ আমি এতোটাও সংস্পর্শহীনও ছিলাম না৷ 

-ছিলে৷ লোকালয়ে থাকলেও আলাদা থেকেছো তুমি। কখনও মেসে উঠোনি৷ সাদিকের সাথে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকো৷ দু'জন দু'রুমে। সাদিক তোমার সবচে কাছের বন্ধু৷ তবুও আমার কেন জানি মনে হয় তার সাথে বন্ডিংটা এতোটা স্ট্রং নয়৷ 

-আমার তো এমন কখনই মনে হয়নি?

-হয়নি। হবে৷ যখন দেখবে যে, এক সময় যে অল্প ক'জন তোমার ছিল, সময়ের দরুণ তারা তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে তখন তুমি বেশ বুঝতে পারবে৷ 

-যেখানে আমার পিতা-মাতা আমাকে রেখে চলে গিয়েছেন, সেখানে অন্য কারোর আমার সঙ্গ ত্যাগ করাটা আমায় অতোটা স্পর্শ করবে বলে মনে হয় না। 

-করবে৷ যখন আপন বিয়োগ ঘটবে তখন বুঝতে পারবে৷ তোমার বাবা মা তোমায় ছেড়ে গিয়েছেন তাতে তোমার দুঃখবোধ হয়নি?

-হয়েছে।

-এখনও হয়?

-হয়৷ তবে তেমন বিশেষ নয়৷ 

-ইদানীং কেঁদেছো? 

-নাহ৷ দাদুর মৃত্যুতেও কাঁদতে পারিনি৷ 

-তোমার জীবনে খুব কম মানুষ এসেছে তাই না?

-হ্যাঁ। একদমই কম। 

-হাসপাতালে একটা মেয়ের কথা বলেছিলে। কগন নাকি কী না?

-সে কথা এখনও মনে আছে? 

-মেয়েদের এমন অনেক কিছুই মনে থেকে যায়৷ মেয়েটার কথা বলো!

-তাকে আমি তেমন চিনি না৷ একদিন হুট করেই বলল, 'আপনার কাঠগোলাপ এতো পছন্দ কেন?' আমি আচমকা তার প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলাম। কী বলবো ভেবে পেলাম না৷ আমাকে এমন অবস্থায় দেখে হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়েছিল উনার।

-উনার সাথে পরিচয় কীভাবে হয়েছে?

-বাসে৷ পাশাপাশি সিটে বসে ছিলাম৷ তখনই সে জানতে চাইলো কাঠগোলাপের ব্যাপারে৷ 

-সে তোমাকে আগ থেকে চিনে নাকি? 

-সেই সম্পর্কে সে কিছুই বলেনি৷ এমনকি তার চেহারা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি৷

-কী বলো?

-হ্যাঁ৷ এক সপ্তাহের পরিচয়। প্রতিদিনই আমাদের দেখা হতো৷ ইভেন শুক্রবারেও হয়েছিল। দেখা হলেই সে নানান কিছু জানতে চাইতো৷ আমি কেবল উত্তর দিয়ে যেতাম। 

-কিছু জানতে চাওনি তার সম্পর্কে? 

-চেয়েছি৷ সে বলেনি৷ 

-মানে কী?

-কে জানি। অদ্ভুত মেয়ে৷ শেষ দিন আমায় বলল, আমি অনুভূতিহীন। মানুষকে বুঝতে পারি না৷ আমি নাকি তাকে বুঝিনি৷ একটুও না৷ আমার পরিবর্তন হওয়া উচিৎ। আরো কতো কিছু বলল! আমি কেবল শুনে গেলাম। কিছুই বলতে পারলাম না৷ মনে মনে তখন প্রচণ্ডরকম হতাশ আমি৷ দুঃখে কষ্টে যায় যায় অবস্থা আমার। বারবার মনে হতো আমি এমন কেন হয়েছি৷ খুব ডিপ্রেশনে ভুগতাম৷ ওই মেয়েটার সাথে সপ্তমত দিনের পর আর দেখা হয়নি৷ 

-আর দেখা হয়নি?

-নাহ৷ 

-কী বলো?

-সত্যি বলছি। 

-তাকে খোঁজার চেষ্টাও করোনি?

-উহু৷ করিনি। 

লারার চেহারা সহজ হয়েছে৷ সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ৷ এমন কিছুও এই পৃথিবীতে ঘটতে পারে বলে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি বললাম,

-ওই সময়টা আমার জন্যে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল৷ আমি তখন অধিক ডিপ্রেশনে ছিলাম। 

-মেয়েটার কারণে?

-উহু৷ তার বলে যাওয়া কথা গুলোর কারণে। কেউই কখনও আমাকে এভাবে বলেনি৷ 

আমার একটু মন খারাপ হলো৷ এই কথাটা মনে হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি অন্যদিকে তাকালাম। হঠাৎই ভীষণ চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করছে৷ লারা বলল,

-তাসফি?

-হু?

-একটা কথা বলি শোনো।

-বলো?

-মানুষ পরিবর্তনশীল৷ তা তো তুমি বিশ্বাস করো তাই না?

-হ্যাঁ৷ করি৷ 

-তাহলে নিজের পরিবর্তনের ব্যাপারটা বিশ্বাস করছো না কেন? কেন মানছো না যে তোমার মাঝে পরিবর্তন সম্ভব?

-আমার তেমনটা মনে হয় না৷ 

-অবশ্যই হবে৷ তুমি অবশ্যই পরিবর্তন হবে৷ তোমাকে হাসপাতালে আমি যেমন দেখেছি তুমি এখন আর তেমন নেই৷ হাসপাতালে তোমাকে আমার বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে তুমি বেশ অস্থির। নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছো। নিজের উপর থেকে কখনই বিশ্বাস হারাবে না৷ হারালেই হতাশা তোমায় কাবু করে নিবে। 

-আমি কেন জানি তা পারছি না৷ নিজের উপর বিশ্বাসটা আর আসে না৷ 

লারা আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো৷ অস্থির স্বরে বলল,

-তুমি হঠাৎ মন মরা হয়ে গেলে কেন?

-তমার কথা মনে পড়েছে। 

-উনার কথা মনে পড়লে তোমার মন খারাপ হয়?

-এখন হচ্ছে।

-কেন?

-জানি না। হয়তো মেয়েটা আমায় ভুল বুঝেছে এই কারণে৷ 

-উনি তোমাকে ভুল বুঝেছেন?

-হ্যাঁ। 

-কীভাবে?

-এই যে সে আমাকে ভালোবাসে৷ আমি তাকে বাসি না৷ সে ভাবে আমি এসব ইচ্ছে করেই করছি৷ তার চেহারার কালো দাগটার জন্যে তাকে পছন্দ করছি না৷ অথচ সে জানে না তাকে অমনই আমার বেশ লাগে৷ 

-একটা কথা বলো তো?

-কী কথা?

-তুমি কি শিওর যে তুমি উনাকে ভালোবাসো না?

-শিওর কীভাবে হবো?

-আচ্ছা থাক৷ শিওর হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ তোমার কি মন ভালো হয়েছে?

-উহু৷ 

-বাসায় চলে যাবে?

-হ্যাঁ। 

-আচ্ছা, আসো। 


হঠাৎই তমার কারণে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ আসার সময় মেয়েটাকে গাছে আড়লে দেখলাম। এই দেখাটাই বোধহয় অন্যায় হয়েছে৷ তখন একবার মন খারাপ হয়েছিল৷ এখনও আবার হচ্ছে৷ এই ব্যাপারটা হৃদয়ে গেঁথে গেলে প্রায়ই এমন ঘটবে। তখন দেখা যাবে মন খারাপের কারণ হবে তমা৷ কিন্তু আমি তেমনটা চাই না৷ কে চাই না তাও বুঝতে পারছি না। এদিকে তার ব্যাপারটা ভুলে থাকতেও পারছি না৷ এটা আবার কোন মসিবত শুরু হলো কে জানে? 

লারা আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। নিজে এগিয়ে আসলো আমাকে ধরতে। যদিও ধরার তেমন বিশেষ প্রয়োজন নেই৷ আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো। বাসার সামনে দেখলাম দুটো চকচকে কার দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এই বাসাতেই এসেছে৷ আমি তেমন গায়ে মাখলাম না৷ কিছুদূর যেতেই সাদিক এগিয়ে এলো৷ সে আমায় ধরে লারার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হেসে বলল,

-এতোক্ষণ পর্যন্ত আমার এই বোরিং বন্ধুটাকে সামলে রাখার জন্যে ধন্যবাদ৷ এবার দায়িত্বটা আমার কাঁধে হস্তান্তর করলে খুশি হবো!

লারা চট করেই হেসে ফেলল। কী অমায়িক হাসি তার৷ অথচ এই মূহুর্তে তার হাসিটা আমার তেমন ভালো লাগলো না। কেমন জানি অস্বস্তি লাগলো। লারা হাসি মুখে বিদায় নিলো৷ যোগাযোগ করবে জানালো৷ সাদিক আমায় নিয়ে লিফটের কাছে এলো। লিফটের কাছে যেতেই সে মৃদুস্বরে বলল,

-তমাকে দেখতে এসেছে৷ ছেলেরা নাকি বেশ হাইক্লাস ফ্যামিলির লোক! তমার তো কপাল খুলে গেল রে!

কথাটা বলেই কেমন করে হাসলো সাদিক৷ আমার বড় অস্বস্তি লাগলো৷ তবে তা প্রকাশ করলাম না৷ বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার অদ্ভুত কারণে ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগলে আমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়৷ শুয়ে থাকলেই দ্রুত ঘুম এসে যায় আমার। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম। 

.

পরবর্তি পর্বে সমাপ্ত

.

ভুলত্রুটি মার্জনীয় 

-তাসফি আহমেদ।


আর দুই পর্ব আছে। পড়বেন সেগুলো? আচ্ছা লিংক দিচ্ছি নিচে। 

ষষ্ঠ পর্ব

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url