গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা - দ্বিতীয় পর্ব । লেখক - তাসফি আহমেদ

গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা - দ্বিতীয়  পর্ব । লেখক - তাসফি আহমেদ







গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা
দ্বিতীয়  পর্ব

তাসফি আহমেদ


.
তিনদিন আগের গল্পঃ
৩.
সাহেদ বসে আছে লেক পাড়ে। তার চোখে জল। মুখ ভর্তি ভয়৷ সে তার পাশে তাকালো৷ পাশে কেউ নেই৷ তবুও তাকালো৷ তাকিয়ে থাকল। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে তার মনে হলো আরশি তার পাশে বসে আছে৷ মলিন চাঁদবদন তাঁর। কাঁদো কাঁদো চেহারায় তাকিয়ে আছে মেয়েটা৷ চোখে তার তিক্ত বেদনা৷ ঘৃণা যেন তার চোখ থেকে আগ্নেয়গিরির মতো বের হচ্ছে। সাহেদ মলিন চেহারায় তাকালো৷ বলল,
-আরশি?
আরশি কিছু বলল না। সে কেবল চুপচাপ সাহেদের দিকে তাকিয়ে থাকল। সাহেদ আবার বলল,
-আরশি? তুমি এসেছো?
আরশি এবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। ভেজা স্বরে বলল,
-তুমি খুনি সাহেদ৷ তুমি খুনি৷ তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার।
সাহেদের কান্না পেল৷ সে হুট করেই কেঁদে দিল। বলল,
-আরশি, কাল রাতে ওই লোকটাও বলেছিল আমি খুনি।
আরশি সাহেদের দিকে না ফিরেই বলল,
-কোন লোকটা বলেছে?
-কাল রাতে এক লোককে দেখলাম আমি। সে আমার বিছানায় শুয়েছিল। দেখতে একদমই আমার মতো। শুধু তার দাঁত ছিল না৷ হাসার সময় মাড়ি দেখা যাচ্ছিল৷ সেই মাড়ি দিয়ে রক্ত ঝরছি আরশি। তার চেহারা ছিল বিচ্ছিরি রকমের।
-সে কে ছিল জানো তুমি?
-জানি না সে কে ছিল। তবে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখনও ব্যাপারটা আমার চোখের উপর ভাসছে।
-সে তোমাকে খুনি বলল তাই না?
-হ্যাঁ। ঠিক তোমার মতো করে বলেছে।
-আমার মনে হয় তাকে আমি চিনি।
-কীভাবে চিনো?
-যেভাবে আমি তোমাকে চিনি!
-মানে?
-সাহেদ, বিছানার ওই লোকটা তুমিই ছিলে। তুমি। তোমার অন্য রূপ। যে রূপটা আমি দেখিনি। না দেখেই তোমার প্রেমে পাগল হয়েছিলাম।
-কী বলছো এসব?
-আমি সত্যিই বলছি সাহেদ। কাল রাতে তুমি তোমার খারাপ স্বত্ত্বাকে দেখেছো৷ যে তোমার দ্বারা একটা খুন করিয়েছে। খুন করিয়ে মজা নিচ্ছে সে।
-আরশি আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।
-মানুষের মাঝে দুটো স্বত্ত্বা থাকে। একটা খারাপ একটা ভালো। ভালো মানুষ গুলোর খারাপ স্বত্ত্বাটা খুব জঘন্য হয়। তুমি নিতান্তই ভালো মানুষ ছিলে। তবে তোমার খারাপ স্বত্ত্বাটা ছিল জঘন্য। তুমি তোমার সেই জঘন্য চেহারাটা দেখেছো সাহেদ।
-আমার মাথা ব্যাথাটা বেড়ে যাচ্ছে আরশি। আর কিছু বলো না তুমি।
-এসবই সত্য কথা সাহেদ৷ তোমাকে এসব বিশ্বাস করতে হবে৷
-আরশি! চুপ করো প্লীজ৷ আমার মাথার ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা করছে।
-তুমি এরচে কঠিন যন্ত্রণা পাবে সাহেদ৷
-স্টপ আরশি। প্লিজ স্টপ।
সাহেদ মাথায় হাত দিল। দুহাতে মাথাটা চেপে ধরল। তার মাথার ভেতরটা যেন ভনভন শব্দ শুরু করছে৷ অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। সে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। মূহুর্তে জ্ঞান হারালো সে।

৪.
সন্ধ্যা হয়েছে সবে। সাহেদ শোয়া থেকে উঠে বসল। মাথায় তার ভীষণ যন্ত্রণা। ভার হয়ে আছে মাথাটা। সে কিছু সময় মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে থাকল৷ কি একটা শব্দ হচ্ছে যেন৷ সে কান পেতে শুনলো৷ পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে৷ কেউ যেন টেপ ছেড়ে বসে আছে৷ সাহেদ মনিরকে ডাকল৷ মনির এলো না৷ সজীবকে ডাকল৷ সেও এলো না। অগত্যা তাকেই উঠে যেতে হলো। ঢুলুঢুলু দেহ নিয়ে সে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল৷ যতো বাথরুমের কাছে যাচ্ছে পানি পড়ার শব্দটা যেন ততো স্পষ্ট হচ্ছে৷ কাছে এগিয়ে আসছে৷ সাহেদ বাথরুমের দরজা খুলে ট্যাপটা বন্ধ করে দিলো৷ ঠিক তখনই তার চোখ গেল বালতির পানির দিকে। সে চমকে উঠল তখন৷ চোখ দুটো বড়বড় হয়ে এলো তার। সমস্ত শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল৷ গা ময় একটা অদ্ভুত শীতল শিহরণ বয়ে গেল। তার অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। সে দেখলো বালতির ভেতর একটা বাচ্চা শিশু ভাসছে৷ যেন সদ্য সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া বাচ্চাটাকে কেউ বালতির পানিতে ঢুবিয়ে রেখেছে৷ সাহেদ চিৎকার দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই বাচ্চাটার চোখ খুলে গেল। সে চোখ বড় বড় করে তাকালো সাহেদের দিকে। তারপর কান্না শুরু করে দিল। কান্নার সময় বাচ্চাটার গলা কাছ থেকে একটা ছিদ্র দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকল। বালতির স্বচ্ছ পানি মূহুর্তে লাল হয়ে গেল। বাচ্চা শিশুটার কান্নার গতী যেন বেড়েই চলল। সাহেদের গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। গা কাঁপা শুরু হলো৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। নাকের ডগায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের বিন্দু জমে আছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই গ্লাসের উপর চোখ গেল। গ্লাসের ওপাশে একটা বাচ্চা শিশু দাঁড়িয়ে আছে৷ সে সাহেদকে দেখছে৷ অবাক চোখে দেখছে৷ শিশুটির চোখে জল জমছে ধীরে ধীরে৷ সেই জল মূহুর্তে রক্তে পরিণত হলো৷ বাচ্চা শিশুটার গাল রক্তে লাল হয়ে গেল। সে কান্না শুরু করে দিল৷ সাহেদ এবার আরো জোরে চিৎকার দিলো। কিন্তু তার চিৎকারে শব্দ হলো না। গলা দিয়ে যেন শব্দই আসছে না। ভয়ে চোখে জল জমে গেল সাহেদের। গলা শুকিয়ে এলো। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। সে বাথরুমের দরজা টানতে থাকল। কিন্তু দরজা খুলল না৷ সে আরো জোরে টানতে থাকল। কিন্তু কোনো ভাবেই দরজা খোলা গেল না৷ গ্লাসের ভেতর থেকে শিশুটা কান্না করছে। চিৎকার দিয়ে কাঁদছে সে শিশু। কান্নার শব্দে সাহেদের কান যেন ফেটে যাচ্ছে। তার হার্টবিট যেন দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সে অসহায়ের মতো দরজা টানতে থাকল৷ টানতেই থাকল৷ ঠিক এমন সময় সে মনিরের গলা শুনতে পেল৷ খানিকটা স্বস্তি ফিরে এলো যেন তার৷ মনির বাথরুমের দরজার কাছে এসে বলল,
-কী ব্যাপার সাহেদ? তুই এখানে শুয়ে আছিস কেন?
সাহেদ অবাক স্বরে বলল,
-আরে গাধা আমি শুয়ে নেই। দাঁড়িয়ে আছে৷ দরজা খোল। আমাকে বাঁচা৷ না হলে ও আমাকে মেরে ফেলবে।
-কে মেরে ফেলবে? কিসের দরজা? কী সব বলছিস তুই? এই সাহেদ? সাহেদ?
মনির সাহেদের গা ধরে বেশ কয়েকবার ঝাকুনি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল সাহেদের। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে থাকল। যেন কাউকে খুঁজছে। তার চেহারা আতঙ্কিত। ঘামে ভিজে একাকার। মনির বলল,
-সাহেদ? ভাই আমার? কী হয়েছে তোর? এমন ঘেমে আছিস যে?
সাহেব কিছু বলল না। তার গা যেন কাঁপছে। নিজেকে স্থির করতে পারছে না। মনির আবার বলল,
-এই সাহেদ, এখানে শুয়ে আছিস কেন?
সাহেদ খানিকটা হাঁটতে থেকে, কিছুটা ভারী স্বরে বলল,
-আমি এখানে শুয়ে ছিলাম? এই লেক পাড়ে?
-হ্যাঁ। সেই দুপুর থেকে তোকে খুঁজছি। পাচ্ছি না৷ ফোন দিলাম। তাও ধরছিস না। তাই খুঁজতে খুঁজতে লেকের দিকে এলাম। এসে দেখি এখানে শুয়ে আছিস। কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করেছে বেশি? এখানে ঘুমালি কেন?
ঘেমে কী হয়েছে তোর শরীর।
সাহেদ ক্লান্ত স্বরে বলল,
-মনির, আমার মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে রে৷ আমাকে বাসায় নিয়ে চল। এখানে ভালো লাগছে না আমার৷

৫.
সাহেদ বিছানায় শুয়ে আছে। তার পাশে বসে আছে মনির৷ মনিরকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সাহেদের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে সে। কিছুই তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। সাহেদ ছেলেটা নিশ্চিত কিছু লুকাচ্ছে। বলতে চাইছে না৷ কিন্তু কী সেটা? মনির বলে উঠল,
-সাহেদ?
সাহেদ চোখ বন্ধ করে জবাব দিলো,
-মনির, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না দোস্ত৷ আমার কিছুই হয়নি৷ খানিকটা মাথা ধরেছে কেবল৷ তাইই ওখানে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
-খানিকটা মাথা ধরায় ঘুমিয়ে যাওয়ার মতো ছেলে তুই না সাহেদ৷ সেটা তুই এবং আমি দুজনেই বেশ ভালো করে জানি৷
-তুই কেন বুঝতে চাচ্ছিস না মনির। আমি তো বলছি কিছু হয়নি আমার।
-সাহেদ, তোকে বেশ ভালো করেই চিনি আমি। তুই কিছু লুকাচ্ছিস৷ আমি শিওর কিছু লুকাচ্ছিস তুই৷
সাহেদ কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। কিছু সময় যেতেই নিজ থেকে বলল,
-কয়টা বাজে মনির?
মনির মোবাইল দেখে বলল,
-আটটা নয় বাজে।
-বাব্বাহ! এতো সময় হয়ে গেছে?
-হ্যাঁ৷ তা হয়েছে। তবে তুই যে প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছিস সেটা আমি বেশ টের পাচ্ছি।
-আরে ওসব কিছুনা। বাদ দে৷ শুন, আজ হঠাৎই একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ ছোট বেলায় যে মুরগি চুরিতে ধরা পড়েছিলাম সেটা মনে আছে তোর?
মনির মলিন মুখে হাসল৷ বলল,
-সেটা ভুলি কীভাবে৷ তোর বাপটা এমন ব্যবস্থা করলেন যে চুরির ব্যাপারটা আজীবনও ভুলব না৷
-হ্যাঁ রে। আমিও ভুলবো না৷ তবে দোষটা আমাদেরই ছিল৷ কী প্রয়োজন ছিল ওই বাজে ছেলেদের সাথে গিয়ে মুরগি চুরি করে পিকনিক করার?
-যা-ই হোক। বেশ মজা হয়েছিল কিন্তু, তাই না?
-হ্যাঁ। মজা তো হয়েছিল বটেই। তবে সেই মজা বাবার বেতের বাড়ি খেয়ে বের হয়ে গেছে৷
সাহেদ ক্লান্ত হাসি দিল৷ মনির বলল,
-উফ! মনে হতেই পেছন দিকটা জ্বলে উঠল৷ চাচা ওইদিন গুনে গুনে দশটা বেতের বাড়ি দিয়েছে আমার পশ্চাতে।
সাহেদ আবারও করেই হেসে ফেলল। বলল,
-আমাকে দিল বিশটা৷ আমি নাকি তার মান সম্মান নষ্ট করেছি। তাকে খারাপ প্রমাণ করেছি। ভূঁইয়া বাড়ির ছেলেরা নাকি এমন হয় না। এই বলে পুরো গ্রামবাসীর সামনে আমার পশ্চাতে দিল মোট বিশটা বেতের আঘাত৷ উফ! কী যন্ত্রণাটাই হয়েছিল রে ভাই!
মুখ কুচকে নিলো সাহেদ৷ মনির হাসতে থাকল। সাহেদের এমন ভঙ্গিতে ভীষণ মজা পেল সে৷ সাহেদ মুখ সরল করে বলল,
-তবে...
মনির হাসি থামিয়ে বলল,
-তবে কী রে?
-আমার মা বেঁচে থাকলে বাবা এই কাজটা কখনই করতে পারতেন না৷ মা মারা যাওয়ার পর বাবা যেন আরো কঠিন হয়ে গিয়েছিলেন৷
মনির কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকল৷ সাহেদ শূন্যে তাকিয়ে থাকল৷ তার দৃষ্টিতে অসহায় ভাব৷ যেন সর্বহারা সে৷ আনমনে বলে উঠল,
-বাবাটা এতো কঠিন হলো কেন রে?
-বাদ দে৷ বাবারা এমনই হয়৷ উপরে শক্ত ভেতরে নরম।
-আমার বাবার ভেতরটাও ভীষণ শক্ত৷ ভীষণ।
-এভাবে বলছিস কেন?
সাহেদ মনিরের দিকে তাকালো। কিছু সময় চুপ থাকল সে৷ বলল,
-আরশি আর আমার ব্যাপারটা বাবার কাছে বলেছিলাম৷ বাবা ধমক দিয়ে বললেন, ওসব প্রেম ট্রেমের কথা যদি আর একবার মুখেই নেই তাহলে তিনি আমার জিহ্বা কেটে ফেলবেন। এমন ভাবে বললেন যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম ভীষণ। এমনিতেই তাঁকে ভীষণ ভয় পাই আমি। তিনি জানালেন, তিনি আমার বিয়ে গ্রামে ঠিক করে রেখেছেন৷ বশির আঙ্কেলের ছোট মেয়ের সাথে। বাবার কথার উপরে দু'কথা বলা সাহস নেই আমার৷ তবুও আরশি প্রেগন্যান্ট ভেবে বললাম, "বাবা, মেয়েটা ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না৷" বাবা সোজাসাপ্টা জবাব দিলেন, "গ্রামে যদি আসিস, তবে একাই আসিস। দুজন হয়ে আসার চিন্তা থাকলে ওখানেই থেকে যাস। ভুলে যাস তোর বাবা আছেন। এই গ্রামের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকবে না তোর৷" এই বলে তিনি ফোন কেটে দিলেন। আমি আমার সৎ মাকে ফোন দিয়ে বললাম বাবাকে যেন তিনি একটু বুঝানোর চেষ্টা করেন৷ তুই তো জানিসই৷ আমার সৎ মা'টা কেমন৷ তিনি কিছু তো বললেনই না উল্টো আমাকে অনেক কথা শুনিয়ে ফোন রেখে দিলেন৷ এরপরে বাবা ফোন দিয়ে দিলেন ঝাড়ি৷ কেন আমি সৎ মা'কে ফোন দিয়েছি৷ আচ্ছা, মনির? সৎ মা গুলো এমন হয় কেন? কেন এতো নিষ্ঠুর হয়?
মনির কিছু বলতে পারল না৷ সে কেবল সাহেদের দিকে তাকিয়ে থাকল৷ ছেলেটাকে কী ভীষণ অসহায় লাগছে৷ মনিরের ভীষণ মায়া হলো। কিন্তু সে তার মায়াটা প্রকাশ করতে পারল না। কেবল রোবটের মতো বসে থাকল। পুরুষ মানুষ বোধহয় এমনই হয়। কিছু জায়গায় কখনও গোপন কোনো প্রিয় অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না৷ কেন জানি, কোথাও না কোথাও আঁটকে যায় সেই অনুভূতি গুলো৷
.
বর্তমান অবস্থাঃ
মনির এবং এহসান সাহেব পুলিশ জিপে বসে আছে। এহসান সাহেবের পাশে বসে আছে পুলিশ অফিসার নুরুজ্জামান। তার বসার কথা সামনের সিটে৷ কিন্তু তিনি সেখানে না বসে এহসান সাহেবের পাশে বসেছেন। এহসান সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে৷ তাঁর চোখে জল। কিছু সময় পর পর ওসি নুরুজ্জামান এহসান সাহেবকে শান্তনা দিচ্ছেন। উনাকে বুঝাচ্ছেন। উনি যাতে ওখানে গিয়ে আরশির সাথে চিল্লাচিল্লি না করেন৷ সরল ভাষায় যেন কথা বলেন। নুরুজ্জামান নিজের মতো করে বুঝাচ্ছেন। এহসান সাহেব কি বুঝতে পারছেন সে বিষয়ে বলা গেল না৷ এহসান সাহেব অনেকক্ষণ যাবত চুপ করে আছেন। কথা বলছেন না৷ মনির সহ এই ব্যক্তিরা আরশির নতুন ঠিকানায় যাচ্ছে। আরশি কোনো হাসপাতালে নেই৷ সে কোথাও বাসা ভাড়া নিয়ে আছে৷ সেই বাসার এড্রেসটা একটু আগে জানালো সে৷ নুরুজ্জামান বাহিনী সেই এড্রেসেই যাচ্ছে৷ আর অল্প কিছু পথ বাকি। এরপরই আরশির খোঁজ পাওয়া যাবে৷ সাহেদের খোঁজও পাওয়া যেতে পারে৷ হঠাৎ করে মনির বলে উঠল,
-ছেলেটা ভালো নেই৷ কী জানি একটা রোগে ভুগছিল। কাউকে কিছু বলতো না৷ আমাকেও বলেনি৷ এই কয়দিনে ওকে বেশ কয়েকবার বেহুশ অবস্থায় পেয়েছি আমি৷
নুরুজ্জামান ভ্রু কুচকে তাকালেন৷ বললেন,
-সাহেদের কথা বলছো?
-হ্যাঁ।
-কী অসুখ ছিল ওর?
-জানি না। কেবল সারাক্ষণ ঘাবড়ে থাকতো৷ ভয়ে থাকতো৷ ঘুমের ঘোরে কোনো বাচ্চার কথা বলতে শুনেছি৷ কাল সকালে উঠে দেখি বাথরুমে পড়ে আছে৷ ঘুমাচ্ছে ওখানে৷
নুরুজ্জামান তাকিয়ে থাকলেন মনিরের দিকে৷ কিছু বললেন না৷ মনির আবার বলল,
-এর আগের দিন হঠাৎই ঘুম থেকে ডেকে তুলল আমায়৷ বলল ওর অশান্তি লাগছে৷ বুকের ভেতর ব্যাথা করছে৷ আমি ওর পালস চেক করলাম। অস্বাভাবিক রকম ধপ ধপ করছিল ওর হার্টবিট। হঠাৎই ও বলল ওর খুব অশান্তি লাগছে৷ শরীর অবস হয়ে আসছে৷ এই বলে ও শুয়ে পড়ল।  কাঁদতে থাকল হঠাৎই। এরপরই ভীষণ গা কাঁপতে শুরু করলো৷ বলল ওর ভীষণ শীত লাগছে৷ আমি আমাদের সকল কাথা এবং কম্বল এনে তার গায়ে দিলাম। তবুও ওর গা কাঁপা কমেনি৷ আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ও বলল ওকে জড়িয়ে ধরতে। ওর গা টা অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম৷ তবুও ওর গা কাঁপতে থাকল। চিন্তায় চোখে জল এলো আমার। কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না৷ আল্লাহ কাছে অনেক প্রার্থনা করলাম। অনেক ডাকলাম। তিনি যেন একটু সাহায্য করেন৷ আমাদের সাথের বন্ধু সজীবটা ছিল না৷ ও গ্রামে গিয়েছিল৷ ওর কোনো এক আত্মিয় মারা গেছেন৷ আমি একা একা কী করবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না৷ এক সময় ও শান্ত হয়ে এলো৷ ধীরে ধীরব ঘুমিয়ে পড়ল। দিনে ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম৷ ডাক্তার সব চেক করে বললেন,শারিরীক দূর্বলতা থেকে এমন হয়েছে। তেমন কিছুই হয়নি৷ ডাক্তার ওকে ঘুমের ঔষধ দিলেন৷ আর কিছু ভিটামিন ট্যাবলেট দিলেন৷ এরপর থেকে আমি ওর খেয়াল রাখতে থাকলাম। ছেলেটা যেন ধীরে ধীরে কোথাও তলিয়ে যাচ্ছে৷ কিছু একটা যেন চুষে খাচ্ছিল আমার বন্ধুটাকে৷
গাড়িটা থেমে গেল৷ এহসান সাহেব দ্রুত নেমে গেলেন। তাঁর পেছন পেছন আসলো নুরুজ্জামান। মনির নামলো বেশ ধীরে। তারা এই বিল্ডিং এর পঞ্চম তলায় উঠল। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো একটা মেয়ে৷ মেয়েটা ভীষণ ঘাবড়ে আছে৷ ভীতু চেহারা তার৷ চোখের নিচে কালি পড়ে আছে। যেন কতোদিন ঘুম যায়নি। মনির বলে উঠল,
-অনামিকা? তোমারা এদিকে কখন এলে?
অনামিকা কিছুই বলতে পারল না৷ তার আগেই ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন এহসান সাহেব৷ ঢুকতেই দেখলেন আরশি বিছানায় শুয়ে আছে৷ বিছানার সাথে মিশে গিয়েছে যেন সে৷ মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ভীষণ কালো মুখটা। চেহারায় যেন রসকষ নেই৷ তার চোখে জল। সে কাঁদছে৷ তার বাবাকে দেখতেই কান্নার বেগটা আরো বেড়ে গেল। এহসান সাহেব কিছু বললেন না৷ কেবল মেয়ের দিকে চেয়ে থাকলেন৷ তাঁর মনে হলো বুকের কাছ থেকে ভারী কিছু সরে গিয়েছে যেন৷ তিনি অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করলেন৷
.
আরশির এখানে এসে অনেক কিছু জানা গেল। কিন্তু সাহেদের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না৷ এ ব্যাপারে মনির অনেক চিন্তায় পড়ে গেল৷ আরশির একটা বাচ্চা হয়েছে চারদিন আগে৷ সে একটা মৃত বাচ্চা প্রসব করেছে। এই ব্যাপারে তার অনেক দুঃখ৷ সাহেদও যেন ব্যাপারটা নিতে পারল না৷ প্রসবে কিছু জটিলতা ছিল আরশির। সে অজ্ঞান ছিল। তাই তার মৃত সন্তানকে সে একবারের জন্যেও দেখতে পেল না৷ তাকে হয়তো ইচ্ছে করেই দেখানো হয়নি। তার আগেই সাহেদ বাচ্চাটাকে কোথাও নিয়ে গিয়েছে। কোথায় নিয়েছে সে ব্যাপারে কেউ কিছুই জানে না৷ মনির মনে মনে বলল,
-ঠিক এই কারণেই হয়তো সাহেদের শরীর এবং মন খারাপ ছিল। কিন্তু ছেলেটা গেল কোথায়? কিংবা তার অবৈধ সন্তানকেও বা কোথায় কবর দিয়েছে? মনির বড় চিন্তায় পড়ে গেল। সে ওসি সাহেবকে বলল,
-স্যার? সাহেদের ব্যাপারটা? ওর তো কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না৷
নুরুজ্জামান নিশ্চিত মনে বললেন,
-চিন্তা করবেন না। খুব বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে হয়তো৷ এ জন্যে কাউকে না জানিয়ে কোথায় ঘুরতে গিয়েছে। চলে আসবে আপনার বন্ধু৷
-কিন্তু স্যার! ও তো এমন ছেলে...
ঠিক সেই সময়ে মনিরের ফোন বেজে উঠল। পকেট হাতড়ে ফোন বের করতেই দেখল সাহেদের নাম ভাসছে৷ জলদি সে রিসিভ করল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাহেদের বলল,
-মনির?
মনিরের চোখে জল জমে গেল৷ সে চট করেই কিছু বলে ফেলতে পারল না৷ অদ্ভুত এক স্বস্তি যেন তাকে ঘীরে ধরল। একটা প্রশান্তি ভাব আঁকড়ে ধরল তাকে। সাহেদ আবার বলল,
-মনির? আরশির বাসায় আছিস এখন তুই। তাই না?
-চুপ কর বেয়াদব। কথা বলবি না একদম!
-খুব রেগে আছিস? মাপ করে দে না প্লীজ৷ আচ্ছা শুন, আমার বাচ্চাটাকে দেখবি? জানিস আমার একটা ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে৷ বাচ্চাটির নাম শারিয়া৷ আমি আর আরশি মিলে এই নাম ঠিক করেছি ওর জন্মের আগে। আরশির উল্টো শারিয়া। নামটা সুন্দর না?
সাহেদের কণ্ঠ কেমন অস্বাভাবিক লাগল মনিরের কাছে৷ মনির বলল,
-সাহেদ? কী হয়েছে তোর? এভাবে কথা বলছিস কেন?
আরশির চেহারা আরো কালো হয়ে গেল। সে উঠে বসে বলল,
-সাহেদের কী হয়েছে মনির ভাই?
এই বলে সে মনিরের কাছ থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিলো। বলল,
-হ্যালো। হ্যালো সাহেদ? তুমি কই? কোথায় আছো এখন?
কাল আসোনি কেন এখানে?
সাহেদ সেই অস্বাভাবিক স্বরে বলল,
-আরশি? আমার জানটা! তোমার একটা মেয়ে বাবু হয়েছে৷ জীবিত হয়েছে। শারিয়া নাম তার৷ তুমি তাকে দেখবে? দেখলে চলে আসো আমাদের গ্রামে। আমি ওকে আমাদের গ্রাম দেখাতে নিয়ে এসেছি৷ আমার রাজকন্যাটাকে তার রাজ্য দেখাচ্ছি গো৷
সাহেদের ফোন কাটা গেল। আরশি অস্থির হয়ে মনিরকে বলল,
-মনির ভাই? কিছু একটা ঠিক নেই৷ সাহেদকে আমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না৷ কিছু একটা হয়েছে ওর৷ আপনি প্লীজ আমাকে ওর গ্রামে নিয়ে চলুন৷ আমি যাবো ওখানে। ও গ্রামেই আছে এখন।
মনির বলল,
-তুমি এই অবস্থায় কীভাবে যাবে? বরং ভালো হয় আমিই যাই৷ তুমি বিশ্রাম নাও৷
-না মনির ভাই। আমাকে যেতেই হবে৷ ও বলছে আমাদের মেয়েকে তার রাজ্য দেখাচ্ছে৷ তিনদিন আগের আমার মৃত মেয়েকে সে কীভাবে তার রাজ্য দেখায়?
মনিরের ভ্রু কুচকে এলো৷ কী যেন ভাবল সে। দ্রুত বলল,
-আমাদের এখনই বের হতে হবে৷ খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। খুব খারাপ।
.
চলবে...
.
প্রথম পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url