Bangla Golpo: অহনা। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
Bangla Golpo: অহনা। ভালোবাসার গল্পটি লিখেছেনঃ সাদ আহম্মেদ
অহনা সকাল থেকে বসে বসে একটা
ব্যাপারই শুধু ভাবছে।সে বিয়েটা করতে চাচ্ছেনা কোনভাবেই।তার মনটা বর্ষার বৃষ্টির
মত বারবার কাদছে, কিন্তু তা কাউকে দেখাতে পারবেনা, বোঝাতেও পারবেনা।সকালবেলা সে তার মাকে বলে এসেছে, “মামণি মেয়ে হওয়ার যন্ত্রণা এত বেশি কেন”?ওর মা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ, “তারপর ভয়ংকর একটা ধমক দিয়ে বললো এইসব ভাবের কথা বলবিনা, তোর বাবার অবস্থা জানিসনা?এমন একটা ছেলে কোথায় পাবো পরে”? অহনার বরের নাম ফয়সাল।ফয়সালের সাথে অহনা একবার দেখা হয়েছিলো, শুধু ওই একবারের দেখাটিও হতোনা যদি অহনা জানতো ফয়সাল তাকে বিয়ে
করতে যাচ্ছে।অহনার সাথে যখন ফয়সালের দেখা হয় তখন সে ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে চা
আর সিঙ্গারা খাচ্ছে।তার মুখ ভরা তখন ক্যন্টিনের ঝাল সিঙ্গারা।হঠাৎ ফয়সাল তার
সামনে বসে বললো, “আস্তে আস্তে খান।গরম চা হঠাৎ করে
খেলে হার্টে ধাক্কা লাগে”। অহনা হা করে তাকিয়ে ভাবছিলো কি
করবে।ট্রেডিশনাল মেয়েদের মত সে কিছুই বললোনা, চুপ করে উঠে যাচ্ছিলো।ঠিক তখন তার মনে হলো, ছেলেটা তার কাজিনের বন্ধু।একবার তাদের বাসায় এসেছিলো।তখন লজ্জায়
কথা বলতে পারেনি।অহনা বুঝতে পারছিলোনা সে এখন কি করবে। অবশেষে সে নিজেই বললো, “ভাইয়া কেমন আছেন”? ফয়সাল মুচকি
হেসে বললো, “বাহ আপনি তো দেখি আমাকে মনে
রেখেছেন।অনেক ধন্যবাদ সেজন্য। কেন আপনার সাথে এখন আমার দেখা হলো তা কিন্তু জিজ্ঞেস
করলেন না”। অহনা বিব্রত বোধ করলো বেশ। আজকে
তার সাথে এক বিশেষ মানুষের দেখা হওয়ার কথা।এসময় একটা উটকো ঝামেলা তার একদম ভালো
লাগছেনা।সে ভদ্রতা বজায় রেখে বললো, “ভাইয়া আমার একটু কাজ আছে।আমি যাই।পরে দেখা হবে”। ফয়সাল চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। অহনার পাশে বসে সে বললো, “পাচ মিনিট সময় দিন।আপনার সাথে একটু কথা আছে”। অহনা অত্যন্ত বিরক্ত হলো, এমন পাচ মিনিট সময় তার কাছে অনেকে চেয়েছে এবং পরে তাকে নিজেদের
অসীম ভালোবাসার গল্প ব্যাখ্যা করেছে।অহনার কোন সমস্যা ছিলোনা যদিনা সেটা পাচ
মিনিটের জায়গায় ৫০ মিনিট, কখনোবা ৩-৪ ঘন্টাও হয়ে যেত।কন্ঠে
অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে সে ফয়সালকে বললো, “আমার তাড়া আছে।একটু তাড়াতাড়ি বলুন”। ফয়সাল হাসিমুখেই বললো, “আপনার কাজিন ইমতি আজকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।সে চাচ্ছিলো যেন আমি
আপনাকে নিয়ে কাজী অফিসে যাই।আপনাকে আমি পিক করতে এসেছিলাম, এত বিরক্ত হবেন জানলে আসতাম না।আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি আপনার
প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে প্রস্তাব দিতে আসছি”। অহনা একটা বিষম ধাক্কা খেলো ওর কাজিনের বিয়ের কথা শুনে। এটা সে
একেবারে আশা করেনাই। তার কাজিন হলো ফার্মের মুরগী টাইপ ছেলে।তার একটাই কাজ, বিশাল বড় একটা চশমা পড়ে মোটামোটা বই পড়া আর একটু পরপর বলা, “আম্মু ক্ষিদা লাগছে।কিছু খাইতে দাওনা কেন”? সে ফয়সালকে বললো, “মেয়েটা কে”? ফয়সাল বললো, “আমাদের এক
ক্লাসমেট।আজকে সকালে মেয়ে এসে ইমতিকে বললো যে সে ইমতিকে ভালোবাসে।যদি ইমতিও তাকে
পছন্দ করে এখনি যেন তাকে বিয়ে করে।আর ইমতিও মেয়েটাকে বহুদিন ধরে ত্যাক্ত করছিলো
প্রস্তাব দিতে দিতে।মেয়ে আজকে ওকে শিক্ষা দিতে এমন করলো বলতে পারেন।ইয়েস, বাট টু সে দ্যা ট্রুথ, মেয়ে ওকে আসলেও ভালোবাসে।কিন্তু ও একটু মোটকা তো তাই সময়
নিচ্ছিলো”। অহনা মেজাজ খারাপ করে বললো, “কাজী অফিস চলেন।আজকে ওর ছাল চামড়া আমি তুলবো”। অহনা ইমতির বিয়েতে শেষ পর্যন্ত সাক্ষী হয়েছিলো এবং বিয়ের পর
কাদতে কাদতে বলেছিলো, “ভাইয়া তুই সুখে থাকিস।এই নে পাচশো
টাকা।ভাবীকে আইসক্রীম খাওয়াইস"। ইমতি রাগ করে বলেছিলো, “যা বেটি ফকিরা”। ফয়সাল তার কিছুদিন পর বিয়ের
প্রস্তাব পাঠায়।অহনা সেদিনই তার সাথে দূরালাপনে বলেছিলো, “আপনি কাজটা ঠিক করেননি”। অহনা কেন এমন বলেছিলো এবার সে গল্পে আসা যাক। অহনাদের থেকে এক
ব্যাচ আগের একটা ছেলের জন্য অহনা সব ভালোবাসা জমা করে রেখেছিলো এবং অদ্ভুত হলেও
সত্য সেটা ওই ছেলেটাও হয়তো জানতোনা।অহনা কেন যেন ছেলেটাকে বলতে পারেনি। অহনা ঠিক
করেছে ছেলেটাকে কখনোও সে বলবেনা তার ভালবাসার কথা, তার সব লুকিয়ে রাখা চাওয়া পাওয়ার অনুভূতিগুলো।কেন বলবে সে?কি করে বলবে সে?এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় রাতেই সে
দুঃস্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্নে দেখতে পায় তার সাথে আরেকটি ছেলের বিয়ে হয়ে
যাচ্ছে।তার হাতে একটি বিষ খাওয়ার শিশি।ঘুম ভাঙ্গলে সে ভয়ঙ্কর রেগে যায় নিজের
উপর। এমন বাংলা সিনেমা টাইপ জিনিসপত্র কেন সে স্বপ্নে দেখে সে নিজেও জানেনা। অহনা
কেন ছেলেটাকে অনেক চেয়েছিলো তা কি সে জানে? মজার ব্যাপার হলো এটাও সে জানেনা।তার সাথে অর্কর প্রথম দেখা মধুর
ক্যান্টিনের পাশে যে আকাবাকা গলিটা মেইন রোডের দিকে বেরিয়ে যায় ঠিক সেখানে।তার
সাথে ছিলো তখন তার ক্লাসমেট ইলা।ইলা আর অর্কর মধ্যে পরিচয় ছিলো কারণ তারা দুজনই
ছবি আকতো।অনেক জায়গয়ায় তাদের দেখা সাক্ষাত হয়েছিলো।ইলার ছবি আকার জগতে অর্কর
একটা বিশাল ভূমিকা ছিল। জলরঙ্গে কিভাবে জীবনকে মেটাফোরিক সামেশনে দেখা যায় এটা
অর্কর থেকে বেশি কে জানে! ইলা সেটা শিখার অনেক চেষ্টা করেছে অর্কর থেকে।কিন্তু ওটা
সবাই পারেনা যে।ইলাও পারেনি এবং অনেক সময় গভীর রাতে অহনাকে সে ফোন করে বলে, “অর্ককে বুঝায় বল আমার সাথে প্রেম করতে।আমি ওর সাথে সারাদিবস ছবি
আকা শিখবো”। যেদিন অহনা প্রথম অর্ক এর বাসায়
গিয়েছিল, তখন তারা অনেক গল্প করেছিলো।হাসিনা
আপা ও খালেদা দাদুকে নিয়ে।দুজনেই মনের সুখে এই দুই মহিয়সী নারীর গুষ্টি উদ্ধার
করেছিলো।অর্ক এত সুন্দর করে গালি দিচ্ছিলো, অহনা তাৎক্ষণিক তার প্রেমে পড়ে যায়। অর্কের প্রিয় উক্তি ছিলো, “এই জীবনে প্রেম করিনাই কোন নারীর সাথে তার কারণ একটাই, এই দুই দেশনেত্রী/জননেত্রী।মেয়েদের দেখলেই ভয় লাগে যে এদের মাঝেই
এই মহান নারীরা লুকিয়ে আছে নাকি আবার”! এগুলো ও জোকস করে বলতো।অহনাকে সে প্রায় সময় বলতো, “আমি তোমার সাথে প্রেম করতে চাই”। অহনা বলতো, “কোন এক
বৃষ্টিস্নাত জোসনা রাতে হাতে একগুচ্ছ কদম ফুল নিয়ে যেদিন বলতে পারবেন সেদিন শুধু
আমার থেকে কিছু উত্তর পাবেন”। অহনা অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করেছে
সেই জোসনা রাতের জন্য। কিন্তু কখনো তা আসেনি।কারণ তখন অর্ক ছবি আকে, শুধুই ছবি আকে তার তুলিতে জীবনের রঙ মিশিয়ে।তার কি কখনও সময় হবে
এটুকু ভাবার যে তার জন্য অহনার মত একটা সাধারণ মেয়ে পড়ার টেবিলের ছোট্ট
বিড়ালমুর্তির ঘড়িটা নিয়ে বসে বসে খেলা করে একজোড়া অশ্রুভেজা নয়ন নিয়ে? অহনা একদিন অনেক অনেক রাগ করে অর্ককে ফোন করেছিলো, “আপনি কিছু বুঝেন না কেন”? অর্ক অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলো, “কি বুঝতে চাইবো? আমার কি কিছু
বোঝার আছে তোমার থেকে”? অহনা কিছু বলেনাই।ফোনটা রেখে
দিয়েছিলো।এটা দুমাস আগের ঘটনা, এরপর অর্কর সাথে
তার আর কখনো কথা হয়নি।অহনা অভিমান করেছিলো এবং এজন্য সে কাদতো কারণ তার মনে হতো
যার জন্য অভিমান করেছে সে, সেই তো জানেনা কেন এত অভিমান। কেন
তাকে এবং তার অনুভূতিকে এমন অপমান করলো ছেলেটা? অহনাকে বিয়ের জন্য তৈরী করা হচ্ছে।তাকে হালকা নীল, মাঝে কালো আর লালের সূক্ষ হাতে করা কাজের আল্পনাময় শাড়ি পড়ানো
হচ্ছে।তার ভয়ংকর গম্ভীর মুখ দেখে সবাই একটু বিমর্ষ।কেউ জিজ্ঞেস করার সাহস
পাচ্ছেনা, আজ অহনার বিয়ে অথচ সে কেন এতো মলিন
হয়ে আছে।পাঠক আপনারা খেয়াল করবেন, মেয়েদের বিয়ের দিনে তাদের বিয়ের সাজে না সাজালেও বলে দেয়া যায়
সেইই আজকের বিশেষ নারীটি।যাদের মধ্যে এই ব্যাপারটি নাই, তাদের জন্য বুঝতে হবে তাহারা এই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়।অহনার
চোখে এমন এক ভয়ংকর শূণ্যতা লুকিয়ে ছিলো যা সবার মনে কাটা বিধিয়েছিলো। অবশেষে
তার ছোট বোন ইনা তাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপু তুই কি বিষ খাবি”? অহনা কিছুই বলেনি।তার দুচোখ বেয়ে শুধু অম্লজল ঝরে পড়েছিলো বোধ
করি। মধ্যবিত্ত ঘরের এক অতি সাধারণ মেয়ের ভালোবাসার মূল্য কি আমরা জানি?তার গভীরতা পরিমাপ করার যন্ত্র কি আবিষ্কৃত হয়েছে?বোধ করি না।তারা সর্বদাই অবহেলিত, তাদের ভালোবাসাগুলো প্রায়ই মুখ থুবড়ে পড়ে।প্রায় সময় তা কেউ
ছুয়ে দেখেনা, যারা ছুয়ে যেতে যায় তাদের অনেকেই
হারিয়ে যায় নয়তো ধোকা দিয়ে যায়।প্রিয় অহনা, আপনার ভালোবাসার মূল্য আপনি বুঝে পাননাই এইজন্য লেখক নিজেও দুঃখিত।
সাতবছর পর কোন এক কাকডাকা ভোরে অহনা ঢুলুঢুলু চোখে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায়, আকাশটা অনেক অভিমান করে আছে।অহনা আলতো পায়ে চুপি চুপি হেটে
জানালার পাশে যখন দাড়ালো, তখন তাকে ভড়কে দিয়ে একটা ছোট
বর্জ্যপাত হলো।অহনা প্যারিসের প্লাযা এথিনি হোটেলের এক চমৎকার স্যুটে বৃষ্টির
প্রতীক্ষায় গভীর আগ্রহ নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকলো।ফয়সাল তখন তার সাথে নেই, ব্যবসায়িক কাজে সকালবেলাতেই সে বের হয়ে গেছে।অহনা কিছুক্ষণ চুপ
করে কি যেন ভাবলো, তারপর পোশাক বদলিয়ে তড়িঘড়ি করে
হোটেল থেকে বের হয়ে আসলো বৃষ্টি দেখার জন্য।মন্টেইন এর প্রশস্ত গলি দিয়ে সে গুটি
গুটি পায়ে হাটতে হাটতে একটা চমৎকার ক্যাফেটেরিয়া পেয়ে গেলে সেখানে এক কাপ
কাপুচ্চিনো পানের প্রবল আকুতি হলো তার। ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে ঢুকে সে মুগ্ধ হয়ে
গেলো।ফ্রান্সের জাকালো হোটেল আর রেস্টুরেন্টের ফাকে এত চমৎকার একটা ছিমছাপ কফি খাবার
জায়গা থাকতে পারে সে ভাবেনি।কত রকমের বাহারী বোতল আর তাতে ভরা আদিম সুধা তাকে আরো
মুগ্ধ করলো।ভেতরে ঢুকে সে ছোট্ট এক কোণে বসে পড়লো। একটু পর যখন তার সামনে কফি
আসলো সে খেয়াল করলো কফি নিয়ে আসা ছেলেটা অর্ক।অর্ক মুচকি মুচকি হেসে বললো, “সখি যাতনা কাহারে বলে গানটি কি শুনেছো মেয়ে”? অহনা মাথা নাড়লো।এর অর্থ দুরকমই হতে পারে। অর্ক কোন এক অর্থ ধরে
নিয়ে বললো, “আমার এক্সিবিশনে আমি সারাদিন এই
গানটাই বাজাচ্ছি।বোকা ফ্রেঞ্চরা গানের কথা কিছুই তো বুঝেনা, শুধু আমাকে এসে বলে অদ্ভুত আদিম সংগীত।আফসোস তারা আমাদের মহাকবিকে
চিনতে পারেনি।আমি মনে করি এদের জীবন শুধু এই একটি কারণে অর্ধেকটাই বৃথা”। অহনা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেমন আছো?কেন আমার সাথে এখন দেখা করলে”? অর্ক হাসছে, শুধু হেসেই যাচ্ছে। হাসি থামিয়ে
অনেক কষ্টে বললো, “তোমাকে রাজকুমারীদের মত লাগছে।তুমি
আগে এত সুন্দর ছিলেনা।এইজন্য চাইলেও আগে বলতে পারিনি, তোমাকে আমি কতটা চাই।আচ্ছা বলবে কি, তুমি এভাবে হারিয়ে গেলে কেন হঠাৎ করে?আমি তো শুধু বুঝতে চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে কতটুকু বুঝেছো”? অহনা অত্যন্ত বিরক্ত হলো, “তুমি এতদিন পর এইসব বলছো কেন?আমি তোমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই।ভালো থাকো”। এই ঘটনার পর তারা প্রতিটি সুন্দর ভোরে এক সাথে চা পান করতো।
তাদের গল্পের বিষয় ছিলো দেশ, দেশের মানুষ, দেশের সংস্কৃতি এবং সবকিছু ছাপিয়ে ভালোবাসা।অহনা গত তিন বছরে
একবারের জন্যও যেই মানুষটাকে ভুলতে পারেনি, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যাকে একবার করে ভালোবেসেছে, যেই মানুষটা তার অনুভূতিগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো তার প্রতিটি
আবেগী অনুভূতির অদবদলের অপর প্রান্তে থেকে।আজ তাকে আবার সে নতুন ভাবে আবিষ্কার
করলো। ক্যাফে মন্টেইনের ছোট্ট ওই কোণায় তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে
কত আবেগ, কত অনুভূতির খেলা করতো তা পাঠককে
জানানোর ভাষা আমার ক্ষমতায় নেই। সন্ধ্যার দিকে ফয়সাল যখন তাদের স্যুটে আসলো, অহনার তখন প্রচন্ড মন ভালো।আজকে অর্ক তাকে স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে
একটা গান শুনিয়েছে। সে তখনো ওই একটাই গান গেয়ে চলছে।কিন্তু ফয়সালকে দেখে হঠাৎ
করে সব সুর যেন কেটে পড়লো।গান থামিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু খেয়ে এসেছো”? ফয়সাল মাথা
নাড়লো, তার হাত থেকে একটা ছোট্ট পুতুল
উকিঝুকি মারছে।ওটা অহনার জন্য।ফয়সাল অহনার পাশে বসে ওর হাতে পুতুলটা দিয়ে বললো, “এটা ষোড়শ শতকে বানানো।ইউরোপের দিকে ওই সময় কিছু প্রাচীন সাধু বাস
করতো যারা নিজেরাই নিজেদের পূজা করতো। তারা বলতো, সৃষ্টিকর্তা তাদের অন্তরে বাস করেন।এই মূর্তিটা তাদেরই বানানো।আমি
তোমার জন্য আনলাম।তোমার এন্টিক জিনিস ভালো লাগে তো”? অহনা মাথা নেড়ে বললো, “না ভালো লাগেনা”। অহনার কথায় হয়তো একটু রাগ ছিলো
যেন যা শুনে ফয়সাল ঘাবড়ে গেলো কিছুটা।আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কখনও আমি কিছু দিলে পছন্দ করোনা।এর কারণ কি আমি তোমার অপছন্দ?অথবা আমার পছন্দগুলো খুব খারাপ”? অহনা ফয়সালের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমি তোমাকে সবসময় বলে এসেছি আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবোনা।আমি
অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি তোমার সাথে থেকে শুধু শুধু আমি দুজনের জীবন নষ্ট করতে
পারবোনা।আমি মনে করি, আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।অনেক
হয়েছে তাই না”? ফয়সাল অহনার মাথায় হাত দিয়ে কি
যেন বলতে চেয়েও বললোনা। নিশ্চুপ থেকে চলে গেলো। অহনার মেজাজটা অত্যন্ত খারাপ
হলো।ফয়সাল নামের এই মানুষটা তার সাথে কখনো ঝগড়া করেনাই। অহনা জানে ফয়সাল তাকে
অনেক ভালোবাসে, যতটা সে বাসে অর্ককে।আজকে অহনা
এভাবে ফয়সালের ভালোবাসাকে অপমান করলো, ফয়সাল একটুও রাগলো না কেন?অহনার খুব ঝগড়া করার ইচ্ছা ছিল।তবে সে মনে হয় কিছুটা সুখীও
হলো।সে আবার অর্ককে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবে, আবার ভালোবাসতে শিখবে।দুনিয়া কি ভাবলো না ভাবলো তাতে তার কি? ফয়সালের থেকে যেদিন বিদায় নেওয়ার সময় হলো, অহনা তখন দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ফয়সালের কাছে এসে বললো, “আমি স্যরি।আমি তোমার কাছে হাজার বছর কৃতজ্ঞ থাকবো ফয়সাল।তুমি এই
যে আমাকে মুক্তি দিলে, আমার ভালোবাসার কাছে যেতে দিলে
এতোটা ত্যাগ স্বীকার কেউ করেনা।তুমি অনেক ভালো মানুষ।থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস”। ফয়সাল তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে,মাঝে মাঝে বৃষ্টির ঝাপটা তার সাথে লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে।অহনার কথা
শুনে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “অহনা তুমি কি জানো আমি আর তুমি কেন
ফ্রান্সে এসেছি”? অহনা কৌতুহলী হয়ে ফয়সালের দিকে
তাকিয়ে বললো, “একথা কেন জিজ্ঞেস করছো এখন এই সময়”? ফয়সাল অহনার খুব কাছে দাঁড়িয়ে বললো, “আমাদের বিয়ের পর তুমি একদিন অর্কর সাথে দেখা করার জন্য বাসা থেকে
কিছু না বলে চলে গিয়েছিলে।আমি তোমার পিছে পিছে গিয়েছিলাম।তুমি ওর সাথে টি.এস.সির
গোল চত্ত্বরে বসে ছিলে।আমার অনেক রাগ হয়েছিলো, আমি তোমার কাছে দৌড়িয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম, আমাকে ভালোবাসা কি খুব কষ্টকর ছিলো? তুমি আমার উপর প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে অর্কর হাত ধরে রাস্তা
পার হয়ে যাচ্ছিলে মনে আছে”? অহনা ফয়সালের কথা শুনে জ্ঞান
হারিয়ে পড়ে গেলো, মূর্ছা যাওয়ার আগে তার শুধু মনে
পড়লো একটি রক্তাক্ত মুখের কথা, অনেকগুলো মানুষ
আর তার চিৎকার করার কথা।ওই রক্তাক্ত মুখটা তার সারা জীবনের ভালোবাসার মুখটির, তার সবগুলো অনুভূতির ছন্দবদ্ধ প্রকাশ ওই মুখে লুকিয়ে আছে। শেষবার
সে মুখটি ছুয়ে দিয়েছিলো তার সব ভালোবাসা দিয়ে।ভয়ংকর চিৎকার করেছিলো যখন সে
বুঝতে পারলো তার ভালোবাসার মানুষটি হারিয়ে গেছে চিরতরে, আর কখনো তার আকা ছবিগুলোর দিকে চেয়ে তার সুন্দর হাতটি ছুয়ে দিতে
পারবেনা। ফয়সালের সাথে বিয়ের পর সে হঠাৎ একদিন অর্কর দেখা পায় তাদের বাড়ির
সামনে।অর্ক সেদিন তার হাত ধরে বলেছিলো, “অহনা আমার সকল ছবিতে যে জিনিসটি আমি খুজে পাইনা তা তোমার মধ্যে
বারবার দেখি জানো।তুমি এভাবে হঠাৎ করে বিয়ে করলে কেন?আমি তোমার জন্য কত স্বপ্ন দেখেছি তুমি জানোনা”। অহনার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মধ্যরাত্রি।চারদিকে বিখ্যাত
ইউরোপিয়ান নিস্তব্ধতা আর শুধুই একটি কোণায় ফয়সাল অহনার মাথায় হাত দিয়ে বসে
আছে। অহনা উঠে বসলো, তার পুরো মাথা কেমন যেন আবদ্ধ হয়ে
আছে। ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললো, “কতবছর ধরে এমন
চলছে”? ফয়সাল অহনার থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে
বললো, “যখন থেকে ওই এক্সিডেন্টটি হলো।তুমি
কখনো মেনে নিতে পারোনি।আমি তোমাকে নিয়ে অনেক অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেক সাইকোলজিস্ট, নিউরোলজিস্টের
কাছে গিয়েছি।কেউ আমাকে হয়তো ভরসা দিয়েছে, কেউ আমাকে সোজাসুজি বলে দিয়েছে তুমি আর সুস্থ হবেনা।প্রতি বছর দু
তিনবার এমন হয়।তুমি সব ভুলে যাও।আমি তোমাকে সব মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি”। অহনা প্রচন্ড রেগে গেলো কেন যেন হঠাৎ।ফয়সালের দিকে আগুনচোখে
তাকিয়ে বললো, “কেন আমাকে বারবার মনে করিয়ে দাও।
আমি অর্ককে কল্পনায় দেখি তাও তোমার ভালো লাগেনা”? ফয়সাল মৃদু কন্ঠে অহনার পাশে বসে বললো, “তুমি অর্ককে দেখতে পাও যা শুধুই কল্পনা।তুমি যে অবাস্তব জগতে বাস
করছো তা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়।আমি তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছি ওইদিনের মত আবার
দেখতে চাই।কোন সমস্যা নাই, তুমি আমাকে ভালোবাসো অথবা না
বাসো।আমি শুধু তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই”। অহনা মাথায় হাত দিলো যন্ত্রণায়। ফয়সালকে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি সবসময় এভাবেই আবার সব কিছু মনে করতে পারি?আবার কি আমি ভুলে যাই সব?আবার কি তুমি এভাবেই আমার পাশে বসে এমন করে বুঝাও”? ফয়সাল মাথা নাড়লো।সাথে বললো, “আমি নিশ্চিত জানি একদিন তুমি আবার সুস্থ হয়ে যাবে”। অহনা অসহায়ভাবে ফয়সালের দিকে তাকালো।তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কখন আবার সব ভুলে যাবো”? ফয়সাল বললো, “হয়তো কালকেই।
হয়তো আবার কাল সকালে আমার তোমার পিছু পিছু যেতে হবে তোমার প্রিয় ক্যাফেতে”। অহনা না চাইলেও কেন যেন জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেন এতটা বছর ধরে আমার পাশে ছিলে”? ফয়সাল মাথা নিচু করে বসে থাকলো।এই কথাটা অহনা তাকে কখনোও জিজ্ঞেস
করেনি।ফয়সাল নিজেকে গুছিয়ে বললো, “অহনা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসিতো, তাই আমার কিচ্ছু আর করার নাই, বিশ্বাস করো।আমি পারলে তোমার সাথে অর্কর আবার দেখা করিয়ে
দিতাম।তুমি তাকে ভালোবাসবে, তুমি অনেক অনেক সুখী হবে এর থেকে
বেশি কিছুই চাইনা।আর একটা উদ্দেশ্যও আছে। বলবো”? অহনা ফয়সালের পাশে বসে তার হাত ধরে বললো, “কি”? ফয়সালের চশমা বারবার ভিজে যাচ্ছে
অনেক অনেক আবেগে।সে তবুও বললো, “প্রতিবার যখন
তুমি আবার সত্যিকারের জগতে ফিরে আসো, আমি বারবার ভাবি তুমি হয়তো একটাবারের জন্য অর্ককে ভুলে যাবে।আমার
কথা একবার ভাববে।একটাবারের জন্য আমার তোমার জন্য যে ভালোবাসা ওটা চোখে পড়বে।কখনো
এমন হয়নি, কখনো না।আমি তবুও আরো ১০০ বছর
অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।তুমি বুঝবে আমার ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য।অহনা, আমি হাল ছাড়বোনা”। অহনা ফয়সালকে শক্ত করে ধরে
রাখে।তার কানে কানে বলে, “কাল আমি হয়তো সব ভুলে যাবো। কিন্তু
একটা জিনিস কখনো ভুলবোনা।যদি মরে যাই তবুও না।যে ভালোবাসায় তুমি আমাকে আগলিয়ে
রাখছো সেটা আমার হৃদয়ে তুমি এমন ভাবে গেথে দিয়েছো সেটা আমার মত একটা মেয়ের
সাধ্য কি ভুলার বলো? আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা তা তো
জানিনা, কিন্তু তোমার মত একজনের জন্য আমার
হাজারটা জীবনের ভালোবাসাও কম পড়ে জানো।আমি এখন শুধু একটা জিনিসই চাই।সব ভুলে
গেলেও তোমাকে আর ভুলতে চাইনা।আমার মনে পড়ে প্রতিবার তুমি এভাবে আমার পাশে বসে বলো, আমি সুস্থ হয়ে যাবো।প্রতিবার আমি তোমাকে একটু একটু করে
ভালোবেসেছি।যেই ভালোবাসায় তুমি আমার জন্য প্রার্থনা করো, সেই ভালোবাসার কিছুটা আমি তোমাকে যদি দিতে পারতাম আর কিছু চাইতাম
না”। ফয়সাল প্রচন্ড কাদছে অহনার হাত ধরে।বাহিরে ঝমঝম বৃষ্টি তার
কান্নার শব্দকে মুছে দিতে পারলোনা।ফয়সাল জানেনা পরেরদিন সকালে অহনা সব ভুলে যাবে
কিনা, ফয়সাল জানেনা এই ভালোবাসার
অনুভূতিটুকু অহনার মাঝে আর থাকবে কিনা?ফয়সাল শুধু জানে আজকে এতগুলো বছর পরে তার ভালোবাসার শব্দগুলো
অহনার হৃদয়কে ছুয়ে দিয়েছে।হয়তো কাল সব অহনা ভুলে যাবে, হয়তো তার অনুভূতির সব সুরগুলো কালকে আর অহনার হৃদয়ে বাজবেনা।তবুও
সে আজীবন অহনাকে তার ভালোবাসার কথা বলে যাবে। হয়তো একদিন কোন এক মহাকালে, অহনা শুধুই তাকে ভালোবাসবে, তারা তাদের নতুন ভালোবাসার নীড় গাথবে পবিত্র অনুভূতির
মায়াজালে।ফয়সাল সেদিনের অপেক্ষায়, লেখক নিজেও কথা রাখলাম।.
সাদ আহম্মেদ