Bangla Golpo: বিষাদ আজ মন ছুঁয়েছে (শেষ পর্ব)

Bangla Golpo-Bangla New Golpo-Bangla Choto Golpo-Bangla Love Story-Bangla Valobasar Golpo-বাংলা গল্প

Bangla Golpo-Bangla New Golpo-Bangla Choto Golpo-Bangla Love Story-Bangla Valobasar Golpo-বাংলা গল্প 

Bangla Golpo: বিষাদ আজ মন ছুঁয়েছে

(শেষ পর্ব)
.
তমা চলে গিয়েছে৷ বাসাতে এক মাত্র শাহেদ। এতো বিশাল বাসা, অথচ মানুষহীতার গুমোট বাঁধা বেদনা যেন সমস্ত ঘরটায় ভেসে বেড়াচ্ছে। একা একা শাহেদের সময় কাটে না৷ বড় কষ্টকর অবস্থা। শরীরটা ভালো হলে এক কথা ছিল। বাইরে হেঁটে আসা যেত। এখন সেটাও করা যাচ্ছে না৷ দুঃসময় শুরু হলে সমস্ত দিক থেকেই শুরু হয়৷

শাহেদ কোনো রকমে নিজের টেবিলের কাছে যায়৷ কাল রাত একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছিল। লেখা হয়নি৷ শব্দ মেলে না৷ লিখতে গেলেই যেন অপরিপূর্ণ লাগে। লেখাকে গাঁজাখুরি মনে হয়৷ কেমন জানি গা'ছাড়া গা'ছাড়া ভাব। এভাবে লেখা যায় না। লিখতে হলে মনের শান্তির প্রয়োজন। এই মূহুর্তে শাহেদের মাঝে সেটা নেই৷ তাও সে চেষ্টা করে। অথচ কিছুই হয় না৷

শাহেদ আবার লিখতে বসলো। একটি প্রেমের গল্প। এই গল্পটার শেষটা সুন্দর নয়৷ কুৎসিত ধরনের৷ শাহেদ প্রথম লাইন লিখলো৷ তারপর সেটা কেটে দিলো। আবার লিখলো এবং আবার কাটলো। তার কাছে কোনো বাক্যই পছন্দনীয় হলো না।

সে গল্পের শুরুটাই করতে পারছে না৷ মূলত সে নিজেকে স্থির করতে পারছে না৷ নিজেকে স্থির করতে পারলে গল্পটা একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শুরু করা যেতো। ঠান্ডা মাথায় ভেবে গল্পটা সমাপ্ত করা যেতো৷ অথচ সেটা করা যাচ্ছে না৷ লিখতে বসলেই শাহেদের মস্তিষ্কে লিলির হাসিটা ভেসে উঠে৷ মেয়েটা এতো অমায়িক ভাবে হাসে যে দেখলে ভালো না লেগে পারা যায় না৷

লিলি মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঠোঁটের কাছে ছোট্ট একটা তিল আঁকে। ঠোঁটের কাছের তিল শাহেদের বিশেষ পছন্দ৷ কিছুটা দূর্বলতা৷ তিল এঁকে লিলি চট করেই শাহেদের সামনে চলে আসে না৷ আড়ালে আড়ালে থাকে৷ কাছে এলেও দ্রুত চলে যায়৷ যতোক্ষন না শাহেদ ব্যাপারটা লক্ষ্য করবে ততোক্ষন সে এমনটা করে যাবে।

শাহেদ যখন টের পাবে তখন নিজ থেকেই ডাক দিবে,
-এই দাঁড়াও তো!
লিলি চট করেই দাঁড়িয়ে যায়৷ হঠাৎ কেন জানি ওর হার্টবিটটা বেড়ে যায়৷ শাহেদ এগিয়ে আসে৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লিলির দিকে। লিলি অবাক স্বরে বলে,
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
শাহেদের চোখে আরেকটু ঘোর ধরে৷ সে কাছে আসে৷ কৃত্রিম তিলে নিজের আঙ্গুল বুলিয়ে দেয়৷ লিলি চট করে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার গা শিরশির করে উঠে যেন৷ মৃদু কেঁপে উঠে৷

শাহেদ আরেকটু কাছে আসে। ঠোঁটের কাছ নিজের মুখটা এনে তিলের উপর চুমু খায়৷ তারপর ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে লিলির ঠোঁটের সাথে৷ লিলি শক্ত হয়ে যায়৷ কোনো রকম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল৷ শাহেদ মুখ সরিয়ে নেয়৷ লিলির মাথার সামনে থাকা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-কৃত্রিমতাও তোমার মাঝে বাস্তবের মতো মিশে যায়৷ চুমু খাওয়ার ইচ্ছে হলে বলার দরকার নেই৷ এমন অভিনব পদ্ধতি বের করিও।

লিলি চট করেই হেসে ফেলে। লজ্জা পায়৷ শাহেদ ব্যাপারটা বুঝল কী করে? সে চট করে শাহেদকে জড়িয়ে ধরে। লজ্জায় তার মারা যেতে ইচ্ছে করে। সে শাহেদের গলা জড়িয়ে ধরে। নিজের মুখটা চেপে ধরে শাহেদের গলার কাছে৷ আলতো করে চুমু খায় সেখানে।

অদ্ভুত এবং অসাধারণ ছিল সেই দিন গুলো। মূহুর্ত গুলো। অথচ আজ মিথ্যা মেকির চাপায় সমস্তই কল্পনা হয়ে গিয়েছে। সেই সত্যও আজ ভীষণ মিথ্যা৷ ব্যাথা ময়৷

শাহেদ বসে থাকলো। তার আর গল্প লেখার ইচ্ছে হলো না৷ সে বসে বসে অতীত কল্পনায় ডুবে গেলো৷ এই ডুবে যাওয়াই তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়৷ কষ্ট বাড়ায়।
.
আসাদ সাহেব বাসায় এলেন দুপুরের দিকে৷ তিনি ভেবেছেন বাসায় এসে তমাকে দেখতে পাবেন। অতী উৎসাহ নিয়ে এক তরুণী তার পিতার জন্যে অপেক্ষা করছে৷ কিন্তু বাসায় এসে তিনি তেমন কিছুই দেখলেন না৷ জানতে পারলেন তমা বাসায় নেই। অথচ তার থাকার কথা। বাবা যেদিন আসবে সেদিন তমা অধীর আগ্রহে বসে থাকে। তার কাছে বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে৷ আজ এমন কি হলো যে তমা বাসায় থাকলো না? আসাদ সাহেব কিঞ্চিৎ মন খারাপ বোধ করলেন। তবে তা প্রকাশ করলেন না।

লিলির সাথে তিনি দেখা করতে গেলেন না৷ লিলি নিজেই এলো৷
-বাবা কেমন আছো?
-ভালোই।
-আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
আসাদ সাহেব প্রশ্নটার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না৷ এ ধরনের প্রশ্ন গুলো তাঁর কাছে অপ্রাসঙ্গিক লাগে। তিনি বললেন,
-তমা বাসায় নেই?
-না বাবা। ভার্সিটি গিয়েছে৷
-এক্সাম নাকি?
-না তো!
তিনি কিছু বললেন না। খানিকটা চুপ থেকে বললেন,
-তোর মেয়ে কেমন আছে?
-ভালো আছে৷ তুমি দেখবে ওকে?
-কই?
-শুয়ে আছে।
-ঘুমাচ্ছে?
-হ্যাঁ।
-তাহলে থাক। পরে দেখবো।
-আচ্ছা।
-আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। এক ঘন্টা পর লাঞ্চ করবো৷ জামিলা আসেনি?
-এসেছেন৷ কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে আরো আগেই।
আসাদ সাহেব কিছু বললেন না আর নিজের রুমে চলে গেলেন।
.
তমা বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো৷ কোনো দিকে তাকালো না৷ দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় উপড় হয়ে পড়লো৷ লিলি-শাহেদের গল্পটা তাকে বিশেষ প্রশান্তি দিতে পারলো না৷ এটি যেন তার মাথা যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মাথাটা কেমন জানি ভারী হয়ে আসছে৷ সে ভেবেছে শাহেদের কাছ থেকে গল্পটা শুনবে এবং নিশ্চিত ছিল যে সে ওদের মিলিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারবে৷ কিন্তু শাহেদের ডায়েরিটা পড়ার পর থেকে তার এই ধারণাটা হাওয়ায় মিইয়ে গেল৷ সেখান থেকেই তার মন খারাপের শুরু৷ ডায়েরি পড়ার ব্যাপারটা শাহেদ জানে না৷ শাহেদ যখন ঘুমাচ্ছিল তখনই লিলি ডায়েরিটা দেখল টেবিলের উপর। খোলা অবস্থাতেই। পৃষ্ঠায় লিলির নাম দেখে তার আগ্রহ আরো কিছু বাড়লো। লজ্জা সম্মানের মাথা খেয়ে সে তার দুলাভাইয়ের ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়ার শুরু করলো৷ পড়ে সে যা জানলো তার জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

তমা যেভাবে শুয়েছিল সেভাবেই শুয়ে থাকলো৷ কয়েক মিনিটের মাথায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। আসাদ সাহেব এসে একবার দেখে গেলেন৷ ভাবলেন তমাকে ডাকবেন৷ কিন্তু ডাকেননি। মেয়েটা এমন নিষ্পাপ ভাবে ঘুমাচ্ছে যে ডাকতে ইচ্ছে করলো না। তমার এতো সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না উনার। উনি দরজার কাছ থেকে এক ভাবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর নিঃশব্দে দরজা টেনে দিলেন৷
.
দুই সপ্তাহ পরঃ
.
শাহেদ চুপচাপ বসে থাকলো। রেস্টুরেন্টটা তার ভালোই লেগেছে৷ মোটামুটি মানুষ আছে। কিন্তু এতো হট্টগোল নেই৷ খুবই শান্ত। মনোরম পরিবেশ। অনেকদিন পর বের হওয়াতে মনটা খানিক প্রসন্ন লাগছে। শাহেদের খাওয়া শেষ৷ তার উচিৎ এখন উঠে যাওয়া৷ অথচ সে উঠছে না৷ ইদানীং একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো শাহেদ৷ সে বেশ অলস হয়ে গিয়েছে। যেখানেই কিছু খাবে সেখানেই বসে থাকবে। কতোক্ষন বসে থাকবে সেটা ও নিজেও জানে না৷ বসে বসে তার মাথায় অনেক চিন্তা আসে। অনেক কিছু ভাবে৷ ভাবতে ভাবতে তার সময় পেরিয়ে যায় অথচ ভাবনা শেষ হয় না৷ কী অদ্ভুত এক ব্যাপার।

শাহেদ লক্ষ্য করলো পাশের টেবিল থেকে একটা মেয়ে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে৷ এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন শাহেদ টের না পায়৷ টের পেলে যেন কঠিন শাস্তি হবে তার। মেয়েটির বান্ধুবিগণ তাকে কিছু একটা নিয়ে খোঁচাচ্ছে৷ অথচ মেয়েটা সেটা পাত্তাই দিচ্ছে না। শাহেদ সেদিকে আর ধ্যান দিলো না৷ দুনিয়ার মোহমায়া তাকে যেন বিশেষ প্রভাবিত করতে পারে না আর। এই জিনিসটা বেশ ভালো হয়েছে। মোহ মায়া মানুষকে শেষ করে দেয়৷

মেয়েটি এবার সাহস করে উঠেই এলো,
-স্যার, কেমন আছেন?
শাহেদ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল,
-এই তো! তুমি কেমন আছো?
-ভালো স্যার৷ আপনি কলেজে আসছেন না কেন?
-তুমি আমার কলেজের স্টুডেন্ট নাকি?
-স্যার, আপনি আমাকে চিনতে পারেননি? আমি নেহা৷ সুমাইয়া নেহা।
শাহেদ ঠিক মনে করতে পারলো না৷ এই মেয়েকে আগে দেখেছে বলেও মনে হয় না৷ শাহেদ ফ্যাকাসে হেসে বলল,
-ঠিক মনে করতে পারছি না।
-আচ্ছা থাক স্যার৷ মনে করতে হবে না৷ আপনি এটা বলুন তো কেন কলেজে আসছেন না?
-অসুস্থ৷ এক্সিডেন্ট হয়েছে৷
-কী বলেন স্যার? কীভাবে?
শাহেদ হাসলো। বলল,
-সে সব অনেক কথা৷ অন্য এক সময় বলবো৷ তা তুমি কি এই কথা জিজ্ঞেস করতেই এসেছো?
মেয়েটা কিছু সময় চুপ করে থাকলো। কি যেন ভাবছে সে৷

শাহেদ দৃষ্টি ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো৷ তাজাতেই অতোশিকে দেখলো। সে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকছে৷ সাথে অন্য আরেকটা মেয়ে৷ শাহেদ মাথাটা নিচু করে রাখলো। মনে মনে খুব করে চাইলো যেন অতোশি ওকে না দেখে। তার সেই চাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেল৷ তার টেবিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অতোশি ঠিকই খেয়াল করে ফেললো৷ এবং চট করেই দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
-শাহেদ? তুমি এখানে?
শাহেদ ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ কিছু বলল না৷ পাশ থেকে ওই মেয়েটা বলল,
-স্যার, আমি আসি৷ ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।
শাহেদ ওর দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসলো। বলল,
-দ্রুতই দেখা হবে নেহা৷
এই কথাটা নেহার এতো ভালো লাগলো যে তার ইচ্ছে হলো সে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আরো এক কোটিবার এই লাইনটা শোনে, "দ্রুতই দেখা হবে নেহা।" কতো আপনমায়া গেঁথে জানি স্যার কথাটা বলেছেন! নেহা তার ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো৷
.
-শাহেদ? তোমার কী অবস্থা এখন? পা ভালো হয়েছে?
শাহেদ মৃদু হেসে বলল,
-আলহামদুলিল্লাহ৷ মোটামুটি ভালো। তুমি এখানে কী করছো?
-ফেন্ডের সাথে এসেছি৷ বাসায় একা একা বোর হচ্ছিলাম।
-আচ্ছা৷ লেখালেখির খবর কী? সব ঠিকঠাক?
-ঠিকঠাক আর কই বলো? সময় ভাসিয়ে নিচ্ছে৷ এই যা!
-সময়ের সাথে ভেসে যাচ্ছো নাকি?
-হ্যাঁ৷ সাঁতরাতে আর ভালো লাগে না৷ এবার স্রোতে গা এলিয়ে দিলাম। যেদিকে ইচ্ছে নিয়ে যাক।
-তোমার কণ্ঠে হাতাশা?
-চোখ জোড়া দেখো। টের পাবে।
-অতোশি, আমি কেবল লিলির চোখ পড়তে জানি৷
অতোশি দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ বলল,
-এক সময় আমারটা পড়তে পারতে না?
-কোন সময়?
-বাহ! সব ভুলে গিয়েছো?
-অতীত কে মনে রাখে?
-পাল্টা প্রশ্ন করার স্বভাবটা তোমার গেল না তাই না?
শাহেদ চট করেই কিছু বলল না৷ খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-অতোশি?
-বলো?
-কতোটা ভালোবাসো আমায়?
-যতোটা তুমি কল্পনাও করতে পারো না।
-আমার চোখ পড়তে পারবে?
অতোশি জবাব দিলো না। সে কেবল তাকিয়ে থাকলো। শাহেদ বললো,
-একটু দেখো তো! আমাকে বলো কী দেখতে পাও।
অতোশি তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-ব্যাথা, ব্যাথা এবং ব্যাথা৷
শাহেদ মাথা নিচু করে রাখলো। অতোশি বলল,
-তোমার চোখ কেমন লালচে হয়ে আছে। চোখের নিচেও কালি। রাতে কি ঘুমাও না?
শাহেদ ফ্যাকাসে হাসল। বলল,
-ঘুম আসে না অতোশি৷
দু'জনেই চুপ করে থাকলো৷ কেউ কথা বলছে না৷ চারপাশ যেন ভীষণ নীরব। অতোশি বলল,
-শাহেদ তোমাকে আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে।
শাহেদ মাথা নিচু করে রাখলো। অতোশি বলল,
-হাতটা এদিকে দিবে?
শাহেদ বলে,
-আর কিছু বলবে অতোশি? আমি চলে যাবো এখান থেকে।
কথাটা বলেই শাহেদ অতোশির দিকে তাকালো। সে লক্ষ্য করলো অতোশির চোখ চিকচিক করছে৷ আশ্চর্য! মেয়েটা কাঁদছে নাকি? শাহেদ কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো কেবল৷ এই মেয়েটা বেশ কঠিন প্রকৃতির। তাকে কখনও কাঁদতে দেখেনি শাহেদ৷ জীবনে এই প্রথমবার দেখলো৷ শাহেদের খানিকটা খারাপ লেগে উঠল। তবে সেটা প্রকাশ করলো না।
.
লিলি কেবিন থেকে বের হতেই দেখলো শাহেদ আর অতোশি বসে আছে৷ দু'জনেই চুপচাপ। যেন এদের মাঝে নীরব যুদ্ধ চলছে৷ লিলি অতোশিকে দেখে বেশ ঈর্ষা বোধ করলো। মেয়েটা বুঝি শাহেদকেই বিয়ে করবে? অর্নব পাশ থেকে বলল,
-চল! দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
লিলি ফ্যাকাসে হাসলো৷ কিছু বলল না৷ কিছু দূর আসার পর ওর মনে পড়লো শাহেদ ওর সাথে দেখা করার জন্যে বেশ কয়েকবার বলেছে৷ ফোন দিয়েছে। মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে গিয়েছে। ও ইচ্ছে করেই মেসেজ সীন করেনি৷ ফোন উঠায়নি৷ আজ সেই দেখাটা করে ফেললে কেমন হয়? নাহ, থাক। আগ বাড়িয়ে কথা বললে আবার কী ভাবে কে জানে!
লিলি শাহেদের টেবিলের পাশ কাটিয়ে চলে এলো৷ ঠিক সে সময়েই শাহেদ দাঁড়িয়ে বলল,
-লিলি?
লিলি চট করেই দাঁড়িয়ে গেলো। আচমকা তার হার্টবিট যেন বেড়ে গেল। বুকের ভেতর কেমন জানি ধপ ধপ শব্দ করছে। হাত পা কেমন শীতল হয়ে আসছে। আশ্চর্য! এমন কেন হচ্ছে? লিলি পেছন ফিরে তাকালো৷ শাহেদ বলল,
-তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
লিলির ভ্রু কুচকে এলো৷ বলল,
-আমার জন্যে? তুমি জানতে আমি এখানে আছি?
শাহেদ হাসলো। কিছু বলল না৷ লিলি খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
-পিছু করছো নাকি আমার?
শাহেদ এই প্রশ্নটারও জবাব দিলো না৷ বলল,
-একটু সময় দাও প্লিজ। ফাইব মিনিট। জাস্ট ফাইন মিনিট দাও।
লিলি খানিকটা খোঁচা মেরে বলল,
-আমার সময় নিয়ে কী করবে তুমি? তোমাকে তো সময় দেওয়ার মানুষের অভাব নেই৷
শাহেদ এবার এগিয়ে এলো লিলির দিকে। লিলির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-ডিভোর্সের ব্যাপারে আলোচনা করতাম৷
লিলির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো৷ হঠাৎই যেন সে বাক শক্তি হারিয়ে ফেললো। কী বলবে ভেবে পেলো না। লিলি অর্নবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুই গাড়িতে গিয়ে বস৷ আমি আসছি৷
অর্নবকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো৷ তার ইচ্ছে ছিল সে এখানে থেকে এদের কথাবার্তা শুনবে৷ লিলির কারণে সেটা সম্ভব হলো না৷ অর্নব চলে গেলো৷

লিলি একটা চেয়ার টেনে বসলো। অতোশির দিকে একবারের জন্যে তাকালোও না৷ অতোশি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
-শাহেদ আমি যাই।
শাহেদ বলল,
-বসো। এক সাথে যাবো৷ বেশি সময় নিবো না৷
-তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই...
-ব্যক্তিগত ব্যাপারটায় তুমিও জড়িয়ে আছো৷ বুঝেছো? আর আমার পা এখনও একদম ভালো হয়নি৷ কেউ একজন পাশে থাকলে ভরসা পেতাম। এই শহরে আমাকে চিনে এমন কেবল তুমিই বাকি আছো৷ বসো একটু৷
অতোশি কিছু বলল না আর৷ বসে পড়লো৷ শাহেদ লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,
-লিলি? কী খাবে বলো? অহ তোমার তো খাওয়া হয়েছে৷ অতোশি? কী নেবে?
-কিছু না৷ তুমি প্লীজ কী বলবে জলদি বলো৷ আমার দম বন্ধ লাগছে৷
লিলির গা জ্বলে গেল একদম৷ রাগ একদম মাথায় উঠে গিয়েছে৷ ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দিক৷ কেবল রেস্টুরেন্ট বলে চুপ থাকলো। শাহেদ বলল,
-লিলি, অরু কেমন আছে?
-ভালোই।
-যাক। ও ভালো থাকলেই আমি ভালো।
-ন্যাকামি না করে কী বলবে বলো?
শাহেদ হাসলো। বলল,
-ন্যাকামি না কী সেটা তুমি বুঝলে এই কথা বলতে না৷ যাই হোক, তুমি কি নিশ্চিত ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছো যে আমাকে ডিভোর্স দিবে?
-হু।
-আমাকে কি আর একবার প্রমাণ করার সুযোগ দিবে যে অতোশি এবং আমার মাঝে কিছু নেই? সবটাই তোমার ভ্রান্ত ধারণা?
-কোনটা ভ্রান্ত আর কোনটা অভ্রান্ত তা বোঝার বেশ বয়স হয়েছে আমার৷
-তুমি কি ভাবছো ডিভোর্সের পর আমি আর অতোশি বিয়ে করে ফেলবো?
-এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই৷ সবই স্পষ্ট।
শাহেদ এবার একটু শব্দ করেই হাসলো৷ বলল,
-তাহলে ডিভোর্সই সই?
-হ্যাঁ৷
-উকিলের কাছে কবে যাবো?
-কবে যেতে চাও?
-আমি বেকার মানুষ। আমাকে যখন বলবে তখনই চলে আসবো।
-আচ্ছা৷ তাহলে দু'দিন পর যাই৷ আমার কিছু কাজ আছে৷ সেগুলো সেরে নেই আগে৷
-আচ্ছা৷
-ঠিকানা টেক্সট করে দিবো।
-আমার লাস্ট দুইটা রিকোয়েস্ট। এগুলো তোমাকে রাখতেই হবে। প্লীজ৷
-আমাকে এসব বলে লাভ নেই৷ তোমার কোনো রিকোয়েস্টের মূল্য নেই আমার কাছে।
-তা আমি জানি৷ তবুও শোনো প্লীজ৷ এগুলো এতো কঠিন কিছু না৷ তুমি চাইলেই পারবে৷ লাস্ট একটা উইস। প্লীজ। অন্তত একটা তো ডিজার্ভ করি নাকি?
-বলো, শুনি৷
-উকিলের ওখানে আসার সময় অরুকে নিয়ে এসো। আর অর্নব ভাইকে সাথে নিয়ে এসো না৷ প্লীজ, লাস্ট আমার এই দুইটা কথা শোনো।
লিলি কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকলো কেবল! শাহেদ বলল,
-ঠিকাছে?
-আচ্ছা, ঠিকাছে।
শাহেদের গলা দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কেবল৷ যেন বুকের উপর থেকে ভারী একটা পাথর সরে গিয়েছে৷ মেয়েকে অনেক দিন পর দেখতে পাবে এমন একটা আনন্দ তার ভেতরটাকে কেমন প্রাণবন্ত করে তুললো৷ শাহেদ উঠে দাঁড়ালো৷ বলল,
-থ্যাংকিউ লিলি। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার৷ আসি৷ দু'দিন পর দেখা হবে৷ অতোশি চলো!
তারা চলে গেল। লিলি চুপচাপ বসে থাকলো৷ তার এখান থেকে একদমই উঠতে ইচ্ছে হলো না৷
.
লিলির বাসায় ফেরার কথা ছিল না৷ তার টিএসসিতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল৷ সেই প্ল্যান ক্যান্সেল করে বাসায় চলে এলো সে। বাসায় এসে দেখলো তার বাবা তমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তমাকে ডাকছেন অথচ তমা সাড়া দিচ্ছে না৷ আশ্চর্য ব্যাপার। তমার কী হয়েছে? ইদানীং ও কেমন জানি হয়ে গিয়েছে৷ ঠিক আগের মতো নেই৷ কারো সাথেই তেমন কথা বলে না৷ কেউ কথা বললেও ও খুব একটা কথা বলে না৷ অন্য সময় আসাদ সাহেব কোথাও এলে তমা কতো কি করতো৷ অথচ আজকাল তেমন কিছু তো দূরে থাক, তমা তার বাবার সাথে বিশেষ কথাও বলছে না৷ কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা করছে৷ ব্যস৷ অথচ তমা তো তেমন মেয়ে না৷ তাহলে ও এমন করছে কেন? কী হয়েছে ওর?

লিলি তমার দরজার কাছে গেল। বলল,
-কি ব্যাপার বাবা৷ এখানে কী করছো?
ওর বাবা কেমন নরম স্বরে বললেন,
-তমাকে ডাকছি। মেয়েটা আমার সাথে ভালো করে কথাও বলছে না৷ আমার খারাপ লাগছে৷ ওর কী হয়েছে বল তো?
-আমি জানি না বাবা৷ তবে আমি লক্ষ্য করেছি৷ কেমন অচেনা অচেনা বিহেভ করছে ও৷
আসাদ সাহেব কিছু বললেন না৷ দরজার কাছ থেকে সরে এলেন৷ লিলি তমাকে ডাকলো,
-তমা? বাবু কি জেগে আছে?
তমার জবাব পাওয়া গেল না৷ লিলি আবার ডাকলো৷ এবার জবাব না পাওয়া গেলেও দরজা খুলে গেল। তমা বাবুকে লিলির দিকে এগিয়ে দিলো৷ লিলি বাবুকে কোলে নিতে নিতে বলল,
-তমা?
-হু?
-তোর কী হয়েছে বলতো?
-কই? কী হবে?
-কিছু তো হয়েছে। তা না হলে তুই এমন বিহেভ করতি না৷
-আমার কিছুই হয়নি।
-সত্যি করে বল! শাহেদ কি কিছু বলেছে তোকে?
তমা বেশ রাগি দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো। বললো,
-দুলাভাই কী বলবে? আর বললেও তাতে তোমার কী? তুমি উনার কী হও?
লিলি যারপরনাই অবাক হলো৷ অবাক স্বরে
বলল,
-আশ্চর্য ব্যাপার৷ তমা তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন?
-যেভাবে বলছি সেটাও কম মনে হচ্ছে আপু৷ তোমার এখনও ডিভোর্স হয়নি, অথচ এর আগেই পর পুরুষের সাথে বাইরে ঘুরাঘুরি শুরু করেছো? এসব কী আপু? তোমার ভালোবাসা কই গেল?
লিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তমার দিকে৷ সে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে আছে৷ যেন তমার মুখ থেকে এমন কথা শুনবে বলে কখনও ভাবেওনি৷ তমা বলল,
-ভালোবাসা এমন হয় জানা ছিল না আপু৷ ওই মানুষটা তোমার যন্ত্রণায় মরছে, এক্সিডেন্ট করে ঘরে পড়ে আছে, জ্বরে তার যাচ্ছেতাই অবস্থা, যে তার লেখালেখির ছন্দ হারিয়ে পাগল প্রায়, তুমি সেই মানুষকে সামান্য একটা কারণ ধরে এভাবে দূরে ঠেলে দিয়ে কীভাবে এমন আনন্দে দিন কাটাও আপু?
লিলির চোখে জল চলে এলো৷ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তমার দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে তমা এসব কথা বলছে। তমা আবার বলে উঠলো,
-পুরনো ভালোবাসার মানুষকে দেখে যে কেউই খানিকটা বিভ্রান্তিতে চলে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক। এর জন্যে স্বামী ত্যাগ করাটা অপ্রাসঙ্গিক। এটা কোনো কারণই না। এখন তো আমার সন্দেহ হচ্ছে যে অর্নব ভাইয়ের সাথে তোমার আগ থেকে সম্পর্ক ছিল কি না!
আসাদ সাহেব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না৷ রাগটা বেশ চড়ে গিয়েছিল৷ রাগের তোড়ে তিনি তমাকে একটা চড় দিয়ে বসলেন। কঠিন স্বরে বললেন,
-তমা, বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা কি তোকে শেখাইনি আমি? ওর তোর বড় বোন। ওর সাথে তুই এমন বিহ্যাভ করতে পারিস না।
চড়ের ভার সামলে তমা হাসলো৷ তার চোখে জল৷ তাও সে হাসছে। বলল,
-বড় ছোটদের পার্থক্য অন্তত তুমি শিখিও না বাবা৷ তোমার মাঝে এই ন্যায় নীতি কিংবা ভালো মানুষি মুখোশটা মানায় না৷ তুমি অনেক কঠিন এবং কুৎসিত মনের মানুষ। দুলাভাই মানুষটা সহজ সরল বলে তার সঙ্গে এভাবে এমন একটা চক্রান্ত করতে পেরেছো। অন্য কেউ হলে মোটেও পারতে না৷ টাকাওয়ালা লোকেরা সহজ সরল মানুষদের উপরই বেশি নির্যাতন করে। তুমিও তেমন৷ তোমার টাকার অনেক বড়াই৷ আপু, শোন, আমাদের গুণধর বাবা কী করেছে। বাবা যখন চট্টগ্রাম ছিলেন তখন দুলাভাই সেখানে গিয়েছেন৷ তোমাদের বিচ্ছেদের ব্যাপারে কথা বলতে৷ বাবা যাতে তোমাকে একটু বোঝান৷ ভাইয়া ঢাকা থেকে অনেকবার কল দিয়েছেন৷ আমার বড় লোক বাবা তো ভাইয়ার ফোন তোলেন না৷ বাবাকে ফোনে না পেয়েই ভাইয়ার চট্টগ্রাম যাওয়া৷ চট্টগ্রাম যাওয়ার পর ভাইয়া যখন বাবার সাথে দেখা করতে যায় তখন আমার বাবার এতো ব্যস্ততা বেড়ে যায় যে ভাইয়ার সাথে দু'দন্ড আলাপ করার সুযোগ হয় না৷ অথচ পুরোদিন তিনি ফ্রিই ছিলেন৷ বাবা সন্ধ্যায় পাঁচ মিনিটের জন্যে ভাইয়ার সাথে দেখা করেন৷ তখন কেবল এটা বলা হয়েছে ঢাকায় গিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে৷ আর কোনো কথাই শোনেননি তিনি। চিন্তা করো আপু, বাবা দুলাভাইকে কতোটা ঘৃণা করে। সব এখানেই শেষ নয়৷ আমাদের পিতামহ এই সুযোগে অর্নব ভাইয়াকে মাঝখানে টেনে আনেন৷ তার বুদ্ধির ধারেই তুমি এতো দিন অর্নব ভাইয়ার সাথে ঘুরছো। ওই যে একদিন রাতে ফোন দিলাম না দুলাভাইকে? তার নাম্বার বিজি ছিল! ওই সময়ে দুলাভাই আসলে অর্নব ভাইয়ের সাথে কথা বলছিল, অতোশি আপুর সাথে না। অর্নব ভাই দীর্ঘসময় নিয়ে দুলাভাইকে থ্রেট দিলেন৷ ভাইয়া যেন আমাদের বাড়িতে না আসে৷ যোগাযোগ না রাখে। তার লেখালেখি যাতে বন্ধ হয়ে যায় সে ব্যবস্থাও নিচ্ছিলেন৷ দুলাভাইয়ের একটা বইয়ের কাজ চলছিল৷ সেই বইটার কাজ মাঝ পথে এসে আঁটকে আছে কে জানো? অর্নব ভাই টাকা দিয়েছিলেন প্রকাশক ভাইকে। দেখো, টাকার কতো পাওয়ার৷ একদিকে দুলাভাইয়ের বই বন্ধ করে দিলো, অন্য দিকে তোমার ভালোবাসার কষ্ট মুছে তোমাকে বেশ প্রাণবন্ত করে তুললো। এই হলো টাকার ক্ষমতা। টাকার কাছে আমরা সকলেই বিক্রিত। মাপ করে দিও আপু৷ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি আসলে। এসব ভাবতে ভাবতে আমার অবস্থা খারাপ।
একসাথে কথা গুলো বলে তমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের রুমে ঢুকে দরজা আঁটকিয়ে দিলো। আসাদ সাহেব চুপচাপ নিজের রুমে চলে এলেন। লিলি তার বাবুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো৷ ঘরের তিন কোণায় তিনজন মানুষ। অথচ মনে হচ্ছে এই ঘরটা ভীষণ খালি৷ অনেক বছর কেউ থাকে না এখানে।
.
মাঝ রাতে লিলি তমার দরজায় টোকা দিলো। একবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,
-দরজা খোলা আছে।
লিলি ভেতরে ঢুকলো৷ দেখলো তমা বই পড়ছে৷ লিলি ওর কাছে গেল। বিছানার কাছে বসে কেমন ভেজা স্বরে বলল,
-ও এক্সিডেন্ট করেছে কীভাবে?
তমা যেন বিরক্ত হলো। বলল,
-তা জেনে তুমি কী করবে?
-আমার টেনশন হচ্ছে ওর জন্যে৷
তমা অবাক হয়ে তাকালো৷ লিলি মাথা নিচু করে বলল,
-তমা? আমি ভালো নেইরে। আমি একদমই ভালো নেই৷ তোর দুলাভাই আজ ডিভোর্সের ডেট জেনে গেল! সে নিজ থেকেই ডিভোর্সের কথা বলেছে৷
তমা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না৷ যেন এমনটা হওয়ারই ছিল। সে খানিক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-কোনো কিছুকে অতিরিক্ত কষলে সেটা তেতো হয়ে যায়৷ তোমার ক্ষেত্রে তো আর তার ব্যতিক্রম হবে না! তাছাড়া ডিভোর্স তো তুমিই চাচ্ছিলে তাই না?
লিলি চুপ করে থাকলো৷ কিছু বলল না৷ তমা চুপ থাকলো৷ কিছুক্ষণ পরই লিলি খানিকটা ফুঁপিয়ে উঠলো৷ সে ভেজা স্বরে বলল,
-তমা একটু এদিকে আয় না! মা তো নেই। তোকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদবো৷
তমা দ্রুত বোনের কাছে এসে বসলো৷ বলল,
-আপু, প্লীজ কান্না করিও না৷
লিলি তমার কথা শুনলো না৷ সে ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকলো ভীষণ। ভেজা স্বরে বলল,
-আমি এখন কী করবো রে তমু?
তমা হাসলো। বলল,
-আমি যা বলবো তা করিও৷ দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে৷
লিলি কিছু বলল না আর৷ তমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখলেন আসাদ সাহেব। তাঁকে বেশ আবেগাপ্লুত হতে দেখা গেল৷
.
টানা দু'দিন শাহেদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না৷ সে মিরপুরে নেই৷ মিরপুরের বাসাটা তালাবদ্ধ। এছাড়া কোথাও যাওয়ার কথা না৷ অতোশিকে ফোন করা হয়েছে৷ অতোশি জানালো ওই দিনের পর থেকে শাহেদের সাথে তার যোগাযোগ নেই৷ ভারী চিন্তায় পড়ে গেল আসাদ পরিবার।

তৃতীয় দিনের দিন শাহেদের নাম্বার থেকে কল এলো৷ হন্তদন্ত হয়ে ফোন ধরল লিলি৷ যেন এক কোটি বছর ধরে এই কলটার অপেক্ষা করছে সে৷ কল ধরে ফোন কানে দিয়ে চুপ করে থাকলো লিলি৷ শাহেদ বলল,
-লিলি?
লিলির সমস্ত শরীর যেন কেঁপে উঠলো৷ শাহেদ বলল,
-ঠিকানা তো দিলে না।
লিলি কী বলবে ভেবে পেল না৷ সে যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শাহেদ আবারও বলল,
-শুনছো?
লিলি কোনো মতে বলল,
-আমাদের বাসার নিচে চলে আসো৷ এক সাথে যাবো।
শাহেদ হাসলো। বলল,
-আমি সেদিকেই আসছি। তুমি প্লীজ বাবুকে নিয়ে নেমে আসো জলদি। ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে৷
লিলি চট করেই হেসে ফেললো৷ অরুর জন্যে শাহেদের এতো টান যেন তাকে কিছুটা আনন্দিত করলো। সে মুগ্ধ হলো৷
.
তমা বাবুকে শাহেদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। শাহেদ কাঁপাকাঁপা হাতে বাবুকে কোলে নেয়৷ তারপর বুকের সাথে একদম মিশিয়ে ফেলে। বাবু কান্না করে না৷ সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রাখে৷ শাহেদের বুকটা পাতলা হয় খানিক। অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব হয়। তার ভীষণ কান্না পায়। বাবুকে কোলে জড়িয়ে তার ভীষণ কান্না করতে ইচ্ছে হয়। শাহেদ কান্না করে না৷ বাবুকে কোলে নিয়ে কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে তমার দিকে তাকায়। তমা হাসে৷ বলে,
-আপনাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দেওয়ার কথা ছিল৷ সেটা দিলাম। আপনার জীবনের সবচে বড় গিফট!
শাহেদ তমার কথাটা ঠিক বোঝে না৷ তাও হাসে৷ আজ তার হাসির দিন৷ বুক ভরা প্রশান্তির দিন৷ সে গাড়িতে উঠে বসে৷ তার পাশে লিলি বসে আছে৷ লিলি আজ শাড়ি পরেছে৷ কালো রঙের শাড়ি৷ তাকে মারাত্মক সুন্দর লাগছে৷ তাকে দেখার লোভ হচ্ছে শাহেদের৷ অথচ সে তাকাতে পারছে না৷ মেয়েটা আজ এতো সুন্দর করে সাজলো কেন? না সাজলেও তো হতো! শাহেদ আড় চোখে একবার দেখলো৷ লিলি চোখে গাঢ় কাজল মেখেছে৷ ঠোঁটের কাছে ছোট্ট কৃত্রিম তিলটাও আছে। আশ্চর্য ব্যাপার! মেয়েটা তিল দিলো কেন? শাহেদ অবাক হয়৷ আরো বেশি অবাক হয় যখন দেখে তাদের গাড়িটা মিরপুরের দিকে যাচ্ছে৷ তখনই তার সন্দেহ হয়৷ সে জানতে চায়,
-উকিলের বাসা কি মিরপুরে?
লিলির চোখ ভিজে আসে চট করেই৷ তার গাল বেয়ে জল পড়ে। সে বলে,
-মিরপুর আমার মেয়ের বাবার বাড়ি৷ আমরা সেখানে যাচ্ছি৷
শাহেদ রোবটের মতো হয়ে যায়৷ সে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে লিলির দিকে৷ লিলিও তাকিয়ে থাকে৷ যেন কতোদিন, কতোদিন তারা একে অপরকে দেখে না৷ শাহেদ কী বলবে ভেবে পায় না৷ সে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। তার চোখে জল। সে কাঁদছে৷
লিলি শাহেদের দিকে আরেকটু সরে আসে। একদম তার গা ঘেঁষে যায়৷ শাহেদের কাঁধে মাথা রেখে তার হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে, ভেজা স্বরে বলে,
-আ'ম সরি৷ আ'ম এক্সট্রিমলি সরি শাহেদ৷
শাহেদ বাক রুদ্ধ হয়ে বসে থাকে৷ তার যেন আজ শব্দ নেই৷ কথা বলার শক্তি নেই৷ সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে না৷ তার প্রবল আনন্দ সে কোনো ভাবেই প্রকাশ করতে পারছে না৷ সে কাঁদছে৷ কেবল কেঁদে যাচ্ছে৷

সত্যিই তমা, এতো বড় গিফট শাহেদ জীবনেও পায়নি৷ পাবেও না৷ তোমার এই দানের জন্যে শাহেদ এবং গল্প উভয়ই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ৷
.
(সমাপ্ত)
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ
.
(গল্পটা আরো বড় করে লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার ঝামেলাটাই সব শেষ করে দিলো৷ আমি যখনই একটা পর্বের গল্প শুরু করি তখনই দেখা যায় নানান সমস্যা এসে হাজির। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বাবার অফিসে থাকতে হয়৷ এরপর টিউশনি করে বাসায় আসতে আসতে বাজে রাত আটটা৷ তখন আর গল্প লেখার মুড থাকে না ভাই৷ অনেক সময় নিয়ে এই গা ছাড়া এন্ডিংটা দিলাম৷ ক্ষমা করবেন সকলে)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url