গল্প - নিশি । লিখেছেন - তাসফি আহমেদ

 গল্প - নিশি । লিখেছেন - তাসফি আহমেদ

গল্প - নিশি । লিখেছেন - তাসফি আহমেদ



গল্প - নিশি ।
- তাসফি আহমেদ


-আপনি আমার ফোন ধরছিলেন না কেন?

মেয়েটা বেশ রাগি স্বরেই কথাটা বলল। আমি খানিকটা অবাকই হলাম। হতভম্ব চেহারা নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম। সে চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার চেহারায় স্পষ্ট রাগ! আমি আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম অনেকেই তাকিয়ে আছে আমাদের এদিকে৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি চিৎকার দিয়ে এমন কথা বলে তবে আশপাশের মানুষদের তাকানোরই কথা৷ আমার খানিকটা অস্বস্তিবোধ হলো! এই মেয়ে নিজের সাথে আমার মানসম্মানটাও একদম বিকিয়ে দিবে৷ আমি বললাম,
-আস্তে কথা বলো। সিনক্রিয়েট করো না৷
-আপনি আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে কিন্তু আরো সিনক্রিয়েট করব।
আমি কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটার দিকে। সেও একভাবে তাকিয়ে থাকলো। আমি কিছু বললাম না আর। পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে মেয়েটা বলল,
-আশ্চর্য তো! আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?
আমি দাঁড়ালাম না৷ এখানে দাঁড়ানো মানেই কথা বাড়ানো হবে। এরচে বেশি কিছু না৷ অযথা এলাকায় আমার ইজ্জত যাবে৷ মেয়েটা পেছন থেকে হেঁটে আসতে আসতে বলল,
-অ্যাই? দাঁড়ান বলছি! দাড়ান!
আমি দ্রুত হেঁটে চলে এলাম কিছুটা পথ৷ মেয়েটা পিছু ছাড়ল না। সেও পেছন পেছন আসতে থাকলো। আমি খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম! কীভাবে এই মেয়ের পিছু ছাড়াই এখন?
নিশি পেছন থেকে দৌড়ে এলো এবার৷ আমার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা থেমে থেমে বলল,
-আপনি এতো নির্দয় কেন বলেন তো?
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ বললাম,
-তোমার সমস্যাটা কী বলো তো? এমন কেন করছো?
সে একদম নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-কী করেছি আমি? আমি তো কিছু করিনি! আর আমার তো কোনো সমস্যা নেই। যতো সমস্যা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে।
-মানে?
-মানে বোঝেন না? বুঝেন না আপনি?
আমি নিশির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ এরপর কিছু না বলেই আবার হাঁটা ধরলাম। নিশি আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-আমি নিজ থেকে এসে কথা বলছি বলে আপনার ভাব বেড়ে গেল না?
আমি জবাব দিলাম না৷ নিশি আবার বলল,
-এতো ভাব নিয়েন না৷ ভাব নেওয়ার মতো বিশেষ কিছু নেই আপনার!
আমি এবার চট করেই দাঁড়িয়ে গেলাম। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-যদি বিশেষ কিছু না-ই থাকে তবে পেছনে পড়ে আছো কেন শুনি? কে বলেছে ভার্সিটিতে না গিয়ে এভাবে আমার পেছন পেছন আসতে?
-আপনাকে এতো কিছু জানতে হবে না৷ আপনি কেবল আমার প্রশ্নের জবাব দিন৷
-কিসের প্রশ্ন?
-কাল রাতে যে এতো গুলো ফোন দিলাম, ধরলেন না কেন?
-এমনি৷
-এমনি মানে? আমি ফোন দিলে আপনি ধরবেন না?
-তুমি ফোন দিলেই যে ধরতে হবে এমন তো না৷
-অবশ্যই এমন৷ আমি ফোন দিলে আপনাকে ধরতেই হবে৷
-অসম্ভব৷ আমার ইচ্ছে হলে ধরব। না হলে না৷
-আমাকে রাগাবেন না বলে দিলাম৷
-আশ্চর্য তো! আমি কেন তোমাকে রাগাতে যাবো?
-তাহলে ফোন ধরবেন না বলছেন কেন?
-কারণ আমি আমার মতের বিরুদ্ধে কোনো কিছুই করি না৷
-আমি এতোশত জানি না৷ আপনি আমার ফোন ধরবেন৷ ধরবেন। ধরবেন৷ তা না হলে...
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম,
-তা না হলে?
নিশি খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল,
-আমি একদম আপনাদের বাসায় চলে আসব৷
আমি কিছু সময় তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটার দিকে৷ বললাম,
-থ্রেট দিচ্ছো?
-সাবধান করছি৷ আর আরেকটা কথা! আপনার ফোন কাল ওয়েটিংয়ে পেলাম৷ সাড়ে বারোটা থেকে প্রায় একটা পর্যন্ত৷ কার সাথে কথা বলছিলেন?
-আমি যার সাথেই কথা বলি তাতে তোমার কী?
-আমার অনেক কিছু৷ আপনি সবার সাথে কথা বলতে পারবেন না৷
-তুমি কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাচ্ছো!
নিশি কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। তার চোখের রুক্ষভাব কমে এলো৷ সে কেমন কোমল দৃষ্টিতে তাকালো৷ বলল,
-নাক গলালে কী হয়?
-অনেক কিছু৷ আমি চাই না যে কেউই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলুক।
-আপনি না চাইলেও আমি বলব৷
-সব কিছু একটা সীমা থাকে নিশি। সীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত কিছু করা ভালো না৷
-আমি কি অতিরিক্ত কিছু করেছি?
-অবশ্যই। এই যে যা যা করছো তার সবই অতিরিক্ত।
নিশি খানিকটা সময় চুপ থাকল। কণ্ঠস্বর অনেকটা নিচে নামিয়ে বলল,
-আপনি আমাকে বোঝেন না কেন বলুন তো!
-নিশি, আমি তোমাকে আগেই বলেছি৷ এখানে কোনো কিছুই সম্ভব না। বলো, বলেছি না?
নিশি মাথা নিচু করে রাখল। আমি বললাম,
-এভাবে চট করেই কোনো কিছু হয়ে যায় না৷ মানুষকে বুঝতে হয়৷ জানতে হয়৷
-আমি তো আপনাকে বুঝি৷ জানি৷
-কিন্তু আমি তো বুঝি না! তোমাকে অনুভব করতে পারি না আমি নিশি।
মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো৷ তার চোখ কেমন ভেজা ভেজা৷ বলল,
-কেন পারেন না?
-জানি না! হয়তো তোমার টাইপের মেয়ে আমার পছন্দ না৷
-আমার টাইপের বলতে?
-মানে তুমি যেমন, তেমন কোনো মেয়ে আমার পছন্দ না৷
-কেমন মেয়ে পছন্দ আপনার?
-সেটা জানার প্রয়োজন নেই৷ পরে দেখা গেল তুমি তেমন হওয়ার চেষ্টা করবে৷ আমি চাই না তুমি তেমন করো৷ প্রত্যেকেরই একটা নিজস্বতা থাকা উচিৎ। বদলানো, কিংবা কারো ইচ্ছে মতো নিজেকে গড়ে তোলা উচিৎ নয়। দেখবে, তোমার ঠিক তোমার মতোই কেউ একজন হবে৷ তোমাকে ঠিক সেভাবে ভালোবাসবে যে-ভাবে তুমি চাও।
নিশি হাসলো৷ ফ্যাকাসে হাসি৷ কেমন জানি একটা স্বরে বলল,
-আপনি যে প্রায়ই এই লেকচার গুলো দেন না, এগুলো দেখবেন একদিন আমাকে মেরে ফেলবে!
আমি তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটার দিকে৷ বলে কী এই মেয়ে! নিশি আবার বলল,
-এই কথা গুলো আমাকে এতো ডিমোটিভেট করে! আমি যেন ডিপ্রেশনে চলে যাই৷ আপনার জন্যে হয়তো এই কথা গুলো বলা সহজ৷ কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন এগুলো আমার ভেতরে কী পরিমাণ প্রভাব ফেলতে পারে? আমার কতোটা খারাপ লাগতে পারে? আপনি না হয় আমাকে পছন্দ করেন না৷ কিন্তু আমি? আমি তো...
নিশি থেমে গেল৷ মলিন দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে৷ হঠাৎই যেন আমি তার চেহারায় রাজ্যের বেদনা দেখতে পেলাম! তার চোখ যেন ভীষণ কষ্টে ভরা৷ নিশি বলল,
-কখনও কি আমাকে ভালো করে দেখেছেন? এই যে আমার চোখ, চোখের কাজল, টিপ, কখনও কি চোখের ভেতরের নির্ঘুম কষ্টগুলো দেখেছেন? কী পরিমাণ ব্যাথা এই চোখ দুটোয় তা কি দেখেছেন? এই যে আমার এতো আগ্রহ, কেন এতো আগ্রহ? আমি যে বারবার ছুটে আসি, কেন আসি? কিসের জন্যে আসি? আপনি কখনও এসব বুঝতে চেষ্টা করেছেন? বলুন, কখনও করেছেন? আপনি কী ভাবেন? আমার জাস্ট ইচ্ছে হয়েছে বলেই চলে এলাম? বা পথে দেখা হয়ে গেল বলেই কথা বলতে এলাম? আপনি কি আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্তকরা মেয়ে গুলোর মতো ভাবেন? স্মার্ট ছেলে দেখলেই লুটিয়ে পড়া টাইপ মেয়ে?
আমি চুপ করে থাকলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। কিছু সময় যেন থমথমে নিরবতায় কেটে গেল৷ নিশি হঠাৎ কিছুটা কঠিন স্বরে বলল,
-যান, চলে যান। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যান৷ যার সাথে ইচ্ছে কথা বলেন! আমি কিছু বলব না৷ একটা টু শব্দও করব না৷ চলে যান আপনি!
নিশি অন্যদিকে তাকালো। তার কপাল কুচকে আছে৷ চেহারায় কেমন রুক্ষতা৷ রাগ৷ বললাম,
-ভার্সিটি যেও৷
-আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাব৷ তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না৷
আমি আর কিছু বললাম না৷ হাঁটা ধরলাম। কিছুটা পথ হাঁটার পর আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম নিশি আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার দৃষ্টিতে ভীষণ অসহায়ত্ব বোধ৷ চোখ ছলছল করছে৷ মেয়েটা কি কাঁদছে? আমি আর অপেক্ষা করলাম না৷ দ্রুত হেঁটে চলে এলাম সেখান থেকে।
.
নিশিদের বাসা আমাদের এই এরিয়াতেই৷ এই ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না৷ আমি তাকে চিনতামও না৷ কখনও দেখেছি বলেও মনে হয় না৷ ওর সাথে পরিচয়টা হয় অন্যভাবে৷ একদিন দুপুরের দিকে একটা আননোন কল পাই। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি স্বর ভেসে আসে,
-সাদিক বলছেন?
-জি৷
-আপনার ব্লাডগ্রুপ ও পজিটিভ?
-জি।
-রিসেন্টলি কোথাও রক্ত দিয়েছেন?
-জি না।
-একজন পেশেন্টের জন্যে জরুরী ভিত্তিতে রক্ত লাগবে৷ আপনি কি রক্ত দিতে পারবেন?
-পারব।
-আপনি এই মূহুর্তে কোথায় আছেন?
-উত্তরায়৷
-কোথায়?
-উত্তরাতে।
-উত্তরার কোথায়?
আমি জায়গার নাম বললাম। মেয়েলি স্বরটা বেশ কিছু সময় চুপ থাকলো৷ বলল,
-আপনি সত্যিই ওই জায়গাতে আছেন?
-জি৷
-আচ্ছা, আপনি একটু অপেক্ষা করুন৷ আমি আসছি।
একটা সময় পর মেয়েটি এসে হাজির হলো৷ আমি তাকে দেখে হাসলাম। বললাম,
-আপনিই ফোন দিয়েছিলেন?
মেয়েটা অনেকটা সময় আমার দিকে চেয়ে থাকল৷ কিছু বলল না৷ আমি মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম৷ সে চোখে মুখে তীব্র অবাক ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার অবাক ভাব দেখে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম! আশ্চর্য! এখানে এতো অবাক হওয়ার কী আছে? আমি কী বলব ভেবে পেলাম না৷ মেয়েটা হঠাৎ লজ্জিত হয়ে নিজেকে সামলে নিলো৷ বলল,
-আপনিই সাদিক?
-জি।
-চলুন৷ দেরি করা যাবে না৷
আমরা দু'জনেই রিক্সায় চড়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। রক্ত দিলাম। যাওয়ার পথে নিশির সাথে টুকটাক কথা হলো৷ তার নাম ধাম জানলাম৷ রক্ত দেওয়ার পর নিশি বেশ খাতিরযত্ন করলো। ফলমূল খাওয়ালো। জুস দিলো। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম নিশির আন্টির বেবি হবে৷ তার জন্যে রক্তের প্রয়োজন ছিল৷ নিশি তার কোনো এক পরিচিত ব্লাড ডোনারের কাছে ব্লাড চাইতেই সে আমার নাম্বার ধরিয়ে দিলো৷ তবে নিশি নাকি তখনও জানতো না যে ব্লাড দিবে সে তার এরিয়ারই হবে৷ এবং সে যে আমিই হবো সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে আরো জানালো যে আমাকে সে আগ থেকেই চেনে৷ প্রায়ই নাকি আমাকে দেখতো তাদের ওইদিকে৷ আমি কিছুটা অবাকই হলাম। মেয়েটা আমাকে আগ থেকেই চেনে তাহলে! এজন্যেই তাহলে প্রথম দেখাতেই এভাবে তাকিয়ে ছিল!
এভাবেই নিশির সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়৷ এরপর প্রায়ই আমাদের দেখা হতো৷ টুকটাক কথা হতো৷ হাই হ্যালো হতো৷ মাঝে মাঝে একসাথে চা খাওয়াও হতো৷ প্রথম প্রথম ব্যাপারটা এমন ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরেই যেন নিশির আগমন বেড়ে যায়৷ তাকে প্রায়ই আমাদের বাসার আশপাশে দেখা যেতো৷ আমাকে দেখলেই এগিয়ে এসে কথা বলতো। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে কোথাও যেতে চাইতো৷ লেক কিংবা পার্কে বসে অনেকক্ষন গল্প করার সঙ্গ চাইত। কিন্তু আমি যেতাম না৷ সে হাজার রিকোয়েস্ট করার পরও না৷ একদিন এতো বেশি জোর করল যে না গিয়ে পারলাম না৷ সে আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল৷ আমরা বেশ কিছু সময় সেখানে কাটালাম৷ নানান কথাবার্তা হলো৷ একটা সময় নিশি চট করেই বলে ফেলল,
-একটা কথা বলি?
-বলো।
-আমি আপনাকে নিয়ে এখানে কেন এসেছি জানেন?
-না তো৷ কেন নিয়ে এসেছো?
-একটা কথা বলার ছিল আসলে।
-কী কথা?
নিশি বেশ কিছু সময় চুপ থাকলো৷ কেমন দ্বিধান্বীত হয়ে আমার দিকে তাকালো৷ বলল,
-বললে আপনি রাগ করবেন না তো?
-না, রাগ করব না৷
-সত্যিই?
-সত্যি।
-আচ্ছা, শুনুন তবে৷ আজ থেকে প্রায় অনেক দিন আগে, আমি একটা ছেলেকে দেখি৷ আকাশি কালারের একটা টি-শার্ট আর একটা ট্রাউজার পরেছিল সে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিল৷ চেহারায় চিন্তার ছাপ৷ যেন সে কিছু একটা ভাবছে মনে মনে৷ আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ হঠাৎ চোখ গেল ছেলেটার উপর। সেই যে চোখ গেল, আর সরাতে পারলাম না। যতোটা সময় সে সামনে ছিল আমি এক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম৷ আমার কি হয়েছিল জানি না৷ হঠাৎই গা'টা কেমন কেঁপে উঠলো৷ চোখে যেন তীব্র ঘোর ধরেছে৷ ছেলেটা সে পথ ধরে হেঁটে চলে গেল৷ আমি বারান্দা থেকে তার গমন পথের দিকে চেয়ে থাকলাম। এক সময় সে আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল৷ আমি তাও তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে৷ কতোটা সময় তাকিয়ে থেকেছি জানি না৷ তবে যতোটা সময়ই তাকিয়েছিলাম, আমার কাছে অদ্ভুত রকমের ভালো লাগছিল৷ মনে ভেতর কেমন জানি শিরশিরে একটা প্রশান্তি বয়ে বেড়াচ্ছিল৷ কী অসাধারণ সে অনুভূতি! আমি জানতাম না এই অনুভূতিটা কিসের। হঠাৎ কেন এমন হচ্ছে তাও জানতাম না৷ অচেনা অজানা এই ছেলেকে দেখে কেন এমন মনে হলো তাও বুঝলাম না! আমার কেবল মনে হচ্ছিল এই ছেলেটিকে আমার ভালো লেগেছে৷ এ এক অন্য রকম ভালো লাগা৷ এই ভালো লাগার নাম নেই। থাকলেও তা জানা নেই আমার৷ সেদিন তাকে দেখে মনে হলো আমি তৃপ্তি পাইনি৷ আমার তাকে আরো দেখতে হবে। খুব কাছ থেকে দেখতে হবে৷ জানেন, সেদিন থেকেই তাকে দেখার লোভ জন্মে গিয়েছিল মনে। সেই লোভ থেকেই তার পিছু নেওয়া৷ খোঁজ নেওয়া। যখন খুঁজে পেলাম তখন মনে হলো, 'হায়! এই ছেলে তো আমার আশপাশেই ছিল! আমি কেন তাকে আগে দেখিনি! কেন এতোদিন সে আমার কাছে আসেনি। কেন?' সেদিন অদ্ভুত প্রশান্তিময় আক্ষেপ জমে মনে৷ আক্ষেপেও যে এতো পরিপূর্ণ প্রশান্তি থাকে জানা ছিল না। লোভে পড়ে তাকে প্রায়ই দেখতে যেতাম৷ আড়ালে আড়ালে৷ গোপনে৷ ভালো লাগতো। সেই ভালো লাগা নিয়েই বাড়ি ফিরতাম রোজ। সাদিক, আপনি কি জানেন, আমার চোখে ঘোর ধরানো সেই ছেলেটি কে? আমার মনের জগতে প্রাশান্তির অনুভূতির ঝড় তোলা সেই পুরুষটি কে জানেন? সেই পুরুষটি হলেন আপনি৷ কেবল আপনি! আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে! খুব মারাত্মক ভাবে পছন্দ হয়েছে। আপনি কি আমার হবেন? চিরদিনের জন্যে আমার?
কথাটা শেষ করে মেয়েটি কেমন উচ্ছ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। চোখে মুখে কী তীব্র আগ্রহ। আমি তার সেই উচ্ছ্বাস, আগ্রহে পানি ঢালতে চাইনি৷ মৃদু হেসে বললাম,
-এই টপিক আজ এই পর্যন্তই থাকুক৷ তোমার জবাব আমি তোমাকে পরে জানিয়ে দিবো৷ আপাতত আমরা উঠি৷ কী বলো?
সে বেশ দ্রুত করে বলল,
-পরে কোনদিন?
-কাল বা পরশু।
-এতো সময়?
-বেশি মনে হচ্ছে?
-খুব বেশি৷
-একটু অপেক্ষা করা যাবে না?
সে চট করেই হেসে দেয়। বলে,
-অল্প কিছু সময়ই তো৷ সমস্যা নেই৷
আমি সেদিন সেখান থেকে চলে আসি৷ পরের দু'দিন প্রায় গায়েব হয়ে যাই। ফোন বন্ধ। ফেসবুকেও নেই৷ একদম ডুব দেওয়ার মতো৷ তৃতীয় দিন আমি কল করে নিশিকে জানাই আমার দ্বারা আসলে তার সাথে সম্পর্ক করা সম্ভব না৷ আমি অন্য রকম কোনো মেয়ে চাই৷ সে আমার কল্প কন্যার মতো নয়৷ মেয়েটা আর কোনো কথা বলেনি৷ ওপাশ থেকে কোনো স্বর ভেসে এলো না৷ আমি দ্রুত ফোন কেটে দেই৷ আমি জানি একটু পর মেয়েটার কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে৷ আমি সেটা শুনতে পারবো না৷ কান্না এমন এক জিনিস যেটা মানুষের শক্ত মনকে মূহুর্তে গলিয়ে ফেলতে পারে। আমি চাই না আমার মন গলুক৷ আমি আমার কল্প কন্যার অপেক্ষা করি৷ এক কাব্যপ্রেমি কল্প কন্যার৷
সেদিন থেকেই আমি মেয়েটাকে এড়িয়ে চলতাম। ডুব দেওয়ার কয়েকদিন পর আমাকে দেখতেই সে এগিয়ে এসেছিল কথা বলতে৷ কিন্তু আমি বলিনি৷ ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেলাম। তারপর থেকে তার দেখা বেশ কমই পেতাম। তবে দেখা হলে জ্বালাতন করতো৷ নানান কথা বলতো৷ আমি তাকে উলটো লেকচার দিতাম। লেকচার দিলে কিছুটা কাজ হতো৷ ক'দিন তাকে দেখতাম না৷ কিন্তু এরপরই কোত্থেকে এসে হাজির হয়ে যেতো৷ তবে এতোদিন সে আমার সাথে এভাবে বিহ্যাভ করেনি৷ এতোটা রাগি আচরণ করেনি যতোটা সে আজ করলো৷ কাল রাতে ফোন দিয়েছিল ঠিকই৷ আমি তুলিনি৷ তার ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম অবশ্য৷ কারণ এতোদিন সে কোনো কল দেয়নি৷ আজ হঠাৎ তার কল দেওয়ার কী হলো? আমি ইচ্ছে করেই তুলিনি৷ ভাবলাম ফোনে আবার কোন আলাপালোচনা শুরু করে! এরচে না তোলাই ভালো৷ কিন্তু ফোন তোলা নিয়ে যে সে এতো রেগে যাবে জানতাম না৷ সেই রাগ না হয় চলে গেল। কিন্তু আজ শেষ বিদায়টা মেয়েটা অন্যভাবে দিল৷ এতোটা রুক্ষ, বেদনাময় চাহনি তার থেকে আশা করিনি আমি৷ আমার খানিকটা মন খারাপই হলো। কেন হলো কে জানে! রাতে ভাবলাম সে ফোন দিবে৷ অথচ সে ফোন দিল না৷ আমি কিঞ্চিৎ অবাকই হলাম৷ আমার ধারণা ছিল যতো যা-ই হয়ে যাক, এই মেয়ে ফোন না দিয়ে থাকতে পারবে না৷ অথচ আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কোনো কলই করলো না৷ পরের ক'দিন আমি নিশিকে অল্প সময়ের জন্যেও দেখলাম না৷ তাদের বাসার আশপাশ দিয়ে ক'বার হাঁটা চলা করলাম৷ তাও দেখলাম না৷ আমি না চাইতেই তাকে খুঁজতে চাইলাম। কেন জানি বার বার মনে হতে থাকলো মেয়েটাকে একবার সরি বলা উচিৎ। তাকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি৷ বোঝানো উচিৎ ছিল৷ আমি বেশ কিছুদিন নিশির দেখা পেলাম না৷ আমার মন খারাপের অসুখটা কেন জানি বেড়েই গেল৷ নতুন করে শূন্যতার রোগ দেখা দিল। বার বার মনে হতে থাকলো আমার কিছু একটা নেই৷ কেউ একজন নেই! কোথাও যেন তীব্র শূন্যতা৷
সকালের দিকে বাইরে বের হলাম। পার্কের দিকে একা একা হেঁটে গেলাম। কেন জানি ভালো লাগছিল না৷ অস্বস্তি কিংবা ভেতরে ভেতরে ভীষণ অশান্তি লাগছিল৷ বারবার নিশির বলা শেষ কথা গুলো কানে বাজছিল। মনে হলো আসলেই কি অন্যায় করছি আমি?
.
পরিশেষঃ
নিলিমাকে নিয়ে নিশিদের বাসার কাছে আসতেই দেখলাম নিশি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাদের দু'জনকে দেখতেই সে কেমন করে যেন তাকালো! তার চেহারা কেমন শক্ত হয়ে এলো৷ সে চট করেই ভেতরে চলে গেল। ঠাশ করে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো৷ আমি হাসলাম। নিলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আজ বহুদিন পর দেখলাম ওকে। নিলিমা তোর ওই কথাটা মনে আছে? ওই যে নিশি একদিন তোর কাছে গেল আমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে!
নিলিমা চট করে হেসে ফেলল। বলল,
-মনে আছে মানে! এই কথা ভোলা যায়! সে এসে কী থ্রেট দিল আমাকে! "আপনি ওর সাথে মিশবেন না৷ ওর কাছে ঘেঁষবেন না৷ ঘেঁষলে খবর আছে আপনার! ওর থেকে দূরে থাকবেন। কী হোন ওর! কে হোন! যা-ই হোন, দূরে থাকবেন বলে দিলাম!"
বলে নিলিমা হাসতে থাকলো। বেশ কিছু সময় হাসলো সে৷ এক সময় হাসি থামিয়ে বলল,
-আমার তখনই মনে হয়েছিল, আমার বন্ধু এবার শিকার হয়েই গেল! কিন্তু এতো দিন মেয়েটাকে ঘোরাবি জানা ছিল না!
আমি হাসলাম। বললাম,
-আমি সময় নিচ্ছিলাম আসলে। চট করেই তো সব কিছু হয়ে যায় না তাই না!
নিলিমা মৃদু হেসে বলল,
-তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা বাকিরা কোথায় বল তো!
আমি পেছনে তাকিয়ে বললাম,
-আসবে। ওয়েট কর৷
-আমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো? নাকি ভেতরে যাবো?
নিলিমা এই কথাটা বলার পরই দেখলাম নিশির বাবা বেরিয়ে আসছেন৷ আমাকে দেখতেই এক গাল হাসলেন৷ আমি সালাম দিলাম। তিনি এসে জড়িয়ে ধরলেন আমায়৷ বললেন,
-বাকিরা কোথায়?
-আসছেন।
-আচ্ছা! তোমার ভেতরে এসো৷ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না৷
আমরা ভেতরে গেলাম। ভেতরে আসতেই গাড়ির হর্নের আওয়াজ এলো৷ আঙ্কেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোমার বাবারা এসেছেন বোধহয়! আমি যাই! তোমরা একা যেতে পারবে না? সেকেন্ড ফ্লোর!
আমি হাসলাম। বললাম,
-সমস্যা নেই৷ আপনি যান৷
আমি আর নিলিমা লিফটের কাছে চলে এলাম। লিফট খুলতেই দেখলাম নিশি দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি বেশ অবাকই হলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! এই মেয়ে এখানে কী করছে? কই যাচ্ছে সে? আমি কিছু বললাম না। নিশি লিফটের ভেতরে থেকে বেশ অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে যেন তার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না! আমাদের দু'জনকে যে এখানে দেখবে এটা তার ভাবনাতেই ছিল না যেন! বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেল! নিশি লিফট থেকে বের হলো না৷ তার চেহারায় হতভম্ব ভাব লেগেই থাকলো৷ আমি আর অপেক্ষা করলাম না৷ লিফটের ভেতর ঢুকে গেলাম৷ নিলিমাও আমার দেখাদেখি ঢুকে গেল৷ আমি সেকেন্ড ফ্লোরের সুইচে চাপ দিলাম। নিশি একভাবে পাথরের মতো দাঁড়িয়েই থাকলো৷ আমরা দ্রুতই সেকেন্ড ফ্লোরে চলে এলাম। লিফট খুলে গেল। আমি আর নিলিমা বেরিয়ে এলাম। এগিয়ে গেলাম নিশিদের বাসার দিকে৷ ওদের বাসার দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। আড়চোখে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিশি লিফট থেকে বেরিয়ে সেই অবাক ভাব নিয়েই তাকিয়ে আছে৷ নিলিমা আমাকে হালকা খোঁচা দিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
-জীবনে এই প্রথম দেখলাম বিয়েতে জামাই মশাই আগেভাগে চলে এসেছে আর বউ সাহেবা লিফটের কাছে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এ এক অদ্ভুত দৃশ্য! পৃথিবীর অদ্ভুততম এক দৃশ্য!
আমি চাপা স্বরে বললাম,
-চুপ থাক! কথা বলিস না৷ নিশি কী করে দেখ!
নিশি এবার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। বলল,
-আপনারা বোধহয় ভুল বাসাতে এসেছেন!
ঠিক সেই সময়েই নিশির আম্মু দরজা খুলে দিলেন। আমি তাকে দেখতেই সালাম দিলাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
-ভেতরে এসো বাবা!
এরপর নিশির দিকে চোখ পড়তেই তিনি খানিকটা কঠিন স্বরে বললেন,
-এই! তুই এখানে কী করছিস? তোকে আমি সারা ঘর খুঁজে বেড়ালাম! এদিকে আয়! আয়?
নিশি আমাদের কাছাকাছি এসে বলল,
-এসব কী হচ্ছে মা?
-দেখো, গাধিটা বলে কী! তার বিয়ে হতে যাচ্ছে অথচ সে বুঝতেই পারছে না! আয় আয়! এদিকে আয়! মেহমান চলে এসেছে! তোমার ভেতরে এসো!
আমি নিশির দিকে তাকিয়ে থাকলাম৷ দেখলাম সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
.
নিশিকে যখন সাজিয়ে নিয়ে আসা হলো তখন সে ফোঁপাচ্ছে৷ তার চোখ কেমন যেন ভেজা ভেজা৷ তার আম্মু তার পাশে বসে আছে৷ নিশি কেন জানি নিজেকে রোখাতে পারছিল না! সে কান্না করছিল। কান্নাটা এমন যে সে নিজেও এটাকে আঁটকাতে পারছে না৷ চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে৷ কাজল লেপ্টে চোখ দুটো কেমন যেন কালসে হয়ে আছে! সে ফোঁপাচ্ছে! আবার ঠোঁট চেপে কান্না রোখবার চেষ্টা করছে৷ অথচ সে তা পারছে না! কবুল বলার আগ মূহুর্তে সে কি কান্না তার! পুরো ঘরটায় কেবল তার কান্নার স্বরটাই ভেসে বেড়াচ্ছিল! সে কবুল বলছিল না! সে কান্না করে যাচ্ছিল কেবল! হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে সে তার আম্মুকে কী যেন বলল! তিনি ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কবুলটা বলে দে না মা! তাহলে কাজি সাহেব বাকি কাজটা সেরে ফেলতে!
সে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
-না! আমি ওর সাথে কথা বলব! ওর সাথে কথা বলতে হবে আমার।
-উফ! তোকে নিয়ে আর পারা গেল না!
নিশির বাবা বললেন,
-যাও! ওদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দাও৷
নিশিকে নিশির আম্মু নিয়ে গেলেন! শ্বশুরমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুমি যাও বাবা!
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভেতরে ভেতরে আমার খানিকটা ভয় হচ্ছিল৷ আশ্চর্য ব্যাপার! এই মেয়ের এখনই কী কথা বলতে হবে? কথাই বলবে? নাকি মারামারি করবে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজ বোধহয় আমার খবরই আছে! আমি নিশির নিশির রুমে গেলাম। দেখলাম সে বিছানার কাছে জড়সড় হয়ে বসে আছে৷ তার চোখে জল। নাকের ডগাটা কেমন লালচে হয়ে আছে৷ আমি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ধিরে ধিরে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। নিশি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
-আপনার তো আমাকে পছন্দ না! আমি আপনার টাইপের না। তাহলে-তাহলে এখন কেন বিয়ে করতে এলেন? কেন?
আমি কিছু সময় চুপ থাকলাম। বললাম,
-এটার কোনো সঠিক উত্তর আমার জানা নেই! আমি একটা বই পড়েছিলাম। "কাদম্বরীর শেষ কাব্য।" এখানে একটা চরিত্র আছে৷ কাদম্বরী, এক কাব্যময় রমনী! তার প্রতিটা কথা, প্রতিটা উক্তি এতো চমৎকার, এতো ভারী, এতো অনুভূতি সম্পন্ন যে আমি কল্পনায় তার প্রেমে পড়ে গেলাম! বইয়ের চরিত্রের সাথে তো আর প্রেম হয় না! তাই আমি আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে এমন কাউকেই চাইলাম। এমনকি আমি এই বইটার লেখক তাসফি আহমেদের কাছেও গেলাম একদিন৷ জানতে চাইলাম পৃথিবীতে আদত এমন কোনো নারী আছে!? তিনি জানলেন, খোদার পৃথিবী বড়ই বিচিত্র। থাকতে পারে৷ আবার নাও পারে৷ আমি কল্পনা করেই লিখলাম! নিশি, এরপর থেকে আমি এই কাব্যকন্যাকে খুঁকে এসেছি৷ একটা মেয়ে যে কাব্যিক কথা বলে, কবিতা পছন্দ করে, মাঝে মাঝে প্রেমিককে খুশি করার জন্যে কবিতা আবৃত্তি করে। আমার মাথায় ভূত চেপেছিল! এই কাব্যকন্যার ঘোরেই পড়ে রইলাম। এইদিকে যে কেউ একজন আমার ঘোরে আবৃত হয়ে ব্যাথা-বেদনায় ভুগছে তা আমি অনুভবই করতে পারলাম না৷ কেউ যে আমার প্রেমে পড়ে তীব্র ব্যাথা ভুগছে তা আঁচই করতে পারলাম না। শেষ যেদিন তোমার সাথে আমার কথা হয়েছে, তুমি যখন আমাকে ওই কথা গুলো বলছিলে, আমি তখন তোমার চোখে কিছু একটা দেখছিলাম। হয় আমাকে না হয় আমার প্রতি তোমার তীব্র ভালোবাসাকে৷ আমি তোমার চোখ ভরা ব্যাথা দেখেছি সেদিন নিশি! সেদিনই আমি অনুভব করি আমি ভুল করছি! আমি একটা কঠিন ভুল করছি! আমি কোনো কাব্যকন্যাকে চাই না৷ আমার কোনো কাব্যকন্যা লাগবে না৷ আমার নিশিকন্যা হলেই হবে৷ একমাত্র নিশি!
এতটুকু বলে থামলাম আমি। নিশির দিকে এগিয়ে গেলাম। তার পাশে বসলাম। সে মাথা নিচু করে আছে৷ এখনও ফোঁপাচ্ছে৷ আমি আবার বললাম,
-নিশি, তোমাকে আজ প্রায় অনেকদিন আমি দেখি না। পনেরো দিনের বেশি হবে হয়তো! আমি প্রায় উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম৷ বোকার মতো তোমাদের বাসার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিলাম। তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছিলাম। তোমাকে যে এতো তীব্রভাবে মিস করব তা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি৷ আমার কেন জানি মনে হতে থাকলো আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা নেই৷ খুব প্রয়োজনীয় কিছু একটা! এতো কিছু থাকার পরও আমি কেন এতো তীব্র শূন্যতায় ভুগতাম জানো? কারণ আমার নিশিটা নেই৷ আমার হৃদয়ে আমার অগোচরে বাস করা আমার সেই প্রিয় নিশিটা নেই! আমি বুঝতে পারলাম আমি আসলে না চাইতেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি৷ নিজের হৃদয়কে শক্ত রেখে, এতো চেষ্টার পর আমি আসলে নিজেকে রোখাতে পারিনি৷ তোমার মায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি৷ সেই আমাকে তোমার মায়ার জালে ফেঁসে যেতেই হয়েছে! আমাকে তোমাকে নিয়ে ভাবতেই হয়েছে। আমার না চাইতেও তোমার প্রেমে পড়ে যেতেই হয়েছে!
কথা গুলো বলে আমি নিশির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে আগের মতোই মাথা নিচু করে আছে! তার কানের কাছের চুল গুলো সামনে চলে এসেছে৷ মেয়েটা সেগুলো সরাবার চেষ্টাটুকুও করল না৷ আমি আলত করে সেগুলো কানের কাছে গুঁজে দিতে চাইলাম। নিশি এক ঝটকায় আমার হাত ঝেড়ে ফেলে দিল৷ আমি আবার কাজটা করতে চাইলাম৷ সে সেই একই কাজ করল। আমি বললাম,
-এমন করছো কেন?
-ছুঁবেন না আমায়।
-কেন?
-আমি বলেছি তাই৷
-তুমি বললেই হবে নাকি?
-অবশ্যই। আমি বললেই হবে৷ আমি আমার মতের বিরুদ্ধে যাই না৷ আমার মন যা চায় আমি তাই করি৷ কেউ আমার মনের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাইলে সেটা আমার অসহ্য লাগে!
আমি বললাম,
-খোঁচা মারছো তাই না?
-মোটেও না৷ আমার মনের কথা বলছি!
আমি কিছু বললাম না আর৷ চুপ করে গেলাম। নিশিও চুপ করে থাকলো। আমি বললাম,
-আর কিছু বলবে?
-কেন? খুব তাড়া নাকি আপনার?
-এতো কঠিন ভাবে কথা কেন বলছো বলোতো! একটু আগে দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে অস্থির৷ এই অল্প কতোক্ষণে মন এতো শক্ত করে ফেললে কী করে?
-বেশি কথা বলবেন না৷ চুপচাপ উঠে দাঁড়ান৷
আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলাম নিশির দিকে৷ উঠে দাঁড়ালাম না। নিশি আবারও বলল,
-কই? উঠুন!
আমি বসেই থাকলাম। এক দৃষ্টিতে নিশির দিকে চেয়ে থাকলাম। নিশি এবার আমার দিকে ফিরলো৷ আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই সেও তাকিয়ে থাকলো। আমাএ চোখে চোখ রাখলো৷ আমি এবার সরল দৃষ্টিতে তাকালাম। তার চোখের গভীরতা খুঁজতে চাইলাম! আশ্চর্য! এই চোখ দুটোয় এতো তীব্র মায়া কেন? এতো অসাধারণ কেন চোখ দুটো? একবার তাকালেই যেন হৃদয়টা নড়ে উঠে! কী আছে ওই চোখে? কী আছে এর গভীরতায়? নিশি হঠাৎ বলে উঠল,
-এতো সুন্দর একটা মূহুর্তে আপনার কি আমার হাতটা ধরার ইচ্ছে হয় না? চাইলেই তো হাতটা শক্ত করে ধরে বলতে পারেন, 'নিশি, সব অভিমান ঝেড়ে ফেলে দাও না এবার! চলো আমরা নতুন কিছু শুরু করি৷'
আমি অপেক্ষা করলাম না এবার। চট করেই নিশির হাতটা ধরে ফেললাম৷ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
-নিশি, আমি জানি আমার দ্বারা যা হয়েছে বড় অন্যায় হয়েছে! আমি না বুঝেই তোমার হৃদয়ে চোট দিয়ে ফেলেছি! আমি তোমার অনুভূতিকে বুঝতে পারিনি৷ এ আমার বড় অন্যায় হয়েছে! না বুঝেই তোমাকে নানান ভাবে নানান বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেছি৷ আমি জানি তুমি কেমন ব্যাথা পেয়েছো। তুমি কতোটা কষ্ট সয়েছো! এই যে আমি তোমাকে ভালোবাসিনা বলার পরও যে তুমি এতো ছুটে আসতে, কেন আসতে? এতো ব্যাথার পরও তুমি কেন ছুটে আসতে? আমি এখন সব বুঝতে পারি নিশি৷ তোমার আবেগ, অনুভূতি সবটাই এখন আমি বুঝতে পারি। নিশি, আমি তো অতীতকে পরিবর্তন করতে পারব না! তবে তুমি যদি চাও একটা সুন্দর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সাজাতে পারি তোমায় নিয়ে৷ নিশি, তুমি কি আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সঙ্গী হবে? চিরদিনের জন্যে আমার হবে?
আমি থামলাম। নিশি একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কেবল৷ কিছু বলল না৷ বলতে পারলো না যেন৷ তার চোখ যেন ছলছল করছে৷ সে আবার কান্না করছে৷ ফোঁপাচ্ছে৷ তার নাকের ডগা লাল হয়ে আসছে৷ সে ভেজা স্বরে বলল,
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে এই কথা গুলো বলছেন! আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি৷ এখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে!
আমি কিছু বললাম না৷ আলত করে নিশির হাতে চুমু খেললাম। নিশির গা'টা কেঁপে উঠল যেন! সে আবার কান্না শুরু করে দিল৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-প্লীজ, একটু জড়িয়ে ধরুন না আমায়! আমার আপনাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! আপনি কি আমায় একটু জড়িয়ে ধরবেন?
আমি কিছু বললাম না আর। নিশিকে জড়িতে ধরলাম কেবল! নিশি আমার বুকের কাছে মাথা রেখেই কান্না শুরু করে দিলো। দু'হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না তার! কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-সাদিক, আমার মনে হচ্ছে আমি আমার পৃথিবীটাকে পেয়েছি৷ আমার একমাত্র প্রশান্তির পৃথিবী।
আমি তার প্রশ্নের জবাব দিলাম না। তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলাম কেবল। থাকুক মেয়েটা এভাবে! তার ব্যাথা গুলো ঝরুক৷ অভিমান গুলো মরুক৷ আমাদের অনুভূতি গুলোর কেবল মিলন হোক৷ তারা বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।
.
বাড়ির সবার সম্মতিক্রমে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল! এখন জাস্ট বিয়েটা হয়ে যাওয়া৷ কয়েকদিন পর অনুষ্ঠান হবে৷ এটা নিশির জন্যে ছোটো একটা সারপ্রাইজ ছিল৷ এই মেয়েটা এতো কষ্ট সয়েছে, তার জন্যে এমন কিছু তো করাই যায়! নাকি? নিশির সাথে চট করেই বিয়েটা হয়ে যাওয়া নিয়ে মানুষের মনে খানিকটা উৎসাহ থাকতেই পারে! এভাবে তো চট করে বিয়ে হয়ে যায় না৷ তবে? আসলে আমাদের ক্ষেত্রে বিয়েটা হয়েই গেল এভাবে৷ নিশির কথা বাসায় বলেছিলাম। চাকরিবাকরি করছি! বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়েছে! তাই বাবা মা'ও না করেননি৷ এ জন্যেই এতো জলদি এতো কিছু হয়ে যাওয়া। এখন নিশিমনি প্রতি বেলা ঘুম থেকে উঠে আমার কপালে একটা চুমু খায়৷ এই চুমুটা হলো ভালোবাসার একটা অদেখা চিহ্ন! যেটা আমাকে পুরো দিন অন্য মেয়ে গুলোর দিকে না তাকাতে সাহায্য করবে৷ এটা হলো নিশিমনির কথা! ইনডাইরেক্টলি, আমাকে বলে দেওয়া যে আমি যেন কোনো মেয়ের দিকে না তাকাই! 😒 মানে এতো প্রেমের পরের নারী জাতির মাঝে সন্দেহটা থেকেই যাবে! 😯
.

সমাপ্ত।
গল্পঃ নিশি।
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
-তাসফি আহমেদ।

Read More

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url