গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা - শেষ পর্ব | লেখক - তাসফি আহমে

গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা - শেষ পর্ব | লেখক - তাসফি আহমে



গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা - শেষ পর্ব | লেখক - তাসফি আহমে



গল্পঃ গোপন গল্পের বেদনা
শেষ পর্ব


তাসফি আহমেদ

.

নুরুজ্জামান মনিরের সাথে গ্রামে নিজ উৎসাহে এলেন। হঠাৎই তার এই ব্যাপারটার প্রতি কৌতূহল তৈরী হলো। তিনি এর শেষটা দেখার জন্যে এলেন৷ পুলিশের জীপটি থামল একটা গেটের সামনে। গেটে বড় করে লেখা, 'দৌলতপুর ভূঁইয়া বাড়ি'। এই লাইনটা একদম স্পষ্ট। মনে হচ্ছে এই গেটেরও বেশ যত্ন হয়৷ গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকতেই একটা কবরস্থান দেখা গেল। কবরস্থানের পরে আছে মসজিদ। মসজিদের উপরে লিখা 'দৌলতপুর ভূঁইয়া বাড়ি জামে মসজিদ'। এরপরে দুপাশে সব বাগান৷ বাগানের মাঝখান দিয়ে একটা সরল রাস্ত গিয়ে থামল একটা বিলাশ বহুল বাড়ির সামনে৷ এরপাশে কয়েকটা ঘর৷ দু'একটা বিল্ডিং। তবে বাড়ির ভেতর ডুকতেই যে বিল্ডিংটা সেটা খুব টানলো সকলকে। মনির বলল,
-এটাই সাহেদের বাসা৷
ততক্ষণে সবাই নেমে গেল গাড়ি থেকে৷ আরশিকে ধরে নামালো অনামিকা। তার পেছন পেছন নেমে এলো এহসান সাহেব। তাঁকে নির্বোধ দেখাচ্ছে৷ অসহায় চাহনি তাঁর৷ তারা সবাই বাড়ির মূল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডোর বেল বাজালো। কিছু সময় পর দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ। দাঁড়ি গোঁফ পেঁকে গিয়েছে তাঁর। চুলও সাদা৷ ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে৷ মুখ তাঁর বড় শক্ত। মনির তাঁকে দেখতেই সালাম দিল। বলল,
-আঙ্কেল কেমন আছেন?
আঙ্কেল কিছু বললেন না৷ তিনি ভেতরে চলে গেলেন। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরলেন তিনি৷ হাতে দুটো খাম। একটা খোলা আরেকটা ঠিক মতোই আছে৷ তিনি বললেন,
-চলুন। বাগানের ধারে চেয়ার পাতা আছে৷ সেখানে বসি।
আর‍শির মনে হলো সব আগ থেকে ঠিক করা ছিল৷ তিনি যেন জানতেন তারা আসবে৷ এ জন্যেই সব ঠিক করা ছিল। ব্যাপারটা কেমন জানি লাগল আরশির কাছে। মনিরও তেমন কিছুই ভাবছিল। এখানে কিছু একটা ঠিক নেই। মোটেও ঠিক নেই। সবাই বাগানে গিয়ে বসল। মনিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো৷ তার জন্যে চেয়ার অবশিষ্ট রইলো না৷ সাহেদের বাবা জনাব শাহ আলোম কড়া স্বরে ডাক দিলেন,
-বদু? এই বদু?
কিছু সময় বাদেই সেন্ড্রো গেঞ্জির সাথে লুঙ্গি পরা একজন বেঁটে লোক এলো। এসেই বলল,
-চাচা ডাকছিলেন?
-বাগানের চেয়ার আরেকটা কই?
বদু নামক লোকটা মাথা নিচু করে জবাব দিল,
-নাই? এইখানেই তো ছিল। সক্কালেও তো দেইখা গেলাম।
-থাকলে কই? নেই কেন?
-আমি খুঁইজ্জা আনতেছি চাচা৷
-তোমার খুঁজতে খুঁজতে এদের যাওয়ার সময় হয়ে যাবে৷ বরং তুমি ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে দাও৷ আর কিছু নাস্তা পানির ব্যবস্থা করো।
বদু মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। কিছু সময় পর চেয়ার এনে দিল৷ মনির সেখানে বসল। বাগানের এই জায়গাটায় এই মানুষ গুলোর মাঝে হঠাৎই যেন একটা পিনপতন নীরবতা নেমে এলো৷ সবাই চুপ করে থাকল৷ এমন সময় শাহ আলোম সাহেব আরশির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুমিই আরশি। তাই না?
আরশি ফিকে হাসি দিয়ে বলল,
-জ্বী আঙ্কেল।
-তুমি তো তাকে ভালোবাসো৷ নাকি?
আরশি মাথা নামিয়ে নিলো। নিচু স্বরে বলল,
-জ্বী।
-আচ্ছা, তুমি কি বলতে পারবে তার কী হয়েছে? হঠাৎই ওকে কেমন জানি ভিন্ন ভিন্ন লাগছে৷ এই যেমন গ্রামে আসার পর সে এই বাড়িতে আসেনি৷ প্রথমে এসেই কবরস্থানের কাছে গেল। নিজের মায়ের কবরের পাশে অনেকটা সময় শুয়ে থাকল। আমি যখন এই খবর জানতে পারলাম লোক পাঠালাম তাকে ধরে নিয়ে আসতে৷ কিন্তু তাকে আনা গেল না৷ তার গা থেকে নাকি বাজে গন্ধ আসছিল। উল্টো সে আমার লোকদের দুটো চিঠি ধরিয়ে দিলো। আমার লোকেরা এসে আমাকে এই চিঠি দুটো দিয়ে গেল। তারা এও বলল, আমার ছেলে নাকি পাগল হয়ে গিয়েছে৷ সে নাকি কবরের সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলছে৷ তুমি এই বিষয়ে কিছু জানো? তার মানসিক সমস্যার ব্যাপারে?
আরশি ভ্রু কুচকে বলল,
-না তো! সে তো ভালোই ছিল৷
-জানতে পারলাম তোমাদের একটা সন্তান হয়েছে। মৃত সন্তান। তা কি সত্য?
আরশি মাথা নিচু করে বলল,
-জ্বী।
শাহ আলোম সাহেব খানিকটা রূঢ় গলায় বললেন,
-বিবাহপূর্ব তোমরা কীভাবে সন্তান নিতে পারলে? পরিবারের কথা কি একবারও ভাবলে না?
আরশি মাথা নিচু করে থাকল। কিছু বলল না৷ শাহ আলোম সাহেব নিজ থেকেই বললেন,
-তোমরা কি বিয়ের করার সিদ্ধান্ত বাচ্চা হওয়ার পরে নিয়েছো? মানে তোমরা কি বাচ্চা হওয়ার পর বিয়ে করতে?
আরশি নিচু স্বরে বলল,
-জ্বী।
-কী আশ্চর্য! এটা কোন ধরনের নিয়ম। তোমাদের বর্তমান জেনারেশনের কী হয়েছে? তোমরা এমন হয়ে গিয়েছো কেন? বিয়ের পূর্বে কীভাবে এমন জঘন্য কাজ করতে পারলে?
আরশি কিছু বলল না৷ চুপ থাকল। মাথা নিচু করে রাখল৷ শাহ আলোম সাহেব বললেন,
-ছিহ! ধিক জানাই। এরচে নোংরা কাজ আর কী হতে পারে? ভালোই হয়েছে আমার ছেলে পাগল হয়ে গিয়েছে। গাধাটা তার জীবনের উচিৎ শিক্ষাটা পেয়েছে৷
আরশি চুপ হয়ে গেল। কেউই কোনো শব্দ করল না৷ শাহ আলোম সাহেব দ্বিতীয় খামটা মনিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-এটা তোমার জন্যে৷ মনির, তোমাকে তো ভালো ছেলে ভেবেছিলাম। ভাবলাম তুমি আমার ছেলের খেয়াল রাখবে৷ নিজের ভাইয়ের মতো করে রাখবে। এই রাখলে খেয়াল?
মনির মাথা নিচু করে নিলো৷ হাত বাড়িয়ে চিটিটা নিলো। খামটা খুলে চিঠিটা হাতে নিতেই সেখানে কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা দেখল,
"মনির, চিঠিটা তুই জোরে পড়বি৷ যাতে সবাই শুনতে পায়৷ কারণ আমি চিঠিটা উপস্থিত সকলকেই উদ্দেশ্য করে লিখেছি। বলা বাহুল্য এই চিঠি চিঠি নয়। এটাকে একটা নোট বলা যেতে পারে৷"

এরপর মূল চিঠির গল্প শুরু হলোঃ
"আমি সাহেদ আহমেদ। জনাব শাহ আলোম ভূঁইয়ার বড় পুত্র৷ শাহ আলোম সাহেব, তথা আমার পিতার গ্রামে অনেক পরিচিতি৷ সবাইই তাঁকে সম্মান করে৷ আমিও করি৷ তার উপর দু কথা বলতে পারি না৷ এই দু কথা বলতে না পারাটাই আমার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরশি নামের মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি৷ তাকে ছাড়া আমি এক মূহুর্ত কল্পনা করতে পারি না৷ আমি এই ব্যাপারে বাবাকে জানালাম। বাবা আমাকে উল্টা বোকা দিয়ে থামিয়ে দিলেন। সে সময় আরশি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। একদিনের একটি ভুল আজ আমাদের এই পরস্থিতিতে ফেলে দিলো৷ আরশির প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানতে পেরে আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বললাম, সে যেন বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলে। আরশি জেদ ধরল। সেই এই বাচ্চার জন্ম দিবে৷ আমি শত নিষেধ করলেও সে আমার কথা মানলো না। আমি বললাম,
-বাবা আমাদের মেনে নিবে না৷ তুমি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলো৷ আগে বাবাকে কনভিন্স করি। এরপর বিয়ে এবং বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভাববো।
এই মেয়েটা তখনও রাজি হয়নি। সে বলল,
-প্রয়োজন সব ছেড়ে দিবো, তবুও আমি এই বাচ্চা নষ্ট করবো না৷
মেয়েটার মাঝে হঠাৎই জানি কী হয়ে গেল। মা মা একটা ভাব চলে এলো৷ আমি তার ভেতর অদ্ভুত একটা খুশি দেখছিলাম। তাকে সত্যিই অন্য রকম লাগছিল। কিন্তু তখনও আমি বাচ্চা প্রসবের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না৷ অনাগ্রহ থেকেই আরশির পাশে ছিলাম। মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসি বলে ছেড়ে দিতে পারিনি৷ তার জন্যে আলাদা বাসা নিলাম। খেয়াল রাখতে থাকলাম। ততদিনও আমরা একটা অবৈধ সম্পর্ক ও সন্তান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে আমাদের বাচ্চাটার জন্মের সময় হয়ে এলো৷ আমি আরশিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। নরমালে সন্তান প্রসবের কথা বললাম। অনামিকা তখন পাশে ছিল। নরমাল সিজারেই আমার বাচ্চাটা দুনিয়ায় আসে৷ কিন্তু দুনিয়ায় আসার পর ডাক্তার জানায় বাচ্চাটা মৃত৷ এই খবরে আরশি ভেঙ্গে পড়ে। তথাপি আমি ভীষণ খুশি ছিলাম। আমার খুশি দেখে কে৷ আমিও যেন মনে মনে চাচ্ছিলাম বাচ্চাটা মৃত হোক৷ আল্লাহ আমার মনের কথা শুনলেন। আমি এরপর অনেক কিছু ভেবে নিলাম। কীভাবে কীভাবে বাবাকে রাজি করবো এসব কিছু। ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাবার প্রবল আগ্রহ আমাকে এই বাচ্চাটার প্রতি অনাগ্রহ করে তুললো যা আমি পরবর্তীতে বুঝতে পারি। মৃত বাচ্চাটাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হলো আমাকে৷ আমি তাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হলাম৷ রাস্তার কাছে আসতেই বাচ্চাটা কেঁদে উঠল৷ আমি চমকে উঠলাম। বাচ্চাটা আরো জোরে কাঁদতে থাকল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের বাচ্চা হয়েছে। জীবিত বাচ্চা৷ আমার শারিয়া। আমার মেয়ে। জীবিত জন্মায়, আরশি৷ আমাদের মেয়ে জীবিত ছিল৷ ঠিক সেই মূহুর্তে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ মনে হচ্ছিল এই বাচ্চার বেঁচে থাকা মানে ঝামেলা৷ ভীষণ ঝামেলা৷ এই ঝামেলা দূর করতে হবে৷ ঠিক সেই সময়ে আমি আমার জীবনের সবচে জঘন্যতম সিদ্ধান্তটা নিলাম৷ আমি অনেক দূরে হেঁটে এসে একটা ঝোপের কাছে বাচ্চাটাকে ফেলে গেলাম৷ বাবুটা ওখানে শুয়ে কাঁদতে থাকল৷ আমি খুব ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে এলাম৷ কান্নাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকল। কিছু দূর আসতেই আমার মনে হলো, হায়, এ আমি কী করলাম? এটা তো আমাদের বাচ্চা! আমি ওর বাবা৷ একটু আগে বাচ্চাটা আমার কোলে থেকে কান্না করেছিল। কী ভীষণ মায়া লাগছিল তখন! আর আমি কী করছি? এই বাচ্চাটাকে ফেলে যাচ্ছি? এ আমি কোন অন্যায় করতে যাচ্ছিলাম? এই ভেবে আমি পেছন ফিরে আবার আসতে চাইলাম। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক আমায় বাধা দিলো৷ মস্তিষ্ক জানালো এই বাচ্চাটা একটা ঝামেলা৷ সবাই জানে এটি মৃত জন্মেছে৷ এখন যদি এটি জীবিতও থাকে তবে সেটা কেউই জানে না৷ কেবল আমি ছাড়া৷ তাই ওই বাচ্চাটা ওখানেই থাকুক৷ জাহান্নামে যাক সেই বাচ্চা৷ আমাকে আমার প্রিয় মানুষটাকে পেতে হবে৷ তাকে পেলে এরপর আরো অনেক বাচ্চা নেওয়া যাবে৷ আগে প্রিয়তমা প্রয়োজন। আমি বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম। মনের শুনবো নাকি মস্তিষ্কের? কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। হঠাৎই আরশির চেহারাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। এই জীবিত বাচ্চাটা দেখলে যে কী খুশি হবে আমার আরশিটা! এটা ভাবতেই আনন্দ লাগল আমার। তার খুশিই আমার কাছে অনেক৷ অবশেষে আমি মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দৌড়ে গেলাম সেই জায়গায় যেখানে আমি আমার বাচ্চাটাকে রেখে এসেছিলাম। কিন্তু দেখানে গিয়ে যা দেখলাম তার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম। আমি দেখলাম ঝোপের ধারে একটা কুকুর আমার বাচ্চাটার গলা কামড়ে বসে আছে৷ আমি চিৎকার দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কুকুরটা আমার বাবুটাকে মুখে নিয়ে দৌড়াতে থাকল৷ আমি তার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকলাম৷ কিছুদূর যেতেই সে বাচ্চাটাকে ফেলে দৌড়ে গেল। আমি দৌড়ে গেলাম আমার বাবুটার কাছে। আমার শারিয়ার কাছে। শারিয়া তখন পুতুলের মতো পড়েছিল। একদম নিস্তব৷ কোনো সাড়া দেয় না সে। একটু কান্নাও করে না। তার গলার কাছ থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। মাথাটা খানিকটা থেতলানো। আমি তার মাথায় হাত রাখি৷ মুখে মুখ লাগিয়ে অক্সিজেন দেই৷ বোকার মতো তার ছোট্ট হাতের পালস চেক করি৷ বুকের কাছে হাত রাখি। নেই। কোথাও স্পন্দন নেই। সব নীরব৷ একদম নীরব। আমি ফাঁকা রাস্তায় আমার বাবুটাকে সামনে রেখে কান্না শুরু করি৷ আমার বুক ফাটা আর্তনাদ কেউ দেখছিল না মনির। কেউ না। কী অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছিল তা তোকে বোঝাতে পারবো না৷ আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ রাতে বাচ্চাটাকে বালির নিচে পুতে দিয়ে আসি৷ পাশেই বালির মাঠ ছিল। আমি আমার শারিয়াকে সেখানে রেখে আসি৷ এরপর থেকে এক প্রকার মানসিক যন্ত্রণা যেন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল৷ আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম৷ দেখতাম আমার বাচ্চাটা শুয়ে আছে আমার কোলে। কান্না করছে৷ আবার দেখি অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে৷ একদিন দেখি বাথরুমের বালতিতে একটা বাচ্চা রাখা৷ বাচ্চাটা পানিতে ডুবে আছে। আমি এই ব্যাপার গুলো নিতে পারছিলাম না। খুব ভারী হয়ে যাচ্ছিল এই পাপ গুলো। দিন দিন যেন বাবুটা আমার স্বপ্নে আসতে থাকল। আমি কেবল তাকে দেখতাম। মাথায় অস্বাভাবিক যন্ত্রণা হতো৷ হুটহাট সেন্সলেস হয়ে পড়তাম। এক সময় মনে হলো আমি আর পারছি না৷ আমার দ্বারা এই পাপ আর বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না৷ এদিকে কাউকে এই ব্যাপারে বলতেও পারছিলাম না৷ ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়ে ধুকে ধুকে মরতে থাকলাম আমি।
আমি আমার এই না বলা গল্পটা গোপন রাখতেও পারছিলাম না। পারছিলাম না এর বেদনা গুলো ভুগতে। তাই তো বাবুটাকে ওই বালুর স্তুপ থেকে নিয়ে এলাম এখানে। আমার মায়ের কবরের পাশে কবর দিলাম। নিজের জন্যে তৈরী করে নিলাম প্রিয় বাগান টা। আমি জানি আমি পাপি। এরচে বড় পাপি হয়তো কেউইই দেখেনি৷ কেবল ভালোবাসাটাকে পাওয়ার জন্যে আমি যা করলাম তার শাস্তি হিসেবে আমি এখন যা করছি তাও কম হয়ে যাবে। সবাই আমাকে ক্ষমা করবেন৷ আব্বা, আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার ভালো ছেলে কখনই আমি ছিলাম না। কখনই হতে পারিনি৷"
মনির থামল। তার চিঠি পড়া শেষ৷ সে চোখ মুছল। আরশি কান্না করে ভীষণ। অনামিকার বুকে মাথা গুঁজে কান্না করে। উপস্থিত সবার চোখে জল। কঠোর মনের শাহ আলোম সাহেবের চোখেও৷ তিনি যেন বরফের মতো জমে বসে থাকলেন। যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। সবাই যখন নীরব তখন বদু নামের লোকটি দৌড়ে এলো আলোম সাহেবের কাছে৷ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-চাচা? চাচা, বড় সাহেব গলায় ফাঁস দিছেন। একটা নীল রঙের শাড়িতে ফাঁস দিছেন। হের গলায় একটা ছবি জুলছিল৷ ছবির মাইয়াডার সাথে এই আফাটার চেহারার বড় মিল। চাচা, আসেন না! দেইখা যান৷ বড় সাহেব এইডা কী করল! ও আল্লাহ গো!
মনির উঠে দাঁড়ালো৷ আরশির কান্নার বেগ বেড়ে গেছে৷ সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। নুরুজ্জামান, এহসান সাহেব এবং শাহ আলোম সাহেব স্থির হয়ে বসে থাকেন। তাঁরা কী করবে বুঝতে পারেন না৷ তাঁদের সকলের চোখেই জল। বেদনার জল। মনির বাগানের দিকে যায় ধীর পাঁয়ে। দু পা যেন চলতে চায় না। বল নেই সেখানে। দুই বন্ধু মিলে ছোট বেলায় যে আম গাছ রোপন করেছিল আজ সেই গাছটায় দুই বন্ধুর একজন ফাঁস দিয়েছে। মনির দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে কেবল। সাহেদ নামক প্রানবন্ত ছেলেটা ঝুলছে৷ পাশে একটা চেয়ার পড়ে আছে৷ মনির ভালো করে দেখল। তার বন্ধুটা সোজা তার দিকে চেয়ে আছে৷ চোখ ভরা তার ভীষণ কষ্ট৷ কিছু না বলা বেদনা যেন আনাগোনা করছে৷ মনির হঠাৎই মাটিতে বসে পড়ে৷ চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে সে৷ তার কান্নায় আকাশ পাতাল ভেঙ্গে আসতে চায়৷ প্রকৃতি যেন থমথমে। ভীষণ নীরব আজ। ভীষণ নীরব৷ কেউ কথা কয় না। কারো শব্দ হয় না। নীরবতায় ছেয়ে যায় সমস্ত ভূঁইয়া বাড়ি।
.
এটাকে কেবল একটা গল্প ভেবে পড়ার অনুরোধ রইলো৷ বাস্তবের সাথে যেন না মেলানো হয়। আশা করছি পাঠকগণ খেয়াল রাখবেন৷ ধন্যবাদ।

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয়  পর্ব



সমাপ্ত


ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url