গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প - প্রথম অংশ । লেখক- তাসফি আহমেদ

গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প - প্রথম অংশ । লেখক- তাসফি আহমেদ   

গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প - প্রথম অংশ । লেখক- তাসফি আহমেদ


গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প

তাসফি আহমেদ
.
(প্রথম অংশ)

"আমি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম৷ এরপরেও কগন এলো না৷ আমার মনে হলো আমার আর এখানে বসে থেকে লাভ নেই। মেয়েটা আজও আসবে না৷ আমার খানিকটা মন খারাপ হলো৷ অথচ এখানে মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই৷ বরং বোকামি। বোকা অনুভূতি। একটা মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে চাইছে৷ নিজ থেকেই চাইছে। আমি এসে তার জন্যে অপেক্ষা করছি। অথচ সে আসছে না৷ আজ নিয়ে তিনবার হলো এমন। মেয়েটা আসবে বলেও আসছে না৷ আমার এখানে রাগ করা উচিৎ। মেয়েটার উপর কঠিন ভাবে রাগ করা উচিৎ। কিন্তু আমি রাগ করতে পারছি না৷ আমার কেন জানি মন খারাপ হচ্ছে। শরীর অবশ অবশ লাগছে৷ মনের সাথে সাথে যেন দেহটাও ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে৷ আমি পার্কের এই বেঞ্চি থেকে আরেকটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। আমার মন চাচ্ছিল না আমি এখান থেকে চলে যাই। মন চাচ্ছে আরো কিছুক্ষণ বসি। একটু অপেক্ষা করি মেয়েটার জন্যে। হয়তো সে আসবে। কিংবা আসছে। রাস্তায় জ্যাম লেগে আছে হয়তো। প্রচণ্ড উত্তাপে সে ঘামে ভিজে যাচ্ছে। ঘর্মাক্ত মুখে টেনশনের ছাপ। এখানে এসে পৌঁছাতে পারছে না বলে তার সে কী টেনশন! তাড়না! বারবার সময় দেখছে৷ মুখ তুলে সামনে তাকাচ্ছে৷ কখন যে জ্যাম ছাড়বে! বেচারি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি কেবল এসব কল্পনা করে করেই প্রায় দু'ঘন্টা এখানে বসে আছি৷ মেয়েটা আসছে না। বাসা থেকে বের হয়ে সে আমাকে ফোন দিল। জানালো সে আসছে। আমি তখন রিক্সায়। ফুরফুরে মন নিয়ে পার্কের দিকে আসছিলাম। সকালের সেই ফুরফুরে তাজা প্রাণ এখন ভীষণ ক্লান্ত৷ দিশেহারা। হয়তো মেয়েটা আসেনি বলে। মন ভার৷ অভিমান জমছে৷ মেয়েটা "আসবে না" বলে দিলেও তো পারতো৷ কিংবা ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালেও হতো। আমি চলে যেতাম৷ অনুভূতি বাড়াতাম না৷ শাড়ি পরা কগনকে দেখব বলে ভীষণ আগ্রহ জাগাতাম না৷ রহস্যময়ী কোনো রমনীর রহস্য উদঘাটন করব বলে কী ভীষণ উন্মাদনা জাগালাম নিজের ভেতর! মেয়েটার কাজল কালো চোখ দুটো দেখবো বলেও কিছু কিছু আগ্রহ ঘামের বিন্দুর মতো জমেছিল ভেতরে৷ কাজলের মায়ায় ডুব দেবার মতো কিছু কাঁপাকাঁপ আগ্রহ সবে গজিয়েছিল সবে। কিন্তু তার না আসাটা সব শেষ করে দিল৷ জন্ম নেওয়া আগ্রহের অঙ্কুর গুলো ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকল৷ সে গুলো যেন মূহুর্তে মন খারাপে পরিণত হলো৷ কগন এই নিয়ে তিনবার এমন করলো৷ প্রথম দু'বার দু'টো যৌক্তিক অযুহাত দেখিয়ে সেরেছে। আজ কী অযুহাত দিবে তা আল্লাহই ভালো জানেন৷ আমি ভাবলাম একবার ফোন দেই৷ কিন্তু ভয়ে দরুন তা আর করা হলো না৷ আমি ফোন দিলে যদি মেয়েটা অন্য কিছু ভাবে? সে যদি ভাবে 'এই ব্যাটা দেখছি দেখা করার জন্যে পাগল হয়ে আছে! লেখক মানুষ এমন হলে হয়!' আমার ভয় অযৌক্তিক। তবুও মনের ভেতর কেমন জানি একটা করে, মেয়েটা যদি সত্যিই ভিন্ন কিছু ভেবে নেয়? অথচ দেখা করা এবং দেখা করার জায়গা নির্বাচন সবই ছিল তার কাছে। সে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে নিজ থেকে উধাও। আসেনি মেয়েটা৷ তবুও ভয়ের ধাক্কাটা সামলে তাকে ফোন দিলাম। একবারই দিলাম। ফোন তুলল না কেউ৷ আমি আর ফোন দেইনি৷ সে যদি ফোন তোলে তবে অবশ্যই দেখবে আমি কল দিয়েছি৷ সে অবশ্যই আমাকে কল ব্যাক করবে৷ আমার প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। অথচ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মেয়েটা কল করেনি৷ অভীমান ভরা বুক নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম সেই দুপুরে। বিকেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম এলো না৷ মোবাইল আর ছাদে গোধুলীর সাথে একটা কলের অপেক্ষা জমিয়ে রেখে আমার বিকেল এবং সন্ধ্যাটা পেরিয়ে গেল। কেউ ফোন দেয়নি৷ আমার মন খারাপ হলো। সন্ধ্যার পর থেকে অভিমানটা জমে বুকের ভেতরটা কেমন জানি ছন্নছাড়া হয়ে গেল। আমি এই বই পড়ছি তো এই মোবাইল টিপছি। বইয়ের দু'পৃষ্ঠা পড়ে বিরক্ত জেগে উঠল। মোবাইলে গেম খেললাম৷ বিরক্তি যেন বাড়ল৷ ফেসবুকে ঢুকলাম। তাও মন টানলো না৷ ইচ্ছে হলো ফোনটা ছুড়ে মারি। গরীব বলে তাও হচ্ছে না৷ সীমাবদ্ধতার সীমাবদ্ধতায় আঁটকে থাকলাম কেবল।


রাত আটটার দিকে হঠাৎই ফোন বেজে উঠল৷ আমি ফোন তুললাম না৷ স্ক্রিনে কার নাম তাও দেখলাম না৷ আগ্রহ নেই ফোন তোলার৷ যে-ই ফোন দিক, কগন মেয়েটা দিলেও আমি ফোন তুলবো না৷ আমার ফোন তুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রথমবার ফোন রিঙ হয়ে থেমে গেল। দ্বিতীয় বার আবার কল এলো। আমি ধরিনি। এভাবে কেউ একজন বেশ কয়েকবার কল দিয়ে ফেলল। আমি ফোনের শব্দে বিরক্ত হলাম কেবল। এরচে বেশি কিছু না। ফোন ধরার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার ভেতর জন্মায়নি৷ ভেতর থেকে যেন কোনো সাড়াই আসছে না৷ এরপর হঠাৎই মেসেজের শব্দ হলো৷ আমি ফোনটা হাতে নিলাম। স্ক্রিনের উপরে একটা মেসেজ ভাসছে৷ কগন নামের কেউ মেসেজ করেছে৷ তার আবদারটা এমন, "ফোন ধরুন প্লীজ৷ জরুরি কথা আছে।" অভিমান যেন আরো দলাপাকিয়ে বসলো৷ আমি মেসেজের রিপ্লাই করলাম না৷ ফোন এলো আবার৷ একবার দুইবার করে বেশ কয়েকবার৷ আমি ফোন তুলিনি। ভাবলাম তুলবোই না৷ কিন্তু কী হলো, আমি ফোনটা ধরে বসলাম। হঠাৎ আমি কেন এমন করলাম তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ দ্রুত বলল,
-কী হলো? ফোন ধরছেন না কেন?
আমি কিছু বললাম না। চুপ থাকলাম। অভিমানী চুপ থাকা। ওপাশ থেকে প্রশ্ন এলো আবার,
-কী হলো? জবাব দিচ্ছেন না কেন?
আমি বললাম,
-ধরিনি কই? এই যে ধরলাম তো।
-এতোক্ষণ কেন ধরেননি?
-ফোনের পাশে ছিলাম না।
-সত্যিই কি তাই?
-আপনার কী মনে হয়? আমি কি মিথ্যা বলছি?
-হ্যাঁ। আমার আপাতত তাই-ই মনে হচ্ছে।
-ভুল ধারণা আপনার৷
-আমি জানি কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক।
-তাহলে জিজ্ঞেস করলেন কেন? না জিজ্ঞেস করলেই তো পারতেন৷
-বাহ মশাই। রেগে আছেন খুব তাই না?
-জ্বি না৷
-আমি জানি রেগে আছেন৷
-ভুল জানেন আপনি৷ আমি কেন আপনার উপর রাগ করবো?
-সেটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন৷
-আমি জানি না৷
ওপাশের মানুষটা চুপ থাকল খানিক। তারপর মলিন স্বরে বলল,
-লেখক?
আমি জবাব দিলাম না৷ সে আবার বলল,
-ওই লেখক? ডাকছি যে শুনেন না?
আমি তখনও কিছু বললাম না৷ চুপ থাকলাম কেবল। সে বলল,
-খুব অভিমান জমেছে তাই না?
আমি চট করেই বললাম,
-অচেনা কারো উপর আমার অভিমান কেন হবে?
ওপাশের মানুষটা যেন রেগে গেল। বলল,
-আমি অচেনা?
-তা নয়তো কী?
-এভাবে বলতে পারলেন?
-হ্যাঁ৷ পারলাম৷
-নিচে নেমে আসুন৷ আজ আপনার খবর আছে৷
-নিচে নামতে যাবো কেন?
-আসুন। তারপর বলছি৷
-আমি বুঝতে পারছি না৷ আপনি কোথায় নামতে বলছেন?
-ওরে আমার বোকা লেখকরে! আপনাদের বাসার নিচে নামতে বলছি৷ ইশারা ইঙ্গিতও দেখছি বুঝেন না৷
-মানে? আপনি আমাদের বাসার নিচে?
-হ্যাঁ৷ সেই কতোক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমি৷
আমি কিছু বললাম না৷ বারান্দার কাছে গেলাম। নিচের দিকে তাকাতেই দেখলাম ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ একজন কানে ফোন ধরে আমার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের ওপাশে থেকে এবার খানিকটা স্বস্তির স্বর ভেসে এলো৷ বলল,
-কী? এবার বিশ্বাস হয়েছে?
আমি বললাম,
-আপনি আমার বাসার এড্রেস কই পেয়েছেন?
সে খানিকটা রাগি স্বরে বলল,
-এখানে দাঁড়িয়েই বলব? নাকি আপনি কষ্ট করে নিচে আসবেন।
আমি কিছু বললাম না। ফোন রেখে দিয়ে নিচে গেলাম। গেইট দিয়ে বের হতেই ওদের দুজনকে দেখলাম। একজন জিন্স আর টপস পরে আছে। অন্য জন শাড়ি পরা। শাড়ি পরা মেয়েটা আমাকে দেখতেই হাসল। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-কগন?
তার হাসি প্রসস্ত হলো। বলল,
-হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন।
-অবাক হলাম। যার আসার কথা বেলা দশটায় সে রাত আটটায় আসছে!
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছু সময়। তারপর মুচকি হেসে বলল,
-আপনার সাথে আমার কথা বলাটা খুব জরুরি৷
-কী এমন জরুরি কথা?
কগন তার বান্ধুবির দিকে তাকালো৷ আমিও দেখলাম তাকে৷ মেয়েটাকে আমি চিনি বোধহয়। ওর নাম নীলিমা। আমাদের এই এলাকাতেই থাকে৷ আশ্চর্য এই মেয়ের সাথে কগনের পরিচয় কীভাবে? কগন মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল,
-খুব ধন্যবাদ তোকে। চিন্তা করিস না৷ বাকিটা আমি সামলে নিবো৷
মেয়েটা মলিন মুখে কাঁপাকাঁপ স্বরে বলল,
-একা একা বাসায় ফিরতে পারবি?
কগন হাসিমুখে বলল,
-আরে হ্যাঁ৷ পারবো৷ চিন্তা করিস না৷
-না হলে আমাদের বাসায় চলে আসিস৷ চিনিস তো৷
-ওরে আমার বড় বোন, টেনশন করিস না আর৷ দেরি হলে আমি থেকে যাবো। ঠিকাছে? আর লেখক মশাই তো আছেই!
এই বলে কগন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। নীলিমা মেয়েটাও মলিন মুখে হাসল। বলল,
-যাই তাহলে৷ সাবধানে থাকিস৷
নীলিমা চলে গেল৷ কগন আমার দিকে ফিরে এলো৷ বলল,
-রাস্তা ধরে হাঁটি তাহলে। কেমন? ল্যাম্পপোস্টের আলোয় লেখকের সাথে হাঁটার মজাটাই তো অন্য রকম।"



নীলিমা বাকিটুকু পড়তে পারলো না আর৷ ডায়েরীটা বন্ধ করে ফেলল চট করেই৷ বুকের সাথে মিশিয়ে রাখল কিছু সময়৷ ওর বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকল। অদ্ভুত একটা হিংসাভাব তার সমস্ত জুড়ে বসল। নীলিমা হুট করেই পড়ে আসা পৃষ্ঠা গুলো এক টানে ছিড়ে ফেলল। পাশ থেকে লাইটারটা নিয়ে পৃষ্ঠা গুলো জ্বালিয়ে দিলো। ছাদের এক কোণা হঠাৎ লাল উজ্বল আলোয় ঝকমক করে উঠল৷ নীলিমা কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকল কেবল৷ তারপর আবার ডায়েরীটা খুলল৷ বাকি অংশটুকু পড়তে শুরু করলো৷
"আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-নীলিমাকে চিনেন কীভাবে?
কগন হাসল। বলল,
-বলতে গেলে নীলিমার দ্বারাই আমি আপনাকে চিনি।
-কীভাবে?
কগন শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে বলল,
-নীলিমা আমার ক্লাসমেট। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড৷ অনেকটা আমার বোনেরই মতো৷ দেখলেন তো একটু আগে৷ যেতেই চাচ্ছিল না আমাকে একা রেখে৷
কগন থামলো৷ আমি বললাম,
-ওর দ্বারা আমাকে চিনলেন কীভাবে তা তো বললেন না৷
-চিনলাম কোনো এক ভাবে৷ আচ্ছা বলেই ফেলি না হয়৷ আমি গল্প পড়ি ভীষণ। অনলাইন এবং অফলাইন; যখন যেখানে পাই। তো একদিন গল্প এবং গল্প লেখকদের কথা উঠায় নীলিমা আপনাকে সেখানে মেনশন করলো। বলল যে ওদের এলাকায় নাকি একজন লেখক আছে৷ খুব ভালো লিখে। আমি উৎসাহবসত আপনার আইডির লিংক চাইলাম। আমার সেই চাওয়াটাই আজ আমাকে এখানে নিয়ে এলো।
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না। হঠাৎ কগন বলে উঠল,
-আচ্ছা লেখক? আমার চাওয়াতে কি দোষের কিছু আছে?
-দোষের প্রশ্ন উঠছে কেন?
-এমনিই৷ ধরুন জানতে চাওয়া৷
-অযাচিত ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করার চাইতে জ্ঞান শূন্য থাকাই কি ভালো নয়?
কগন হাসল। বলল,
-বলতে চাইছেন না তাই না?
-জটিল প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই বলে কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইলাম আরকি।
এই বলে মৃদু হাসলাম। কগন খানিকটা হেসে বলল,
-লেখক মানুষের বুদ্ধির অভাব নেই৷ আজ আপনি তা প্রমাণ করলেন৷
আমি কিছু বললাম না৷ মুখের হাসিটা স্থির রাখলাম। অনেকটা সময় হলো। আমরা হাঁটছি। মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ বসন্তের খুবই চমৎকার একটি রাত৷ আকাশে চাঁদ মামা আলো দিচ্ছে নিজ মনে৷ আমরা দু'জন চাঁদের আলোর সাথে নিয়নবাতির আলোও গায়ে মাখছি। আমার কাছে হঠাৎই কেন জানি ভালো লেগে উঠল। অদ্ভুত একটা আনন্দ হতে থাকল৷ কিছু সময় পরই কগন পাশ থেকে বলে উঠল,
-লেখক?
আমি আনমনে বললাম,
-হু?
-আপনার মন ভালো হয়েছে?
-আমার মন কি খারাপ ছিল?
-পাল্টা প্রশ্ন খুবই বিরক্তিকর। আমার ভালো লাগে না৷
কগন মলিন মুখে কথাটা বলল। আমি বললাম,
-আমি মানুষটাই বিরক্তিকর।
-বেশি বলবেন না৷ যা বলছি তার জবাব দিন। রাগ কমেছে?
-আমি রাগ করিনি।
-তাহলে? অভিমান?
-আপনার উপর আমি অভিমান করবো কেন?
-তাহলে কি ভাবছেন আমি ঠকবাজ? প্রতারক? আসব আসব বলে ঘুরাচ্ছি৷ অথচ আসছি না?
-আশ্চর্য! তা কখন বললাম।
-বললেননি বটে। বুঝতে পেরেছি আমি৷
-কীভাবে বুঝেছেন শুনি?
-বলব কীভাবে বুঝেছি?
-হ্যাঁ৷ অবশ্যই।
-তাহলে এদিকে ঘুরে দাঁড়ান তো। আমার দিকে তাকান৷
-কেন?
-আহা! তাকান না৷
আমি কগনের দিকে তাকালাম। মেয়েটা বেশ সরল দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকল। আমি প্রথমবারের মতো তার চোখে চোখ রাখলাম। সত্যি বলতে আমার গা শিউরে উঠেছিল তখন। আমি চট করেই চোখ সরিয়ে নিলাম। কগন চুপিসারে বলল,
-লেখক? ভয়ে পেয়েছেন?
-কিসের ভয়?
-চোখের। যদি প্রেমে পড়ে যান!
-আপনার ধারণা আপনার চোখে চোখ রাখলে আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাবো?
কগন পরিপূর্ণ আস্থার সাথে বলল,
-হ্যাঁ। শতভাগ নিশ্চিত।
-ভুল ধারণা আপনার।
-তাহলে চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন কেন? দেখুন না আমার দিকে। চোখের গভীরতা বুঝুন না একটু৷
কী নিষ্পাপ আবদার। কীভাবে ফেলে দেই আমি। আমি কগনের দিকে তাকালাম৷ অল্প কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার মনে হয়েছিল আমি এই পৃথিবীতে নেই৷ অন্য কোথাও, অন্য কোনো ভূবনে হারিয়ে গিয়েছিল। কিছু সময় পরই আমি চোখ নামিয়ে নিলাম৷ বললাম,
-কগন? এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি আপনার প্রেমে পড়ে যাবো নিশ্চিত৷
কগন হেসে উঠল। বলল,
-স্বীকার করবেন বলে ভাবিনি৷
-সত্য স্বীকারে দোষ কই?
-পৃথিবীর সকল মানুষ যদি কথাটা বুঝত! পৃথিবীটা আসলেই একটি সুন্দর জায়গায় পরিণত হতো৷ অভিমান ঝরেছে কিছু?
আমি খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেলাম৷ তবুও চেহারা শক্ত রেখে বললাম,
-অভিমান করেছি কই?
-তবে আমি যে আপনার চোখে অভিমান দেখলাম?
আমি কগনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বললাম,
-আপনি চোখে ভেতরে লুকানো অভিমান দেখতে পারেন?
-এমন আরো অনেক কিছু দেখতে পারি আমি।
আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-কগন? মানুষ মুগ্ধ করার দারুণ ক্ষমতা আছে আপনার।
-আপনি? আপনাকে কী বলবো তাহলে? আপনি তো অনুভূতি দিয়ে মানুষকে পাগল করে ছাড়েন।
-অনুভূতি দিয়ে? সত্যিই কি এমন হয়?
-পৃথিবী বড়ই বিচিত্র লেখক! এখানে বিচিত্র জিনিস হারহামেশা ঘটে৷ বরং আগ্রহ নিয়ে ঘটে৷
-হয়তো এক কারণেই পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর।
-ভালো বলেছেন।
-তা আজ সময় মতো পৌঁছালেন না কেন?
-আর বলবেন না দুঃখের কথা৷ আপনার আর আমার কপালটাই ভীষণ খারাপ৷ দেখা করবো করবো বলে করাই হচ্ছে না৷ একের পর এক ঝামেলা এসে বিধছে।
-আজ কী ঝামেলা হলো?
-মা ওয়াশরুমে স্লিপ খেয়ে পড়ে যান৷ আপনাকে যখন ফোন দিয়েছি ঠিক তারপরই বাসা থেকে ফোন আসে। আমাকে জলদি করে বাসায় পৌঁছাতে হয়। এরপর মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। পাঁয়ে চোট পেয়েছেন ভীষণ। এক্সরে করাতে হয়। সেই সব ঝামেলা ছুকিয়ে উঠতে উঠতে বেশ দেরি হয়ে যায়৷
-আশ্চর্য! আপনি আন্টিকে এভাবে রেখে এখানে কী করে এলেন? কগন, আপনার এখানে আসা একদমই ঠিক হয়নি। অন্যায় হয়েছে।
-প্লাবন সাহেব, এখানে এখন না এলে কেউ একজন আমাকে ছলনাময়ী ভাবতো৷ আমার নামে বিরূপ ধারণা নিয়ে থাকতো৷ আমি চাই না মানুষটা আমাকে নিয়ে বিরূপ কোনো ধারণা রাখুক৷
কথাটা শুনতেই আমার মনের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল। অদ্ভুত শিরশিরে একটা অনুভূতির প্লাবন বয়ে গেল সমস্ত দেহ জুড়ে৷ বললাম,
-সেই মানুষটা কী এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল নাকি? নিজের মায়ের চেয়েও বেশি?
-মূল কথা সেটা নয়৷ আমি চেয়েছি কেউ যেন আমাকে ভুল না বুঝে৷ আর মায়ের একটা ব্যবস্থা করেই আমি এখানে এসেছি৷ এছাড়া আসার প্ল্যান ছিল না। ভাইয়া আর ভাবি এসেছেন বলেই আমি এখানে আসতে পেরেছি। মাকে তো আর একা একা রেখে আসবো না। অবশ্য এক্সরে রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। চিন্তার তেমন কারণ নেই।
-বেশ ভালো। তবে এপাশের মানুষটাকে কি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না?
-একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।
-আপনার ধারনা আমি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ?
-সবার কাছে কেমন জানি না৷ তবে আমার কাছে তো অবশ্যই৷
-অচেনা কাউকে কি এতোটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ?
মেয়েটা হঠাৎ করে থেমে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝপথে। খানিকটা রাগি স্বরে বলল,
-এই অচেনা কথাটা যদি আর একবার বলেছেন তো দেখবেন আমি কী করি৷ হয় আমি খুন হবো না হয় আপনাকে খুন করবো৷
আমি খানিকটা শব্দ করে হাসলাম। মেয়েটার চেহারায় রাগটা দারুণ মানিয়েছে৷ চেহারা কেমন কঠিন করে রেখেছে৷ সেই কঠিন চেহারাতেও অদ্ভুত মায়া খেলা করে৷ এমন চেহারা দেখলে সত্যিই দারুণ আনন্দ পাওয়া যায়৷ এই মেয়েকে রাগিয়ে বেশ আনন্দ পাওয়া যাবে৷ আমি হাসিটা স্থির রাখলাম৷ কগন বলে উঠল,
-বাজে লোক৷ আবার হাসেও। হুহ৷
এবার যেন সে মিথ্যে মিথ্যে রাগ করলো৷ আমি কিছু বললাম না৷ তার রাগত চেহারাটা উপভোগ করতে থাকলাম৷ সত্যিই তাকে অনিন্দ্য লাগছিল৷
.
চলবে...
(প্রথম অংশ)


(দ্বিতীয় পর্ব)
ক্লিক করুন।

গল্পঃ গল্প কন্যার গল্প

ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url