গল্পঃ অবিন্যস্ত আমি শেষ পর্ব

বাংলা ছোট গল্প| Bangla Love Stories| Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.


গল্পঃ অবিন্যস্ত আমি

শেষ পর্ব



সেই বহু বছর আগের কষ্টটা আজ আবার ফিরে আসে। আবারো আপন জন হারানো কষ্টে আমার ঘুম আসে নি আমার। কারণটা মিরা! সে আমার বন্ধু। পুরো ভার্সিটির কেবল আমার সাথেই আমার বন্ধুত্ব বেশি।বেশ গাঢ় বন্ধুত্ব। কিন্তু আমি সীমা লঙ্গণ করি। বন্ধুত্বের চেয়ে আরো বেশি কিছু ভাবতে থাকি। এই পাথুরে হৃদয় কেবল তাকে ভালোবেসেছে। তার কথা মনে রেখেছে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। চরম ভুল। নিজের মা বাবা আপন হল না আর সে তো পর।সে কেন আপন হবে। তাকে আপন ভেবেছিলাম কেন জানি না তবে তাকে আপন ভেবে সত্যিই বড় ভুল করেছি। যার ফল পাচ্ছি এখন। পাশ থেকে মোবাইলটা হাতড়ে নিলাম। ছয়টা প্রায় বেজেই গিয়েছে। আমি উঠে পড়ি। আজ ঘুম আসবে না আর। এমন অনেক হয়েছে। অনেক রাত ঘুম যাই নি। আয়নার সামনে দাঁড়ালাম একবার। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। আসলেই অনেক খুঁত আছে আমার মাঝে। চোখের নিচে কালি পড়ে আছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আমি মৃদু হাসলাম। মনে মনে বললাম, যার কিছু নেই তার কোন কিছুই নেই। যার আছে তার অনেক কিছুই আছে। আমি আমার লাইব্রেরীর দিকে গেলাম। বিন্যাস্ত বইয়ের সমাহার সেখানে। বিশাল বড় বারান্দা। সেখানে একটা চেয়ার পাতানো।আমি চেয়ারটায় বসলাম। নিজের পিঠ এলিয়ে দিলাম চেয়ারের গায়ে। পূব আকাশে তাকিয়ে থাকলাম এক দৃষ্টিতে। সূর্য উঠবে। রক্ত বর্ণের সূর্য। নতুন দিনের নতুন সূর্য।  দিনের শুরুতে একটা নতুন সূর্য দেখা যায়। ইশ! যদি আমার জীবনেও একটা নতুন সূর্য দেখা দিত! বা সূর্য রূপী কেউ। আমি মৃদু হেসে উঠে।যতবার এই দিনের প্রথম সূর্য দেখতে এসেছি ঠিক ততবার কিসব উদ্ভট ভাবনা এসেছে মনে। 
.
সাদিক আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখে কেবল উত্তেজনা দেখতে পেরছি আমি। এই হল আমার আরেক বন্ধু। আমাকে খুব আপন ভাবে। আমি ভাবি না। সারাদিন আমার সাথে কাটায়। হাসাতে চায়। আমি হাসি না।ছেলেটা অনেক কথা বলে।বাচাল যাকে বলে আরকি। অনেক বার বকেছি।বাজে ব্যাবহার করেছি। উঁহু! সে হাল ছেড়ে দেয় নি। লেগে আছে আমার সাথে। অন্য কেউ হলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতোও না।সাদিক বলে উঠে,
"কিরে! তোর চোখ এত লাল কেন? কি হয়েছে?"
"কিছু হয় নি!"
"তাহলে চোখ লাল কেন?"
"রাতে ঘুম হয় নিই আজ।"
"কেন? "
"সব কথা কি তোকে বলতে হবে? শুন সব কথা সবাইকে বলতে নেই। আর সবার সব কথা শুনতেও নেই। বুঝতে পেরেছিস?"
ছেলেটা কথা বলে না আর।
ুপ করে, মুখ কালো করে মায়া মায়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তবুও আমার মন গলে না।  ওর সামনে থেকে চলে আসি। ক্লাসে এসে বসতেই মিরার কথা মনে পড়ে।ওর কন্ঠ কানে ভেসে আসে। মুগ্ধ করার মত একটা কন্ঠ তার!  তাকাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তাকাই নি। চোখ-মুখ শক্ত করে বসে থাকি।  সাদিক এসেই আমার পাশে বসল। এসেই তার কথা বলা শুরু। "দোস্ত শুন! সেদিন একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে। আমাদের বাসার যে বেড়ালটা..."
ও কথা বলতে থাকে। আমি চুপচাপ শুনে থাকি। চোখে মুখে কোন আগ্রহ নেই। আগ্রহে ছাপ নেই। কেমন জানি পানির মত সরল হয়ে নির্বিকার হয়ে আছে। 
.
মিরার দিকে তাকাই নিই প্রায় পাঁচ দিন হল। ওর দিকে তাকিয়ে কথাও বলি নি। চুপচাপ নিজের মত চলাফেরা করেছি আর সাদিকের বকবকানি শুনে গিয়েছি। যে আমাকে আপন ভাবে নি তাহলে  আমি কেন তাকে আপন ভাববো। ওর দিকে দুচোখ তুলে তাকাইও নিই। তবে আজ তাকাতেই হল। কারণ একটু আগে যে কথাটা ও বলেছিল সেটা শুনে আমার ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দুঃখের ঝড় বইতে থাকে। একটু যেন কষ্ট হয় আমার। সাদিকের জোরাজুরিতে ক্লাসের কয়েকটা হাতে গোনা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বসলাম ক্যাম্পাসের সবুজ চাদর বিছানো মাঠে। কিছু সময় পরই মিরা এসে হস্তদন্ত হয়ে বলে,
"গাইজ লেটস মিট উইথ মাই বফ! তোমাদের চমকে দেবার জন্যে এতদিন বলি নিই। আজ বলছি। এই হচ্ছে সিফাত! আমার ভালোবাসা। অনেক আগ থেকেই চলছিল আমাদের খুনসুটি ।বাট আজ সেটা প্রকাশ করলাম আরকি।" এই বলে ও মৃদু হাসল। আবার বলল,
"এই এদিকে এসো।এদের সাথে পরিচিত হও। এরা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।"
আমি তাকালাম এবার।একেবারে সোজাসুজি সিফাতের দিকে তাকালাম। সে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে।হাত মেলাচ্ছে। আমার সাথেও হাত মেলাতে আসে।আমি হাত বাড়িয়ে দেবো ঠিক তার আগেই মিরা বলে," ওর সাথে না পরিচিত হলেও চলবে।"
সিফাত অবাক হয়। বলে, "এ কেমন কথা! উনার সাথে হব না কেন?"
"কারণ সে একটা রোবট। আর রোবটের সাথে কথা বলতে নেই। তারউপর উনি মস্ত বড় একজন অভিনেতা। এই যে তার চেহারা দেখছো না এটা একটা মুখোশ মাত্র। এর পিছনে লুকিয়ে আছে একটা স্বার্থপর মানুষের ছায়া।"
সিফাত ঠিক বুঝে উঠল না ব্যাপারটা। মিরা এগিয়ে এসে সিফাতের হাত ধরল। টেনে নিয়ে যাবে ওকে। এর আগেই সাদিক আমার হাত ধরে। আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেখান থেকে। সাদিক ছেলেটার মন যে কি চলছে কে জানে। যাকে আপন ভেবেছি সে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আর যাকে ভাবি না সে যেন আপনা আপনি আপন হতে আসছে। অদ্ভুত! নাকি আমিই
ভুল করছি। সঠিক মানুষটিকেই কি আমি এখনও চিনতে পারলাম না! 
আরো কয়েকদিন অতিবাহিত হয়। আমি মিরার দিকে তাকাই নিই এক মুহূর্তের জন্যে। সে মাঝে মাঝে আমার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে। উচ্চস্বরে তার প্রেমিকার গল্প বলে। তার প্রশংসায় গড়িমসি খায় । আমি চুপচাপ থাকি। সেদিকে তাকাই না। তাকানোর ইচ্ছে হয় না। আড্ডায় বসি না আর। একা একা ভার্সিটির এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে। মিহিনের কথা ভাবি। আমার ছোট বোন মিহিন। কত অভিমান নিয়ে মেয়েটা সেদিন এই পৃথিবী ত্যাগ করে! কি পোড়া কপাল তার। আমার! আমার দাদুর। মানুষটা এর জন্যে নিজেকে দোষরোপ করছে। নিজের ছেলের এমন কুকর্ম দেখে আঁৎকে উঠেন তিনি। অপরাধবোধ খুঁড়ে খুঁড়ে খায় থাকে। আমি তাকে শান্তনা দেই। তাকে জড়িয়ে ধরে তার সাহসীকতার প্রশংসা করি। তখন তার চোখ মুখ দেখি না। তাই তার মুখ তখন কেমন হয় সেটা আমার অজানা। দাদুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ি আমি। দাদু মাথায় বিলি কেটে দেয়। দলা হয়ে যাওয়া, চামড়ায় ভাঁজ পড়া হাত গুলো দিয়ে উনি যখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেউ আমি অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করি তখন। যেন পৃথিবীর সকল শান্তি,ভালোবাসা, মায়া যেন কেবল ওই দুহাতেই আছে। যেমন দুহাতের চামড়ায় লেপ্টে আছে। মিশে আছে রক্তে। কিন্তু কেন জানি আমি এমন আনন্দ বাইরে প্রকাশ করতে পারি না। দাদুর সাথে অনেক ঘুমিয়েছি এমন। যতদিন ঘুমিয়েছি ততদিন আমার ঘুম এত ভালো হয়েছে যা বলার মত না! ভার্সিটির কোণায় একটা ছোট্ট ইটের তৈরি বেঞ্চির উপর বসে বসে কথা গুলো ভাবছিলাম। ঠিক তখনই কারো উপস্থিতি টের পাই। পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে উঠে নিতুকে দেখি। সে মায়া মায়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের সাথেই পড়ে। সাদিকের সাথে খাতিরটা একটু বেশিই ভালো তার। কোন দিন তেমনভাবে কথা হয় নি। হাই হ্যালো হয়েছে কেবল। কিন্তু মেয়েটা এখানে কি করছে। এখানে কেন? নিতু আমার পাশে আরেকটু সরে এসে বসল। আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম চট করেই। ও বলল,
"কেমন আছো?"
আমি একটু বিরতি নিয়ে বললাম, 
"ভালো"
তারপর কিছু সময় নিরাবতা। আমি সৌজন্যের খাতিরেও জিজ্ঞেস করি নি সে কেমন আছে।ইচ্ছে হয় না। ও আবার বলে,
"আচ্ছা তুমি এমন কেন? "
"কেমন।"
"এই যে এত গম্ভীর। কথা বল না। হাসো না। এমন কেন?"
"জানি না।"
মেয়েটা যেন একটু আহত হল। আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল। আমার অস্বস্তি বাড়ে আবার। আমি দূরে দৃষ্টি ফেলে চেয়ে থাকি। চোখে ভীষণ রকমে শূন্যতা, কষ্ট খেলা করে। এরা কেন বুঝে না আমি এমনই। নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না।শেখায় নিই কেউ। আমি চট করেই চোখ নামিয়ে নেই মাটির দিকে। মিরা আসছে এদিকে। তার পাশে সুন্দর করে কথা বলা মিশুক প্রকৃতির সিফাত নামক ছেলেটা আছে। আমার হঠাৎ-ই হিংসে হল ভীষণ। যেন গা জ্বলে গেল। ওরা এদিকেই আসছে। আমার মাথা নিচু করা। ওদের দেখতে চাই না আমি। পাশ থেকে নিতু কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। তার চোখ মুখ যেন কিছু একটা বলতে চায় আমায়। আমি ওর দিকে তাকাই। চমকে উঠি। নিতু লজ্জা পাচ্ছে! কিন্তু কেন? নিতু ইতস্তত করতে করতে বলল,
"আসলে আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।"
নিতু এতটুকু বলে থামে।ওর মুখ লাল হয় খানিকটা। কান লাল হয়। চোখ দুটো অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। আমি নিতুর দিকে তাকাই। লজ্জায় মাখা, অস্থির হয়ে থাকা চেহারার মেয়েটাকে আমার ভীষণ সুন্দর লাগে।  আমি হঠাৎ-ই খানিকটা আনন্দ অনুভূব করি। এই মুহূর্তে আমার হাসা উচিৎ। বা মুখের হাবভাব পরিবর্তন করে একটু মোলায়েম বা খানিকটা আগ্রহী করা উচিৎ।  কিন্তু আমি পারছি না। দুঠোট একটুও চওড়া হয় না। একে অপরের সাথে আঁটকে আছে কেবল। আমি বললাম,
"হাদারামটা আজও আসে নি তাই না!"
নিতু চমকে উঠে। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।তার চোখে আশ্চর্য বোধক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মানে আশ্চর্য হলে মানুষের চোখ যেমন হয় আরকি! আমি আবার বলি,
"খুব ভালোবাস ওকে তাই না!"
নিতুর অবাকের সীমা থাকল না। সে কেবল একদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি সাদিককে ফোন দেই। রিং হয় কয়েকবার। তারপর ও কেটে দেয়। আমি অবাক হই ভীষণ। আশ্চর্য! এমনতো আগে হয় নি! এখন কেন হচ্ছে? ও তো আমার ফোন সবসময় ধরে। এখন ধরছে না কেন? দুদিন থেকে ভার্সিটিও আসছে না। কোন বিপদ হয় নি তো! আমি ফোন দিতে থাকি কয়েকবার। সাদিক ফোন ধরে না। খানিকটা হতাশ হয়ে নিতুর দিকে তাকাই। নিতুর অবাক ভাব তখনো কাটে নি। বলি,
"ও ফোন ধরছে না। ব্যস্ত নিশ্চই। তোমাকে কিছু বলে যায় নি?"
নিতু কিছু বলে না। কেবল আমার দিকে তাকিয়ে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ায়। আমি অবাক হই! সাদিক তো এমন ছেলে না। তাহলে ও এমন বিহেব করছে কেন? নিতুর সাথে কিছু হয় নিই তো! আমি নিতুর দিকে তাকিয়ে বেশ অস্থির হয়ে বলি,
 "তোমার সাথে ওর কিছু হয়েছে? এই যেমন ঝামেলা টামেলা হয়েছে? " 
 নিতু মাথা নাড়িয়ে বলে, "না"
 আমি খানিকটা চুপ থেকে ভাবতে থাকলাম। আমিও তো এমন কিছু বলি নি যে যার জন্যে ও ভার্সিটি আসবে না। তাহলে ও ভার্সিটি আসছে না কেন? আমি নিতুর দিকে তাকাই। সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে যাই। কেউ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার অস্বস্তি লাগে। আমি চোখ নামিয়ে নেই। আবার তাকাই। বলি,
 "কি ব্যাপার! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? "
 নিতু মুখ খোলে এবার। বলে,
 "অবাক হচ্ছি। বিশ্বাস কর আমি এত অবাক কোন দিন হই নি। অন্তত তোমার কাছ থেকে এটা আশা করি নিই। তুমি কিভাবে জানলে যে আমি সাদিককে ভালোবাসি?কিভাবে বুঝলে এটা! আমি তো জানতাম তুমি নির্বোধ! কথা কম বল।"
 আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলি,
 "আমি চুপ করে থাকি এটা সত্য। তাই বলে আমার চোখ, কানও যে চুপ করে থাকে তা কিন্তু না। তোমাকে আমি আরো বেশ কয়েকবার দেখেছি ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। ওর কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনতে। এই দেখো, ও দুই দিন ভার্সিটি না আসতেই তোমার চোখ জোড়া কেমন অস্থির হয়ে আছে। বারবার সাদিক কে খুঁজছে। কেন খুঁজছে! কেন এত অস্থিরতা! নিতু আমি গম্ভীর থাকি ঠিকই। কিন্তু মানুষকে বুঝতেও পারি। সত্যিই বুঝতে পারি।"
 আমি থামলাম। নিতু কোমল সওস্বরে বলল,
 "সত্য বলতে সবার সাথে সাথে আমিও ভাবতে শুরু করেছি যে তুমি আসলেই রোবট প্রকৃতির! কথা কম বল। সবার প্রতি তোমার আগ্রহ নেই বললেই চলে। আচ্ছা! এর পিছনে কি কোন বড়সড় কারণ লুকিয়ে আছে নাকি তুমি ছোট বেলা থেকেই এমন।"
 মেয়েটা নিজের অজান্তেই মস্ত বড় একটা ভুল করেছে। আমাকে আমার ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। যেটা আমি এক মুহূর্তের জন্যে মনে করতে চাই না। সেই বিবর্ণ স্মৃতি মনে হতেই আমার গায়ে কাটা দেয়। ঘৃণা হয় ভীষণ। তখন আমি আর নিজের মাঝে থাকি না। অন্য কোথাও যেন হারিয়ে যাই। যেন রাজ্যের বিষন্নতা, গম্ভীরতা আমায় আঁকড়ে ধরে। আমি চুপ করে থাকি অনেকক্ষন। চোখ মুখ শক্ত করে নিতুর দিকে তাকাই। নিতু চমকে উঠে। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি,
 "সাদিকের নাম্বার তোমার কাছে নেই? "
 নিতুর এবার অবাক হওয়ার সীমা ছাড়িয়ে গেল। কেবল চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি ওর চোখ দেখে যা বুঝার বুঝে নিলাম। বললাম,
 "এখন নাম্বার কি নিবা নাকি চুপ করে বসে থাকবা। দেখো এখানে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না। তোমাকে না হয় আমাকে,কেউ একজনকে এখান থেকে উঠতে হবে। বুঝতে পেরেছো?"
 নিতু কি বলবে ঠিক ভেবে পেল না।কেবল নিজের ফোনটা বের করে বলল,
 "নাম্বার বল!"
 আমি নাম্বার বলি। নিতু চুপচাপ নিজের ফোনে তুলে নেয়। নাম্বার নেওয়া শেষে বলে,
 "তুমি ভুল করছো তাসফি। মস্তবড় ভুল করছো। তুমি না বললেও আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি যে তোমার কোন খারাপ অতিত আছে। থাকতেই পারে। অনেকেরই থাকে। কিন্তু তাই বলে নিজেকে কষ্ট দেওয়া অপার্থিব। তোমার সাথে অনেক খারাপ কিছু হয়েছে। খুঁজে দেখো এরচে খারাপ আরো কতজনের সাথে হয়েছে! একটু ভালো করে দেখলে দেখবে তারা অনেকেই খুশিতে আছে। তোমার মত গম্ভীর নেই কেউ। কারণ তারা তাদের কষ্ট ভুলে গিয়ে এখন শান্তিতে আছে। তাসু আমি জানি কষ্ট ভুলা কঠিন। কিন্তু ভুলতে তো হয়। কাটার মত গলায় বাধিয়ে রাখা ঠিক না। পরে গিলতেও পারবে না আবার বের করতেও পারবে না। আজিবন এই একটু জিনিস গলায় বাধিয়ে তিলে তিলে মরবে তুমি। সেই মরবেই! কিন্তু সবার মত মারা যাবে না। সবাই একটু আদটু খুশি,শান্তি নিয়ে মারা যায়। কিন্তু তুমিই? তুমি মারা যাবে রাজ্যের অভিমান, কষ্ট নিয়ে। ওদের মৃত্যু মৃত্যুর মত হলেও তোমারটা হবে না। তুমি কষ্ট নিয়ে মারা যাবে। বিধাতা আমাদের একটা সিমিত সময় দিয়েছেন। এই অল্প সময়ে যদি সারা বেলা কষ্টের ভোজা মাথায় নিয়ে সেই কষ্টকে গলায় বেধেই মারা গেলাম তাহলে আমার জিবনে বেঁচে থাকার স্বার্থকতা কোথায়? কেন বেঁচে থাকব আমরা! যেখানে সকলে হাসিখুশি থাকছে। আমি তোমাকে মারা যেতে বলছি না তাসফি,কেবল বলছি একটু হাসার জন্যে। জীবনটা উপভোগ করার জন্যে। আমার কথা গুলো একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো। দেখবা তোমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে কয়েক গুণে বেড়ে যাবে। মরে যাবার কথা মাথায় আসবে না আর। অনেক ভালো থাকবে। তোমার সাথে সাথে তোমার প্রিয় এবং আশেপাশের মানুষ গুলোও ভালো থাকবে। কষ্ট পাবে না তারা। যেমনটা সাদিক পাচ্ছে। বেচারা কত কষ্ট করে তোমায় হাসানোর আর তুমিই কিনা তাকে কষ্ট দিচ্ছো!"
 আমার বুকের ভেতরটা যেন নড়ে উঠল। হায়! সাদিক  আমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে! আমি ওকে কষ্ট দিচ্ছি! হ্যাঁ খারাপ ব্যবহার করতাম ঠিকই কিন্তু কখনই তো ওর চোখে মুখে এতটা কষ্ট দেখতাম না! নিতু যেন আমার মনের কথাই বুঝতে পারল। বলল,
 "শুন ওর খারাপ লাগতে না পারে কিন্তু আমার লাগে। আর তুমি নিজের দিকে একবার তাকাও তাসু। কি চেহারা করেছো তুমি! আর..."
 নিতু কথাটা শেষ করতে পারল না।   কেউ একজন ওর হাত টেনে উঠাতে চাইল। আমি মাথা তুলে তাকাই।  মিরা এসেছে! একা! তার পাশের সুদর্শন যুবকটি কই? আমি খানিকটা অবাক হয়ে মিরার দিকে তাকাই। মিরা নিতুর হাত টানছে। কেন টানছে! মিরা বেশ কড়া স্বরেই বলল,
 " নিতু তুই এখানে কি করছিস! তাও আবার এই রোবটের সাথে!"
 নিতু হাসল। বলল,
 "এইত একটু কথা বলছিলাম। ওকে কথা গুলো বলা খুব জরুরী।"
 মিরা চোখে মুখে তীব্র রাগ এনে ভ্রু কুছকে বলে,
 "কেন! কি দরকার? আর কি এত জরুরী কথা বলছিলি?"
 "বলব! আগে আমাকে বলতে দে। ওকে বুঝাই। তারপর তোকে সব খুলে বলব। তুই আমাদের একটু একা থাকতে দে।"
 মিরার মাথাটা যেন গরম হয়ে গেল চট করেই। বলে,
 "তুই ওর সাথে কোন কথা বলবি না। কোন কথা বলা যাবে না।আয় আমার সাথে আয়।"
 এই বলে নিতুকে টানতে থাকে। নিতু বিরক্ত হয় এবার। বলে,
 "আরে এত টানছিস কেন? তুই যা আমি  আসছি। জাস্ট ওকে কয়েকটা কথা বলে আসি।"
 "না! তুই ওকে কোন কথা বলতে পারবি না। আর কোন পাথুরে মানুষের সাথে তো নাই!"
 "কি আশ্চর্য! আমি ওকে হেল্প করছি। আর তুই সেখানে আমায় বাধা দিচ্ছিস। আচ্ছা তুই এমন করছিস কেন? কি ব্যাপার! কোন কাজ আছে নাকি কোথাও যেতে 
  হবে?"
  "কোন কাজ নেই। তবে তোকে আমার সাথে যেতে হবে।"
  "কোথায় যাবো।"
  "জানি না।"
  "তাহলে টানছিস কেন? "
  মিরা চট করেই কিছু বলতে পারল না। কেবল অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।নিতু আবার বলল, 
  "কি ব্যাপার! কথা বলছিস না কেন? কেন ঢেকেছিলি? "
"কেন! তোকে কি আমি এমনি ডাকতে পারি না!"
"পারিস।পারবি না কেন? তবে এখন একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব তোর সাথে।"
"না এখন যেতে হবে। আয়। আয় আমার সাথে।"
"ছেলেটা আমার মস্তবড় বড় একটা উপকার করেছে। এবার আমাকে একটু করতে দে।"
"না! তুই ওর সাথে আর এক শব্দ কথা বলতে পারবি না।"
"আশ্চর্য! কেন পারবো না।"
"কারণ ও ভালো ছেলে না। বাজে ছেলে। কত মেয়েদের সাথেই ওর এমন ডেটিং হয়!"
"মিরা আমি সেদিন থেকে লক্ষ্য করছি তুই সুযোগ পেলেই তাসুকে অপমান করিস।কেন বলতো!"
মিরার মেজাজটা এবার সত্যি গরম হল। বলল,
"খবরদার তুই ওকে তাসু বলে ডাকবি না। তোকে তাসু বলে ডাকাত অধিকার কে দিয়েছে? খবরদার ওকে এই নামে ঢাকবি না। ওকে কেবল আমিই এই নামে ডাকব। এই নামে ডাকার অধিকার কেবল আমার আছে। কেবল আমার। কেবল তুই না। এই পৃথিবীর কোন মেয়েই ওকে এই নামে ডাকতে পারবে না। ডাকলে আমি সত্যিই তাকে খুন করবো।"
আমি সহ নিতু দুজনেই চমকে উঠলাম। কি বলে এই মেয়ে। মাথা ঠিক আছে? নিতু তো দাঁড়িয়েই গেল।বলল,
"মানে? কি বলছিস এসব! "
মিরাকে একটু অস্থির দেখালো। কেমন অস্বাভাবিক। গা যেন কাঁপছে। চোখ মুখ লাল করে মিরা বলল,
"যা বলছি তাই।আমি যা বলছি তাই সত্য।আর ওকে এই নামে ডাকা তো দূরে থাক ওর সাথে কথাও বলা যাবে না। কেউ বলতে পারবে না। নিতু তুইও বলতে পারবি না। এখানে ওর সাথে আর একটা শব্দ  বলবি তো তোকে আমি খুন করব। এতে আমাদের বন্ধুত্ব গেলে যাবে। তবে তুই ওর সাথে কোন কথা বলতে পারবি না।"
আমরা কেবল আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটার মাথা ঠিক আছে? নিতু বলল,
"এই মিরা! তোর মাথা ঠিক আছে। কি যাতা বকছিস তখন থেকে। আর কি জানি বললি? খুন করবি! ওর সাথে কথা বললে খুন করবি? দেখ আমি ওর সাথে কথা না ওর হাত ধরবো। দেখি তুই কি করতে পারিস।"
এই বলে নিতু আমার হাত ধরল। মিরা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে যেন নিতু টেনে ফেলে দিল। তারপর চট করেই আমার হাত চেপে ধরল। বলল,
"ওর হাত কেবল আমি ধরবো। এ অধিকার কেবল আমার আছে।তুই কোন অধিকারে ধরছিস ওর হাত?
এরপর আর যদি দেখি তাহলে তোকে সত্যিই খুন করব আমি।" এবার আমি মুখ খুললাম। ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
"আপনি কোন অধিকারে ধরছেন। কে দিল আপনাকে এই অধিকার।"
মিরা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। আমি যেন চমকে উঠলাম। ওর চোখে জল জমতে শুরু করেছে। আশ্চর্য! ও কান্না করছে কেন? আমি আবার বলি,
"বেশ তো আমাকে খারাপ ছেলে বলে পুরো ক্যাম্পাস মাইকিং করেছিলেন। এখন আসল খারাপ কে? যে নিজের বফের হাত ছেড়ে আমার হাত ধরে,সময়ে সময়ে বফ পাল্টায় সেই কি খারাপ নয়?"
"তাসফি..."
"খবরদার আপনি আমার নাম ধরে ডাকবেন না। আপনি যেমন আমায় চিনেন না ঠিক তেমনি আমি আপনাকে চিনি না।"
"তাসু! প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর। ও আমার বফ না। আমার ফুফাতো ভাই।আমি ওকে..."
"হাহ! এখন নিজের বফকেও অস্বিকার যাচ্ছেন। সত্যিই আপনার দ্বারা সবই সম্ভব।নিতু তুমি যাবে! গেলে আসো।এখানে আমার আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।"
"তাসু প্লিজ..."
আমি আর পিছন ফিরে তাকালাম না।হাটা ধরলাম।নিতু আসে নিই। সে কেবল একদৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকিয়ে ছিল।এখন কি করছে সেটা ঠিক জানি না আমি। আমি চলে এলাম। এত ছলনার মাঝে আর থাকা যায় না।
.
সাদিককে আজ ভার্সিটিতে দেখলাম। ভালো লাগল আমার। বন্ধুটা অনেকদিন পর আসল ভার্সিটি। আমি একটু তাড়া দিয়ে ওর কাছে গেলাম। আমাকে দেখতেই ও ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। আমার জন্যে একটু দাঁড়ালোও না। আমি ভীষণ খারাপ লাগল। তবুও তাড়াতাড়ি করে ক্লাসে গেলাম। বন্ধুটা আজ এল! 
ক্লাসে ঢুকতেই একটু কেমন যেন লাগল। একটু থমথমে পরিবেশ। আশ্চর্য নিরাবতা সবার মাঝে। আমি এত কিছু খেয়াল না করে সাদিকের পাশে গিয়ে বসলাম। ক্লাস তখনও নিরব ছিল। আমি এবার অবাক হলাম। নিতুকে দেখলাম মুখ কালো করে বসে আছে। সাদিকও। মিরা যেন একটু পর কান্না করে দিবে। আমি সাদিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললাম,
"কি রে। কি হয়েছে বল..."
সাদিক আমার পাশ থেকে উঠে গেল।এবার আমার অবাক হওয়ার সীমা ছাড়িয়ে গেল। সাদিক এমন ব্যবহার করছে কেন?
সাদিক ক্লাসের সবার সামনে গেল। একেবারে স্যার যেখানে দাঁড়ান সেখানে। সাদিককে কেমন জানি দেখাল।একেবারে অন্য দিনের চেয়ে আলাদা। সাদিক বলতে লাগল,
"গত কয়েক দিন ভার্সিটি আসি নি। তার একটা ক্ষুদ্র কারণ আছে। একটা গল্প জেনে সেটা হজম করতে আমার ঠিক তিনদিন লেগে গেল। আমি এখন ভুলতে পারছি না। এত খারাপ লাগছে যে বলে বুঝাতে পারব না। একবার ভেবে দেখো আমার ভেতর যদি এত খারাপ লাগা কাজ করে তাহলে যার সাথে এটা ঘটেছে তার ভেতর কতটা খারাপ লাগবে,কতটা কষ্ট হবে সেটা ঠিক আমার অনুমেয় নয়। এটা অনুমান করতেও আমার খারাপ লাগবে। কষ্ট হবে। আমি সেটা চাইও না। আমি কেবল গল্পটা বলতে চাই। যাতে তোমারা মানুষটিকে না ভুল বুঝো। যেন ভালোবেসে একটু কাছে টেনে নাও। গল্পটা আমার এক বন্ধুর। খুব প্রিয় বন্ধু। নাম তাসফি। ওর দাদুকে অনেক রিকোয়েস্ট করার পর উনি বললেন। আর উনি বলার পর আমি আর নিজের মাঝে থাকলাম না। অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করতে থাকল আমার মনে।..." 
সাদিক বলতে থাকে। আমি আমার চমকে যাওয়া ভাবটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। কদিন থেকেই দেখছি আমি অন্য রকম হয়ে যাচ্ছি। আর গম্ভীর থাকছি না। হাসিখুশি থাকতে ইচ্ছে করে আজকাল। সাদিক গল্প বলে। আমার মনে বিষন্নতা বাড়ে। এই গল্পটা বললেই আমার গম্ভীরতা আসে। কষ্ট হয়। আমি উঠে দাঁড়াই। এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না। থাকলে আমার গম্ভীরতা, কষ্ট ফিরে আসবে। আমি খুব করে চাচ্ছি তারা যেন ফিরে না আসে। কোন ভাবেই যেন না আসে। আমি ক্লাস থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাই।
.
আমার মন খারাপ থাকলেই আমি মিহিনের কাছে চলে আসি। মিহিনের কবরের কাছে। দুএকটা কথা বলে নিজেকে হালকা করি। ভার্সিটি থেকে সোজা এখানে চলে আসি। আমার ছোট বোনটার সাথে কথা বলতে।কিন্তু আজ কেন জানি কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেবল কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনেক দিন পর আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমি কান্না করে দিলাম। চীৎকার করে কাঁদলাম। প্রায় বিশ বছর পর এত জোরে,এত কষ্ট, এত আবেগ নিয়ে কাঁদলাম। বললাম,
"বোনরে কি দোষ করেছি আমি। তুই গেলি গেলি আমাকে সাথে নিয়ে যাতি। দাদুকে সহ নিয়ে যেতি। কেন আমাদের একা ফেলে চলে গেলি। এত অভিমান তোর! এত রাগ! কেন গেলি! কেন আমায় একা ফেলে গেলি।  এই ভাইটার জন্যে একটু মায়া হল না। একটু ভালোবাসার টানেও বুঝি তোর থাকতে ইচ্ছে হল না। জানিস আমার বন্ধুরা আমাকে হাসানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাদিকটা তো আজ গল্পটা বের করেই ফেলল। আর মিরা! সে তো আছেই। তাকে কি বলব আমি ঠিক বুঝতে পারি না। সে নিজেই আমাকে বুঝে না। আমার ভালোবাসা বুঝে না। সে জানে না আমি তার জন্যে আজ হাসতে চাচ্ছি। বাঁচতে ইচ্ছে হয় কেবল তার জন্যে। কিন্তু দেখ, সেও তোর মত কি নিষ্ঠুর! আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে সেদিন নিজের প্রেমিক নিয়ে হাজির হল। বিশ্বাস কর তার সাথে ওই ছেলেটিকে দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। বুকে ফেটে কান্না আসে আমার। সে আমায় বুঝে না। তুই আমায় বুঝিস নি। তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব। মিরাকে হারালে যে আমার বেঁচে থাকার মানে টাই হারিয়ে যাবে। এত কষ্ট নিয়ে বাঁচবো কিভাবে। কিভাবে বাঁচবো!"
আমার চোখ আজ বাধা মানে না। আষাঢ়ে বর্ষণ শুরু হয়। আমি কান্না করি। চিৎকার দিয়ে কান্না করি। চিৎকারের সাথে যেন দলা দলা কষ্ট বের হয়। অভিমান ভেঙ্গে চুরে নাই হয়ে যায়। আমার বাঁচার আকাঙ্ক্ষা যেন তীব্র হয়। সাথে মিরাকে ফিরে পাবার আশা জাগে মনে। আমি কাঁদি। মন খুলে কাঁদি। ঠিক তখনই পিছন থেকে কারো ভেজা গলার আওয়াজ ভেসে আসে।কন্ঠটা সাদিকের।বলে,
"প্রমাণ তো পেলি। গাধাটা তোকেই ভালোবাসে। তোর গাধা তোরই আছে।থাকবে। কেউ হাত দিবে না। খবরদার এরপর থেকে আমার নিতুর গায়ে অযথা টাচ করবি না। তাকে কি ব্যাথাটাই না দিলি সেদিন। যেন আমার বুকে সুই ঢুকিয়ে দিলি। কত বড় সাহস! আমার নিতুকে ফেলে দেয়! আবার ধাক্কা দিলে দেখে নিবো কিন্তু হু!"
সাদিক থামে। আমি ততক্ষনে পিছন ফিরে তাকাই। ওরা তিনজন এসেছে। মিরার সাথে সুদর্শন ছেলেটি নেই। তাহলে কি মিরা সেদিন সত্য বলেছে!
মিরা সাদিকের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া স্বরে বলে,
"আমি মারবো। সে যদি আর কোন দিন তাসুর হাত ধরে, ওকে তাসু বলে ঢাকে তাহলে ওকে খুন করে ফেলবো।হুহ! উনার সাহস কত! আসছে আমার বরের  হাত ধরতে।"
নিতু হাসল এবার। বলল,
"এতই যখন ভালোবাসতে তাহলে ওকে এত অপমান, এত কষ্ট কেন দিতি।"
মিরা আমার দিকে তাকায়। তার চোখে জল জমে আবার। বলে,
"দেখ ও কখনই আমাকে কিংবা তোদের কাউকেই নিজের এমন গোপন কথা বলেনি। আমরাও জানি না তার গম্ভীরতার কারণ। তাই জানার জন্যে উঠে পড়ে লাগলাম। ঠিক সেদিনই ও আমাকে প্রচন্ড রকমে এভয়েড করে। আমার কষ্ট হয় ভীষণ। কেবল মনে হত ও আর আমার নেই। আমার কাছে নেই ও। অথচ ওকে এতদিন নিজের কাছে আগলে ধরে রেখেছি। এখন কিভাবে হারাই!  গাধাটাকে বুঝাতে চেয়েছি যে আমি তার জিবনে কত গুরুত্ব পূর্ন।  আর আমি কি করে জানতাম যে ও আমাকে ভালোবাসে! ও তো একটা রোবট।তাই কোন উপায় না পেয়ে নিজের ফুফাতো ভাইকে কাজে লাগালাম। প্রথম দিন ওর চোখ দেখেছিস! কেমন জানি জ্বলে উঠল। সেদিন থেকেই ডোজটা একটু বাড়য়ে দিলাম।হিহিহি।"
মিরা হাসল। আমি ওর হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর করে হাসে। আমি মুগ্ধ হই। মুগ্ধ হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকি। ঘোর লাগা চোখে তাকাই আমি। মানুষ এত সুন্দর হয়! আমি চট করেই অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করলাম। কেমন জানি অনুভূতি হল আমার হৃদয়ে। আমার চোখে জল জমে।খুশির জল। প্রথমবারের মত আমি প্রচন্ড রকমে আনন্দিত হয়ে কান্না করি। মিরা অপেক্ষা করে না আর। হুট করেই চোখে একগাদা জল এনে আমার দিকে দৌড়ে আসে। আমার বুকের বাঁ পাশের ধপ ধপ শব্দটা যেন প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে। মেয়েটা সত্যি আমাকেই ভালোবাসে। ওর জন্যে যদি আমাকে মরতেও হয় তাহলে আমি এক পাঁও পিছনে নিবো না।
.
গল্পে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এলোমেলো লাইনে ভরপুর। কোন মজা নেই যেন। এর কারণও আছে বটে। এই গল্পটা আর লিখতামও না। কেবল দুএকজন মানুষের কারণের দিলাম। এই প্রথম কোন গল্পের থিম নিয়ে আমার ভীষণ অনীহা জাগল। তারও একটা কারণ আছে। বলার উপায় নেই। তা না হলে বলতাম।ক্ষমা করবেন ।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url