গল্পঃ ভালো আছি আমি ৩

গল্পঃ ভালো আছি আমি

তৃতীয় পর্ব

তাসফি আহমেদ


রাতভর আমার দুশ্চিন্তা যেন বেড়েই চলল। আমি খুব ভাবতে থাকলাম। অনিচ্ছাকৃত একটি অজানা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছি আমি। আমার এই সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হয়নি৷ ব্যাপারটা নিয়ে আমার আরো আগ থেকেই ভাবা উচিৎ ছিল। কেন ভাবিনি তা ঠিক বুঝতে পারছি না৷ আমার দ্বারা এমন ভুল হওয়ার কথা না। তবুও হয়ে গেল। আমাকে অতি সত্তর ভুলটা থেকে সরে আসতে হবে। এছাড়া গতি নেই৷ মীরা মেয়েটা আমার মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে ভীষণ। আমি চাই না সে জড়িয়ে যাক৷ আমি চাই সে আমার থেকে দূরে সরে গিয়ে ভালো থাকুক৷ ডিভোর্সি নারীদের বিবাহ নিয়ে জটিলতা থাকে। পুরুষদের তা থাকে না৷ পুরুষরা চাইলে সহজেই স্বল্প বয়সী কোনো মেয়েকে বিবাহ করতে পারে। ছাই সে পুরুষ তিনটা বিয়ে করা হোক না কেন, তার অতি ধন সম্পত্তি থাকলেই চলবে। বাবারা তাদের কন্যা দান করতে দ্বিধা করবেন না৷ আমার অবশ্য সে ইচ্ছে নেই৷ একটা মেয়ে কিংবা ধরুন একজন নব তরুণী অবশ্যই চাইবে তার স্বামীর জীবনে সে-ই প্রথম নারী হোক৷ ছেলেটির ডিভোর্স হয়েছে শুনলে কতিপয় নারী সবার অগোচরে অথবা গোচরে নাক কুচকে নেয় কিংবা যে নব তরুণী বিয়ে করবে তার মনে একটি ঘৃণ্য অনুভূতি তৈরী হয়৷ যা নিতান্তই স্বাভাবিক। আমার এই ধারণাটাই মূলত আমাকে কোনো নব তরুণীকে বিয়ে করার জন্যে বাধা দিচ্ছে। আর সত্যি বলতে আমি এই মূহুর্তে বিয়ে করার মানসিকতায় নেই। যদিও মীরা মেয়েটি আমাকে ভীষণ রকম কাবু করে নিয়েছে। এখন আমি সেই কাবু থেকে বের হতে চেষ্টা করছি। কিন্তু তার সামনে গেলেই আমি যেন নাই হয়ে যাই৷ সে যা বলে তা শুনতে যেন অদ্ভুত রকমের ইচ্ছে করে। আনন্দ হয় ভীষণ। সারাটা রাত এই বিচিত্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাইনি। সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গল ফোনের শব্দে৷ স্ক্রিনে মীরার নাম। ধরতেই সে চেঁচিয়ে উঠল,
-ফোন ধরতে এতোক্ষণ লাগে? কতোবার ফোন দিয়েছি আমি।
আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম,
-ঘুমিয়ে ছিলাম৷ টের পাইনি৷
-এতো বেলা করে ঘুমচ্ছেন? কয়টা বাজে খেয়াল আছে?
-তাড়া নেই আজ। তাই বেলা করে ঘুমচ্ছি।
-তাড়া নেই বলতে? অফিস নেই আজ?
-নাহ।
মীরা যেন খুশিই হলো। বলল,
-বাহ! তাহলে তো ভালোই হলো৷
আমি অবাক স্বরে বললাম,
-ভালো হবে কেন?
সে বলল,
-কারণ আছে মহাশয়। উঠুন জলদি। ফ্রেশ হোন।
-নাহ। আরেকটু ঘুমাবো। ঘুম পুরেনি।
-আর ঘুমাতে হবে না। উঠে রেডি হোন৷ আপনাকে আমার ভার্সিটি আসতে হবে।
-ভার্সিটি গিয়ে আমি কী করবো?
-কিছু করতে হবে না৷ আপনাকে কেবল আসতে হবে৷
-আমি আসবো না। দুঃখিত।
-আপনাকে আসতে হবে৷
-জোর করছেন কেন?
-আমার ইচ্ছে।
-আপনার ইচ্ছেতেই সব হবে?
-সব হবে না। তবে যা সাধ্যের ভেতর তা হতে হবে৷
-সরি। আমার আসর ব্যাপারটা সাধ্যের ভেতর না।
মেয়েটা হাসলো। যেন আমি খুব মজাদার একটা জোক্স বলেছি। বলল,
-আমি জানি আপনি আসবেন৷
-কীভাবে জানেন?
-ফোন রাখলাম।
কথাটা বলেই মীরা ফোনটা রেখে দিল। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। আমি অপেকক্ষন হ্যালো হ্যালো করলাম। পরে বুঝতে পারলাম ফোন কাটা গিয়েছে। কী করবো ভেবে পেলাম না। যাবো কি যাবো না এই বিষয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে থাকলাম।
.
আমাকে কিছুটা সময় দাঁড়াতে হলো এখানে। মীরা এই জায়গাটার কথাই বলছিল। বলল এখানে দাঁড়াতে।আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভেতর থেকে শব্দ আসছে। কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে হয়তো। গান বাজনা হচ্ছে। কিছু সময় যেতেই মীরা এসে উপস্থিত হলো। আমি তাকে দেখে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। মেয়েটা আজ শাড়ি পরেছে। বসন্তি কালারের শাড়ি হয়তো। আমি তা ঠিক বুঝতে পারছি না৷ আমি কেবল বুঝতে পারছি মেয়েটাকে অসাধারণ লাগছে। কেবল অসাধারণ বললে ভুল হবে৷ ভয়ংকর অসাধারণ লাগছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বেশিক্ষণ তাকালে সমস্যা। মেয়েটা এতো সুন্দর করে কাজল দেয় কেন? চোখ দুটো এতো সুন্দর লাগে! সে এসেই বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
-চলুন।
খানিকটা চুপ থেকে আমি বললাম,
-কই যাবো?
-ভেতরে যাবেন না?
-নাহ। ভেতরে যাবো না। কেন ডেকেছেন সেটা বলুন৷
কথাটা বলে শেষ করতে পারিনি৷ সে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকল। বলল,
-আপনি না! খুব অদ্ভুত মানুষ।
এই বলে সে আরো জোরে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। আমি কিছু বললাম না। বাধ্য ছেলের মতো তার পিছু পিছু যেতে থাকলাম। কিংবা আমার কী বলা উচিৎ বা করা উচিৎ তাও বুঝতে পারলাম না৷ আমার কাছে ব্যাপারটা খুব ভালো লাগল। মেয়েটা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকজন দেখছে৷ মেয়েটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হাঁটছে। তার নাকের ডগায় মৃদু মিস্টি রাগ খেলা করছে। তার হিলের ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। আমাদের এই অবস্থায় দেখে অনেক যুবকের হৃদয় কেঁদে উঠছে। কেউ অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা আমায় আরো আনন্দিত করল।

মীরা আমাকে একটা জটলার সামনে নিয়ে এলো৷ যেখানে কিছু যুবক ছিল। কিছু শাড়ি পরা যুবতী ছিল। সেখানে ট্রেনে দেখা হওয়া মীরার বান্ধুবীও ছিল। তাদের পেছনে চেয়ার পাতা। অনেকে বসে আছে সেখানে। সামনে স্টেজ৷ কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে হয়তো। কিসের অনুষ্ঠান হলো তা জানতে নিচ্ছে হলো না৷ স্টেজের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। স্টেজে তখন গান গাচ্ছেন এক ভদ্রলোক৷ ভদ্রলোককে আমি চিনি না। চেনার কথাও না। এসব গান বাজনা শুনি না আমি। হঠাৎ মীরা বলে উঠল,
-পরিচিত হোন। এই হলো আমার বন্ধু অহনা। মনে আছে ট্রেনে যে ছিল আমার সাথে?
তাহলে ট্রেনের ওই মেয়েটির নাম অহনা। আমি হাসলাম। হায় বললাম। সবার সাথে পরিচিত হলাম। পরিচয় পর্বের শেষ হলো বটে তবে তার বান্ধুবিদের আমাকে দেখা শেষ হলো না। তারা আমাকে আড় চোখে দেখছে। তাদের দেখার ধরণটা বিচিত্র। আমার মনে হচ্ছে এরা আমার ব্যাপারে আগ থেকেই জানে। আমাকে আগ থেকেই চিনে। আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না৷ এদিক সেদিক তাকাতে থাকলাম। খানিকটা অস্বস্তি হতে থাকল। এতো ভীড়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না। এরা এমন ভাবে তাকাচ্ছে তাও ভালো লাগছে না৷ হয়তো তারা আমাকে এখন থেকেই মীরার হাজবেন্ড ভাবা শুরু করছে৷ তারা সেভাবেই তাকাচ্ছে। একে অপরকে ইশারায় কিছু বলছে। আমার মনে সেই অস্বস্তিটা আবার জেগে উঠল। আশ্চর্য ব্যাপার, আমার উচিত ছিল এখানে না আসা, মীরাকে এড়িয়ে চলা, তার অবদার না রাখা। অথচ আমি তা পারছি না। কেন পারছি না? আমি কী খুব দূর্বল? মীরার প্রতি দূর্বল? তাহলে? কী করবো এখন?
মীরা সারাটাক্ষন আমার সঙ্গে ছিল। আমার পাশে পাশে ছিল। আমাকে নিয়ে সে স্টেজের সামনে গেল৷ সামনের দিকের চেয়ারটায় বসে পড়ল। আমাকে বসতে বলল তার পাশে। আমি বসলাম। আমাদের আশপাশে তার বন্ধুবান্ধবরা বসল। স্টেজে গান গাওয়া ছেলেটার গান গাওয়া শেষ। সে নেমে যাচ্ছে। ছাত্রজনতা হাততালি দিচ্ছে৷ আরেকটা ছেলে উঠে এল। সে বোধ হয় উপস্থাপক। সে উপস্থাপনা শুরু করল,
-এই পর্যায়ে কবিতা আবৃতি করে আপনাদের মুগ্ধ করবে...
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মীরা মেয়েটা সুযোগ করে আমাকে দেখছে। আমার জানি কেমন লাগছে। ভালোও লাগছে আবার খারাপও লাগছে৷ আমার ভালো লাগতে দেয়া যাবে না৷ যতো ভালো লাগবে সমস্যা তত হবে৷ কিন্তু আমিও বা কী করবো? জোর করে তো নিজেকে খারাপ লাগানো যায় না৷ স্টেজে একটা মেয়ে উঠে কবিতা আবৃতি করে চলে গেল। তার কবিতাটা সুন্দর ছিল। আবৃতিও সুন্দর ছিল। আমি হাততালি দিলাম। মীরাকে বললাম,
-মেয়েটার আবৃতি কী দারুণ তাই না?
মীরা কেমন করে জানি তাকাল। বলল,
-আপনার পছন্দ হয়েছে আবৃতি?
-হ্যাঁ।
-কবিতা আবৃতি আপনার পছন্দের।
-হ্যাঁ।
-কিন্তু আমি তো কবিতা আবৃতি করতে জানি না।
-আপনাকে যে কবিতা আবৃতি জানতে হবে তা তো নয়। সবাইকে আল্লাহ সব গুণ দেয় না।
মীরা মন মরা করে বলল,
-আল্লাহ কেন আমাকে এই গুণ দেয়নি?
-সেটা একান্তই তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু আবৃতি করাটা বিশেষ কিছু নয়। সবাইই পারে। তবে সবার আবৃতিতে মুগ্ধ হওয়া যায় না। কেবল কিছু সংখ্যকই পারেন মানুষ মুগ্ধ করতে৷
-তাহলে মেয়েটার আবৃতি আপনাকে মুগ্ধ করেছে?
-জ্বি হ্যাঁ। অনেক দিন এমন মধুর কণ্ঠে আবৃতি শোনা হয়নি৷
কথাটা বলে মনে হলো এই কথাটা বলা ঠিক হয়নি। মীরা মেয়েটার মুখ কালো হয়ে গেছে। চেহারা ফ্যাকাসে লাগছে। কেন লাগছে তা আমি বুঝতে পারছি। ইদানীং মীরার কিছু ব্যাপার আমি বুঝতে পারি। মীরা বলল,
-আমি কবিতা আবৃতি শিখব৷ শিখে আপনাকে শুনাবো৷ আপনি মিথ্যা মিথ্যা হলেও বলবেন মুগ্ধ হয়েছেন। কেমন?
-মিথ্যা মিথ্যা বলব কেন?
-আমার আবৃতি সুন্দর হবে না৷ তারপরও বলবেন সুন্দর হয়েছে। তা না বললে আমি কষ্ট পাবো। আপনি কি আমায় কষ্ট দিবেন?
-জ্বি না৷ তা আপনি হঠাৎ আবৃতি শিখতে যাবেন কেন?
মীরা কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমিও তাকিয়ে থাকলাম। সে বলল,
-আপনাকে মুগ্ধ করতে। আমি আপনাকে মুগ্ধ করতে চাই।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন জানি শিরশির করে উঠল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। কী অনিন্দ্য সেই অনুভূতি! আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। স্টেজের দিকে তাকালাম। উপস্থাপক ছেলেটা উঠে এসেছে। সে জানালো তাদের প্রধান আকর্ষণ, বিশিষ্ট সেলিব্রেটি গায়িকা মঞ্চে আসবেন। এক্ষুনি আসবেন। ছাত্রজনতা চিৎকার দিয়ে উঠল। মীরাকে উত্তেজিত দেখালো না। তাকে বেশ স্বাভাবিক দেখালো৷ আমার মাঝেও খানিকটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার নামটা উচ্চারণ করতেই আমি খানিকটা ধাক্কার মতো খেলাম। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। পুরনো ব্যাথা নাড়া দিলো। ভেতরে ঝড় বইতে লাগল। উপরে উপরে আমি ঠিকই স্বাভাবিক থাকলাম। যেন কিছুই হয়নি। অনামিকা চৌধুরী নামক জনৈক গায়িকা গান গাওয়ার জন্যে স্টেজে আসবে। এতে এতো হতভম্ব, মন মরা হওয়ার কিছু নেই৷ আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। মীরা আড়চোখে দেখছে আমায়। বর্তমানের সাড়া জাগানো গায়িকা অনামিকা চৌধুরী স্টেজে উঠল। তার চোখে সানগ্লাস, জিন্স আর শার্ট পরিহিত এই অনামিকা কে আমার খুব একটা পরিচিত মনে হলো না৷ অনামিকা মাইক হাতে নিলো৷ সবাইকে হায় জানালো। ছাত্রজনতা চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর হুট করেই আমাকে দেখে মেয়েটা স্থির হয়ে গেল যেন। কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সে চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর আবার তাকালো। একটা গান ধরল। অথচ সে ঠিক ভাবে গাইতে পারছে না। আমি স্পষ্ট তার চোখে অস্বস্তি দেখছি। ব্যাথা দেখছি। ব্যাথা? ব্যাথা কিসের? আমি উঠে যেতে চাইলাম। মীরা খপ করে আমার হাতটা টেনে ধরল। কঠিন গলায় বলল,
-কোত্থাও যাবেন না আপনি।
আমি অনুনয় করে বললাম,
-আমি থাকলে সে গাইতে পারবে না মীরা।
মীরা কঠিন গলায় বলল,
-আমিও তাই চাই। সে না গাইতে পারুক। যখন গাইতে পারবে না তখন দেখকবে ছেলেরা জুতা মারবে৷ আমি লোক ঠিক করে রেখেছি। ইশারা দিলেই হবে।
আমি স্বব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বললাম,
-এই জঘন্য চিন্তা আপনার মাথায় আসলো কী করে?
-জানি না৷ সে আপনাকে ঠকিয়েছে। এটি আমার ভালো লাগেনি। আমি চাই সে একটা উচিৎ শিক্ষা পাক।
আমি তাকে কঠিন গলায় বললাম,
-আজ যদি ওর গায়ে একটা ছোট্ট কাগজও পড়ে তবে আমি কী করব ভেবে পাবেন না৷ হাত ছাড়ুন। আমাকে যেতে দিন।
কথাটা বলতেই মীরা হাত ছেড়ে দিলো। তার চোখ চিকচিক করে উঠল। মূহুর্তে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি তা অগ্রাহ্য করে চলে এলাম। মীরা বসে থাকল৷ সে বসে বসে কান্না করছে৷ তার বন্ধুরা তাকে শান্তনা দিচ্ছে। তাকে ওখান থেকে নিয়ে এল। সে কিছুতেই ওদের কথা শুনছে না৷ কান্না করেই যাচ্ছে। করুক। আমার কী! পাজি মেয়ে। আমার ভালোবাসার অসম্মান করতে চলেছিল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে। তবে অনামিকার দৃষ্টি নাগালের বাহিরে। চলে আসবো ঠিক সেই মূহুর্তে অহনা এসে হাজির হলো। বলল,
-ভাইয়া, প্লীজ কিছু মনে করবেন না৷ প্লীজ।
আমি কিছু বললাম না। দাঁড়িয়ে থাকলাম কেবল।
সে আবার অনুনয় করে বলল,
-প্লীজ!
আমি বললাম,
-একটা মানুষকে আমি ভালোবাসি। শুদ্ধ ভালোবাসি। সে মানুষটি আমাকে ভালোবাসতে পারেনি৷ তার ভালোবাসা ছিল অন্য কিছু। তাই আমাদের সম্পর্ক টিকেনি। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক না?
অহনা মেয়েটা বোধহয় বুঝতে পারল না। তাইই কিছু বলল না৷ আমি বললাম,
-আমি কখনোই চাই না আমার কারণে আমার ভালোবাসার মানুষ আমার জন্যে অপমানিত হোক। কখনই চাই না। একজন প্রেমিক কখনই এমন চাইবে? বলুন চাইবে?
অহনা মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল,
-ভাইয়া, কী বলব। আপনার সাথে দেখা হবার পর থেকে যা শুরু করছে সে, সত্যিই এসব অভাবনীয়। আপনি জানেন না ও কতো বোরিং টাইপের ছিল পুরো ভার্সিটিতে আমিই কেবল তার বন্ধু ছিলাম। এছাড়া ও কারো সাথেই মিশত না। তার ভাষা ছিল কর্কশ। ভীষণ রাগি। প্রেম ট্রেম এসব বিশ্বাসই করে না৷  একদিন একটা ছেলে প্রপোজ করে বসল৷ সে মাঠের মাঝে সবার সামনে ছেলেটাকে অপমানিত করল। ডিপার্টমেন্টে হ্যাড এর কাছে বিচার দিল। ছেলেটাকে এক মাসের জন্যে ভার্সিটি থেকে ব্যান করে দিল। বুঝুন কেমন মেয়ে ছিল৷ কিন্তু হুট করেই আপনাকে দেখার পর কী যে পরিবর্তন ঘটল বিশ্বাস করবেন না আপনি। এই যে দেখুন না। এই গায়িকাকে একদম সহ্য করতে পারে না সে। তাকে জুতা মারার জন্যে প্ল্যান করছিল। কেন জানেন? কারণ মেয়েটা আপনাকে কষ্ট দিয়েছে তাই। আপনাকে কেউ কষ্ট দিলে যে সহ্য করতে পারবে না তা কি আপনি বুঝতে পারেন?
আমি হ্যাঁ না কিছু বললাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। অহনা বলল,
-এই যে দেখুন না। আমি আপনার সাথে কথা বলছি তাও সহ্য হচ্ছে না৷ কেঁদে কেঁদে কাজল লেপ্টে কী একটা অবস্থা করেছে৷ আমাদের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি আড় চোখে দেখলাম একবার। আসলেই মেয়েটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ বড় বড় করে দেখছে। আমি বললাম,
-আপনি আপনার দৃষ্টিতে দেখুন, আমার অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করান,এবার বলুন তো আমার আর মীরাকে কি মানায়? আমাদের মধ্যে কিছু হবে? তার বাবা মা কী ভাববে? আর আমারও তো একটা পছন্দের ব্যাপার আছে তাই না?
-আপনার কী তাকে পছন্দ নয়?
-এই প্রশ্নের উত্তরটাই খুঁজছি৷ আমি কি তাকে পছন্দ করি? যদি করিও তবে আমার যে কন্টিনিউ করা সম্ভব হবে না!
অহনা মর্মান্তিক গলায় বলল,
-সে খুব আহত হবে। সহ্য করতে পারবে না৷ আপনি প্লীজ একটু ভাববেন।
এই বলে আমার হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল অহনা৷ ঠিক তার কয়েক সেকেন্ড পর মীরা এসে হাজির হলো। ধাক্কা মেয়ের সরিয়ে দিল অহনাকে। অহনা হাসতে থাকল। দূরে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারল একটা। বলল,
-দেখলেন?
আমি হাসলাম খানিক। সত্যিই ব্যাপারটা বেশ আনন্দকর লাগল আমার কাছে। আমি হাসলাম। তারপর হাসি থামিয়ে অন্য দিকে চেয়ে থাকলাম। মীরা একবার আমায় দেখছে আবার মাটির দিকে তাকাচ্ছে। তার দৃষ্টিতে অপরাধবোধ। সে আবার তাকালো৷ আবার চোখ নামিয়ে নিল। কিছুটা সময় কাটল নীরাবতায়। সেই স্তব্ধটা ভাঙ্গল সে নিজেই। ভারী স্বরে বলল,
-সরি।
আমি কিছু বললাম না। এমন ভাব করলাম যেন আমি শুনতেই পাইনি৷ সে আবার বলল,
-সরি বললাম তো৷
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কিছু বলতে যাবো ঠিক তার আগেই একটা মেয়ে এসে হাজির হলো। বলল,
-শাকের আহমেদ আপনিই না?
-জ্বি।
-আপনাকে অনামিকা ম্যাম ডাকছেন। যদি একটু আসতেন।
আমার ভ্রু কুচকে এলো। অনামিকা আমাকে ডাকবে কেন? ডাকার তো কথা না। তাহলে? মীরার ব্যাপারটা টের পেয়েছে সে? তাহলে কী সে কিছুটা জ্বলন অনুভব করছে?
.
পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত ইনশাল্লাহ।



দ্বিতীয় পর্ব Click Here...

.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ

বাংলা গল্প| Love Stories Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url