গল্পঃ নেকড়ে মানব

বাংলা গল্প Love Stories Bangla Choto Golpo  Bangla Valobashar Golpo Bangla Golpo


গল্পঃ নেকড়ে মানব 

লেখকঃ তাসফি আহমেদ 


রাত প্রায় দুটো বেজে গিয়েছে। গভীর রাত৷ রাতের ঠিক এই সময়টায় কাছে কোথাও তীব্র একটা চিৎকার শোনা গেল৷ চিৎকারের উৎস সম্পর্কে সঠিক জানা গেল না। তবে সে চিৎকার যে কোনো পুরুষের তা স্পষ্ট বোঝা গেল৷ শব্দটা কেমন জানি ভয়ানক লাগল রুবিনার কাছে৷ তার মনের ভেতর কেমন জানি ভয় ঢুকে গেল৷ মন কেমন কু ডাক ডেকে উঠলো৷ মনে হলো খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। খুব খারাপ কিছু। সে আর দাঁড়িয়ে থাকলো না৷ হাঁটা ধরলো৷ আজ এক বেলা খদ্দের না পাওয়া গেলে কোনো বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে না৷ তার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে৷ কাল কেন, আরো এক মাস গা না বেচে থাকা যাবে৷ সে দ্রুত হাঁটতে থাকলো৷ ঠিক তখনই রাস্তার পাশের ঝোপটা কেমন জানি নড়ে উঠলো৷ তার মনে হলো শক্তিশালী কিছু একটা ওখানে লুকিয়ে আছে৷ কারণ ঝোপটা খুব জোরে নড়ছিল৷ রুবিনার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় তখনই৷ একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় তার সমস্ত শরীর বেয়ে৷ সে কেমন জানি ঘামতে থাকে। রুবিনা আর অপেক্ষা করলো না৷ সে হাঁটার গতি বাড়িতে দিলো৷ ঠিক সেই মূহুর্তে ঝোপের পাশে থাকা গাছটা নড়ে উঠলো৷ এতো জোরে নড়ে উঠলো যে রুবিনা চমকে গিয়ে পেছনে তাকালো৷ তার কয়েক সেকেন্ড পরই ঝোপের আড়াল থেকে লাপ দিয়ে বেরিয়ে এলো কিছু একটা। ল্যামপোষ্টের আলোয় রুবিনা স্পষ্ট দেখলো নেকড়ের মতো কিছু একটা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী ভীষণ হিংস্র চেহারা তার। রুবিনার চোখ বড় হয়ে এলো৷ কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো। সে বরফের মতো জমে গেল যেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে জীবনে সেরা ভয়টা সে আজ পেয়েছে৷ ঠিক এমন মূহুর্তে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। কাছের কোনো বিল্ডিং থেকে থেকে শব্দ আসছে হয়তো৷ রাস্তার ওপাশেই সারি সারি বিল্ডিং। রুবিনা খানিকটা নড়ে উঠল৷ তারপর দৌড়াতে শুরু করলো৷ কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে৷ সে চিৎকার দেওয়ার সময়টুকুও পেল না। 
.
রাত দুটো মানে অনেক রাত। কিন্তু এই জিনিসটা বাচ্চারা বুঝে না৷ তারা বেলা অবেলা না বুঝে হুট করেই চিৎকার দিয়ে উঠবে৷ কান্নায় আসমান ভেঙ্গে আসবে যেন৷ এই মূহুর্তে আকরামের ঘরে এই কান্ডটা ঘটছে৷ তার এক মাসের বাচ্চাটা চিৎকার দিয়ে কান্না করছে। আকরামের স্ত্রী সোমা বাচ্চাটাকে থামানোর চেষ্টা করছে৷ বুকের দুধ দিয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটা খাচ্ছে না। মুখ সরিয়ে নিয়ে কান্না করছে। কান্নায় যেন দম বন্ধ হয়ে আসবে৷ আকরাম উঠে দাঁড়ালো৷ তার চোখে ঘুম। তবুও সে কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে৷ কোলে নিয়ে হাঁটছে৷ বাচ্চাদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছে৷ তও বাবুর কান্না থামলো না৷ সোমা এসে কোলে নিলো৷ তাতেও কাজ হলো না৷ ঠিক সে সময় তাদের দরজায় আওয়াজ দিলো কেউ। আকরামের মা ডাকছেন৷ আকরাম দরজা খুলে দিলো৷ তার মা জিনাত ইসলাম ভেতরে এসে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
-কী ব্যাপার? বাবু এমন কান্না করছে কেন? 
আকরাম চিন্তিত স্বরে বলল,
-জানি না মা৷ সেই কখন থেকে কাঁদছে। 
জিনাত ইসলাম এগিয়ে এলেন৷ সোমার কোল থেকে বাবুকে নিজের কোলে নিলেন৷ তারপর বিছানার কাছে বসে দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করলেন৷ তাঁর ধারণা মতে বাচ্চাদের এমন কান্নাটা শুভ নয়। তা যদি রাত দুটোয় হয় তবে তো নয়ই। তিনি ভাবছেন বাবু হয়তো ভয় পেয়েছে। দুষ্টু জ্বীনেরা বাচ্চাদের ভয় দেখায়৷ এতে আনন্দ পায় তারা৷ এখন তেমন কিছুই হয়েছে হয়তো৷ তিনি আয়তলকুরসি পাঠ করলেন৷ সূরা ফাতেহা,ইখলাস,নাস তিনবার করে পাঠ করে বাবুর গায়ে ফু দিলেন৷ ফু'তে কাজ হলো হয়তো৷ বাবুকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থামানো গেল৷ কিন্তু পরক্ষণেই বাবু আবার কেঁদে উঠলো৷ আবার সেই মর্মান্তিক কান্না৷ জিনাত ইসলাম পূর্বের মতো আবার দোয়া পড়তে শুরু করলেন৷ তাঁর পাশে নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে আকরাম এবং সোমা৷ তাদের বেশ চিন্তিত লাগছে৷ তারা বুঝতে পারছে না বাবু আজ রাতে হঠাৎ এমন কেন করছে। এভাবে কান্না করছে কেন? ঠিক এমন সময় কিছু একটার আওয়াজ পাওয়া গেল৷ কিছু একটা যেন গোঁ গোঁ করছে৷ আওয়াজটা খুব সম্ভবত নিচ থেকে আসছে। তাদের বাসাটা তিন তলায়  হওয়ায় শব্দটা সহজে পাওয়া গিয়েছে। আকরাম বারান্দার দরজাটা খুলে ব্যাপারটা দেখতে চাইলো৷ ঠিক তখনই তার মা চাপা স্বরে বললেন,
-এই? কই যাস? 
আকরাম বলল,
-নিচে কিছু একটার শব্দ হচ্ছে হয়তো৷ দেখে আসি।
জিনাত ইসলাম নিজের স্বরটা আরেকটু নামিয়ে বললেন,
-চুপ গাধা! এখানে এসে বোস! দরজা খোলার দরকার নেই। যেই ঘরে বাচ্চা শিশু থাকে সেই ঘরে রাত বিরাতে দরজা-জানালা খুলতে নেই৷ খারাপ হয়।
আকরাম বুঝতে পারলো না আসলে কী খারাপ হয়। তার মা মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন যে আকরাম একদমই বুঝতে পারে না৷ সে পূর্বের জায়গায় এসে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই মনের হলো শব্দটা আরো কাছ থেকে আসছে৷ এই যেন খুব কাছেই৷ আকরাম চিন্তায় পড়ে গেল। কিসের শব্দ হতে পারে এটা? জিনাত ইসলাম নিজেও শব্দটা পেলেন এবার৷ তিনিও খানিকটা অবাক হলেন! কেমন ভয়ংকররকমের গোঁ গোঁ শব্দ। তাঁর কপালে ভাজ পড়লো৷ ভয়ে সোমার চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে এলো৷ শব্দটা একদম কাছে এসে থেমে গেল যেন৷ হঠাৎই ঘরময় অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো৷ একটা শীতল ভয় যেন সমস্ত রুমের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আকরাম আর সোমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো৷ বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন জিনাত ইসলাম। তিনি দোয়া পাঠ করা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ কারণ বাবুর কান্না থেমে গিয়েছে। ঠিক তখনই বাবু আবার চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো। এবারে তার কান্নার স্বর আরো তীব্র৷ এতো তীব্র স্বরে কাউকে কাঁদতে দেখেননি জিনাত ইসলাম। তিনি আবার দোয়া পড়তে শুরু করলেন। এতোক্ষন গুন গুন শব্দে দোয়া পড়ছিলেন তিনি৷ এখন জোরে জোরে পড়ছেন। তাঁর দোয়ায় কাজ হচ্ছে না৷ বাবুর কান্না থামছে না৷ বরং যেন বেড়েই চলছে। তার মনে ভয় খেলা করতে থাকলো৷ মন বলল যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না৷ খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। ঠিক তখনই শব্দটা হলো৷ কিছু একটা ধপ করে ওদের বারান্দায় নামলো যেন৷ ভারী একটা শব্দ৷ ভয়ে আকরামের গলা শুকিয়ে এলো। সে বারান্দার দরজার দিকে তাকালো একবার। দরজাটা বেশ নড়বড়ে। এক লাত্থিতেই ভেঙ্গে যাওয়ার মতো৷ দরজাটা ঠিক করবে করবে বলে করা হচ্ছে না৷ বারান্দার দরজা বলে হয়তো সে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ ছিল৷ আকরাম কথা গুলো ভাবছিল, ঠিক সেই মূহুর্তে বারান্দার দরজাটা নড়ে উঠল৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দেখা গেল দরজাটা ভেঙ্গে পড়ে গেছে৷ আকরামের সমস্ত গা শিউরে উঠল। সে অবাক হয়ে দেখলো বারান্দায় নেকড়ের মতো কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে এবং দাঁতে রক্ত লেগে আছে। এক ফোট রক্ত টুপ করেই টাইলস করা মেঝেতে পড়লো৷ আকরাম সমেত তার মা এবং স্ত্রী চিৎকার দিয়ে উঠলো। বাবুর অস্বাভাবিক কান্না যেন আরো বেড়ে গেল। 
.
সৃজিয়া বাসাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখাচ্ছে৷ ভেতরে ভেতরে কিছু একটা যেন ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷ তার মোটেও এখানে আসতে ইচ্ছে ছিল না৷ তবুও কেন জানি চলে এলো৷ নিজের মনকে বাধা দিতে পারলো না৷ এমন একটা ব্যাপার তার জীবনে প্রথম ঘটছে৷ এমন পাগলামো সে আর জীবনেও করেনি৷ তুষার ছেলেটাকে প্রথম থেকেই তার কেমন জানি লাগতো৷ কিছুটা বিরক্তি ছিল তার উপর৷ ছেলেটার অনেক ভাব৷ ছেলে মানুষের এতো ভাব থাকবে কেন? এই ব্যাপারটা সৃজিয়া একদমই মানতে পারছিল না৷ তাই হয়তো বিরক্তিটা জেগেছে৷ তুষারের সাথে সৃজিয়ার পরিচয় তুষারের কাজের মাধ্যমেই আসলে৷ সৃজিয়ার মামাতো বোন নেহার কিছু সমস্যা ছিল৷ ভূত জনিত সমস্যা৷ আর তুষারের কাজই হচ্ছে ভূত তাড়ানো৷ তখনই পরিচয়। তখনকার সাময়িক আলাপে সৃজিয়া ধরে নিয়েছিল ছেলেটার অনেক ভাব৷ সে কোনো ভাবেই সৃজিয়াকে পাত্তা দিচ্ছিল না৷ সৃজিয়াকে দেখলে রাস্তার ছেলেরা হা করে তাকিয়ে থাকে৷ অথচ এই ছেলেটা ওর দিকে তাকালো না বললেই চলে! তখনই সৃজিয়ার ইগো হার্ট হয়। সে তুষারকে আড়ালে ডেকে এনে যাচ্ছেতাই বলে৷ খোঁচা দিয়ে কথা বলে৷ যেন তুষারের উপর তার অনেক অধিকার৷ তাই এমন ভাবে খোঁচাচ্ছে। তুষার ছেলেটা নেহাত ভালো বলে কিছু বলেনি৷ সেদিন নীরবে প্রস্থান করেছে৷ নিজের কাজটা সুন্দর ভাবে করে চলে গিয়েছে৷ যখন সৃজিয়ার রাগ পড়লো তখন তার মনে হলো, শিট! কাজটা একদম ঠিক হয়নি৷ ছেলেটাকে হঠাৎ ও এমন বকা দিলো কেন? এটা মোটেও ঠিক হয়নি৷ তার নিজের উপরই রাগ হতে থাকলো৷ ভাবলো, আশ্চর্য! আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম? এমন বিহ্যাভ কেন করেছি? সৃজিয়া নিজের ভেতরই অস্বস্তিবোধ করতে থাকলো৷ তার অপরাধবোধ জেগে উঠলো৷ তখনই ভাবলো, নাহ, ছেলেটার সাথে কথা বলে সরি বলে নেওয়া উচিৎ। তা না হলে ছেলেটা কী না কি ভেবে বসে থাকবে কে জানে! সৃজিয়ার কেমন জানি লজ্জাও হতে থাকলো৷ ইশ! ফোন দিয়ে কী বলবে সে? নিজের ভুলের জন্যে সরি বলবে? আশ্চর্য! সৃজিয়া কখনই এমন করতো না৷ তার দ্বারা ভুল ঠিক তেমন হতো না৷ তবে হলেও ক্ষমা চাওয়ার মতো মেয়ে সে নয়৷ দু'কথা বাড়িয়ে বলে হলেও সে নিজের কথাকে আগে রাখবে৷ বড্ড জেদি৷ পাগলাটে। সে তার মামার কাছে তুষারের নাম্বার চাইলো৷ মামা বললেন,
-ওর নাম্বার বলতে আমাকে একটা বিকাশ নাম্বার দিয়ে গিয়েছে৷ ওটা দিতে পারি৷
সৃজিয়া ওটাই নিলো৷ নেওয়ার সময় লজ্জা হচ্ছিল। মামা যদি ওকে প্রশ্ন করেন যে, ওর নাম্বার দিয়ে তুই কী করবি? তখন সে কী বলবে? তার কাছে এই প্রশ্নটার জবাব ছিল না। তবে ভাগ্য ভালো যে মামা প্রশ্নটা করেননি৷ স্বাভাবিক ভাবেই দিলেন৷ সৃজিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে ওই নাম্বারে ফোন দিলো৷ ফোন দিয়েই জানতে পারলো ওটা তুষারের নাম্বার নয়৷ কোনো এতিমখানার এক কর্মির নাম্বার৷ ভীষণ রাগ হলো ওর৷ ছেলেটা নিজের নাম্বার দিয়ে গেলে কী হতো? কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? সৃজিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা নিলো যে আর কখনই সে এই ছেলের খোঁজ নিবে না। সরি বলা তো দূরের ব্যাপার৷ সেই প্রতিজ্ঞা নেওয়া সৃজিয়া আজ তুষারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে লজ্জামাখা চেহারা নিয়ে। সে কেন এমন করছে তা সে জানে না৷ তবে তার তুষারের সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে করছে৷ খুব।
বাড়িটাতে আগেও একবার এসেছে সৃজিয়া৷ প্রথমবার তুষারের সাথে মামাতো বোনের কেস নিয়ে আলোচনার করতে এসেছে৷ আর আজ এসেছে৷ তবে আজ আসার কারণটা সে স্পষ্ট জানে না৷ সৃজিয়া কলিং বেল বাজালো৷ অল্প কিছু পরেই দরজা খুলে দিলো কেউ। সৃজিয়া ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকালো৷ সে দেখলো একটা সুদর্শন ছেলে হাস্যজ্বল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার নাম তুষার আহমেদ। তার সাথে তুষারের চোখাচোখি হতেই তার কলিজার ভেতর ধক করে উঠলো। ভেতরের সব গুলিয়ে গেল। গা ভর্তি শিনশিনে এক অনুভূতি হলো তার। কেমন জানি কেঁপে উঠলো সে। সৃজিয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো৷ তার মনে হলো আর একটু তাকিয়ে থাকলে সে মারা যাবে৷ দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে৷ তুষার বলল,
-আরেহ! ডাক্তার সাহেবা? হঠাৎ এই গরীবের ঘরে?
(প্রথম পর্ব) 
গল্পঃ নেকড়ে মানব। 
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব। 
(দ্বিতীয় পর্ব)
.
ওসি নুরুজ্জামান তার কেরিয়ারে এমন 
মারাত্মক কেস আর দেখেনি৷ কিংবা এমন মারাত্মক কেস আসবে সেটা সে কল্পনাও করেনি৷ একটা নেকড়ে কীভাবে তিন তলায় উঠে চারজন জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলে? এসব কী কখনও সম্ভব? নাটক সিনেমায় এসব হয়৷ কিন্তু বাস্তবে? কথাটা সে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছিল না৷ প্রথমে একদম হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল৷ কিন্তু যখন তার চাচা আশফাক সাহেব তাকে ফোন করে জানালেন তখন সে কিছুটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এখন এখনে এসে সে ব্যাপারটা পুরোপুরিই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। নুরুজ্জামান বারান্দায় এলো। এই বারান্দা দিয়েই ঢুকেছে জানোয়ারটা৷ কিন্তু সে বারান্দার গ্রীলটা ফাঁক করলো কীভাবে? এতো শক্তি তার? হাত দিয়ে টেনে গ্রীল ফাঁক করেছে? একটা নেকড়ে? আশ্চর্য! তারচে অবাক করা ব্যাপার হলো ওই নেকড়ে এই দালান বেয়ে উপরে উঠলো কীভাবে? নেকড়ে কি দালান বেয়ে উঠতে পারে? মাথা ঘুরে উঠলো তার। এসব যেন একদমই হজম হচ্ছে না৷ আশ্চর্য! এসব কীভাবে সম্ভব?
লাশ গুলো মেঝেতে রাখা হয়েছে। আকরামের এক পাশে তার মায়ের লাশ৷ অন্য পাশে তার স্ত্রীর৷ তার স্ত্রীর পাশে শুয়ে আছে তার এক মাস বয়সী ছোট্ট ছেলেটা। যার নাম সদ্যই রাখা হয়েছিল অয়ন৷ লাশ গুলোর বর্তমান অবস্থা না বলাই ভালো৷ একটা নেকড়ে মানুষকে কতো নির্মম ভাবে হত্য করতে পারে সেটা এই লাশ গুলো না দেখলে বোঝা যাবে না৷ আকরাম নুরুজ্জামানের চাচাতো ভাই৷ সেই হিসেবে আকরামের লাশটা স্পেসিফিক করা নুরুজ্জামানে জন্যে কঠিন কিছু নয়৷ কিন্তু  এখানে এসে নুরুজ্জামান আকরামে লাশটাও চিনতে পারছিল না৷ সব গুলো লাশের দশা এক। নুরুজ্জামান হঠাৎ কাউকে ডেকে উঠলো,
-মজিদ?
মজিদ নামক কনস্টেবল রুমের ঢুকে বলল,
-জি স্যার?
-ফরেনসিক টিম চলে গিয়েছে?
-জি স্যার। 
-লাশ গুলো ময়না তদন্তের জন্যে নিতে বলেছিলাম৷ নিচ্ছো না কেন?
-আপনার চাচা বাধা দিচ্ছেন স্যার৷ তিনি বলছেন লাশ নিতে দিবেন না৷ যদি লাশ নিতে হয় তবে তাকে খুন করেই লাশ গুলো নিতে হবে৷ 
নুরুজ্জামান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-তুমি ব্যবস্থা করো৷ আমি উনার সাথে কথা বলছি৷ 
-স্যার আপনি আগে উনার সাথে কথা বলে নিন৷ 
-বলব বলেছি তো৷ তুমি ব্যবস্থা করো। 
মজিদ গেল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো৷ নুরুজ্জামান বলল,
-কী ব্যাপার। তুমি যাচ্ছো না কেন?
-স্যার, সব কিছু ব্যবস্থা করা আছে৷ আপনি কেবল চাচার থেকে অনুমতি নিন৷ 
-অনুমতি নিবো মানে? খুন হয়েছে, লাশ ময়না তদন্তের জন্যে যাবে৷ এটাই তো নিয়ম৷ উনি অনুমতি দেওয়ার কে?
মজিদ কিছু বলল না৷ সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো৷ নুরুজ্জামান নিজেকে স্থির করে বলল,
-চাচা কি খুব রেগে আছেন?
-জি স্যার৷ মহশিনকে একটা চড়ও দিয়ে ফেলেছেন। 
নুরুজ্জামান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। মানুষটা আজ এক সাথে চার-চারজন মানুষকে হারিয়েছে। তার মাঝে কী বয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই নুরুজ্জামান বুঝে। কিন্তু কী করার৷ লাশ তো নিতে হবে৷ সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো৷ তার পেছন পেছন এলো মজিদ৷ নুরুজ্জামান বলল,
-মজিদ?
মজিদ এগিয়ে এসে বলল,
-জি স্যার? 
-কারা জানি নেকড়েটাকে দেখেছে?
-এই এলাকার নাইট গার্ড আর সামনের বিল্ডিংয়ে থাকা একটা ছেলে৷ 
-তারা এখানে আছে?
-জি স্যার।
-তাদের ডাকো তো একটু৷ 
-জি স্যার৷
নুরুজ্জামান খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,
-তোমাকে না বলেছি সারাক্ষণ 'জি স্যার, জি স্যার' না করতে? 
-জি স্যার। সরি স্যার৷ আর হবে না।
নুরুজ্জামানের মেজাজটা কেমন জানি খারাপ হয়ে এলো৷ তবে কিছু বলল না৷ মজিদ চলে গেল৷ নুরুজ্জামান নিজের ফোনটা বের করে তার বাবাকে ফোন দিলো,
-আসসালামু আলাইকুম, বাবা কতদূর এসেছেন? 
নুরুজ্জামানের বাবা জনাব মহি উদ্দিন বললেন,
-এইতো! প্রায় পৌঁছে গেছি। 
নুরুজ্জামান খানিকটা বিরক্তি ভরা স্বরে বলল,
-চট্টগ্রাম থেকে কখন পথ দিয়েছেন? এতো দেরি হচ্ছে যে?
-পথে গাড়িতে একটু সমস্যা হয়েছিল। কী হয়েছে? কিছু বলবি?
-হ্যাঁ। চাচাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না৷ আপনাকে লাগবে।
-কেন? কী হয়েছে?
-লাশ নিতে দিচ্ছেন না। 
মহি উদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-এই তো আমি পৌঁছে গেছি। চিন্তা করিস না৷ 
নুরুজ্জামান ফোন রেখে দিলো৷ সে তার চাচাকে কেন জানি ভীষণ ভয় পায়৷ ছোট বেলা থেকেই। চাচার সামনে কখনই কিছু বলতে পারে না৷ চোখে চোখ রাখতে পারে না। ছোট বেলার সেই ভয়টা এখনও যায়নি৷ ছোটবেলায় মানুষের মনে কিছু কিছু ভয় এমন ভাবে ঢুকে যায় যে যেগুলো চাইলেই খুব সহজে মুছে ফেলা যায় না৷ আজীবন থেকে যায়৷
.
নুরুজ্জামান দাঁড়িয়ে থাকল৷ অল্প কিছু পরেই মজিদ দু'জন মানুষ নিয়ে ফিরে এলো। একজনের নাম জোবায়ের। জোবায়েরের বয়স তেমন নয়। বিশ-বাইশ হবে৷ ফর্সা চেহারা৷ চোখের নিচে কালী৷ নুরুজ্জামান তাকেই সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করলো,
-নাম কী?
-জোবায়ের হোসেন।
-কিসে পড়ো?
-অনার্স প্রথম বর্ষ।
-কাল রাতে যা দেখেছো সংক্ষিপ্ত আকারে বলো ফেলো তো!
জোবায়ের কিছুক্ষণ চুপ থাকলো৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে সে৷ বলল,
-স্যার, রাত তখন প্রায় দুটোর বেশি৷ আমি নিজের রুমের জানালার কাছে বসে আছি৷ পাবজি খেলছিলাম। হঠাৎই কিছু একটা শব্দ পাই৷ শব্দের উৎসের খোঁজে তাকাতেই দেখি আকরামের ভাইয়ের বারান্দার দরজা খোলা৷ স্যার, আমি আমার বিছানা থেকে স্পষ্ট দেখলাম একটা নেকড়ে ওদেরকে কীভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল। আমি সাথে সাথেই চিৎকার দেই৷ ভয় পেয়ে যাই। 

ছেলেটার চোখ মুখ ভর্তি ভয়৷ চোখে যেন বিন্দু বিন্দু জল। ছেলেটা যে মিথ্যা বলছে না এটা অত্যন্ত সত্য৷ নুরুজ্জামান বলল,
-ভিডিও করোনি?
-সে সময় কই স্যার! এভাবে কাউকে মরতে দেখে হাত পা আপনা আপনিই অবস হয়ে আসে৷ ভিডিও কীভাবে করি?
-আচ্ছা৷ তুমি যেতে পারো৷ তদন্তের প্রয়োজনে তোমাকে থানায় ডাকা হতে পারে। নির্ভয়ে চলে এসো৷ 
জোবায়ের চলে গেল। নুরুজ্জামান নাইট গার্ডের দিকে তাকালো। নাইট গার্ডের বয়স পঞ্চাশ উর্ধ। চুল পেঁকে আছে৷ নুরুজ্জামান বলল,
-আপনি কী দেখেছিলেন?
-সংক্ষিপ্ত করে বলছি স্যার৷ যা দেখলাম খুবই ভয়ানক। ওই জিনিসটাকে যখন দেখছিলাম ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। 
-কী দেখছিলেন সেটা বলেন।
-একটা নেকড়ে। বিশাল দেহ। বড় বড় দাঁত। দাঁতে আর মুখ রক্ত লেগেছিল৷ আমি এদিক দিয়া যাচ্ছিলাম। তখনই দেখলাম কিছু একটা দৌড়ে যাচ্ছে৷ 
-দৌড়াতে দেখেছেন?
-জি স্যার।
-কোনদিকে গেল।
-পূব দিকে৷ 
-আচ্ছা৷ আপনি এখন আসতে পারেন৷ তদন্তের... 
নুরুজ্জামান বাকিটা বলে শেষ করতে পারলো না৷ তার আগেই নীরব নামক কনস্টেবল দৌড়ে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-স্যার, আরেকটা লাশ পাওয়া গিয়েছে৷ খুবই বিভৎস অবস্থা৷ 
নুরুজ্জামান ভ্রু কুচকে বলল,
-কোথাও পাওয়া গেছে?
-এই তো৷ ঝোপের কাছে৷ 
নুরুজ্জামান আর দাঁড়ালো না। দৌড়ে গেল৷ 
.
সৃজিয়া মাথা তুলে বলল,
-হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়লো৷ তাই আসলাম। 
তুষার অবাক স্বরে বলল,
-এই পৃথিবীতে এটি অন্যতম একটি আশ্চর্যরকম ঘটনা যে কেউ আমার কথা মনে করে আমার জন্যে দেখা করতে এসেছে৷ নচেৎ মানুষ ওঝা টোঝা থেকে বেশ দূরেই থাকে৷ 
-এখন আসাটা কি আমার অন্যায় হয়েছে?
তুষার হাসলো৷ বলল,
-না, তা নয়৷ ভেতরে আসুন৷ 
সৃজিয়া ভেতরে ঢুকলো৷ ঢুকতেই এক প্রকার প্রশান্তি তাকে আঁকড়ে ধরলো৷ ওর হঠাৎই কেন জানি ভালো লেগে উঠলো৷ আশ্চর্য! এই ছেলের ঘরটা এতো সুন্দর কেন? কী গোছগাছ! সৃজিয়া চারপাশটা দেখতে থাকল৷ উত্তরের দেয়ালে বিশাল ঈগলের পেইন্টিংটা দেখল! প্রথমবার এসে সে এই পেইন্টিংটা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ এখন অবশ্য পাচ্ছে না৷ এই একটা পেইন্টিং আর একটা নেকড়ের পেইন্টিং৷ সৃজিয়া পশ্চিমের দেয়ালে তাকালো৷ তাকিয়ে তাকে অবাক হতে হলো৷ নেকড়ের পেইন্টিংটা নেই৷ অথচ গতবার যখন এসেছিল তখন পেইন্টিংটা এখানেই ছিল। এই দেয়ালেই লেপ্টে ছিল। নেকড়েটা ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে৷ সৃজিয়া বলল,
-আচ্ছা, এই দেয়ালে যে নেকড়ের পেইন্টিংটা ছিল ওটা কোথায়?
-হঠাৎই এই প্রশ্ন?
-এমনিই৷ দেখছি না বলেই জিজ্ঞেস করলাম। 
-প্রথমবার এসে অনেক কিছুই মুখস্ত করে নিয়েছেন দেখছি৷
সৃজিয়া হাসলো৷ বলল,
-না, আসলে তা নয়৷ ওই ছবিটা দেখে সেদিন ভয় পেয়েছিলাম। তাই মনে আছে আরকি৷ 
-আচ্ছা, বসুন৷ আমি চা করে আনছি৷ 
-নাহ৷ তার প্রয়োজন পড়বে না৷ আমি চলে যাবো৷
-আহা! বসেন না৷ সবেই তো আসলেন৷ বাই দ্য ওয়ে, আজ আপনাকে দারুণ লাগছে৷ সব সময় এভাবে থাকলেই তো পারেন। হাসি-খুশি, প্রানবন্ত! 
সৃজিয়া কিঞ্চিৎ খুশি এবং কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,
-সব সময় এভাবে থাকবো মানে? আপনার কী মনে হয়? আমি সব সময় অন্যভাবে থাকি?
-তা তো থাকেনই৷ কেমন গম্ভীর রগচটা টাইপ।
অন্য সময় কথাটা শুনলে বেশ রাগ হতো
সৃজিয়ার৷ আজ কেন জানি হচ্ছে না৷ আজ হঠাৎই ওর অন্য রকম ভালো লাগছে৷ সৃজিয়া বলল,
-আমি সব সময় এমনই থাকি৷ আপনি দেখতে ভুল দেখেছেন হয়তো৷ বাদ দিন৷ আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। 
তুষার খানিকটা হেসে বলল,
-সব কথা কি এখানেই শেষ করবেন? নাকি চা খেতে খেতেও কিছু বলবেন? 
সৃজিয়া লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিল৷ বলল,
-সরি৷ আসলে নিজেকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না৷ আচ্ছা চা টা আমি বানালে কেমন হয়?
-মেহমানকে দিয়ে কীভাবে রান্না করাই?
-আরেহ! সমস্যা নেই৷ প্রথম দিন আপনি চা করে খাওয়ালেন৷ আজ আমি করে খাওয়াবো৷ 
-আচ্ছা৷ আসুন৷ কিচেনটা এদিকে৷ 
তুষার কিচেনে আসলো৷ তার পেছন পেছন এলো সৃজিয়া৷ তুষার ভেতরে ঢুকে বলল,
-এই হলো এই গরীবের কিচেন৷ 
সৃজিয়া ভেতরে ঢুকে বেশ মুগ্ধ হলো৷ ওদের কিচেনটাও এতোটা সুন্দর না! এতোটা গোছগাছ করে রাখা না, যতোটা এই কিচেনটা সুন্দর, গোছগাছ করে রাখা৷ এই ছেলের সব কিছু এতো পার্ফেক্ট কেন? হঠাৎই সৃজিয়ার চোখ গেল বেসিনের উপর৷ বেসিনের হাতলটা কেমন লালছে হয়ে আছে৷ ওর মনে হলো এগুলো রক্ত। হ্যাঁ৷ সত্যিই। রক্ত৷ সে তুষারকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুষার এগিয়ে হাতলটা ক্লিন করতে থাকল। বলল,
-মোরগ জবাই করেছিলাম। তখন রক্ত লেগেছিল হয়তো৷ 
সৃজিয়া কিছু বলল না আর৷ চুলাটা জ্বালিয়ে দিলো৷ বলল,
-আচ্ছা, আপনার ঘরটা এতো গোছানো কীভাবে?
-আমি একা মানুষ! বেশিরভাগ সময়ই থাকতে হয় ঘরের বাইরে৷ তাছাড়া জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করার মতোও তেমন কেউ নেই৷ তাই সব নিজের অবস্থানেই থাকে৷ 
-জিনিস গুলো এতো চকচকে পরিষ্কার থাকে যে?
-সপ্তাহে একদিন সব কিছু পরিষ্কার করি৷ 
-বাহ! তাহলে বলা যায় আপনি বেশ গোছালো মানুষ। 
-গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করি আরকি। 
-খুব ভালো৷ গোছানো মানুষ আমার খুব পছন্দের।
তুষার হাসলো। বলল,
-পছন্দ অপছন্দ পরে জানছি। আগে আমাকে দু'মিনিট সময় দিন। আমি কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করি৷ 
-আরে আরে এসব কিছু করতে হবে না৷ আমি শুধুই চা খাবো৷ আর কিছুই খাবো না।
-তা বললে তো হবে না৷ প্রথমদিন এসেও কিছু খেলেন না৷ আজও তা হয় কীভাবে? যতো যা-ই হোক, আপনাকে আজ কিছু খেতেই হবে৷ 
এই বলে তুষার চলে গেল। সৃজিয়া মৃদু হাসলো। তার কাছে আজ অন্যরকম ভালো লাগছে৷ দিনটাকে কেমন সুখি সুখি লাগছে৷ তার মনে হলো, ইশ! যদি সব গুলো দিন এমন সুন্দর হতো! 
.
সৃজিয়া জলদি চা বানিয়ে নিলো৷ দুটো কাপে চা ঢেলে বসার ঘরে আসতেই দেখলো তুষার দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটি টি-টেবিল। সেখানে নানান রকমের নাস্তা৷ নাস্তা রাখা শেষ৷ তুষারের সেদিকে মন নেই৷ সে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। টিভিতে নিউজ দেখা যাচ্ছে। সৃজিয়া এগিয়ে এলো৷ টিভির হেড লাইনটা দেখেই চমকে গেল সে। "রহস্যময় এক নেকড়ের হাতে খুন গোটা এক পরিবার"। সৃজিয়ার অবাক হওয়ার সীমা থাকলো না৷ এমন কিছু ঘটা অস্বাভাবিক। নেকড়ে কীভাবে এই শহরে আসবে? তাও আবার চার তলায় উঠে মানুষ খুন করবে? অসম্ভব! সৃজিয়া স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো৷ ঠিক তখনই কিছু একটা দৌড়ে আসার শব্দ হলো৷ অদ্ভুত ভারী কিছুর শব্দ৷ তুষার এবং সৃজিয়া দুজনেই চমকে উঠলো। দুজনেই এক সাথে শব্দের উৎসের দিকে তাকালো৷ তাকাতেই শীতল একটা শিহরণ বয়ে গেল সৃজিয়ার সমস্ত শরীরে। তার হাত থেকে চায়ের ট্রে'টা পড়ে গেল। হাত পা অবশ হয়ে এলো৷ সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না৷ একটা নেকড়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন সে খেয়ে ফেলবে তাকে। ভয়ে তার শরীর কাঁপতে থাকলো৷ সে কেমন বরফের মতো জমে গেল৷ বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল৷ আড় চোখে তাকালো তুষারের দিকে। তুষার তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কেমন রহস্যময় এক চেহারা ছেলেটার৷ আশ্চর্য! ছেলেটা হাসছে! হাসছে কেন? হাসার কী আছে? এমন সময় কেউ হাসে? আচ্ছা নেকড়েটা এখানে এলো কীভাবে? তুষারের ঘরে কী করছে সে? ঠিক তখনই সৃজিয়া যেন কিছু একটা বুঝতে পারলো। তার মানে? এই খুন গুলো তুষার করেছে? তুষার? সৃজিয়ার দম বন্ধ হয়ে এলো যেন৷ সে যেন ভয়ে মারা যাবে৷ সে আর কিছুই ভাবতে পারলো না৷ মাথাটা কেমন ভারী হয়ে এলো৷ মূহুর্তে জ্ঞান হারালো সে। জ্ঞান হারানোর সময় এক মূহুর্তের জন্যে তার মনে হলো এটাই তার শেষ দেখা৷ এরপর সে আর এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না৷ তাকে একটা নেকড়ে খেয়ে ফেলবে৷ জঘন্য ভাবে খেয়ে ফেলবে।
.
চলবে...
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব৷ 
(তৃতীয় পর্ব)
.
সৃজিয়ার জ্ঞান ফিরে এসেছে। সে চোখ মেলে নিজেকে একটি বইঘরে আবিষ্কার করলো৷ অদ্ভুত সুন্দর এক বইঘর৷ বইঘরের চার দেয়ালে লেপ্টে আছে নানান রকম বই। উপর থেকে নিচ তাক তাক করা৷ সৃজিয়া কোনো মতে উঠে বসলো। বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল বিছাটা বিশেষ বড় নয়৷ একজন ঘুমানোর জন্যে যথার্থ৷ বিছানা থেকে কিছুটা দূরে একটা টেবিল। টেবিলে নানান রকমের জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে। একটা টেবিল ল্যাম্প, নানান কাগজ পত্র, কলম দানি, এসব৷  উত্তরের দেয়ালের ঠিক মাঝ বরাবর একটা বড় জানালা। জানালার তিন পাশে বই, বইয়ের তাক। জানালাটির সামনে বড় একটি চেয়ার রাখা। চেয়ারের পাশে ছোট্ট একটি টি-টেবিল। জানালার থাই খুলে দিয়ে ওই চেয়ারে বসে বই পড়াটা যে কী ভীষণ আনন্দের হবে সেটা যেন সৃজিয়া বুঝতে পারলো৷ সে কিছু সময়, এক মনে জানালাটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কেমন মুগ্ধতা ঘিরে আছে সমস্ত রুমে। নতুন বইয়ের কেমন একটা ঘ্রাণ ভাসছে। আবার অল্প কিছু সময় পর পর মিষ্টি একটা ঘ্রাণও আসছে। সৃজিয়ার কেমন জানি লাগল৷ ঠিক পরক্ষণে নেকড়েটার কথা মনে পড়তেই সে আঁতকে উঠল৷ একরাশ ভয় তাকে ঘিরে ধরল। অবাক কান্ড! সে ভেবেছে তার মৃত্যু অবধারিত। নেকড়েটা যেভাবে তাকিয়ে ছিল তা দেখে মনে হচ্ছিল সেটা ওকে তখনই খেয়ে ফেলবে৷ কিন্তু খেলো না৷ কাহিনী কী? ঘরময় শীতলতা৷ এসি চলছে হয়তো৷ এই এসির মাঝেও ঘামতে থাকলো সৃজিয়া৷ ঠিক তখনই খট করে একটা শব্দ হলো৷ দরজা খুলে রুমে ঢুকলো তুষার। তার হাতে একটা সুপের বাটি৷ বাটি থেকে ধোঁয়া উঠছে৷ সৃজিয়া ভ্রু কুচকে তাকালো৷ ভাবল, ব্যাপার কী? এই ছেলে কী নিয়ে আসছে? দেখে তো মনে হচ্ছে খাবার কিছু। তারমানে সে তাকে নেকড়ে দিয়ে মারবে না। বিষ খাইয়ে মারবে? এতোটা সময় ছেলেটাকে কতো ভালো লাগছিল তার৷ এখন লাগছে না৷ এখন কেমন জানি ভয় হচ্ছে৷ কান্না পাচ্ছে৷ চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার। রাগ হচ্ছে। সে মানুষ চিনতে ভুল করছে। এমন ভুল হওয়ার কথা না৷ তবুও কীভাবে যেন হয়ে গেল৷ সৃজিয়া বসে থাকলো৷ বহু কষ্টে কান্না আঁটকে রেখেছে সে৷ যেখানে মৃত্যু অবধারিত সেখানে কান্নার কোনো মানেই হয় না৷ বরং কেঁদেকেটে শত্রু পক্ষের আনন্দটা বাড়িয়ে দেওয়া বোকামি৷ যেটার ইচ্ছে একদমই নেই তার৷ সৃজিয়ার ইচ্ছে সে হাসিমুখে মারা যাবে৷ ছেলেটা তখন অবাক হয়ে দেখবে৷ ভাববে আশ্চর্য! এই মেয়ে মরে যাচ্ছে অথচ তার মাঝে কোনো ভাবান্তরই নেই? এটা কেমন কথা? সেই সময়ে তার মাঝে একটা জেদ কাজ করবে৷ রেগে গিয়ে বলবে এই মানুষটাকে মেরে মজা পাইনি৷ ধুরর! ঠিক সেই সময়ই জিত হবে সৃজিয়ার৷ আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে সেই জিত দেখার জন্যে বেঁচে থাকবে না মেয়েটা৷ এই অল্প সময়ে সৃজিয়া অনেক কিছু ভেবে ফেললো৷ ভাবতে ভাবতে ভাবনার ভীড়ে হারিয়ে গেল সে। তুষারের ডাকেই ঘোর ভাঙ্গল। ভাঙ্গতেই সেই দেখল তুষার তার পাশে বসে আছে৷ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ আশ্চর্য ব্যাপার! ছেলেটা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন কোনো কিছুই হয়নি৷ সবটা একদম স্বাভাবিক। মানুষ এমন সময় এতো স্বাভাবিক থাকতে পারে কীভাবে? কে জানে! এই ছেলেটাকে প্রথম থেকেই কেমন অদ্ভুত লাগছিল সৃজিয়ার। বিশেষ করে এই ছেলের চোখ৷ এই ছেলের চোখের দিকে তাকালেই গা কেঁপে উঠে তার। বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়৷ কেমন জানি একটা দূর্বলতার সৃষ্টি হয় মনে৷ তাই চট করেই চোখ সরিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই৷ চোখ না সরালে হয়তো মারাত্মক কিছু ঘটে যাবে৷ এই ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। জীবনে অনেক ছেলে দেখেছে সে৷ কিন্তু কখনই এমন কোনো ছেলের পাল্লায় পড়েনি। এই ছেলেটা আসলেই অদ্ভুত। 
-সৃজিয়া?
উফ! কী দারুণ কণ্ঠ৷ কণ্ঠ দিয়েই ছেলেটা কোটি কোটি মেয়ের মনে জায়গা করে নিতে পারবে৷ সৃজিয়া ভাবছে যদি কণ্ঠ বিষয়ক কোনো প্রতিযোগিতা রাখা হয় তবে ছেলেটা অবশ্যই সেটায় প্রথম হবে৷ নোবেল প্রাইজ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো সেটাও পেয়ে যাবে৷ সৃজিয়া জবাবে হু-না কিছুই বলল না৷ চুপচাপ বসে থাকলো। ছেলেটা মৃদু হেসে বলল,
-এতো কি ভাবছো শুনি?
সৃজিয়া চট করেই জবাব দিলো, 
-তা শুনে আপনার কাজ নেই৷ 
-আমি শুনতেও চাচ্ছি না৷ তবে হাসি পাচ্ছে এটা ভেবে যে দেশের ভবিষ্যৎ কোনো ডাক্তারনী একটা নেকড়েকে দেখা মাত্রই ঠাস করে অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ হাউ ফানি! 
-ব্যাপারটা আপনার কাছে ফানি মনে হচ্ছে?
-অবশ্যই হচ্ছে৷ 
-তা তো হবার কথাই৷ মানুষ প্রাণ নিয়ে খেলেন যে! 
ছেলেটা চট করেই কিছু বলল না৷ আচমকা এমন কথার জন্যে প্রস্তুত ছিল না হয়তো৷ মুখ কালো করে কিছু সময় সৃজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ সৃজিয়া একবার আড় চোখে দেখলো। আহা! মুখটা কেমন বানিয়ে ফেলেছে! চেহারার সাথে তুষারের কণ্ঠস্বরটা পরিবর্তন হয়ে যায়৷ কেমন রূঢ়তা চলে আসে কণ্ঠে। বলে,
-সুপটা জলদি খেয়ে নাও। 
-আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। 
-ইচ্ছে না হলেও খেয়ে নাও৷ তোমার শরীর দূর্বল৷ 
-দূর্বল হলে আপনার কী?
তুষার কিছু বলল না৷ কেবল সৃজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল৷ আশ্চর্য! ছেলেটা রাগছে না কেন? ছেলেটা মনে হয় মানসিক ভাবে দারুণ স্ট্রং৷ নিজেকে বেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানে৷ ছেলেটা তাকিয়ে থেকেই বলল,
-তোমাকে কীভাবে খাওয়াতে হয় তা আমার বেশ জানা আছে৷
সৃজিয়া এমন ভাব করলো যেন কথাটা সে শুনতেই পারেনি৷ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো। তুষার 'ন্যানি' বলে ডাক দিলো। ঠিক সেই সময়ই কিছু একটা দৌড়ে আসার আওয়াজ পাওয়া গেল। ঠিক অজ্ঞান হওয়ার আগে নেকড়েটা দৌড়ে আসার সময় যেমন শব্দ হয়েছিল তেমন। সৃজিয়ার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো৷ আশ্চর্য! ছেলেটা করতে চাচ্ছে কী? নেকড়েটাকে ডাকার কী আছে? বিষ খাইয়ে যেহেতু মারবেই সেহেতু নেকড়ের কী প্রয়োজন! সৃজিয়া ভেবে পেল না। নেকড়েটা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। এসেই সে তুষার পেছেন দাঁড়ালো৷ তুষার বলল,
-খাওয়া খেতে বলছি খাও। না খেলে এইটা তোমাকে খেয়ে নিবে। 
সৃজিয়া কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আশ্চর্য ব্যাপার! যার মৃত্যু অবধারিত তাকে এমন ভয় দেখানোর কোনো মানে আছে? সৃজিয়ার কান্না পেলো৷ গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে বসে আছে কান্না গুলো৷ বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত রাখছে সে৷ হাসি মুখে মরে ছেলেটাকে উচিত শিক্ষা দিবে৷ সৃজিয়া মাথা নিচু করে রাখল৷ তবুও সুপের বাটিটা নিলো না৷ তুষার খানিকটা বিরক্তি ভরা স্বরে বলল,
-আশ্চর্য! তোমার মাঝে কী ডরভয় নেই? একটু আগেও তো এটাকে দেখে অজ্ঞান পড়লে! এখন এমন শক্ত হয়ে বসে আছো যে?
-মৃত্যুমুখী মানুষদের ভয় পেতে নেই৷ ভয়  পেলেই শত্রু পক্ষের জিত৷ আমি সেটা কিছুতেই চাই না৷ 
-কিহ? মৃত্যুমুখী যাত্রী মানে? 
-এমন ভাব করছেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না?
তুষার কিছু বলল না৷ সৃজিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সৃজিয়ার কেন জানি মনে হলো এই ছেলে তার মন পড়ে ফেলেছে৷ মনের সব কথা পড়ে নিয়েছে৷ এমনটা কেন মনে হলো সেটা সে জানে না৷ তবে মনে হলো কেবল! অবশ্য এমন অদ্ভুত অনেক কিছুই তার মনে হয়৷ তুষার হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। বলল,
-এতোক্ষন খামখা সময় নষ্ট করছিলাম৷ তোমার যে মনের ভয় এখনও যায়নি সেটা আমার আগে বোঝা উচিৎ ছিল। 
সৃজিয়া অবাক স্বরে বলল,
-মনের ভয় মানে? আপনি আমাকে খুন করবেন না?
-করার হলে তো সেই কখন করতাম৷ 
-মানে? আমি কিছুই বুঝছি না৷ 
-ওয়েট! আমি ক্লিয়ার করছি৷ 
-করুন।
-তুমি ভাবছো কাল রাতে নেকড়ে দ্বারা যে হত্যাকাণ্ডটা হয়েছে সেটা আমি করিয়েছে৷ মানে আমার এই নেকড়েটা করেছে৷ রাইট?
-হ্যাঁ৷ সেটাই তো! এটা তো আর...
-থামো। আমার কথা শেষ হয়নি৷ তুমি ভেবেছো, যেহেতু নেকড়ে তোমাকে খেয়ে ফেলেনি সেহেতু তোমাকে অন্যভাবে মারার প্ল্যান করা হয়েছে৷ সুপে বিষ মিশিয়ে তোমাকে মারা হবে৷ এই জন্যে তোমাকে ভয় পাচ্ছো না৷ মৃত্যুমুখী মানুষদের ভয় পেতে নেই৷ এতে তার শত্রুপক্ষ কিছুটা বিচলিত হবে৷ তাই তো?
সৃজিয়া কেমন বোকার মতো তাকালো৷ অবাক স্বরে বলল,
-এই কথাটা আপনি কীভাবে জানলেন?
-সেটা তোমার না জানলেও চলবে? 
-আশ্চর্য! এটা কেমন কথা? আপনি আমার মনের কথা গুলো পরপর করে বলে দিয়েছেন, আর আমি এটা জানতে পারবো না যে আপনি কীভাবে সেই কথা গুলো জেনেছেন?
কথাটা শেষ করেই সৃজিয়ার মনে হলো ছেলেটা মানুষের মন পড়তে পারে। অবশ্যই পারে৷ তা না হলে এই কথা গুলো সে কীভাবে জানলো? এটা তো অসম্ভব!
তুষার বলল,
-জগতের সব রহস্যের সমাধান খুঁজতে নেই৷ কিছু কিছু রহস্য অমীমাংসিত থাকা উচিত। 
-কিন্তু আমাকে সেটা জানতেই হবে৷
-এতোক্ষনে তুমি আমার অনেক রহস্য জেনে গিয়েছ৷ বাকি গুলো না জানাই ভালো৷ 
-ভালো কেন? 
-আকর্ষণ বাড়বে৷ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ প্রবল। 
সৃজিয়া রাগি দৃষ্টিতে তাকালো৷ তার ভীষণ মেজাজ গরম হচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে কিছু একটা দিয়ে ছেলেটার মাথাটা ফাটিয়ে দিক৷ কী সব আবোলতাবোল বলছে। তুষার হুট করেই বলল,
-আমি মোটেও আবোলতাবোল কিছু বলছি না৷ যা সত্য তাই বলছি৷ তোমার একটা ব্যাপারে ক্ল্যারিফিকেশনের প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে এই নেকড়ে আসলে আমার কাছে আসছে কোত্থেকে? তাই তো?
সৃজিয়া হ্যাঁ না কিছুই বলল না৷ সে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকলো তুষারের দিকে। এই ছেলে মন পড়তে পারে৷ এটা নিশ্চিত৷ তুষার বলল,
-তুমি প্রথমবার এসে আমার একটা কুকুরকে দেখেছিলে৷ মনে আছে? 'ন্যানি' নাম?
সৃজিয়ার ভ্রু কুচকে এলো।  বলল,
-হ্যাঁ৷ তা তো দেখেছিলাম। 
-আচ্ছা৷ আরেকটা ব্যাপার বলি। আমি যে জাদু জানি এই ব্যাপারটা তো তোমার অজানা নয়৷ রাইট?
সৃজিয়া কিছু বলল না৷ তুষার বলল,
-আচ্ছা৷ তুমি জানো না হয়তো৷ তবে শিগগিরই জানবে৷ ওয়েট এন্ড সি৷ 
কথাটা বলেই তুষার মনে মনে কিছু একটা পড়লো৷ তারপর বিছানার কাছে থাকা কাথাটা নিয়ে মেলে দিল নেকড়েটার গায়ে৷ তারপর সব কিছু খুব দ্রুতই ঘটতে থাকলো৷ নেকড়েটা ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকলো৷ একটা সময় তুষার কাথাটা সরিয়ে নিতেই সৃজিয়া দেখল সেই ছোট্ট কুকুরটি বসে আছে৷ কাথা সরাতেই সে দৌড়ে এলো তুষারের কাছে৷ পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল৷ তুষার তাকে কোলে নিয়ে বলল,
-জাদু কি পছন্দ হয়েছে?
সৃজিয়ার মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না৷ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না৷ এসব কীভাবে সম্ভব? আশ্চর্য ব্যাপার৷ তুষার বলল,
-আজকের নিউজ দেখে আমি নিজেও বেশ অবাক হয়েছি৷ এমন ঘটনা তোমাদের জন্যে আসলেই অবিশ্বাস্য। তবে...
সৃজিয়া অবাক হয়ে বলল,
-তবে?
-তুমি ডাক্তার। বললে এসব হুজুগে ব্যাপার বিশ্বাস করবে না। 
-হুজুগে ব্যাপার কেউই বিশ্বাস করবে না৷ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি বললেন, 'এমন ঘটনা তোমাদের জন্যে আসলেই অবিশ্বাস্য।' এখানে তোমাদের বলতে কী বুঝিয়েছেন? এই ঘটনা কি আপনার জন্যেও অবিশ্বাস্য নয়?
তুষার হাসলো। বলল,
-না। আমি ওঝা মানুষ। এসব ব্যাপারে কিঞ্চিৎ জ্ঞান আছে আমার। তাই এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার ধারণা আছে৷ তবে তোমরা সাধারণ মানুষ এগুলো বুঝবে না৷ 
-বুঝব না কেন? বললে তো অবশ্যই বুঝবো!
তুষার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো,
-সৃজিয়া, আমি তোমাকে তুমি-তুমি করে বলছি৷ এই ব্যাপারটা তুমি লক্ষ্য করোনি?
-কথা ঘুরাবেন না প্লীজ৷ 
-তোমার এখন যাওয়া উচিত। বাসায় চিন্তা করবে৷ 
-সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না৷ আপনি আমাকে বলুন। 
-আমার ভালো লাগছে না এখন। অন্য একদিন বলব। আজ না প্লীজ৷ 
সৃজিয়া কিছু বলল না আর৷ চোখ নামিয়ে নিলো৷ 
.
নুহাশ আর ইমি নামের এক কপোত-কপোতীকে দেখা যাচ্ছে৷ গভীর রাতে হাঁটার অভ্যাস এদের৷ অদ্ভুত অভ্যাস৷ এমন অভ্যাস এই পৃথিবীতে কারো আছে কি না কে জানে। আকাশ ভর্তি জোছনা৷ সেই জোছনায় জমিন লেপ্টে আছে। সবুজ গাছের পাতায় পড়ছে। পিচ ঢালা পথের উপর পড়ছে৷ সেই পথ মাড়িয়ে নগ্ন পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। পাশে পাঞ্জাবী পরা তার প্রেমিক। দু'জন দু'জনের হাত চেপে ধরে আছে৷ কী দৃঢ় সেই বন্ধন৷ কী আস্থা নিজেদের মাঝে৷ নুহাস বলল,
-রাত-বিরাত এমন অদ্ভুত ইচ্ছে মানুষের করে? 
-তোমার খারাপ লাগছে?
-না, তা নয়৷ 
-তাহলে বলছো যে?
-অবাক হচ্ছি। 
-অবাক হওয়া ভালো৷ 
মেয়েটা হাসলো। শব্দ করে হাসা৷ হাসিতে মুক্ত ঝরে যেন। ছেলেটা বলল,
-প্রায় পাঁচ বছর তোমায় জানি৷ সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে৷ কিন্তু কিছু ব্যাপার এখনও পরিবর্তন হয়নি৷ জানো সেগুলো কী?
মেয়েটা সব গুলো জানে৷ তবুও জানতে চায়৷ এই ছেলেটার মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে এতো ভালো লাগে! মেয়েটা বলে,
-কী সেগুলো?
-তোমার হাসি, হাসির শব্দ আর আমার হৃদয়ের সেই শব্দে বারবার কেঁপে উঠা৷ এতো সুন্দর! কী ভীষণ অনুভূতিময়। হাসিটা একদম হৃদয় ছুঁয়ে যায়৷ 
কথাটা শোনার পরই মেয়েটার কাঁদতে ইচ্ছে হয়৷ চোখে জল চলে আসে যেন। ছেলেটা এতো সুন্দর করে কথা বলে কেন? বলে,
-শাড়ির প্রশংসা কে করবে শুনি?
-সেই প্রশংসা আজ থাক৷ সব গুলো বলে ফেললে তোমার কান্না থামানো যাবে না৷ 
-খুব বুঝো আমায় তাই না?
-না বুঝলে কি এতোদূর আসা যায়?
এই বলে ছেলেটা থেমে যায়। মেয়েটাকে টেনে নেয় নিজের কাছে। বুকের ধারে মেয়েটা লেপ্টে যায়৷ আকাশের উজ্জ্বল চন্দ্রও যেন এদের এই খুনসুটিতে জ্বলে যায়৷ হিংসা হয়৷ ঠিক এমন সময় কাছে কোথাও শব্দ হয়৷ হিংস্র কোনো জানোয়ারের আওয়াজ। নুহাস আর ইমি থেমে যায়৷ একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে৷ 
.
চলবে...
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব
(চতুর্থ পর্ব)
.
নুরুজ্জামান বসে আছে তার রুমে। মাথায় চিন্তার শেষ নেই। পাঁচ জন মানুষ মারা গিয়েছে, আজ দু'দিন হলো, এই ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই তার কাছে৷ জবাব দিতে পারছে না মিডিয়ায়৷ উপর মহল থেকে চাপ আসছে। সে কী করবে বুঝতেই পারছে না৷ মাথা ভার হয়ে আসছে৷ ঠিক সেই সময়ই তার রুমে মজিদ আসলো৷ মজিদের চেহারায় চিন্তার ছাপ। মুখটা কেমন ভয়ার্ত হয়ে আছে৷ বলল,
-স্যার, ঝামেলা হয়েছে একটা৷ 
-কী ঝামেলা? 
-এই মাত্রই খবর এসেছে৷ দু'জন মানুষের লাশ পড়ে আছে রাস্তার উপর। লাশ দুটো চেনা যাচ্ছে না৷ চেহারা নাকি...
-থামো। আর বলতে হবে না৷ যাও, গাড়ি বের করো৷ আমি আসছি৷ 
মজিদ চলে গেল। নুরুজ্জামান বসে থাকলো। তার দেহ যেন শীতল হয়ে আসছে। সে যেন ধীরে ধীরেই জমে যাচ্ছে। এখান থেকে উঠতে মন চাচ্ছে না। এই লাশ গুলো দেখতে ইচ্ছে করছে না আর৷ এই জীবনে অনেক লাশ দেখেছে৷ কিন্তু কখনই এমন লাশ দেখেনি৷ গত কয়েকদিন যাবত সে ঘুমোতে পারছে না৷ ঘুমাতে গেলেই লাশ গুলো ভেসে উঠে চোখের সামনে৷ নুরুজ্জামান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বেরিয়ে গেল নিজের রুম থেকে৷ 
শিশির বসে অাছে নুরুজ্জামানের রুমে। তার সামনে চায়ের কাপ। কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে৷ নুরুজ্জামান চেহারে হেলান দিয়ে বসে আছে৷ তাকে কিছুটা শান্ত দেখাচ্ছে৷ চোখেমুখে চিন্তিত ভাবটা নেই। শিশির সিগারেট ধরালো৷ লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেটটা ছুঁড়ে মারলো নুরুজ্জামানের দিকে৷ নুরুজ্জামান খানিকটা উঠে এসে সিগারেটের প্যাকেটটা নিলো৷ সিগারেট বের করে ঠোঁটের কাছে চেপে ধরলো৷ তারপর লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো৷

নুরুজ্জামানের চিন্তার ভারটা শিশিরের উপর গিয়েছে৷ শিশিরকে ভীষণ চিন্তিত লাগছে৷ বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের একজন দুর্দান্ত গোয়েন্দা সে৷ আজ পর্যন্ত কোনো কেস বাকি রাখেনি৷ সব গুলোরই একটা পরিপূর্ণ সমাধান করেছে৷ সল্প সময়ে বেশ নাম কামিয়েছে ছেলেটা৷ এই কেসটা তাকে সম্প্রতিই দেওয়া হয়েছে৷ খুবই ইমিডিয়েট কেস৷ এর সমাধান দ্রুত করতে হবে৷ না করতে পারলে খবর আছে৷ 

শিশির এবং নুরুজ্জামান দুজনেই ছোট বেলার বন্ধু৷ ইন্টার পর্যন্ত একসাথে ছিল। এরপরই তাদের পথটা ভীন্ন হয়ে যায়৷ পাল্টে যায় দু'জনের লক্ষ্যও। আজ অনেক দিন পর এই কেসের দরুণ তাদের আজ দেখা হওয়া৷ 

নুরুজ্জামান এবার ঝুঁকে বসলো টেবিলের উপর৷ টেবিলের উপর কয়েকটা ছবি রাখা৷ প্রতিটি ছবিই নাম্বারিং করা৷ সে প্রথম চারটা ছবি এগিয়ে দিলো শিশিরের দিকে৷ শিশির এক চুমুকে চা'টা শেষ করে ছবি গুলোয় চোখ রাখলো। নুরুজ্জামান বলল,
-এই চারজন এক পরিবারের৷ 
কথাটা বলেই আরেকটা ছবি বাড়িয়ে দিলো এবং বলল,
-এ হচ্ছে একজন দেহ ব্যবসায়ী। নাম রুবিনা৷ সেই রাতেই মেরেছে একে৷ 
তারপর আরো দুটো ছবি বাড়িয়ে দিলো৷ এবার তাকে বলতে দিলো না শিশির৷ নিজেই বলল,
-নুহাস এবং ইমি৷ মন্ত্রির মেয়ে এবং তার জামাই। এদের গভীর রাতে হাঁটার অভ্যাস। সেই অভ্যাসই জম হয়ে দাঁড়ালো৷ আচ্ছা, তোর কী মনে হয়? এগুলো কি কোনো নেকড়ে করেছে?
নুরুজ্জামান আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
-হ্যাঁ৷ অবশ্যই। এই কেসের সব ডিটেইলস তো তাই-ই বলছে। 
-দেখ, আমি এসবে খুব একটা বিশ্বাসী নই। ভৌতিক কিছু ব্যাপার বিশ্বাস করা যায়৷ তবে এতো ড্রামাটিক ভৌতিক ব্যাপার অবিশ্বাস্য। যে ঘটনা মানুষ কল্পনা করে এসেছে এতো কাল, আজ সেটা বাস্তবরূপ নিয়েছে। কিন্তু সেটা কীভাবে? কীভাবে সেটা সম্ভব? 
-কী বলতে চাচ্ছিস?
-আমার অন্য কিছু মনে হয়।খুনিরা সব সময় ইউনিক কিছু করতে চায়৷ এমন কিছু যাতে মানুষ ঘাবড়ে যায়৷ তারা চায় তাদের নিয়ে আলোচনা হোক৷ মানুষের মনে তাদের নিয়ে ভয় জমুক৷ কৌতূহল জমুক। আবার তারা এও চায় যে তাদের কখনই কেউ ধরতে পারবে না৷ পুলিশ গোয়েন্দা টক্কর দিয়ে চলতে চায় এরা৷ এমনটা কারা করে জানিস?
-সাইকো? বলতে চাচ্ছিস সাইকোপ্যাথি? 
-আমার তেমন কিছুই মনে হচ্ছে৷ 
-তো সাইকো কি বিশেষ ক্ষমতা বলে তিন তালায় উঠেছে নাকি? আর বারান্দার গ্রিল যে ফাঁক করলো? আর এই যে আঙ্গ্যুলের চিহ্ন? তাছাড়া দু'জন সাক্ষীও আছে৷ 
-তাহলে আমাকে এটা বল যে নেকড়েটা তোর চাচার পরিবারের সকলকে মেরে ফেলল। কিন্তু তোর চাচাকে মারলো না কেন? 
নুরুজ্জামান খানিকটা থতমত খেয়ে গেল৷ কিছু বলতে পারলো না৷ শিশির বলল,
-তাছাড়া সে তেমন আক্রমণ করছে না৷ বুঝেশুনে আক্রমণ করছে৷ যেটা কোনো নেকড়ের পক্ষে সম্ভব না। নেকড়ে একবার মাঠে নামলে সামনে যতো মানুষ পাবে সলকেই চিবিয়ে যাবে৷ আজ পাঁচজন, দুদিন পর দু'জন। ব্যস এতটুকুই?
-তুই বলতে চাচ্ছিস সত্যিকারের নেকড়ে হলে আরো বেশি হত্যাকাণ্ড হতো?
-সেটাই তো স্বাভাবিক তাই না?
-হ্যাঁ৷ তা ঠিক৷ কথায় যুক্তি আছে৷ কিন্তু ভূতের ব্যাপারটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো না। বরং সকল প্রমাণ সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শিশির চুপ করে কিছু একটা ভাবলো৷ মাথায় চিন্তা ভর করছে৷ সে একে একে বিষয় গুলো আরেকবার ভাবলো৷ তারপর বলল,
-এসব ভূতপ্রেত তো আর আইন বিশ্বাস করবে না৷ আর আমরা যদি সেদিকেই তদন্ত করি তবে চাকরি হারাবার সম্ভাবনা আছে। 
-তো কী করবো আমরা?
-কী আর করার৷ যে পথ পাবো সে পথেই তদন্ত করে যাবো।
-তাহলে সেটাই শুরু করি। নাকি?
-হ্যাঁ। অবশ্যই৷
-তা কোথা থেকে শুরু করবো?
-একদম প্রথম থেকে৷ ধর শুরু করা হলো। রাত দুটো বাজে। দুটোর পরের কাহিনী বলা শুরু কর। 
নুরুজ্জামান কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো শিশিরের দিকে৷ তারপর বলল,
-রাত দুটো বাজে৷ দুটোর সময়ই একটা বিকট শব্দ হয়৷ কেমন পুরুষালী একটা শব্দ৷ 
-ওয়েট! শব্দ কোত্থেকে এলো? এই ব্যাপারটা তো আগে বলিসনি? 
-ব্যাপারটা প্রথমে আমলে নেইনি৷ কিন্তু দ্বিতীয়বার খুনের আগেও এমন চিৎকার শোনা যাওয়ায় বিষয় আমলে নিতে হচ্ছে৷ 
-তারমানে একটা পয়েন্ট পাওয়া গেল। খুনি খুন করার পূর্বে তীব্র একটা চিৎকার দেয়৷ তারপর নিশ্চয়ই নেকড়ে হয়ে যায়। রাইট! বাহ! একদম ফিল্মি৷ প্রথমে মানুষ। তারপর চিৎকার দিয়ে সেই মানুষ হয় নেকড়ে! দারুণ তো! 
-দেখ ব্যাপারটা মোটেও মজার নয়৷ এই কেসের সাথে এটি অবশ্যই কানেক্টেড।
-কীভাবে? চিৎকার তো যে কেউই দিতে পারে৷ 
-তাহলে দ্বিতীয় খুনের আগে চিৎকার শোনা গেল কেন?
-চিৎকার যে দিয়েছে সেই ব্যাপারে তুই নিশ্চিত হলি কীভাবে?
-এলাকার লোকজন বলেছে৷ কারো তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেকের৷ আর ওয়াচম্যানও বলছিল চিৎকারের কথা৷ 
শিশির খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-আচ্ছা৷ মানলাম। আমাকে এটা বল যে চিৎকারের উৎস খোঁজা হয়েছে? কোত্থেকে চিৎকার আসে?
-না৷ সেটা খুঁজিনি৷ 
-সেটা অবশ্যই খোঁজা উচিৎ। মজিদকে ডাক। তাদের দুটো টিমে ভাগ কর৷ দুই এলাকায় দুই দল পাঠা৷ চিৎকার কোন দিক থেকে শোনা গেছে ব্যাপারটা জান৷ যেদিকে মানুষের মতের সংখ্যা বেশি হবে তাদের সেদিকে যেতে বলবি৷ তারপর ওই জায়গাটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে বলবি৷ 
নুরুজ্জামান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো৷ বলল,
-সেখানে গিয়ে খুঁজবেটা কী?
-যেহেতু এইদিকটা ফিল্মি সেহেতু এদিক ফিল্মি স্টাইলেই তদন্ত হোক৷ যেহেতু প্রথমে মানুষের তীব্র চিৎকার শোনা যায় সেহেতু ধারণা করা যায় যে নেকড়েটা মানুষ থেকে নেকড়ে হচ্ছে৷ মানে ফিল্ম কিংবা প্যারানরমাল বই গুলোতে এমনই ঘটে৷ মানুষ নেকড়ে হয়ে যায়৷ তারপর খুন করে আবার মানুষ হয়ে যায়। রুপান্তরিত হয়৷ যাকে বহুরূপী বলা হয়৷ 'তাসফি আহমেদ' নামক এক লেখকের 'নেকড়ে মানব' নামে একটা বই আছে এমন৷ সেটাতে এমন কিছু কাহিনী ছিল৷ 
নুরুজ্জামান কিছুটা রাগি ভাবে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুই বোধহয় ব্যাপারটা সরিয়াসলি নিচ্ছিস না৷ 
শিশির কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,
-কীভাবে নেই বল? এমন কিছু আগে কখনই ঘটেনি৷ এসব বিষয় কীভাবে কী করব বুঝতেই পারছি না৷ তবে আমার সিক্স সেন্স হঠাৎ কেমন একটা তাড়া দিচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে তুই ওদের ওই এলাকায় পাঠা৷ নিশ্চয়ই কমন কিছু পাবি৷
-এমনটা কেন মনে হচ্ছে? 
-চিৎকারের ব্যাপারটা থেকেই বলছি৷ চিৎকারটা একই সময়ে শোনা গেছে৷ তাইই এমনটা মনে হচ্ছে।
নুরুজ্জামান আর কিছু বলল না৷ শিশিরের কথা মতো দুটো দল করা হলো এবং তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো৷

খানিকটা নীরবতা নামলো নুরুজ্জামানের রুমে৷ শিশির এবং নুরুজ্জামান কেউই কিছু বলছে না৷ শিশির আরেকটা সিগারেট ধরালো৷ নীরবতা ভেঙ্গে বলল,
-নুরু?
নুরুজ্জামানকে নুরু বলে ডাকে সে৷ 
-হ্যাঁ। 
-তোর শরীরের এই অবস্থা কেন? কেমন দূর্বল লাগছে তোকে। শুকিয়ে কী একটা অবস্থা। আবার চোখের নিচেও কালী৷ ঘটনা কী? 
নুরুজ্জামান ক্লান্ত স্বরে বলে,
-আর বলিস না৷ এই হত্যাকাণ্ড ঘটার পর থেকে ঘুমাতেই পারছি না৷ একদমই ঘুম আসছে না৷ চোখ বন্ধ করলেই লাশ গুলো ভেসে উঠে৷ 
-আঃ এটা তো মোটেও ভালো কথা নয়৷ ঘুম না হলে তো কাজ করা মুশকিল হয়ে যাবে৷ 
নুরুজ্জামান চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো৷ কিছুই বলল না। শিশির বলল,
-তোকে কিছু প্রশ্ন করছি৷ সঠিক জবাব দিবি।
নুরুজ্জামান ভ্রু কুচকে তাকালো৷ বলল,
-কেমন প্রশ্ন?
-তোর চাচার ব্যাপারে৷ 
-তোর কি উনার সন্দেহ হচ্ছে?
-সন্দেহ আমার সকলের উপরেই হয়৷ সেটা কথা না৷ আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানা প্রয়োজন৷ 
-আচ্ছা৷ প্রশ্ন কর৷ আমি জবাব দিবো৷ 
শিশির খানিকটা চুপ থাকলো৷ তারপর বলল,
-তোর চাচা মানুষটা রাগি সেটা আমি জানি৷ তিনি তোকেও যে দেখতে পারেন না সেটাও জানি৷ আমি জানতে চাচ্ছি উনার সাথে উনার ফ্যামিলির রিলেশন কেমন? 
-আছে। মোটামুটি ভালোই৷ 
-তুই সত্য বলবি বলেছিস৷ 
-মিথ্যা বলিনি তো!
-বলেছিস৷ উনার সাথে উনার ঘরের মানুষদের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না৷ বিশেষ করে আকরামের সাথে৷ 
নুরুজ্জামান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-একদম প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিস দেখছি।
-তুই জানিস আমি সব সময় হোম ওয়ার্ক করেই আসি৷ 
-হ্যাঁ৷ এটা সত্য যে আকরামের সাথে চাচার ঝামেলা হয়েছিল৷ আকরাম তার স্ত্রীকে পছন্দ করেনি৷ বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে৷ চাচা এক প্রকার জোর করেই ওকে ওই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছেন৷ 
-বিয়ে না করার কোনো কারণ আছে? আকরাম কাউকে পছন্দ করতো?
-আমার জানা মতে তেমন কেউ নেই৷ 
-তাহলে বিয়ে করতে নিষেধ করেছে কেন? আর তোর চাচাও বা কেন জোর করে তাকে ওই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছেন? মেয়েটার বাবা তোর চাচার বন্ধুও ছিলেন না যে বন্ধুর মেয়েকে ছেলের বউ বানাবেন!
-সেই ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট না৷ তবে আকরামের স্ত্রীরা বড় লোক ছিলেন৷ সেটা একটা কারণ হতে পারে৷ 
-আচ্ছা। তোদের সাথে তোর চাচাদের সম্পর্ক কেমন?
নুরুজ্জামান খানিকটা হেসে বলল,
-আমি ছাড়া বাকি সবার সাথেই ভালো। ছোট বেলা থেকেই আমি উনাকে ভয় পাই৷ আর উনিও কেন জানি আমাকে পছন্দ করেন না৷
-পছন্দ করেন না কেন? 
নুরুজ্জামান মাথা নামিয়ে বলল,
-সেটা আমি জানি না৷ 
শিশির কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো নুরুজ্জামানের দিকে৷ তারপর চোখ সরিয়ে নিলো৷ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়৷ এরপর বলল,
-এই গেল আকরামের ফ্যামিলির ব্যাপার৷ বাকি থাকলো ওই পতিতা এবং রাস্তায় পড়ে থাকা নুহাস আর ইমি নামের দুই তরুণ-তরুণী। 
-আকরামের কেসের সাথে এদের কোনো কানেক্ট পাচ্ছিলাম না আমি৷ 
-হ্যাঁ৷ সেটা ঠিক৷ তবে আমি রিসার্স করছি৷ তদন্ত সঠিক পথে গেলে এমন একটা সত্য বেরিয়ে আসবে যেটার কাছে এই নেকড়ের কাহিনীটা একদম চাপা পড়ে যাবে৷ হুলুস্থুল একটা কাণ্ড বেধে যাবে।
-মানে? কী বলতে চাইছিস?
-তোকে পরে বলব! আমার অনুসন্ধান শেষে। দেখা যাক কী হয়! 
ঠিক এমন সময় ফোন বেজে উঠে নুরুজ্জামানের৷ কল ধরতে ওপাশ থেকে শোনা যায়,
-স্যার, টিম ওয়ান রিপোর্টিং। আমরা এখানে কিছু পেয়েছি। 
-মানে? সন্দেহজনক কিছু?
-হ্যাঁ স্যার৷ 
নুরুজ্জামান উত্তেজিত স্বরে বলল,
-হাত লাগাবা না ওখানে৷ আমি আসছি। 
নুরুজ্জামান দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। বলল,
-তোর সন্দেহ সত্যি হয়েছে৷ ওখানে কিছু পাওয়া গিয়েছে৷ 
ঠিক তখনই আবার ফোন বেজে উঠে নুরুজ্জামানের৷ ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে শোনা যায়,
-স্যার, টিম টু রিপোর্টিং৷ আমরা এখানে কিছু পেয়েছি। সন্দেহজনক কিছু৷
কথাটা শুনেই খুশিতে চকচক করে উঠে নুরুজ্জামানের চোখ৷ অবশেষে তার সন্দেহই সঠিক হয়েছে। পৃথিবীতে ড্রামাটিক কিছু ঘটে গিয়েছে এই দু'রাতে৷ এই ব্যাপারে সে একদম নিশ্চিত। 
.
চলবে...
.
আমার আসলে এসব সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই৷ কিছু মন গড়া কল্পকাহিনী শোনাচ্ছি আপনাদের৷ লেখার হাতও বিশেষ ভালো নয়৷ তাই ভুল গুলো একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷ 
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব 
(পঞ্চম পর্ব)
.
শিশির বেশ ভালো করে দেখল জিনিস গুলো৷ একটা সাদা রঙের শার্ট। কালো একটা ট্রাউজার। সত্যি বলতে এগুলোকে শার্ট কিংবা ট্রাউজার বললে প্রকৃত শার্ট কিংবা ট্রাউজারকে অপমান করা হবে৷ এগুলোর প্রকৃত অস্তিত্ব নেই৷ শার্টটা ফেটে আছে৷ ট্রাউজার‍টাও৷ ছিড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা৷ অন্য আরেকটা প্যাকেটে একটা টি-শার্ট ও জিন্সের অবশিষ্ট পড়ে আছে৷ সেগুলোর অবস্থা না বলাই ভালো৷ তবে এটা অনুমান করা যায় যে এগুলো কারো ব্যবহার্য সামগ্রী। দুটো এলাকায় এই জিনিস গুলো পাওয়া যাওয়াটা আসলেই কেসটার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে৷ শিশির এবার আসলেই নেকড়ের ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে৷ তা না হলে ওই জায়গায় জিনিস গুলো পাওয়া যাওয়াটা অস্বাভাবিক। অবার স্বাভাবিকও হতে পারে৷ তবে ওই ঝোপের আড়ালে এসব পরিধেয় জিনিসপত্র এভাবে অবশ্যই ভাববার বিষয়৷ শিশির ভাবছে৷ জিনিসপত্র গুলো নিয়ে যাওয়া হলো ফরেনসিক ল্যাবে৷ সেখান থেকে কিছু একটা ক্লু পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা। শিশির চেয়ারে বসে পড়লো৷ তার সামনে বসে আছে নুরুজ্জামান। তার চেহারাটা খানিকটা মলিন। চিন্তিত। তবে বিশেষ নয়৷ সে বলে উঠল,
-তাহলে? এই পর্যন্ত কী দাঁড়ালো? আমার লোকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং সেখানে ছেড়া জামা কাপড় পেয়েছে৷ এই ব্যাপারে কী বলবি তুই?
শিশির খানিকটা চুপ থাকলো৷ তারপর খানিকটা হেসে বলল,
-ফরেনসিক রিপোর্ট আসতে কয়দিন লাগবে?
-দু'দিন তো লাগবেই৷ 
-আরো ফাস্ট করানো যায় না? 
-ফাস্ট করে কী হবে? জামাকাপড়ের ফরেনসিক রিপোর্ট কী আসবে?
শিশির হাসলো। বলল,
-জামাকাপড়ের ফরেনসিক রিপোর্ট নয়। তবে দারুণ একটা রিপোর্ট অবশ্যই আসবে৷ 
-দারুণ রিপোর্ট? মানে কী?
-তুই হয়তো খেয়াল করিসনি৷ জামাকাপড়ের সাথে কিছু সংখ্যক চুলও পাওয়া গিয়েছে৷ এখন চুলের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পেয়ে গেলেই আমার আসলে নেকড়ে বাবুকে পেয়ে যাবো। 
নুরুজ্জামান অবাক হয়ে হাসলো৷ হঠাৎই তার চেহারা যেন ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ সে খানিকটা জোরালো স্বরে বলল,
-ইয়েস! তাহলে তো কেসটা দারুণ ভাবে সলভ হয়ে যাবে৷ 
-আমারো তাই মনে হয়৷ তবে...
-তবে?
-মানুষ থেকে নেকড়ে হচ্ছে, ব্যাপারটা কেমন জানি৷ এটা কীভাবে সম্ভব বলতো?
নুরুজ্জামানকে খানিকটা চিন্তিত লাগল৷ সে বলল,
-এই ব্যাপারটা আসলেই চিন্তার৷ কীভাবে এসব সম্ভব? মানুষ কীভাবে নেকড়ে হয়?
-তুই ভূতপ্রেতাদিতে বিশ্বাস করিস?
-অল্প অল্প। 
-ভয় পাস?
-তেমন না। 
-আমিও এসব বিশ্বাস করি না৷ তবে কিছু ব্যাপার আছে অবশ্যই৷ ছোটবেলার কিছু কাহনী আমার স্পষ্ট মনে আছে এখনও৷ যে গুলো আমি হাজার যৌক্তিকতা দিয়ে সমাধান করতে পারিনি৷ 
-কেমন ঘটনা?
শিশির খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-এক রাতের কথা বলছি। আমাদের তখন টিনের ঘর৷ বাগানের কাছেই আমাদের বাসা৷ আমাদের আশেপাশে আরো ঘর ছিল। তবে আমাদেরটা একটা কোণায় পড়ে গিয়েছে৷ তো একদিন হলো কী, রাতের বেলা ঘুমাচ্ছি। রাত প্রায় একটা বাজে তখন৷ গ্রামে একটা বাজে মানে নিশুতি রাত৷ হঠাৎ আমাদের টিনের ঘরে টং করে একটা শব্দ হয়৷ যেন কেউ ইচ্ছে করে টোকা দিচ্ছে৷ আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষে। শব্দটা আমার রুমের পাশেই হলো৷ আমি আর মেজো ভাইয়া এক সাথে ঘুমাতাম। প্রথম প্রথম কেউ গায়ে মাখিনি৷ কিন্তু শব্দটা ধীরে ধীরে কেমন জানি তীব্র হয়ে উঠে৷ ঢেউ খেলানো টিনের উপর কেউ হাত বুলিয়ে যায় অনায়াসে। শব্দ হয়৷ আমাদের সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়৷ আমরা ভাবলাম চোরটোর কী না। সবাই এক সাথে জড়ো হয়ে গেলাম৷ শব্দ তখনও হচ্ছে। ঘরের পেছন দিকে থেকে শব্দ আসছে৷ আমরা প্ল্যান করলাম যে সামনের দরজা দিয়ে আমি আর মেজো ভাইয়া বের হবো৷ পেছনের দরজা দিয়ে বের হবে আব্বা। সবাই দৌড়ে যাবো৷ আমাদের আগমনে চোর বাবাজি হতভম্ব হয়ে যাবে৷ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করবে৷ আমরা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরবো৷ প্ল্যান মোতাবেক সব হলো৷ টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দৌড়ে গেলাম আমরা৷ নাই। পেছনে কেউ নেই৷ একদম খালি৷ হঠাৎই ঘরের পাশের সুপারি গাছটা নড়ে উঠলো৷ মৃদু হাসির শব্দ পেলাম যেন৷ আমরা দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকলাম। আয়তল কুরসি পড়ে গায়ে ফুক দিয়ে সবাই জড়ো হয়ে বসে আছি৷ সে এবার আমাদের চালের উপর উঠে এলো৷ এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটতে থাকলো৷ তার প্রতি কদমে শব্দ হয়। সেই শব্দ আমাদের মনে ভয় তোলে৷ আমরা সবাই জড়ো হয়ে বসে থাকি৷ কেউ কেউ ভয়ে কাঁপি৷ 
এতটুকু বলে শিশির থেমে যায়৷ নুরুজ্জামান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে৷ ঘরময় অদ্ভুত নীরবতা। ঠিক সেই সময়ে মজিদ এসে ডাক দেয়,
-স্যার? 
নুরুজ্জামান কেঁপে উঠে। কিছুটা লাফিয়ে উঠে যেন৷ ভিতু চোখ নিয়ে তাকায় মজিদের দিকে। তোতলাতে তোতলাতে বলে,
-ক-ক-কী? কী হয়েছে?
শিশির হাসে। হাসিতে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে তার৷ নুরুজ্জামান অবাক হয়। বলে,
-হাসছিস কেন?
-তোর এমন অবস্থা দেখে৷ শালা মিথ্যা একটা গল্পে তুই এতো ভয় পেয়ে গেলি?
এই বলে সে আবার হাসে৷ পকেট হাতড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে। সিগারেট ধরায়৷ নুরুজ্জামান রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে৷ তার রাগ হয়৷ ছেলেটা ওকে বোকা বানাচ্ছে?
শিশির আবার বলে,
-তোকে একটা হাস্যকর কাজ করতে হবে?
নুরুজ্জামান রাগি স্বরে বলে,
-কী কাজ?
-রাগিস না৷ দুষ্টামি করছিলাম৷ 
-কাজটা কী?
-আশেপাশের প্রত্যেকটা থানায় এলার্ট করে দে৷ নাইট ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর৷ যেহেতু চিৎকারের আওয়াজ এই শহর থেকেই শোনা যায় তাই পরবর্তিতে শহরের ভেতরে কোথাও এই চিৎকারটা শোনা যাবে৷ চিৎকার শোনা গেলেই ওই এলাকায় পুলিশ উপস্থিত হবে৷ এর আগে এলাকাবাসীকে এলার্ট করে দিবি৷ ঠিকাছে?
-উপরমহলে আলোচনা করতে হবে৷ সে অনেক ঝালেমা৷ তুই তোর স্যারকে কল কর। তিনি বললে দ্রুতই ব্যবস্থা হবে৷ 
শিশির কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো নুরুজ্জামানের দিকে৷ তারপর বলল,
-পুলিশে জয়েন করেছিস কেন? এতো ভীতু মানুষ হয়?
নুরুজ্জামান মাথা চুলকালো৷ সে খানিকটা ভীতু৷ এটা সে বিশ্বাস করে৷ এই জন্যেই হয়তো প্রমোশন হয় না৷ 
.
রাতের প্রায় দেড়টা বাজে৷ শহরের প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ রাত দশটার আগেই সকলকে নিজের ঘরে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে৷ রাতে যেন কেউ না বের হয়৷ গভীর রাত্র বের হওয়া মানে মৃত্যুকে মুখে নিয়ে বের হওয়া৷ অবশ্য এর আগেই মানুষ সাবধান হয়ে গিয়েছে৷ সন্ধ্যার পরেই মানুষজনের দেখা খুব একটা পাওয়া যায় না৷ কিছু উঠতি বয়সি তরুণ তরুণী অবশ্য ব্যাপারটা আমলে নিচ্ছে না৷  তাদের মাঝে এসবের ভাবান্তর নেই৷ মৃত্যুকে তার ভয় করে না৷ তবুও সাবধান করা হচ্ছে সকলকে৷ প্রয়োজনে লাঠি চার্জের অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ এসবই দেখাচ্ছিল টিভিতে৷ মীরা বেশ কিছু সময় টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ তার মনের ভেতর হটাৎই এক প্রকার ভয় দেখা দিয়েছে৷ রাতের প্রায় দেড়টা বাজে, সে এখনও তার অফিস কক্ষে বসে আছে৷ এভাবে তার কখনও বসে থাকতে হয়নি৷ আজ হচ্ছে৷ হওয়ার কারণ হচ্ছে আজ ওই নেকড়েটার কিছু জামাকাপড় এসেছে ওদের অফিসে৷ সেখানে কিছু চুল পাওয়া গিয়েছে৷ চুল গুলোর পরিক্ষা চলছে তাদের ল্যাবে৷ ল্যাবে এক মাত্র সে আর তার সিনিয়র মতিউর রহমান আছেন। মতিউর রহমানের বয়সে প্রায় পঞ্চাশ এর উপর৷ তিনি আপাতত চুল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছেন৷ উপরমহল থেকে আদেশ এসেছে, এই রিপোর্টটা যতো জলদি সম্ভব বের করতে৷ যার কারণেই আজকে এতো রাত পর্যন্ত অফিসে থাকা৷ মীরার বাড়ির সকলে তাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে৷ কিছুক্ষণ পর পরই ফোন দিচ্ছে৷ কখন আসবে, কখন পৌঁছাবে এসব নিয়ে৷ মীরা এবার যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আছে৷ মোবাইল ফোন বন্ধ করে বসে  আছে টিভির রুমে৷ বিরক্তি লাগছিল বলেই আসলে টিভির রুমে আসা৷ এখন মনে হচ্ছে এই রুমে এসে বেশ অপরাধ করেছে সে৷ এসেই নেকড়ের উত্তপ্ত নিউজটা দেখতে হলো৷ দেখার পর থেকে তার ভয় করছে৷ গা শিউরে উঠছে যেন৷ তার মনে হচ্ছে আজ রাতটা এখানে থাকা ঠিক হয়নি। বাড়তি কিছু টাকা পাওয়ার আশায় এখানে থাকাটা অন্যায় হয়েছে৷ কে জানে কখন আবার নেকড়ের সামনে পড়তে হয়৷ তাছাড়া বাড়ি পৌঁছানো নিয়েও খানিকটা ঝামেলা রয়েছে৷ তার স্যার বলেছেন তাকে বাসায় ড্রপ করে দিবেন। এখন মনে হচ্ছে সেই কাজটা হবে না৷ স্যার খুব রেগে আছেন৷ রেগে থাকলে উনি এমন কথা দেওয়া ব্যাপার গুলো ভুলে যান৷ কিংবা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়েও বলা যাবে না৷ অন্তত মীরা এই কাজটা করতে পারবে না৷ সে স্যারকে খুব ভয় পায়৷ আর মতিউর রহমান সাহেবও যথেষ্ট রাগি৷ যদি সত্যি এমন কিছু হয় দারুণ একটা সমস্যায় পড়বে মীরা৷

মতিউর রহমান সাহেব রেগে থাকার কারণ আছে৷ তার ছোট ছেলে বাইরে কোথাএ গিয়েছে৷ বন্ধুদের সাথে পার্টি আছে নাকি৷ এদিকে দুনিয়া উল্টে যাচ্ছে অন্যদিকে তারা আছে পার্টি নিয়ে৷ এটা শোনার পরই রেগে আছেন তিনি৷ তারচে বেশি রেগে আছেন নিজের স্ত্রীর উপর৷ উনার স্ত্রীর সহয়তায়ই ছেলেটা বাইরে গিয়েছে৷ তা না হলে ছেলের বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ ছেলে তাঁকে যথার্থ ভয় পায়৷ এখন এতো রাত হয়েছে, ছেলে ঘরে ফিরছে না, এই নিয়ে বেশ ভালো চিন্তায় পড়লেন উনার স্ত্রী৷ কিছুক্ষণ আগে স্ত্রী ফোন করে বললেন,
-হ্যালো?
তিনি কাজের সময় ফোন ধরেন না৷ উনার স্ত্রী রাহেলা এক বার নয়৷ প্রায় কুড়িবার ফোন দিয়েছে। বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করে বললেন,
-ব্যস্ত আছি এখন৷ পরে কথা বলি! ডিস্টার্ব করো না৷ 
রাহেলা কান্না শুরু করে দিলেন৷ মতিউর রহমান অবাক হয়ে বললেন,
-কাঁদছো কেন?
-মাহির এখনও ঘরে ফিরেনি৷ 
মাহির উনার ছেলের নাম৷ সে ঘরে ফিরেনি শুনেই রাগটা চড়ে গেল মাথায়। তবুও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কোমল স্বরে বললেন,
-কোথায় গিয়েছে?
-অর্নবদের বাড়িতে আজ পার্টি ছিল। সেখানে৷ 
তিনি যথেষ্ট কোমল স্বরে বললেন,
-আমি তাকে রাতে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছি। সে আমার কথা অমান্য করে যায় কীভাবে? তাকে ওখানে যাওয়ার অনুমতি দিলো কে?
রাহেলা ভেজা স্বরে বললেন,
-অর্নব বেশ জোরাজোরি করেছিল৷ তাই আমি না করতে পারিনি। 
-অর্নব যে জোরাজোরি করেনি সেটা আমি বেশ ভালো করেই জানি৷ তুমি তাকে বাধাই দাও৷ নিশ্চয়ই এটা বলেছো যে, "তোর বাপকে আমি সামলে নিবো।" তাই না?
রাহেলা কিছু বললেন না৷ চুপ হয়ে গেলেন৷ কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছে না৷ যেন উনার চালাকিটা ধরা পড়ে গেল৷ মতিউর রহমান বেশ স্বাভাবিক এবং নরম স্বরে বললেন,
-তোমরা আমার কথা শুনো না৷ আমার কথার গুরুত্বটা বোঝো না৷ এটা ঠিক করোনি৷ মায়ের মায়া ভালো। তবে অতিরিক্ত ভালো নয়৷ এখন এক কাজ করো৷ আলমারি থেকে বিদেশি টর্চটা বের করে বেরিয়ে পড়ো রাস্তায়৷ খোঁজো ছেলেকে।রাখছি আমি। 
এই বলে তিনি ফোনটা রেখে দিলেন৷ ফোন বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখলেন৷ এই অবস্থায় তাকে কেউ রাগান্বিত বলবে না৷ তবে যে উনার পাশে থাকবে, যাবে, তার উপর কিছুটা আঁচ আসবে৷ এই যেমন মীরার উপর আসলো৷ মীরার ফোন বাজছিল৷ একবার, দুবার, তিনবার। মতিউর রহমান রেগে গেলেন। চিৎকার দিয়ে বললেন,
-এই স্টুপিড মেয়ে? তোমার ফোন কি তুমি আছাড় মারবে নাকি আমি মারবো? 
এতো জোরে চিৎকার দিলেন যে মীরা ভয়  পেয়ে গেল। ভয় পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। 

মীরা আবার ল্যাবের ভেতর ঢুকলো৷ ঢুকতেই দেখলো মতিউর রহমান সাহেব ঝুকে পড়ে কিছু দেখছেন৷ মীরা এপ্রোন, গ্লাবস এবং গ্লাস লাগিয়ে এগিয়ে গেল। ঠিক সে সময়ই দরজা ভাঙ্গার আওয়াজ পেলো সে। মতিউর রহমান মাথা তুলে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এই রুমের দরজাটা ভেঙ্গে ফেলল কেউ৷ দরজা গলে রুমে প্রবেশ করলো বিশালাকার নেকড়েটা৷ সেটি হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ মতিউর রহমান এবং মীরা দু'জনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তারা যেন জীবনের সেরা অবাক হচ্ছেন আজ। এমন কিছুর জন্যে এরা কেউই প্রস্তুত ছিল না৷ নেকড়েটা হঠাৎই 'উ' করে তীব্র একটা চিৎকার দিলো৷ সেই চিৎকারে ক্যামিকেলের জার গুলো নড়ে উঠলো। সমস্ত রুমটা কেঁপে উঠলো যেন। নেকড়েটা আর অপেক্ষা করলো না। দৌড়ে এলো মতিউর রহমানের দিকে। মতিউর রহমান কী করবেন ভেবে পেলেন না৷ তিনি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন। একটু আগে তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন৷ ছেলেটা কোথায় আছে না আছে এসব নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন। নেকড়েটা কোনো ক্ষতি করে বসলো না তো এমন কিছুও ভেবেছেন। এখন তাঁর চিন্তা হচ্ছে না৷ উনার কাছে নিশ্চিন্ত লাগছে। উনার মনে হচ্ছে উনার ছেলে এখন ভালো ছেলে। সুরক্ষিত আছে৷ এই মূহুর্তে এই একটা খবরই তার জন্যে সুখকর৷ কে জানে হয়তো জীবনের শেষ খুশির খবর এটা। এতেই তিনি খুশি৷ শেষ মূহুর্তে তার ছেলেটাকে দেখার ভীষণ ইচ্ছে হলো৷ ইশ! যদি কোনো উপায়ে ছেলেটাকে একবার দেখা যাতো! 
.
চলবে...
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব। 
(ষষ্ঠ পর্ব)
.
মীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখে রাজ্যের ভয়৷ জল জমে আছে। চেহারা ফ্যাকাসে। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে৷ সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার হার্টবিট যথার্থ ফাস্ট। সে হুট করেই মেঝেতে পড়ে গেল। তবে জ্ঞান হারালো না৷ তার ভীষণ দূর্বল লাগতে থাকলে৷ মুখ দিয়ে একটু শব্দও বের হচ্ছে ন৷ সে নির্বিকার হয়ে দেখলো নেকড়েটা মতিউর রহমান সাহেবকে একবার টেবিলের উপর তো অন্যবার পশ্চিমের দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারছে। মতিউর রহমান যেন খেলার পুতুল। নেকড়েটা অনেকদিন পর দারুণ একটা পুতুল পেয়েছে৷ সেই পুতুল দিয়ে বেশ আনন্দের সহিত খেলছে৷ মতিউর রহমান সম্ভবত বেঁচে নেই। তাঁর মাঝে কোনো প্রকার চেতনা দেখা যাচ্ছে না৷ কোনো আর্তনাদ নেই৷ 

রুমের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে। ক্যামিকেলের জার গুলো পড়ে ভেঙ্গে গিয়েছে৷ মেশিন গুলোর অবস্থা যাচ্ছে তাই৷ মীরা স্তব্ধ হয়ে মেঝেতে বসে থাকলো। নেকড়েটার একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগল তার৷ এটি স্পষ্ট মানুষের মতো দাঁড়াতে পারে৷ আরেকটা অবাক করা ব্যাপার হলো এটির পাঁ ক্যাঙ্গারুর মতো৷ হাত বানরের মতো৷ বাকি সব নেকড়ের মতো। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। এমন নেকড়ে পৃথিবীতে থাকতে পারে বলে তার ধারণায় নেই৷ 

নেকড়েটা যখন নিশ্চিত হলো যে মতিউর রহমান বেঁচে নেই তখন সে ঘুরে দাঁড়ালো৷  তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে চলে যাবে৷ তার কাজ শেষ৷ কিন্তু হঠাৎ চোখ গেল মীরার উপর৷ সে মীরার দিকে তাকাতেই স্থির হয়ে গেল৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো৷ তাকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এটা অনুমান করা যাচ্ছে যে সে মীরাকে দেখে বেশ খুশি হয়েছে৷ সে এক পা, দু পা করে এগিয়ে আসছে৷ সে যতই এগিয়ে আসছে মীরার হার্টবিট ততো ফাস্ট হচ্ছে৷ সে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে৷ তার নিচের ঠোঁটটা অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে৷ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। গা গুলিয়ে আসছে যেন। নেকড়েটা একদম তার কাছে চলে এলো৷ মাথা নিচু করে মুখটা মীরার মুখের কাছে নিয়ে এলো৷ তার গা থেকে অস্বাভাবিক স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ আসছে৷ গন্ধটা মীরার নাক দিয়ে সোজা পেটে চালান হয়ে গেল৷ অমনি পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠলো তার৷ বোমি আসবে যেন৷ 

নেকড়েটা ধীরে ধীরে হাত বাঁড়িয়ে আনলো মীরার দিকে৷ মীরাকে টান দিবে ঠিক তার আগেই কারো গলার স্বর ভেসে এলো৷ 
-খবরদার, ওকে ধরবে না?
নেকড়েটা চট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো৷ মীরাও দেখলো, পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে যুবক বয়সি একটা ছেলে। যার তীক্ষ্ণ চোখ নেকড়েটার দিকে৷ পিস্তল তাক করে আছে। যুবকটি হলো শিশির। সে আরো দু'কদম এগিয়ে এলো। নেকড়েটা এবার শিশিরের দিকে ফিরে তাকালো৷ দেখে মনে হচ্ছে বেশ রেগে গিয়েছে সে৷ শিশিরকে সে মোটেও এখানে আশা করেনি৷ সে তার দাঁত বের করে গোঁ করে একটা শব্দ করলো৷ তারপর তার সামনে থাকা ভাঙ্গা একটা মেশিন ছুড়ে মারলো শিশিরের দিকে৷ শিশির আচমকা এমন আক্রমনে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল। তবুও নিজেকে সামলে সে দ্রুত সরে দাঁড়ালো৷ মিশিনটা গিয়ে পড়লো দরজার কাছে৷ শিশির সরে গিয়ে ঘাড় ঘুরানোর সময়টাও পেলো না৷ নেকড়েটা ততোক্ষণে ওর সামনে চলে এসেছে। ওরা গলা চেপে ধরেছে৷ জোরে পিশে ধরেছে মেঝের সাথে। শিশিরের হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল। সে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ তবে পারছে না৷ তার গলাটা বসে এসেছে যেন৷ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে৷ 

ঠিক এমন সময় পুলিশ বাহিনী এলো৷ বাহিনীতে সদস্যের সংখ্যা কম। মাত্র সাতজন। মাত্র সাতজন কেন এলো এই ব্যাপারটা বুঝা গেলো না। এতো বড় একটা ব্যাপার কিন্তু পুলিশ এলো মাত্র সাতজন! শিশির মজিদকে ফোন করে জানিয়েছে যাতে সব জায়গায় এলার্ট করে দেওয়া হয়। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া র‍্যাবকে জানানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। মজিদকে বলে শিশির মোটামুটি নিশ্চিত ছিল আজ নেকড়েটাকে ধরা যাবে৷ ধরতে না পারলেও গুলি করে দিবে৷ এরপর যা হবার হবে৷ সে ভেবেছিল এই বিল্ডিংয়ের চারপাশ পুলিশের ঘেরাটোপে থাকবে। অনেক পুলিশ অফিসার আসবে। কিন্তু সেসবের কিছুই ঘটল না। ঘটল কেবল সাতজনের আগমন। শিশির অবাক হয়ে দেখল এই বাহিনীতে মজিদ নেই৷ সে বেশ হতাশ হলো। এই বাহিনী এসেই পিস্তল তাক করে রাখলে নেকড়েটার দিকে৷ নেকড়েটা চট করেই কী করবে বুঝতে পারছিলো না৷ সে শিশিরের গলা ছেড়ে দিলো৷ তারপর কী মনে হতেই সে শিশিরকে তুলে ধরে ছুড়ে মারলো পুলিশ বাহিনীর দিকে৷ পুলিশ বাহিনী এমন আক্রমনে হতভম্ব৷ তারা কী করবে বুঝতে পারলো না৷ সরেও কূল পেলো না৷ তাদের গায়ের উপর এসে পড়লো শিশিরের দেহ। সাথে সাথে কতোগুলো চিৎকার হলো এক সাথে৷ সবাই মেঝেতে পড়ে গেল। তাদের গা ডিঙ্গিয়ে চলে গেল নেকড়েটা৷ দৌড়ে সে কোথাও হারিয়ে গেল৷ 

পুলিশ বাহিনী উঠে দাঁড়ালো কোনো মতে৷ শিশিরকে ধরে বসালো তারা৷ শিশির কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল,
-আপনারা আমাকে ছাড়ুন। নেকড়েটার পিছু করুন। জলদি।
পুলিশ বাহিনী শিশিরকে ছেড়ে দিলো৷ দৌড়ে গেল নেকড়ের গমন পথের দিকে৷ শিশির দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলো৷ জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলো৷ বাঁ'হাতের কনুইতে ব্যাথা পেয়েছে সে৷ দারুণ ব্যাথা করছে৷ সে মীরার দিকে দূর্বল দৃষ্টিতে তাকালো৷ মীরা ততোক্ষণে উঠে বসেছে। সে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনি ঠিকাছেন?
মীরা উঠে এলো৷ তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না৷ কেমন জানি কাঁদতে ইচ্ছে করছে৷ সে বহু কষ্টে নিজের কান্না চেপে ধরে আছে৷ আজ এই মানুষটা না এলে সে নিশ্চিত মারা যেতো৷ তার মানুষটার প্রতি মায়া হলো ভীষণ। সে কাঁপাকাঁপা পাঁয়ে এগিয়ে এলো শিশিরের দিকে। শিশিরের কাছে এসে বলল,
-আপনি ঠিকাছেন?
শিশির দূর্বল স্বরে বলল,
-দেখছেন তো অবস্থা! হাত-পা সব অবশ লাগছে।
ঠিক সে সময়েই রুমে এলো নুরুজ্জামান। তার পরনে লুঙ্গি আর একটা সেন্ড্রো গেঞ্জি৷ সে ঘেমে একাকার। দৌড়ে এসেছে যেন৷ হাঁপাচ্ছে। তাকে দেখে ভীষণ চিন্তিত লাগছে। সে এসেই শিশিরকে জীবিত দেখে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ বন্ধ করে ফেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস। সে শিশিরের কাছে বসে বলল,
-তুই ঠিকাছিস? দেখি কই ব্যাথা পেয়েছিস?
শিশির মৃদু হাসলো। বলল,
-আমার কথা বাদদে৷ তুই আগে তোকে দেখ৷ কী পরে এসেছিস এগুলো?
-আরে কে জানতো যে নেকড়ে ব্যাটা আজ এ্যাটাক করবে? জানলে শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুমাতাম৷ এখন হঠাৎ আক্রমণের খবর পাওয়াতে উঠেই দৌড়ানো শুরু করেছি৷ কী পরেছি না পরেছি এসবের খবরই ছিল না৷ 
-তা আমি যে এতোগুলা কল দিলাম?
-তুই তো জানিসই আমার ঘুম সম্পর্কে। খুব ভারী। দেখি চল! তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। আপু, আপনি ঠিকাছেন? কোথাও লাগেনি তো?
মীরা হঠাৎ এমন প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না৷ সে মৃদু স্বরে বলল,
-হ্যাঁ। তবে...
-তবে?
-আমার স্যারকে মেরে ফেলেছে সে৷ ওই যে! স্যার পড়ে আছেন৷ 
শিশির এবং নুরুজ্জামান একসাথে তাকালো৷ তারা দেখলো যে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে মেঝেতে৷ 
.
শিশির হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তার পাশে বসে আছে নুরুজ্জামান। সে একটা আপেল কেটে দিলো শিশিরকে। বলল,
-হাতের কী অবস্থা?
-মোটামুটি৷ মোচকে গিয়েছে তো! তাই চাপা ব্যাথা করছে। 
-ব্যান্ডেজ কয়দিন রাখতে হবে?
-বেশি দিন না৷ জটিল চোট নয়৷ ব্যান্ডেজ না করলেও চলতো৷ 
-আচ্ছা তুই রাতে খবর পেলি কীভাবে যে ফরেনসিক অফিসে আজ আক্রমণ হবে? 
-আমার হোটেল ওখান থেকে বেশি দূরে নয়। 
-তা তো জানি৷ কিন্তু খবর পেলি কীভাবে? 
-আমি আসলে তখন হোটেলে ফিরছিলাম৷ এমন সময় চিৎকারটা শুনলাম। ল্যাবের সামনে আসতেই দেখি ভেতরে কিছু একটার শব্দ হচ্ছে৷ তাই সাতপাঁচ না ভেবে চলে গেলাম ভেতরে৷ গিয়ে দেখলাম মেয়েটার উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে নেকড়েটা। তখনই আমি তাকে বাধা দিলাম এবং সে আমার উপর আক্রমণ করে বসলো। আচ্ছা মেয়েটার খোঁজ নিয়েছিস আর?
-নাহ৷ তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়েছিলা রাতে৷ এরপর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
-মজিদ কই?
-কেন?
-এ হাদারামকে পুলিশের চাকরি দিয়েছে কে?
নুরুজ্জামান কোমল স্বরে বলল,
-রাগিস না৷ সে নিজেও আমার মতো ভীতু। আমাকে বলা ছাড়া কিছু করবে না৷ 
-পুলিশের যে তো বাজে অবস্থা তা তোদের না দেখলে বুঝতাম না৷ দায়িত্বের প্রতি এতো অবহেলা কেন তোদের? 
নুরুজ্জামান কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রাখল। শিশির বলল,
-ওদের যে আমি নেকড়েটার পিছু করতে বলেছিলাম ওরা সেটা করেছে?
নুরুজ্জামান মাথা তুলে জবাব দেয়,
-হ্যাঁ। পিছু নিয়েছিল। তবে ধরতে পারেনি৷ লোকটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। 
-লোকটা মানে?
-নেকড়েটাকে ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখেছিল। ওরা পিছু করছিল। কিন্তু সেই অন্ধকার থেকে যখন ওটা কিছুটা আলোয় গেল তখন তারা অবাক হয়ে দেখলো যে একটা উলঙ্গ ব্যাক্তি দৌড়ে যাচ্ছে৷ ওরা পিছু করেছে বাট ধরতে পারেনি৷ 
শিশির অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-ওদের দ্বারা তাকে ধরা সম্ভবও না৷ লজ্জা হওয়া উচিৎ তোদের। 
নুরুজ্জামান কিছু না বলে চুপ করে থাকল।
.
একদিন পেরিয়ে গিয়েছে৷ এই একদিনে শিশির অনেক ভাবলো৷ অনেক ভেবে একটা উপায় বের করলো৷ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একজন ওঝার সাথে দেখা করবে যে ভূতপ্রেতাদিতে বিশেষ জ্ঞান রাখেন৷ এমন একজন মানুষের খোঁজ সে পেয়েও গিয়েছিল৷ নাম তুষার আহমেদ৷ এর নামে অনেক গল্প শুনেছে৷ যাক, কাজের উদ্দেশ্যে এই মানুষটাকে দেখাও হয়ে যাবে। 

এই মূহুর্তে শিশির এবং নুরুজ্জামান দাঁড়িয়ে আছে তুষারের ঘরের সামনে৷ তারা কলিংবেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও দরজা খোলা হয়নি৷ খোলার কোনো লক্ষনও পাওয়া গেল না। নুরুজ্জামান আবার কলিং বেল চাপ দিবে ঠিক তার আগেই দরজাটা খুলে গেল৷ দরজা খুলতেই তারা দেখল একটা যুবক বয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স তাদের চেয়ে কম৷ কম হলেও ছেলেটাকে অদ্ভুত লাগল তাদের৷ কেন এমন লাগল তারা সেটা বলতে পারলো না৷ তবে অদ্ভুত লাগল। বিশেষ করে এর চোখ দুটো অসাধারণ। এটা বলতেই হবে৷ নুরুজ্জামান বলল,
-এটা কী তুষার সাহেবের বাসা?
তুষার কোমল স্বরে জবাব দিলো,
-হ্যাঁ৷ কোনো দরকারে এসেছিলেন?
-হ্যাঁ৷ উনার সাথে আমাদের মিটিং ছিল আজ৷ আমি নুরুজ্জামান। এই থানার ওসি৷ আর ইনি হচ্ছেন শিশির আহমেদ। গোয়েন্দা অফিসার। 
তুষার হাসলো। বলল,
-অহ। সরি৷ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলাম৷ প্লীজ ভেতরে আসুন৷
নুরুজ্জামান এবং শিশির ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করতেই তাদের অদ্ভুত রকম একটা শীতলতা অনুভব হলো৷ কেমন জানি ভালো লাগতে থাকলো৷ মনের ভেতর যেন প্রশান্তির দরজাটা খুলে গেল চট করেই। কিন্তু সেই প্রশান্তিটা বেশিক্ষণ টিকলো না। তুষার দরজা আঁটকাতেই হঠাৎ লাইট গুলো জ্বলতে-নিভতে থাকলে। তুষারের ছোট্ট কুকুরটি দৌড়ে এলো৷ শিশির এবং নুরুজ্জামানদের দেখতেই ঘেউঘেউ করে উঠলো৷ অস্বাভাবিক চিৎকার করতে থাকলো কুকুরটা। এদিকে লাইট গুলো যেন কাঁপছে৷ কাঁপাকাঁপা ভাবে জ্বলছে। নিভছে৷ হঠাৎই তাদের মনে হলো পুরো ঘরটাই নড়ে উঠছে। তুষার ভীষণ অবাক হলো। তার অবাক হওয়ার সীমা থাকলো না৷ নুরুজ্জামান খানিকটা ভয় পেয়ে গেল৷ সে থমথমে চেহারায় তাকিয়ে আছে৷ শিশির কী করবে বুঝতে পারছে না৷ সে পেছন ফিরে তুষারের দিকে তাকালো৷ বলল,
-এসব কী?
তুষার কিছু বলল না৷ ভেতরে চলে গেল৷ নুরুজ্জামান নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলো। শিশির খানিকটা এগিয়ে দেয়ালের একটা পেইন্টিং দেখলো৷ বিশালাকার একটা নেকড়ের পেইন্টিং। তবে এই নেকড়েটা তার দেখা নেকড়ের মতো না। এটি সত্যিকারের নেকড়ের মতো৷ পেইন্টিংটা তার কাছে কেমন জীবিত মনে হলো। সে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলো৷ তার কাছে মনে হলো নেকড়েটা জীবিত। সত্যি সত্যি সে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ এই যেন দৌড়ে এসে মাথাটা ছিড়ে নিবে৷ শিশির চিত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকলো৷ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নুরুজ্জামান। সেও অবাক হয়ে নেকড়েটাকে দেখছে৷ ঠিক তখনই তুষার এলো। বলল,
-দুঃখিত স্যার৷ মেইন লাইনটা খানিকটা সমস্যা করছিল। আসুন। বসুন প্লিজ। 
শিশির বলল,
-এই পেইন্টিংটা কোত্থেকে কিনেছো?
তুষার বলল,
-এটি আমার করা পেইন্ট৷ ওই যে, ওই দেয়ালের ঈগলটাও৷ 
নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে বলল,
-বাহ! তুমি তো দারুণ আঁকো৷ 
-ধন্যবাদ স্যার৷ বসুন প্লীজ৷ 
শিশির এবং নুরুজ্জামান বসে পড়লো৷ তাদের এখন বেশ স্বাভাবিক লাগছে৷ বলতে গেলে স্বাভাবিকের চেয়ে ভালো লাগছে৷ পূর্বের সেই প্রশান্তিটা ফিরে এলো৷ এতো ভালো লাগছিল যা বলার মতো না৷ তাদের ইচ্ছে হলো এখানে থেকে গেলেই বেশ ভালো লাগবে৷ তুষার ভেতরের ঘরে গেল৷ ফিরে এলো অল্প সময়ের মধ্যেই। স্ট্রেচার ঠেলে এগিয়ে এলো সে। সেখানে নানান রকমের নাস্তা রাখা। আপেল, মাল্টা এবং কয়েক প্রকার বিস্কুট। সাথে চায়ের কাপ এবং ফ্লাক্স। সে টি-টেবিলের সামনে এসে সব গুলো রাখল। শিশির বলল,
-এসবের কী প্রয়োজন ছিল? আমরা তুষার সাহেবের সাথে দেখা করেই চলে যেতাম৷ আচ্ছা উনি কই? দেখছি না যে?
তুষার তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। কিছু বলল না৷ সোফায় গিয়ে বসলো। শিশির বলল,
-তা তুমি কি উনার ছেলে নাকি?
তুষার এবার আরেকটু বেশি করে হাসলো। তার কেমন জানি মজা লাগছিল। সে বলল,
-আমিই তুষার আহমেদ৷ এই ঘরে আমি আর এই কুকুরটি ছাড়া আর কেউই থাকে না৷ 
শিশির এবং নুরুজ্জামান দুজনেই অবাক হয়ে তাকালো। নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে বলল,
-তুমি তুষার? মানে ভূতপ্রেত তুমিই তাড়াও?
তুষার হাসলো। বলল,
-হ্যাঁ। 
-এতো ছোট বয়সে?
তুষার স্ফীত হেসে বলল, 
-কাজের ব্যাপারে আলোচনা করলে ভালো হয়৷ আমার মনে হচ্ছে আপনার নেকড়ের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন। 
শিশির বলল,
-হ্যাঁ। আসলে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনার প্রয়োজন ছিল না৷ 
-আচ্ছা কী জানতে চাচ্ছেন বলুন৷ 
-আমাকে একটা ব্যাপারে ক্লিয়ার করে বলতে হবে যে মানুষ কি আদৌও কখনও নেকড়েতে রূপান্তরিত হতে পারে?
-যে জিনিস গুলো অশরীরি তারা চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। সেটার কিছু লিমিটেশন থাকে। তবে যদি তারা একটা জীবিন্ত দেহ পেয়ে যায় তবে তারা সেটার নানান রকম ব্যবহার করতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো লিমিটেশন নেই৷ 
কথা গুলো শিশিরের মাথার উপর দিয়ে গেল। সে কিছুই বুঝতে পারলো না৷ বলল,
-এখনও ক্লিয়ার হয়নি বিষয়টি৷ 
তুষার বলল,
-আপনারা প্যারানরমাল এক্টিভিটিতে বিশ্বাস করেন?
শিশির এবং নুরুজ্জামান কী জবাব দিবে ভেবে পেল না৷ তুষার নিজ থেকেই বলল,
-আপনাদের না করারই কথা। তবুও বলছি৷ ব্যাপার গুলো আপনাদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। আমাদের আশপাশের একটা অদৃশ্য জগৎ আছে। যেটা আমরা দেখতে পাই না। সেই জগতেও ভালো মন্দের অবাদ বিচরণ। তারা আমাদের দেখতে পারে। কিন্তু আমরা তাদের দেখতে পারি না৷ সেই অদৃশ্য প্রাণ গুলোকে আমরা অশরীরী বলি। যাদের শরীর নেই অথচ উপস্থিতি আছে৷ এই অশরীরীদের মধ্য মন্দ যারা, তারা তাদের অদৃশ্য ব্যাপারটার ফায়দা উঠায়৷ মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা নেয়৷ আবার কেউ কেউ মানুষের উপর আক্রমণ করে বসে। আবার মানুষ তাদের ক্ষতি করে বলে তারা মানুষের আক্রমণ করে। এমন অনেক কেস আছে৷ আমাদের আশেপাশেই ঘটছে। অথচ আমরা টের পাই না৷ পেলেও হেসে উড়িয়ে দেই৷ যাই হোক, এই ব্যাপার গুলো খুবই কমন। অনেক হয়ে থাকে। তারা অদৃশ্য হয়ে এক ভাবে মানুষের ক্ষতি করে। তবে এভাবে তাদের ক্ষতি করার মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। তারা চাইলেই সব কিছু করতে পারে না৷ অন্য আরেক ভাবে মানুষের ক্ষতি করা যায়। তা হলো মানুষের দেহকে নিজের করে নিয়ে ক্ষতি করা৷ এই অশরীরীরা যখন একটা দেহ পায় তখন ওই দেহটার উপর সম্পূর্ণ অধিপত্য করে নেয়৷ নিজের মতো করে চালাতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই৷ তারা যেমন ইচ্ছে তেমন করতে পারে। 
শিশির খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-তারমানে এই যে নেকড়ে মানব যেটা, সেটা দ্বিতীয় পর্যায়ের মানে মানুষের দেহ নিয়ে ক্ষতি করা অশরীরী। 
-হ্যাঁ৷ ঠিক তাই৷ আচ্ছা আপনারা নেকড়েটাকে দেখেছেন?
-হ্যাঁ। পরশুই দেখা হলো। 
শিশির এমন ভাবে কথাটা বলল যে ব্যাপারটা খুব সাধারণ ব্যাপার৷ নেকড়েটার সাথে চাইলেই দেখা করা যায়। তুষার বলল,
-ওটা দেখতে কেমন?
-দেখতে খুবই অদ্ভুত। এমন নেকড়েও হয় তা আমার জানা ছিল না৷ আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখেছি যে নেকড়েটা দাঁড়িয়ে আছে৷ অনেকটা ক্যাঙ্গারুর মতো৷ 
তুষার চুপ করে থাকলো। কিছু ভাবছে যেন। শিশির আবার বলল,
-আর বাকি সব নেকড়ের। চোখমুখ, দাঁত,গায়ের রং এসব একদম নেকড়ের মতো। 
তুষার বলল,
-এদেরকে বলা হয় কুমেরুকা। এরা মূদ সম্প্রদায়ের পিচাশ। 
-মানে? এদের সম্প্রদায়ও আছে নাকি?
তুষার হাসলো৷ বলল,
-আমি আগেই বলেছিলাম। আমাদের জগতের মতো এদেরও একটা অদৃশ্য জগৎ আছে৷ এসব আমাদের কাছে খুবই হাস্যকর লাগে। তবে এসব আসলেই সত্য৷ তাদের ওখানে এখনও রাজতন্ত্র চলে। 
-এসব তুমি জানলে কী করে?
-আমার কাজই তো এসব ব্যাপারে রিসার্চ করা। 
-এতো আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছো যেন নিজে গিয়ে দেখে এসেছো।
কথাটা বলে শিশির হাসলো। তুষারও বিপরীতে হাসলো৷ কিছু বলল না। শিশির বলল,
-এরপর? এদের সম্পর্কে আর কোনো তথ্য?
-আরো অনেক তথ্য আছে৷ মূদ সম্প্রদায়ের পিচাশেরা শয়তানের পূজা করে। তাদের শয়তানের দুইজন স্ত্রী৷ সেই দুই স্ত্রীকে দেবী মানে তারা৷ এরা সর্বমোট তিনটি মূর্তির পূজা করে। সেটা নিয়ে অন্য একটা কাহিনী আছে। তবে এই সম্প্রদায়ের পিচাশরা খুব শক্তিশালী হয়৷ এদের গৃহপালিত পশু হচ্ছে কুমেরুকা। কুমেরুকা নেকড়েও না আবার ক্যাঙ্গারুও না৷ কিন্তু দেখতে মনে হয় দুটোর সাথে মিলে। এদের হাত মানুষের হাতের মতো৷ তবে সেই হাতে লোম থাকে অনেক। কুমেরুকাকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো অনেক শ্রমের ব্যাপার৷ যে-ই এই কাজটা করুক, ঠিক করেনি। সে মারাত্মক একটা ভুল করেছে। 
শিশির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-ভুল তো করেছেই। কিন্তু এই ভুল ঠিক করা যায় কীভাবে? আই মিন এসব থামানোর কোনো উপায় আছে?
তুষার খানিকটা চুপ করে থাকলো৷ বলল,
-আমি কাল আপনার সাথে দেখা করবো৷ তখন জানাবো কী কী করতে হবে৷ 
শিশির হাসলো৷ বলল,
-ঠিকাছে। 
.
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। তুষার নিজের বই ঘরে বসে আছে৷ উত্তরের জানালার কাছে৷ জানালাটা খোলা। এই জানালায় গ্রিল নেই। তাই বাতাস অবাধে প্রবেশ করতে পারে। বাইরে ভরা চাঁদের আলো৷ কিছুটা আলো তুষারের রুমেও পড়ছে৷ সে চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে বই পড়ছে। বইটা বেশ দারুণ। সে এ যাবত বেশ দারুণ দারুণ বই পড়েছে। 'কৃষ্ণপক্ষ' নামের এই বইটি তাদের মধ্যে অন্যতম। বইটা এই নিয়ে তৃতীয়বার পড়ছে সে৷ যতোবারই পড়ে তার কাছে কেমন নতুন নতুন লাগে৷ এতো ভালো লাগে যা বলার মতো না। পড়ার একটা সময় তুষারের মনে হলো জানালার কাছে কেউ বসে আছে৷ তার দিকে গভীর মনোযোগে দেখছে। তুষার বইটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে জানালার দিকে তাকালো৷ তাকাতেই দেখলো নেকড়েটা জানালার কাছে বসে আছে৷ তুষারের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে৷ তুষার কিছু বলল না৷ বইটা বন্ধ করে শীতল চোখে তাকিয়ে থাকলো নেকড়েটার দিকে৷ 
.
চলবে...
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব
(সপ্তম পর্ব)
.
তুষার শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নেকড়েটার দিকে। তাকে দেখে তেমন ভীত মনে হলো না৷ বরং বেশ শান্ত লাগলো। নেকড়েটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুষারের দিকে৷ তাকে বেশ হিংস্র লাগছে৷ যেন তুষারকে একদমই সহ্য হচ্ছে না তার৷ সে কয়েক পাঁ এগিয়ে এলো৷ তুষার ঠিক এক ভাবেই তাকিয়ে থাকলো নেকড়েটার দিকে। কিছু সময় পর হুট করেই তুষার চেয়ার থেকে উঠে দৌড়াতে শুরু করলো। এতো জোরে দিল যে আশপাশের কোনো কিছুই তার খেয়াল থাকলো না। নেকড়েটা যেন বুঝতেই পারছিল তুষার দৌড়াবে৷ সে আগ থেকেই প্রস্তুত ছিল৷ সেও দৌড়াতে থাকলো তুষারের পেছন পেছন৷ তুষার দৌড়ে গিয়ে বাসার ছাদে উঠলো৷ নেকড়েটাও পেছন পেছন এলো৷ এসেই তুষারের দিকে দৌড়ে আসতে থাকলো সে৷ তুষার আর অপেক্ষা করলো না৷ মন্ত্র পড়তে শুরু করলো৷ সে যতো জাদু জানে সব কাজে লাগাবে আজ৷ সব৷ 
.
শিশির একবার আশফাক সাহেবের বাসায় এলো৷ তার মনে হলো ইনার সাথে কিছু কথা বলা উচিৎ। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ব্যাপার গুলো সংযুক্ত। তুষার ছেলেটার ভাষ্যমতে কোনো মানুষ নেকড়ের এই রূপকে নিজের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে৷ কোনো মানুষ কেন এমন করবে? করার জন্যে কোনো কারণ তো অবশ্যই থাকতে হবে৷ সে নেকড়ে হয়েই প্রথম রাতে আশফাক সাহেবের বাড়িতে হামলা করলো৷ আশফাক সাহেবের পরিবারের সকলকে মেরে ফেলল অথচ আশফাক সাহেবকে মারলো না। এই ব্যাপারটা অত্যন্ত রহস্যজনক৷ নেকড়েরা এতো সহজে শিকার ছেড়ে দেয় না৷ দেওয়ার কথাও না৷ আর এ তো পিচাশ! এর তো আক্রমণ আরো মারাত্মক। এটি কেন আশফাক সাহেবের কোনো ক্ষতি করলো না? যদি এমন হতো যে নেকড়েটা দৈনিক রাতে মানুষ মারছে তাহলে অবশ্যই বোঝা যেতো যে এটি পৃথিবীতে রাজত্ব করতে এসেছে৷ সে এক চেটিয়ে ক্ষমতাবলে টিকে থাকতে চাচ্ছে৷ কিন্তু এই ব্যাপারটা তেমনও না৷ এটি যেন গুনে গুনে মানুষ খুন করছে। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে৷ যেটা কালই জানতে পেরেছে সে৷ নুহাশ এবং ইমির লাশ গুলো বাকি লাশ গুলো থেকে ভিন্ন। তাদের রক্ত চুষে নেওয়া হয়েছিল। অথচ এই ব্যাপারটা সে জানতোই না। এদের রক্ত কেন চুষে নেওয়া হয়েছে? এটাই কি নেকড়েটার খাদ্য? তুষার ছেলেটাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল৷ কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি৷ তখন মনে ছিল না৷ তুষারের নাম্বার শিশিরের কাছেও নেই যে ফোন দিয়ে জানতে চাইবে৷ একটা ব্যাপার করা যায়৷ তা হলো এই মূহুর্তে তার বাসাতে চলে যাওয়া যায়৷ কিন্তু এখন তাও সম্ভব নয়৷ সে খানিক আগেই সেখান থেকে এসেছে। নুরুজ্জামান তাকে হোটেলের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। হোটেলে থেকেই তার মনে হলো আশফাক সাহেবের সাথে দেখা করা উচিৎ। তাই সে চলে এলো৷ রাতের এখন সাড়ে আটটা বাজে মাত্র৷ শিশির বসে আছে আশফাক সাহেবের সামনে। আশফাক সাহেব যে তাকে দেখে খুশি হোননি তা বেশ টের পেয়েছে সে৷ তবুও কিছু করার নেই৷ তাকে কিছু ব্যাপারে জানতে হবে৷ সে বলল,
-চাচা, আপনার কী মনে হয়? এই খুন গুলো কেন করা হচ্ছে?
আশফাক সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন৷ তাঁর বিরক্তির সীমা থাকলো না৷ তিনি বললেন,
-কেন করা হচ্ছে তা আমি জানি কীভাবে? 'কেন'র উত্তর খোঁজার দায়িত্ব আপনার৷ আমার না৷ 
-তা ঠিক৷ তবে আপনার অনুমানটা জানতে চাচ্ছি৷ 
-আপনার মনে হচ্ছে আমি অনুমান করার মতো অবস্থায় আছি? আমার পুরো পরিবার কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে৷ আমি সর্বহারা৷ সর্বহারা মানে বোঝেন?
শিশির খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-একটা প্রশ্ন করছি৷ আশা করছি রাগবেন না৷ 
-জলদি করুন। আমার এতো সময় নেই৷ 
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-ওই রাতে আসলে কী হয়েছিল? আপনি ঠিক কী দেখলেন?
প্রশ্নটা শুনেই যেন আশফাক সাহেব রেগে গেলেন৷ তিনি হয়তো ভাবলেন এমন অনর্থক প্রশ্ন করার যৌক্তিকতা কী? শিশির বলল,
-প্লীজ৷ রাগবেন না৷ আসলে আমার মাথা থেকে এই ব্যাপার গুলো যাচ্ছে না৷ তাইই জানতে চাচ্ছি৷ 
আশফাক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-গভীর রাতে হঠাৎই তীব্র একটা চিৎকার শুনি আমি৷ আমার স্ত্রী এবং সন্তানের গলার আওয়াজ৷ আমি চমকে উঠি৷ বিছানায় বসে দেখি আমার স্ত্রী পাশে নেই। তখনও চিৎকার আসছিল৷ আমি বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে এলাম। চিৎকার হুট করেই থেমে গিয়েছে৷ তবে আমার মনে হচ্ছিল চিৎকারটা আমার ছেলের রুম থেকে আসছে। তাই আমি তার রুমের দিকে গেলাম৷ দরজার কাছে যেতেই আমাকে চমকে যেতে হলো৷ আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম আমার স্ত্রীর দেহ পড়ে আছে মেঝেতে৷ তার গলার কাছ দিয়ে ফিনকি মেরে রক্ত বের হচ্ছে৷ গলগল শব্দ হচ্ছে৷ আমি দৌড়ে রুমে গেলাম৷ গিয়ে দেখলাম রক্তে ছড়াছড়ি অবস্থা৷ বারান্দার দিকে চোখ যেতেই দেখলাম নেকড়েটা দাঁড়িয়ে আছে৷ গাঁঢ় কাত করে আমাকে দেখলো সে। তারপর চলে গেল। 
আশফাক সাহেব থামলেন। শিশির ভাবলো তাঁর চেহারা নরম হয়ে আসবে৷ মলিন স্বরে কথা গুলো বলবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি৷ তিনি খুব স্পষ্টই কথা গুলো বলছেন। তার মাঝে কোনো নরম ভাব নেই। চেহারায় রুক্ষতা লেগে আছে। কথা বলছেন কড়া স্বরে৷ শিশির বলল,
-আপনি কখনও ভেবেছেন যে নেকড়েটা আপনাকে দেখেও কিছু করলো না কেন?
আশফাক সাহেব এবার বিরক্ত হলেন৷ কঠিন স্বরে বললেন,
-আপনার ইচ্ছে কী? আমাকে মেরে ফেলা উচিৎ ছিল?
-দুঃখিত। আমি সেটা মীন করিনি। আপনি ভুল বুঝছেন। 
-সেটা মীন করেননি তো কী করেছেন? কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?
-আপনার কি মনে হচ্ছে না যে ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক? নেকড়েটা আপনার কোনো ক্ষতি করল না কেন?
-ক্ষতি করলো না কেন সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। আশা করছি সঠিক জবাব পেয়ে যাবেন৷ 
ভদ্রলোক রেগে যাচ্ছেন তা বেশ বুঝা যাচ্ছে৷ শিশির আর এই ব্যাপারে কথা বলল না৷ সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
-আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি৷ কিছু মনে করবেন না আশা করি। 
-মনে করলেও আপনি সেই প্রশ্নটাই জিজ্ঞেস করবেন। এটাই আপনাদের ন্যাচার৷ 
শিশির কিছু বলল না৷ কিছু সময় চুপ থাকলো। তারপর বলল,
-আপনি আপনার ছেলেকে তার অমতে বিয়ে দিলেন কেন? 
কথাটা শুনতেই উনার মুখটা কেমন শক্ত হয়ে এলো। খানিকটা রাগ চলে এলো চেহারায়৷ বললেন,
-আমি ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই না।
-প্লিজ৷ অন্তত এই ব্যাপারে আলোচনা করুন। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি৷ 
আশফাক সাহেব কিছু বললেন না৷ চুপ করে থাকলেন৷ শিশির আবার বলল,
-প্লিজ চাচা!
আশফাক সাহেবের চেহারা সহজ হয়ে এলো৷ বললেন,
-মেয়েকে আমার পছন্দ ছিল। তাই বিয়ে দিয়েছি৷ এটা তো জানার মতো তেমন বিষয় না৷ 
-শুধুই এই কারণে বিয়ে দিয়েছেন?
-আপনার কী মনে হচ্ছে? অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে নাকি?
শিশির খানিকটা রহস্য ভরা জবাব দিলো,
-কেন? থাকতে পারে না?
-জি না। তেমন কোনো কারণ নেই।
-মিথ্যা বলবেন না। আপনার মতো মানুষের মুখে মিথ্যা শুনলে কেমন জানি ঘেন্না হয়। 
-কথাবার্তা সাবধানে বলুন৷ লিমিট ক্রস করবেন না। 
-আপনি নিজে কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। বৃদ্ধ হয়েছেন তবুও মিথ্যা বললার অভ্যাস যায়নি। আকরামকে আপনি এমনি এমনি বিয়ে দেননি৷ তাকে বিয়ে দিয়েছেন নিজের ইগোকে স্যাটিসফাইড করতে। 
-মানে?
-বাহ! এমন ভাব করছেন যেন কিছুই বুঝতেই পারছেন না৷ আকরামের সাথে যাকে বিয়ে দিয়েছেন সেই মেয়েকে যে নুরুজ্জামান পছন্দ করতো তা কি আপনার অজানা ছিল?
আশফাক সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকালেন শিশিরের দিকে। কিছুই বলতে পারলেন না৷ শিশির বলল,
-কোনো কারণে হয়তো আপনি নুরুজ্জামানকে অপছন্দ করতেন। তাই বলে তার পছন্দের মানুষকে তার কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নিবেন? আপনি কি মানুষ? ওকে এভাবে কষ্ট দিলেন কেন?
-সেটা ওর প্রাপ্য ছিল। বেয়াদবটাকে একটা উচিৎ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
-কিসের শিক্ষা দিয়েছেন আপনি? 
-তার বেয়াদবির শিক্ষা৷ 
-কিসের বেয়াদবি? নুরুজ্জামান তো বাজে ছেলে নয়?
-বাজে ছেলে নয়? মানুষের উপর দেখে তার চরিত্র নির্বাচন করবেন না৷ 
-তাকে আমি ছোট বেলা থেকেই জানি৷ আমার জানা মতে সে ওই রকম ছেলে নয়৷ 
-আপনি ভুল জানেন৷ তার মতো লম্পট ছেলে এই দুনিয়াতে নেই৷ আমি যা করেছি ভালোই করেছি। বেয়াদবটাকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিয়েছি৷ এবং দিয়ে যাবো৷ জীবনে যতোবার সুযোগ পাবো তা করে যাবো৷ 
-আপনি কি জানেন আপনি মানুষটা  কতোটা খারাপ?
-আমি জানি আমি খারাপ। খারাপের উপর খারাপ। আপনি এখন বিদায় হোন৷ জলদি আমার ঘর ছাড়ুন। 
শিশির চোখমুখ লাল করে বেরিয়ে এলো৷ ঠিক তখনই তার ফোনে একটা কল এলো৷ আননোন নাম্বার৷ সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কেউ বলল,
-স্যার, আমি তুষার বলছি৷ আপনি কী আমার এখানে একবার আসতে পারবেন? খুব আর্জেন্ট৷ 
শিশির অবাক হয়ে বলল,
-কেন? কী হয়েছে?
-আপনি প্লীজ একবার আসুন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জলদি চলে আসুন৷ 
শিশির জলদি বেরিয়ে গেল। দ্রুত চললো তুষারের বাসার উদ্দেশ্যে। তার মাথায় নানা চিন্তাভাবনা। কী হয়েছে? ছেলেটা কেন এতো দ্রুত যেতে বলেছে? শিশিরের চিন্তার শেষ থাকলো না। চিন্তিত এবং অস্থির মন নিয়ে উপস্থিত হলো তুষারের বাসায়৷ দরজা খুলতেই দেখলেন তুষারের ঘেমে এককার হয়ে যাওয়া চেহারাটা৷ তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল৷ তুষার জলদি বলল,
-প্লীজ। ভেতরে আসুন। 
শিশির দ্রুত ভেতরে ঢুকলো। বসার ঘরে আসতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সে। তার যেন অবাক হওয়ার সীমা থাকলো না৷ জীবনের সেরা অবাকটা আজ হতে হলো তাকে৷ 
.
চলবে...
আশা করছি পরবর্তী পর্বে শেষ হয়ে যাবে৷ ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

গল্পঃ নেকড়ে মানব 
(অষ্টম পর্ব)
.
শিশির অবাক স্বরে বলল,
-একে খাঁচায় বন্দি করলে কীভাবে?
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সোফার উপর গিয়ে বসলো সে৷ ক্লান্ত স্বরে বলল,
-একে ধরতে বারোটা বেজে গিয়েছিল আমার৷ এমনিতেই এরা শক্তিশালী। তারউপর আজ আবার ভরা অমাবস্যা। 
-অমাবস্যাতে এরে শক্তিশালী হয়ে যায় নাকি?
-হ্যাঁ। 
শিশির এগিয়ে গেল। খাঁচাটার ভেতর শুয়ে আছে নেকড়েটা। তাকে অত্যন্ত ক্লান্ত লাগছে। শিশির বলল,
-যে প্রাণিটা এতোদিন মানুষের প্রাণ নিয়েছে সে আজ খাঁচা বন্দি? ভাববার বিষয়৷ কীভাবে এর মোকাবেলা করলে?
তুষার হাসলো। বলল,
-আমার কাজই হচ্ছে এদের মোকাবেলা করা৷ মোকাবেলার ট্যাকনিকটা জানা আছে৷ এজন্যেই হয়তো পেরেছি৷ 
-ইম্প্রেসিভ! ইশ! আমি যদি সেই মুহুর্তে উপস্থিত থাকতাম! 
তুষারের ভ্রু কুচকে এলো৷ তার মনে হলো শিশির সাহেব তার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না৷ তিনি অন্য কিছু ভাবছেন নিশ্চয়ই! তুষার চট করেই দুটো লেবু এনে দিলো। বলল, 
-এগুলো নেকড়েটার দিকে ছুড়ে মারুন তো!
শিশির অবাক হলো। বলল,
-লেবু?
তুষার স্ফিত হাসলো। বলল,
-হ্যাঁ৷ মেরে দেখুন৷ 
শিশির একটা লেবু ছুড়ে মারলো৷ ঠিক তখনই নেকড়েটা নড়ে উঠলো৷ তীব্র একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো তার গলা দিয়ে। সেই চিৎকার অনবরত চলতে থাকলো। তুষার উঠে গিয়ে লেবুটা নিয়ে এলো। নিয়ে আসতেই চিৎকার থেমে গেল নেকড়েটার৷ সে স্থির হয়ে বসলো খাঁচাটার ভেতর। শিশির এক ভাবে তাকিয়ে থাকলো নেকড়েটার দিকে। তার চোখে মুখে অবাকের ছাপ লেগে আছে। সে যেন ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছে না। তুষার বলল,
-অবিশ্বাস্য তাই না?
শিশির এগিয়ে এসে সোফায় বসল। বলল,
-অবিশ্বাস্য তো বটেই। এতো মারাত্মক একটা প্রাণি অথচ সামান্য একটা লেবুকে ভয় পায়? 
তুষার হাসলো। বলল,
-সব কিছুরই একটা দূর্বলতা থাকে। সেই দূর্বলতাটা খুঁজে নিলেই তার উপর কাবু করা যায়৷ 
-আচ্ছা, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি৷ এরা কি রক্ত খায়? মানুষের রক্ত?
-হ্যাঁ। খাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কেন? এমন কিছু ঘটেছে?
-ঘটেছে তো বটেই। দুটো লাশ পেয়েছিলাম। দুটো লাশই ছিল রক্ত শূন্য৷ দেহে কোনো রক্তই ছিল না। 
তুষার খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-নেকড়েটা সম্পূর্ণ রূপে কাবু করে নিয়েছে এর দেহের উপর৷ তার বেঁচে থাকার জন্যে অবশ্যই খাদ্যের প্রয়োজন৷ এ জন্যেই রক্ত চুষে নিয়েছে। রক্ত এদের প্রিয় খাবার৷ যদিও নিজেদের রাজ্যে খেতে পারে না৷ কারণ সেখানে রক্ত নেই। এ জন্যেই এরা মাঝে মাঝে ব্যাকুল হয়ে পড়ে রক্ত খাওয়ার জন্যে৷ তারপর মানুষের উপর আক্রমণ করে। 
শিশির চুপ করে থাকলো। তার মাথায় হঠাৎই একটা চিন্তা ভর করলো৷ তার মনে হলো সে কোনো গোলকধাঁধায় আছে৷ তার চারপাশে যা হচ্ছে সব কিছু প্ল্যান করা। এই তুষার, তুষারকে খুঁজে বের করা, তুষারের এমন ভূতপ্রেতাদি নিয়ে বিস্তর জ্ঞান তাকে যেন ভীষণ ভাবিয়ে তুলছে। কোথাও সব কিছু এই ছেলেটা করছে না তো? নেকড়েটা যেখানে মানুষকে মশা মারার মতো মেরে ফেলে সেখানে এই তুষার বেটা নেকড়েটাকে ধরে ফেলল? খাঁচায়ও বন্দি করে ফেলল? যে এমন একটা নেকড়েকে খাঁচায় বন্দি করতে পারে তার পক্ষে এই পৃথিবীতে এমন একটা নেকড়ের প্রবেশ করানোটা অস্বাভাবিক কিছু না৷ সে চাইলেই এমন কিছু করতে পারে৷ তুষারকে মারাত্মক ভাবে সন্দেহ হতে থাকলো তার৷ সে আড়চোখে দেখলো তুষারকে৷ তুষার তাকিয়ে আছে তারদিকেই। তাদের চোখাচোখি হলো।  শিশির জলদি চোখ সরিয়ে নিলো৷ সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো৷ তা দেখে তুষার হাসলো। বলল,
-আপনি ভাবছেন আমি এসবের সাথে যুক্ত আছি কি না তাই না?
শিশির হতভম্ব হয়ে তাকালো তুষারের দিকে। তার চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ। সে ভাবলো, আশ্চর্য ব্যাপার! এই ছেলেটা তার মনের কথা জানলো কীভাবে? তুষার আবার বলল,
-সমস্যা নেই৷ আপনি গোয়েন্দা মানুষ। মানুষকে সন্দেহ করার অধিকার রাখেন। এক দিক দিয়ে বলা যায় আপনার সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। 
-স্বাভাবিক মনে হলো কেন?
-এই যে আমি নেকড়েটাকে এভাবে কাবু করে ফেলেছি, তাকে ধরে খাঁচায় রেখেছি, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি এসব দেখার পর যে কারোই সন্দেহ হতে পারে। 
-একটা কথা বলো তো?
-কী কথা?
-তুমি কি মানুষের মন পড়তে পারো নাকি?
-এটা কেন মনে হলো?
শিশির খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-আমি আসলে কিছুক্ষণ আগে তোমাকে সন্দেহ করছিলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি এর সাথে যুক্ত। কিন্তু এরপর তুমি আমার মনের কথা গুলো বলে দিলে। কেন সন্দেহ করছি তাও বলে দিলে। এটা কীভাবে সম্ভব? 
তুষার খানিকটা হেসে বলল,
-জানি না। আমার হঠাৎই মনে হলো আপনি এমন কিছু ভাবছেন। তাই বলে ফেললাম। আচ্ছা, আপনার কেস কতদূর আগালো?
তুষার স্পষ্ট প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইছে, তা বুঝতে পারলো শিশির। শিশির আর সেদিকে এগোলো না৷ তুষার যেহেতু বলতে চাইছে না, থাক, সেটা অজানা থাক। জোর করা উচিৎ না৷ সে বলল,
-আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে কেস হচ্ছে এটা৷ এখানে না আছে কোনো সূত্র, না আছে কোনো ক্লিয়ার ভিক্টিম৷ আমার কাছে আছে কেবল একটা নেকড়ে আর আর কয়েকটা লাশ৷ 
-এগুলো থেকে কি কোনো কিছু বেরিয়ে আসেনি? আপনার সন্দেহ?
শিশির খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-সন্দেহ আমি সম্পূর্ণরূপে একজনের উপর করছি৷ এছাড়া সন্দেহ করার মতো আর কেউ নেই। বাকি যাদের খুন করা হয়েছে তারা কেবল বলির পাঠা হয়েছে৷ কেবল প্রথম চারটা খুন প্ল্যান মতো হয়েছে। 
-প্ল্যান মতো?
-হ্যাঁ। প্ল্যানই৷ 
-আপনার এমনটা মনে হচ্ছে কেন?
-এমনটা মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে প্রথম খুনে ওই পরিবারের চারজন সদস্যকে খুন করা হয়৷ একজনকে সামনে পেয়েও খুন করা হয়নি। 
-সামনে পেয়েও খুন করলো না? স্ট্রেঞ্জ!
-হ্যাঁ। আচ্ছা তুমিই বলো, এই যে এই পিচাশ, এটি কি তার শিকারকে রেখে চলে আসে?
-ইম্পসিবল। এটা তো সম্ভবই না। খুন করে আনন্দ পায় এরা। নেকড়েটা অবশ্যই তাকে খুন করে ফেলতো৷ কিন্তু তাকে খুন করেনি। ব্যাপারটা অবশ্যই ভাববার। 
-হ্যাঁ। এই ভাবনাটায় আমি বেশ মনোযোগী হই। এবং দারুণ কিছু তথ্য পাই। 
-কেমন তথ্য?
-ওই পরিবারের যে সদস্যটি বেঁচে আছে তাঁর নাম আশফাক চৌধুরী। তিনি বৃদ্ধ৷ মানুষটি অত্যন্ত বদমেজাজী। ইগো উনার রগে রগে ঘুরে বেড়ায়। নিজের ছেলেকে ছেলের অমতে বিয়ে দেন৷ এ নিয়ে ঝালেমা হয়৷ তাঁর ছেলে আকরাম কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল বাবার সাথে ঝগড়া করে। সে এই মেয়েকে বিয়ে করবে না৷ তার বাবা তাকে 'জোর করে' বিয়ে দেন৷ আমি জোর করে বিয়ে দেওয়ার কারণ খুঁজতে বের হই৷ সেখানেই মূল ঘটনাটি জানতে পারি৷ যে মেয়েটির সাথে আকরামের বিয়ে হয় সেই মেয়েটিকে পছন্দ করতো নুরুজ্জামান। নুরু...
-নুরুজ্জামান? আপনার সাথে ওই দিন যে এসেছিল সে? 
-হ্যাঁ৷ সে-ই৷ সে আশফাক চৌধুরীর বড় ভাইয়ের ছেলে৷ এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে৷ আশফাক চৌধুরী কোনো একটা কারণে এই নুরুজ্জামানকে দেখতে পারেন না৷ জঘন্যরকম ঘৃণা করেন। তিনি নুরুজ্জামানের ছায়াও দেখতে পারেন না৷ কেন সেটা আমি জানি না৷ তবে আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনো কাহিনী আছে৷ এই দুটো ব্যাপার যুক্ত৷ 
-কোন দুটো ব্যাপার?
-প্রথম ব্যাপারটা হচ্ছে নুরুজ্জামানের পছন্দের মেয়েটির সাথে আশফাক সাহেব নিজের ছেলের বিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে তিনি নুরুজ্জামানকে দেখতে পারেন না৷ তিনি জানতেন নুরুজ্জামান মেয়েটি পছন্দ করে৷ জানা স্বত্ত্বেও তিনি তার ছেলেকে ওই মেয়েটার সাথে বিয়ে দেন৷ এতে নুরুজ্জামান কষ্ট পায়৷ নুরুজ্জামানকে কষ্ট দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে আশফাক সাহেবের। এ জন্যে তিনি  নুরুজ্জামানের পছন্দের মানুষটির সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দেন। এই ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত। 
-আপনি এতোটা নিশ্চিত হয়ে বলছেন কীভাবে?
-আমি আশফাক সাহেবের সাথে কথা বলে এলাম সবে। তিনি নিজ মুখ ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন৷ তিনি বলেছেন, বাকি জীবনে যতোবার সুযোগ পাবেন ততোবার নুরুজ্জামানকে কষ্ট দিয়ে যাবেন। 
-এখানে আপনার সন্দেহ হচ্ছে কাকে?
-সন্দেহ হচ্ছে নুরুজ্জামানকে৷ 
-নুরুজ্জামানকে? কেন?
-কারণ আছে। গত মাস ধরে তার জীবন ধারার উপর নানান পরিবর্তন দেখলাম আমি৷ আমি তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেক করলাম। তার ব্যাংক একাউন্ট থেকে অনেক গুলো টাকা তোলা হয়েছে একসাথে৷ এই টাকা গুলো নিয়ে সে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়৷ প্রায় দু সপ্তাহ সে কোথায় ছিল এটা জানা গেল না৷ আমি অনেক চেষ্টা করেছি৷ আমার নিজস্ব গুপ্তচর লাগিয়েছি কিন্তু কেউই এই ব্যাপারটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলো না৷ আমার কথা হচ্ছে নুরুজ্জামান এতগুলো টাকা নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল৷ কই গেল? আমি এই প্রশ্নটার উত্তর পাচ্ছি না৷ আর একটা প্রশ্ন আছে৷ আশফাক সাহেব কেন নুরুজ্জামানকে ঘৃণা করে সেটা। 
তুষার খানিকটা চুপ করে থাকলো৷ বলল,
-নুরুজ্জামানের সেই টাকা গুলো অন্য কোথাও ব্যয় করেছে হয়তো!
-তার ব্যয় করার মতোন তেমন কোনো জায়গা নেই। সে যে এগুলো কোথাও ব্যয় করেছে সেটা জানা যায়নি৷ তবে আমি নিশ্চিত, সে ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক কাজে এগুলো ব্যবহার করেনি৷ আমি যদি একবার তার ব্যবহারের খাতটা পেয়ে যাই তবে অবশ্যই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। 
-সে আপনার বন্ধু ছিল। আপনার মনে হচ্ছে সে এমন করবে?
-প্রত্যেকটা মানুষের ভেতরই একটা কালো সত্ত্বা থাকে৷ মানুষ যখন প্রবল হতাশায় ভোগে তখন সেই সত্ত্বাটা বেরিয়ে আসে। নুরুজ্জামান ইদানীং কেবল হতাশায় না, খুব দুঃখ কষ্টে জীবন পার করছিল৷ তার ঘুম হতো না। আমি তাকে ঘুমের ট্যাবলে কিনতে দেখেছি। যেই নুরুজ্জামানকে আমি এতো কাল থেকে দেখে এসেছি, সেই নুরুজ্জামানকে দেখেও চেনা না৷ চিনতেও কষ্ট হয়৷ 
তুষার খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার বন্ধু সেই টাকা গুলো কোনো বাজে পথে ব্যয় করেছে এবং নিজের মধ্যে শয়তানের ছায়া প্রবেশ করিয়েছে। মানে নেকড়েটা! 
শিশির সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
-এমনটা কি স্বাভাবিক নয়? হতে পারে না?
-হ্যাঁ। তা অবশ্যই পারে। তবে চলুন, দেখা যাক এই নেকড়েটা আসলে কার দেহের ভেতর প্রবেশ করেছে। 
শিশির অবাক হয়ে বলল,
-তুমি একে মানুষ রূপান্তরিত করতে পারবে?
তুষার হাসলো। বলল,
-আমার উপর আপনার সন্দেহ দূর করতে তো এটা করতেই হবে। এবং আপনার কিছু উপকারই হবে। 
-কেমন উপকার? 
-আপনি জানতে পারবেন আসল খুনি কে এবং কেন এমন করছে সে।
শিশির অত্যন্ত খুশি হয়ে বলল,
-বাহ বাহ! তাহলে তাই করো৷ জলদি করো৷ আমার একে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। 
তুষার উঠে দাঁড়ালো। ভেতরের রুমে গিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে এলো৷ ব্যাগের ভেতর থেকে কালো রঙের সুতো বের করলো৷ সেই সুতো নিয়ে এগিয়ে গেল নেকড়েটার দিকে। শিশিরও এগিয়ে এলো৷ তারও দেখতে ইচ্ছে করছে আসলে ব্যাপারটা কী? তুষার এগিয়ে গেল বেশ ধীরে। নেকড়েটা ঘুমিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে নেকড়েটার এক হাতে কালো সুতোর কিছু অংশ বাঁধল। বাঁধতেই দেখা গেল নেকড়েটা শোয়া থেকে উঠে গিয়েছে৷ তার এক হাত যেন অবশ হয়ে গিয়েছে৷ সে সেটা নাড়াতেই পারছে না৷ তুষার কায়দা করে অন্য হাতেও সুতোর কিছু অংশ বেঁধে দিলো। তাবিজের মতো৷ নেকড়েটা চাপা একটা চিৎকার করলো। এমন একটা ভাব করলো যেন তার দেহের দু'পাশ ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে৷ তুষার খাঁচাটার মুখ খুলে দিলো৷ টেনে বের করলো নেকড়েটাকে। তুষার কালো সুতোর কিছু অংশ ছিড়ে মালার মতো বানালো। সেটি পরিয়ে দিলো নেকড়েটার গলায়৷ অমনি নেকড়েটা মেঝেতে শুয়ে পড়লো৷ তার গলার স্বর অত্যন্ত চাপা হয়ে এলো। অদ্ভুত রকম গোঁ গোঁ স্বর আসতে থাকলো৷ পশু জবাই করলে যেমন একটা শব্দ আসে তেমন। তবে এই শব্দটা অত্যন্ত চাপা। নেকড়েটা অতিদ্রুত মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো এবং ধীরে ধীরে সে মানুষে রূপান্তরিত হতে থাকলো৷ তার দেহের বড় বড় লোম গুলো যেন ক্রমশ দেহের ভেতর ডেবে যাচ্ছে। কোথাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে তার পা গুলো৷ হাত গুলো৷ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল প্রাণিটি মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। শিশির অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো একটা সম্পূর্ণ নগ্ন মানুষ মেঝের সাথে মিশে আছে। তার সমস্ত দেহ ঘেমে একাকার। তার দু হাতে কালো সুতো দিয়ে তাবিজের মতো বাঁধা৷ গলার সুতোটিও ঠিক আছে। শিশির এগিয়ে গেল৷ সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল এই মানুষটি নুরুজ্জামান হবে৷ অবশ্যই নুরুজ্জামান। এখানে সন্দেহের কিছু নেই৷ কিন্তু দেখা গেল তেমন কিছুই ঘটলো না। মেঝেতে যে শরীরটি পড়ে আছে সেটি নুরুজ্জামানের নয়, অন্য কারো। একে চেনাই যাচ্ছে না। মোটেও চেনা যাচ্ছে না। কে এই মানুষটা? এখানে কী করছে? শিশিরের মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। সে কোনো ভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না যেন৷ 
.
আর এক পর্ব আছে৷ যদিও গল্পটি সম্পূর্ণ লিখা শেষ৷ পুরোটাই গ্রুপে পোষ্ট দিয়েছিলাম। প্রায় 4980 শব্দ। বেশি শব্দ হওয়ায় পুরোটা পোষ্ট হয়নি৷ তাই ওটা ডিলিট করে আরেক পর্ব করে দিয়েছে। আগামীকাল শেষটা পাবেন ইনশাল্লাহ।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ।  


গল্পঃ নেকড়ে মানব 
(শেষ পর্ব)
.
মেঝেতে পড়ে থাকা উলঙ্গ মানুষটির চেতনা ফিরে এসেছে৷ তাকে একটা ট্রাউজার এবং টি-শার্ট দেওয়া হয়েছে। সে সেগুলো পরে ক্লান্ত দেহ টেনে সোফায় এসে বসেছে। তার চেহারাময় অদ্ভুত এক ক্লান্তি চেপে আছে৷ তাকে ফ্রুটস দেওয়া হয়েছে। গরম গরম এককাপ কফি দেওয়া হয়েছে। এসব খাওয়ার পর যেন তার দুর্বলতা কিছুটা কেটে গিয়েছে। তাকে কিছুটা সতেজ মনে হচ্ছে৷ শিশির নিজের কফির মগটা টি-টেবিলে রেখে বলল,
-কে আপনি?
লোকটা জবাব দিলো না৷ শিশির আবার বলল,
-আপনি কে? আর এসব কী? এমন জঘন্য নেকড়েকে নিজের ভেতর পালছেন কেন?
লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ ক্ষীন স্বরে বলল,
-ইমন! ইমন নামআমার। 
-এসব কেন করছেন? এই যে এই হত্যা গুলো? এসব নিরিহ মানুষদের খুন করছেন কেন? 
-দেবতার আদেশে। 
-দেবতা? কোন দেবতা?
-যে দেবতা আহারে উন্মাদ থাকা এক যুবককে আহার দিয়েছে৷ তাকে দু'বেলা ভাত খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে৷ তাকে অন্ধকারের মাঝে আলো দেখিয়েছে৷ আমি সেই দেবতার কথা বলছি। 
শিশির মেজাজটা চড়ে গেল। সে বলল,
-আপনার কী মনে হচ্ছে আমরা আপনার সাথে ফান করছি? তামাশা করছি? এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন কেন? 
ইমন নামের যুবকটি চুপ করে থাকলো৷ অনেকটা সময় পর বলল,
-সিগারেট হবে?
শিশিরের মাথায় রাগটা চড়ে গেল যেন৷ সে উঠে গিয়ে একে চড় দিবে ভাবছে৷ তার আগেই তুষার তাকে শান্ত থাকতে ইশারা দিলো৷ তুষার নিজের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটারটা বের করে এগিয়ে দিলো৷ ইমন সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল,
-ব্রান্ডের সিগারেট! বাহ! একদিকে মানুষ খাদ্যাভাবে মরে অন্য দিকে মানুষ উন্নতমানের বিষ খেয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে মারে। হাহাহা! অদ্ভুত দেশ আমাদের।
ইমন হাসলো৷ তার হাসিতে এবং চেহারায় বিদ্রুপ মিশে আছে৷ 
শিশির ভ্রু কুচকে বলল,
-আপনিও তো খাচ্ছেন৷ নিজেকে তো আপনিও মারছেন৷
ইমন আবার হাসলো। বিদ্রুপের হাসি। বলল,
-আমি অনেক আগেই মরেছি স্যার৷ 

এই বলে সে সিগারেটে আগুন ধরালো৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে সিগারেটে অভ্যস্ত৷ সিগারেট ধরার স্টাইল বলছে সে একজন চেইন স্মোকার৷ শিশির নিজেও একটা সিগারেট ধরালো৷ তুষারও। ঘরময় হঠাৎই সিগারেটের ধোয়ায় ভরে গেল৷

ইমন বলল,
-'ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ' সম্পর্কে জানেন?
তুষার কিংবা শিশির কেউই জবাব দিলো না। ইমন নিজ থেকেই বলল,
-এটি একটি গবেষণা। এই গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।
তুষার এবং শিশির দু'জনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো৷ তারা কী বলবে ভেবে পেল না৷ ইমন বলল,
-এটি হচ্ছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের খবর৷ এখন তো আরো বেশি হবে৷ দিনদিন স্মোকার বাড়ছে৷ তবে আমার এই কথাটি বলার উদ্দেশ্য আছে৷ উদ্দেশ্যটা হলো, আমরা সকলেই দামী দামী সিগারেটে খেতে পারি অথচ রাস্তার ধারে অনাহারে পড়ে থাকা মানুষ গুলোকে দু'টাকা দিতেও আমাদের নানান চিন্তাচেতনা বের হয়৷ লোকটা ফ্রড, ভিক্ষুকের অভিনয় করছে বলে জুতাপেটা করা হয়৷ অথচ সে কেন ভিক্ষুকের অভিনয় করছে সেটা জানার প্রয়োজনবোধ কেউ করে না৷ চুরি করার চেয়েও তো ভিক্ষুকের অভিনয় করা অনেক ভালো৷ তাই না?
তুষার বলল,
-আপনিও তো স্মোক করছেন৷ সিগারেট খাচ্ছেন৷ আপনিও কি সেই কাতারে? ভিক্ষা দেন?
ইমন হাসলো৷ বলল,
-আমি একসময় ভিক্ষা নিতাম৷ এখন অবশ্য সময় ফিরেছে৷ এখন দিচ্ছি৷ 
তুষার সিগারেটে জোরে একটা টান দিলো৷ ইমন মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে বলল,
-এই শহরে আসার পর থেকেই সিগারেট খাওয়া শিখেছি৷ এই শহর আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে৷ তার মধ্যে এই সিগারেট অন্যতম। আমি বাংলার ছাত্র ছিলাম। গ্রামে এক সময় আমাকে মেধাবী বলা হতো৷ দরিদ্র ঘরের মেধাবী ছেলে৷ এ যেন গোবরে পদ্ম ফুল। তবে আমি বাংলায় স্নাতক করছি শুনে মানুষের একটু মন খারাপ হতো৷ যখন শুনতো বাংলা নিয়ে পড়ছি তখন গলার স্বরটা কেমন টেনে বলতো, 'বাংলা?'। যেন কোনো গুরুত্বই নেই৷ আশ্চর্য ব্যাপার৷ যাক সে সব কথা। রুবিনা নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। মেয়েটার সম্পর্কে জানতাম না৷ আমি যেখানে থাকতাম এর আশেপাশেই নাকি কোথাও তার বাসা ছিল৷ সে তাদের বিশাল সম্পত্তির নানান বৃত্তান্ত দিতো৷ আমি কখনই সেসব দেখার ইচ্ছে পোষণ করিনি৷ আগ্রহ জাগেনি। কেবল উন্মাদের মতো একটুকরো ভালোবাসা জেগেছিল তার জন্যে৷ গরীবের কপালে ভালোবাসা কি চিরস্থায়ী হয়! নানান মাধ্যমে জানা গেল মেয়েটা এমন অনেক ছেলের সাথে পার্টটাইপ প্রেম করে৷ তাদের সাথে ঘুরে ঘুরে নিজের পেটের আহার জোগায়৷ আমি ভাবলাম মেয়েটি আমার মতোই দরিদ্র হয়তো৷ তাই এমন করে৷ কিন্তু ওই মা* যে টাকার বিনিময়ে বিছানায়ও যেতো সেটা আমার জানা ছিল না৷ মূলত আমার জীবনের অন্ধকার পর্যায়টা সেখান থেকেই শুরু হয়৷ রুবিনার জন্যে জীবনে প্রথম সিগারেট হাতে নেই৷ রুমমেট বলল,
-টেনে দেখ! দারুণ প্রশান্তি পাবি! 
কিন্তু কে জানতো৷ সেই সিগারেটে যে গাঞ্জা মেশানো ছিলো? সেখান থেকেই শুরু হয় গাঞ্জার প্রতি টান। শিশির স্যার, আমি কিন্তুু ভালো ছিলাম। নামাজ কালাম পড়তাম। শহরে এসেছি পড়াশোনা করে মানুষ হতে। দেখেন, এই শহর আমাকে কীভাবে মানুষ করছে৷ 
শিশিরের সিগারেট খাওয়া শেষ৷ সে বিরক্তি স্বরে বলল,
-আপনি বন্ধু নির্বাচনে ভুল করেছেন৷ এখানে শহরের দোষ কোথায়?
-তাই বলে আমার জীবনের দু'জন বন্ধুই ভুল হবে? কেন? এমন কেন হবে? এটা তো অন্যায়। 
-অন্যায় বলল কে? আপনি তো ভুল মানুষই বেছে নিয়েছেন৷ একজন বেশ্যা আরেকজন গাঞ্জাখোর। এখানে অন্যায় আপনারই৷ 
ইমন স্ফিত হাসলো৷ বলল,
-উনার নাম নীরব আহমেদ৷ অত্যন্ত ভদ্রলোক। সবার সামনে অমায়িক ব্যবহার৷ রাতের অন্ধকারেই যা অনিষ্ট করেন আরকি৷ তবে স্যার, আমার বাকি রুমমেটরা কেন টানতো? কেন তাদের গার্লফ্রেণ্ডদের টেনে এনে ঘন্টার পর ঘন্টা রুমে আঁটকে থাকতো? আমাদের কেন সেই সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো?
-আপনি খারাপ জায়গায় গিয়েছেন৷ 
-তিনটা জায়গা বদলেছি স্যার৷ সব খানেই এমন দু'একজন থাকে৷ এমন কেন? 
-সব জায়গায় ভালো-খারাপ মানুষ থাকে৷ আমাদের উচিৎ ভালো মানুষের সঙ্গ নেয়া৷ খারাপদের থেকে দূরে থাকা৷ 
-তা অবশ্য ঠিক বলেছেন স্যার৷ ভালো মানুষও থাকে এদের ভীড়ে৷ নুহাস নামের একটা ছেলে ছিল৷ খুবই হেল্ফুল৷ আমার যখনই টাকার প্রয়োজন পড়তো আমি তার কাছে গিয়ে বলতাম,
-দোস্ত কিছু টাকা দে। হাত একদম খালি৷ মাস শেষে টিউশনির বেতন পাবো৷ তখন দিয়ে দিবো৷ 
সে মৃদু হেসে বলতো,
-টাকা দিবো। তবে তোকে কসম দিতে হবে সেগুলো ভুল পথে ইউজ করবি না৷ 
আমি তাকে এমন শতশত কসম দিয়েছি, তবে সেটা রাখিনি। অনেকবার টাকা নিয়েছি, আজ পর্যন্ত দেইনি৷ সেগুলো এখনও বাকি রয়ে গেছে৷ তাকে জানানোও হয়নি যে আমি তার কথা রাখিনি৷ তার দেওয়া টাকা দিয়ে গাঞ্জা কিনে খেয়েছি৷ নেশা করেছি। তবে সে বুঝতে পারতো৷ আমি ঘুমিয়ে থাকলে সে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। নামাজের জন্যে ডাকতো৷ আমি বিরক্ত হয়েও কিছু বলতাম না৷ পাছে যদি সে রাগ করে তবে লজ্জায় পড়বো, পরবর্তীতে টাকা চাইবো কীভাবে?

শিশির ভ্রু কুচকে আছে। তার মাথায় যেন চট করেই কিছু একটা খেলে গেল। বলল,
-ওয়েট! থামুন৷ আপনি কোন রুবিনার কথা বলছেন? কোন নুহাস? যাদের খুন করেছেন তারা?
ইমন অট্টহাসি দিলো৷ হাসতে হাসতে বলল,
-এতোক্ষন পর টের পেলেন?
-ইউ... 
-থামেন স্যার! সবটা শুনেন৷ আরো অনেক কথা বাকি। কোথায় যেন এসেছিলাম? ও হ্যাঁ অন্ধকার। মনে পড়েছে৷ রুবিনা আমায় এমন চোট দিলো যে আমি সেটা সয়ে নিতে পারছিলাম না। লাইন চ্যুত হয়ে গেলাম৷ হাতের টিউশনিটাও চলে গেল৷ বাবাকে টাকার জন্যে ফোন দিলে ধমকাতেন৷ এতো টাকা দিবেন কোত্থেকে? যেখানে নিজেদের খাওয়া দাওয়াও জোটাতে কষ্ট হয়। এদিকে আমার টাকার প্রয়োজন৷ কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। নুহাসকে বললাম কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে৷ সে একটা শপে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলো। যা বেতন পেতাম মোটামুটি চলতো৷ আমি ভাবলাম এসব ভুল পথ ছেড়ে দিবো৷ ভালো হয়ে যাবো৷ ঠিক সে সময়ই আমার সাথে ইমির বন্ধুত্ব হয়৷ দারুণ একটা মেয়ে সে। আমার তাকে ভালো লেগে যায়৷ মন্ত্রীর মেয়ে হয়ে বাংলায় পড়ছে এই ব্যাপারটা আমায় আরো বেশি অভিভূত করে৷ আমি তার প্রতি দূর্বল হই৷ কিন্তু এর কিছুদিন পরেই জানতে পারি সে নুহাসের প্রিয়তম কেউ৷ নুহাস তাকে ভালোবাসে৷ ইমিও তাকে ভালোবাসে৷ আমি আবার ডুব দিলাম হতাশার সাগরে৷ বাঙালির ইমোশন বেশি৷ খুব দ্রুতই আঘাত পায় এরা৷ তবে আমি নিজেকে আবার শুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম৷ ইমি এবং নুহাসকে শ্রদ্ধা করতাম। তারা তাদের মতো ভালো থাকুক। ঠিক তার কিছুদিন পরেই আরেকটা অঘটন ঘটলো আমার জীবনে৷ জানা গেল ছোটবোনকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ সন্ধ্যা হয়ে গেলেও বাড়ি ফেরেনি৷ পুরো রাত খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না। পরেরদিন স্কুলের পাশের ডোবায় আমার ছোটবোনের লাশ পাওয়া যায়। সে গুটিশুটি মেরে পানিতে শুয়েছিল নাকি। খুব মজার একটা ঘুম যাচ্ছিল৷ ছোটবোনকে ধর্ষণ করা হয়৷ কিছু কুলাঙ্গার আমার বোনটাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে। বাংলাদেশে এটি একটি সাধারণ ঘটনা৷ তাই কেউ যেন গায়েই মাখল না। পুলিশ থানায় অনেকদিন ঘুরেছি৷ লাভ হলো না৷ তারা খুনিকে ধরতে পারেনি৷ অথচ খুনিকে ধরাটা কঠিন কিছুও ছিল না৷ আমরা জানতাম কে এমন করেছে৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঠানোর ক্ষমতা আমাদের ছিল না৷ এসব ধীরে ধীরে চাপা পড়লো৷ কিন্তু বাবার কষ্টটা চাপা দেওয়া গেল না৷ বাবা স্ট্রোক করলেন৷ বাঁচানো গেল না৷ খুব দ্রুত সময়েই আমি আমার নিকটস্থ দু'জন মানুষ হারালাম৷ এরপর অবশ্য মাকেও হারাতে হলো৷ মাকে নানার বাড়ি রেখে এসে শহরে আসলাম। নিজের চিরচেনা সেই শহরে। শহরে আসার পর বেশ কিছুদিন আমার কারো সাথেই যোগাযোগ হলো না৷ আমি কেমন বিচ্ছিন্ন হতে থাকলাম৷ কেমন অদ্ভুত হয়ে যেতে থাকলাম। ততদিনে আমার স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছিল। আমি পরীক্ষা দেওয়ার আগে মায়ের নাম্বারে ফোন দিলাম। কয়েকবার দিলাম৷ শেষবারে ফোন ধরা হলো৷ ধরলেন আমার বড় মামা। তিনি জানালেন আমার মায়ের আবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে৷ খুবই ভালো একটা পরিবারে৷ গ্রামে এলে আমি যেন নানার বাড়িতে যাই৷ সেটাই আমার এক মাত্র যাওয়ার জায়গা৷ আমি অবশ্য আর গ্রামে ফিরে যাইনি৷ স্নাতক শেষ হলো৷ অন্ধকারে আরো গভীর ভাবে ডুবে গিয়েছিলাম ততোদিনে৷ মদ গাঞ্জায় লেগে থাকতাম। এক সময় বুঝানোর মতো নুহাস ছেলেটা ছিল৷ এখন সেও নেই৷ সে চাকরি করছে৷ আমার স্নাতকের রেজাল্ট ফেইল এসেছে। আমাকে আবার এক্সাম দিতে বলা হলো। কিন্তু আমি আর কখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাইনি৷ সব কিছু ছন্নছাড়া হতে থাকলো৷ বদ অভ্যাস জনিত কারণে শপের চাকরিটাও চলে গিয়েছে৷ আমি ধীরে ধীরে পথে বসতে শুরু করলাম। অন্ধকার গহীন কিছুতে আমি দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকলাম৷ এক সময় নেশা করার টাকা পাওয়া যেতো না৷ নেশা না করে পাগলের মতো লাগছিল। মাথা হ্যাং হয়ে ছিল৷ ঘোরের ভেতর চলে যেতে থাকলাম। সেই ঘোরের ভেতর আমি একদিন চুরি করে বসি৷ কিন্তু তাতে লাভ হলো না৷ চুরি করাও একটা আর্ট৷ যেটা সকলে পারে না৷ এদিকে আমি অভিজ্ঞও নই৷ ধরা খেয়ে গেলাম। পাব্লিক প্রচুর মারলো৷ পুলিশ এসে বাঁচালো আমায়৷ কয়েকদিন হাজতে থাকতে হয়৷ সেখানে অবশ্য ভালোই লেগেছিল। নিয়ম করে খাবার দাবার পেতাম। সেই সুখ বেশিদিন টিকল না৷ হাজত থেকে মুক্তি পেলাম৷ আবার সেই অন্ধকার ঘোর ধরা জীবন৷ না পারছি নেশা করতে, না পারছি কিছু খেতে৷ পানি কেনার টাকাও ছিল না৷ প্রচণ্ডরকম হতাশায় ভুগছিলাম। শেষমেশ ভাবলাম এই অপদার্থ জীবন আর রাখবো না৷ যে জীবনেই খালি ট্র‍্যাজিডিই ঘটছে, কোনো পরিপূর্ণ সমাপ্তি নেই সে জীবন রেখে কী লাভ৷ আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম৷ একটা অন্ধকার জায়গায় বসে বসে ভাবছিলাম কীভাবে মরলে ভালো হয়৷ ঠিক তখনই আমার দেবতা আসেন৷ পৃথিবী ভরা অন্ধকারের মাঝে এক গুচ্ছ আলোর মতো৷ স্যুট-কোট পরা দেবতা। কী মার্জিত চেহারা বলে বোঝানো যাবে না৷ তিনি এসে সিগারেটে দিলেন৷ দামী একটা সিগারেট। অন্ধকারে আমি তার চেহারা না দেখলেও তিনি যখন নিজের ফোনটা বের করে মুখের সামনে ধরেন আমি ঠিক তখনই তার কোমল চেহারাটা দেখি৷ দুজনে অনেক্ষণ ধরে সিগারেট ফুকলাম। এরপর তিনি আমায় পেট ভরিয়ে খাওয়ালেন। হাজী বিরিয়ানি৷ কী চমৎকার ঘ্রাণ৷ এখনও নাকে লাগে যেন৷ আমি সেদিন তিন প্লেট বিরিয়ানি খাই৷ সাথে সালাত। একটা কোক দেওয়া হয় আমায়। আমার মনে হয় আমি জীবনে এতো দারুণ খাওয়া কখনই খাইনি৷ এই প্রথম খেলাম৷ আবেগে আমার চোখে পানি চলে আসে। প্রবল আনন্দে আমি আমার দেবতার পদতলে মাথা ঠেকাই৷ তার হাতে চুমু খাই। এরপর থেকে তিনি আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন৷ আমাকে প্রায় টাকা দেন। অনেক টাকা। আমাকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘোরেন৷ একদিন আমরা পাহাড় দেখতে যাই। বিশাল বিশাল পাহাড় দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল৷ আমার কাছে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতা দেখে অন্য রকম ভালো লাগছিল। নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জাগছিল৷ দেবতা আমাকে বিচিত্র একটা জগতে নিয়ে যান তখন। অদ্ভুত অন্ধকার ঘেরা একটা জায়গায়৷ সেখানে আমাকে অজ্ঞান করা হয়৷ আমার অনুমতিতেই তা করা হয়। যে দেবতা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন তার জন্যে আমি অজ্ঞান কেন নিজের জানটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত৷ সেখান থেকে কবে ফিরি জানা নেই৷ দিনক্ষনের হিসেব ভুলে গিয়েছি৷ শহরে আসার পর দেবতা আমাকে একটা কিছু কথা বলেন, 

'ইমন, তুমি এখন থেকে নতুন করে বাঁঁচবে৷ এই পৃথিবীতে গরীবদের জন্যে কিছু নেই৷ যার ক্ষমতা বেশি, অর্থবিত্ত বেশি তার পা ছোঁয় সকলেই। তুমিও আজ থেকে শক্তিশালী। তোমার ভেতর তুমি ছাড়াও অন্য একজনকে পাবে তুমি। তোমার কাছের একটি বন্ধুকে পাবে যে কখনই তোমাকে ঠকাবে না। বরং তোমার উপকার করবে। তুমি আজ থেকে অর্থবিত্তবান। তোমার দ্বারাই এই পৃথিবীতে নতুন সূর্য উঠবে৷ সত্যের জয় হবে৷ অন্যায় হবে না কোথাও। হলেও তার প্রতিবাদ করবে তুমি। তুমি তাদের শাস্তি দিবে৷ প্রয়োজনে খুন করবে৷ কী? তুমি কি এগুলো করতে পারবে না?" 

আমি মাথা নুইয়ে সায় দিলাম৷ তার জন্যে আমার জান পর্যন্ত হাজির৷ এ আর এমন কি! এরপর তিনি আমায় অনেক গুলো টাকা এক সাথে দেন৷ বলেম আমি যেন সাবধানে থাকি। টাকা পেয়েই আমি খুশিতে আত্মহারা। আর কী লাগে। এরপর এক রাতে হঠাৎ আমার মাঝে কেমন এক উন্মাদনার সৃষ্টি হয়৷ গা দিয়ে আগুন বের হতে থাকে যেন৷ আমি পাগলের মতো হয়ে যাই৷ আচমকা দৌড়াতে শুরু করি৷ ঝোপের ভেতর চলে যাই৷ সেখানে গিয়েই যেন প্রচণ্ড প্রশান্তি পাই আমি৷ এরপর কি জানি হতে থাকে৷ অদ্ভুত কিছু। আমার গা দিয়ে বড় বড় লোম গজাতে থাকে। হাত পা কেমন জানি হয়ে যায়৷ প্রচণ্ড কষ্টে তীব্র একটা চিৎকার দেই আমি৷ এরপরই নিজেকে একটা খোলশের ভেতর আবিষ্কার করি৷ কেমন অচেতন অচেতন একটা ভাব৷ কিন্তু আমার দেহ কী করছে তার টের পাই আমি। চোখ দিয়ে কেমন ঘোল ঘোল দেখি। দেখি, রুবিনার আতঙ্কিত চেহারা৷ শালিকে রাস্তায় দেখেই আমার অচেনাতা উবে যায় যেন। রাগে গা ফেটে যায়। আমার তখন দেবতার কথা মনে পড়ে যায়৷ তিনি পৃথিবী পরিষ্কারের দায়িত্ব আমার হাতে দেন৷ এই পৃথিবীকে পরিষ্কার করতে হলো এই বেশ্যা গুলোকে আগে মারতে হবে। তা না হলে এরা মানুষ ঠকিয়ে তাদের জীবন তচনচ করে দিবে৷ যতদিন বেশ্যা থাকবে ততদিন এই পৃথিবীতে পাপ হতে থাকবে৷ আমি আর অপেক্ষা করলাম না৷ তার কারবার সেখানেই শেষ করে ফেললাম। এরপর হঠাৎই মনে হলো আমাকে কেউ কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ আমিও তার সাথে যেতে থাকলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও। একসাথে চারটা খুন করলাম। না, আমি নই। সেই খুন গুলো করে আমার জীবনের সবচে প্রিয় বন্ধু৷ যাকে আপনারা নেকড়ে বলেন৷ সে৷ কিন্তু সে কেন এদের খুন করে তা আমি তখন জানতাম না। ওই বৃদ্ধকে দেখেও কেন খুন করলো না তাও জানতে পারলাম না। খুনাখুনির পর্ব শেষ করে আমি বাড়ি ফিরলাম। ভীষণ ক্লান্ত দেহ৷ এরপর আরো দুটো খুন করি৷ সেগুলো একদম অনিচ্ছাকৃত। নুহাস এবং ইমি। তাদের মারার ইচ্ছে আমার মোটেও ছিল না৷ কিন্তু তারা আমাদের সামনে পড়ে যায়৷ আমার আর আমার প্রিয় বন্ধুর৷ বন্ধুর খুব ক্ষুদা পেয়েছিল তখন৷ তার রক্ত চাই৷ আমি বললাম এদের নয়৷ অন্য কারো খাও৷ সে আমার কথা শুনলো না। সে তাদের রক্ত চুষে খেল। আমি তার উপর রাগ করলাম। আমার রাগ বন্ধুর উপর কোনো প্রভাব ফেলল না। আমি মন খারাপ করেই থাকলাম। এরপর আমরা আবার খুন করে গেলাম ফরেনসিক ল্যাবে৷ এই খুন করা হয় কেন সেটাও আমি জানি না৷ তখনই আমার মন নাড়া দিয়ে উঠল৷ আমি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে যাই এই কারণ গুলো খুঁজতে৷ তখনই আমি বৃহৎ সত্যটি জানতে পারি৷ আমাকে সেই সত্যটা আমার বন্ধুই জানায়৷ হঠাৎ বন্ধুর সাথে কেউ দেখা করতে আসে৷ সুন্দরী একটি মেয়ে। ফর্সা চেহারা। চকচকে হলুদ চুল তার৷ পরনে কালো একটা কোট৷ বড় কোট৷ দে একদম আমার সামনে চলে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-কেমন আছো ক্যামু?
তাকে দেখে আমি হতভম্ব। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তার আগেই আমার ভেতর থেকে কেউ জবাব দিয়ে উঠলো৷ আমি যারপরনাই অবাক হলাম৷ আমার বন্ধু কথা বলতেও জানে? এরপর ওই মেয়েটা কী জানি কথা বলল ওটার সাথে৷ যাওয়ার আগে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে গেল সে। সেই চুমু ছিল আমার জীবনের সেরা চুমু৷ এতো অনুভূতি প্রবণ এবং অনিন্দ্য যা বলে বোঝানো যাবে না৷ তার কোমল ঠোঁটের স্পর্শে আমার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গিয়েছিল যেন৷ অদ্ভুত কিছু অনুভূতি হলো। তার যাওয়ার পরই আমি আমার বন্ধুর সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। পৃথিবীতে আমিই এক মাত্র মানুষ যে তার শরীরে লুকোনো বন্ধুর সাথে কথা বলতে জানে। কথার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম আমার দেবতা আমার এই দেহ তাদেরকে উপহার স্বরূপ দিয়েছে৷ তাদেরকে আমার দেহ দিয়ে বিনিময়ে তার স্বার্থ উদ্ধার করেছেন৷  নেকড়ে বন্ধুর দেবতা আমার শরীরটা নিজের আয়ত্ত্বে নেন এবং আমার ভেতর নেকড়েটাকে প্রবেশ করিয়ে দেন৷ এই ছিল মূলত আমাদের পাহাড় ভ্রমনের মূল উদ্দেশ্য। এসব জানার পর দেবতার প্রতি মারাত্মক ঘৃণা জন্মে আমার। আমার জীবনের শেষ মানুষটি, যাকে আমি আমার আলোর দিশারী ভেবেছিলাম সেই মানুষটিও ছিল মারাত্মক একটি ভুল৷ এটা ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে। যাই হোক, তিনি আমার পৃথিবী পরিষ্কারের দায়িত্ব দিয়েছেন আমি সেই কাজে লেগে গেলাম। বন্ধুকে সাথে নিয়ে গেলাম নিজ গ্রামে৷ আমার বোনের পাঁচজন ধর্ষণকারীকে খুঁজে বের করে তাদের নির্মম ভাবে হত্যা করলাম। কয়েকজনকে উপহার দিয়েছি আমার নেকড়ে বন্ধুকে। সে এমন উপহারে ভীষণ খুশি হয়৷ তখন তার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানতে পারি। সেদিন যে মেয়েটি এসেছিল তার নাম ফ্লোরা। ফ্লোরা মেয়েটি আমার এই নেকড়ে বন্ধুটিকে পুষতো৷ একমাত্র ফ্লোরাই তাকে ভালোবাসতো। আর কেউই তাকে ভালোবাসতো না৷ আজ হঠাৎ আমার উপহারে সে অত্যন্ত খুশি হয়ে কথা গুলো বলে ফেলে৷ আমি কিছু বললাম না এ নিয়ে৷ তাকে নিয়ে আবার শহরে ফিরলাম৷ ফিরে আমার দেবতাকে খুন করে ফেললাম৷ শালার ভদ্রবেশে থাকে। নিজেকে মহান ভাবে। কুত্তা****।  তুই কেন এমন করলি? তুইই তো বললি পৃথিবী পরিষ্কার করতে। আমি এখন তাই করলাম। তোর মতো কুত্তা***কে মারা উচিৎ। এই পৃথিবীতে তোর বাঁচার অধিকার নেই৷ তোর মতো এমন মানুষকে এই পৃথিবীতে রাখলে পৃথিবীটা নষ্ট হয়ে যাবে৷ 
ইমন ছেলেটা থামলো। শিশির এবং তুষার দু'জনেই চুপচাপ বসে আছে। তাদের চেহারা থমথমে হয়ে আছে৷ তারা কী বলবে বুঝতে পারছে না৷ ইমন ছেলেটা বলল,
-স্যার? টিভিটা অন করুন। তরতাজা কিছু নিউজ পাবেন। 
তুষার দ্রুত টিভি অন করলো৷ টিবিতে সব চ্যানেলেই দুটো নিউজ বারবার দেখাচ্ছে। প্রথম নিউজটি হচ্ছে, 
"শহরের নেকড়ে এখন গ্রামে। মিরনপুর গ্রামের পাঁচজন যুবককে নির্মম ভাবে হত্যা৷" 

সাড়ে চারটার নিউজ এটা৷ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার আরেকটা নিউজ দেখাচ্ছে৷ সেই নিউজটি হচ্ছে, 

"নেকড়ে ধরতে গিয়ে প্রাণ হারালেম ওসি নুরুজ্জামান।" 

শিশির এবং তুষার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে টিভির স্ক্রিনের দিকে৷ তারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না৷ ইমন হঠাৎই হেসে উঠল। তার অট্টহাসি সমস্ত রুমে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। শিশির নুরুজ্জামানের ফোন কল দিলো। সেই কল রিসিভ হলো না৷ শিশির মজিদকে কল দিল। মজিদ কল ধরেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-স্যার, ওই শালা ন্যাকড়ে আমার স্যার রে মেরে ফেলছে।
শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ ফোন কেটে পকেটে রাখলো। মাথাটা কেমন ভারভার লাগছে৷ ইমন হাসি থামিয়ে বলল,
-স্যার, কেমন লাগছে?
শিশির কড়া স্বরে বলল,
-কেমন লাগছে বলতে পারছি না৷ তবে আপনি যা করেছেন ঠিক করেননি৷ আপনার কঠিন শাস্তি হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অন্যায়।
ইমন চোখমুখ কঠিন করে বলল,
-যে দেশে আইনই নেই সে দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা আর যাই হোক অন্যায় হবে না৷ আমার বোনের যে হত্য হলো, এতো গুলো দিন যে পেরিয়ে গেল, সেই হত্যার খুনিদের ধরা গেল না কেন? তখন আপনার আইন কোথায় ছিল? 
শিশির জবাব দিতে পারলো না। সে চুপ করে থাকলো৷ ইমন বলল,
-আপনার বন্ধু, নুরুজ্জামান, সে আমাকে নিয়ে পাহাড়ের ধারে এক ওঝার কাছে যায়৷ ওঝাকে অনেক টাকা দেয় সে। সেই ওঝা আমাকে এই নেকড়ে দেবতার হাতে তুলে দেয়। আমি হই নেকড়ে মানব৷ তারপর সে আমার দ্বারা তার স্বার্থ হাসিল করে। আশফাক সাহেবের পুরো পরিবারকে হত্যা করে আশফাক সাহেবকে মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে দেয়। আমি তাকে অত্যন্ত ভালো মানুষ... 
হঠাৎই ইমন কেঁপে উঠে। মেঝেতে পড়ে যায়৷ অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে৷ আচমকা এমন দৃশ্য হতবাক হয় তুষার ও শিশির৷ তুষার জলদি করে ঘড়ি দেখে৷ বলে,
-রাত সাড়ে বারোটা পেরিয়ে গেছে৷ 
শিশির বলল,
-সাড়ে বারোটা? তাতে কী?
-অমাবস্যার রাত গভীর হতে হতেই এদের শক্তির পরিমান বেড়ে যায়৷ এরা শিকারের জন্যে পাগল হয়ে যায়৷ ইমনের দেহের ভেতরের নেকড়েটা এখন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। সে বেরিয়ে আসতে চাইছে। 
-এখন? কী করবে? 
-একে পুড়িয়ে ফেলতে হবে৷ 
-পুড়লে এর নাশ ঘটবে?
-হ্যাঁ৷ এছাড়া আর উপায় না৷ 
-কোনো ভাবে ইমনকে বাঁচানো যাবে না?
তুষার মুখ কালো করে বলল,
-পারলে আমি অনেক আগেই কাজটা করতাম। কিন্তু এটা সম্ভব না৷ নেকড়েটার হৃদপিণ্ড আর ইমনের হৃদপিণ্ড এক সাথে জোড়া লাগানো হয়েছে। এই জোড়া খোলা অসম্ভব। এখন ইমনকে মারলেই তবে নেকড়েটাকে মারা যাবে। 
ইমনের নাড়াচাড়া প্রবল হতে থাকলো। তার গলা দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ আসতে থাকলো। তার গায়ের চামড়া দিয়ে লোম বের হতে দেখা দিলো৷ সেগুলো বের হচ্ছে আবার লুকিয়ে যাচ্ছে চামড়ার ভেতর। তুষার বুঝল সময় বেশি নেই৷ যা করার দ্রুতই করতে হবে৷ 

অমাবস্যার সেই রাতের নিকষ অন্ধকারে ইমন নামক একটি ছেলেকে পোড়ানো হয়ে গেল। জ্যন্ত অবস্থা পুড়তে হলো। তার তীব্র চিৎকার এই নানান রূপে মানুষ গড়া শহরের কেউ শুনতে না পেলেও এই শহরের দু'জন মানব শুনতে পেল। তারা পাথরের মতো তার মৃত্যু দেখলো। তাদের কিছুই করারা ছিল না। তারা নিরুপায়। তারা নীরবে দাঁড়িয়ে দেখলো। দু'ফোটা চোখের জল ফেললও যেন। ইমনের মতো ছেলের জন্যে এই অনেক। তারা দু'জনে  মনে মনে দোয়া করলো এমন মৃত্যু এমন পৃথিবীর কারো না হোক। কারো না হোক। 
.
সমাপ্ত। 
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url