ভালোবাসার পরিনতি (১ম পর্ব)

বাংলা গল্প| Love Stories Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo


ভালোবাসার পরিনতি

(১ম পর্ব)

তাসফি আহমেদ

.
মহি রুপার হাত ধরে পার্টি সেন্টার থেকে বের হল।দুজনেই চেহারায় বিষন্নতা।রাস্তা
র সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিএনজি এর জন্যে। দুজনেরই মন খারাপ। কেউ কোন কথা বলছে না।সব কিছুর জন্যে মহি নিজেকে দোষারোপ করছে।নিজের উপরই ঘৃনা হচ্ছে।সিএনজিতে বসেও কেউ কারো সাথে কথা বলল না।একঝাক বিষন্নতা নেমে এল তাদের মাঝে।
.
গরিব আর অভাব, এরা একে অপরের সাথে আড়াআড়ি ভাবে যুক্ত।একে অপরের পরিপূরক। একটা ভালো বন্ধন কাজ করে এদের মাঝে।খুব শক্ত বন্ধন।এরা একে অপরকে কখনই ছেড়ে যায় না।আঠার মত লেগেই থাকে।যেন সে গরিব হল কেন? এটাই তার দোষ এবং শাস্তি স্বরূপ তাকে দেওয়া হয়েছে এক ঝাক অভাব।এটা তাকে মেনে নিতেই হবে।অমান্য করার অধিকার কিংবা ক্ষমতা তার নেই।এমনই এক অভাবে লেগে থাকা পরিবারে জন্ম রুপার। ঘরে যেন এক ঝাক আলো নিয়ে এল মেয়েটা।সে সুকেশিনী ও সুহাসিনী। ওর হাসির ঝলকটা শুধু দুই ঠোটের মাঝে সিমাবদ্ধ থাকে না।পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ, মুখ,নাক সর্বোপরি পুরো মুখটাই যেন হাসে।পড়ালেখায় একেবারে প্রথম কাতারে।কাউকে আকৃষ্ট করার মত দুটি চোখ আছে মেয়েটার।এবার উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে।দিন কয়েক পর এইচ এস সি দিবে।বাহ্যিক দিক থেকে মেয়েটা যতটা সুন্দর ভিতরের দিকটা ঠিক ততটাই কোমল।মেয়েটা মাঝে মাঝে ভাবে,কেন সে গরিবের ঘরে জন্মাল।কেন সে অভাবে জর্জরিত পরিবারে জন্মাল।এই একটাই দোষ। যার কারনে কোন বড় লোকের ছেলে ওকে বিয়ে করবে না।ওর খুব ইচ্ছে একজন বড়লোক বাড়ির বউ হবে।পায়ের উপর পাঁ তুলে খাবে।গোটা কয়েক কাজের লোক থাকবে। ওদের উপর ও জোর খাটাবে। বসে বসে আদেশ দিবে।এটা কর! ওটা কর! আরো কত কি?
পশ্চিম পাশের জানালা দিয়ে রক্তাক্ত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে এ কথা গুলোই ভাবে রুপা।অবসর সময় পেলেই নিজের ভাবনায় এগুলোও একটু যোগ করে। কিন্তু ভাবার সময় মেয়েটার মনে থাকে না যে ওরা গরিব! এত বড় স্বপ্ন গরিবদের দেখতে নেই।এটা যেন তাদের মাঝে শোভা পায় না।তবুও রুপা স্বপ্ন দেখে।বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।এমন জর্জরিত, অভাবগ্রস্ত পরিবারটাকে সমাজে উচ্চবিত্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে রুপা।সেই স্বপ্নের পথ ধরেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায় সে।নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে। নিজের পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে।
.
ছেলেটার নাম মহি। সবে মাস্টার্স পাশ করা এক টগবগে যুবক।চাকরি খুঁজছে তন্নতন্ন করে।ছোট ভাই টা সবে অনার্স প্রথম বর্ষে। ছোট বোনটা এবার এসএসিসি দিবে।বড় বোনটা শশুড় বাড়ি সাজাতে ব্যাস্ত। এক বৃষ্টিস্নাত দিনে ছেলেটা চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে বেরিয়েছে মাত্র।ঠিক তখনই পকেটে থাকা মোবাইলটা ঝাঁঝালো রিংটোন দিয়ে বেজে উঠে। বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে।মোবাইল কানে দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল ছোট বোন মিতুর কান্না।মেয়েটা কান্নার জন্যে ঠিক মত বলতেও পারছে না কি হয়েছে।মহি কিছু একটা আঁচ করতে পেল। খুব খারাপ কিছু হয়েছে।খুব খারাপ! যা শুনার জন্যে ও এখনও প্রস্তুত না।যখনই ওর বোন ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,
"ভাইয়া...ভাইয়ারে বাবা আর কথা বলে নারে।একটু চোখ তুলে আমাকে দেখে না রে ভাইয়া। ভাইয়ারে সবাই বলে বাবা নাকি আর নেই।বাবা নাকি আর কথা বলবে নারে ভাইয়া।"
শুধু এতটুকুই কানে যায় মহির।আর যেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না।মস্তিষ্কের নিউরন গুলো কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছে।আর এক পাঁ সামনে এগুচ্ছে না।হাঁটার জন্যে বিন্দু মাত্র শক্তিও নেই।যেন সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া এক নবজাতক। যেন কিনা এখনও হাঁটতে শিখেনি। ইন্টার্ভিউ অফিসের ফ্লোরেই বসে পড়ল মহি।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে কান্না করছে।নানা চিন্তা মাথায় উঁকি দিচ্ছে।কষ্টগুলো যেন চারদিক থেকে জড়িয়ে ধরছে।কি করবে ও এখন।কি খাওয়াবে ওর পরিবারকে।ওর বাবা ছিলেন একজন সরকারি অফিসের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী। অনেক কষ্টে চালাত নিজের সংসারটা। তখন তো কোন ভাবে চলত।কিন্তু এখন কি হবে।এখন কিভবে চলবে ওরা?
এর বেশ কিছুদিন পর একটা চিঠি আসে।চিঠিটা দেখা মাত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহির মুখটা। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল।বেতন যদিও কম।তবুও এটাই এখন সোনার হরিন।নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো।
.
সংসারটাকে সবে মাত্র গুঁছিয়েছে মহি।নিজের মত করে চালাচ্ছে ও।ওর বাবা কিছু টাকা পেয়েছে অফিস থেকে।সেগুলো ব্যাংকে জমা রেখেছে।প্রয়োজনে কাজে লাগাবে।এখন ছোট বোনটা টাকা চায় মহির কাছ থেকে।ছোট ভাইটা ডেইলি না চাইলেও মাঝে মাঝে চায়।টিউশনি করিয়ে এত টাকা পায় না।আবার অনেকে ঠিক মত টাকাও দেয় না।তাই বড় ভাই মহির কাছে চায়।বোনের এসএসিসি পরিক্ষার রেজিস্টেশনের জন্যে বেশ কিছু টাকা লাগবে। কিন্তু এই মূহুর্তে এত টাকা নেই মহির কাছে।অনেক ভেবে ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তোলে। একটু বাড়িয়ে তোলে।ঘরের জন্যে বেশ কিছু ভালো বাজার করে।অনেক দিন ভালো মন্দ খাওয়া হয় না ওদের।তাই ভাবল," আজ কিছু নিয়ে যাই।ভালো মন্দ কিছু খাই।"
.
এর দুই বছর পর মহির মা হঠাৎ পাগলপারা হয়ে যায় মহিকে বিয়ে করানোর জন্যে।কিন্তু এখন কিভাবে বিয়ে করবে ও।এখন কি বিয়ে করার সময়? সবে সংসারটাকে নিজের মত গুঁছিয়ে নিয়েছে। সংসারের এত জন মানুষের ভার টানতে কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায় সেখানে আরেক জন নতুন মানুষ এলে কতটা কষ্ট হবে সেটা অনুমান করতেই কেমন যেন লাগে মহির।নিজের ঘরের বারান্দায় বসে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে মহি।রুমের লাইট বন্ধ।পুরো ঘরটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে।বাইরে খুব অন্ধকার।ঘন কালো,ঘোর লাগানো অন্ধকার।মহি সেদিকে তাকিয়ে আছে।
ঘভির ভাবনায় ডুব দিয়েছে।যেন সে এক জায়গায় বসে আছে,আর ওর ঠিক চারপাশে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভাবনা গুলো গুরুপাক খাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর পর এক একটা ভাবনা এসে ওর সামনে দাঁড়াচ্ছে আর ও সেটা ভাবছে।হঠাৎ-ই ওর গায়ে কারো হাতের স্পর্শ লাগল।ও একটু লাপ দিয়ে উঠল।ভাবতে ভাবতে একেবারে ঘোরের ভিতর চলে গেছে।পিছনে তাকাল।দেখল ওর মা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।নিজের রুমের দিকে তাকাতেই দেখল লাইট জ্বলছে।ও সেদিকে তাকিয়ে ভাবল,"নিশ্চই মা জ্বালিয়েছে।মা যে কখন এল টেরই পেলাম না।বাপ রে! এ কেমন ভাবনা। নিজেকে একেবারে ডুবিয়ে ফেলে।কোথায় যেন হারিয়ে যাই।কি অদ্ভুত! এমন তো আগে হয় নি।অবশ্য এখন নিজের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে।কত কিছু নিয়ে ভাবতে হয়! তার উপর ওই বিয়ের চাপ।ওফ্! আর কত চাপ যে নিতে হবে? হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে নিজের চোখ দুটো কচলিয়ে ওর মা কে বলল,
:কিছু বলবে মা?
ওর মা এমন ভাব করল যেন ওর কথা উনার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি।তিনি ওর কাঁদে হাত রেখে বললেন,
:কি রে খোকা! এমন অন্ধকারের মাঝে ডুব দিয়ে বসে রইলি যে? তোকে এমন অবস্থায় তো আগে দেখি নি?
:সে কিছু না মা! একা একা তো! তাই সব কিছু অন্ধকার করে বসে রইলাম।খারাপ না! ভালোই লাগছিল!
:তোর উপর খুব চাপ পড়ে তাই না?
:মা! কি যে বল না? এক সময় তোমরা আমার জন্যে করেছ।আজ আমি তোমাদের জন্যে করছি। এখানে চাপের কিছু নেই। এটা আমার দায়িত্ব। এটা আমার কর্তব্য মা!
:সে তো জানি রে খোকা! তবে এই বয়সে এত চাপ নেওয়া তো আর যেমন তেমন ব্যাপার না। আমি তো তোর বাবা কে দেখেছি।আমি জানি রে খোকা,সংসার চালানো যে কতটা কষ্টের সে আর আমার আজানা নেই।
ও ওর কাঁদ থেকে মায়ের হাতটা সরিয়ে নিজের দুহাতের মাঝে রেখে বলল,
:প্রমোশনটা হয়ে গেলে আর তোমার কষ্ট করতে হবে না মা! তখন দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।তুমি শুধু দোয়া কর মা।
:সে তো করবই।আচ্ছা তুই থাক! আমি গেলাম।আর শুন! রাত জাগিস না।পরে অসুখ করবে।তাড়াতাড়ি শুয়ে যাস।
:আচ্ছা মা।
ওর মা ধির পায়ে চলে যেতে লাগলেন।মহি সেদিকে তাকিয়ে আছে।ভাবছে,"মা হয়ত অন্য কোন কথা বলতে এসেছে।নিশ্চই বিয়ের ব্যাপার নিয়ে। আমার এ অবস্থা দেখে হয়ত বলেন নি।"ওর মা দরজা পর্যন্ত যেতেই ও দেখল মায়ের কাপড়ের এক পাশ তেলাপোকা খানিকটা কেটে ফেলেছে।কাপড়টাও অনেক পুরোন হয়ে গেছে।ও কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর নিজে নিজেই বলে উঠল,
:এবার বেতন পাওয়ার পর মায়ের জন্যে একটা কাপড় কিনতে হবে।উনার কাপড় গুলোর যে কি অবস্থা?
এই বলে ও উঠে দাঁড়াল।ভাবনার ঘোরে আর ডুব দিতে চায় না। হারিয়ে যেতে চায় ঘুমের রাজ্যে।সেখানে ভাবনা গুলো এসে ভিড় জমায়।আচ্ছা এরা কি মানুষের পিছু ছাড়ে না?নাকি আজিবন লেগেই থাকে।আচ্ছা এদের কি কোন ভাবেই দূর করা যায় না?
.
রুপা ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদে।একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে।ভবে,কি হল এটা।এভাবে বুঝি ভেংগে যায় গরিব মেয়ে গুলোর সকল স্বপ্ন। সকল ইচ্ছে বুঝি এই ভাবে চুরমার হয়ে যায়।
এর বেশ কিছুদিন পর হুট করেই রূপার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়।রুপার খুব ইচ্ছে হল,
একটু প্রতিবাদ করি।একটু বুঝিয়ে বলি।কিন্তু কোথাও যেন একটু বাধা পায় রুপা।বলতে পারে না।বাবা মায়ের সিদ্ধান্তকে মুখ বুঁজে মেনে নেয় রুপা।মুখ চেপে সহ্য করে যায়।ওর বাবা মা তো ওর ভালোই চায়।আর এলাকার ছেলে গুলো যে হারে ডিষ্টার্ব শুরু করেছে তাতে কোন সময় কি হয়ে যায়।এর থেকে বরং এখন বিয়েটা করে ফেলাই ভালো।যা যুগ পড়েছে! এই বলে রুপা নিজেকে শান্তনা দেয়।মেনে নেয় সবকিছু। শান্তনা দিলেও যেন মন মানতে চায় না।প্রতিবাদ করার তীব্র ইচ্ছা জাগে।প্রতিবাদ করতে মায়ের ঘরের সামনে যায়।দরজা অব্ধি যেতেই আবার ফিরে আসে।কোন মতেই নিজের মাঝে সাহস জোগাতে পারে না।সামনে গেলেই সব যেন গুলিয়ে যায়।
.
রুপার মন খারাপ ছিল।ভীষন মন খারাপ ছিল ! মুখটা কালো করে রেখেছিল সারাক্ষণ।তারপর যখনই মহিকে দেখল তখনই সব কষ্ট, গ্লানি,ক্লান্তি,বিষন্নতা যেন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল।একরাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেল রুপার মন।ঠিক এমনই একজন পুরুষ চেয়েছিল রুপা।যাকে রুপা সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসবে।রুপা আশ্চর্য হয়ে মহিকে দেখছিল।ঠিক যতটা আশ্চর্য রুপা হয়েছে মহি যেন তার দ্বিগুণ আশ্চর্য হয়েছে।নির্বাক হয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে।এত সুন্দর মানুষ হয়? আশ্চর্য! মহি এত সুন্দর মেয়ে কখনই দেখে নি।নিশ্চই স্বপ্ন দেখছে! মহি দুচোখ বেশ কয়েকবার কচলিয়ে নিল।না! ও স্বপ্ন দেখছে না।এ যেন নির্জর বাস্তব।আহঃ খোদার সেকি কৃপা! মেয়েটা একদম মহির মন মত হয়েছে।
.
রুপা মিটমিট করে চোখ খুলল। পুরো রুমটা বেশ গোছানো। সব যেন পিটপাট।একেবারে রুপার মন মত।একটু নড়তে যাবে তখনই রুপা অনুভব করল কেউ একজন ওকে জড়িয়ে ধরে আছে।রুপা ঠিকই বুঝতে পেল কে সে।রুপা নড়ল না আর।চুপচাপ শুয়ে রইল।ভীষন ভালো লাগছে ওর।অদ্ভুত সে অনুভুতি! যেন রুপাকে ভালোবাসায় ঘিরে আছে।ভালোবাসার আবেশ জড়িয়ে ধরেছে রুপাকে।ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে ঠক ঠক আওয়াজ এল।
:ভাবি! অ্যাই ভাবি উঠ।অনেক হয়েছে।উঠ এবার!
রুপা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠটা আবার ভেসে এল।বলল,
:অনেক বেলা হয়েছে ভাবি।উঠ!
রুপা একটু নড়ে উঠল।নড়তেই মহিও নড়ে উঠল।চোখ মেলে দেখল রুপা কে।ঘুম ভেঙে এমন মায়া ময় চাহনি দেখে মুগ্ধ হয় মহি। তখনই দেখল ও রুপাকে জড়িয়ে ধরে আছে।আর রুপা গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সেই চোখে একঝাক লজ্জা খেলা করছে।যে ভাবে শরৎ-এর আকাশে সাদা মেঘ উড়ে বেড়ায় ঠিক সেভাবেই রুপার চোখে লজ্জা উড়ে বেড়াচ্ছে।মহি তা দেখতে পাচ্ছে।ভীষন সুন্দর লাগছে রুপাকে।ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠটা আবার ভেসে এল।
:অ্যাই ভাইয়া উঠ।মা ডাকছে।
মহি হুট করেই রুপাকে ছেড়ে দিল।উঠে বসল বিছানায়। রুপা আরেকটু বেশি লজ্জা পেল।মহির এমন কান্ড দেখে ঠোটের কোন মৃদু হাসি ঠাই পেল।রুপা উঠে গেল।দরজা খুলল।দেখল মিতুর বিরক্তেভরা চাঁদবদন। দরজা খুলতেই মিতু ঘরে ঢুকে গেল।বলল
:বিয়ের প্রথম দিনেই এই অবস্থা। সামনের দিন গুলোতে যে কি হবে সেটা খোদাই মালুম।কিরে ভাইয়া কোথায় ছিলিরে এতক্ষনে! কোথায় জমে ছিলি!
এই বলে মিতু মুখ টিপে হাসল।রুপা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল।সেও কিছুটা হাসছে।মহির যেন লজ্জার সীমা নেই।সে তোয়ালে নিয়ে মিতুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল
:বড্ড পেঁকে গেছিস না।দাঁড়া! তোরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে।তখন বুঝবি।কোথায় জমে ছিলাম।
:এত সহজে তোদের ছেড়ে যাব না।একেবারে জ্বালিয়ে পুড়ে তবে যাব।বুঝলি?
:দেখা যাবে।
এই বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল মহি।মিতু রুপার দিকে তাকিয়ে দেখল সেও লজ্জা পেয়েছে।একটু হেসে মিতু বলল,
:হয়েছে! আর লজ্জা পেতে হবে না।খেত চল ভাবি।মা ডাকছে।
রুপা আস্তে আস্তে মিতুর সাথে যেতে লাগল।
.
রুপা অনেকটাই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।কেননা সেও এসেছে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে।এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান আছে রুপার।অল্প কিছুদিনেই রুপা মহিদের পরিবারের বিশেষ কেউ হয়ে উঠল। রুপা এখন ঠিক আগের মত নেই।এখন সংসারি হয়েছে মেয়েটা।এত বেশি কাজও নেই এখানে।সপ্তাহে প্রায় দিনই আলুর বক্তা আর ডাল খেতে হয়।এটা রান্না করতে এতটা কষ্ট পেতে হয় না।বিভিন্ন তরকারিও রান্না হয়ে মাঝে মাঝে।বিশেষ করে মাসের প্রথম দিকে একটু ভালোমন্দ খাওয়া যায়।মাসের শেষের দিকে কষ্টটা অনেকটাই বেড়ে যায়।রুপা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে।নামাজ পড়ে।মহিকেও উঠায়।মহি নামাজ পড়ে আর ঘরে আসে না।অনেকক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে।সকালের মায়া ভরা শান্তি মাখা বাতাসে আবেশিত হয় মহি।এ এক ঐশ্বরিক শান্তি। সকালের এমন পরিবেশ খুব পছন্দ মহির।ওর খুব ইচ্ছে রুপা সাথে নিয়ে কিছুটা পথ হাঁটবে।কিছু কথা বলবে রুপার সাথে।রুপা সেগুলো শুনে মুগ্ধ হবে।মৃদু স্বরে হাসবে।মহি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওকে দেখবে।কিন্তু এমনটা হয় না।মহি কখনই রুপাকে বলতে পারে না।মহি জানে রুপাকে বললেও সে আসবে না।এখন অনেক গুলো কাজ করতে হবে ওকে।শীতের মাঝে অনেক গুলো থালাবাসন ধুয়ে রাখতে হবে ওকে।সবার জন্যে নাস্তা তৈরি করতে হবে।মহি কথা গুলো ভেবে কষ্ট পায়। মেয়েটাকে এমন আহামরি কিছু দিতে পারে নি ও।না পেরেছে শান্তি দিতে, না পেরেছে গহনা অলংকার। ভিষন মন খারাপ হয় মহির।খুব রাগ হয় ওর অফিসের লোক গুলোর প্রতি।এত দিনে ওর প্রমোশন হয়ে যাবার কথা।একজনের সাইন এখনও বাকি। সে সাইন দিলেই এতদিন প্রমোশনটা হয়ে যেত।কিন্তু সে দিচ্ছে না।তাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে,
:সময় হলে পেয়ে যাবেন।
আসলে ব্যাপারটা সময়ের না।ব্যাপারটা হচ্ছে টাকার।তাকে কিছু টাকা দিয়ে দিলে এতদিনে কাজটা হয়ে যেত।কিন্তু টাকাটা পাবে কই।যেখানে নিজেরা খেয়ে পরে বাঁচতে কষ্ট হয় সেখানে তাকে টাকাটা দেয় কিভাবে? মহি মন খারাপ করে বসে থাকে। ভীষন মন খারাপ হয় ওর।তীব্র নিন্দা হয় লোক গুলোর প্রতি।এরা কি মানুষ? নাকি মানুষ রূপি জানোয়ার।গরিব মানুষ গুলোকে ছুসে খায় এরা।আল্লাহ এদের কখনই মাপ করবে না।কখনই না।মহি বসে থাকে।মনে মনে স্থির করে আজ অফিস যাবে না।একদিন না গেলে কি হয়।বস বকবে।বকুক না।একদিন বকা খেলে কিছুই হয় না।আজ মন খারাপের দিন।মন খারাপের দিনে অফিস যেতে ইচ্ছে হয় না ওর।
.
রুপা নাস্তা বানিয়ে বসে থাকে। একটু চিন্তা করছে।মানুষটা সে কখন বের হল এখনও এল না কেন? এদিকে অফিসের সময়ও হয়ে যাচ্ছে।সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।সবার নাস্তা খাওয়া শেষ।সবাই যে যার গন্তব্যে চলে গেছে।বাসায় রুপা আর ওর শাশুড়ি আছে কেবল। রুপা চিন্তিত হয়ে বসে আছে।ঠিক নয়টা পঞ্চাশে মহি আসল।দেখল রুপা খাবার টেবিলে বসে আছে।মুখটায় শুকনো লাগছে।মহি এগিয়ে গিয়ে বলল,
:কি ব্যাপার! এভাবে বসে আছ যে?
মহির কথায় রুপা একটু নড়ে উঠল।বলল,
:কি ব্যাপার! এতক্ষণ কোথায় ছিলে । সেকখন থেকে তোমার জন্যে বসে আছি।অফিস যাবে না?
রুপার এমন কান্ড দেখে ভিষন ভালো লাগল মহির।এতক্ষণ যে মন খারাপ ছিল তা কেটে গেছে।বলল,
:বাইরে ছিলাম।একটু হাঁটাহাটি করছিলাম আরকি!তুমি নাস্তা কর নি?
:না!তোমার সাথে করব বলে বসে আছি।তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।অফিসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
:কই।দাও!তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও।
.
রুপা মহির টাইটা শক্ত করে বেধে দিল।মহির দিকে তাকাতেই দেখল সে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।বলল,
:এভাবে তাকিয়ে আছ যে?কি দেখছ এমন।
:তোমাক দেখছি ।তোমাকে যতই দেখি ততই তোমার প্রেমে পড়ে যাই।কি অদ্ভুত মায়া খেলা করে তোমার মাঝে।যা আমাকে তোমার প্রতি আকৃষ্ট করে। আচ্ছা! তুমি এত সুন্দর কেন?
রুপা কিছুটা লজ্জা পেল।মৃদু হাসল।বলল,
:হয়েছে।আর বলতে হবে না।অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।যাও।
মহি রুপার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ! রুপার কপালে আলত মায়ায় ভালোবাসার পরশ দিল।বলল,
:সাবধানে থেক।আমি গেলাম।
মহি চলে যায়।রুপা ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।সারা সকালের সকল কষ্ট যেন এক নিমিশেই শেষ হয়ে গেল।মানুষটা যাদু জানে নিশ্চই। কেবল একটা কথা বলল "সাবধানে থেক "এ কথাটার মাঝে এমন কি আছে যে রুপার এত ভালো লাগল।কি এমন আছে যে রুপার সকল ক্লান্তি গ্লানি নিমিশেই দূর হয়ে গেল।কথাটার মাঝে রুপা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়।ভালোবাসা খুঁজে পায়।যা রুপা চেয়েছিল।হুম।রুপা তা পেয়েছে।ভালাবাসা!পরম পবিত্র ভালোবাসা পেয়েছে ও।
মানুষটা নিশ্চই যাদু জানে। তা না হলে কিভাবে সে আমাকে নিজের মায়ায় ফেলে দিল।কিভাবে সে
আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করল।আর আমাকে বলে কি না আমার মুখে,চোখে মায়া খেলা করে।বড্ড পাগল মানুষটা।হ্যাঁ! আমার ভালোবাসায় পাগল।কথা গুলো রুপা ভাবে।আনমনে হাসে রুপা।শব্দহীন হাসি। এসব ভেবেও যেন অদ্ভুত শান্তি পায় রুপা। সারাদিন কাজ করেও এতটা কষ্ট হয় না। যতটা শান্তি এসব ভেবে পায়।
রুপা রান্না করে।ওর শাশুড়ি ওকে সাহায্য করে রান্না ঘরে ।ঠিক তখনই রূপার ফোন বেজে উঠে।রুপা ফোনের আওয়াজ শুনে ব্যাকুল হয়ে যায়।নিশ্চই মহি করেছে।দৌড়ে চলে যায় ফোনের কাছে।ওর শাশুড়ি রুপার এমন কান্ড দেখে মনে মনে হাসে।একটু শান্তিও পান তিনি।
যাক অবশেষে একজন মনের মত বউ পাওয়া গেল যে কি না আমার অনুপস্থিতিতেও এ সংসার সামাল দিতে পারবে। নিজের মত গুঁছিয়ে রাখতে পারবে।
কথা গুলো ভাবে মহির আম্মু।আনন্দ হয় উনার।রুপার প্রতি আমরন ভালোবাসা জন্মায় তার মনে।
.
বিকেল বেলা হলেই রুপার দিন গুলো কাটে অস্থিরতায়।কখন মহি আসবে।কখন ওর মুখটা দেখতে পাবে।সময় যতই বাড়ে অস্থিরতা যেন ততই বাড়তে থাকে।বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হয়ে যায় এর মাঝে।সার্বক্ষণিক খবর রুপার চাই।একটু দেরি হওয়া চলবে না।ফোন তুলতে দেরি হলেই অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় রুপার।তাই মহিও ফোন তুলতে দেরি করে না।প্রয়োজনীয় কাজ থাকলে একটা মেসেজ দিয়ে রাখে মহি।সে জানে ফোনে না পেলে এপাশের মানুষটার ভিষন অস্থিরতা শুরু হবে।পাগলামো শুরু হবে।
.
সকল অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে কলিংবেল বেজে উঠে।রুপা দৌড়ে যায়।দরজা খোলে।দেখে ক্লান্তি,গ্লানি,কষ্টে বিষন্ন হয়ে থাকা এক টুকরো হাসি।এত ক্লান্তির মাঝেও যে মানুষ হাসতে পারে সেটা রুপা আগে জানত না।দেখেও নি কবু।কেবল মহিকেই প্রথম দেখেছে।বিষন্ন সন্ধ্যায় প্রিয়জনের বিষন্ন চেহারা দেখে রুপার বাড়তি কোন ইচ্ছে জাগে না।জাগলেও দমিয়ে পেলে।মানুষটা কত কষ্ট করে! ও যদি কিছু চায় তাহলে নিশ্চই এ নিয়ে মহি টেনশনে পড়ে যাবে।পরে ইচ্ছে পুরোন করতে না পেরে হতাশায় ভুগবে মহি।রুপা এটা কখনই চায় না।একদম না।রুপা তাড়াহুড়ো করে মহির ব্যাগটা নিয়ে নেয়। রুমে গিয়ে মহি খাটের উপর বসে পড়ে।বড্ড ক্লান্ত সে।রুপা লেবুর শরবত বানিয়ে আনে।খেতে দেয় মহিকে।মহি কিছুটা আশ্চর্য হয়।রুপাকে দেখলে মহির ক্লান্তি যেন হুট করে কোথায় চলে যায়।ওর মায়া ভরা মুখটা ক্লান্তিরা সহ্য করতে পারে না বোধ হয়। তাই চলে যায়।
ওহে মায়াবিনী,
এত মায়া কেন তোমার মাঝে।
যা দেখে,
ক্লান্তিরা পালায় দূর বহু দুরে।
.
অফিস থেকে একটা পার্টি দেওয়া হয়েছে।একটা বড়সড় ডিল পাশ হয়েছে।যার ক্রেডিট অনেকটাই মহির ।কিন্তু সে খুব ছোট পদে চাকরি করে।তাই ক্রেডিট গ্রহিতার লিস্টে নাম আসে না তার।এটা জগতের নিয়ম।সকল বড় কাজের পিছনে ছোট ছোট মানুষ গুলো হাত থাকে। প্রয়োজনে তারা হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ন কেউ।কিন্তু প্রয়োজন পুরিয়ে গেলে সেই ছোট ছোট মানুষগুলোর মূল্য থাকে না আর।তারা মূল্যহীন হয়ে যায়।তাদেরকে আর খুঁজেও পাওয়া যায় না।এটা জগতের নিয়ম।এ নিয়ম গুলো মনুষ্য সৃষ্টি। সে মানুষ গুলো বড় জগন্য। বড় বিবৎস তারা।তাই তারা এত কঠোর নিয়ম সৃষ্টি করতে পেরেছে।মহি মেনে নেয়।তবুও যাবে বলে স্থির করে।আর যাই হোক! নিজের অফিসের পার্টি বলে কথা।
.
রুপা একটা শাড়ি পড়েছে।মেরুন কালারের একটা শাড়ি।কপালে টিপ দেয় নি।মুখে সামান্য মেকআপ। ঠোটে গোলাপি লিপষ্টিক। চোখে গাঢ় ঘন কাজল।কানে একটা গোল্ডেন কালারের দুল।গলায় একটা হার।সেও গোল্ডেন কালারের। দূর থেকে দেখলে যে কেউই বলবে এগুলো খাঁটি সোনার তৈরি। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই না।রুপার তৈরি হওয়া শেষ।সে বসে আছে আয়নার সামনে।তারপাশে বসে আছে মহি।সে তাকিয়ে আছে রুপার দিকে।একরাশ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।মুগ্ধতায় যেন চেয়ে মহি।রুপা লজ্জা পাচ্ছে। ভীষন লজ্জা পাচ্ছে।এতে মুখটা কিছুটা লালছে হয়ে যাচ্ছে।যা রুপার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
:এত সাজলে কেন?
:কই এত সাজলাম।তুমি তো দেখলেই কেমন সাজলাম।তোমার সামনেই তো সাজলাম।
:তোমার কি বিন্দুমাত্র ধারনা আছে যে তোমাকে কতটা সুন্দর লাগছে?
রুপা কিছু বলে না আর।লজ্জায় আবেশিত সে।যাক তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।রুপা চেয়েছিল মহিকে চমকিয়ে দিবে।এবং সে তা করেছে।মহিকে একেবারে ভড়কে দিয়েছে সে।যা ওদের ভালোবাসা কে আরেকটু গাঢ় করেছে।
.
চলবে...
.
গল্পটা গুছিয়ে লিখতে পারি নি।ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
.
তাসফি আহমদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url