গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প - দ্বিতীয় অংশ । লেখক- তাসফি আহমেদ

গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প - দ্বিতীয় অংশ । লেখক- তাসফি আহমেদ  



বাংলা ছোট গল্প.। Bangla Love Stories Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.




গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প



দ্বিতীয় অংশঃ

আমরা দু'জন ফুটফাত ধরে হাঁটতে থাকলাম। মাথার উপরে চাঁদ৷ বসন্তের মায়া মাখানো পরিবেশ! হঠাৎ কগন বলে উঠল,
-লেখক?
আমি আনমনে বললাম,
-হু।
-আমি একটা বিষয়ে রাগ করেছি আপনার উপর৷
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-মেয়ে জাতি খুবই অদ্ভুত জাতি৷
-কেন? অদ্ভুত কেন?
-এরা প্রশংসা পেতে এতো ভালোবাসে তাই!
-এটা তাদের অধিকার। প্রিয়জনের প্রশংসা পাবে না তো কার থেকে পাবে, হু?
-তাহলে কি আমি কারো প্রিয়জন?
কগন রহস্যময়ী হাসি দিলো। বলল,
-তা তো বলিনি।
-তাহলে অপ্রিয়?
-সেটাও না৷
-তবে?
-সিদ্ধান্ত নেইনি।
-সব ব্যাপারে কি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেন?
মেয়েটা হাসল। বলল,
-অবশ্যই৷
আমি মৃদু হেসে চুপ থাকলাম। সে বলল,
-আপনি কিন্তু কথার ছলে আমার রাগের ব্যাপারটা ভুলিয়ে দিচ্ছেন। এটা অন্যায়।
-আমি এই অন্যায়টা বারবার করতে চাই৷
সে মাথা নিচু করে মুখ মলিন করে বলল,
-আমি চাই না৷
আমি কিছুটা চুপ করে বললাম,
-শাড়ি পরেছেন। অথচ আমি এ নিয়ে কিছুই বলিনি৷ এ জন্যেই তো রাগ তাই না?
সে চুপ থাকল। আমি বললাম,
-মানুষের প্রশংসা করি না আমি৷ তার সেটা 'আলগা পিরিত' ভেবে হাসির মাঝে উড়িয়ে দেয়৷
তার মলিন জবাব,
-আমি প্রশংসা শুনতে চাইনি৷
-সত্যিই চাননি?
সে মুখ শক্ত করে বলল,
-হ্যাঁ।
আমি খানিকটা চুপ থাকলাম। সেও। নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। যেন ক'পা সামনে এগোলো তাই গুনছে৷ বললাম,
-আপনাকে এভাবে দেখার একটা ভীষণ আগ্রহ জমেছিল সেই সকালে। আমি অনেক্ষণ অপেক্ষা করেছি৷ আপনি আসেননি। আমার আগ্রহরা তখন মরে গিয়েছি।
সে মাথা তুলে অন্যদিকে তাকালো৷ অভিমানী মুখে বলল,
-মনে হয় আমি ইচ্ছে করেই আসিনি৷
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-কগন?
তার নিরুৎসাহিত জবাব,
-হু।
-আপনি খুব সুন্দর করে কাজল পরতে জানেন৷
সে কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকল। আমি বললাম,
-আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখি৷ কেউ খুব যত্ন করে নিজের চোখে কাজল মাখছে৷ আমি ভীষণ আগ্রহে তাকিয়ে থাকি৷ তার কাজল কালো চোখ দুটো দেখবো বলে। কিন্তু আমার দেখা হয় না৷ তার আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।
মেয়েটা এবারেও চুও থাকল। আমি বললাম,
-আজ আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নের বাকি অংশ বাস্তবে দেখছি; আপনার চোখে৷ সেই চোখ দুটোর সাথে আপনার চোখের ভীষণ মিল। একদম কাজলটাও৷ হয়তো এ কারণেই এতো আকর্ষণ। আমার আকর্ষণ মিথ্যা হয়নি।
তার মুখ লাল হলো হলো খানিক৷ খানিকটা উজ্জ্বল হলো। তবে তা প্রকাশ করলো না৷ বলল,
-আকর্ষণ কি কেবল চোখের মাঝে?
আমি হাসলাম। বললাম,
-বলব না৷
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-কেন?
আমি বললাম,
- মন চাচ্ছে না।
-মনের বিপরিতে গিয়ে কি কথাটা বলা যায় না?
-অবশ্যই না৷
-আচ্ছা৷ বলতে হবে না৷
খানিকটা নীরবতা। আমি বললাম,
-রাগ করলেন বুঝি?
-না।
-আমি তো দেখছি।
-কীভাবে দেখছেন?
-চেহারায় ভাসছে৷
-আপনি চেহারা পড়তে পারেন?
-না। তবে আপনারটা কেন জানি পারছি৷


মেয়েটা কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। আমি বললাম,
-শাড়িতে বেশ মানিয়েছে।
সে একটু হাসলো৷ বললাম,
-মিথ্যা বলিনি৷ আপনাকে সত্যিই অসাধারণ লাগছে৷
-কিন্তু আমার চেহারা তো বিশেষ সুন্দর নয়৷ বর্ণটাও না৷
-তা বললো কে?
-সবাই তো বলে৷
-সবার কথা গায়ে নিতে নেই৷
-কিন্তু সবার বিচার তো একই!
-হবে হয়তো৷ কিন্তু তারা তো আমার মতো দেখেনি৷ আমার চোখে দেখেনি৷ আমার চোখে আপনি সুন্দর। অনিন্দ্য।
মেয়েটা চুপ থাকল। একদম চুপ। আমি তার দিকে তাকাতেই মনে হলো সে কাঁদছে৷ আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,
-কগন?
সে মাথা নিচু করে আছে৷ আমি তার থুতনি ধরে মাথা উঁচু করলাম। মেয়েটা সত্যি সত্যিই কাঁদছে। চোখ ভরা তার জলে। আমি বললাম,
-কাঁদছেন কেন?
সে কিছু বলল না। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণাটা মুছল৷ খুব সাবধানে। যেন কাজল লেপ্টে না যায়। আমি পকেট থেকে রুমালটা বের করে দিলাম। বললাম,
-নিন।
সে রুমাল নিলো৷ আমি কাঁপাকাঁপা স্বরে বললাম,
-কান্নার কিছু এখানে হু?
সে ধরা ধরা গলায় বলল,
-আমাদের বাসার সবাই ফর্সা৷ কেবল আমি ছাড়া৷ তাই যখনই বাসায় কেউ আসে, তখনই আমায় দেখে নানান কথা বলে। আমি কেন শ্যামলা, কেন সবার মতো হইনি এসব৷ মজার ছলেও অনেকে আঘাত দেয়। সেসব কথা আমি কঠিনভাবে ফেস করতে পারলেও মনে মনে কথাটা রয়েই যায়। গভীর রাতে কান্নার কারণ হয়৷ কিন্তু আজ আপনি সুন্দর বললেন বলে, কেন জানি না, আচমকা চোখে জল এসে গেল৷ নিজেকে আসলেই রূপবতী মনে হলো৷ লেখক, আপনি কীভাবে নিজের অনুভূতিকে কথার মাঝে এতো জীবন্ত করতে পারেন? গল্পে গল্পে না হয় পারতেন। কিন্তু সামনের মানুষটির অনুভূতিকে এভাবে নাড়িয়ে দিবেন ভাবিনি৷
আমি হাসলাম। বললাম,
-কাজলটা লেপ্টে যেতে দিন। দেখি, লেপ্টে যাওয়া কাজলে আপনাকে কেমন সুন্দরী লাগবে৷
-তার প্রয়োজন নেই৷ ওইভাবে দেখলে আপনি পালাবেন৷
-বিশ্বাস রাখতে পারেন।
-আমি সেই বিশ্বাস রাখি মনে৷
-তবে ভয় কিসের?
-হারানোর।
-প্রিয় মানুষদের হারানোত ভয় থাকে। আমি তো আপনার প্রিয় মানুষ নই।
-অপ্রিয় যে তাও তো বলিনি৷
-খুব কথা জানেন আপনি৷
-আপনি বুঝি কম জানেন!
আমি কিছু বললাম না। চুপ থাকলাম খানিক। কিছু সময় পর নিজ থেকেই বললাম,
-একটা জিনিস খেয়াল করেছে?
-কোন জিনিসটা?
-আমাদের প্রথম দেখা হয়েছে আজ৷ অথচ আমরা এমন ভাবে কথা বলছি যেন আমাদের দেখা সাক্ষাৎ এমন বহুবার হয়েছে।
-লেখক? আপনার সাথে আমি যখন মেসেঞ্জারে কথা বলতাম তখন আমার মনে হতো আপনি আমার সামনে বসে আছেন। একদম কাছে৷ আমরা গল্প করছি৷
-সেটা কীভাবে হতো?
-জানি না। কেবল মনে হতো৷ ঘোর সৃষ্টি হতো৷
আমি চুপ থাকলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না৷ সেও চুপ থাকল৷ চট করেই আমার মনে হলো আমরা অনেকদূর হেঁটে এসেছি৷ আমি বললাম,
-আশ্চর্য! আমরা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে চলে এসেছি!
মেয়েটার ঘোর ভাঙ্গল যেন৷ চট করেই চারপাশ দেখলো। বলল,
-আরেহ! তাই তো৷ আমার তো খেলায়ই নেই৷
আমি ঘড়ি দেখলাম। বললাম,
-অনেক সময় হয়ে গিয়েছে।
-কয়টা বাজে?
-দশটা বাজতে চলেছে।
সে অবাক স্বরে বলল,
-দশটা? কী বলেন?
-দেখুন।
আমি তাকে ঘড়ি দেখালাম। সে যেন ভীষণ অবাক হয়েছে। বলল,
-এতো সময় হয়ে গেল অথচ টেরও পাইনি?
-কথা কথায় কীভাবে যে সময়টা পেরিয়ে গেল!
সে খানিকটা চুপ থাকল। তারপর বলল,
-লেখক?
-জ্বি বলুন।
-আমাকে যে এবার যেতে হচ্ছে৷
-আচ্ছা। আমি রিক্সা ডেকে দিচ্ছে। রিক্সায় করে যাওয়া যাবে তো?
-হ্যাঁ৷ এখান থেকে কাছেই।
আমি রিক্সা ডাকলাম। সে জায়গার নাম বলো৷ তারপর রিক্সায় উঠে বসলো৷ আমি বললাম,
-তাহলে আজ এই পর্যন্তই?
সে মলিন হাসি দিল৷ বলল,
-আমরা ওই পার্কে একদিন অবশ্যই দেখা করবো। সেদিন আমি সময় মতো পৌঁছাবো। কথা দিলাম।
-বেশ। তাই হোক।
সে হাসল। কিন্তু চুপ করে থাকল। রিক্সাওয়ালা মামাকে যেতে বলল না৷ কে বলল না তা ভাবলাম খানিক৷ সে চুপ করে থাকল। আমি বললাম,
-মামা, যাও তাহলে।
মেয়েটা চট করেই আমার দিকে তাকালো৷ এবং তাকিয়ে থাকলো৷ কিছুদূর গিয়ে চোখ নামিয়ে আবার তাকালো৷ আমার কেমন জানি লাগল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো আমার। তার চোখটায় কিছু একটা ছিল। কিছু আকাঙ্ক্ষা! কিংবা চাওয়া৷ আমি জোরে করে ডাক দিলাম। দৌড়ে গেলাম রিক্সার পেছন রিক্সা থামল৷ কগন পেছন ফিরে তাকালো৷ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমি তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। চেহারাটায় কেমন জানি উজ্জ্বলতা ফুটে ছিল৷ খুব মনে ধরল আমার। আমি কাছে গিয়ে বললাম,
-কগন, আমি যদি আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই তবে কি আপনার খুব প্রব্লেম হবে?
সে চট করেই জায়গা করে দিল৷ যেন এই কথাটার অপেক্ষাই করছিল৷ মুখ ভর্তি তার বিজয়ের হাসি। যেন আমি এই কথাটি বলাতে তার দুনিয়ে উজ্জ্বল হয়েছে৷ সুন্দর এবং আলোকিত হয়েছে৷ আমি উঠে বসলাম। সে আমাকে পানির বতোল এগিয়ে দিলো৷ আমি কয়েক ঢোক পানি গিলে নিলাম। বতোলটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। সে খুব যত্নে তা নিজের ব্যাগে রাখল৷ যেন খুব মুল্যবান কিছু রাখছে৷ আমি তার চোখের দিকে তাকালাম৷ কী উচ্ছাস সেখানে। আনন্দে ভরপুর। বললাম,
-লুক দেওয়া কী প্রয়োজন ছিল? নিজ মুখে কি বলতে পারতেন না যে, লেখক আমাকে বাড়িয়ে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসুন?
সে সামনেত দিকে তাকিয়ে বেশ আনন্দিত স্বরে বলল,
-সব কথা মুখে বলে দিতে হয় না লেখক৷ কিছু কিছু কথা চোখের ভাষায় বুঝে নিতে হয়।
-সবার কী চোখেত ভাষা পড়ার ক্ষমতা থাকে৷
-প্রিয়জনদের অবশ্যই থাকে।
-তাহলে আমি প্রিয়জন তা স্বীকার করছেন?
-অস্বীকারওবা করলাম কই?
আমি কিছু বললাম না। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলাম৷ আড়ালে সে আমাকেও দেখে নিলো৷ আমরা রিক্সায় করে চললাম সামনের দিকে৷ আমাদের পিছু পিছু, যেন জন্যেই দৌড়ে দৌড়ে আসছে চাঁদটা। তার কোমল আলোয় ভাসিয়্র দিচ্ছে আমাদের৷ আমরাও ভেসে যাচ্ছি অদূরে৷ অনুভূতির কোনো এক অতল গহ্বরে।


তৃতীয় অংশঃ
.
এভাবেই আমাদের দু'চার দিন করে রোজ মেলামেশা হয়ে উঠল৷ অচেনা অজানা কগন নামটা হঠাৎই আমার অভ্যাসে পরিণত হলো৷ সেই ছাপ যেন লেখালেখিতেও পড়লো। আমার গল্প গুলো যেন হঠাৎ কগনের মাঝে ফুটে উঠল। সে ফুটে উঠল আমার গল্পে৷ খুব গোপনে জায়গা করে নিলো সেও৷ এভাবেই এগিয়ে গেল আমাদের বেনামি সম্পর্কটা৷ তার বই পছন্দ। আর আমার কাঠগোলাপ। সে রোজ আমার জন্যে কাঠগোলাপ নিয়ে আসতো৷ আমি নিয়ে যেতাম বই৷ তবে সব সময় কাঠগোলাপ না পেলেও সে নানান ফুল নিয়ে আসতো আমার জন্যে৷ ফুল না হলে পাতার মাঝে সুন্দর করে কোনো এক কবির/লেখকের একটা-দুটো উক্তি লিখে নিয়ে আসতো আমার জন্যে৷ কিংবা মাঝে মাঝে ডায়েরী লিখে আমাকে উপহার করতো৷ আমি বই কিনে সেখানে তার জন্যে শুভেচ্ছা বাণী লিখতাম৷ না লিখলে বড্ড রাগ করতো সে। আমার লিখা ততো ভালো নয়৷ তবে মেয়েটাকে তা ভীষণ প্রভাবিত করতো৷ আমি খুব বুঝতাম৷ সে আমার লেখার হারিয়ে যাচ্ছে৷ অথচ আমি তেমন ভালো লেখকই নই। "যে যেথায় মানায়" নামে একটা বই প্রকাশ হয়েছিল আমার। সে-ই আমার প্রথম ক্রেতা৷ তার কড়া আদেশ! আমি যেন প্রথম বইটা তার কাছেই বিক্রি করি৷ অন্য কারো কাছে বিক্রি করলে তিনি আমার খবর করে ছাড়তেন৷ কী আবেগি নিষ্পাপ আবদার। আমি খুব যত্নে আমার জীবনের প্রথম অটোগ্রাফটা তাকে দিলাম। সে মুগ্ধ হলো। চোখের কোণে দু'ফোটা জল জমলো৷ গৌধুলি লগ্নে লেক পাড়ে অঘোষিত সম্পর্কে বিনা অনুমতিতে সে আমার কাঁধে মাথা রেখেছিল। আমার রুমাল দিয়ে চোখ মুছেছিল। আমি তাকে দেখলাম একবার৷ মেয়েটা অনিন্দ্য সুন্দর লাগছিল৷ আমিও যেন ধীরে ধীরে তার মাঝে তলিয়ে যেতে থাকলাম। এভাবে দিন যাচ্ছিল৷ ততদিনে পড়াশোনা শেষে একটা চাকরিও জুটে গিয়েছিল আমার।
.



একদিন হঠাৎই মা তার ঘরে ডাকলেন৷ আমি বেশ অবাক হলাম৷ মা সাধারণত এতো আয়োজন করে আমাকে ডাকেন না৷ আমি মায়ের ঘরে গেলাম। যেতেই মা দরজা আঁটকে দিলেন। আমাকে নিয়ে বারান্দায় বসলেন। খুব সুন্দর করে পান বানিয়ে মুখে দিলেন। বললাম,
-মা, কী হয়েছে? হঠাৎ এভাবে ডেকে আনলে যে।
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
-তুই বই লিখেছিস একটা। আমি এ কয়দিনে সেটা পড়ে শেষ করেছি৷ ভালো লিখেছিস তো! আমি তো জানতামই না আমার ছেলে এমন লেখালেখি করছে!
আমি হাসলাম৷ লজ্জা পেলাম খানিক। মা বললেন,
-সব কিছু ঠিক আছে। এখন বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবছিস?
আমি বললাম,
-সেটা নিয়ে ভাববে তোমরা। আমি নিশ্চয়ই নই৷
-আচ্ছা৷ কেমন মেয়ে পছন্দ তোর?
-যেমনটা তোমাদের পছন্দ।
-আমাকে খুশি করার জন্যে বলিস না৷ নিজের কথা ভেবে দেখ৷ আমি বৃদ্ধ হচ্ছি৷ মৃত্যুর অপেক্ষা কেবল। ভবিষ্যতটা তোর৷ এখানে আমাকে খুশি করানোটা তোর জন্যে বোকামি। তোর কেমন মেয়ে পছন্দ স্পষ্ট করে বলতো?
আমি খানিকটা চুপ থাকলাম। একটু একটু লজ্জা লাগছিল৷ স্বভাবত আমি মায়ের সামনে কোনো ব্যাপারেই লজ্জা পাই না৷ আজ কেন যেন পাচ্ছি৷ মা বললেন,
-লজ্জার কিছু নেই৷ আমরা এখানে কিছু নির্মম সত্য বিচারের জন্যে বসেছি। তোকে সব কিছু স্পষ্টই বলতে হবে।
আমি খানিকটা চুপ থাকলাম। বাইরে প্রগাঢ় অন্ধকার। আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম,
-আমার সংসারী মেয়ে পছন্দ৷ যে হাজার ব্যস্ততায়ও বই পড়া ভুলবে না। যে তোমাদের খেয়াল রাখবে৷
-আমাদের খেয়ালের কথা বাদদে৷ নিজের কথা ভাব৷ অবশ্যই এমন মেয়েকে চাইবি যে তোর খেয়াল রাখবে৷
-হ্যাঁ। ঠিক তাই৷
-তা এমন কাউকে পছন্দ আছে?
আমি এবার আসলেই লজ্জা পেলাম। মা আগ বাড়িয়ে বললেন,
-কগন মেয়েটার খোঁজ নিয়েছি আমি।
আমি চট করেই মায়ের দিকে তাকাতে পারলাম না। মৃদু হেসে বললাম,
-তুমি ওর খবর জানলে কীভাবে?
-কীভাবে সেটা প্রশ্ন নয়৷ আমার কথা হচ্ছে মেয়েটা কি তোর জন্যে ঠিক আছে? কিংবা আমাদের জন্যে?
কথাটা মাথার উপর দিয়ে গেল যেন। বললাম,
-ঠিক বুঝিনি মা।
-বাস্তবতা ভাবতে শিখ প্লাবন। আবেগের বসে ভুল করে বসিস না। পরে ভীষণ পস্তাবি।
-তুমি বলতে চাইছো কগন আমার জন্যে ঠিক নয়?
-তা নয়। আমি তোকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করতে বলছি। তুই কি আসলেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখিস? কিংবা সে কি তোকে মানবে?
-মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে মা!
-কেবল ভালোবাসা দিয়ে সংসার জীবন চালানো যায় না৷ সংসারে আরো অনেক কিছু মেনে চলতে হয় বাবা৷ একে অপরকে মানার, একে অপরকে শ্রদ্ধা-সম্মান করার, কোনো কিছু যাতে দু'জনের কারো উপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো না হয়, এমন অনেক কিছুই হিসেব করে চলতে হয় বাবা৷ সে বাবার আহ্লাদী মেয়ে৷ আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরে কি সে ঘাম ঝরাবে?
আমি চুপ করে থাকলাম। মাথাটা কেমন জানি করছে। মা বললেন,
-এই সংসারটা আমি এতোদূর টেনে এসেছি একা একা। আমি তোর বউ হিসেবে এমন একজনকে চাই যে আমার এই আমানত কে সঠিক ভাবে আগলে রাখতে জানবে৷ তোর কাছে আমার এই ছোট্ট একটা আবদার৷ আমার আর কিছু চাই না বাবা৷
মা আমার হাত ধরে কথাটা বললেন৷ চোখেমুখে তার মিনতি। তিনি খুব চাইছেন সংসারটা একটা বিশ্বস্ত হাতে দিতে৷ আমি কিছু বললাম না৷ চুপ করে থাকলাম৷ মা বললেন,
-এরপর তোর যদি মনে হয় কগন এই সংসারে টিকতে পারবে তবে আমি কখনই দ্বিমত করবো না৷ আমি তাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসতে এক পায়ে প্রস্তুত৷



আমি চুপ করে থাকলাম৷ নিজের ঘরে এসে খুব ভাবলাম কথা গুলো নিয়ে৷ আমরা আমাদের সময়টা বেশ ঘোরে ঘোরে কাটিয়ে দিয়েছি৷ অথচ আমরা এই বাস্তব ব্যাপার গুলো নিয়ে কখনই কোনো কথা বলেনি৷ আমাদের মাঝে কখনই সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়নি৷ আমরা একটা বেনামি সম্পর্কে এগিয়ে যাচ্ছি৷ কেবল উপহার দেওয়া নেওয়া কিংবা সুন্দর সুন্দর মূহুর্তের মাঝে আমরা সময়টা পার করেছি৷ অথচ আমাদের এই বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ। আমরা কোন সম্পর্কে আছি? কেন আছি? কিংবা আমাদের চাওয়া পাওয়া গুলো? আমাদের এমন আলোচনার ভীষণ প্রয়োজন। ভীষণ।
.

গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প

(শেষ অংশ)

.
নীলিমা কিছু সময় আকাশের দিকে চেয়ে থাকল৷ আকাশে চাঁদ তখন নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে৷ চাঁদের কোমল আলো নীলিমার মলিন- চোখে, মুখে, গালে  লেপ্টে থাকা রঙিন হিংসায় পড়ছে। খুব যত্ন করে শাড়ি পরেছে মেয়েটা। দূর থেকে কেউ দেখলে বলবে ছাদের এই কোণায় কোনো পরী বসে আছে। পরীটার ভীষণ মন খারাপ৷ চেহারা ভর্তি পেয়েও না পাওয়ার ছাপ। যেন কতোদিনের গ্লানি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে৷ নীলিমা ডায়েরীর যে পৃষ্ঠা গুলো পড়েছিল সেগুলো একে একে ছিড়ে নিলো৷ লাইটার টা বের করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো৷ মূহুর্তে জ্বলে উঠল প্লাবন নামের ছেলেটির লিখা অপ্রকাশিত একটি গল্পের কিছু অংশ। নীলিমা মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে এলো আগুনের দিকে। আগুনের হলদে আলো তার চেহারাকে আরো আলোকিত করে তুলল। মেয়েটাকে সত্যিই দারুণ লাগছিল৷ কেবল চেহারাটার মলিন ভাবটা উবে যেতে দেরি, তাহলে যে-ই দেখবে সে প্রশংসা না করে পারবে না৷ নীলিমা আবার ডায়েরীটা পড়তে শুরু করলোঃ
"মায়ের কথা গুলো আমার মাঝে একদম গেঁথে গেল। আমার মনে হচ্ছিল এই গেঁথে যাওয়ার জন্যেই মা আমাকে কথা গুলো বলেছেন। তার মানে আড়ালে-ইঙ্গিতে তিনি জানালেন কগন তার সংসারের জন্যে উপযুক্ত নয়৷ আমি কথা গুলো নিতে পারছিলাম না৷ বারবার যেন কানের কাছে বাজছিল। রাতে ঠিক ভাবে ঘুম হলো না৷ কগনকে জানিয়ে রাখলাম আজ দেখা করছি৷ আমাদের সেই প্রিয় পার্কে৷ দশটা বাজে আসার কথা আমাদের। কিন্তু আমাকে গিয়ে খানিকটা অবাক হতে হয়৷ কগন এসে বসে আছে। আমার আগে এসেছে মেয়েটা! পরনে তার শাড়ি৷ মেরুন রঙের। চুলে খুব সুন্দর করে খোপা করেছে। কালো কেশে হলুদ সাদা মেশানো কাঠগোলাপের দল চুপটি করে আছে। চোখ ভরা গাঢ় কাজল। কপালে বিন্দুর মতো টিপটা যেন সমস্ত মুখে অদ্ভুত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আমাকে দেখতেই স্পষ্ট হাসলো সে। হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে৷ গজ দাঁত দুটো যেন ভীষণ মায়া কাড়ে৷ আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠে৷ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়৷ আমি কগনের পাশে বসি৷ বলি,
-কগন, কেমন আছেন আপনি?
সে হাসি মুখে জবাব দিলো,
-লেখকদের সঙ্গ পেলে কারো খারাপ লাগবে বলে মনে হয় না৷ কেউ খারাপ থাকবে বলেও না৷
-তাই? এই কথা কে বলল শুনি?
-বলেছেন কেউ একজন। ধরুন কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি!
-তা সেই জ্ঞানী ব্যক্তি কি আপনি?
সে হাসল। হাসিতে শব্দ হয়৷ আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে যেন৷ বললাম,
-একক ভাবে নিজেকে জ্ঞানী বলছেন। এটা যে অন্যায় তা কি জানেন?
-অন্যায়? কেমন অন্যায়, হু?
আমি থমকে গেলাম। কথা গুলিয়ে গিয়েছি যেন। বললাম,
-হবে কোনো এক অন্যায়। আচ্ছা আপনি নিজেই বলুন, নিজেকে যে জ্ঞানী বলে সে কি আসলেই জ্ঞানী? নাকি দশজনে যাকে জ্ঞানী বলবে সে জ্ঞানী?
-নিজের প্রতি বিশ্বাসি হয়ে নিজেকে জ্ঞানী বললাম। এখন দেখছি লেখক সেই বিশ্বাসটা কেড়ে নিতে উঠে পড়ে লেগেছে!
-আমি কারো বিশ্বাস করে নিতে চাইনি৷ চাই না৷
-তবে মেনে নিন আমি জ্ঞানী।
আমি হাসলাম। বললাম,
-মানিয়েই ছাড়বেন?
সে আত্মবিশ্বাসের সাথে হাসল। বলল,
-অবশ্যই।
আমি হেসে বললাম,
-তাই হোক। মেনে নিলাম। আপনি জ্ঞানী৷
মেয়েটার চোখমুখ হঠাৎ স্পষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কোনো যুদ্ধে বিজয়ী যেন৷ বললাম,
-আমার আগে এলেন দেখছি!
-কারো জন্যে অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।
-সেই ভালো লাগাটার সৃষ্টি কোথা থেকে?
-মনের গভীর থেকে।
-কতোক্ষণ অপেক্ষা করছেন?
-সে হিসেব বাদ দিন৷ এতো জরুরি তলবের কারণ কি জানতে পারি?
আমি খানিকটা হাসলাম। বললাম,
-এমন কঠিন কোনো কারণ নয় যে আপনাকে জানতেই হবে৷ কথা বলতে মন চাইলো৷ তাই ডাকলাম।
-তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে আপনি অন্য কোনো কারণে ডেকেছেন। লেখক, আমাকে মিথ্যা বলবেন না।
আমি খানিকটা চুপ করে থাকলাম৷ কগন আমার দিকে চেয়ে থাকল কিছু সময়৷ তারপর বলল,
-কিছু হয়েছে?
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
-না। তা নয়। তবে...
-তবে?
-কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল।
-বেশ তো! জিজ্ঞেস করুন না। এতো ঘাবড়াবার কী আছে?
-জানি না। আমি কথা গুলো বলতে চাইছি। কিন্তু বলতে পারছি না৷ মুখ দিয়ে আসছে না৷
কগন মুচকি হাসি দিল। চোখেমুখে তার আনন্দের ছাপ। বলল,
-শুনুন, এতো ঘাবড়ার কিছু নেই৷ আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন৷
আমি খানিক চুপ করে থাকলাম৷ তারপর বললাম,
-আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। এই ধরেন জগৎ সংসার, সম্পর্ক কিংবা ধরুন চাওয়া-পাওয়া নিয়ে৷
-বেশ তো! কথা বলার বেশ কিছু টপিক পাওয়া গেল।
আমি মলিন মুখে হাসলাম। খানিকটা চুপ থাকলাম৷ পাশে কোথাও একটা পাখি ডাক দিলো। এরপরই গাছের ডাল থেকে পাখিটির ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়ার কিছু শব্দ হলো কেবল৷ নীরবতা ভেঙ্গে বললাম,
-আপনার জীবনের উদ্দ্যেশ্য কী কগন? লক্ষ্য কী? কী হতে চান?



সে খানিকটা ভাবল। তারপর বলল,
-একটা সহজ এবং সুন্দর জীবনযাপন করতে চাই আমি। পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস দিবো। আমি নিজের জীবনে কিছু একটা করতে চাই৷ কিছু একটা হতে চাই, লেখক। আমার নিজস্ব একটা পরিচয় চাই৷ সবাই যেন আমাকে কগন চৌধুরী নামে চিনে। আমার বাবার পরিচয়ে নয়।
-বাহ! বেশ বলেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ের ভেতর এমন কিছু থাকা চাই৷ তাহলে হয়তো দেশটা সামনে কিছুটা এগিয়ে যাবে।
সে স্মিত হাসল। বলল,
-আপনারটা বলুন না?
-আমার আর কী বলবো! সহজ সুন্দর জীবন তো সকলেই চায়৷ আমার চাওয়াটাও ব্যতিক্রম নয়৷ চাকরি পেয়েছি। বিয়ে করবো এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবো৷ এইতো!
-আচ্ছা। বেশ ভালো তো!
-সংসার নিয়ে আপনার ধারণা কী?
-এই জিনিসটা নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। বেড়েই উঠেছি কেবল। রান্নাঘরে ধার ধারিনি পর্যন্ত৷
-তবে স্বামীর সংসার? তা কী করে সামলাবেন?
সে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল যেন। বলল,
-এটাই চিন্তার বিষয়। তবে আমার মনে হয় স্বামী স্ত্রী দু'জনে মিলে একসাথে মিলেমিশে থাকলে সংসারটা বেশ দারুণভাবেই চালানো যাবে। কী? আমি কি ভুল বললাম? পুরুষদের কি মেয়েদের কাজে সাহায্য করতে নেই?
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-তা তো বটেই। এতে ঝামেলাও কম হবে। কিন্তু এমনটা ক'জন পুরুষে ভাবে বলুন! সবাইই তো এমন চায় যে মেয়েরা সংসার করুক৷ রান্নাঘরে ভেতর তাদের জীবনটা পার করে দিক৷
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছু সময়। তারপর চট করেই বলে বসল,
-লেখক? আপনি কি সেই পুরুষদের দলে? নিশ্চয়ই নয়?
তার চেহারাটা হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে গেল৷ কেমন জানি মলিন মলিন ভাব। বললাম,
-আমার ধ্যান ধারণা তেমন নয়। তবে...
-তবে?
-কিছু সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ আমি।
-আপনি একজন লেখক হয়ে এই কথা বলছেন?
-সময় এবং অবস্থান আমাদের এমন অনেক কিছু বলতে বাধ্য করে৷ এতে যদি লেখক হওয়াটা অন্যায় হয় তবে আমি লেখালেখি ছেড়ে দিবো। একজন লেখক হয়ে কখনই এমন কিছু বলতে চাই না।
এই বলে আমি থামলাম। খানিকটা চুপ করে গেলাম আমি৷ মন ভার হলো ভীষণ। কগন কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল,
-কেমন মেয়ে পছন্দ আপনার?
আমি তখনও চুপ থাকলাম৷ নীরবতা ভেঙ্গে বললাম,
-বাদ দিন সেসব৷ আমার চাওয়া পাওয়ায় কী এসে যায়।
-অনেক কিছু এসে যায়৷ প্লীজ বলুন৷
-বলতে ইচ্ছে করছে না৷
-প্লীজ৷ বলুন না৷
-সহ্য হবে আপনার?
-অবশ্যই হবে৷
-ভুল বুঝবেন না তো!
-জ্বি না৷
-বুঝবেন!
-সত্যি বলছি। বুঝব না৷
-আমি সত্যি বলছি। আপনি ভুল বুঝবেন৷
-বলছি তো বুঝব না। প্লীজ প্লীজ৷ বলুন না।
মেয়েটার মুখ মলিন। তারউপর তার শিশু সুলভ আবদার। আমার মন যেন গলে পানি হয়ে যায়। বলা বাহুল্য! শক্ত ছিলও বা কবে৷ আমি খানিকটা চুপ থেকে জবাব দিলাম,
-আমার সংসারি মেয়ে পছন্দ৷ যে আমার মায়ের মতো আমাদের সংসারটাকে ধরে রাখবে৷
সে কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,
-সেই রান্নাঘরে পড়ে থেকে জীবন পার করে দেওয়া তাই না?
-অনেকটা তেমনই।
-মনে দাগ কাটল লেখক। আপনার মুখ থেকে এমন কিছু শুনবো বলে আশা করিনি।
-কেন?
-জানি না। হয়তো আপনার প্রতি আমার চাওয়াটা অনেকটা ভিন্ন রকমের ছিল।
-আমরা কল্পনায় মানুষের উপর অনেক কিছু চেয়ে বসি৷ একজন মানুষকে নিয়ে অহেতুক কল্পনা করি। যার ফলটা সব সময় বিপরীত হয়৷
মেয়েটা খানিকটা চুপ থেকে বলল,
-আমার খারাপ লাগছে৷ মন খারাপ হচ্ছে।
আমি চুপ করে থাকলাম। মেয়েটা বলল,
-কথাটা ফিরিয়ে নিন প্লীজ৷
-বাস্তবতা অনেক নিষ্ঠুর কগন। প্রিয় জনের জন্যে আমাদের অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়৷
-তাই বলে আপনি আমাকে বিসর্জন দিয়ে দিবেন?
আমি চট করেই মেয়েটার দিকে তাকালাম। বললাম,
-আপনি কি আমার এমন কেউ যাকে বিসর্জন দিবো?
সে আমার চোখে চোখ রাখল। তার চোখে স্পষ্ট জল৷ সে বলল,
-কেউ কি নয়? এতো দিনেও কেউ হইনি আমি?
-আমারও তাই প্রশ্ন। আমরা কী? কিসের ভিত্তিতে আমাদের এতো মেলামেশা?
-আপনি কি তা বুঝতে পারেননি?
-কোনো কিছু স্পষ্ট নয়৷ আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি আমার। আবার মনে হয় আপনি কেউ না৷ অচেনা কেউ৷ মন দু'দিক নিয়ে দোটানায় আছে কগন।
মেয়েটা চুপ করে থাকল। তার চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মূহুর্তে। হঠাৎ মেয়েটা কান্না করে দিল। কী ভীষণ নিষ্পাপ কান্না৷ একদম বাচ্চাদের মতো। এতো বড় একটা মেয়েকে এভাবে কাঁদতে, দেখতে মানায় না৷ বললাম,
-কগন? কাঁদছেন কেন?
মেয়েটা কিছু বলল না। চুপ করে কাঁদতে থাকল। বললাম,
-আশ্চর্য! আপনি কাঁদছেন কেন?
-আমার কাঁদতে মন চাচ্ছে তাই!
-বড় হয়েছেন৷ এখন এভাবে কান্না মানায় না।
-না মানাক। তাতে আপনার কী?
-বাহ! এখনই দূর করে দিচ্ছেন?
মেয়েটা চট করেই আমার দিকে ফিরে তাকালো৷ আমার হাত চেপে ধরল। ভেজা স্বরে বলল,
-আপনাকে আমি কখনই দূরে যেতে দিতে চাই না৷ আমি চাই আপনি আমার পাশে থাকুন এভাবে৷ সুন্দর সুন্দর কথা বলুন৷ আমরা ঘুরবো৷ আনন্দ করবো৷ সংসার করবো৷
মেয়েটা জল ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো আমার দিকে৷ আমি বললাম,
-কগন?
সে ভেজা জবাব দিলো,
-হ্যাঁ৷
-আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না?
সে বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ালো৷ সে আমাকে ভালোবাসে৷ বললাম,
-সত্যি করে বলুন।
-সত্যি করে বলছি।
-আবেগ দূরে রাখুন। আমি আপনার চোখ ভরা আবেগ দেখি।
-আমি আবেগের বসে বলছি না। আমি মন থেকে বলছি আমি আপনাকে ভালোবাসি।
-এই ভালোবাসার সৃষ্টি কোথা থেকে?
-জানি না।
-কবে থেকে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন৷


-আপনার গল্প পড়ার পর থেকে৷
-এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কেমন? গল্পে যে 'আমি' থাকি তা থেকে কি এই আমি'টা ভিন্ন নয়।
-উহু।
-এই যে সংসার নিয়ে কথা গুলো বললাম, আমার এগুলো বলা ঠিক হয়নি। এমনটা অন্যায়। তবুও আপনি বলবেন আমি ভিন্ন নই? গল্পে তো আমি এমন না৷
-আমি এসব কিছু জানি৷ কিচ্ছু জানতে চাই না। আমি কেবল আপনাক্র চাই। কেবল আপনাকে।
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ তারপর বললাম,
-কগন?
-আপনি যেন দিন দিন পাল্টে যাচ্ছেন। আমার কাছে এমন মনে হচ্ছে কেন?
কগন এবার জোর করে আমার হাত চেপে ধরল। বললাম,
-প্লীজ, এভাবে বলবেন না। আপনার মনে কি আমার জন্যে একটু মায়াও নেই? একটু প্রেমও কি জাগেনি?
আমি খানিকটা চুপ করে থাকলাম। বললাম,
-আমার কাছে সেই জবাব স্পষ্ট নেই৷
-আপনি মিথ্যা বলছেন।
আমি চুপ করে থাকলাম। কগন আমার দিকে চেয়ে থাকল। আমি বললাম,
-আমার মায়ের সংসারি মেয়ে পছন্দ৷ যে মেয়ে কোমল হাতে আমাদের সংসারটা সামলাতে পারবে। আমি জানি আপনি তা পারবেন না৷
-পারবো৷ আপনি যদি পাশে থাকেন তবে অবশ্যই পারবো৷ আমার ছায়া হিসেবে আপনাকে চাই আমি। তাহলে আমি যেকোনো কিছু করতে পারবো। তবুও আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লীজ৷
আমি অনেকক্ষন চুপ করে থাকলাম। কগন বলল,
-প্লীজ।
আমি এবারেও কিছু বললাম না। কগন বলল,
-প্লাবন, আপনি আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছেন৷
আমি কগনের দিকে তাকালাম। বললাম,
-আমি চাই না আপনি আপনার স্বপ্ন গুলো বিসর্জন দিন৷
-আপনার চেয়ে মূল্যবান কিছু আমার জীবনে নেই৷
আমি মেয়েটার দিকে চেয়ে থাকলাম। তাকিয়ে থাকলাম তার গভীর চোখ দুটোর দিকে। কী ভীষণ মায়া খেলে সেখানে।"
গল্পটা শেষ৷ দেখে মনে হচ্ছে লেখক ইচ্ছে করেই এখানে শেষ করেছেন। বাকি অংশ লিখেননি। নীলিমা দেখল পৃষ্ঠার শেষ অংশে লিখা
"গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প।
লেখকঃ প্লাবন হাসান।"
নীলিমা কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাবলো, মানুষটা কী সুন্দর করে লিখে! অথচ আমি স্বার্থপরের মতো তার লিখা গুলো, বলা বাহুল্য তার প্রিয় স্মৃতি গুলো জ্বালিয়ে দিলাম। জ্বালিয়ে দিচ্ছি৷ নীলিমা এবার ডায়েরীটায় আগুন ধরিয়ে দিল৷ আগুন জ্বলতে থাকল। ধীরে ধীরে প্লাবন হাসান নামক লেখকের একটি স্মৃতি জ্বলে ছাই হয়ে গেল। অথচ গল্পটা তো তার মনে গাঁথা৷ নীলিমা কি সেখান থেকে এই গল্পটা দূর করতে পারবে? আচ্ছা উনাদের ওই গল্পটার শেষে কি হয়েছিল? কগন আর প্লাবন এক হয়নি কেন? কেন প্লাবন আর নীলিমা এক হয়ে গেল? কেন কগন অন্য কোথাও বেশ সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকল? নীলিমা উঠে দাঁড়ালো৷ ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে অদূর অন্ধকারে চোখ রাখল৷ এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল কেবল। চোখভরা তার শূন্যতা। হঠাৎই পাশে আবিষ্কার করলো কাউকে৷ পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল প্লাবন দাঁড়িয়ে। ছেলেটার মুখ মলিন। জ্বলে যাওয়া ডায়েরীটার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছু সময়৷ চোখে জল জমলো যেন৷ নীলিমা অদূরে দৃষ্টি রেখে বলল,
-জ্বালিয়ে দিলাম সব৷ আমি চাই না আপনি এসব মনে রাখেন৷ আমি আপনাকে পেতে চাই৷ একদম আমার মতো করে৷ আমি চাই আপনি আমার হোন৷
-এমন একটা প্রশ্ন কগন করেছিল। আমি তার উত্তরে...
-স্টপ! আমি আর কিছু শুনতে চাই না৷ কগন নামটা আমি শুনতেও চাই না৷
প্লাবন থেমে গেল। সে নিশ্চুপ। জবাব নেই। নীলিমা বলল,
-গল্পটা এভাবে লিখলেন কেন?
-যে গল্পের সত্যকার সমাপ্তিই নির্দিষ্ট হয়নি সে গল্পের সামাপ্তি গল্পে নির্দিষ্ট হবে কীভাবে?
-আমি অতো প্যাঁচালো কথা বুঝি না৷ আমাকে ক্লিয়ার করে বলুন তো কগনকে কেন আপনি ছেড়ে দিলেন৷ মেয়েটা আপনাকে ভালোবাসতো।
প্লাবনের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি৷ বলল,
-ভালোবাসা আর মোহ'তে গুলিয়ে গিয়েছিল মেয়েটা৷ দুটো মিলেই সে ভেবে নিয়েছে সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে৷
-একটু বিস্তারিত বলবেন? আমি না এসব ভারী ভারী কথা নিতে পারি না৷ বুঝি না৷  স্পষ্ট করে বলুন না, কগনের সাথে আপনার আসলে কী হয়েছিল?
প্লাবন আগের মতোই হাসি দিল। বলল,
-আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি৷ আচ্ছা নীলিমা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সঠিক উত্তর দিবে?
নীলিমা একটু কাছে এগিয়ে এলো৷ বলল,
-বলুন।
-পাখিকে তুমি বন্দি করে রাখতে পছন্দ করে রাখবে নাকি তাকে স্বাধীন করে দিবে উড়ার জন্যে! যেখানে পাখির বৈশিষ্ট্যই উড়ে বেড়ানো!
-আমি অবশ্যই পাখিকে ছেড়ে দিবো৷ তাকে মুক্ত আকাশে উড়তে দিবো৷
-ধরে নাও, আমিও তাই করেছি।
-তাই বলে মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিবেন?
-না। দোষ সম্পূর্ণ আমার নয়। সে-ই জড়িয়েছিল আগে৷ আমি সেদিন পার্ক থেকে ফেরার পথে একটা ঝামেলা হয়৷ এই কথাটা আমি কাউকে বলিনি। আমি আশা করবো তুমিও তাই করবে৷
-আপনি নির্ভয়ে বলুন।
-আচ্ছা৷ শুনো তাহলে, পথে আমার পাশ কাটিয়ে একটা গাড়ি থামলো। হঠাৎ করেই ড্রাইভার বের হয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বলল,
-ভেতরে যান। স্যার আপনার সাথে কথা বলবে। আমি তখনও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছু বলতে পারছিলাম। আমি গাড়ির ভেতরে তাকাতেই দেখলাম স্যুট-কোট পরা এক ভদ্রলোক বসে আছেন। হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি ভেতরে গেলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো৷ নীলিমা, জানো তখন কী হয়েছিল? ওই ভদ্রলোক কে জানো? উনি কগনের বাবা। কগনকে আমার কাছ থেকে কিনতে চাইলেন৷ আমি তখন কী বলেছি জানো? বলেছি, "আপনি মানুষটা ভদ্র৷ তাই ভদ্রভাবে আসছেন বুঝাতে৷ মেয়ে আপনার। তার উপর অধিকারও আপনার৷ আপনি চাইলে আমার উপর মামলা করতে পারতেন। কিংবা অন্য কিছুও করতে পারতেন। কিন্তু করেন নি৷ আই মাস্ট এপ্রিশিয়েট দেট৷ যান, আপনার মেয়েকে আমি গিফট করলাম। আমার অর্থপয়সার প্রয়োজন নেই৷ তবে একটা জিনিস ভেবে দেখুন, আপনার মেয়েকে আমি গিফট করছি৷ আমি, এমন একজন হতদরিদ্র মানুষ, যে আপনার মেয়েটার প্রিয় হয়ে গেল। খুব অনায়াসেই। এই হতদরিদ্র আমিই আপনাকে পৃথিবীর সবচে মুগ্ধকর এবং আপনার প্রিয় জিনিসটি গিফট করছি। যেটা এই পর্যন্ত কেউই করেনি।" আরও কিছু কথা বলেছিলাম। ভদ্রলোক একটা কথাও বলেননি আর। আমি চলে এলাম। এরপরেও আমি বলব আমি মূলত কগনকে ওই কারণে ছাড়িনি। আমি ছেড়েছি, কারণ আমি চেয়েছি মেয়েটা খুশি হোক৷ আমাদের এই ঘরে এনে আমি তার স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে দিতে চাই না৷ আর এখানে এলে সে মানিয়েও নিতে পারতো না৷ বন্যরা বনে সুন্দর। শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বুঝেছো? এ ছাড়া বড় ভাইয়া নিজের বউ নিয়ে ভিন্ন থাকেন। এ নিয়ে আমার বাবা মায়ের ক্ষোভের শেষ নেই৷ বড় ছেলে তো গেল, বাবা মা এখন ছোট ছেলেকে হারাতে চান না, এই একটা কারণ হতে পারে কগনকে ছাড়ার৷ আর আমিও চাইনি আমাকে দশ মাস দশদিন গর্ভে রাখা মা, কষ্ট করে সংসারের বোঝা টেনে নেওয়া আমার বাবা, আমার জন্যে কষ্ট পাক। তাদের সুখের জন্যেই নিজের একটুখানি সুখ বিসর্জন দিলাম। ক্ষতি কি এতে। এছাড়াও কগনকে আমি স্বাধীন করে দিতে চেয়েছিলাম। এবং দিলাম। সে এখন চাইলেই নিজের জন্যে কিছু করতে পারবে৷ নিজের একটা পরিচয় তৈরী করতে পারবে৷ আমি তা-ই চাই৷ মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ হোক৷ তার যা ভারী ভারী সখ আহ্লাদ সব পূরণ হোক। এখানে আসলে সে আলো ছড়াতে পারতো না। এখন যেখানে আছে সেখানে বেশ পারবে৷ তবে এতো কিছুর পরও কগন চলে যাওয়ার সময় আমাকে একটা কথা বলে গেল, নীলিমা নাকি আমাকে আগ থেকেই পছন্দ করতো৷ অথচ নীলিমা আমাকে সে কথা কখনো বলেওনি। আজ আমাদের দু'জনের বিয়ে হয়ে গেলেও না!
নীলিমা যেন লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
-আপনাকে আমার আগ থেকেই পছন্দ ছিল। একই এলাকাতে থাকি বলে প্রায়ই দেখি। পছন্দের মাত্রাও যেন ধীরে ধীরে বাড়ে। ভার্সিটিতে খুশি হয়ে আপনার প্রশংসা করতে গেলাম। কিন্তু তার ফল যে এতো ভারী পড়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। কগন আপনার পেছনে পড়ে। নিজে তো পড়ে সাথে আমাকে নিয়েও পড়ে৷ বিশ্বাস করবেন না, কী যে খারাপ লাগছিল আমার। আমার মন চাচ্ছিল ওর চুল গুলো টেনে ছিড়ে ফেলি। বদ মেয়ে। একবার কি দেখিয়েছি অমনি আমার মানুষটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে শুরু করেছে৷ খুব রাগ হতো আমার। সেদিন রাতে যে আমার সাথে আপনাদের বাসার সামনে এলো, আমাকে একা বাসায় পার করে যে আপনারা দুজনে শহর ঘুরলেন, বিশ্বাস করেন রাগে, জিদে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছিল৷ বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করেছি সারারাত৷ ঘুম হয়নি বিন্দুমাত্র। বারবার আপনাদের কথা মনে পড়তো! কী জানি করছে আপনারা৷ এই সব৷ এরপর আমরা যখন রোজ মিলতে শুরু করলেন, আমি তখন যেন রোবট হয়ে গিয়েছিলাম। ভার্সিটি মিস করতে শুরু করি। খাওয়াদাওয়া এক প্রকার উঠে যায়৷ কেমন জানি পাগল পাগল লাগতে শুরু করে। এরপরই আপনার আম্মু আসে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি যেন হাতে চাঁদ পাই। বাবা মাকে কিছুই বলতে হয়নি৷ তার বুঝে নিয়েছেন৷ আমার আর আপনার বিয়ে হয় এরপর। কিন্তু কগন এই কথা জানলো কী করে যে আমি আপনাকে ভালোবাসি?
প্লাবন কিছু সময় চুপ থাকলো। বলল,
-মেয়েটা ভীষণ চতুর। জেনেছে কোনো এক ভাবে৷
কথাটা আনমনে বলল প্লাবন। দৃষ্টি দূরে কোথাও৷ নীলিমা একদম পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল,
-প্লাবন?
-হু?
-আপনি কি ভালো আছেন?
প্লাবন চুপ থাকল। নীলিমা আবার বলল,
-আপনি কি আমার জন্যে একটু ভালো থাকতে পারবেন? আমি আপনাকে ভালো রাখব! কথা দিচ্ছি৷ আপনার মায়ের সংসারটাকে গুছিয়ে রাখতে পারবো৷ কেবল আপনি আমার পাশে থাকলেই হবে। থাকবেন?
প্লাবন নীলিমার দিকে না ফিরেই বলল,
-কগন যদি ভালো থাকতে পারে তবে আমি কেন নয়?
-আপনি কগন নামটা আর নেবেন না,প্লীজ৷ আমার অসহ্য লাগে।
প্লাবন এদিক ফিরে হাসল। বলল,
-সেকি! আপনার বন্ধু বলে কথা!
-যে-ই হোক, আপনি কেবল আমার। আপনার মুখে কেবল আমার নাম থাকবে। কেবল আমার নাম৷
প্লাবন নীলিমার হাত ধরে কাছে নিয়ে এলো একদম। নীলিমা যেন মিশে গেল প্লাবনের দেহের সাথে। প্লাবন বলল,
-অন্য কারো নাম নিলে কী হয়?
-কিছু না। আমার অসহ্য লাগে কেবল!
-বেশ তবে তাই হবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।
-কী শর্ত?
-তোমার আমাকে তুমি করে বলতে হবে।
নীলিমা যেন লজ্জা পেল। মুখ লাল হলো তার৷ প্লাবন বলল,
-রাজি আছো?
নীলিমা লজ্জা মিশ্রিত জবাব,
-হু।
এই বলে সে প্লাবনের বুকে মুখ গুঁজল। প্লাবন মৃদু হাসলো৷ বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো মেয়েটাকে৷ হঠাৎ নীলিমা বলে উঠল,
-প্লাবন?
-হু?
-তুমি আবার লেখালেখি শুরু করবে।
-না৷
-হ্যাঁ। করবে।
-প্লীজ৷ জোর করো না।
-করবো। তুমি লিখবে৷ আমি তোমার গল্পের নায়িকা হবো৷ বলো লিখবে?
-আচ্ছা। লিখব! তোমাকে নায়িকা বানাবো৷
-গুড বয়। একটা কথা বলি?
-বলো।
-আমার না আজ ভীষণ খুশি লাগছে।
-খুশি? কেন?
-জানি না। কিন্তু লাগছে। যেন মনে হচ্ছে আমি পেয়েছি। যে জিনিসটা চেয়েছি সেই জিনিসটা পেয়েছি৷
প্লাবন হাসল খানিক। নীলিমার চুলে মুখ গুঁজে দিল। বলল,
-নীলু?
-হু?
-তোমাকে নীলু বলে ডাকি?
-হ্যাঁ। ডাকো।
-নীলু, তোমার কোনো স্বপ্ন নেই?
নীলিমা চুপ করে গেল যেন৷ কিছু সময় পর বলল,
-আমি সেই প্রথম থেকে তোমার বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি ভীষণ খুশি আজ।
প্লাবন কিছু বলল না৷ নীলিমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। একদম বুকের মাথে মিশিয়ে নিলো৷ ভাবলো, এই মেয়েটাকে এভাবে আগলে রাখবে সে। কখনই ছেড়ে দিবে না৷ হাজার ঝড় এলেও না৷
.
(সমাপ্ত)

.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url