গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা

বাংলা গল্প| Bangla Love Stories| Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.

গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা 

তাসফি আহমেদ

প্রথম পর্ব
.
সাহেদকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ রাতে সে বাসায় ফিরেনি৷ দুপুরে খেয়ে যে বের হয়েছে এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নাই। কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। ফোন দেওয়া হয়েছে তাকে। কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। ব্যাগপত্র সব ঠিকই আছে৷ জামাকাপড় সব ঠিকঠাক ভাবে রাখা। কিছুই নিয়ে যায়নি। কেবল আরশি নামক তার প্রেমিকার একটি শাড়ি ছিল তার কাছে। সেই শাড়িটা নিয়ে গিয়েছে। আরশির একটা ছবিও ছিল। তাও নিয়ে গিয়েছে৷ এই দুইটি সংবাদ সাহেদের বন্ধু মনিরের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে৷ মনির সাহেদের সব থেকে কাছের বন্ধু৷ সাহেদের যাবতীয় গোপন ব্যাপার সে জানে৷ এ জন্যে তাকে থানায় তুলে নিয়ে আসা হলো।

মনির এখন থানায় বসে আছে৷ তার পাশে বসে আছেন আরশির বাবা৷ আরশির বাবার জনাব এহসান আহমেদের ধারণা সাহেদ নামক অপদার্থটা তাঁর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে৷ কারণ আজ প্রায় তিনদিন থেকে তিনি তাঁর মেয়ের কোনো সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না৷ এই তিনদিনে তিনি যতবারই তাঁর মেয়েকে ফোন দিচ্ছিলেন ততবারই সেই ফোন তার এক বান্ধুবি ধরেছে৷ কাল আর সেই বান্ধুবিও কল ধরেনি। তাই এহসান সাহেব হলে আসলেন মেয়েকে দেখতে। কিন্তু হলে এসে জানতে পারলেন মেয়ে আরো পাঁচ মাস আগে হল ছেড়েছে। এই খবরে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরপর আরশির কোনো খোঁজ না পেয়ে থানায় এলেন তিনি। থানায় এসে ওই মেয়ে বান্ধুবিটার নাম্বারে বেশ কয়েকবার কল দিলেন। কিন্তু সে ফোন তুলল না৷ একসময় ফোন বন্ধ করে দিলো সে। আরশির সেই বান্ধুবির নাম অনামিকা। অনামিকার খোঁজে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এই মূহুর্তে তাকে হলে পাওয়া যায়নি। তার ব্যাপারেও কেউ জানে না৷ কেউই বলতে পারবে না সে এখন কোথায় আছে৷
কিছু সময় নীরাবতার পর ওসি নুরুজ্জামান খানিকটা কঠিন মুখে বললেন,
-এই ছেলে? তুমি কি সত্যিই জানো না সাহেদ কোথায়?
মনির বিরক্তভরা কণ্ঠে বলল,
-না স্যার। আমি সত্যিই জানি না সাহেদ কোথায়। জানলে কী আমি এতোক্ষণ চুপ করে থাকতাম?
-তুমি নিজেকে সাহেদের সব থেকে কাছের বন্ধু বলছো৷ কাছের বন্ধু হিসেবে তো তোমার জানার কথা সাহেদ এই মূহুর্তে কোথায়?
আরশির বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন,
-অফিসার? আমি দেখি এই ছেলের সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলছেন। দু'চারটে দিলে আপনা আপনিই সব বলে দিবে৷
মনির আরশির বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আঙ্কেল, উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না৷ আমার বন্ধু হারিয়ে গিয়েছে। সে আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। তার জন্যে আমারও চিন্তা হচ্ছে৷
-অভিনয় করবে না তুমি৷ তুমি অবশ্যই জানো তোমার ওই বজ্জাত বন্ধু আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় পালিয়েছে!
-আপনার মেয়ে নিয়ে পালায়নি সে। সে একাই পালিয়েছে। কোথায় আছে আল্লাহই ভালো জানে৷
ওসি সাহেব বললেন,
-তুমি কীভাবে নিশ্চিত ভাবে বলছো যে সাহেদ উনার মেয়েকে নিয়ে পালায়নি?
-তার কারণ আছে৷ উনার মেয়ে কোথায় আছে তা আমি জানি৷ পাঁচমাস আগ থেকে সে হল ছেড়েছে। রুম ভাড়া করে থাকছে।
এহসান সাহেব মনিরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার কুচকানো মুখ সরল হলো খানিক। কৌতূহল সৃষ্টি হলো। ওসি নুরুজ্জামানের চেহারার অবস্থা বলা গেল না। তিনি যেই অবস্থাতে ছিলেন সেই অবস্থাতেই আছেন। তার কাছে যেন এই বিষয় নতুন নয়৷ একটা মেয়ে হল থেকে পাঁচ মাস আগে একটা ভাড়াটে রুমে উঠছে এই ব্যাপারটায় নতুন কী? অবাক হওয়ার কী আছে?
.
তিনদিন আগের গল্পঃ
১.
সাহেদের ঘুমটা হুট করে ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার মতো তেমন কোনো কারণ নেই৷ কোনো দুঃস্বপ্নও সে দেখেনি৷ তারপরও ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম এলো না। বালিশের কাছ থেকে ফোন নিয়ে সময় দেখল। রাত তখন তিনটা আঠারো। সে উঠে বসল। বসতেই মনে হলো মাথাটা যেন ঘুরছে। সে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেল। লাইট জ্বলালো। ওয়াশ রুমে গেল ঢুলতে ঢুলতে। ওখান থেকে ফিরে নিজের বিছানার কাছে আসতেই দেখল তার বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে৷ যে শুয়ে আছে সে দেখতে একদম অবিকল তার মতো৷ একদম যে ভঙ্গিতে সে শুয়েছিল ঠিক সেভাবেই মানুষটি শুয়ে আছে৷ মানুষটাকে দেখতেই সাহেদের মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল। সে কেঁপে উঠল খানিক। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল তার। শরীরময় অদ্ভুত শীতল শিহরণ বয়ে গেল। খানিকটা শব্দ হতেই বিছানায় শুয়ে থাকা সাহেদের মতো দেখতে লোকটার চোখ দুটো চট করেই খুলে গেল। সে সোজা সাহেদের দিকে তাকালো৷ তাকিয়ে হাসলো। হাসার সময় সাহেদ দেখল লোকটার দাঁত নেই। মাড়ি দেখা যাচ্ছে। দাঁত নেই ওয়ালা হাসিটা ভীষণ জঘন্য লাগল সাহেদের কাছে। তার মনে হলো সে জীবন এমন মারাত্মক হাসি দেখেনি৷ আর দেখতেও চায় না। সে চিৎকার দিয়ে উঠল। তার চিৎকারে আরো ভীষণ মজা পেল যেন লোকটা৷ সে আরো জোরে হাসতে থাকল। অস্ফুট স্বরে বলতে থাকল,
-তুমি খুনি সাহেদ৷ তুমি খুনি।
ঠিক সে সময় লোকটার দাঁতের মাড়ি বেয়ে রক্ত ঝরতে থাকল। এক সময় দেখা গেল সাহেদের বিছানা রক্তে ভরে যাচ্ছে৷ লোকটা মহানন্দে হাসছে। সাহেদের হাত পাঁ অবশ হয়ে হলো৷ সে যেন চিৎকার করার ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলেছে৷ মূহুর্তে জ্ঞান হারালো সে। তার দেহ নিস্তেজ হয়ে এলো দ্রুত।

ঘুম ভাঙ্গল বেলা এগারোটায়। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল। রাতের কথা মনে হতেই সে জলদি করে উঠে বসল। মাথাটা ভার হয়ে আছে তার৷ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে৷ সাহেদ আধশোয়া হয়ে বসল। কিছু সময় পার হতেই মনির এলো তার রুমে। মনির তার রুমমেট। পাশের রুমে থাকে সে। চেহারা কালো৷ খানিকটা খাটো। সুস্বাস্থবান। সাহেদের কাছে এসে বলল,
-কী রে? রাতে কী হয়েছে তোর? এভাবে চিৎকার দিলি যে?
সাহেদ সেই প্রশ্নের জবাব দিল না৷ বলল,
-আমি বিছানায় কীভাবে এলাম?
-আমি আর সজিব ধরে উঠিয়েছি। ফ্লোরে পড়ে ছিলি তুই৷
সাহেদ কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকল৷ মনির বলল,
-কী হয়েছে রাতে? ফ্লোরে শুয়ে পড়লি কেন?
সাহেদ মেকি হাসল। বলল,
-রাতে গরম লাগছিল ভীষণ। তাই ফ্লোরে নেমে ঘুমালাম।
-গরম লাগলে ফ্যান ছেড়ে দিতে পারতি৷ ফ্লোরে ঘুমানোর কী প্রয়োজন?
-কারেন্ট ছিল না। এ জন্যেই তো ফ্লোরে ঘুমালাম।
-কাল রাতে কারেন্ট ছিল না?
-হ্যাঁ। ছিল না।
-তুই সত্যি বলছিস?
-আমি সত্যি বলছি৷
-তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে তুই মিথ্যা বলছিস?
-তা আম জানি কী করে? তোর মনের ব্যাপার তুই-ই জানবি।
মনির থামল৷ সাহেদের কথা তার বিশ্বাস হলো না। সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে৷ সে আবার বলল,
-ঘুমের ঘোরে উল্টাপাল্টা কী জানি বলছিলি৷ কিছুই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না। কেবল আরশির নামটা শুনতে পেলাম। তাও স্পষ্ট না।
সাহেদ ভ্রু কুচকে বলল,
-আমি আরশির নাম নিয়েছি?
-হ্যাঁ। বেশ কয়েকবার নিয়েছিস৷
-আর কিছু বলেছি সাথে?
-বলেছিস তো অনেক কিছুই। কিন্তু কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায়নি।
সাহেদের মুখটা এতোক্ষণ আতঙ্কিত ছিল। মনির শেষ কথায় শান্তি পেল যেন৷ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। মনির আবার বলল,
-একটা কথা বলি?
-অনুমতি চাচ্ছিস?
মনির কিছু সময় চুপ থাকল। ভালো করে দেখল সাহেদকে। তারপর বলল,
-শোন। আরশির সাথে ঝামেলাটা মিটিয়ে নে। ভালো হবে৷
সাহেদ মুখটা মলিন করে নিচু স্বরে বলল,
-আমিও তো তা-ই চাই৷ কিন্তু ও নিজেই তো আমার সাথে দেখা দিচ্ছে না৷
-আমি কি ওর সাথে কথা বলব?
-নাহ৷ তার প্রয়োজন নেই৷ তুই গেলে আবার তোর উপর রাগবে সে। আমাকেই কিছু করতে হবে।
-হ্যাঁ। কিছু কর। তোর অবস্থা ভালো ঠেকছে না। চোখের নিচে কালি পড়ে কী অবস্থা হয়েছে তোর!
সাহেদ মৃদু হাসল। বলল,
-তুই আমাকে নিয়ে বেশি ভাবিস তো তাই তোর এমন মনে হয়!
মনির বলল,
-আমার ছোট বেলার বন্ধু তুই। তোকে নিয়ে ভাববো নাতো কাকে নিয়ে ভাববো? আয়। নাস্ত করতে যায়। বেলা অনেক হয়েছে৷

২.

সাহেদ নাস্তা করে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো৷ আলম চাচার দোকানে গেল। আলম চাচা চায়ের দোকান দেয়৷ দোকানটা সাহেদের বাসার সামনেই৷ তাই সাহেদের সাথে পরিচিতি বেশ ভালো৷ দেখাসাক্ষাতে বেশ হাসি-তামাশা হয়। সাহেদ দোকানে আসতেই আলম চাচা বললেন,
-কী খবর সাহেদ?
সাহেদ হাসল। বলল,
-আলহামদুলিল্লাহ চাচা৷ ভালো আছি। তোমার খবর কী?
আলম চাচা এক গাল হাসলেন৷ হাসলে তাঁর দাঁতের মাড়ি সহ দেখা যায়৷ লোকটার চেহারা কালো। কালো চেহারায় হাসি স্পষ্ট হয়৷ সাহেদ স্তব্ধ হয়ে গেল৷ সাথে সাথে কাল রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল। তার মাথাটা যেন ঘুরিয়ে উঠল৷ আলম চাচা বললেন,
-আমার খবর ভালোই। তয় তোমার খবর মনে হয় না ভালো। রাতে কি ঘুম টুম কম যাও নাকি?
-না তো। ঘুম তো বেশ ভালোই হয়। এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?
-না, তোমার চেহারাটা শুকাইয়া আছে। চোখের নিচে কালি জমে আছে যেন। কী হইছে? কোনো ব্যাপারে কি চিন্তিত?
সাহেদ হাসল। বলল,
-জীবন বড় বিচিত্র চাচা৷ এই বিচিত্র রকম ব্যাপারটাই বেশি বেশি ভাবতেছি৷
-আরে এ আর এতো ভাবনের কী হইলো? ইয়াং মানুষ। সব সময় প্রেশ মাইন্ডে থাকবা৷ তাইলেই ভালো লাগবো। ঠিকাছে?
-তা অবশ্য ঠিক বলেছো তুমি। কই চা দাও তো। মাথাটা বেশ ধরেছে। তোমার চা ছাড়া এই ধরাটা নামবে না। বুঝলে?
আলম চাচা হাসি দিলেন৷ গর্বের হাসি তার৷ আসলেই তার চা ভালো হয়। সাহেদকে চা দেওয়া হলো। সে চা হাতে নিতেই দেখল পাশ দিয়ে মসজিদের হুজুর যাচ্ছে৷ সে ডেকে সালাম দিলো৷ বলল,
-হুজুর চা খেয়ে যান?
হুজুর হাসলেন৷ পঞ্চাশ উর্ধ বয়স তাঁর৷ দাঁড়ি ভর্তি হাসিটা তাঁর অমায়িক। তিনি এগিয়ে এসে সাহেদের সাথে হাত মেলালেন৷ বললেন,
-সাহেদ, তাড়া আছে আমার৷ তা না হলে চা অবশ্যই খেতাম। আচ্ছা ইদানিং তোমাকে মসজিদে কম দেখা যাচ্ছে। অসুস্থ নাকি?
সাহেদ হাসল খানিক। বলল,
-অসুস্থ নয়। তবে একটু ঝামেলায় আছি আরকি। এ ব্যাপারে পরে কথা বলব আপনার সাথে।
-আচ্ছা৷ ঠিকাছে। সাক্ষাতে বলিও৷ তবে আর যাই করো বাবা, নামাজ ছাড়িয়ো না৷ ঠিকাছে।
সাহেদ হাসল। বলল,
-জ্বী৷ অবশ্যই। নামাজ ছাড়বো না৷ দোয়া করবেন হুজুর৷
হুজুর চলে গেলেন। সাহেদ সেখানে আরো কিছুক্ষণ বসল৷ এলাকার এক বড় ভাই এলো। তার সাথে কিছু হাসিতামাশা করল। তারপর সেখান থেকে উঠে গেল। কিছু দূর হেঁটে একটা পার্কে গেল৷ খুব পরিচিত একটা পার্ক৷ আরশিকে নিয়ে প্রায়ই এখানে আসতো সে৷ লেকের ধারে বসে কতো গল্প করতো৷ সময়ের বিবর্তনে আজ সেই গল্প গুলো বাতাসে কিংবা নিজ মুখেই রয়ে যায়। বৃহৎ করে তা প্রকাশ ঘটে না৷ সাহেদ পার্কে ঢুকল। খুব পরিচিত লেকের পাড়টায় বসল। পাঁচ মাস আগে আরশি আর তার গমন ছিল এখানে। কতো আসতো! লেকের ধারে আরশি মেয়েটা খুব নির্ভয়ে সাহেদের কাঁধে মাথা রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতো৷ কতো গল্প হতো সে সময়৷ অনুভূতিরা তখন বিদ্যুৎ গতীর মতো প্রখর ছিল৷ সময় গুলো এতো ভালো কাটতো! সাহেদ নিজের পাশে হাত রাখে। বলে,
-আরশি, আবার বাবুটা! আমার জান, আমি খুনি৷ আমাকে ক্ষমা করে দিও  প্লীজ৷
সাহেদ জানে। আরশি তাকে কখনই ক্ষমা করবে না৷ কখনই না৷ তারপরও সে ক্ষমা চায়। তার পাশে থাকা শূন্যস্থানটার কাছে৷ লুটিয়ে পড়ে যেন শূন্যস্থানের কাছে। হঠাৎ  সাহেদ নামক হাসি খুশি অথচ ভেতরে গভীর বেদনা নিয়ে থাকা ছেলেটা কেঁদে উঠে। আশপাশের মানুষ তাকায়৷ নানান জনে নানান কথা ভাবে৷ তাতে গা নেই সাহেদের। সে ক্ষমা চায়৷ খুব করে চায়৷
.
বর্তমানঃ
মনির, আরশর বাবা এবং ওসি সাহেব একটা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ বাসাটার নাম ইসমাইল মঞ্জিল৷ ইশমাইল মঞ্জিলের তৃতীয় তলায় আরশি থাকে। এমনটাই মনির জানিয়েছে। আরশির বাবা জনাব এহসান সাহেবকে বড় চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ তাঁর মুখটা কালো হয়ে আছে। চিন্তায় মাথাটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে। ভেতরে মেয়েকে কী অবস্থায় দেখবেন এই ব্যাপারে তিনি অত্যাধিক চিন্তিত৷ তার মাথায় একটা কুকথা ঘুরছে। তা যদি সত্যি হয়ে যায় তবে তিনি সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না৷ গ্রামে তাকে সবাই মানে। বড় সম্মান তার৷ তাঁর মেয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে তিনি ওই সমাজে মুখ তো দূরে থাক, বাসই করতে পারবেন না৷ মনির এগিয়ে গেল। তার পেছন পেছন আরশির বাবা ও ওসি সাহবে আসছেন৷ ওসি সাহেব বড় নিশ্চুপ ধরনের। তিনি এই ব্যাপারটায় তেমন মাথা গামাচ্ছেন না৷ এখানে আসতেও তিনি নারাজ ছিলেন৷ এহসান সাহেবের জোরাজোরিতে আসলেন৷ তারা তৃতীয় তলায় আসার পর থমকে দাঁড়াতে হলো। রুমে তালা মারা৷ বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল এই বাড়ি থেকে তারা এক সপ্তাহ আগেই চলে গিয়েছে৷ অন্য কোথায় গিয়েছে সে ব্যাপারে তিনি জানেন না৷ মনিরও হতভম্ব হয়ে গেল৷ সে স্তব্ধ হয়ে আছে৷ চিন্তায় মশগুল সে৷ সাহেদ এটা কী করলো? এই ব্যাপারটা ও লুকালো কে ওর কাছে? ওসি সাহেব বললেন,
-কী ব্যাপার। আপনার বন্ধু তো এখানে নেই৷
মনির অবাক স্বরে বলল,
-আমারো তাই কথা। ওরা এখানেই ছিল বলে আমি জানতাম। কিন্তু এখান থেকে যে চলে গিয়েছে তা জানতাম না।
এহসান সাহেব বললেন,
-তুমি আমাদের ঘুরাচ্ছো না তো? কোনো ভাবে কি তুমি সাহেদের পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা লুকাচ্ছো?
-আঙ্কেল সাহেদ আপনার মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়নি। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।
-আরে বাবা কীভাবে নিশ্চিত থাকবো? আমার মেয়ে হারিয়েছো৷ তুমি বুঝতে পেরেছো? আমার মেয়ে হারিয়েছে, মেয়ে।
মনিরের খানিকটা মায়া হলো ভদ্রলোকের জন্যে। সে বলল,
-আঙ্কেল? আপনার মেয়ে প্রেগন্যান্ট ছিল। তাকে নিয়ে পালানোটা সহজ ব্যাপার নয়৷
এহসান সাহেবের মুখটা ভীষণ কালো হয়ে গেল। উনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কথা বলতে পারলেন না৷ একদম চুপ হয়ে গেলেন। মানুষটার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। বুকের ভেতরটা অদ্ভুত রকম করে উঠল। চাপা একটা যন্ত্রণা করতে থাকল। তিনি কী করবেন বুঝতে পারলেন না৷ কাঁদবেন নাকি মেয়ের উপর রাগ করবেন বুঝতে পারছেন না। বড় আদরের মেয়ে তাঁর। এ কোন পথে গেল সে। কী ভুলে শাস্তি এটা।

মনির কিছু বলল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল৷ ওসি সাহেব এবার একটু নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলেন। উনার কাছে মনে হলো এখানে কোনো ঝামেলা আছে। কিছু একটা ঠিক নেই। তিনি মনিরকে বললেন,
-আরশি কতো দিনের প্রেগন্যান্ট ছিল বলতে পারবেন আপনি?
মনির খানিকটা ভেবে বলল,
-ওর লাস্ট স্টেজ ছিল।
-তারমানে ওরা এখন হাসপাতালে থাকার সম্ভাবনা বেশি৷ হাসপাতাল গুলো চেক করতে পারলে কিছু একটা পাবার আশা করা যায়৷ কিন্তু এই শহরে এতোগুলা হাসপাতাল যে চেক করেও কূল পাওয়া যাবে না৷ কী যে করি এখন?
ওসি সাহেব থামতেই এহসান সাহেবের ফোন বেজে উঠল। তিনি হাস্তদন্ত হয়ে ফোন তুললেন৷ স্ক্রিনে আরশির নাম দেখতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভারী স্বরে বলে উঠলেন,
-আমার মেয়ে ফোন দিয়েছে।
এটা বলে তিনি তাকিয়ে থাকলেন স্ক্রিনের দিকে। কী করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না। কিছু সময় চুপ থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ে কঠিন কিছু কথা বলবেন তিনি। অনেক বকা দিবেন৷ সে যা করেছে ঠিক করেনি। অন্যায় করেছে। মহা অন্যায়৷
এই ভেবে তিনি ফোন রিসিভ করলেন৷ ওসি সাহেব এবং মনির এগিয়ে এলো তাঁর দিকে। এহসান সাহেব কল ধরে বললেন,
-হ্যালো, আরশি?
আরশি খানিক চুপ থেকে বলল ভেজা স্বরে বলল,
-বাবা?
মুহূর্তে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল এহসান সাহেবের। তিনি খানিকটা জোরব বলে উঠলেন,
-আরশি, মা, তুই কই মা? কেমন আছিস তুই?
আরশি চুপ থাকলো এবার। কথা বলল না৷ এহসান সাহেব আবার জোরে বলে উঠলেন,
-কিরে মা? কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে তোর?
এবার ওপাশ থেকে শব্দ এলো৷ কান্নার শব্দ৷ আরশি কাঁদছে। খুব শব্দ হচ্ছে তার কান্নায়৷ এহসান সাহেবের বুকটা ছিড়ে গেল যেন। কেঁদে উঠল তাঁর মন। যে মেয়েকে তিনি কখনই কাঁদতে দেননি আজ সেই মেয়ের এমন কান্না তিনি সত্যি সহ্য করতে পারছিলেন না। তাঁর চোখ দুটো যেন অকারণেই জল জমে গেল। আমি হঠাৎই কান্না শুরু করতে থাকলেন। ওসি সাহেব এবং মনির মলিন মুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাদের বড্ড মায়া হচ্ছে মানুষটার জন্যে। কিছু সময় আগেও তাদের মনে হলো এই মানুষটার মতো কঠিন মানুষ আর দুটো হয় না। অথচ এখন মনে হচ্ছে এই মানুষটার মতো নরম মনের আর কেউ নেই। একদমই নেই। তারা তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল একটা বাবা নামক পাথরটার কান্না৷ এই কান্না সহজে দেখা যায় না৷ সহজে, সব জায়গায় দেখা যায় না। বাবারা সব সময় কাঁদেন না৷ মাঝে মাঝে কাঁদেন। সেই কান্নাটা ভীষণ হৃদয়বিদারক হয়৷ বেদনায় ভরা থাকে৷ কষ্ট গুলো যেন ডানা মেলে উড়ে তাঁর চার পাশে।
.
গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা

দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ



Next Post Previous Post
4 Comments
  • Yusuf AHmed
    Yusuf AHmed ২০ মার্চ, ২০২০ এ ১:৩৮ PM

    অসাধার। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। তারাতারি দেওয়ার চেষ্টা করবেন ভাই

    • Author
      Author ২১ মার্চ, ২০২০ এ ৬:৩৬ PM

      দ্বিতীয় পর্ব দিয়েছি ভাই

  • Karim Sadik
    Karim Sadik ২০ মার্চ, ২০২০ এ ১১:৫২ PM

    Waiting for next part.

  • Author
    Author ২১ মার্চ, ২০২০ এ ৬:৪০ PM

    দ্বিতীয় পর্ব দিয়েছি ভাই

Add Comment
comment url