ভালোবাসার গল্পঃ রাত্রি। লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ

 



ভালোবাসার গল্পঃ রাত্রি । লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ


সাদ আহম্মেদ


রাত্রি যখন আমাকে বললো, তার সাথে আমার সংসার ডিশমিশ, তখন আমার কেন যেন কষ্ট হয়নি।একটুও না।কারণ আমি এমন কিছু করিনি যাতে সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব।আমি এতটাই Careless ছিলাম, যে মনে পড়েনা শেষ কোন বিবাহবার্ষিকী অথবা তার জন্মদিনের মত বিশেষ কোন দিনে তার হাতে হাত রেখে বলেছিলাম শুভ কামনা।আমাদের চার বছরের সংসার আমি নিজের হাতে নষ্ট করেছি, আমি তার জীবনের চাওয়া পাওয়া সবগুলো নিজের হাতে দলিত মথিত করেছি।আজকে কোন অধিকারে আমি তাকে উত্তর দেব? আমি মনে মনে শুধু বললাম রাত্রি আমাকে ক্ষমা করো।আমি কতটাই নীচ যে এই কথাটা তাকে সরাসরি বলার সাহসটুকুও আমার ভেতরে নেই। রাত্রি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলার নাই?ঝগড়া করবেনা?” আমি অনেক কষ্ট করে হলেও তাকে বলতে পারলাম, “এই অধিকারটুকু আমার নাই। তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি তোমাকে সাধুবাদ জানাচ্ছিরাত্রি হেসে বললো, “তুমি অনেক ভালো মানুষ এটা কি জানো?” আমি নীচের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে তাকে বললাম, “হ্যারাত্রি কথা শেষ করে রান্নাঘরে চলে গেল সকালের নাস্তা বানানোর জন্য। তাকে অনেক ক্লান্ত মনে হলো।কিন্তু আমি জানি সে এখন আমার মত একটা মূক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন করে হাসতে শিখবে। ভাবছি হয়তো আর বছর খানেক পরে সে কোন এক ঝরঝরে সংবেদনশীল পুরুষের হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে কোন এক শপিং মলে।তাকে আহলাদ করে বলবে, এটা ওটা কিনে দিতে।সে অনেক ভালোবাসা পাবে, পাবে বেচে থাকার নিঃশ্বাসটুকু।আচ্ছা তখন যদি ভুলক্রমেও আমার সাথে দেখা হয়ে যায়, আমি কি করবো বলুন তো?এই কথা ভেবেই আমার নিঃশ্বাসটুকু আটকে আসতে চায়।আমি সেই চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা করি।জানি আজকে অফিসে যেতে দেরী হয়ে যাবে।মুর্শেদ ভাই কি ডেকে আমাকে ঝাড়ি দেবে? যেহেতু দেরী করার কোন মিথ্যা কারণ বলতে পারবোনা,তখন কি করবো? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে প্রধাণ সড়কে এসে পড়লাম জানিনা।চারাপাশে অনেক গাড়ি ঘোড়া।আমি ক্লান্ত বিরক্ত এবং পরিশ্রান্ত।জঞ্জাল নগরীর চলমান যন্ত্রগুলোকে পাশ কাটিয়ে নিজেই এক যন্ত্রবন্দী হয়ে মোহাম্মদপুর অফিসে রওনা হলাম। অফিসে এসে দেখি মানুষজন আমাকে দেখে বেশ বিরক্ত, দু একজন হাসিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কি অর্ক ভাই,ভাবীর সাথে ঝগড়া করে আসলেন নাকি?” আমি হাসিমুখে বললাম, “আপনাদের ভাবী আমাকে বেলই দেয়না,ঝগড়া করবে কি?” আমার পিওন আসলাম সামনে এসে বিশাল দুঃসংবাদ দিলো।আমাকে মুর্শেদ ভাই ডেকেছে।আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো।বিশাল ঝাড়ির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম আমি।মুর্শেদ ভাইয়ের অফিসে যখন গেলাম তখন উনি হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কাকে যেন বকাঝোকা করছেন।আমাকে দেখে হাসিমুখে ফোনটা রেখে দিলেন পরে আবার কথা বলার আশ্বাস দিয়ে।বুঝলাম কথা হচ্ছিলো নীনা ভাবীর সাথে। মুর্শেদ ভাই আজকে হলুদ রংয়ের হিমুটাইপ শার্ট পরে এসেছেন। নীনা ভাবীর সাথে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন উনি প্রায়ই আমাকে বলতেন অর্ক দোস্ত তুই যাই করিস হলুদ জামা পড়ে আমার সামনে আসবিনাআমি কাকতালীয় ভাবে মুর্শেদ ভাই আর তার বিয়ের দিনে হলুদ একটা স্ট্রাইপ শার্ট পড়ে গিয়েছিলাম। নীনা ভাবী আমাকে বিয়ের মঞ্চের সামনে দেখে অত্যন্ত কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরাসরি বললেন, “তুমি এখান থেকে না গেলে আমি বিয়ে করবোনাআমি অবাক হলাম, তবে তার কথা শুনে নয়। তার অভিমান ভরা তুমি সম্বোধনের ডাক শুনে।আশিক আমাকে ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষেই জানিয়েছিলো যে নীনা ভাবী আমাকে নাকি পাগলের মত ভালোবাসে। তাহলে কি ও সেদিন সত্যি কথাটাই বলেছিলো?আচ্ছা তাহলে যখন মুর্শেদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, যখন মুর্শেদ ভাইয়ের হয়ে তার ঘটকালী করেছিলাম তখন কিছু বলে নাই কেন?আমি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে চলে এসেছিলাম। আজকে মুর্শেদ ভাইয়ের হলুদ জামা দেখে হাবিজাবি কথাগুলো মনে হয়ে গেলো। মুর্শেদ ভাইয়ের কন্ঠ শুনে আবার জগতে ফিরে আসলাম।দুরুদুরু বুকে মনে হলো, মুর্শেদ ভাই কি এইসব জানে? “অর্ক আজকে তোমাকে একটা বিশেষ খবর দেব।আমি তোমাকে এই অফিস থেকে বের করে দিবো ভাবছি।কেমন হবে?” আমি বোকার মত বললাম, “জ্বীমুর্শেদ ভাই সজোরে হাসতে হাসতে বললেন, “পরের মাস থেকে তুমি চাটগার হালিশহর প্রজেক্টে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করবে।না করে লাভ নাই।আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবোনা এটা তো জানোই,তাই না অর্ক?” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। মুর্শেদ ভাই জানেন আমি কখনো না শব্দটা বলতে পারিনা।আমাদের কন্সট্রাকশন কোম্পানীর সাথে সাবডিলারশীপে যারা কাজ করে তাদের সাথেও আমি মিনমিন করে কথা বলি।এইতো সেদিন শাহ সিমেন্টের লোক আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বললো আমি নাকি কোন প্রকৌশলীই না, কারণ তাদের মত ভালো সিমেন্ট কোম্পানীকে আমি একসেপ্ট করিনি। আজকে যখন এমন একটা প্রমোশন পেলাম, তখন আমি তাকে সামান্য ধন্যবাদটাও কি করে দেব খুজে পাচ্ছিলাম না।চলে যাওয়ার আগে শুধু তাকে বললাম, "জ্বী চলে যাব চাটগা ৩১ তারিখেই"বাসায় যখন ফিরে আসলাম তখন পুরো বাসায় আমি একা, ঠিক একা যে তা নয়। আমার ছোট্ট বেডরুমে একটা জ্বলজ্বলে চিঠি যাতে লেখা ভালো থেকো। রাতের খাবার বাহিরে রাখা আছে, ঠান্ডা হয়ে গেলে গরম করে নিয়োআমি গোসলের পানি গরম করে ঠান্ডা ভাত তরকারীই খেয়ে নিলাম, কারণ সারাদিন অফিসের কাজের ঝক্কির পর এত শক্তি ছিলোনা আবার সবকিছু গরম করার। আজকের রান্নাটা খুব সাধারণ ছিলো।হঠাৎ করে দেখি পাশে রাত্রি বসে আছে। কি অদ্ভুত আমি আগে কেন খেয়াল করিনি।ও আমাকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “খাবার ভালো হয়েছে?মাছের কাটা বেছে দিবো?” আমি বলি না না ঠিক আছে। আমি বেছে নিতে পারবোরাতে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন রাত্রিকে সারাটি ঘর খুজেও পেলাম না।বুঝতে পারলাম সে হয়তো কোন কারণে রাগ করে ছাদে চলে গেছে।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।সকালে অফিস আছে যে! সকালে যখন অফিসে যাচ্ছিলাম তখন কোন কিছু খেলাম না।রাত্রি কেন যেন নাস্তা বানায়নি আজকে।অফিসে যাওয়ার আগে ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছে বড় বড় চোখ করে।ভাবলাম কিছু বলবে কিন্তু কিছুই বললোনা।রাস্তায় যখন বের হলাম তখন মনে পড়লো, কালই চলে যেতে হবে চাটগা। আমি তো রাত্রিকে কিছুই জানালাম না এখনো। মুর্শেদ ভাই আমার কাধে হাত দিয়ে বললেন, “আমি যাচ্ছি তোমার সাথে কাল। তোমার জন্য একটা ছোট্ট বাসা ঠিক করা আছে।আস্তে আস্তে মালামাল শিফট করে নিওআমি মাথা নাড়লাম যার অর্থ ধন্যবাদ।আমি জানিনা মুর্শেদ ভাই কেন আমাকে পছন্দ করেন এতোটা। আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হলাম।রাত্রির জন্য কিছু ফুল কিনতে হবে, সাথে ওর প্রিয় আইসক্রিম।আজকে ওর সাথে সারারাত গল্প করবো,আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন আকবো।যা আগে করিনি তার সবকিছু করবো।প্রিয় রাত্রি, আমি কি তোমাকে ভালবাসি? তুমিই বলে দাও। বাসায় যখন পৌছালাম, তখন দেখি কেউ নেই বাসায়।আমি অপক্ষা করতে থাকি রাত্রির নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনার জন্য।সারাটি ঘরে কোথাও রাত্রির অস্তিত্ব অনুভব করতে না পেরে আমি কেন যেন হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে যাই।আমি বসে পড়ি মেঝেতে আর ভাবতে থাকি কখন আবার সে পাশে এসে বসবে।আমার মাথায় হাত দিয়ে বলবে, “খাবেনা?” রাত কয়টা বাজে তা আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে রাত্রির হাতের স্পর্শ।ও আমাকে ফিসফিস করে বলছে, “তুমি কখন খাবে?” আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, “খাবোনাতারপর সে কোথায় যেন চলে গেল।আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম।ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমার মাথাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি রাত্রি বাসায় নেই সেই দিনের পর থেকেই। কিন্তু ওর অনুপস্থিতি আমি মেনে নিতে পারছিনা।তাই ওকে আমার আশে পাশে কল্পনা করে নিচ্ছি। কিন্তু যখন ওকে দেখতে পাই এতটা বাস্তব মনে হয়।আমি ঘুমের মধ্যেই ভয় পেয়ে যাই। প্রচন্ড ভয়। মুর্শেদ ভাই প্রচন্ড জোরে গাড়ি চালাচ্ছে মাতাল হয়ে, আমি একটু বিরক্ত তার এই আচরণে।আজকে আমার ঢাকা অফিসে শেষ দিন উপলক্ষে উনি আমাকে নিয়ে সেলিব্রেশন করলেন ঢাকা ক্লাবে।জনি ওয়াকার এক বোতল খালি করে আমাকে রাগত ভংগীতে বললেন, “ছাগল তুমি লালপানি খাওনা কেনআমি হেসে বললাম, “পানির কোন রঙ নেইআমি বুঝতে পারছিনা মুর্শেদ ভাই কেন এত রেগে আছে। আমার দিকে বারবার তাকিয়ে হাসছে আর কি যেন বিড়বিড় করে বলছে।আমরা এখন ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি।উনি হঠাৎ করে গাড়ি থামিয়ে আমাকে বললেন, “যাও শুশু করে আসো।আমার গাড়ি নোংরা করবানাআমি বললাম, “ভাইয়া আপনি বোধহয় নিজের জন্য থামিয়েছেনমুর্শেদ ভাই লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন,”মাথাটা ঠিক নাই অর্ক।মাইন্ড করোনা।আসো একটু গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশের প্রকৃতি দেখিআমি গাড়ি থেকে নেমে উনার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।উনি ওম শান্তি বলতে বলতে গাড়ির কাছে ফিরে এসে আমার জিজ্ঞেস করলেন, “নীনার সাথে তোমার কয় বছর এফেয়ার ছিলো?” আমি বললাম, “আমার ছিলোনা।উনি হয়তো আমাকে পছন্দ করে থাকতে পারেনউনি হেচকি দিয়ে বললেন, “মহিলা জাতটা ভালো না অর্ক।আমি পাচ বছর বিয়ে করলাম, সে আমাকে একদিনের জন্যও ভালোবাসেনাই।তুমি কি জোর করে ওকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিছো?” আমি কিছু না বলে গাড়িতে বসে বললাম, “ভাইয়া দেরী হচ্ছে।চলেনমুর্শেদ ভাই আবার গাড়ি স্টার্ট করে রওনা হলেন।আমি হঠাৎ করে উনাকে বললাম, “ভাইয়া আমার মাথা আজকাল খারাপ হয়ে গেছেমুর্শেদ ভাই হেসে বললেন, “তোমার বউ কি তোমাকে ছেড়ে দিছে?” আমি বললাম, “হ্যা।আপনি কি করে জানলেন?” “নীনা বলছে।রাত্রি ওকে মাঝে মাঝে ফোন করে।বউ ছেড়ে দিলে সবারই মাথা খারাপ হয়ে যায়, সো ইটজ নট আনইউজালআমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। হঠাৎ করে বললাম, “গাড়িটা ঘোরান।আমি চিটাগাং যাবোনামুর্শেদ ভাই বললো, “সামনে একটা বিখ্যাত বিরানী হোটেল আছে,ওখান থেকে বিরানী খেয়ে তারপর ব্যাক করবো। ওকে?”রাত্রি চারটা বেজে বিশ মিনিট তখন।আমি রাত্রির মায়ের বাসায়। ওর মা বাবা সবাই খুব অবাক হয়েছে।একটু পর রাত্রি এসে আমার পাশে বসলো।তার চোখে তখনো অনেক ঘুম এবং বিরক্ত ভাব। সে প্রথমেই আমাকে বললো, “আমি যাবোনাআমি বললাম, “যেতে হবেনা। ওই বাসায় যেতে আমারও ইচ্ছা করেনা।আমি তোমার সাথে এখানে থাকি?” আমার কথা শুনে রাত্রি কি অবাক হলো? ও আমাকে শান্ত হয়ে বললো, বাথরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।এরপর কিছু খেয়ে তারপর কথা বলো।আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে চুপ করে বসে রইলাম।হঠাৎ করে ও অনেক কাদলো, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদলো। আমাকে জিজ্ঞেসা করলো, “তুমি জানতেনা আমাকে কত ভালবাসো?” আমি ওর দু হাত ধরে বললাম, “নাহ!এখন যেহেতু জানি তোমাকে আর ছাড়বো নারাত্রি অঝোরে কাদতে থাকলো। আমি ওকে থামালাম না।শুধু কাছে টেনে নিয়ে বসে থাকলাম।

.

ভালোবাসার গল্পঃ রাত্রি 


-সাদ আহম্মেদ



গল্পঃ মায়া

লেখকঃ তাসফি আহমেদ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url