ভালোবাসার গল্পঃ পতিত মেঘদল। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ

ভালোবাসার গল্পঃ পতিত মেঘদল। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ


ভালোবাসার গল্পঃ পতিত মেঘদল। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ তাসফি আহমেদ




'কী হয়েছে আপনার?'

লিফটের কাছে যেতেই দেখলাম নীরা দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নীরা বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ আমি ওর দিকে ফিরতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো৷ আমি বললাম,
-কেমন আছো নীরা?
নীরা জবাব দিলো না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো৷ আমি আড়চোখে মেয়েটাকে দেখলাম একবার৷ তার মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে৷ চেহারাটা কঠিন করে রেখেছে৷ আমি আবারও বলি,
-ভার্সিটিতে গেছিলা? এতো দেরিতে আসলে যে?
নীরার জবাব নেই৷ তার চেহারা ক্রমেই কঠিন হয়ে আসে৷ একটা সময় এই নীরাই আমার সাথে কতো মধুর স্বরে কথা বলতো৷ অথচ আজকাল তেমন কথা তো দূরে থাক, ভালো করে তাকিয়েও দেখে না৷ না দেখাটাও অবশ্য স্বাভাবিক। তবে ইদানীং কিছু ব্যাপার অতিরিক্ত ঘটছে। আগে আমি তাকে 'কেমন আছো' জিজ্ঞেস করলে অন্তত মৃদু হেসে জবাব দিতো৷ অথচ আজকাল তা করে না৷ সে কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। আমার সাথে দেখা হলেই তার চাঁদবদন শক্ত পাথর হয়ে যায়। এমন কেন হয় কে জানে! 

লিফট চলে এলে নীরা দ্রুত ভেতরে ঢুকে যায়৷ আমি ধীর পাঁয়ে ঢুকি। নীরা চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি কিছু বলি না আর। নিজের মতোই ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকি৷ এর ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর মেয়েটা বলে উঠে, 'কী হয়েছে আপনার?' আমি অবাক হই। তার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলি,
-কই? কী হবে?
নীরা আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দিয়ে আগুন ঝরে যেন৷ চোখে যেন বিন্দু বিন্দু জল জমে। চেহারার কাঠিন্যতার চেয়েও মেয়েটা বেশ স্বাভাবিক স্বরে আবার কথাটা বলে,
-কী হয়েছে আপনার? 
আমি যারপরনাই অবাক হই৷ আশ্চর্য! আমার কী হবে? কী জানতে চাইছে মেয়েটা? ওর দিকে তাকিয়ে বলি,
-আমার কথা বাদ দাও৷ তোমার কী হয়েছে সেটা বলো? 
নীরা আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঠিক একই কথা আবার বলে। তবে এবার তার স্বর কিছুটা কঠিন শোনায়, 
-কী হয়েছে আপনার বলুন? 
আমি বলি,
-আমার তো কিছু হয়নি৷ তবে...
নীরা ঠিক আমার সামনে চলে আসে। তার দৃষ্টি আগের চেয়ে কঠিন হয়৷ বলে,
-ডোন্ট ট্রাই টু হাইড এনিথিং ফ্রম মি৷ আই ক্যান রিড ইউর আই। 
আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকে না৷ আমি এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেও কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তার চোখ দেখে আরো অবাক হই। তার চোখেতে কিছু একটা ছিল৷ চোখ ভরা বেদনা ছিল। ছিল জানতে চাওয়ার আকুতি৷ কিছুটা জোর করার অধিকারবোধ। ঠিক তখনই আমার মাথায় ওই ব্যাপারটা চলে আসে। অনেক আগে ঘটে যাওয়া সেই ব্যাপারটা। নীরা কি এখনও সেটা ভুলতে পারেনি? 

ধীরে ধীরে নীরার চেহারার কাঠিন্যতা কমে আসতে থাকে। সে মাথা নিচু করে নেয়৷ ঠিক সেই সময়ে লিফটে শব্দ হয়। পঞ্চম তলা চলে এসেছে৷ নীরা নিচু স্বরে বলে,
-সরি। 
কথাটা বলেই নীরা চলে যায়৷ আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি৷ লিফট আবার চলতে শুরু করে। 

এই বিল্ডিংয়ের একদম উপরের তলায় দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসা আছে৷ একটা বাথরুমসহ দুই রুমের ছোট্ট একটি বাসা। আমি সেখানে থাকি। মাঝে মধ্যে আমার এক বন্ধু এসে আমার সাথে থাকে৷ বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায় নীরারা থাকে। তারাও ভাড়াটিয়া। তারা এখানে অনেক আগ থেকেই থাকে৷ 

নীরার সাথে আমার পরিচয় হবে সেটা আসলে আমি কখনই ভাবিনি। সে কারো সঙ্গেই তেমন মিশে না৷ কথা বলে না৷ সারাক্ষন কেমন রাগি রাগি চেহারা নিয়ে থাকে৷ তার মাঝে রসকষ কিছু আছে বলে মনে হয় না। সে সকাল বিকেল নিয়ম করে ছাদে আসে৷ কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখে সারাক্ষন। ছাদে আসলে তার প্রথম কাজ হয় গাছে পানি দেওয়া৷ বাড়িওয়ালার থেকে অনুমতি নিয়ে সে ছোট্ট একটি বাগান করেছে ছাদে। সেখানে কয়েকটা ফুল গাছ আছে। তারমধ্যে একটি কাঠগোলাপ গাছও আছে। কাঠগোলাপ আমার তেমন পছন্দের ছিল না৷ বলাবাহুল্য, আমি কাঠগোলাপ নামে কোনো ফুল আছে বলেও জানতাম না৷ জানলাম অনেক পরে, আমার এক পাগল বন্ধুর মাধ্যমে। তার আবার কাঠগোলাপ ভীষণ পছন্দের৷ সেই বন্ধু একদিন হঠাৎ করে আমায় ফোন দিয়ে বলে,
-সাদিক, কোথায় তুই?
বললাম,
-বাসাতে। কেন? 
-এক যায়গায় যাবো৷ যাবি আমার সাথে? 
-কই যাবি এই অসময়ে। 
-যাবো৷ আমার একটা পছন্দের জায়গা আছে। কাল্পনিক পছন্দের জায়গা৷ যাবি কি না বল?
-দোস্ত, মাসের শেষ দিক৷ হাত খালি রে। 
-তো আমার হাত কোন দিক থেকে ভর্তি? আমিও তো অর্থসংকটে আছি। 
-তাহলে যাওয়ার টাকা পেলি কই?
-পেয়েছি কোনো এক ভাবে। 
-কোনো এক ভাবে মানে? তুই এই অসময়ে টাকা পেলি কই? মাসও তো শেষ হয়নি এখনও৷ টিউশনির টাকা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ সত্যি করে বলতো টাকা পেলি কোথায়? 
ছেলেটি মৃদু হেসে বলে,
-টাকা ধার নিয়েছি। 
-ধার? কার থেকে ধার নিলি? শফিক্কার কাছ থেকে?
-হু। 
-তোকে ওই বদ লোকের কাছ থেকে টাকা নিতে বলল কে? জানিস না লোকটা ভালো না? টাকা নিয়ে পরে ক্যাচাল করে?
-আরেহ! টেনশন নিস না৷ উনি ভালো হয়ে গিয়েছেন। আর কয়েকদিন পরে তো টিউশনির বেতন পাবোই৷ তখন দিয়ে দিবো। চিন্তা করিস না৷ তুই কেবল বল যাবি কি না?
-তুই যে কী করিস না!
-বাস স্ট্যান্ডে চলে আয়৷ যাবো আর আসবো। বেশি সময় লাগবে না। 
-তুই এখন বাস স্ট্যান্ডে? 
-হ্যাঁ৷ তোর এরিয়ার এখানে৷ আমি ডাবল টিকেট কেটে রেখেছি৷ বাস আর আধ ঘন্টার ভেতরে ছাড়বে৷ এখন বাজে রাত নয়টা৷ আমরা ওখানে ভোরে পৌঁছে যাবো৷ জলদি আয়৷ 
-তুই কী যে করিস না, কিছুই বুঝি না৷ তা তোর মাথায় হঠাৎ এই পাগলামি চাপল কী করে?
-সব কথা পরে হবে৷ তুই জলদি চলে আয়৷

তখন আমরা একসাথে ভার্সিটি পড়তাম৷ আমার আর ওর বন্ধুত্ব খুবই চমৎকার ছিল৷ কীভাবে জানি আমরা একে অপরকে বুঝে যাই। কোথাও গেলে এক সাথে যাই৷ ঘুরাঘুরি করি এক সাথে। সেদিন আমরা বাসে করে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। সে তখনও আমাকে কিছু বলেনি। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায় কেবল৷ ভোরে বাস থামলে দু'জনেই এক সাথে নেমে যাই৷ তারপর আমাদের অনেক দূর হাঁটতে হয়৷ আমরা হাঁটি৷ ভোরের নীরব পরিবেশে হাঁটতে চমৎকার লাগে৷ আমি ভীষণ আনন্দ অনুভব করি৷ বন্ধুকে জিজ্ঞেস করি, 
-কই যাচ্ছি আমরা?
ও কিছুই বলে না৷ দ্রুত পাঁয়ে হেঁটে যায় কেবল৷ বেশ কিছু দূর হাটার পর হঠাৎই একটা ঘ্রাণ লাগে নাকে। আমি থমকে দাঁড়াই৷ আমার পাশে থাকা বন্ধুটিও দাঁড়িয়ে যায়। চোখ বুঁজে ভারী একটা শ্বাস নেয়৷ বলে,
-এই ঘ্রাণটা জান নিয়ে নিবে রে সাদিক। 
আমি কিছু বলি না। চুপ করে থাকি৷ ঘ্রাণটা আসলেই অসাধারণ। শান্ত ভোরে হঠাৎ এমন একটা ঘ্রাণ নাকে এলে কেমন প্রশান্তি অনুভব হয়৷ কেমন জানি ভালো লেগে যায়৷ 

আমরা এগিয়ে যাই৷ একটা পুকুরের কাছে এসে দাঁড়াই৷ পুকুরটার কাছে আসতেই ঘ্রাণটা তীব্র হয়৷ এখানকার বায়ুতে যেন ঘ্রাণটা ভীষণ মিশে আছে। যেন তাদের ভীষণ প্রেম৷ আমরা একটি গাছকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাই৷ গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াই৷ ঘ্রাণটা তখন মারাত্মক রকমের ঘোর ধরায় মনে৷ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কেমন অন্যরকম একটি ভালো লাগার অনুভূতি মন ছুঁয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকি৷ গাছ ভর্তি হলুদ-সাদা কাঠগোলাপ; প্রসন্ন মনে ফুটে আছে যেন। নির্দ্বিধায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে যেন প্রচণ্ড সুখে আছে সে৷ কিছু ফুল সবুজ ঘাস আলোকিত করে বসে আছে৷ কিছু পানির গায়ে পড়ে তাকে এক অনবদ্য রূপ দিয়েছে। আর চারদিকে এই ফুলের মুগ্ধকর ঘ্রাণ পরিবেশটাকে কেমন ঘোরময় করে তুলছে৷ অদ্ভুত, চরম অদ্ভুত এক সুন্দর জায়গা ছিল সেটি৷ অবিশ্বাস্যরকম সৌন্দর্য ছিল তার। তখনকার সেই সময়, সেই ঘ্রাণ, সেই হলুদ-সাদা কাঠগোলাপ আমার চোখের উপর এখনও ভাসে। চোখ বুঁজলেই আমি যেন এখনও তার ঘ্রাণটা পাই। আহ! কী চমৎকার এক দৃশ্য। সেখান থেকেই কাঠগোলাপের মায়া ধরে আমায়৷ ফুলটি এমন এক মায়া করে যে তার প্রেমে না পড়ে আসলে পারা যায় না। 

কাঠগোলাপ প্রিয় হবার বেশ কিছুদিন পর আমি ছাদের গাছটি লক্ষ্য করি৷ তখনই আমার মনে হয় এটি নিশ্চিত কাঠগোলাপ গাছ৷ আমি বন্ধুকে ফোন দেই৷ তাকে জানাই এখানেও কাঠগোলাপ গাছ আছে৷ বন্ধু দ্রুত চলে আসে আমার বাসায়৷ আমরা দু'জন তখন গাছটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করছিলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। গাছটিতে ফুল নেই৷ তাই তাকিয়ে থাকাটা কিছুটা অযৌক্তিক এবং অনর্থক। কেন তাকিয়ে ছিলাম কে জানে৷ ঠিক এমন সময় নীরা এসে হাজির হয়৷ আমাদের তার বাগানের কাছে দেখে ছুটে আসে,
-এই আপনারা এখানে কী করছেন?
আমি বলি,
-দেখছি৷ এটা কাঠগোলাপ গাছ না?
-হ্যাঁ, কাঠগোলাপ গাছ। 
-ফুল ধরবে কখন বলতে পারবেন?
-যখন সময় হবে তখন ধরবে৷ তা জেনে আপনার কী লাভ?
-লাভ বলতে আসলে আমাদের দু'জনের কাঠগোলাপ ভীষণ পছন্দের৷ মারাত্মক রকমের ভালোবাসি। 
-তা বাসুন৷ সমস্যা নেই। তবে আমার বাগান থেকে দূরে থাকবেন ভাই৷ কাছে ঘেঁষবেন না৷ 
আমার মাথায় আগুন ধরে যায় যেন৷ আশ্চর্য! মেয়েটা এভাবে কথা বলছে কেন? আমি অবাক স্বরে বলি,
-কাছে ঘেঁষলে সমস্যা কী? 
-সমস্যা কী মানে? অনেক সমস্যা৷ কাছে আসবেন না৷ ব্যস। 
পাশ থেকে আমার বন্ধু বলে উঠে,
-আচ্ছা, জ্বালাবো না৷ আপনার গাছে ফুল করলে আমাদের একটু জানাবেন৷ আমরা দেখতে আসবো কেবল।
নীরা রুক্ষস্বরে বলে, 
-আমার আর কাজ নেই৷ আপনাদের জানাতে যাবো। যদি আপনাদের বেশি পছন্দ হয়ে থাকে তবে নিজেরা গাছ লাগিয়ে নিন৷ তারপর সারাক্ষণ বসে বসে দেখবেন৷ কেউ কিছু বলবে না। তবে খবরদার আমার বাগানের কাছে ঘেঁষবেন না৷ তা না হলে খবর আছে বলে দিলাম।
কথাটা বলে নীরা ছাদের কার্ণিশের দিকে চলে যায়৷ তার কানে ইয়ারফোন। চেহারায় সেই রুক্ষতা৷ আশ্চর্য! এই পিচ্চি মেয়েটা এমন কেন? এতো এটিচিউড কিসের? এমন বিহেভ করে যেন সে অনার্স পাশ করে বিবাহের অপেক্ষায় থাকা এক তরুণী। অথচ সে ইন্টারে পড়তো তখন৷ 

আমি আর আমার বন্ধু কেবল অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছু সময়। কিছু বলিনি আর৷ নীরবে রুমে চলে আসি কেবল।

সেদিন থেকেই নীরাকে আমি যারপরনাই অপছন্দ করা শুরু করি৷ তার দিকে আর তাকিয়েও দেখিনা৷ তাকে দেখলেই যেন গা জ্বলে আমার। ইন্টার পড়ুয়া একটা মেয়ের এমন গা জ্বালানো কথাগুলো মেনে নেয়া আমার জন্যে কষ্টসাধ্য ছিল। তাই বাড়িওয়ালার কাছে অনুমতি চাইলাম একটা কাঠগোলাপ গাছ লাগানোর৷ ভদ্রলোক দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন৷ তার ছাদ এমনিতেই জঙ্গলের মতো হয়ে গিয়েছে। তিনি তা আর বাড়াতে চান না৷ তার কথা সত্য৷ ছাদে মোটামুটি ভালোই গাছ আছে। এক্ষেত্রে যে কেউই নিষেধ করবে৷ তা-ই স্বাভাবিক। আমি তা মেনে নিলাম। তবে নীরার প্রতি আমার রাগ ক্ষোভ তখনও যায়নি। আমি সম্পূর্ণরূপে তাকিয়ে এড়িয়ে গেলাম। এমন একটা ভাব করলাম যেন এই বাড়িতে নীরা বলতে যে কেউ আছে তা আমি জানিই না। এসব তার মাঝে কোনো প্রভাব ফেলতো বলে মনে হয়নি কখনও। 

এরপর হঠাৎই মেয়েটা কিছুদিনের জন্যে উধাও হয়ে যায়। কয়েকদিন দেখি না৷ আমি ভারী চিন্তা হলো। গোমড়া মুখটা নিয়ে নিত্য ছাদে আসা মেয়েটার হঠাৎ কী হলো? কী এমন জরুরি কাজ তাকে এই ছাদে আসা হতে বঞ্চিত করলো? আমি খোঁজ লাগাই৷ জানতে পারি মেয়েটি এক্সিডেন্ট করেছে৷ হাসপাতালে আছে এখন৷ এক্সিডেন্ট মোটামুটি রকমের হয়েছিল বলে জানতে পারি৷ আমার মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে যায়। বেচারা মেয়েটির জন্যে খানিক মায়া অনুভব হয়৷ মায়া হয় ছোট্ট বাগানটির জন্যে৷ তার শূন্যতায় ভুগতে থাকা সমস্ত ছাদটির জন্যে৷ কে হয় কে জানে! 

আমি তার অপূর্ণতার সুযোগ নেই৷ নিয়ম করে তার গাছে পানি দেই৷ কানে হেডফোন লাগিয়ে ছাদের কার্ণিশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি৷ ছোট ছোট যে বাচ্চা গুলো ছাদে আসে আমি তাদের নিয়ে বেশ মজা করি৷ দুষ্টামি করি। আমার ভালো লাগে৷ নিজেকে স্বাধীন মনে হয়৷ মনে হয় আজ এই ছাদটায় আমি নির্ভয়ে হাঁটতে পারবো৷ যা ইচ্ছে করতে পারবো! মুখ গোমড়া করে কেউ তাকিয়ে থাকবে না৷ বিরক্ত হবে না৷ চেঁচাবে না৷ নীরার অপূর্ণতা যেন আমাকে একটা খোলা আকাশ দিলো৷ প্রানবন্ত প্রাণ দিলো। এই যে আমি এই ক'দিন প্রত্যেক বিকেলে ছাদে হাঁটি, মেয়েটির বাগানে পানি দেই, ছোটদের সাথে দুষ্টামি করি, এইসবের কিছুই নীরা থাকতে করা যেত না৷ আমি কেন জানি তার উপস্থিতিতে ছাদে অস্বস্তিবোধ করতাম। মনটায় যেন কিছু একটা বিধে থাকতো৷ মেয়েটি যেন ছাদময় প্রবল বিরক্ত নিয়ে বসে থাকতো। 

সে যাই হোক, দুটো সপ্তাহ আমার বেশ ভালোই কেটে গেল। এক সকালে ভার্সিটির জন্যে বের হতেই লিফটের কাছে নীরার সাথে দেখা হয়ে যাই৷ আমি স্বভাবতই মাথা নিচু করে তাকে এড়িয়ে চলি৷ সেদিনও তাই করলাম৷ ব্যাপারটা যেন নীরা বুঝতে পারে৷ নিজ থেকেই বলে,
-কেমন আছেন? 
আমি তার দিকে তাকাই। মৃদু হাসি৷ বলি,
-এই তো! আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কী অবস্থা? 
-অবস্থা একটু ভালো৷ এক্সিডেন্ট যে করেছি সেটা তো জানেনই। এখন মোটামুটি ভালো আছি। 
-আচ্ছা৷ 
আমি আর কিছু বললাম না। নীরা নিজ থেকেই বলে,
-আপনার কাছে সরি চাওয়ার ছিল আসলে৷ 
আমি অবাক হই৷ মেয়েটা এক্সিডেন্ট করে বদলে গেল নাকি? তার কণ্ঠে এতো কোমলতা কেন? অবাক স্বরে বলি,
-সরি? সরি কেন?
-ওই যে সেদিন বাজে ব্যাবহার করলাম। আপনাদের মনে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। সেই শাস্তিই হয়তো আল্লাহ দিয়ে দিলো আমাকে৷ 
আমি বলি,
-ব্যাপার না! বাদ দিন ওসব৷ এক্সিডেন্ট হয়েছে এখন ঔষধ খান। ঠিক হয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ। 
লিফট থেমে যায় তখন। আমরা বেরিয়ে আসি৷ বলি,
-আমি গেলাম৷ পরে কথা হবে৷ 
নীরা কিছু বলে না৷ মৃদু হাসে৷ 

সেদিন বিকেলেই তার সাথে আমার দেখা হয় আবার৷ আমি তখন তার বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাগানের ছোট্ট লিকলিকে গাছটিতে কেবল দুটো কাঠগোলাপ ধরেছে। আমি সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ঠিক সে সময় নীরা এসে উপস্থিত হয়৷ সে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়৷ আমি তার উপস্থিত টের পেতেই বাগানের কাছ থেকে সরে আসি৷ বলি,
-সরি! আসলে ফুল গুলো দেখতে...
আমাকে থামিয়ে নীরা মাথা নিচু করে বলে,
-লজ্জা দিবেন না প্লীজ। আমি ওই দিনের ব্যাবহারের জন্যে খুবই লজ্জিত৷ আসলে আমি একা একা বড় হয়েছি৷ বন্ধুবান্ধবী তেমন নেই৷ আমি কারো সাথে মিশতে পছন্দ করি না৷ একা থাকতে ভালোবাসি৷ তা-ইই হয়তো আমার মাঝে রুক্ষতা চলে এসেছিল। যার ফলে বাজে ব্যাবহার করে ফেলি। প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দিবেন৷ বাসায় এসে যখন জানতে পারলাম, আমার অনুপস্থিতিতে আপনি আমার বাগানের খুব যত্ন করেছে তখন আসলে আমার লজ্জাবোধ আরো বেড়ে গিয়েছিলো। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাবার মতো অবস্থা! 
নীরা দ্রুত কথা গুলো বলে ফেলে। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আমি মৃদু হাসি৷ বলি,
-ইটস ওকে৷ নো প্রব্লেম। 
নীরা মাথা তুলে বলে,
-এখন থেকে আপনি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে গাছ দেখবেন, ফুল দেখবেন৷ প্রয়োজনে আপনার বন্ধুকে ডেকে এনে এক সাথে দেখবেন৷ আমি কিছু বলবো না। 
আমি হাসি দিয়ে বলি,
-আচ্ছা ঠিক আছে। 

এভাবে নীরার সাথে আমার পরিচয় হয়৷ ধীরে কথা বাড়ে। দুইয়ে মিয়ে আড্ডা হয় রোজ বিকেলে। দিনের আলোকে মেরে অন্ধকারকে আধিপত্য করে নিতে দেখি রোজ৷ কতো কতো কথা হয় তার আর আমার সাথে৷ তার কলেজের খুটিনাটি গল্প গুলোও বাদ পড়ে না৷ ততোদিন পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু আচমকা নীরার আমাকে প্রপোজ করে বসাটা দারুণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

আমি কখনই এই ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি। নীরা সর্বক্ষণই এক ছিল৷ তার ছোট বেলা কিংবা বর্তমান, আমি না আসার আগ পর্যন্ত সে ভীষণ একা ছিল। তাই হঠাৎ আমার মতো একটা বন্ধুকে পেয়ে যাওয়াতে তার ভাবনার দ্বার স্বাধীন হয়ে যায়৷ সেটা স্বাভাবিকও। সে আমাকে আপন করে নেয়৷ তারপর আমার সাথে একদম মিশে যায়৷ আমি তার সকল কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি৷ একজন কথক অবশ্যই একজন ভালো শ্রোতাকে পছন্দ করে। নীরাও তাই করে। আমাকে পছন্দ করতে থাকে৷ পছন্দ করতে করতে সে এক সময় উপলব্ধি করে সে আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছে৷ আমাকে ছাড়া এখন তার চলেই না৷ বিকেলের আড্ডাটা না হলে তার দমবন্ধ লাগে নাকি! নানান আবেগি কথা বলে নীরা তার প্রেম উপস্থাপন করে। অথচ সেই সময়ে তার প্রতি আমার সেই দৃষ্টি ছিল না৷ তাকে আমি একান্তই একজন ভালো বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবিনি৷ তারউপর তার বয়সটা ছিল আবেগী৷ ভুল পথে যাবার বয়স৷ এই সময়ে তার ভালো করে লেখাপড়া করা উচিৎ। যতো ভালো পড়াশোনা করতে পারবে তার ভবিষ্যৎ ততো সুন্দর হবে৷ আমি নীরাকে বোঝাই৷ অনেক বুঝিয়ে বলি, ইন্টারমিডিয়েট হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট৷ এখানে যে ভালো করবে সে-ই উন্নতি পাবে ভবিষ্যতে। আমি তাকে বোঝাই, এখন পড়াশোনার সময়৷ প্রেম ট্রেম করে সময় নষ্ট করার সময় নয়৷ মেয়েটা কী বুঝে তা আমি জানি না৷ সেদিন আর কোনো কথা না বলেই চলে যায়৷ পরবর্তী দিন গুলোতে আমি তাকে বিশেষ দেখেছি বলে মনে হয় না৷ একটা সময় একদমই দেখা হতো না৷ এরপর যা হতো কথা হতো না৷ নীরা এড়িয়ে যেত৷ আমিও কিছু বলতাম না৷ তাকে ডিস্টার্ব করতে চাইতাম না আসলে৷ সে তার মতো থাকুক৷

এভাবেই আমাদের দূরত্ব বেড়ে যায়৷ দূরত্ব বেড়ে গেলে একটা সম্পর্ক আর আগের মতো থাকে না৷ মরিচা ধরে যায়৷ সমস্তই খয়ে যায়৷ আমাদের বেলায়ও বিপরীত ঘটেনি৷ নীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবার পর তাকে কেবল অভিনন্দন জানানো ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগই পাইনি৷ সেই সে সুযোগ দেয়নি৷ এমনকি নিজ থেকেও জানায়নি সে সাফল্যের কথা। আমি নিজ থেকেই তাকে বললাম,
-নীরা ভালো আছো?
-আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি? 
-আমি ভালো আছি৷ তুমি ঢাবিতে চান্স পেয়েছো শুনে খুবই ভালো লেগেছিল। তোমার জন্যে অনেক অভিনন্দন এবং শুভ কামনা রইলো৷ 
নীরা মৃদু হেসে বলে,
-ধন্যবাদ৷ 
আমি মৃদু হাসলাম। কিছু বলতে যাবো ঠিক তার আগে সে বলে,
-আসি তাহলে। পরে কথা হবে৷ 
আমি হাসলাম। কিছু বলিনি আর। 

নীরার মাঝে একটা পরিবর্তন এসে যায়৷ যেটা স্বাভাবিক ভাবে সকলেরই আসে৷ তার ম্যাচিউরিটি বৃদ্ধি পায়৷ চিন্তা ভাবনা তীক্ষ্ণ হয়৷ আবেগ কমে আসে৷ সে জন্যেই সে এতো এড়িয়ে গেল। আজ যদি আমরা রিলেশনে থাকতাম এবং নীরা যদি এভাবে আমাকে এড়িয়ে যেতো তাহলে কী হতো? আমার ভালো লাগতো? লাগতো না৷ মূলত এই চেতনা থেকেই আমি তার প্রপোজাল একসেপ্ট করিনি৷ 
.
'টং' করে একটা শব্দ হলো৷ লিফট থামার শব্দ৷ আমি লিফট থেকে বেরিয়ে এলাম। মাথায় তখনও নীরার সেই বাড়াবাড়ি কিংবা অধিকার খাটাতে চাওয়ার ব্যাপারটা ঘুরছে। মেয়েটা আজ এমন করলো কেন? কেন এভাবে তাকালো? কী চায় সে? হঠাৎ এমন আচরণ কেন? আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে যাই৷ বাসার দরজা খুলে নিজের রুমে যাই৷ ড্রেস চেঞ্জ করি৷ ফ্রেশ হই৷ সবটাই যেন ঘোর নিয়ে করছি৷ মাথায় যেন লিফটে নীরার এমন আচরণ করাটা ঘুরছে৷ কারণ খুঁজছে৷ মেয়েটা এমন কেন করলো?
.
অনেকটা সময় পেরিয়া যায়৷ নীরা তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ আমি ব্যস্ত হই চাকরি খোঁজ নিয়ে৷ আমার তখন অনার্স শেষ৷ 

নীরার সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমে যায়৷ কথা হয়না বললেই চলে। কাঠগোলাপ গাছ একা আমি দেখি রোজ৷ কিংবা সে একা দেখে। দু'জনের একসাথে দেখা হয় না বহুদিন৷ সে তার মতো থাকে। আমি থাকি আমার মতো। আমার চাকরি হয়ে গেলে আমি সেখানে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ি৷ সকাল সকাল বেরিয়ে গেলে আসতে হয় সন্ধ্যার দিকে৷ সন্ধ্যার পর সময়টা কীভাবে যেন পেরিয়ে যায়৷ ক্লান্ত দেহ বিছানা অব্দি গেলেই চোখে ঘুম লাগে৷ পৃথিবীর কোনো খবর থাকে না আর৷ এভাবে চলছিল সব কিছু৷ 

তারপরই অফিসে চিত্রা আসে৷ চিত্রা এমন একটি মেয়ে যাকে যে কারোই প্রথম দেখায় প্রচণ্ডরকম ভালো লেগে যাবে৷ তার চোখ ভরা কাজলে যেন পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা বসে থাকে৷ সে গুছিয়ে শাড়ি পরতে জানে৷ কপালে কালো টিপ দেয়৷ তাকে জিন্স-টপসেও দারুণ লাগে৷ অফিসের এই মেয়েটির সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় দ্রুত৷ আমার একাকী সময়টুকু খুবই চমৎকার রকমে কাটতে শুরু করে৷ অফিসের বাইরেও চিত্রার সাথে আমার সাক্ষাৎ শুরু হয়। আমরা একে অপরের কাছে আসি৷ দু'জন দু'জনকে জানতে শুরু করি সবে৷ তার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে৷ অনুভূতিরা তীব্র হয়৷ তাকে নিয়ে প্রেম প্রেম অনুভূতি হয়৷ তার শূন্যতা ভীষণ ভোগায়৷ মনে কেউ যেন নেই! বুকের বাঁ পাশটা একদম খালি৷ তাকে না দেখলে যেন দম বন্ধ লাগে৷ পাগল পাগল লাগে৷ আমি একদিন তাকে কথা গুলো বলব বলে সিদ্ধান্ত নেই৷ গুছিয়ে নেই নিজেকে৷ অথচ সেই দিনটি আর আসে না। চিত্রাকে এমডি স্যারের ভালো লেগে যায়৷ তিনি তাকে নিজের পুত্রবধূ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন৷ সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিত্রার বিয়ে হয়ে যায়৷ অথচ এই ব্যাপারটায় চিত্রার কোনো দ্বিমত দেখিনি৷ তাকে ভীষণ আনন্দিত হতে দেখেছি। দেখেছি সে হঠাৎ কীভাবে আমাকে ভুলে যায়৷ চিনেও না চেনার ভান করে। কীভাবে গম্ভীর এবং অহংকারী হয়ে উঠে রাতারাতি। আমি হতাশ হই৷ ব্যাথা পাই৷ আমার চলন্ত জীবন যেন হঠাৎ থমকে যায়। ব্যাথা গ্রাস নেয় আমাকে। অন্ধকার যেন গিলে খায় আমাকে। রুমের বাতি নিভিয়ে কতো রাত একাকি নির্ঘুমে কাটিয়েছি তার অন্ত নেই৷ বিষাদ যেন সমস্ত হৃদয় মন্ডলকে আবৃত করে নেয়৷ আমাকে যেন কেমন ধূসর অন্ধকারে ঠেলে দেয়। সেই মূহুর্তে আমার পাগল বন্ধুটি কাছে আসে৷ আমাকে বোঝায়৷ নতুন করে চলতে শেখায়৷ আমাকে হাসানোর কী আপ্রাণ চেষ্টা করে সে৷ 

ধীরে ধীরে সমস্তই ঠিক হয়ে আসে৷ আমি আবার যেন নিজের স্বত্তায় ফিরে যাই৷ তবে পুরনো সেই জোশটা যেন আর খুঁজে পাইনা৷ ক্লান্তি অবসাদ যেন লেগেই থাকে৷ পুরনো সাদিককে যেন আর খুঁজে পাওয়াই যায়না৷ 
.
ডিনার শেষ করে বেরিয়ে এলাম। খোলা ছাদে খানিকটা হাঁটাহাঁটির লোভ বলা চলে। ছাদে আসতে দেখি নীরা দাঁড়িয়ে আছে৷ একদম পূর্বের মতো ছাদের কার্ণিশ ধরে। পার্থক্য কেবল আজ তার কানে ইয়ার ফোন নেই৷ সে বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাকে দেখে আমি অবাক হই। অনেক দিন তাকে এভাবে দেখি না৷ ঠিক সেই মূহুর্তে আবার চট করেই লিফটের কথাটা মনে পড়ে যায়৷ জানতে ইচ্ছে হয় সে কেন এমন করলো? অথচ তা বলার সাহসটুকু আমার নেই৷ আমি পেছন ফিরে চলে আসবো এমন সময় নীরা বেশ নরম স্বরে ডাক দেয়,
-এদিকে আসুন। 
আমি তার দিকে তাকাই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই৷ তার কণ্ঠে যেন প্রচণ্ড বেদনা-বিষাদ। আমি এগিয়ে যাই৷ আশ্চর্য! নীরা কি কাঁদছে? আমি গিয়ে বলি,
-কিছু বলবে?
নীরা চুপ করে থাকে। তার দৃষ্টি অন্য কোথাও। দূর অদূরে। যেখানে চোখের নয় মনের দৃষ্টি যায়৷ নীরা এতো গভীর ভাবে কী ভাবছে? আমি ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখি মেয়েটির চোখে জল৷ সেই জল অবলীলায় গাল বেয়ে যায়৷ আমি চট করেই বলি,
-নীরা তুমি কাঁদছো কেন?
নীরা মাথা নিচু করে নেয়৷ চোখের জল মুছে। নাক টানার শব্দ হয়৷ নীরা কেমন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
-আপনি কি কখনই আমাকে বুঝতে পারবে৷ না?
আমি চট করেই থেমে যাই৷ কী বলব ভেবে পাই না। নীরা বলতে থাকে,
-অতোটুকু বয়সে আপনাকে ভালো লেগে যায় জানেন? আমি তখন জানতামও না প্রেম কী! অনুভূতি কী! অথচ এই আপনি না থাকলে বুকের বাঁপাশে কী অদম্য এক বেদনা আমাকে গ্রাস করে নেয় সেটা কি জানতেন? জানতেন না৷ আমার না সহ্য করার ক্ষমতা ভীষণ ভালো৷ আমি কখনই বাড়তি কিছু প্রকাশ করতে পারতাম না৷ সে জন্যে আপনি আমার অনুভূতি গুচ্ছকে অবহেলা করে ফিরিয়ে দিলেও আমি কিছুই বলতে পারিনি। করতে পারিনি৷ কেবল সয়ে গেলাম। যেই আপনাকে না দেখলে বুকের ভেতর হাসফাস করে, দমবন্ধ লাগে, পাগলের মতো ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়, সেই অাপনাকে আমি কয়েক সপ্তাহ না দেখে কাটিয়ে দিলাম। বুকের সব ব্যাথা বেদনাকে গিলে নিয়ে আমি দিব্যি বেঁচে থাকি৷ বেঁচে থাকাটা হয় মৃত্যুর মতো। পাথুরে টাইপ। সাদিক, আপনি জানেন না, আপনাকে আমি কী পরিমাণ ভালোবাসি৷ কতো বেশি চাই৷ আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষা আমাকে কী তীব্র ভাবে পাগল করে তুলে৷ আপনার ভরাট কণ্ঠ আমার হৃদয়ে কী পরিমাণ ঝড় তোলে। অথচ সেই সব আপনি আবেগ বলে উড়িয়ে দিলেন৷ জানেন, ব্যাপারটা একটুও সহ্য হয়নি আমার৷ এতো এতো রাগ হলো যে ইচ্ছে হলো আপনাকে খুন করে ফেলি৷ আপনি কেন আমার অনুভূতিকে বুঝতে পারলেন না? আমি ভাবলাম দূরে চলে যাই৷ আপনাকে বুঝিয়ে লাভ নেই৷ বুঝবেন না৷ আমার দূরে যাওয়া হয়নি৷ বাড়িতেই থেকে যাই৷ আপনাকে দেখলেই এড়িয়ে যাই৷ আড়াল হই। আবার পেছন ফিরে দেখি৷ লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার চলে যাওয়া দেখি। আপনার একবারও মনে হয়নি কেউ আপনাকে দেখছে৷ আমি ব্যর্থ হই৷ হাল ছেড়ে দেই৷ সাদিক আমার হবে না। কক্ষনোই না৷ কিন্তু যখন আপনাকে একটা মেয়ের সাথে রিক্সায় দেখলাম, আপনাদের দু'জনকে হাসাহাসি করতে দেখলাম, বিশ্বাস করবেন না গা'টা একদম জ্বলে গেল। আমার সরল দুনিয়াটা যেন উল্টে গেল। হঠাৎই কেমন বিচ্ছিরি এক অনুভূতি হলো৷ ইচ্ছে হলো ওই মেয়েটাকে গিয়ে কয়েকটা দেই। খুন করে ফেলি। আপনি বিশ্বাস করবেন না, আমি তখন পাগল মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল৷ আমার বারবার মনে হতে থাকলো আমার বুকটা খালি হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরে সব শূণ্যতা৷ বেদনা। মনটা কেমন কেঁদে উঠে আমার। বান্ধুবি রিক্সায় করে বাসায় নিয়ে আসে৷ আমি সারাটা পথ মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি৷ সেই কান্না বাসায় এলেও থামেনি৷ দু'দিনেও না। এরপর থেকেই আমি কেমন জানি হয়ে যাই৷ পাগলের মতো আচরণ করি৷ খাবারটাও যেন ঠিক ভাবে গিলতে পারি না৷ কী এক অসহ্য যন্ত্রণা! আমি বুঝবেন না এসব৷ ইদানীং আপনার ফ্যাকাসে চেহারা, বিষাদ বেদনায় ক্লান্ত চোখ আমাকে আরো বেশি উদ্বেলিত করে তোলে। আমি যেন ঠিক টের পেয়ে যাই, কিছু একটা ঠিক নেই৷ মানুষটা ভালো নেই৷ তার কিছু হয়েছে৷ কিছু একটা হয়েছে৷ জানেন, আমার আপনার কাছে খুব আসতে ইচ্ছে করে৷ আপনার কষ্ট গুলোকে ভাগাভাগি করতে মন চায়৷ অথচ আমি সাহস পাই না৷ এই ছাদে এলেই আমার বুকের কাঁপনটা বেড়ে যায়৷ শূন্যতার অনুভূতি আমাকে উন্মাদ করে তোলে। আপনি এখন তার কিছুটা আঁচ করতে পারবেন৷ কারণ কেউ তো আপনাকেও শূন্য করে চলে গিয়েছে তাই না৷ সেখান থেকে অন্তত আমার কথাটা একটু ভাবুন৷ একটু বুঝুন৷ একটু আঁচ করার চেষ্টা করুন, এতো বছর একটা প্রেম বুকে লালনপালন করে আমি কী তীব্র বেদনায় আছি?
মেয়েটা থেমে যায় চট করে৷ আমার দিকে কেমন ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ আমি চুপ করে থাকি কিছু সময়৷ কিছু বলতে পারি না যেন৷ গলা বেয়ে ভারী দীর্ঘশ্বাস আসে কেবল৷ হঠাৎ অনুভব হয় চোখ জোড়া ঘোলা হয়ে আসছে। আমি চোখ মুছে নেই৷ বলি,
-নীরা, আমি ভীষণ টের পাই৷ ব্যথা-শূন্যতা কী তা আমি ভীষণ টের পাই৷ 
নীরা চুপ করে থাকে৷ আমিও চুপ করে থাকি কিছু ক্ষন৷ এরপর বলি,
-আমি তোমাকে বুঝতে পারিনি৷ আর ওই মেয়েটি আমাকে বুঝতে পারেনি৷ 
নীরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলি,
-এভাবে তাকিয়ো না নীরা৷ অপরাধবোধ হয়৷ 
নীরা চট করেই বলে উঠে, 
-আমার তো তা চাই না৷ আমি মুক্তি চাই৷ আপনি আমাকে মুক্তি দিন৷ 
আমি অবাক স্বরে বলি,
-মুক্তির ক্ষমতা আমার কাছে নেই। দিবো কী করে?
-আপনি ভাবুন৷ এটা কেবল আপনিই পারবেন।
-কেন এই ভাঙ্গাচূরা মানুষটাকে চাইছো যে তোমাকে সারাবেলা কষ্টই দিয়ে গেল?
-কারণ ভাঙ্গাচুরা মানুষটা ছাড়া আমি সুখ কই পাবো বলেন? কে দিবে আমাকে এতো প্রশান্তি যতোটা তার মাঝে মেলে। 
-প্রশান্তি পেয়েছো কখনও?
-এই যে তাকিয়ে থাকি, কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখাচোখি হয়, এটাও আমার জন্যে অনেক কিছু৷ অনেক অনেক কিছু৷ অদ্ভুত প্রশান্তি মেলে। 
আমি কী বলব ভেবে পাই না৷ নিরিহ দিশাহীন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসে। বলে,
-আপনি অনেক ভুগেছেন৷ আপনাকে এভাবে ভুগতে দেখলে আমি এমনিতেই মারা যাবো৷ 
আমি কেবল শুনে যাই। চুপ করে থাকি৷ মেয়েটি বলে,
-আমাকে একটু সুযোগ দিন৷ আমি আপনাকে গড়ে দিবো৷ ভাঙ্গাচুরা মানুষটাকে সাজিয়ে নিবো৷ 
মেয়েটা থামে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল৷ এক সময় আনমনে বলি,
-একটা মানুষ কীভাবে একজনকে এতোটা চাইতে পারে নীরা?
সে কিছু বলে না৷ কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আমি তার চোখ দেখি৷ তার চোখ ভর্তি তীব্র প্রেম আমি খুব অনুভব করি। আমার মনে হলো এখন আর দেরি করা ঠিক হবে না৷ দেরি করলে খুব অন্যায় হবে৷ খুব অন্যায়। আমি তার দিকে একটু এগিয়ে যাই৷ চোখের জল মুছে দেই৷ বলি,
-অনেক কান্না হলো৷ চলো নীরা, এবার একটু হাসি৷ 
মেয়েটা চট করেই তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো৷ চোখ বেয়ে অঝরে পানি পড়তে লাগল৷ সে কান্না করতে করতে আমায় জড়িয়ে ধরলো৷ মূহুর্তে তার কান্নার বেগ তীব্র হলো। গা কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো সে৷ আমি কিছু বললাম না আর। তার কাঁধের কাছে মুখ গুঁজে রাখলাম৷ মেয়েটা কাঁদুক৷ কাঁদলে বুকটা খানিক হালকা হবে৷ এই সময়ে তার এটির বেশ প্রয়োজন৷
.
গল্পঃ পতিত মেঘদল। 
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url