Bangla Golpo: মেয়েটি ৪
Bangla Golpo: মেয়েটি
(চতুর্থ পর্ব)
.
রাত বারোটায় এমন একটা আলোচনায় বসার ইচ্ছে আমার কোনো কালেই ছিল না৷ তবুও আমাকে সাদিকের সাথে বসতে হচ্ছে৷ ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন৷ তমার আচার-ব্যাবহার আমার ঠিক ভালো ঠেকছে না৷ মেয়েটা আমার সাথে এমন করছে কেন? আমি সেই ব্যাপারটাই ঠিক বুঝতে পারছি না৷ এ জন্যে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। মনে অস্বস্তি নিয়ে প্রশান্তি পাওয়া যায় না। আমি প্রশান্তি পাচ্ছি না৷ প্রশান্তি না পেলে ঘুম হবে না৷ আমি নিশ্চিত আমার আজ ঘুম হবে না৷ মূলত সেই কারণেই সাদিকের সাথে আলোচনায় বসা৷ আলোচনায় বসা বলতে আয়োজন করে তেমন কোনো আলোচনা নয়। সাদিক নিজেই আমার রুমে এসেছে। আমার সাথে বসে ফোন টিপছিল৷ কিছুক্ষণ পর তার প্রিয়জনের কল এলো। সে ফোন ধরে তার সাথে মিষ্টি আলাপ শুরু করলো৷ সাদিক আমার সামনেই নীরার সাথে কথা বলছে। বলে। সে এই ব্যাপারটায় লজ্জা পায় না৷ নীরার সাথে বিশেষ কথা না থাকলে সে প্রায়ই আমার সামনে নীরার সাথে আলাপ চালিয়ে যায়৷ আমিই বরং সরে যাই। কারো একান্ত আলাপ শোনার ইচ্ছে আমার নেই। তবে তার এমন আচরণের মানেটাও আমি ঠিক বুঝি না। সে আমার সামনে কথা বলে কী বোঝাতে চায়? তার গার্লফ্রেন্ড আছে এটা? কে জানি৷
যাই হোক। সাদিক দ্রুতই তার প্রেমালাপ সারলো। আমার পাশে বসে এটা সেটা জানতে চাইলো৷ আমি সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাকে বললাম,
-তোকে একটা কথা বলার ছিল।
সাদিক ফোন টিপতে টিপতে বলল,
-কী কথা?
-যা বলছি একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবি এবং আমাকে সঠিক উত্তরটা দিবি।
সাদিক মনোযোগী ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকালো,
-আচ্ছা, বল।
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-একটা মেয়ে আর একটা ছেলে, দুজনেই বেশ ভালো বন্ধু৷ কেবল ভালো বন্ধু৷ তাদের মাঝে অন্যকিছু মোটেও নেই৷ কিসব প্রেম ট্রেম এসব৷ কিন্তু ইদানীং একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে৷ ছেলেটা অন্য কোনো মেয়ের কথা বললে কিংবা কোনো মেয়ের সাথে কথা বললেই মেয়েটা কেমন রেগে যায়৷ মুখ কালো করে ফেলে। এমন একটা ভাব করে যেন তার জগৎ-সংসার উল্টে গিয়েছে। মেয়েটা এমনটা কেন করছে বলতে পারবি?
সাদিক চট করেই জবাব দিলো না৷ সে হাসতে থাকলো। এমন ভাবে হাসছে যেন আমি খুব হাসির কোনো কৌতুক বলেছি। আশ্চর্য ব্যাপার! এখানে হাসির কী আছে? আমি খুব কঠিন দৃষ্টিতে তাকালাম সাদিকের দিকে। সাদিক নিজেকে সামলে নিলো৷ তবে তার মুখ থেকে হাসির রেশটা গেল না৷ সে বলল,
-মাঝে মাঝে তোকে মুভি কিংবা নাটক দেখতে বলি কেন জানিস? কারণ সেখানে এমন কিছু কাহিনী ঘটে এবং কেন ঘটে তার উত্তর পাওয়া যায়৷ কিন্তু তোকে আজ পর্যন্ত আমি কোনো নাটক ছবি দেখাতে পারিনি। পারলে আজ অন্তত এই কথাটা তুই বলতি না৷
আমি যথার্থ অবাক হলাম। এই কথার সাথে নাটক-সিনেমা কীভাবে যুক্ত সেটা বুঝতে পারলাম না৷ হ্যাঁ এটা সত্য যে আমি এসব দেখি না। আমার এসবে কোনো টানই কাজ করে না। আমি ঘুরতে পছন্দ করি। পড়তে পছন্দ করি। মুভি দেখার অভ্যাস আমার কোনো কালেই ছিল না৷ আমি বললাম,
-তোকে এর কারণ বলতে বলেছি। আমার হিস্ট্রি বলতে বলিনি।
সাদিক খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-আরে বেটা এটা কে না বুঝে? এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে এটা একটা সিম্পল ক্যামিস্ট্রি। মেয়েটি ছেলেটার মুখে অন্য মেয়ের নাম শুনতে পছন্দ করছে না কিংবা অন্য মেয়েকে ছেলেটির পাশে পছন্দ করছে না এর মানে এই যে মেয়েটি ছেলেটিকে পছন্দ করে৷ পছন্দের মানুষের পাশে অন্য কাউকে কেউই পছন্দ করে না৷ তার ঈর্ষা হয়। রাগ হয়। তার ভয় হয় যে মানুষটি অন্য কারো হয়ে যায় কি না! তাকে ছেড়ে চলে যায় কিনা। সে ভয়ে থাকে। এ জন্যে তাকে দেখলে মনে হয় তার জগৎ সংসার উল্টে গিয়েছে৷
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। এই জগতে প্রেম-ভালোবাসা আমায় তেমন স্পর্শ করেনি৷ ছোটবেলা থেকেই দূরে থেকে বড় হয়েছি। বাবা মায়ের ভালোবাসা পাইনি। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকা কালিন সময়ে বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়৷ তাদের দু'জনের খুশির জন্যে কোরবানি হতে হয় আমাকে। এক সময় টানাটানি শুরু হয় আমার দায়িত্ব নেওয়া নিয়ে৷ কখন কোথায় থাকব এসব নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়৷ বাবা বলেন তাঁর কাছে থাকতে হবে৷ মা বলেন মায়ের কাছে। অথচ দু'জনে চাইলেই আমি দু'জনের কাছেই থাকতে পারতাম। কিন্তু তারা এমনটা চায়নি৷ নিজেদের দিকটা ভেবেছে। তাই আলাদা হয়ে গিয়েছে। আমিও আমার দিকটা ভেবে নেই৷ চলে আসি দাদুর কাছে৷ সেখানেই বড় হই। কে জানি কিসের জোরে সেই সময়ে আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দাদু আমাকে বেশি ভালোবাসতেন আমি হয়তো সেটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি কিংবা হয়তো ভালোবাসা পাবার তৃষ্ণায় আমি তাঁর কাছে গিয়ে উঠেছি। আবার এও হতে পারে যে বাবা মায়ের উপর সুপ্ত একটা রাগ ছিল আমার। তাইই তাদের ত্যাগ করা।
আমার নির্দিষ্ট ব্যাংক একাউন্ট আছে৷ সেই একাউন্টে প্রতি মাসে টাকা চলে আসে। বাবা মায়ের টাকার অভাব নেই। দু'জনেই দূর থেকে টাকা পাঠাতে পারেন অথচ কাছে এসে খোঁজ নিতে পারেন না৷ যাই হোক, ঠিক এসব কারণে কী না জানি না তবে আমার মাঝে কোনো কিছু নিয়ে বিশেষ কোনো অনুভূতি হতো না৷ আমার মন যেটাকে ভালো বুঝতো সেটাই করতাম। আমাকে হাজার কথা বলা হলেও আমি কখনই আমার মনের বিপরীতে যেতে পারতাম না৷ মন যদি খারাপ পথ বেছে নিতো তবে আমি খারাপ পথেই যেতাম। লোকজন নানান কথা বললেও আমি সেই পথ ছাড়তে পারতাম না৷ আমার জীবন যাত্রা কিছুটা মন কেন্দ্রিয়৷ মনের উপর বিশেষ জোর দেই না আমি৷ আমার কখনই মনে হয়নি তমা আমার অতি প্রিয় কেউ৷ হ্যাঁ, তাকে আমি পছন্দ করি৷ তার মায়াময় চেহারাও আমার বেশ ভালো লাগে। কিন্তু সেসব মোটেও প্রেম-ভালোবাসার ইঙ্গিত নয়৷ এসব প্রকৃতিগতই। একটা ছেলে ও মেয়েরা মধ্যকার সাধারণ অনুভূতি। কোনো বিশেষ লক্ষ্যন নয়। সে আমার অত্যন্ত কাছের একজন বন্ধু৷ সেই জন্যে তার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিও তেমন ছিল। তাকে নিয়ে আমার বিশেষ কোনো অনুভূতি নেই৷ কিন্তু তার মাঝে আমাকে নিয়ে বিশেষ কিছু আছে হয়তো। সাদিকের কথাটা যদি সত্য হয় তবে মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে। কিংবা ভালোবাসে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? তাকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ সত্যি বলতে ভালোবাসার অনুভূতিটা কী তা ঠিক আমি জানি না৷ আমার জীবনে আমি কোনো রোমান্টিক বই পড়িনি৷ ভূতের এবং অত্যাধিক রহস্যের বই পড়া আমার৷ আমার লাইব্রেরী ভর্তি সব ভৌতিক আর রহস্যের উপন্যাস৷ আমি ডিটেকটিভ বই পড়তে বেশি পছন্দ করি৷ এসব বইতে প্রেম-ভালোবাসার তেমন কোনো বিচরণ নেই৷ থাকলেও সেসব আমার মাঝে তেমন প্রভাব ফেলেনি৷ আমার এই অভ্যাসটা এসেছে আমার দাদু থেকে৷ তিনি ডিটেকটিভ বই পড়তেন বেশি৷ তার কালেকশনে এগুলো বেশি ছিল৷ তিনি আমাকে প্রথম তিন গোয়েন্দা পড়তে দেন৷ প্রথম বইটা হাতে নিয়েই আমি পাগলের মতো সেটা গিলে খেয়েছি। আমার মনে হয়েছে এরচে আনন্দের জিনিস আর কিছুই হতে পারে না৷ বইটা পড়ছি আর মনে হচ্ছে আমার চারপাশে যেন এমন কিছুই ঘটছে৷ কিশোর, মুসা, রবিন এরা কে কি করছে সব যেন আমার চোখের সামনে ঘটছে৷ আমি দেখছি। আনন্দ পাচ্ছি৷ সেই থেকে শুরু আমার বই পড়া৷ সেবা প্রকাশনির অধিক বই আমার পড়া শেষ৷ এছাড়া দেশি এবং বিদেশি ভৌতিক ও গোয়েন্দা বইয়ের অভাব নেই আমার কাছে৷ হুমায়ূন স্যারের কয়েকটা বই অবশ্য আমি কিনেছি। সেগুলো রোমান্টিক বই বলে জানিয়েছে সাদিক। কিন্তু কেন জানি আমি সেগুলো পড়তে পারছি না৷ শুরু করবো করবো করেও করা হচ্ছে না৷ সাদিক চট করেই বলল,
-এই তাসফি?
আমি খানিকটা কেঁপে উঠলাম। ঘোর ভাঙ্গল যেন। ভাবনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। সাদিক আবার বলল,
-কী ব্যাপার? কী এমন ভাবছিস?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-কিছু না৷
সাদিক আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়৷ বলে,
-তাসফি?
-হু।
-তুই যে মেয়েটির কথা বললি সেই মেয়েটি তমা নয়তো?
আমি তার দিকে সহজ ভঙ্গিতে তাকালাম৷ সহজ ভাবেই বললাম,
-হ্যাঁ।
-তমা এমন করেছে?
-হু৷
-ঘটিনা খুলে বল তো?
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-কাল সে আমাকে নিয়ে বের হলো৷ তিনশো ফিটের দিকে গেল। সেখান দেখা লারার সাথে৷ লারাকে দেখতেই মেয়েটার মুখ কালো হয়ে গেল৷ তখন থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে আমার সাথে একটু কথাও বলেনি। কেবল রাগি একটা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। বিশ্বাস করবি না আমি কখনই ওর চেহারায় এতোটা রাগ দেখিনি৷
সাদিক যেন খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল৷ বলল,
-বাহ! তোর জীবনেও তাহলে প্রেম চলে এলো?
-প্রেম? কই? কখন এলো?
-এইযে তমা! তমা এমন করেছে কেন জানিস? কারণ সে তোকে ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে৷ যার জন্যেই সে তোর পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না৷
-তো এখানে আমি কী করবো?
সাদিক অবাক স্বরে বলল,
-কী করবি মানে? তুই কিছু ফিল করছিস না?
-কী ফিল করবো?
-প্রেম ভালোবাসা? কিংবা তার জন্যে স্পেশাল কোনো অনুভূতি?
-সেগুলো কীভাবে ফিল করে?
সাদিক খানিকটা বিরক্ত হলো যেন৷ তাও নিজেকে সংযত রেখে বলল,
-এই ধর তার সাথে হাঁটতে তোর ভালো লাগে, অন্য রকম অনুভূতি হয়, তার ছোঁয়ায় তোর গা কেঁপে উঠে, তাকে দেখার জন্যে তোর মাঝে কেমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, কয়েকদিন না দেখে তুই থাকতে পারিস না এসব৷ মানে স্পেশাল কিছু অনুভব করিস তাকে নিয়ে?
-আমি বলতে পারছি না৷ তবে কাল সে আমার হাত ধরেছিল৷ আমার সমস্ত গা তখন শিউরে উঠেছিল৷ শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল সমস্ত শরীর বেয়ে৷
সাদিকের মুখ উজ্জ্বল করে বলল,
-গুড৷ এইতো প্রেম অনুভূতি জেগেছে৷
-এটাই কি প্রেম অনুভূতি?
-হ্যাঁ কিছুটা৷
-কিন্তু এটা তো অন্য কারণেও হতে পারে।
-অন্য কী কারণ?
-বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমাদের সব সময়েই একটা আকর্ষণ থাকে। যেটা স্রষ্টা প্রদত্ত৷ আমার জীবনে এই পর্যন্ত কোনো মেয়ে আমার হাত এভাবে ধরেনি৷ এটা সম্পূর্ণই আমার জন্যে প্রথম। প্রথম বলে আমার এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ আর তাছাড়া...
-তাছাড়া?
-আমি হাসপাতালে যে কয়দিন ছিলাম ততদিন তমার কথা আমার তেমন বিশেষ মনে পড়েনি। পড়লেও তার সাথে যোগাযোগ করার তেমন আগ্রহ জাগেনি৷
সাদিক কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো। আমার মাথা ভার ভার লাগছে। এই ব্যাপার গুলো অত্যন্ত জটিল বলেই আমি কখনই এসব নিয়ে ভাবি না৷ আমি চট করেই বললাম,
-একটা কথা মনে পড়েছে।
-কী কথা?
-হাসপাতালে আমি লারাকে কিছু কথা বলেছিলাম। প্রেম সম্পর্কিত। সেই কথা গুলো আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে৷ ওখানকার গোটা মূহুর্তটাই আমার স্পষ্ট মনে আছে। কেন আছে তা জানি না।
সাদিক অবাক হয়ে দেখলো আমায়। অবাক স্বরে বলল,
-তুই প্রেম সম্পর্কিত কথা বলেছিস?
-হ্যাঁ৷
-অবাক করলি৷ তুই প্রেম সম্পর্কিত কথাও বলতে পারিস?
-কে জানি। তখন তোর কিছু কথা মনে পড়েছিল। সে গুলো বলে ফেললাম।
-কোন কথা গুলো?
-ওই যে প্রেমিক-প্রেমিকা চুজ করার মতো কিছু না৷ এটা সম্পূর্ণই অন্তর জনিত ব্যাপার৷ মন যেখানে সায় দিবে সেখানে প্রেম হবে৷ যে মানুষটিকে দেখে মনে হবে এর সাথে সারাজীবন থাকা সম্ভব তাকেই যেন স্বামী হিসেবে বরন করে নেওয়া হয়৷
সাদিক কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। আমি বললাম,
-আমি তাকে শাড়ি পরতে বলেছি। নীল শাড়ি৷ চোখে কাজল দিতে বলেছি৷ কপালে ছোট্ট একটি টিপ। সেই সময়ে আমি এই মেয়েটিকে নীল শাড়ির বেশে কল্পনা করে ফেলেছি৷ আমার তখন অত্যন্ত ভালো লেগেছে তাকে।
-লারাকে তোর পছন্দ হয়েছে?
-ঠিক বলতে পারছি না৷
-ঠিক ভাবে কী বলতে পারবি তুই?
-আমি এসব কিছুই বুঝতে পারছি না৷
-বুঝা বুঝি বাদ দে৷ তোর দ্বারা কখনই প্রেম ট্রেম হবে না৷ এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
-বাদ দিতেই তো আলোচনা করতে বসেছি৷ আমারও এসব ভালো লাগে না৷
সাদিক খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-তমার হয়তো তোকে ভালো লেগেছে৷ পছন্দ করে৷ ওয়ান সাইড লাভ৷ তোর তাকে পছন্দ না হতেই পারে৷ এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এখানে তোর প্যানিক হওয়া কিছু নেই৷ তুই ঘুমিয়ে পড়।
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ থাকলাম। সাদিকের ফোন এলো। সে আমার রুম থেকে চলে গেল। তার যাওয়ার অল্প কিছু পরেই আমার ফোনে কল এলো। অপরিচিত নাম্বার৷ কল ধরে বললাম,
-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
ওপাশ থেকে মেয়েলি স্বর ভেসে এলো,
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। মিস্টার আহমেদ বলছেন?
-কোন মিস্টার আহমেদকে চাচ্ছেন আপনি?
-হাত পা ভাঙ্গা মিস্টার আহমেদকে৷
কথাটা বলেই মেয়েটি হাসতে থাকলো। হাসির স্বরটা মিষ্টি৷ অতি উত্তম৷ তবে তার এমন কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এটা আবার কেমন রসিকতা? বেশ রাগ হলো আমার। কিন্তু প্রকাশ করলাম না৷ অপরিচিত কারো উপর রাগ ঝাড়তে ইচ্ছে হয় না আমার৷ বললাম,
-ভুল নাম্বারে ফোন দিয়েছেন৷ রাখুন৷
বলেই কলটা কাটতে যাবো ঠিক তখনই ওপাশ থেকে মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলল,
-এই এই শোনেন? ফোন কাটবেন না।
আমি আবার ফোন কানের কাছে নিয়ে বললাম,
-জি বলুন।
-কী বলব?
-ফোন দিয়েছেন কেন?
-কথা বলতে৷
-কী কথা?
-আপনার সাথে নানান বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছে আমার। আপনি কি ফ্রি আছেন?
আমি রাগের পরিমাণটা আরেকটু বাড়লো৷ তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললাম,
-আপনি কি আমার পরিচিত কেউ?
-তেমন পরিচিত নই।
-কেমন পরিচিত? নাম কী আপনার?
-নাম বললে চিনতে পারবেন?
-চেষ্টা করে দেখতে পারি৷
মেয়েটি খানিকটা চুপ করে থেকে বলল,
-লারা চৌধুরী।
আমার অবাক হওয়ার সীমা রইলো না আর৷ আশ্চর্য! লারা আমাকে ফোন করেছে? মূহুর্তে আমার সকল রাগ পানি হয়ে গেল৷ বুকের ভেতরটা আদ্র হয়ে এলো৷ সকল বিরক্তি কোথাও যেন উড়ে গিয়েছে৷ আমি খানিকটা ভারী গলায় বললাম,
-পরিচয়টা আগে দিলে ভালো হতো না?
-একটু রসিকতা করলাম আরকি। বাবা বলেন আমি নাকি রসিকতা করতে জানি না৷
-তিনি ভুল বলেন। আপনি বেশ রসিকতা জানেন।
-ভুল না। আমি ইদানীং কিছুটা পরিবর্তন হয়েছি। আগে এমন ছিলাম না।
-আগে কেমন ছিলেন?
-গম্ভীর। বদমেজাজি। কারো সাথে বেশি মিশতাম না।
-এখন কেমন?
-এখন গম্ভীর থাকি না আর৷ মেজাজও ভালো থাকে। বন্ধুদের সাথে ভালো সময় অতিবাহিত করছি।
-বাহ। বেশ তো! তা হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেন? বিশেষ কোনো কারণে?
-তা জানি না। তবে বিশেষ কেউ অবশ্যই এর জন্যে দায়ী৷
-খুব ভালো।
মেয়েটা খানিকটা চুপ থাকলো। আমিও চুপ থাকলাম। অল্প কিছু পরেই ওপাশ থেকে মিষ্টি স্বরটা ভেসে এলো,
-আপনার কি জানতে ইচ্ছে করছে না সেই মানুষটা কে?
-মানুষের ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম।
-মানুষের ব্যাপারে আগ্রহ কম থাকতে পারে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তো আগ্রহ কম থাকার কথা নয়?
-তাহলে কি বেশি থাকার কথা?
-অবশ্যই।
-তা কেন?
মেয়েটা চুপ করে গেল। তারপর বলল,
-জানি না৷
আমি বললাম,
-আমার জানতে ইচ্ছে করছে সেই স্পেশাল মানুষটি কে?
-মোটেও না৷ আপনি আমাকে খুশি করার জন্যে এখন এই কথাটা বলছেন।
-আমি আপনাকে খুশি করতে যাবো কেন?
মেয়েটা চুপ করে গেল৷ ওপাশে পিনপতন নীরবতা। আমি বললাম,
-লারা?
-হু?
-আপনি কি রাগ করেছেন?
-তা জেনে আপনার লাভ নেই?
-তা হয়তো নেই৷ তবে বললে উপকার হতো৷
-কী উপকার?
-আপনি রাগ করেছেন কি না তা বুঝতে পারতাম।
-তা বুঝে আপনি কী করবেন?
-আপনাকে রাগ করতে নিষেধ করবো৷ ভুল বিষয়ে রাগ করে থাকা উচিত নয়৷
-আপনার মনে হচ্ছে আমি ভুল বিষয়ে রাগ করেছি?
-জি৷
-তাহলে সঠিক বিষয়টি কী?
-সঠিক হচ্ছে আমি নিজ থেকে জানতে চাচ্ছি আপনার ওই স্পেশাল মানুষটি কে। আমি আমার মনের ইচ্ছের বাহিরে কোনো কিছুই করি না৷ এবং যা বলি নিজ থেকেই বলে। মন যদি বলে যে এই কথাটা বলার উচিৎ নয় তবে আমি মরে গেলেও সেই কথাটা বলি না। লারা, আপনি কি বিষয়টি বুঝতে পারছেন?
লারা চট করেই কিছু বলে ফেলল না। চুপ করে থাকল। আমার মনে হলো মেয়েটি কান্না করছে। কিন্তু এখানে তো কান্না করার কিছুই ঘটেনি। তাহলে সে কান্না করবে কেন? নাকি আমি ভুল ভাবছি? মেয়েটির স্বর ভেসে এলো। প্রসন্ন গলা৷ কান্না করেনি বোধহয়। আমি ভুল শুনেছি। লারা বলল,
-শুনেন?
-জি বলুন।
-কাল আমি আসবো।
-কোথায় আসবেন?
-আপনাদের বাসায়।
-আসুন৷
-কেন আসবেন জানতে চাইবেন না?
-আমাকে দেখতে আসবেন নিশ্চয়ই।
-তা ঠিক। তবে...?
-তবে?
-আপনাকে নিয়ে বের হবো আমি৷
-বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার।
-আমি এসব কথা শুনতে চাই না৷ কাল আপনাকে আমার সঙ্গে বের হতে হবে৷ ব্যস!
-আচ্ছা৷ ঠিক আছে৷
-সত্যিই ঠিক আছে?
-জি।
মেয়েটা যেন বেশ খুশি হলো। সে হাসলো মৃদু শব্দে৷ বলল,
-ভালো আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
-হ্যাঁ৷ ডিনার হয়েছে?
-হ্যাঁ৷
-ঔষধ খেয়েছেন?
-জি৷
-তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন৷
-আচ্ছা৷
-আমায় ঠিকানাটা টেক্সট করে দিবেন। কেমন?
-জি। দিবো।
-শুভ রাত্রি।
মেয়েটার সাথে কথা বলেই আমি শুয়ে পড়লাম। রাতে আমার চমৎকার একটা ঘুম হলো। আমার মনে হলো আমি অনেকদিন পর এমন চমৎকার একটা ঘুম দিয়েছি। সকাল বেলায় বেশ আনন্দঘন হৃদয় নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। লারা এলো দশটার দিকে। সে আমাদের বাসায় এলো৷ আমি তাকে আসতে বললাম। সে নিচে দাঁড়িয়ে থাকলো। জানালো সে উপরে আসতে পারবে না৷ আমি যেন একদম প্রস্তুত হয়ে নিচে যাই৷ আমি তাই করলাম। প্রস্তুত হয়ে বের হলাম। বের হলাম সাদিককে নিয়ে। সে আমার সাথে নিচ পর্যন্ত যাবে৷ দু'জনে লিফটে উঠলাম। দ্বিতীয় তলায় আসতেই লিফট থেমে গেল। দেখলাম তমা দাঁড়িয়ে আছে। বিষন্ন চেহারা। কোথাও যাচ্ছে যেন। সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ভেতরে আসলো। কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমাকে দেখলেই সে হাই হ্যালো করতো। এখন সেসব কিছুই করলো না৷ আমি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। তমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন জানি পারছি না৷ ভেতর থেকে কথা বের হচ্ছে না যেন। বহু চেষ্টার পর বললাম,
-তমা কেমন আছো?
লিফট সেই সময়েই থেমে গেল। থামতেই জলদি করে বেরিয়ে গেল তমা। আমার কথার জবাব তো দূরে থাক আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। এমন একটা ভাব করলো যেন আমার কথাটা সে শুনেইনি।
আমি খানিকটা আহত হলাম। মন খারাপ হলো। খারাপ মন নিয়েই এগিয়ে গেলাম আমি।
.
চলুক...
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ
বাকিটা পড়তে ইচ্ছে করছে? বেশ, নিচে এর পরের পর্বের লিংক দেওয়া হলো-