Bangla Golpo: মেয়েটি ৭
Bangla Golpo: মেয়েটি
(শেষ পর্ব)
-তারপর? সব ঠিকঠাক চলছে?
কথাটা শুনে তমা হাসলো বোধহয়। মৃদু শব্দ হলো। তবে চেহারার ভাব স্পষ্ট বোঝা গেল না। ছাদের এপাশটা অন্ধকার। এ কারণেই মেয়েটার চেহারার ভাবটা ঠিক ধরতে পারিনি৷ তবে তার হাসার স্বরে কিছু একটা ছিল। বেদনায় কাতর কিংবা তাচ্ছিল্যের স্বর, এমন কিছু। আমি সেটাও ঠিক ধরতে পারিনি। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। ঘুম আসছিল না আমার। লারা মেয়েটি আজ ফোন দেয়নি। কালও দেয়নি। কেন দেয়নি তা ঠিক জানি না। আমার দেওয়া উচিৎ ছিল হয়তো। প্রত্যেক দিন সে-ই কেন দিবে? তাও আমি দেইনি। একটা ফোন দেওয়াই যেত।
বই পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে মাথাটা খানিক ভারী হয়ে এলো। ভাবলাম ছাদে এসে কিছু সময় কাটাই। অন্ধকারে হাঁটি। ভালো লাগতে পারে।
ছাদে এসে কিছু সময় একা থাকতে হলো। বুকের কাছে দু'হাত ভাঁজ করে আকাশের দিকে চেয়েছিল। ভুলবসত ছাদের উত্তর দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷ চুপচাপ, স্থির হয়ে৷ অন্ধকারের কারণে ভালো বোঝা গেল না। মানুষটা হয়তো মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আরো কিছু সময় খুঁটিয়ে দেখতেই মনে হলো এই মেয়েটি তমা। কৌতূহল বসত এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই স্পষ্ট হলাম তমাই। আমার উপস্থিতি টের পেতেই সে খানিকটা নড়ে উঠলো। একটু সরে দাঁড়ালো। সেখান থেকেই কথা শুরু। টুকটাক কথা। আলোচনায় গাঢ়ত্ব নেই৷ কেমন জানি গা-ছাড়া ভাব৷ আমি প্রশ্ন করছি, সে উত্তর দিচ্ছে। অথবা আমি উত্তর দিচ্ছি সে প্রশ্ন করছে। সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না৷ আশপাশের সব দেখছে। কেবল যেন আমাকে দেখছে না৷ অদ্ভুত লাগলো৷ ইদানীং মেয়েটার সকল কিছুই অদ্ভুত লাগে৷ তাকে যেন ঠিক চিনতে পারি না আমি।
কথাটা বলার কয়েক সেকেন্ড পরেই তমা বেশ ঝরঝরে স্বরে বলল,
-এই তো! ভালোই চলছে৷ আগামি মাসে বিয়ে। তার প্রস্তুতি চলছে। ব্যস্ত সময়। বোঝই তো!
আমি হাসলাম। বললাম,
-তা ঠিক।
মেয়েটা চুপ থাকলো। আমি ঠিক কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কেমন জানি লাগছিল আমার। অসুস্থ অথবা দূর্বল৷ পা যেন অল্প অল্প কাঁপছে৷ তমার সাথে কথা বলতে যেন ভয় লাগছে আমার। বুকের ভেতর কেমন করে জানি কাঁপছে৷ আশ্চর্য। এমন লাগছে কেন? আগে তো এমন হয়নি৷ বললাম,
-এতো রাতে ছাদে এলে যে?
তমার উদাসী জবাব,
-অন্ধকার দেখতে এসেছি৷
-অন্ধকার ভালো লাগে?
-ইদানীং লাগছে৷
-ইদানীং লাগার কারণ?
-তা জানি না।
তমা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থেমে আবার বলল,
-তুমি যে এলে? তোমাকে তো রাতে ছাদে আসতে দেখা যায় না।
-আমি ইদানীং আসছি। ভালো লাগছে। জোছনা, অন্ধকার এসবের মাঝে নিজেকে একটুখানি ভিজিয়ে নেওয়া। এইতো!
-ভালোই।
তারপর আবার অল্প কিছু নীরবতা। সময়টাও বেশ নীরব। ক্লান্তির ভারে নুইয়ে পড়ছে যেন। আমার কিছু দূরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে। নীরবতাটুকু যেন আমাদের দুজনের দূরত্বটুকুর মধ্যেই। বাকি চারপাশে বেশ কোলাহল। এই থমকে চলা নীরবতাটা আমার কাছে খুব নতুন। এমন নীরবতা আমাদের মাঝে আর কখনই আসেনি৷ আসবে বলে ভাবিওনি আমি। তমা মেয়েটাকে ইদানীং আমার অচেনা লাগছে। আমি যেন তাকে ঠিক ধরতে পারি না৷ বুঝতে পারি না৷ তার হাসির স্বর, তাচ্ছিল্যের স্বর, সবই যেন এক লাগে৷ কেন লাগে তাও জানি না৷ বড় অদ্ভুত ব্যাপার। বললাম,
-তোমার মাঝে বেশ পরিবর্তন হয়েছে তমা।
তমা আবারও হাসলো। বলল,
-মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। আমি যেমন হচ্ছি তুমিও তেমন হচ্ছো। সময় নিজের মতো করে পরিবর্তন করে নিচ্ছে৷
আমি খানিকটা অবাক স্বরে বললাম,
-আমার মাঝে কী পরিবর্তন দেখলে?
তমা এবারেও হাসলো। বলল,
-একটা সময় তুমি মানুষের সাথে মিশতে পছন্দ করতে না৷ মেয়ে মানুষের সাথে তো না-ই। এখন তো প্রতি বেলা করে ঘুরছো! মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছো! এটা কি পরিবর্তন নয়?
-লারার কথা বলছো?
তমা চুপ থাকলো। কিছু বলল না। আমিও কিছুটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-সে আমার এই অবস্থার জন্যে গিল্টি ফিল করছে। তাই আমি যেহেতু বাসায় একা একা বোর না হই তার জন্যে আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বের হয়৷ ঘুরাঘুরি করে। দ্যাটস ইট! এর বাইরে তো কিছু না।
তমা এবারেও চুপ থাকলো। আমি বললাম,
-তমা? কিছু প্রশ্ন করি?
তার নিষ্প্রাণ জবাব,
-হু।
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-আমরা দু'জন সব সময় ফ্রেন্ডই ছিলাম৷ রাইট?
তমা চট করেই জবাব দিলো না৷ আমি তার জবাবের অপেক্ষা করলাম৷ তমা বলল,
-হু।
-শুধুই বন্ধু৷ তাই তো?
-হু।
-তাহলে তুমি চট করেই কেন মুভ করলে? কেন আমাকে পর করে দিলে। এমন বিহ্যাভ করলে যেন আমি কেউই না৷ আমাকে তুমি চেনোই না৷ যেন আমি কোনো আগুন্তক কিংবা পথচারী৷ যার সাথে কথা না বললেও চলে৷
তমা জবাব দিলো না। চুপ করে থাকলো৷ আমি বললাম,
-বলো প্লীজ৷ আমার উত্তর গুলো জানতে হবে। জানাটা খুব প্রয়োজন আমার জন্যে৷
তমা চুপ করেই থাকলো। কিছু সময় পর রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বলল,
-তুমি হঠাৎ এই প্রশ্ন গুলো করছো কেন?
-হঠাৎ না৷ কিছু দিন থেকেই প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আজ পেলাম বলেই করলাম।
তমা মাথা নিচু করে বলল,
-এমনটা করার তেমন বিশেষ কোনো কারণ ছিল না। ইচ্ছে হয়েছে বলেই করেছি।
-ইচ্ছে? তাহলে তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে কষ্ট দিলে?
-কষ্ট পাও নাকি তুমি? জানতাম না তো!
-এতোটা দিনের বন্ধুত্ব আমাদের। অথচ তুমি জানোই না আমার কষ্ট আছে কি নেই!
-জানি বলেই তো বললাম। তোমার মাঝে অনুভূতির অভাব৷ বুঝতে না পারার অভাব। ব্যাথা না পাওয়ার অভাব৷ তোমার হৃদয়ে ব্যাথা বলতে কিছুই নেই৷
-এই জানলে তুমি আমায়?
-এরচে ভিন্ন কিছু কি কখনও তোমার কাছ থেকে পেয়েছি?
-কখনও কি পাওয়ার চেষ্টা করেছো?
-করেছি হয়তো৷ তুমি বুঝতে পারোনি।
-এমন করার কী লাভ যেটা ওপাশের মানুষটি বুঝতেই না পারে? অপরপক্ষের মনের মাঝে প্রভাব ফেলে না?
-প্রভাব ফেলবে কী করে? সেখানে যে মস্তবড় দেয়াল। অচেনা অস্পষ্ট দেয়াল।
-কখনও কি সেই দেয়ালটা ভাঙ্গতে চেয়েছো? কখনও কি ভেবেছো যে এই অস্পষ্ট দেয়ালটা ভাঙ্গলেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে? তুমি ওপাশের মানুষটির মনে প্রভাব ফেলতে পারবে? তুমি কি আসলেই তেমনটা চেয়েছো? কখনও চেয়েছো?
-আমার অক্ষমতা। আমি সেই দেয়াল ভাঙ্গতে পারিনি।
-তাহলে তার শাস্তিটা আমাকে কেন পেতে হবে? তুমি কেন আমায় এড়িয়ে চলবে?
-তুমি বুঝবে না সেটা।
-এভাবেই তো এড়িয়ে গিয়েছো৷ বুঝবে না সেটা! কখনই কি বুঝাতে চেয়েছো? চাইলে অবশ্যই পারতে। আমি অতোটা অবুঝ নই।
-তোমার অনুভূতিরা বড়ই অবুঝ৷ তারা বুঝতো না।
-তাহলে লারা কীভাবে পারছে? কীভাবে আমাকে বুঝতে এবং বুঝাতে পারছে?
-সে পারছে নাকি?
-অবশ্যই পারছে। তার জন্যেই তো আজ আমার মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছো। পাচ্ছো না?
তমা কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো। মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। আমি বললাম,
-আমাকে তুমি পছন্দ করতে, তাই না?
তমা চট করেই মাথাটা তুলে দেখলো আমায়৷ আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনবে বলে সে আশা করেনি হয়তো। মেয়েটা থতমত খেয়ে গেলো। কিছু বলতে পারল না৷ খানিকটা সময় নীরবতায় কাটলো৷ আমি বললাম,
-ভালোবাসা, ভালো লাগা, পছন্দ-অপছন্দ এসব আমার মাঝে কখনই কোনো প্রভাব ফেলেনি৷ কেবল ওইদিন ছাড়া। ওই একটা দিন, একটা মূহুর্ত আমার জন্যে অনেক কিছু ছিল। অনেক।
তমা চট করেই বলল,
-কোন দিন? কোন সময়?
আমি হাসলাম। বললাম,
-বলা যেহেতু শুরু করেছি, শেষ অবশ্যই করবো। একটু অপেক্ষা করো৷
তমা কিছু বলল না। চুপ করে থাকলো। আমি বললাম,
-তমা, তুমি আমাকে ভালোবাসতে, প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতে। অথচ আমি সেটা কখনও টের পাইনি৷ বুঝতেই পারিনি৷ এটা তো সত্য কথা তাই না?
তমা এবারেও চুপ থাকলো। আমি বললাম,
-ভালোবাসা একটা অনুভূতি। অদ্ভুত, অথচ হিমশীতল অনুভূতি। যার কোনো সঙ্গা নেই, যা স্পষ্ট না৷ কখন, কোথায়, কীভবে প্রেম হবে সেটাই কেউই বুঝতে পারবে না৷ কেউই না। ভালোবাসা মানে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা৷ নিজেকে কারো হাতে তুলে দেওয়া৷ এমন একটা হাত, যেই হাতে নিজেকে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র ভয় হবে না, দ্বিধা আসবে না৷ যার সাথে সব শেয়ার করা যাবে৷ সব। নিজের পাগলামো গুলো যে ঠিক বুঝতে পারবে, নিজেকে বুঝতে পারবে। যার চোখ দেখেই অন্তরের গভীরতা বোঝা যাবে। চোখ দেখে বোঝা যাবে বিপরীত মানুষটা কী ভীষণ ভাবে তাকে চায়। তাকে পাওয়ার জন্যে কতোটা আগ্রহী সে মানুষটা। ভালোবাসা অদ্ভুত, অতুলনীয়। প্রিয় মানুষটিকে দেখলে চট করে মনটা ভালো হয়ে যাওয়া, তার হাত ধরতেই নিজের মাঝে পরিপূর্ণতার অনুভূতি হওয়া, আমার কাছে ভালোবাসার অনুভূতিটা এমনই। এমনই মনে হচ্ছে৷ দু'পক্ষের দু'জন যদি নিশ্চিত ভাবে এই অনুভূতি গুলো অনুভব করে তবে তাদের মাঝে অবশ্য প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে৷ তারা একটা সম্পর্কে যেতে পারে৷ তমা, তোমার কি মনে হয় আমাদের মাঝে এমন কোনো অনুভূতি আছে? মনে হয়?
তমা মাথা তুলে তাকায়। অন্ধকার, তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসী গলায় বলে,
-যদি থাকে? থাকলে কী হবে?
-থাকাটাই প্রশ্ন। তুমি আমাকে নিয়ে অনেক কিছুই অনুভব করতে পারো৷ অনেক কিছুই পারো৷ এটা তোমার অনুভূতির স্বাধীনতা। কিন্তু সেই অনুভূতিটা তো আমাকেও ছুঁতে হবে তাই না? বলো? আমারও সেইম অনুভূতি হওয়ার কথা না?
-হয়নি? তুমি তেমন অনুভব করোনি? আমার অনুভূতি কি তোমাকে ছুঁয়ে যায়নি?
আমি তমার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তমা মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ বললাম,
-তুমি হয়তো ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কোনো অনুভূতি প্রকাশই করোনি৷
-তার মানে?
-তুমি স্বাধীন ভাবে তোমার অনুভূতি জাগিয়েছো৷ তোমার অনুভূতি জেগেছে৷ তবে সেটা তোমার নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিজের ভেতরেই আবৃত রেখেছো৷ তোমার সেই অনুভূতি আমাকে ছুঁয়ে যায়নি৷ আমি বুঝতেই পারিনি! তুমি হঠাৎ লারাকে আমার পাশে দেখে রেগে গেলে। কথা বলা বন্ধ করে দিলে। আমি টের পাইনি। কিছুই অনুভব করিনি৷ তুমি আমার সাথে কথা বলছো না দেখে মন খারাপ হতো আমার। সেই মন খারাপটা আবার বেশিক্ষণ থাকতোও না৷ সেদিন তোমার সাথে তোমার হবু হাজবেন্ড ইমনকে দেখলাম। আমার বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠলো যেন৷ এই জ্বলে উঠার কারণটা আমি জানি না৷ এর কোনো সঙ্গা আমার জানা নেই৷ এটা হয়তো স্বাভাবিকও হতে পারে৷ আমার বন্ধুর পাশে অন্য কাউকে দেখে আমার হিংসে হচ্ছে৷ এটা স্বাভাবিক। এই হিংসেটাও অতি সাময়িক৷ পরবর্তীতে এটি আমার মাঝে তেমন প্রভাব ফেলেনি। তমা, আমি ভাবতাম আমার অনুভূতিরা চাপা। অনুভূতিরা কিছু একটার আড়ালে চেপে আছে৷ ধরা দিচ্ছে না৷ কিন্তু এই কয়দিনে টের পেলাম, তোমাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো অনুভূতিই নেই। তোমার কোনো কিছুই আমার মাঝে এতো বেশি প্রভাব ফেলে না৷ তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু৷ ব্যস৷ একজন বন্ধু মাত্র৷ তোমায় নিয়ে আমি এরচে বেশি কিছু অনুভব করি না৷ হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে তোমাকে নিয়ে মন খারাপ থাকতো আমার৷ তবে সেটা কেবল সহানুভূতি। এরচে বেশি কিছু না৷ তোমাকে একজন বন্ধুরূপেই আমি অনুভব করি৷ ভালো বন্ধু৷
তমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কিছু বলছে না সে৷ কথা বলতে পারছে না যেন৷ আমি আবারও বললাম,
-তোমার ভালোবাসাটা হয়তো একতরফাই ছিল। যে ভালোবাসা আমার মাঝে কোনো প্রভাব ফেলেনি, সেটা নিয়ে একটা সম্পর্কে যাওয়াটা অন্যায় ছাড়া কিছুই নয়৷ আমি সব সময় আমার অনুভূতিকে প্রাধান্য দেই৷ দিচ্ছি৷
আমি চুপ করে গেলাম। কিছু বললাম না। তমাও চুপচাপ থাকলো। আমি রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম৷ আকাশের দিকে তাকালাম। কী সুন্দর আকাশ৷ তমা চট করেই বলে উঠলো,
-তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছো৷ প্রেম হয়নি আসলে। আকর্ষণ ছিল হয়তো৷ কি জানি। আমিও হঠাৎ কনফিউশনে পড়ে গেলাম।
আমি অবাক স্বরে বললাম,
-কনফিউশান?
তমার স্বরটা কেমন সরল হয়ে এলো৷ পুরনো সেই স্নিগ্ধতাটা যেন ফিরে এলো৷ বলল,
-ঠিক বুঝতে পারছি না৷ ইমন ছেলেটাকে দেখার পর থেকে কেমন কেমন লাগছে। কেমন অন্য রকম৷ তাকে দেখার পর থেকেই তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বলার একটা সাহস পেয়েছি৷ নিজেকে স্থির রাখতে পারছি৷ ছেলেটা অন্যরকম। আমার বেশ ভালো লেগেছে৷
শেষের কথাটা এমন ভাবে বলল যেন সে হাসছে৷ লজ্জাময় হাসি৷ ও নিজ থেকেই বলল,
-তোমার মানুষটা কে? আমার মনে হয় আমি তাকে চিনি।
আমি হাসলাম। বললাম,
-তুমি তাকে চেনো৷ অবশ্যই চেন। তাকে দেখার পরই আমার মনে হয়েছে এই মেয়েটা কেবল আমার জন্যেই তৈরী হয়েছে৷ কেবল আমার জন্যেই৷ এতো ভালো লাগছিল আমার যা বলার মতো না৷ যাই হোক, সে আমার হোক কিংবা না হোক, আমি তাকে ভালোবাসি৷ ভীষণ ভালোবাসি৷ এটাই আমার স্বার্থকতা।
তমা হাসলো৷ বলল,
-ভালোই পরিবর্তন হয়েছো তুমি। লারাকে একটা থ্যাঙ্কিউ দিও৷
আমি খানিকটা হেসে বললাম,
-আচ্ছা৷ ঠিকাছে।
তমা নিজেও হাসলো৷ বহুদিন পর তার হাসির স্বর পেলাম। আমার বেশ ভালো লাগলো৷ তমার সাথে অনেকটা সময় সেখানে থাকলাম। টুকাটাক কথা বলে রুমে ফিরে এলাম। সাতপাঁচ না ভেবে লারাকে একটা কল দিয়েই ফেললাম। রিং হতেই রিসিভ করে ফেলল মেয়েটা৷ যেন এতোটা সময় সে ফোনের কাছেই ছিল, আমার কলের অপেক্ষা করছিল।
.
পরিশেষঃ
এরপর সময় বেশ ভালোই গতিতে চলে গেল৷ বেশ ধুমধামে তমার বিয়েটা হয়ে গেলো। সেই সময় পর্যন্ত আমি আর লারা বেশ ভালো ভাবেই ছিলাম। রোজ ফোন দেয়া, অনেক সময় পর্যন্ত কথা বলা, মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া, বেশ ভালোই চলছিল। এরপর একদিন চট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বাসা পরিবর্তন করবো। সাদিককে কাজে লাগিয়ে দিলাম৷ বাসা পেতে খানিকটা দেরি হয়ে গেলো। ততোদিনে লারার সাথে আমার সম্পর্কটা আরো গাঢ় হয়ে গিয়েছিল৷ আমি আসলে সেটাই চাচ্ছিলাম৷ সম্পর্কটা গাঢ় হোক৷ এরপর একদিন দিনক্ষণ ঠিক করে নতুন বাসাতে উঠে গেলাম। সব কিছু নতুন করে গোছগাছ করলাম৷ আমার পায়ের সমস্যাটাও ততোদিনে ভালো হয়ে গিয়েছিল৷ নতুন বাসায় উঠেই খানিকটা ব্যস্ত হয়ে যাই আমি। নিজের সব কিছু ঠিকঠাক করতে একটু সময় লাগছিল৷ ততোদিন লারার সাথে কথা হয়নি আমার। সময় করে ফোন দেওয়া হয়নি৷ একদিন হুট করেই সিমটা বন্ধ করে দিলাম। সাদিককে বললাম লারার নাম্বারটা যেন ব্ল্যাক লিস্টে রাখে৷ টানা তিন সপ্তাহ লারার সাথে কোনো যোগাযোগ হলো না। নিজেকে সালাম দিত্র খানিকটা কষ্ট হলো। তবুও সামলে নিলাম। নতুন বাসার ঠিকানাটাও লারা জানে না৷ এটাতে সুবিধা হয়েছে৷ মেয়েটা খুঁজেও পাবে না আর। এরমাঝে একদিন তমার ফোন এলো৷ ছলেবলে সে আমার নতুন বাসার ঠিকানা জানতে চাইলো৷ দিলাম না৷ কারণ আমি নিশ্চিত যে লারা ওকে দিয়ে ফোন করিয়েছে। জানতে চাচ্ছে যে আমি কোথায় আছি৷ তমাকেও বললাম না৷ সর্বোপরি নিজেকে লারার কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখলাম। তারপর একদিন নিজেই গিয়ে উপস্থিত হলাম লারার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। অপেক্ষা করলাম কখন সে বেরিয়ে আসবে৷ তার বেরিয়ে আসতে খানিকটা সময় লাগলো৷ আমি অপেক্ষা করলাম৷ সত্যি বলতে আমার বুক কাঁপছিল। কেমন অস্থির লাগছিল। মেয়েটা আমাকে দেখে কী রিয়েক্ট করবে সেটা নিয়ে ভাবনায় ডুবে ছিলাম। গা ঘামাচ্ছিল। হার্ট বিট যেন প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে৷ লারা একটা সময় বেরিয়ে এলো। পাশে তার এক বন্ধুবী। মেয়েটার মুখটা শুকনো৷ চোখে কাজল নেই। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই৷ ফ্যাকাসে চেহারা। কেমন দূর্বল লাগছে তাকে। কিছু একটার শূন্যতায় ভুগছে যেন৷ আমি আড়াল ছেড়ে দাঁড়ালাম। ফুটপাতের কাছ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটা রাস্তার দু'পাশে তাকালো৷ রিক্সার খোঁজ করছিল হয়তো৷ রাস্তার কাছে আরেকটু সরে আসতেই আমাকে দেখলো সে৷ প্রথমবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিলো মেয়েটা। কিছু সময় সোজা মাটির দিকে তাকিয়েছিল। কিছু চিন্তা করছিল হয়তো৷ ভুল দেখলো না তো? অল্প কিছু পরেই মেয়েটা দ্রুত আমার দিকে ফিরে তাকালো। এবং তাকিয়েই থাকলো৷ চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ। নিজেকে যেন কোনো ভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছে না৷ সে স্থির বরফের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমতে থাকলো। চেহারায় কেমন প্রাণ ফিরে পেল মেয়েটা৷ আমি এদিক থেকে তাকিয়ে থাকলাম। গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকলাম৷ তার চোখ বরাবর। চোখ দিয়ে অন্তর দেখার চেষ্টা করলাম। সেই চেষ্টাতেই আমি যেন নাই হয়ে গেলাম৷ অদ্ভুত এক ঘোর ধরলো আমার চোখে৷ আমার সমস্ত দেহ যেন নিয়ন্ত্রণ হারালো। গা কেঁপে উঠলো খানিক। হিমশীতল রক্তের স্রোতে বয়ে গেল সমস্ত শরীর বেয়ে৷ আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না৷ কাঁপাকাঁপা পাঁয়ে এগিয়ে গেলাম৷ আমি দেখেছি ওটা৷ যেটা দেখার জন্যে এতোদিন মেয়েটার সাথে কথা বলিনি৷ দেখা করিনি৷ আমি ভালোবাসা খুঁজতে চেয়েছিলাম৷ খুঁজতে খুঁজতে আমি ভালোবাসার চেয়ে অধিক কিছু পেয়ে গেলাম৷ লারা৷ লারা চৌধুরী। তাকেই একেবারে নিজের করে পেয়ে গেলাম৷ লারা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো৷ কয়েক পা আসার পর গতি বদল হলো তার৷ সে দৌড়াতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এলো মেয়েটা৷ একজন অসাধারণ রূপবতীর এভাবে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসাটা অস্বাভাবিক। সকলের নজরে পড়ে৷ পড়ছে৷ অনেকেই আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কারো দেখার সময়ও নেই। আমি সেদিক গা দিলাম না৷ আমার কাছে এই মূহুর্তে এই রূপবতীকে বুকে টেনে নেওয়াটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো৷ লারা এগিয়ে আসছে৷ আমি কাঁপাকাঁপা পাঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছি৷ আমার বুক কাঁপছে। ভীষণ কাঁপছে৷ চোখে জল জমছে৷ আমার কেমন জানি কান্না পেল। তাও আমি স্থির থাকলাম। যে মেয়েটা এগিয়ে আসছে তাকে সামলে নিতে হবে আমার৷ বুকের উপর আছড়ে পড়াটা সামলে নিতে হবে৷ অতপর, অতপর সেই সময়টা এলো৷ মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকের কাছে। প্রচণ্ড রকম শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো আমায়৷ কান্নায় লুটিয়ে পড়লো তার দেহ৷ ভীষণ বেদনায় নিজেকে ভাসিয়ে নেওয়া মেয়েটা আজ কাঁদতে কাঁদতে নিজের বেদনা ঝরাচ্ছে। কষ্ট কমাচ্ছে। আমি তাকে সেই সুযোগ দিলাম। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলাম তাকে। লারা কাঁদছে৷ শব্দ করে কাঁদছে৷ ফোঁপাচ্ছে৷ কাঁদুক৷ মাঝে কান্নাটাও ভালো। অধিক ভালো।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।