গল্পঃ ফিরে তাকানো হয়নি।

বাংলা গল্প Love Stories Bangla Choto Golpo  Bangla Valobashar Golpo Bangla Golpo.


গল্পঃ ফিরে তাকানো হয়নি 


বেশ ঝাকঝমক ভাবেই আমার আর কাবেরির বিয়ে হয়েছে।অসাধারণ রূপবতী কাবেরি।যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনই ওর প্রেমে পড়ে যাই। ঘন কাজলে
ঘেরা  দু'চোখ, ঠোটে লালছে কালারের আবরন, মুখে সামান্য আটাময়দার প্রলেপ দেওয়া, মেরুন কালারের শাড়ি পরিহিতা মেয়েটাকে দেখে আমি যেন কোন ভাবেই চোখ ফিরাতে পারছি না। আমি তখন আমার "আমি" কে হারিয়ে ফেলি। খুঁজে পাই আমার 'তুমি' কে।তারপরেও যা যুগ পড়েছে! তাই ভালো মতে খবর নিলাম।ওর প্রতিটা পজেটিভ খবর আমাকে ওর প্রতি আরেকটু আকৃষ্ট করেছে।আরেকটু নমনীয় করেছে আমার হৃদয়টাকে।আমি কোন খুতই পেলাম না বিয়ের জন্যে 'না ' করার।আর তাছাড়া কোন মেয়েই সব দিক দিয়ে সমান নয়।কোন বা কোন দিক দিয়ে কম তো আছেই।এটা বিধাতার নিয়ম।বিধাতা কাউকে ঠকায় না।
বিয়ের আগে ফোন দিতাম। কেমন আছে জিজ্ঞেস করতাম। এতটুকুই!এতটুকু শুনার পরেই আমার হৃদয়টা কেন জানি জুড়িয়ে যায়।ওর চিকুন স্বরের কোন কন্ঠ আমার হৃদয়ের দ্বার ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে।সত্যিই তখন এক অন্য রকম অনুভুতি হত। ফোন দিলে বেশি কথা হত না। একটুও না! লজ্জা পেতাম।দুজনে ভিষন লজ্জা পেতাম।আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতাম, "কেমন আছ? " ও পাশ থেকে ভেসে আসত সেই স্বরটা।ফোনের স্পিকার ভেদ করে কানে পর্দা অতিক্রম করত সেই মধুর বানি খানা।"ভালো।আপনি? "  আমি আর কথা বলতে পারতাম না। কথা আর সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না আমার।টুপ করেই কলটা কেটে দেই। আবার দেই।আগের নিয়মে চলতে থাকে।সেই জায়গাতে এসে আবারে ফোন কেটে দেই।এভাবেই খেলতে থাকি আমরা।অদ্ভুত সেই খেলা। আমার  মন চাইত সারাদিন ওর সাথে কথা বলি।
কিন্তু কোন এক জড়তার কারনে তা আর হয়ে উঠে না।
.
বাসর রাত কেমন তা আমি জানি না।কি করব,কি বলব ওর সামনে গিয়ে, খুব টেনশনে হচ্ছিল।একগাদা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল।খুব ঘামিয়ে গিয়েছিলাম।
আমার এ নির্মম অবস্থা দেখে কত তামাসাই না করেছে ভাবি আর আন্টিরা।সে আর বলতে।হাসতে হাসতে যেন গড়িমসি অবস্থা। 
সেই রাতে ওকে সর্ব প্রথম একটা কথাই বলেছিলাম,
"তোমার যা চাই আমি তোমায় তাই দিব,আমি তোমার সব চাওয়া পুরুন করব।কিন্তু আমার মাকে কখনওই কষ্ট দিওনা কখনই না।উনার কষ্ট আমি একদম সহ্য করতে পারি না।"
সে সেদিন মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।আর আমি মৃদু হাসলাম।
.
খুব ভালোই ছিলাম আমরা।এই বেশি ভালো থাকাটাই হয়ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।শুনতে হয় আশ্রাব্য সে বানি।  আমার মা মারা যায়।বিদায় নেয় আমাদের ছেড়ে। পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে।খুব ভেংগে পড়ি।কারন এই মা ছাড়া এই জগৎ সংসারে আপন বলতে কেউ নেই।ভিটে বাড়ি আছে নোয়াখালী। একটা বাড়ি আছে ওখানে আমাদের।আমার নামে বাড়িটা।
ব্যস এতটুকুই। এখন কাবেরি আর সেই ঠিকানাই আমার একমাত্র পরিচিত।
 . 
কাবেরি আমাকে অনেকটাই স্বাভাবিক করে তুলেছে।
কষ্ট গুলো ভুলে যেতে সাহায্য করেছে। 
আমি আর কাবেরি প্রতিদিন বিকেলবেলা মনপুরি পার্ক এ যেতাম।ও আমার কাঁদে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। গৌধুলিরর রক্তিম আলো ওর মুখটায় পড়ত। ফর্সা মুখটা কিছুটা লালছে হয়ে যেত। আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও লজ্জা পেয়ে আমার বুকে মুখ লুকাত।আমি ওকে বাহুডোরে জড়িয়ে নিতাম।
চাঁদনি রতে দুজনেই ছাদে যেতাম।শুধু আমরা আর আমাদের ছায়া মূর্তি থাকত। নিস্তব্ধ থাকত রাত।মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ আসত।সাই করে চলে যেত একটা গাড়ি।তারপর আবার সব নিরব।নিস্তব্ধ ।ও থাকত আমার বাহুতে মাথা রেখে।খুব শক্ত করে ধরে রাখত।আর আমি শুধু তাকে দেখতাম। হাজার বছর বাঁচলেও আমি শুধু তাকেই দেখতাম।শুধু তাকেই দেখে যেতাম।জানি না! ওর ওই দু'চোখে কি আছে।কেন আমাকে ওর প্রতি এতটা দূর্বল করছে।কেন আমাকে মহিত করছে।আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না।তবে এটা বুঝতে পারতাম যে কিছু একটা আমাকে ওর প্রতি আকৃষ্ট করত।ওর প্রতি ভালোবাসা যোগাত।মাঝে মাঝে খুব রাগও করত কাবেরি।অভিমানি স্বরে বলত,
: এভাবে তাকিয়ে থাকার কোন মানে হয়? আমার লজ্জা লাগে না বুঝি।
আমি ওর কথা শুনে কি বলব বুঝতে পারি না।কথা আসে না মুখ দিয়ে।কেবল তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয়।ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না।  
ও কখন ঘভির রাতে বলে নি আইস্ক্রিম  খাবে।শুধু একটা অতি সামান্য অনুরুধ করেছে। বলেছে, "চাঁদ দেখব"।আমিও নিয়ে যেতাম।না করতাম না।কারন ভালো লাগত আমার। ও বিছানা থেকে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকত।একটুও নড়ত না।অন্যদিকে তাকিয়ে কিছুটা আহ্লাদী হয়ে বলত,
:আমি হাঁটতে পারব না।সারাদিন সংসারের কাজ করতে হয়ে। এ ঘর ও ঘর দৌড়াতে হয়।আমার পাঁ ব্যাথা হয়ে যায়?  কথা শুনে আমি মৃদু হাসতাম কেবল।কিছু বলতাম না।
 কোলে তুলে ছাদে নিয়ে যেতাম।
.
কত সুন্দরই না ছিল দিন গুলো। বারান্দায় দাড়িয়ে কথা গুলো ভাবছে তাসফি। তখনও গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ও হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে পানি গুলো মুছলো।খুব নোনতা পানি গুলো। অব্যক্ত কিছু কথা লেগে আছে এখানে।যা কখনই জানতে পারে নি কাবেরি।ওই তিন মাস খুব ব্যাস্ত ছিলাম।কিন্তু তাই বলে এমন হবে?বিধাতা এমন বিচার করবে আমার প্রতি?কাবেরি  আমার ছোট ছেলেটার কথাও ভাববে না ।কেন ও এমন হয়ে গেল?কেন?
বেশি ভালোবেসেছি। তাই বলে এমন শাস্তি? 
কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল তাসফি।কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে আসল।বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।চিঠি লিখবে তাসফি।চিঠি!!
.
যথা রিতি অফিস থেকে আসলাম।কিন্তু ও দরজা খুলতে এত দেরি করছে কেন? এখন প্রতিদিনই দেরি করে দরজা খুলে।কাহিনি কি? ?তবুও কিছু বলতাম না।ভালোবাসি বলে। দরজা খুলেই আমার দিকে না তাকিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল।আমার ছেলে রোহান দোড়ে বাবার কোলে আসত।এসেই বলত,
বাবা আমার চোকলেট কই?
আমি বলতাম,
ওহ বাবা সরি।বাবা আনতে ভুলে গেছি।
ও কিছু বলত না।মন খারাপ করে বসে পড়ত। কিছুক্ষণ পর ঠোট উল্টিয়ে কান্না করবে।তার আগেই ওকে চকলেট গুলো দিয়ে দিতে হবে।ওর এই মন খারাপের মুড টা দেখলেই ভালো লাগে
ভিষন ভালো লাগে আমার।ঠিক ওর মায়ের মত। তাই ওর সাথে এমন করি।
চকলেট গুলো পেয়ে খুব খুশি হত ও।আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
তুমি আমার ভালো বাবা।
তারপর গালে একটা চুমু দিয়ে পালাত।
রাতে ঘুমানোর সময় আমি কাবেরি কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই।তাই যথা রিতি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্ত আমি ওকে জড়িয়ে ধরার পর আমি অন্য কারো গায়ের গন্ধ পেলাম।যেখানে আমি প্রতিদিন ওর শরির হতে আমার গায়ের গন্ধ পেতাম সেখানে অন্য কারো গন্ধ?কাবেরি কেমন জানি করে উঠল। যার দ্বারা বুঝা যায় ও নিজেকে ছাড়াতে চাচ্ছে। আমি ওকে ছেড়ে অন্য পাশ হয়ে শুলাম। ও একটা বড় শ্বাস ফেলল। যা বুঝায় "যাক বাবা বাঁচা গেল "
আমি ওর সাথে এতটা জড়িয়ে গিয়েছি যে,ওর শরিরের গন্ধ আমার বেশ জানা আছে।একদিন, দুইদিন, তিনদিন নয় পুরা এক মাস ওর গায়ে অন্য কারো গন্ধ পেলাম। এই গন্ধটা আমার খুব পরিচিত। কিন্তু কার তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।গন্ধটা যত তিব্র হচ্ছে আমি ওর থেকে তত দুরে সরে যাচ্ছি।যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি আমি।কাবেরির মাঝে আর আমাকে খুঁজে পাই না আমি।একদম না।অন্য কাউকে পাই।ওর চোখে অন্য কেউ খেলা করে।অন্য কারো ছায়া ভাসে ওর দু চোখে। যা আমি একদম সইত্ব পারি না।একটুও না। এখন আমাদের মাঝখানে রোহান ঘুমায়। খুব কষ্ট হত।কিন্তু কি পোড়া কপাল আমার,আমি কাঁদতেও পারতাম না।কাঁদার সময় পেতাম না আমি।অফিসে এ কাঁদা যায় না।বাড়িতে ওদের সামনে কাঁদতে পারতাম না।
একটু কান্না করে যে নিজেকে হালকা করব সে উপায়ও নেই। ভিষন এক লাগতে শুরু করে আমার।মায়ের নিষ্পাপ মুখখানা ভেসে উঠে দু'চোখে।
কিছুদিন পর,
অফিসের কাজে মন বসছিল না।তাই ভাবলাম তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাই।আমি জানি এই সময় কাবেরি রোহান কে স্কুল থেকে আনতে যায়।তাই আস্তে আস্তে হাঁটতেছিলাম।একটা রিক্সা নিলাম।বাড়ির মাঝা মাঝি পথে আসার পর দেখলাম, ফুটপাতে কেউ একজন কারো হতে হাত ধরে হাটতেছে।ওদের দেখে খুব ভালো লাগল।আমি আর কাবেরিও এমন হাঁটতাম।কাবেরির কথা মনে হতেই মেয়েটার শাড়ির দিকে নজর গেল।খুব চেনা মনে হচ্ছে। সেবার কাবেরি কে এমন গোলাফি কালারের একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম।কি খুশিটাই না হয়েছে ও। আমি চট করেই মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম।আমার চামড়া যদি কেউ টানদিয়ে ছিড়ে ফেলত তবুও আমি এতটা কষ্ট পেতাম না যতটা কষ্ট পেলাম ওদের দেখে।পুরো গা যেন জ্বলে যাচ্ছে।কেউ যেন পেট্রল ঢেলে আমাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।অভি! আমার খুব ভালো বন্ধু।বন্ধু বললে ভুল হবে।আমার ভাই বলা যায়।যার রক্ত আমার শরিরে প্রবাহিত হচ্ছে।যে আমাকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে!সেই অভি কাবেরির হাত ধরে হাঁটতেছে।অভিকে কাবেরির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম কয়েক মাস আগে।তারপর থেকেই হয়ত...?তারপর থেকে হয়ত আমি হারিয়ে গেছি।
অভি কে খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন বাঁচালি আমায় সেদিন?এই দৃশ্য দেখার জন্যে?
ছিঃ কতটা নিষ্ঠুর তুই।
.
চিঠি দুটো লিখা শেষ। একটা কাবেরির আরেকটা অভির।চোখ দুটোর পানি মুছল তাসফি।তারপর উঠে দাঁড়াল। লাইটটা নিভিয়ে দিল।
.
প্রিয় বলাটা ঠিক হিবে কিনা তা আমি জানি না।তবুও যেহেতু আমি এখনো তোমার স্বামি তাই প্রিয় বললাম।অন্যথায় ক্ষমা করে দিও।আমি বেশ কিছুদিন যাবত তোমার মাঝে অনেক পরিবর্তন দেখতে পারছি। কিন্তু শেষ পরিবর্তন টা আমি মানতে পারি নি।কিছুতেই না।তুমি বাবুকে কারনে অকারনে মারতে।যা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।এতটা নিষ্ঠুর তুমি? তাই আজ চলে যাচ্ছি কোন এক অজানা নিড়ে।খুব ভালোবাসাতাম তোমাকে আমি।এটাই হয়ত তার মূল্য।সবাই বলত ভালোবাসার মানুষ যদি তাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে সুখি হয় তাহলে তোমার উচিৎ তাকে তার ভালোবাসার কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু আমি তোমাকে অভির হাতে পৌঁছে দিব যে সেই ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেন নি।আমি কিছুতেই সেটা করতে পারব না। তাই পারলাম না।ক্ষমা চাচ্ছি তার জন্যে। সুখে থেক তোমরা।শুধু একটা প্রাশ্ন আমার মাঝে রয়েই গেল,
আমি কি তোমাকে ভালোবাসতে পারি নি?আমি কি...
ওর বাকি লিখা গুলো বুঝা যাচ্ছে না।কাগজের নিচের দিকটা ভিজে আছে।হয়ত কারো অস্রু জলে।
কাবেরিও আর পড়তে পারছে না।চোখ গুলো ঝাপসা হয় গেল।চল চল করে উঠল ওর
চোখ দুটো। চারপাশ থেকে বিন্দু বিন্দু জল জমা হতে থাকল।এই পড়বে বলে।
.
:কি হল জান কথা বলছ না কেন? কি হয়েছে তোমার? সেই থেকে কান্না করে যাচ্ছ তুমি।কিছুত বল...
হস্তদন্ত হয়ে কথা গুলো বলল অভি।কাবেরির জবাব না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
:অ্যাই। কি হয়েছে তোমার?অ্যাই কাবেরি? 
কাবেরি কাঁপা হতে একটা চিঠি অভি কে দিল।তার উপরে লিখা, "শুধু তোর জন্যে অভি "এই হাতের লিখাটা খুব করে চিনে অভি।কোন এক প্রিয় বন্ধুর হাতের লিখা ওটা।হ্যাঁ মনে পড়েছে।তাসফির হাতের লিখা ওটা।তাসফির? অভি খামটা খুলে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করল,
ভাই অভি,
তোকে আমি নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম।আমার তো ভাই ছিল না।তুই তার অভাব পূরন করলি।এই পৃথিবীতে আমার মাত্র তিন জন আপন জন আছে।কাবেরি,রোহান, আর তুই।তুই তোর রক্ত দিয়ে আমার জীবন বাঁচিয়েছিস।মনে আছে সে কথা তোর।আমাকে ভার্সিটিতে রাফি মেরেছিল।আর সেদিন আমাকে মারার কারনে তুই রাফিকে মারলি।এত মারলি যে ও এক মাস হাসপাতালেই ছিল।তোর ভয়ে আমাকে ভার্সিটির কেউই কিছুই বলত না।মনে পড়ে সে কথা গুলো। মনে পড়ে সেদিন তুই ক্যাম্পাসে চিৎকার দিয়ে বলেছিস "তাসফি আমার ভাই।আমার ভাই তাসফি।" জানিস সেদিন কি যে ভালো লেগেছিল না রে? এতেই আমি খুব খুশি। তবে আমার একটা রিকুয়েস্ট প্লিজ না করিস না।তুই আমার কাবেরি কে সুখে রাখিস। আমি তো রাখতে পারলাম না।তাই তুই একটু দেখে রাখিস।ওর যেন কোন ভাবে ক্ষতি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখিস।আর শুন তুই তো উকিল।প্লিজ ডিবোর্স লেটার টা খুব জলদি পাঠিয়ে দিস।আমি আমার ই-মেইল দিয়ে দিয়েছি।আমাকে খোঁজার না চেষ্টা করলেই খুশি হব।ওকে নিয়ে খুব ভালো থাকিস।
ইতি
তাসফি।
.
তাসফি নিজের ট্রান্সফার করায়।এখানকার উপজেলা ওর অফিস।
তাসফির দিনকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না।রোহানটা শুধু ওর মাকে দেখতে চায়।কিন্তু ওকে যে কি করে বুঝায়?নিজে রান্না করে খায়।সব কিছু নিজেই করে।নিজের পুরোন বাড়িটাতে এসেছে তারা।অনেক সৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।গ্রামের মানুষ খুব ভালোবাসত ওর বাবা কে।সেই সুত্রে তাসফিও ভালো সন্মান পায় তাদের থেকে।এখানে রোহানের কিছু বন্ধু হয়।অবশ্য তাদের তাসফিই জুটিয়ে দেয়।কিন্তু তারপরও প্রায় ওর মন খুব খারাপ থাকত।
ভিষন খারাপ থাকত।
.
প্রায় মাসতিনেক পরের কথা,,,
তাসফি যথারিতি অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে।রোহান আরো আগেই আসে ওর এক বন্ধুর সাথে।স্কুলটাও বেশি দুরে নয়। তাসফি দরজা নক করল।দরজা খোলা মাত্রই অন্য কারো মুখ ভেসে উঠল। খুব চেনা সে মুখ।কাবেরি!! হ্যাঁ এটা কাবেরিই?'কি হাল হয়েছে ওর চেহারার।বুকের কষ্ট আর বিষন্নতা আড়াল করে বললাম,
আরে কাবেরি?কি অবস্থা তোমার?? অভির কি...
আরে অভি তুই এখানে?খবর কিভবে পেলি?কিভবে আসলি এখানে?
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই
দুজনে হঠাৎ আমার পাঁয়ের উপর পড়ল।সে কি কান্না ওদের।
আমি ওদেরকে বুকে নিলাম।তারপর সোফায় বসালাম।
বল কি অবস্থা তোদের?কবে বিয়ে করলি?
অভি বলল,
:আর কত নিজে কষ্ট পেয়ে অন্যকে আনন্দ দিবি বল।সে বারো তেরো বছর হতেই দেখে আসছি তুই সবার কথা ভাবিস।বিনিময় তুই কষ্ট পাস।কেন?তুই এমন কেন বল?
আমি বললাম,
:সেটা তুই আমার থেকে ভালোই জানিস। এখন বল তোদের বৈবাহিক জীবন কেমন যাচ্ছে।
ও বলল,
:এ নিয়ে আর একটা কথা বললে তোকে আমি খুন করব।আরে আমি না হয় ভুল পথে যাচ্ছিলাম, তোর তো উচিৎ ছিল আমাকে একটা চড় দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যে আমি ভুল পথে যাচ্ছিস।আমাকে না হয় নাই বললি,
কাবেরি কে তো বলতে পারতি?
আমি বললাম,
: তোরা দুজনেই সুখি থাকবি।তাই তোদের সুখের কথা চিন্তা করে আমার এই পথে আসা।
আর সবচেয়ে বড় কথা হল আমি তোদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি।
হঠাৎ-ই রোহান আসল।দৌড়ে গিয়ে ওর মাকে সরি কাবেরিকে আম্মু বলে জড়িয়ে ধরল। সাথে হাজারো প্রশ্ন।কাবেরিও ওকে জড়িয়ে ধরল।পরম মায়ায়।একজন মায়ের মত।যেন কত দিন পর ফিরে পেল তার শান্তিকে।তার ছেলেকে।আমি উঠে গিয়ে কাবেরির কাছ থেকে ওকে নিয়ে নিলাম।কাবেরি এমন ভবে তাকাল যেন এটা যে আমি করতে পারি না।
আমি রোহান কে বললাম,
বাবু উনি তোমার আম্মু নয়। আন্টি! আন্টি বলে ডাক উনাকে?ওরা দুজনেই আমার দিকে কেমন করে জানি তাকাল।মনে হচ্ছে এ আমি বলতেই পারি না।এমন কি রোহানও।রোহান মন খারাপ করে বেরিয়ে এল।দরজা থেকেই দেখা যায়,উঠনে সবাই খেলছে।আর আমার ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে।বড্ড খারাপ লাগল আমার।আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে অভিকে বললাম,
:কই ডিবোর্স পেপার দে। আমি সই করে দেই।
অভি আমার পাঁয়ের উপর এসে বলল
প্লিজ ভাই আমি তোর কথা রেখেছি।নিজের সবটা দিয়ে ওকে আগলে রেখে আমি তোর কাছে এনেছি।ওকে আমি সেদিন এরপর থেকে আমার হাত ওর শরিরে লাগাই নি।বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে একা একা।প্লিজ তুই ওকে মেনে নে।প্লিজ আমার এই রিকুয়েস্টটা রাখ।
:কি যা তা বলছিস।এটা কোনভাবেই সম্ভব না।অভি! কোন ভাবেই না।
:কেন সম্ভব না?
:তোরা দুজন দুজনকে ভালোবাসিস।ভিষন ভালোবাসিস।
:রাখ তোর ভালোবাসা।এটা কোন ভালোবাসাই নয়।আমরা আবেগের বসে ভুল করে ফেলেছি।তুই আমাদের ক্ষমা করে দে প্লিজ।প্লিজ ক্ষমা করে দে।
:তোর বয়স যদি এখন আঠারো কিংবা বিশ হত তাহলে আমি মেনে নিতাম এটা।আবেগ।কিন্তু এখন কোন ভাবেই এটা মানা যায় না যে তুই আর ও এটা আবেগের বসে করেছিস।
:প্লিজ দোস্ত।এমন বলিস না।
:ডিবোর্স পেপার তুই আনিস নি? না আনতে থাক।আমি নিজেই নিয়ে নিব।
তারপর অভি কি জানি দেখল।আমি সেদিকে তাকালাম।দেখলাম একটা কোরানশরিফ রাখা।ও আস্তে করে উঠে গেল।আমাকে বলল,বার্থরুমটা কোথায়? আমি অজান্তেই দেখিয়ে বলে উঠলাম ডানে গিয়ে বাঁয়ে। ও সেদিকে গেল।আমি আড় চোখে কাবেরির দিকে তাকালাম।দেখলাম,সে কান্না করছে।চোখ দিয়ে কেবল পানি পড়েই যাচ্ছে।আমি অবশ্য সেদিকে খেয়াল দিলাম না।কিন্তু ভিতরে যে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে,সব যে উলটপালট হয়ে যাচ্ছে সেটা কোন ভাবেই বুঝতে দিলাম না।চোখের পানি গুলো কোন মতে আঁটকালাম।
অভি এসেই কোরানশরিফ ছুঁয়ে বলল,
:এই কোরান ছুঁয়ে বলছি,আমি তোর কাবেরির হাতটা একটু ধরেছি। মাঝে মাঝে একটু জড়িয়ে ধরেছি।কিন্তু আমরা কোন দিনই চারদেয়ালের মাঝে আবদ্ধ হয়ে সময় কাটাই নি।তুই ভাবছিস তোর গায়ের গন্ধ কিভাবে হারিয়ে গেল।গন্ধ হারিয়ে যাবার জন্যে কোন রুমের প্রয়োজন হয় নারে পাগল।ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতেই আমার গন্ধ গুলো ওর মাঝে ছড়িয়ে গেছে।তোর থেকে দূরত্ব বাড়ার কারনেই তোর গন্ধ গুলো হারিয়ে গেছে।আমরা কোনদিন এক রুমে আবদ্ধ হই নি রে।একদম হই নি।
আমি কেন জানি চোখের জল গুলো আঁটকাতে পারছি না।কোন রকম উঠে গিয়ে দিলাম ওকে চড়।ভেজা কন্ঠে বললাম,
:এটা কোরান।মহান এটা! পবিত্র গ্রন্থ।আর তুই কিনা এই মহান গ্রন্থ ছুঁয়ে এসব কথা বললি।তোকে এমন বেয়াদবি কাজ কে শিখয়েছেরে?
:আমি কি করতাম বল।যদি এই পথে না যেতাম তাহলে কি তুই বিশ্বাস করতি?
:এতদিন আমার সাথে থেকে তুই এতটুকুও বুঝিস নি।আমাকে এতটুকুও চিনিস নি? 
ও কিছু বলল না।কেবল অপরাধির মত মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।কাবেরিও একটা কথাও বলল না।শুধু তার ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।আর একটু শব্দও হল না রুমে।কেবল বাহির থেকে বাচ্ছা গুলোর চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এল।তারা খেলাধুলা নিয়ে খুব ব্যাস্ত।শুধু রোহান বাদে।চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে বসে আছে।হয়ত ভাবছে "আমার মা কিভাবে আমার আন্টি হয়ে গেল।" এতটুকু একটা ছেলে।এসবের কিছুই বুঝে না।আমার কেন জানি আমার ছেলেটার জন্যে মায়া হল।ভিষন মায়া হল।এই মূহুর্তে ওর মাকে খুব দরকার। খুব! আমি আস্তে করে অভিকে জড়িয়ে ধরলাম। বাঁধ ভাঙ্গা কান্না ভেসে গেলাম দুজনে।কাবেরিও কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিল।বাচ্ছা গুলো খেলছে। হাসছে।চেঁচাচ্ছে।আর এই ঘরে কান্নার রোল পড়ছে।কি অদ্ভুত।ওরা কান্না করছে।কেউ টের পেল না।কেবল সাক্ষি থাকল  টিভিটা।সোফাগুলোও সাক্ষি রইল।রুমের লাইটগুলোও।চার দেয়ালের প্রতিটা ইট,বালু,কনা সাক্ষি রইল।এরা কান্না করছে। মিলনের কান্না।
.
কাবেরি আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।হ্যাঁ আজ ওর শরির হতে আমি আমার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। ও বলল,
:তুমি জানো? তুমি না থাকায় আমি তোমার একটা শার্ট জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম। কেবল মনে হত এটাই তুমি।যেন আমার পাশে তুমি,তোমার বুকে আমি মাথা রেখে আছি।
আমি শুনে থাকলাম কেবল।কিছু বললাম না। 
ও আমার বুকে মাথা রেখে কান্না শুরু করে দিল।
আবার বলল,
:জানো আমি কত দিন এই বুকে মাথা রাখতে পারি নি।ভেতরটা যেন ছিড়ে যাচ্ছিল।আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করে পেলেছি।কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর আমি এর পরে একটা দিনও সুখে ছিলাম না।অপরাধাত্ব আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল।
আমি প্রতিদিন মরেছিলাম।ধুকে ধুকে অনুশোচনয় মরে যাচ্ছিলাম। খুব ইচ্ছে হত মরে যাই।কিন্তু এত বড় অপরাধের বোজা মাথায় নিয়ে মরে যাওয়া হয় আমার।
আমি কিছুটা অভিমানি হয়ে বললাম,
:কেন?সুখের জন্যেই তো আমাকে...
আর বলতে পারলাম না।কথা বলার রাস্তা টা কেউ একজন ব্লক করে দিয়েছে।কথা নয় ভালোবাসা চলাচল করবে এখান দিয়ে।
.
আমি আর কাবেরি সহজে এক হই নি।আমি আর রোহান এক খাটে ঘুমাতাম।আর ও অন্য খাটে।জানি কষ্ট হত।তবে এটা ওর জন্যে প্রযোজ্য ছিল।বেশি দিন থাকতে পারি নি।হার মানতে হয়েছে ওর কাছে।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url