ভালবাসার গল্পঃ জেগে থাকা রাতের জ্যোৎস্না। লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
ভালবাসার গল্পঃ জেগে থাকা রাতের জ্যোৎস্না। লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
সাদ আহম্মেদ
নীতুর সর্দি লেগেছে। বারবার নাক টানছে। আমি ফোনের এপাশ থেকে বুঝতে পারছি ওর দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা। হোয়াটসএপে খুব একটা ভালো কথা শুনা যাচ্ছেনা। আমি আবার মেসেঞ্জারে চেষ্টা করলাম কথা বলতে। নীতু বারবার বলছে, আমি ভালোবাসি। আমি তারপরও আরেকবার আরেকটু স্পষ্ট করে শোনার জন্য ওকে ফোন করেই যাচ্ছি। ও ১৪ তম চেষ্টায় ফোন ধরার পর আমাকে বললো, হাসিব থামো। হবেনা তো ওমন? বুঝতে পারছোনা? আমি মৃদু হেসে বলি, না হতে হবে। আমার ভালো লাগেনা। দিন কাটেনা। আমরা প্রতিবার যখন কাছাকাছি বসে থাকতাম, তুমি হাত ধরে যেভাবে ভালোবাসি বলতে ওভাবে বলতে হবে।
নীতু হাসে। আমি কল্পনা করতে পারি ও এখন ডান চোখের ভ্রু উচিয়ে মুখে হাত দিয়ে হাসছে। ওর হাসি প্রথম যখন শুনেছিলাম তখন মনে হয়েছিলো মেয়েটার ঠান্ডা লেগেছে।
এখন মনে হয়, আচ্ছা এমন হতে পারে যে মৃত্যুর পর আমি খোদার সাথে একটা চুক্তি করলাম। চুক্তিনামায় একটাই চুক্তি। আমার প্রতিটা ভালো কাজের বিনিময়ে ওর খসখসে বিচ্ছিরি রকমের হাসিটা এক মিনিট করে শুনতে দিতে হবে। নীতুর হাসি কমে আসলে আমাকে বললো, তুমি এমন পাগল পাগল করো মাঝে মাঝে। আমি তোমার থেকে এখন প্রায় ৭০০০ কিমি দূরে রাত না হওয়া একটা ঠান্ডার শহরে বসবাস করছি। তোমার হাতটাও ছুয়ে দিতে পারছিনা। আমি দীর্ঘশ্বাসটা টেনে আরেকটু বড় করে ওকে বললাম, তুমি আমার মনে এসো কাউকে না জানিয়ে, বৈশাখী ঝড় তুলে অল্প করে ভালোবেসো নীতু আবার হাসছে। আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ওর হাসি শুনি। ওকে একটু পর বলি, বেশি সস্তা হয়ে গেছে কবিতা, আমি তো পারিনা জানোই। নীতু আমাকে ফোনের ওপাশ থেকে তিনটা চুমু দিয়ে বলে, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।সত্যি, সত্যি, তিন সত্যি। ফোনটা রেখে দেওয়ার পরও কানে বারবার ভালোবাসি কথাটা বাজতেই থাকলো। এমন কেন লাগে? যখন খুব ভালোবাসার মানুষটা তার মনটা মেলে ধরে, তখন এমন কেন লাগে? আমি উত্তর খুঁজিনা। ঘুমিয়ে যেতে হবে।
কাল সকালে একটা ইন্টারভিউ আছে। লিফট বিক্রি করে এমন একটা কোম্পানী। আমি মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করিনি, কোনরকমে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা মাসে তিনটা টিউশনী করে রাতের বেলা মেসে এসে পাউরুটি দিয়ে চা ভিজিয়ে খাওয়া খুব সাধারণ একটা বালক। নয় মাস ধরে বেকার বসে আছি এটা ছাড়া আমি আর কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত না। এটা নিয়ে এতো ভাবতামনা, এখন ভাবতে হচ্ছে কারণটা নীতু। নীতুকে বিয়ে করতে আমার খুব শখ হয়। এই কথাটা আমি কতবার ওকে বলেছি, প্রতিবার শোনার পর ও খিক খিক করে হাসে। আমাকে বলে, মানুষ এতো শখ করে। আর তুমি শখ করলা আমাকে বিয়ে করার। এই যে ও হাসে, এই যে আমি ওর হাসির শব্দটা শুনতে পাই এইজন্য এমন উদ্ভট কথাগুলো আরো বেশি বলি। আমি সারাদিন ওকে নিয়ে ভাবি, প্রতিটা রাতে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে, কখনো ক্ষুধার জ্বালাতে কোকাতে কোকাতে, কখনো মাথা ব্যাথার প্রচন্ড যন্ত্রণায়- আমি সবসময় ওকে নিয়ে ভাবি। আজ রাতে অথবা এমন আরো হাজারটা রাতে আমি ওর সাথে গল্প করি। যত কষ্ট থাক সব ভুলে যাই। কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে যাই আমি টের পাইনা। আজকেও পেলাম না।
ইন্টারভিউ রুমটা খুব ছোট্ট। আমি এখনো রিসেপশনে বসে আছি, কিন্তু যখনই কেউ বের হয় ভেতরে কি হচ্ছে কম বেশি বোঝা যায়। আমি কয়েকবার উকি দিয়েছি। চোখে চশমা, ছাই রঙের কোট গায়ে দেওয়া একটা লোক কলম নাচিয়ে নাচিয়ে খুব ভাব নিয়ে প্রশ্ন করছে। ইন্টারভিউয়ের আগে আমি কিছু মুখস্থ উত্তর তৈরী করে নিয়ে যাই। আজকে কেন জানি, ভবিষ্যতে কি হতে চাচ্ছেন- এই প্রশ্নটার আপডেট করা উত্তরটা মনে পড়ছেনা ঠিকমত। রিসেপশনে রুমিলা নামে একটা রোগা মেয়ে বসে আছে। আমার দিকে একটু পরপর আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি যে তার তাকানোটা বুঝতে পারছি এটা হয়তো সে বুঝতে পারছেনা। একটা সময় সে তাকালে আমি স্পষ্ট ভাবে তার দিকে তাকাই। অদ্ভূত ব্যাপার সে চোখ সরিয়ে নিচ্ছেনা। আমি নিজেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমার বন্ধু ফজলুর রহমান কমল, বর্তমান মেসমেট আমাকে ইন্টারভিউতে আসার আগে বারবার বলে দিয়েছে রিসেপশনে মেয়ে থাকলে যেন ভাব করে আসি। তার মতে রিসেপশনিস্ট ম্যাডামরা খুব পাওয়ারফুল হয়, এরা চাইলে সহজেই আমার মত গরীব মেধাবীদের চাকরী হয়ে যেতে পারে।
এসব আজেবাজে কথা ভাবতে ভাবতে মহিলা আমার নাম ধরে ডাকা শুরু করলো। আমি কিছু উত্তর দেয়ার আগে বললো, আপনি হাসিব জুবায়ের না? আমি হাসিমুখে বললাম, জ্বী। ভেতরে যাবো? মহিলা আমার দিকে না তাকিয়ে তার ডেস্কের কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, যাবেন না? আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে ইন্টারভিউ দিতে চলে গেলাম। ভেতরে ঢুকে খেয়াল করলাম সবাই খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছে। আমি হাসিমুখে বললাম, ভালো আছেন? ব্যাপারটা খুব উদ্ভট হয়েছে, সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝলাম আমার প্রথম বলা দুই শব্দে আমি রিজেক্ট খেয়ে গেছি। ভয়ানক ব্যাপার। চাকরী খুব জরুরী দরকার। টিউশনী মাত্র এখন দুইটা করি। টাকার অভাবে মাসের শেষ আট দিন ৫২ টাকা নিয়ে ঘুরছি। আম্মুকে ফোন করার টাকাটাও নেই।মেসের ভাড়া কোনভাবে হয়তো ম্যানেজ হয়, আর কিছুই করা যায়না। বিপদে আছি আমি আইজুদ্দিন। আমি কি আরো কিছু বলবো? এমন কিছু যাতে তারা আমার গাধামী ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে একটা চাকরী হাতে ধরিয়ে দেয়। কি বলা যায়? বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর চশমা পড়া ভদ্রলোক আমার দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমরা তো ভালো নাই।
দেশের অবস্থা গুরুতর। নতুন বাজার খোলা যাচ্ছেনা, পুরনো ব্যবসাগুলো সব থমকে আছে হরতাল ধর্মঘটের আড়ম্বরে। আমি বাংলার ছাত্র ছিলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। বাংলা বই পড়েন নাকি হাসিব সাহেব? আমি হাসিমুখে বললাম, জ্বী। কাল পড়েছি কড়ি দিয়ে কিনলাম। বিমল মিত্রের লেখা, খুব ভালো উপন্যাস স্যার। দ্বিতীয় ভদ্রলোক খুক খুক করে কাশি দিয়ে হাতের কাছে রাখা পানির গ্লাসে এক চুমুক পানি খেলো। আমি বুঝলা্ এই কাজটা সে ভাব দেখানোর জন্য করেছে। আমিও তার ভাবে গলে গিয়ে তাঁকে একটা অতিরিক্ত সালাম দিয়ে বললাম, স্যার... উনি আমাকে বললেন, আপনার রেজাল্টতো অনেক ভালো। দেশের বাহিরে চলে যাবেন না তো আবার? আমি হাসিমুখে বললাম, আপাতত ইচ্ছা নাই। আপনাদের প্রতিষ্ঠানের মত ভালো কোথাও চাকরী করতে চাচ্ছি এখন। তাছাড়া আমার আর্থিক অবস্থা দেশের বাহিরে যাওয়ার মত নয়। মনে মনে নিজেকে নিজে সাবাশ দিলাম। চমৎকার উত্তর হয়েছে।
আমি নিশ্চিত সামনের তিন ফুলবাবু খুব খুশি হয়েছে আমার উত্তরে। আমি পরের প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিন নম্বর ফুলবাবু এতোক্ষণ সব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছিলো। সে এবার হাসিমুখে বললো, জুবায়ের সাহেব আপনার মত এমন মুখস্থ উত্তর দিয়ে অনেকেই আমাদের বোকা বানাতে চায়। আমরা কিন্তু এতো বোকা না। আমিও আপনার বয়সে অনেক ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়িয়েছি। এমন অনেক গাজাখুরি গল্প করতাম। পরে চাকরী না পেয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। আপনারা তরুণ প্রজন্ম তো আবার মাস শেষে বেতন ছাড়া চলতে পারেন না। ব্যবসা করার সাহস আর ধৈর্য্য আপনাদের নাই। যাই হোক, আমরা আপনাকে পরে জানাবো। কষ্ট করে আসার জন্য অশেষ মেহেরবানী। অফিস থেকে বের হয়ে মনে পড়লো আমার জুতার মোজাটা ফুটো হয়ে গেছে। এক জোড়া মোজা হাতে পায়ে ধরে হয়তো বিক্রেতার থেকে ২৫ টাকায় কেনা যাবে। কিন্তু এই টাকাটা খরচ করা সম্ভব না। ৫ দিন রাতে বন রুটি কেনা যাবেনা। আমি শিস বাজাতে বাজাতে বাসে উঠলাম। বাস ভাড়া ৮ টাকা লাগবে। এইজন্য রুটির সাথে ২ দিন চা খাওয়া বাদ দিতে হবে। শুকনা রুটি অবশ্য স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কোন কবি বলেছেন তা মনে নেই। রাতের বেলা মেসের ছাদে উঠে ফোন দিলাম নীতুকে।
নীতু দুবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরে বললো, ঠান্ডা লাগছে। চা বানাচ্ছিলাম। চিনি কম দিয়ে আজকাল চা খাই। ভালো লাগেনা একদম। তিতকুটে। আমি হেসে বলি, আচ্ছা তোমার ক্লাস কেমন হচ্ছে? নীতু হেসে বলে, ক্লাস ভালো লাগেনা। আমার ইচ্ছা করে স্ট্যানফোর্ডের পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরে ঘুরে দেখি।আমার ভাইয়া এখন স্ট্যানফোর্ডের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছে, বায়ো ইনফরমেটিক্স ডিপার্টমেন্টে। ভাইয়ার থেকে কত বছর ধরে স্ট্যানফোর্ডের গল্প শুনেছি। এখন যখন নিজে পড়ি কি যে একটা অদ্ভূত অনুভূতি হয় বোঝাতে পারবোনা।তুমি কেন এখানে এপ্লাই করো না পিএইচডি এর জন্য? তোমার তো রেজাল্ট ভালো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, আমি হতদরিদ্র মানুষ নীতু। চান্স পেলেও প্লেনের ভাড়া দিতে পারবোনা।তবে তোমার জ্ঞাতার্থে জানাই, আমি এইবছর চারটা ইউনিতে এপ্লাই করেছি ইউএসএ তে। অসাধারণ সব মোটিভেশন লেটার লিখেছি। দেখি যদি হয়, তাহলে আম্মুকে বলবো। হয়তো কিছু একটা হবে।হয়তো না। নীতু চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ।
তারপর বলে, হাসিব একটা কথা বলি। তুমি কখনো কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ করবেনা। তুমি দরিদ্র এই কথাটাও আর বলবেনা। জানো, আমেরিকাতে কত লোক রাস্তায় শুয়ে থাকে। এরা কিন্তু টাকার অভাবে দরিদ্র না। এদের কেউ নেই এইজন্য এরা দরিদ্র। এরা জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে এখন রাস্তায় ঘুমায়, ড্রাগস নেয়, নিজেকে একটু শান্তি দিতে যা ইচ্ছা করে বেড়ায়। তোমার তো আমি আছি তাই না। গত তিনবছরে একবার এমন হয়েছে আমি তোমার থেকে একটু দূরে গেছি। যত কিছু হোক, আমি সবসময় তোমার সাথে আছি। জানো তো? আমার মাঝে মাঝে কাঁদতে ইচ্ছা করে। এই যেমন এখন ইচ্ছা করছে। এই কান্নাটা আনন্দের। আনন্দটা হয় যখন মনে হয় নীতুর মত একটা অসাধারণ মানুষ আমাকে ভালোবাসে এটা ভেবে। মেয়েটা আমার থেকে গুনে গুনে ৮ বছরের ছোট। কিন্তু যখন কথা বলি মনে হয় ও আমার থেকে অনেক বড়। পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল সমস্যাটা আমার মত প্রেমিকদের। এরা হাজার লক্ষবার চেষ্টা করলেও বলতে পারেনা কাউকে কতটা ভালোবাসা যায়। আমিও পারিনি। নীতুকে আমি বলি, তোমার নামটা নীতু রেখেছে কে? নীতু হেসে বলে, তোমাকে আগেই বলেছি। আমার ফুফু আমি হওয়ার পর আমাকে দেখে বাবাকে বলেছিলো, আল্লাহ এই মেয়ের তো চোখ অনেক বড়। নিশ্চিত ১০-১২টা প্রেম করবে। ফরিদ তুই এর নাম নীতু রাখ। নীতু নামটা শুনেই ছেলেরা সাবধান হয়ে যাবে। বুঝে যাবে, এ যেন তেন মেয়ে নয়। এ হলো প্রেমকুমারী। আমি হাসি। যতবার এই গল্পটা ওর কাছে শুনি ততবার হাসি। নীতু তোমাকে হাজারটা জেগে থাকা রাতের জ্যোৎস্না উপহার দিলাম।
তুমি আমার কবিতা হয়ে থেকো, সবচেয়ে প্রিয় কবিতা। সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের ফোন পেয়ে।আম্মু খুব রেগে আছে তিনদিন কথা বলিনা তাই। আমি ইতুমিতু করে বললাম, আম্মু কয়েকদিন খুব ঝামেলায় ছিলাম। কাল রাতে বাসায় এতো দেরী করে আসছি তোমাকে এইজন্য আর বিরক্ত করিনাই। রাগ কইরোনা প্লীজ। আম্মু ঝাড়ি দিয়ে বললো, আমি একা একা কুমিল্লায় পড়ে আছি। তোর বাবা সকালবেলা বের হয়ে শান্ডার তেল বিক্রি করে, সারাদিন খবর থাকেনা। আজকাল তুইও ভুলে গেছিস। মাশাল্লাহ আমি যে একটা মানুষ কারোও কোন খেয়াল নাই। আমার বাবা রিটায়ার্ড সরকারী দ্বিতীয় শ্রেণীর অতি সৎ কর্মকর্তা। সে আজকাল কিছুটা হোমিওপ্যাথির জ্ঞান অর্জন করেছে বিধায় বাসা থেকে ৫০০ মিটার দূরত্বে একটা দোকান নিয়ে মানুষের রোগ বালাই এর হোমিও চিকিৎসা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মা এটাকে রাগ করে শান্ডার তেল বলেছে। আমি হাসিমুখে মা কে বলি, মা বাবাকে তার মত কাজ করতে দাও। কে জানে হয়তো সে একদিন বিখ্যাত মানুষ হয়ে যাবে, সবাই বলবে ওই দেখ ভাই হোমিও চিকিৎসক ফারুক সাহেবের বউ আর ছেলে হেটে যায়। আম্মা রাগে ফোস ফোস করে বলে, গু বলবে। তোর বাবা কি কোন মানুষের চিকিৎসা করে। তার কাছে গতকাল দুজন রোগী আসছে। রোগী কারা জানিস? একটা মুরগী আর একটা রামছাগল। সে মুরগীকে সাদা হোমিও বড়ি গুড়া করে খাইয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে মুরগী আর ডিম পাড়েনা। সকালবেলা মুরগীওয়ালা বাড়ির দরজা ধাক্কায় মাথায় তুলে তোর বাবাকে মুরগী দেখাইতে নিয়ে গেছে। দুইদিন পর দেখবি গরু ছাগল, সাপ ভালুক নিয়ে লোকজন বাসায় আসবে। তোকে সবাই ডাকবে মুরগী ডাক্তারের ছেলে। কত সম্মান পাবি তাই না?
আমি ফোনে হাসতে হাসতে মারা যাই। আল্লাহ আমার বাবা মা কে কেন এত কিউট করে বানাইছে জানিনা। আমি খুব ভাগ্যবান,অতি অতি ভাগ্যবান। আম্মাকে বললাম, সকালে নাস্তা করে মেটফরমিন খেয়েছো? আম্মা শান্ত হয়ে বলে, ওষুধ খেতে ভালো লাগেনারে বাবু। তুই চলে আয় কুমিল্লায়। একসাথে থাকবো, তাও ভালো। সন্ধ্যা থেকে মেসের বারান্দায় বসে আছি। হাতে এক কাপ চা। চা আজকে আদা দিয়ে বানিয়েছি। খেতে ভালো হয়নি, আজকাল যাই মুখে দেই বিস্বাদ লাগে। বন্ধু ছোটন সকালে ফোন করে বলে, দোস্ত ২০০ টাকা ধার দে। আমি পিচিক করে বেসিনে থুথু ফেলে ওকে বললাম, দোস্ত আমাকে ৫০ টাকা ধার দিয়ে যা। তিনদিন ধরে বনরুটি আর চা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। একদিন চাকরী পেয়ে টাকা দ্বিগুণে শোধ দিবো। ছোটন ফোন কেটে দিলো দুটো অশ্লীল গালি দিয়ে। ছোটন আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। বর্তমানে সে একটি গরুর খামারে চাকরী করে। ক্যাশিয়ার টাইপ একটা কাজ। ওর একটু চোরা অভ্যাস আছে তাই বেশিদিন ওকে কেউ চাকরীতে রাখেনা। শেষ চাকরীতে তাঁকে রীতিমত গণপিটুনি দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিলো। আমার মনে হয় তার বর্তমান চাকরীটাও এখন আর নেই। ওর বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। প্রায়ই তাঁকে স্কুলের হেডস্যার ক্লাসে এসে মারতে মারতে বলতো, আলিমের ঘরে জালিম হইছে। ওর বাবা রিটায়ার্ড হওয়ার পর ২ লাখ টাকা পেয়েছিলো। কোন একভাবে ছোটন সেই টাকাটা চুরি করে পালিয়ে যায়। তিনমাস পর যখন বাসায় ফিরে তখন তার বাবার জানাযা পড়ানো হচ্ছে। ওর মা ছোটকালে পুলিশের এক হাবিলদারের সাথে ভেগে গিয়েছিলো। ভাই বোন নেই। সে খুব যত্ন করে বাবার কবরে হাত তুলে দোয়া পড়িয়েছিলো। রাতে আমার বাসায় ভাত খেয়ে সিগারেট ফুঁকে বলছিলো, একদিন অনেক বড় মানুষ হবো বুঝলি। ফুলিরে বিয়ে করে গাড়িতে ঘুরাবো। তোরে ব্যাকসিটে চড়ায় আইসক্রিম খাওয়াবো। আমি ওকে বললাম, দোস্ত তুই আর পড়াশোনা করবিনা? সে খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, ধুর বাল। পড়াশোনা করে কে কবে বড় হইছে। আমি ব্যবসা করমু। টাকার ব্যবসা। নিজে টাকা ছাপায় মানুষরে বান্দি বানায় খাটামু। আমি হাসিমুখে বলি, ফুলি কে? ও আমার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বলে, আছে এক মাইয়া। ঢাকায় পরিচয় হইছে। ৫০ টাকা লাগে ওরে খাইতে। কিন্তু আমার থিকা টাকা নেয়না। ভালো মাইয়া দোস্ত। মন অনেক ভালো। মেয়েটা অসুখ করছে। আমি ওরে এখন আমার থাকার জায়গায় আইনা রাখছি। বহুত ভালো মেয়ে। আমারে ভাজি ডাল রাইন্ধ্যা খাওয়ায়। আমি তখন কলেজে পড়ি। এসএসসি পাশ ১৮ বছরের ছোটনের জীবনটা তখন আমার অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। সেইরাতে ও আমার বাসায় চুরি করে পালিয়ে যায়। আহারে ছেলেটা আমার কাছে চাইলেই আমি আমার জমানো টাকা দিয়ে দিতাম। শুধু শুধু আব্বার ঘড়ি আর শখের মোবাইলটা নিয়ে গেলো। ছোটন অবশ্য চুরি করে লজ্জা পায়না। অনেকদিন পর ঢাকা শহরে আবার হঠাৎ করে একদিন আমাকে দেখা হলে বলে, দোস্ত সেদিন মিসটেক হয়ে গেছে। আঙ্কেলরে আমি নিজে হাতে একটা আপেলফোন কিনে দিয়ে আসবো। একটু সবুর কর। ব্যবসা করতেছি। সকালবেলা আমার মোবাইলে ইউনিভার্সিটি অফ উতাহর এক প্রফেসর থেকে মেইল আসলো। তিনি আমাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানালো যে আমার এপ্লিকেশনটি তারা গ্রহণ করেছে। তিনি চান আমি যেন তাদেরকে ফিরতি মেইলে আমার সিদ্ধান্ত জানাই। আমাকে এম্বেডেড সিস্টেম ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে হবে। তার কিছু পেপার আমাকে উনি পড়তে দেবেন যদি আমি শেষমেষ তার সাথে কাজ করতে আগ্রহী হই। আমি কিছুক্ষণ ভ্যান্দা মেরে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। একবার ভাবলাম সবাইকে জানাই। তারপর কেমন যেন মিইয়ে গেলাম। সব কেমন বিষণ্ণ লাগছিলো। সবকিছু। আমি হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। আজকে আমার এক জায়গায় ইন্টারভিউ ছিলো। গত ১ বছর ২ মাস ধরে আমি কুকুরের মত একটা চাকরী খুঁজছি। মফস্বলে অত্যন্ত টেনেটুনে চলা এক পরিবারের ছেলের এতোদিন বেকার হয়ে ঘোরা মানায়না। তাইতো সেদিন অন্তুর আম্মা আমাকে বলছিলো, হাসিব তুমি কি আসলেও পাশ করছো বলো তো? এতোদিন চাকরী পাইলানা। রেজাল্ট খারাপ? আমি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছিলাম। হাসিমুখে তার দেয়া এক কাপ চা আর বিস্কিট দুপুরের লাঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করে বিদায় নিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো শালার এই টিউশনী আর করবোনা। এইরকম অকল্পনীয় চিন্তা বেশিক্ষণ মাথায় টিকেনা। মেসমালিকের বউয়ের চেহারা মনে পড়লেই ভাবনা দূর হয়ে যায়। আন্টির নাম সুফিয়া বেগম। বিশিষ্ট কবির নামে নাম। নাম সুফিয়া হলেও তার আচরণে কোথাও সুফি ভাব নেই। ভাড়া একটু দেরী হলে তিনি মেসের লোকজনের মান ইজ্জত সব খেয়ে হজম করে ফেলে দেয়। আমি অবশ্য তার ভয়ে কখনো ভাড়া দেরী করে দেইনি। একবার আফজাল ভাই তিনদিন দেরী করেছিলেন। উনার সাথে নিচে যাচ্ছিলাম চা খেতে। তখন দেখা হয়ে গেলো সুফিয়া আন্টির সাথে।আফজাল ভাই সিনিয়র মানুষ, বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি। উনাকে সুফিয়া আন্টি দেখে সরাসরি বললেন, অফিসে বেতন দেয়না? ভাড়া দেন না ক্যান? আফজাল ভাই থতমত খেয়ে আমার দিকে একবার তাকান। আরেকবার আন্টির দিকে। বিস্ময় কাটতে আমতা আমতা করে বললেন, আপনি এভাবে বলছেন কেন? আমি সাপ্তাহিক ছুটি পড়ে যাওয়াতে টাকা তুলতে পারিনি। আমি কালকে রবিবার দিয়ে দেবো। সুফিয়া আন্টি আরো ভয়ংকর স্বরে বললেন, আমি কিভাবে কথা বলি মানে? পছন্দ না হইলে উঠায় দিবো। দিন রাত ছাদে যেয়ে সিগ্রেট টানতে তো ভুল হয়না। প্যান্ট টাইট দিয়ে অফিসে যাইতো তো ভুল হয়না। ভাড়া দিতেই খালি ভুল হয়, হাঁ? আফজাল ভাই সেদিনই বাসা ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে দেয়ার আগে একটা প্রেমপত্র লিখে আন্টির বাসার দরজার নিচে রেখে যান। সেখানে শুধু একটা ছোট্ট বাক্য লেখা ছিলো, আপনে একটা মহান মা*ী। অনেক চিন্তা করে রাতের বেলা আম্মাকে ফোন দিয়ে খবরটা জানালাম। আমার গরীব মা চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর বললো টাকা নিয়ে টেনশন করিসনা। হয়ে যাবে। খুব দ্রুত লাগবে? আমি আমতা আমতা করে বললাম, চারমাস পর হলেও চালায় নেয়া যাবে। শুধু প্লেন ফেয়ার আর কিছু হাতখরচ হলেই চলবে। এরপর আব্বাজান কথা বললেন, পাশের বাড়ির ফেলু কাকাও আমাকে আমেরিকা জায়গাটা যে ভালো না বুঝায় দিয়ে গেলেন। কিছু লোক অন্য কারো ভালো খবর শুনলে অনেক চাইলেও নিজের মন খারাপ ভাবটা লুকাতে পারেনা। এইরকম আরেকজন ছিলো আমার ভার্সিটির একবছর জুনিয়র ছোটভাই আসিফ। আসিফের সাথে রাস্তায় হঠাৎ দেখা। আমাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি অবস্থা ভাই, বেকার জীবন কেমন যাচ্ছে? আমি হাসিমুখে বললাম, তোমার জয়েন কবে পিডিবি তে? আসিফ চুলে হাত দিয়ে আচড়িয়ে বলে, এইতো ভাই খুব তাড়াতাড়ি। আপনেও ট্রাই করেন ভাই। হয়ে যাবে পরের বছর ইনশাল্লাহ। আমি মাথা নাড়ি। তাঁকে আশ্বস্ত করি পরের বছর অবশ্যই আমি চেষ্টা করবো ভালোভাবে পরীক্ষা দেবার। ৫১ হাজার টাকা বেতনের চাকরী তো যেনতেন ব্যাপার না! বিদায় নেবার আগে সে জানতে চাইলো, ভাই আপনি জি আর ই দিছিলেন না জানুয়ারীতে। আপনে মিয়া বাহিরেও মনে হয় এপ্লাই করেন নাই ঠিক মত? আমি হতাশ হয়ে বলি, করছিলাম। ঠিকমত কোথাও ডাকে নাই। দেখি কি করা যায়। আমার নতুন পাওয়া এডমিশিনের কথা আসিফকে বললাম না। শুধু শুধু কারো মন খারাপ করিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিলোনা। তার থেকে আমি গেলাম ময়না মামার দোকানে। মামার দোকান টিএসসি থেকে ৫০০ মিটার সামনে ভাস্কর্যের কোল দিয়ে। ঢাকা শহরের সেরা ঝালমুড়ি বানায় নোয়াখালী বিভাগের গর্বিত বাঙ্গাল ময়না মামা। মামা আমাকে চটপটি দিয়ে বলে, ওস্তাদ আজকে একটা পোলার চোখ কানা কইরা দিছে উত্তরার দিকে। কালকে থিকা মিছিল যামু। ময়না মামা আমার থেকে সমর্থন চায়। আমি কিছু না বললে সে দমে যায়। অভুক্ত বেকার যুবকেরা প্রেমে মাতাল থাকার সময় বিদ্রোহের ডাক দিতে পারেনা। তাদের পেটে থাকে ক্ষুধা, অথচ হৃদয় ভরা অভিমান। ক্ষুধা আর অভিমান মিলেমিশে জাতীয় সকল আপদ বিপদ, সংগ্রাম প্রতিবাদকে রঙ্গিন খামে বন্দী করে আকাশে পাচার করে দেয়। সেই আকাশে চিল উড়ে, শকুন দাবড়ে বেড়ায়। খামগুলোতে শুধু মরচে ধরেনা। এরা অপেক্ষা করে, হঠাৎ একদিন প্রেরকের কাছে ফেরত আসবে এই অপেক্ষায় তারা মেঘে মেঘে ভেসে বেড়ায়। আমি এখন ভেসে বেড়াচ্ছি। নাহ, আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিতে যাবো এই আনন্দে না। আমার সাথে নীতুর দেখা হবে। হঠাৎ করে ওর পাশে রাস্তায় হাটা শুরু করবো। ও আমাকে দেখে কি করবে এই চিন্তার বাহিরে আমার আর কিছু মাথায় আসছেনা। ৬ দিন আগে যে ৭টা বাচ্চাকে লাইসেন্সহীন ড্রাইভার চাপা দিয়ে ১ সেকেন্ডে মেরে ফেললো, সেই চিন্তাও আমার মাথায় আসছেনা। আমি খবর দেখি, পত্রিকা পড়ি তারপর আস্তে করে নিজেকে আড়াল করে ফেলি। মাঝে মাঝে ভীতু হয়ে বেঁচে থাকা জায়েজ হয়ে যায়। একসময় আমি ভীতু ছিলাম না। কিন্তু আজকাল খুব নিজেকে ভালোবাসি। এই দেশে নিজেকে ভালোবাসলে সাহসী হয়ে বাঁচা যায়না। রাতের বেলা নীতুকে ফোন দিলাম। নীতুর দেশে তখন সকাল বেলা। ওর গলা ঠান্ডায় মনে হয় জমাট বেধে গেছে। নাক টেনে টেনে কথা বলছে। আমি একটু সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলাম, নীতু তুমি কি কান্না করছো? নীতু চুপ করে থাকলো অনেকক্ষণ। আমিও নিশ্চুপ থাকলাম। স্থবিরতায় উত্তর খুজছিলাম, কিন্তু সব কেমন যেন শূণ্য হয়ে রইলো। ও আস্তে আস্তে বললো, জানো মাঝে মাঝে খুব একা লাগে। তখন কাউকে কাছে পাইনা। এমনটা হওয়া শুরু করছে এই শীতের দেশে আসার পর থেকে। কেমন যেন একটা স্তব্ধতা কাজ করে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে মনে পড়ে খুব? নীতু অনেকক্ষণ পর ভেবে উত্তর দিলো, জানিনাহ! তুমি তো জানো আম্মু মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা কেমন যেন দূরের মানুষের মত হয়ে গেছে। খুব খারাপ একটা সময়ে তোমার সাথে পরিচয় হয়। তুমি কি সুন্দর করে আমাকে জীবন কি তা বোঝাতে। আমার খুব ভালো লাগতো তোমার জীবনদর্শন। আমি তোমার সাথে আমার চিন্তা মিলাতে পারতাম না। কারণ আমি তোমার মত না হাসিব। কিন্তু আমার খুব ভালোবাসতে ইচ্ছা করতো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসছি জানো তো? আমি কিছু বললাম না। ওর সব কথা এতো ভালো লাগে কেন আমি জানিনা। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, নীতু আর একা থাকতে হবেনা। আমি চলে আসবো। আমি তোমার হাত ধরে পুরাটা পৃথিবী হেটে বেড়াবো। আল্লাহর কাছে প্রতিদিন ভিক্ষা চাইবো যেন আমার সবকয়টা ঘুমভাঙ্গা ভোরে তোমার জন্য নতুন করে ভালোবাসা হয়। কিন্তু আজকে নীতু কাঁদছে। আমি জানি নীতু কাঁদছে। ওকে বললাম, কি হয়েছে বলো তো? নীতু ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে, হাসিব তুমি জানো তো আমি তোমাকে ভালোবাসছি অনেক। তুমি জানো তো তাই না? কিন্তু আমার মধ্যে একটা একাকীত্ব ছিলো, তুমি কি সেটা কখনো বুঝতে পেরেছো? আমি ওকে আমার এডিমিশনের কথা বলতে গিয়েও ধৈর্য্য ধরে থেমে যাই। ওকে আদর করে বলি, কি হইছে তোমার বলো তো? আমাকে বলো? নীতু নিজেকে সামলে বলে, আমার কিছুই হয়নাই। আমি জানিনা তুমি বুঝবে কতটা। কিন্তু আমার নিজেকে কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আর সেই মানুষটা নেই যেই মানুষটাকে তুমি চিনতে। আমি বললাম, তুমি কেমন ছিলে, এখন এই তুমিটা কেমন আমি হয়তো বুঝিনা। কিন্তু আমি জানি তুমি অনেক ভালো। তুমি আমার পরী, সাদা পরী। আমি খুব দ্রুত তোমার কাছে এসে পড়বো দেখো। হয়তো একদিন তোমার হোস্টেলে তোমার রুমের পাশে এসে হাজির হয়ে যাবো। আমাকে সেদিন রান্না করে খাওয়াবে তো? তোমার বিখ্যাত খিচূড়ি আর ডিম? নীতু হাসছে। আমি ওর হাসির শব্দে নদীর শান্ত জলে মাছারাঙ্গা পাখির ডানার গল্প খুজতে থাকি। পরের চার মাস খুব দ্রুত কেটে যায়। মোটামুটি টাকা পয়সা, প্লেনের টিকেট সব গুছিয়ে ফেলেছি। শুধু একটা জিনিস ঠিকমত হয়না। নীতুর সাথে আজকাল কেমন যেন কথা হয়না। আমি ওকে ফোন দিলে ও কথা বলে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি ও কেমন যেন বদলে গেছে। তারপর আবার মনে হয়, সব বাজে ভাবনা। ওর হয়তো এক একা মন খারাপ। পরিবার থেকে দূরে একা একা ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে পড়ে থাকে। বয়সটাও তো বেশি না, যাকে ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি সেও হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশে পড়ে রয়েছে। কিন্তু আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। আর দশদিন পর আমার ফ্লাইট। আজকে ঢাকাতে আমার শেষ দিন। মেসে যা কিছু ছিলো সব গুছিয়ে রেখেছি। রাতের হানিফ বাসে করে চলে যাবো আমার প্রাণের শহর কুমিল্লায়, আমার বাড়ীতে। কতদিন লালমাই যাইনা, চন্দ্রমুড়ায় পা রেখেছি প্রায় চার বছর হয়ে গেছে। শালবন বিহারে আমার একটা নির্দিষ্ট ভাঙ্গা টিলা আছে যেখানে আমার বসে থাকতে খুব ভালো লাগে। কেন যেন মনে হতো এখানে বিশাল বিশাল গুপ্তধন আছে। তিন গোয়েন্দার “পাগলের গুপ্তধন” বইটা পড়ে কতবার ভেবেছি এখানেও এমন কিছু গোপন স্থাপনা আছে যেটা খুড়ে বের করলেই বিশাল একটা সিন্দুক বের হবে। সেই সিন্দুক ভাংলে কি পাওয়া যাবে তা কখনো ভাবিনি। সিন্দুক পেলেই আমি খুশি। এখন তো বড় হয়ে গেছি, এসব ফ্যান্টাসী কাজ করেনা। ভালোবাসাটা অবশ্য বেশ কাজ করে। দুদিন পর পশ্চিমে আঁধার গড়বো, কিন্তু এই ভালোবাসাগুলো কি সেখানে কখনো অনুভব করবো? নায়াগ্রা ফলস, ডিজনীল্যান্ড, আইম্যাক্স থ্রিডি – কত কত বিনোদন। আমি নিশ্চিত সেখানে আমি চন্ডীমুড়ার গম্বুজগুলো, অথবা নজরুল ইন্সটিউটের বিদ্রোহী কবির জ্বলজ্বলে চোখের ছবিটাই খুজে বেড়াবো। ভার্সিটির এক বড় ভাই বলতো, বাংলাদেশের মাটির গন্ধে বড় নেশা আছে। লাখ লাখ চুতিয়া নেতার পয়দা দিয়েও এই নেশা কাটবেনা। আমি এখনো দেশ ছাড়িনি। দেশ ছাড়লেও আমার আত্না আমাকে এই মাটির নেশায় আটকে রাখবে, ছাড়বে না আমি জানি। ভোরসকালে ছোটন আমার বাসায় আসলো। আমাকে বললো, দোস্ত খুব ক্ষুধা লাগছে। নাস্তা খাওয়া। আমি নিচের হোটেলে ওকে পরোটা ভাজি কিনে খাওয়ালাম। সে দাঁত খিলাল করতে করতে বললো, দোস্ত একটা ঝামেলা হইছে। আমার বউয়ের বাচ্চা হইছে আজকে। ভয়ে যাইতে পারতেছিনা হাসপাতালে। এক সপ্তাহ ধইর্যা ধান্দাবাজি করতে একটু বরিশাল গেছিলাম। আজকে সকালে ওর ফুপু ফোন কইর্যা বলে বাচ্চা হইয়া গেছে। হাসপাতালের বিল লাগবো। কিছু টাকা ধার দিবি? আমি চিন্তা করলাম, আমার কাছে আমেরিকায় হাতখরচের জন্য কিছু টাকা আব্বু দিয়েছিলো। সেখান থেকে কিছু দিলে খুব সমস্যা হয়তো হবেনা। আমি কিছুক্ষণ পর বললাম, দোস্ত আমি তো আমেরিকা চলে যাচ্ছি ২৯ তারিখ। কিছু টাকা আছে হাতখরচের জন্য। আমি তোকে দিতে পারি পাঁচ হাজারের মত। ছোটন শিস বাজিয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ। তাতেই চলবো। কিন্তু তুই আমেরিকা যায়া কি করবি? এই দেশে বহুত ব্যবসা আছে। ভালো মত থাইকা পড়া রাজার মত থাকতে পারবি। তুই যা টাকা আছে ওইগুলা দিয়ে আমার সাথে বিজনেস কর। আমি হাসিমুখে ওকে নিয়ে হোটেল থেকে উঠে বাসায় গেলাম। ছোটন আমার মেসের বিছানায় শুয়ে বললো তার সাথে যেয়ে যেন তার সদ্য জন্মানো মেয়েটাকে দেখে একটা নাম দিয়ে আসি। আমি রাজী হয়ে ওকে বললাম, দোস্ত আমার নামের পছন্দ ভালো না। পুরানা আমলের নাম শুধু মনে হয়। মনে কর, বকুল ফুলি জবা। এইসব নাম তোর পছন্দ হবেনা। হাসপাতালে ছোটনের মেয়েকে দেখে মনটা শান্ত হয়ে গেলো। জন্মের পর বাচ্চারা সাধারণত ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে থাকে। এই বাচ্চাটা অন্যরকম। সে বড় বড় গোল চোখে তাকিয়ে দেখছে সবাইকে। আমার ভুল না হলে তার সাথে মজা করলে সে হাল্কা করে ঠোট বাকিয়ে হাসি দেয়। আমি ছোটনকে বললাম, মহাশ্বেতা। এক বিখ্যাত লেখিকার সম্মানার্থে নামটা দিলাম। আমার খুব প্রিয় লেখিকা। তোর বউকে জিজ্ঞাসা কর রাজী আছে কিনা? ছোটনের বউয়ের নাম টুম্পা। মেয়েটার সারাটা মুখ জুড়ে ক্লান্তি। চোখ দেখে মনে হয় লজ্জায় কুঁকড়ে আছে নতুন আগন্তুক আসার অপরাধে। আমি তার পাশে যেয়ে বললাম, ভাবী আপনি কি খুব চিন্তিত? ছোটন সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। টেনশন নিয়েন না। টুম্পা কিছু বললোনা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। মেয়েটার বয়স আন্দাজ ১৬ কি ১৭ হবে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে এই অসহনীয় সমাজে সে হাজার বছরের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দে যেন সে অনেকগুলো গল্প বলে ফেললো। এই দেশে গরীব ঘরের মেয়েরা গেরস্থের উঠোনে বিছানো পাটির মত। যখন প্রয়োজন শক্তিশালী সমাজ তাতে পা মুছে যলে যায়। ছিড়ে যাক ভেঙ্গে যাক, তার ব্যবহার কমবেনা। কিন্তু দিন শেষে কেউ সেই পাটিতে লেগে থাকা ময়লাটা মুছে দিয়ে যায়না, যত্ন তো দূরের কথা। মোসাম্মাত টুম্পার জীবনটা হয়তো এমনটাই ছিলো। তার চোখে আছে সামনে অনাগত ভবিষ্যতের ভয় আর হৃদয়ে ছোট্ট আত্রলিতার হামি দেয়া গুঞ্জনের অপ্রকাশিত আনন্দবার্তা। ছোটন তার বউকে কিছুক্ষণ কথা বলার পর বললো, আমি হাসপাতালের বিল দিয়া আসতেছি। তু্মি একটু অপেক্ষা করো। আজকেই তোমারে নিয়া যামু। টুম্পা কিছু বললোনা। ও চলে যাওয়ার পর হঠাৎ কান্না শুরু করলো।আমি কিছু না বুঝে বাহিরে দাড়িয়ে থাকলাম। একটু পর টুম্পার ফুফু এসে বললো, তোমার বন্ধু তো আর আইবোনা। হেয় কি টাকা পয়সা নিয়া আসছিলো? দুইদিন ধইর্যা মাইয়াটা এহানে আটকায় পইড়্যা আছে। ওই পোলা হইলো নেশাখোর। টাকা পাইলে নেশা ছাড়া আর কিছু করেনা। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, আমি ওকে কিছু টাকা দিয়েছি। ও বিল দিয়ে এখুনি এসে পড়বে। আপনারা আরেকটু অপেক্ষা করেন। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। এরপর ছোটনের বউকে যেয়ে বললাম, ওকে কি একটা ফোন করবেন। টুম্পার শ্বাশুড়ি বললো, অনেকবার ফোন দিছি। ধরেনা। আপনে একবার দেন। বাচ্চার গায়ে জ্বর আইছে। আমি টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি এতো চিন্তা করবেন না। আমি ছোটনকে ফোন দিচ্ছি। ওর তো এতো দেরী করার কথা না। আমি ছোটনকে তিনবার ফোন দিলাম। একবারও ফোন ধরলোনা। চতুর্থবার সে ফোন ধরে নেশাগ্রস্ত গলায় বললো, দোস্ত আমি আইতেছি তোর বাসায়। তুই কই? আমি মেজাজ শান্ত করে বললাম, ছোটন তুই হাসপাতালের বিলটা দিয়ে তোর বউকে নিয়ে যা। একটু পর পর আয়া টাইপ কিছু মানুষ এসে জঘণ্য ভাষায় কথা বলছে বেড খালি করার জন্য। ছোটন চুক চুক করে বললো, দোস্ত তোরে আসলে বলা হয়নাই। এই মাগীর পয়দা যেইটা হইছে ওইটা আমার না। আজকে চেহারা দেইখ্যা শিউর হইছি। এইজন্য রাগ কইর্যা আর আসিনাই। দোস্ত তুই চইল্যা আয়। এই মাগী ওর পুরুষরে ডাইক্যা বাচ্চা ক্লিয়ার কইর্যা দিবো। আমি হতভম্ব হয়ে ওর কথা শুনছিলামশ। একটু পর আবার ও বললো, দোস্ত তুই একটা কাম কর। তুই মাগীরে ফোন দে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা দিলাম ওর বউকে। ওর বউকে কি বললো ও জানিনা। ওর বউ ফোনে অঝোরে কান্না শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোর মত বেজন্মার বাচ্চা আমি রাখমুনা। প্রায় ১৫ মিনিটের মত আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি বলবো এই পরিস্থিতে বুঝতে পারছিলাম না। আমি অনেক ভেবে টুম্পাকে বললাম, দেখুন আমার বন্ধু আপনাকে কি বলছে আমি জানিনা। সে আপনার কি হয় তাতেও আমার যায় আসেনা। আমি বিল দিয়ে আপনাদের হাসপাতাল থেকে ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করছি। টুম্পা আমার হাত ধরে বললো, ভাই বিশ্বাস করেন আমি খারাপ মেয়ে না। আমার আব্বা স্কুল টীচার ছিলো। আপনের বন্ধু আমারে ফুসলায় ঢাকা নিয়ে আসছে। আমারে মারছে, নির্যাতন করছে। এই বাচ্চা ওর। আমি বাচ্চা নিতে চাইনি। ও জোর কইরা আনছে। হেয় নেশা করে, আমি ভয় পাইতাম বাচ্চা হইলে বেইচ্চা দিবো। ভাই, আপনে আমার আপন ভাই। বিশ্বাস করেন আমি নষ্ট বেটী না। আমার বাপের কাছে যাওয়ার মুখ নাই। আমারে ঘরে নিবোনা কেউ। আমি কই যামু? আমার বাচ্চা কই যাবে? আমি কিছু চিন্তা না করে বললাম, আমার বাড়ি কুমিল্লায়। আপনি আমাদের বাসায় থাকবেন। আমার বাবা মা অনেক ভালো মানুষ। আপনি এখন একজন মা এবং আপনি একটা ফুটুফুটে কন্যাকে জীবন দিয়েছেন। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীতে এখন এই মুহুর্ত থেকে আর কিছু নাই। আপনার বাবার সাথে আমার বাবা মা কথা বলবে। ছোটনকে আমি পুলিশে দিবো। সে যা করেছে তার শাস্তি সে পাবে। আমি বুঝতে পারছিলাম টুম্পা আমার কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা। আমি বাহিরে বের হয়ে মেসের পথে হাটা দিলাম। বাবা মা কে বললে আমি নিশ্চিত তারা আপত্তি করবেনা। এসব ভাবতে ভাবতে মেসে ঢুকে মনে হলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। ১০ মিনিট পর বুঝতে পারলাম, আসলেও সমস্যা হয়েছে। আমার পাসপোর্ট ছোটন নিয়ে গেছে। টাকা পুরাটা নেয়নি। ল্যাপটপটাও নিয়ে গেছে। আমি ছোটনকে ফোন দিলাম, সে একবারেই ফোন ধরলো। আমি ওকে শুধু বললাম, তুই আমার সব রেখে দে। শুধু আমার পাসপোর্টটা ফেরত দিয়ে যা। ছোটন বারবার কসম খেয়ে বললো, বিশ্বাস কর দোস্ত আমার আগের অভ্যাস নাই। তোর পাসপোর্ট দিয়া আমি কি করবো? আমি একটা কাজ করি। তোর মেসে পরের সপ্তাহে আসতেছি। আইস্যা ঠিকমত কথা বলতেছি। আমি বললাম, শোন তুই আমার পাসপোর্ট বিক্রি করে যেই টাকা পাবি তার থেকে বেশি টাকা আমি তোকে দিতে পারবো। আমার কাছে আরেক বন্ধুর কিছু টাকা আছে। ওটা তুই নে। তোকে আমি ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি তোর টাকা লাগবে। তুই এসে নিয়ে যা। কিন্তু পাসপোর্টটা খুব জরুরী লাগবে বন্ধু। প্লীজ এটা দিয়ে যা। ছোটন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। আমাকে ফ্যাস ফ্যাস করে বললো, আচ্ছা আমি তোর বাসায় আসতেছি। আমি কাকুতি মিনতি করে বললাম, পাসপোর্টটা আছে তো? সে একটু লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললো, আচ্ছা থাকবো। তুই থাক। আমি রাত্রি ১০টায় আসতেছি। সন্ধ্যা সাতটায় আলমেরিনা নার্সিং হোম এন্ড হসপিটাল, বাড্ডায় পৌছালাম। আমার কাছে যা টাকা ছিলো তার সাথে মেসের পাশের রুমের মেরাজ ভাইয়ের থেকে কিছু টাকা নিয়ে নার্সিং হোমের বিল দিতে এসেছি। আসার পথে বারবার বাচ্চাটার চেহারা চোখে ভাসছিলো। নার্সিং হোমের সাথে লাগানো ফ্ল্যাডলাইটের আলোয় যখন বাচ্চার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া নিথর দেহটা দেখলাম তখনও হলদেটে বাচ্চাটার হাসির ছবিটা আমার কল্পনা থেকে মুছে যাইনি। পাশেই ওর মা পড়ে ছিলো।দূর থেকে দেখলেও আমি বুঝতে পারছিলাম, একটা অসহায় বাংলাদেশের আরেকবার আজকে মৃত্যু হয়েছে। প্রায় দিন হয়, আজকেও হয়েছে। নতুন কিছু না। আমি তবুও হাসপাতালে যাই। তাদেরকে অনেক সাধাসাধি