Bangla Golpo: মিহিন এবং শিউলি ফুল ২

 
আমি যখন মিহিনদের বাসার কাছে

Bangla Golpo: মিহিন এবং শিউলি ফুল


দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

আমি যখন মিহিনদের বাসার কাছে পৌঁছালাম তখন ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। ভোরের পাখি কাকের হাঁক আমি স্পষ্ট শুনি৷ 


মিহিনদের বাসার পেছনে জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। সেখানে একটি শিউলি গাছ আছে। শিউলি গাছটার ঠিক নিচে একটা বেঞ্চি আছে। সাদা রঙের বেঞ্চি। আমি কখনই এই জায়গাটা দেখিনি৷ সেটা সুন্দর বলেছি কারণ জায়গাটা 'ভীষণ সুন্দর' এমনটা মিহিন বলেছে। ছবি পাঠিয়েছে। তাতে আমি তেষ্ট ছিলাম। কিন্তু আজ জায়গাটা কাছ থেকে দেখে আমার মনে হলো এতোদিন কেন এখানে আসিনি। কেন এই বেঞ্চিটাতে কিছু সময় বসিনি৷ কী সুন্দর মায়াময় একটি জায়গা। 

গাছে নবফুটন্ত শিউলি। সেই শিউলি ঝরে পড়ে কুয়াশায় ভেজা সবুজ ঘাসের গায়ে৷ কিছু ফুল বেঞ্চিটা স্পর্শ করে পড়ে যায়৷ কিছু ফুল বেঞ্চিতে একরাস মুগ্ধতা নিয়ে বসে থাকে৷ আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শিউলি গাছ দেখি৷ শিউলির ঝরা দেখি। সদ্য ফুটন্ত ভোরে ঝরে যাওয়া শিউলি কী অনিন্দ্য এক সৌন্দর্যতা সৃষ্টি করেছে তা বলার মতো না। 

আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি৷ ভোরে কুয়াশায় এই শিউলি আমাকে অদ্ভুত আনন্দ দেয়৷ আমার মন ভালো হয়৷ আমি বুঝতে পারি, মিহিনের মন খারাপ থাকলে সে কেন এখানে এসে বসে থাকে৷ কীভাবে এই জায়গাটা মেয়েটির মন প্রশান্তি জাগায়। 

আমি জানি মিহিনের মন খারাপ। তার মন খারাপ থাকলে সে শিউলি তলায় আসে৷ এই বেঞ্চিটায় বসে থাকে৷ আমার ধারণা সে আজও আসবে৷ আসতে বাধ্য৷ 

আমি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করি৷ এমন সময়, হঠাৎই আমি অনুভব করি, আমার বুকের ভেতর কাঁপছে৷ ধপ ধপ শব্দের মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে। মিহিনের সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে ঠিক এমনটা হয়৷ কেন হয় কে জানে! 

আমি ভালো করে সামনের দিকে তাকাই৷ কুয়াশায় তেমন কিছু দেখা যায় না৷ ঘোলাটে ঘোলাটে লাগে৷ আমি ভালো করে দেখি৷ দূরে কার যেন অবয়ব দেখা যায়৷ সাদা সেলোয়ার-কামিজ পরা কেউ একজন ধীর পাঁয়ে এগিয়ে আসে৷ আমার বুকের ভেতর কাঁপন বাড়ে ভীষণ৷ মেয়েটি আরেকটু কাছে আসে৷ ক্রমশ সে স্পষ্ট হয়৷ সাদা জামা পরিহিতা মেয়েটির গলার কাছে ওরেঞ্জ কালারের ওড়না দেখি আমি। যেন জীবন্ত শিউলি ফুল। চোখে যার গাঢ় কাজল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। খালি পাঁয়ে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে মেয়েটা এগিয়ে আসছে। যেন জগতের সকল সৌন্দর্যতাকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসছে সে। তার ফর্সা পা'টি কী কোমল ভাবে ঘাস মাড়িয়ে আসছে৷ ঘাসেরাও যেন ধন্য বোধ করে। 

আচ্ছা, মেয়েটি কি জানতো আজ আমি আসবো? জানতো? না জানলে সে এতো সাজবে কেন? কেন চোখে কাজল কিংবা ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে আসবে? আমার অবাক হওয়ার সীমা থাকে না৷ 

মিহিন বেঞ্চিতে এসে বসে। কিছু শিউলি কুড়িয়ে হাতে নেয়৷ কপালের কাছের অবাধ্য চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়। কানের পাশে সে একটা শিউলি রাখে। পৃথিবীর সকল মায়া একত্র করে সেই ছোট্ট শিউলিটি মিহিনের কানের পাশে বসে থাকে। তাকে অদ্ভুত মায়াবী লাগে। আমার মনে হয় কুয়াশাচ্ছন্ন এই ভোরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমনী একটি সাদা বেঞ্চ আলোকিত করে বসে আছে৷ এই দৃশ্য কতোটা অসাধারণ সেটা কেউ সামনাসামনি না দেখলে বুঝবে না৷ 

হঠাৎ এক ঝাক হিমশীতল বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়৷ সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক শিতল শিহরণ বিরাজ করে৷ আমি ভালো করে মিহিনকে দেখি। তার চেহারায় কিছু একটা নেই৷ কিছু একটাকে আমি ভীষণ মিস করি৷ তার চেহারা ফ্যাকাসে। চোখ ভর্তি কেমন বেদনা। সে যেন পৃথিবীর সেরা দুঃখি প্রেমিকা। 

আমি ধীর পাঁয়ে এগিয়ে যাই। আমার হার্টবিট তখন বেশ বেড়ে যায়৷ কেমন যেন লাগতে থাকে আমার৷ আমি এগিয়ে যাই৷ হঠাৎ মিহিন লক্ষ্য করে আমায়৷ আমি ভাবলাম আমায় দেখে সে প্রসন্ন বোধ করবে৷ অথচ সে চেহারা কালো করে ভ্রু কুচকে তাকায়। আমি হঠাৎ থমকে যাই। এই মিহিনকে যেন আমি একদমই চিনি না৷ ভীষণ অচেনা লাগে। সে ভ্রু কুচকে বলে,
'তুমি? তুমি এখানে কী করছো?'
আমি আরেকটু এগিয়ে যাই৷ বলি,
'মিহিন, তোমার সাথে কথা আছে আমার।'
'তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ ভালো হয় তুমি এখান থেকে চলে যাও।'
'প্লীজ মিহিন৷ এমনটা বলো না৷ এতোটা পথ হেঁটে এসেছি, অন্তত এমন কোনো কথা শুনতে নয়।'
'তাহলে কেমন কথা তুমি শুনতে চাও বলো? কীভাবে বললে তুমি এখান থেকে চলে যাবে?'
'প্লীজ! ডোন্ট হার্ট মি মোর।' 
'হার্ট! হার্টের কি বোঝো তুমি?'
'মিহিন, আমাকে অন্তত কিছুটা সময় দাও প্লীজ৷ আমি তোমাকে সবটা বলবো।'
'সবটা বলা লাগবে না৷ তুমি চলে যাও এখান থেকে৷ দ্রুত চলে যাও। তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে।'
'অসহ্য লাগুক, আর যা-ই লাগুক, আমি তোমাকে বলেই যাবো।'
'দেখো, সিনক্রিয়েট করো না৷ আমাকে একা থাকতে দাও।'
'একা থাকতে দিলে তুমি ভালো থাকবে?'
'অবশ্যই থাকবো। অন্তত আঘাত দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না।'
'আমি তোমাকে আঘাত দেইনি মিহিন।'
'যেটা করেছো সেটা আসলেই আঘাত ছিল না৷ তুমি আমায় আঘাত করোনি। স্পষ্ট খুন করেছো।'
আমি তার দিকে এগিয়ে যাই। বলি,
'আমি তোমাকে ভালো রাখতে চেয়েছি।'
'তার নমুনা আমি বেশ পেয়েছি।'
'বোঝার চেষ্টা করো মিহিন। চিত্রার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।'
'ওই কু**বাচ্চার নাম নিবি না তুই।'
মিহিন চেহারা লাল করে আমার দিকে তাকায়৷ হঠাৎ তার এমন রেগে যাওয়ায় আতঙ্কিত হই আমি৷ আমি বেঞ্চিতে বসি৷ সে দ্রুত বলে,
'উঠ! উঠে যা এখান থেকে। তা না হলে চিল্লাবো আমি।'
আমি সেখানে বসে থাকি৷ মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। তার চেহারা কেমন লালচে হয়ে উঠে। হঠাৎ তাকে কেমন মায়াবী লাগে আমার কাছে৷ ওই মূহুর্তে আমি যেন দ্বিতীয়বার আমার রাজকন্যার মায়ায় পড়ি। প্রেমে পড়ি। আমি বলি,
'মিহিন, শান্ত হও। আমি চলে যাবো।' 
'বেশ তো! যাও। দ্রুত যাও।'
'পাঁচ মিনিট৷ জাস্ট পাঁচ মিনিট দাঁতে দাঁত চেপে আমার কথা গুলো শোনো। পাঁচ মিনিটের পর এক সেকেন্ডের জন্যে তুমি আমাকে এখানে পাবা না৷ কথা দিলাম।'
মিহিন হঠাৎ শান্ত হয়৷ আমার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে বসে। বলে,
'বলো।'
আমি মৃদু হাসি৷ হঠাৎই আমার মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়৷ ওই মূহুর্ত, মিহিনের ওই রাগান্বিত চেহারা আমায় কেমন আনন্দিত করে। আমি বলি,
'তোমাকে এই অবস্থায় অসাধারণ লাগছে মিহিন। অসাধারণ লাগছে।'
মিহিন ভ্রু কুচকে কিছু বলতে চায়। আমি তাকে থামিয়ে বলি,
'তোমাকে কিছু বলতে হবে না৷ আমি জানি আমার সময় পাঁচ মিনিট। এই সময়টা কেবল আমার। তাই আমি যা বলবো তুমি তা'ই শুনবে৷'
মিহিন চুপচাপ থাকে। আমি আবারও বলি,
'পাঁচ মিনিট অনেক সময়৷ ৩০০ সেকেন্ড। ৩০০ সেকেন্ডে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।'
মিহিন কেমন জানি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়৷ তার দৃষ্টি কেমন শূন্য শূন্য লাগে।আমি বলি,
'তুমি জানতে আমি আসবো৷ অবশ্যই জানতে। সে জন্যেই তুমি এমন সেজেছো। সাদ-ওরেঞ্জ মিলিয়ে তুমি জীবন্ত একটা শিউলি হয়ে এখানে এসেছো৷ তোমাকে আমি একবার একটা ভোরের গল্প বলেছিলাম। সেই গল্প ভোর থাকবে, ভোরের শিউলি থাকবে, শিউলির মতো করে তুমি সাজবে। আমি তোমাকে দেখে মুগ্ধ হবো। তুমি আমার চাওয়া পূর্ণ করেছো। সত্যিই মিহিন, তুমি আমায় ভালোবাসো না, আমাকে নিয়ে ভাবো না৷ তাও আমার জন্যে কতো করলে!'

মিহিন কেমন করে যেন তাকায়৷ তার দৃষ্টি সরল হয় ক্রমশ। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মৃদু হাসি। বলি,
'এই যে চমৎকার একটা ভোর উপহার দিলে, কুয়াশা, শিউলি, তুমি, হিমশীতল বাতাস এসব আমার জন্যে কম কিছু না৷ অনেক অনেক।' 
মিহিন একবার চোখ নামিয়ে নেয়৷ আবার মাথা তুলে তাকায়৷ আমি বলি,
'চিত্রা আমার কেউ না৷ সে অচেনা। আমার ভাবনার বাহিরে৷ মিহিন আমার কাছের, জানা কেউ। যার অবর্তমান আমাকে ভীষণ ভোগায়। যে আমাকে খুব বোঝে৷ জানে। ভালোবাসে৷ অথচ আমি যেই মিহিনটাকে জানি, তুমি সেই মিহিন নও। তুমি অন্য রকম মিহিন। তোমাকে আমার চাই না। পাঁচ মিনিট ঘনিয়ে এসেছে। মিহিন, আমি চাই তুমি বাকি সময়টা চোখ বন্ধ করে রাখো৷ এতোক্ষন আমি যা বলেছি তা একটু ভাবো। অবশ্য সেটা করা না করা একান্তই তোমার ব্যাপার।'

আমি চুপচাপ মিহিনের পাশে বসে থাকি। পাঁচ মিনিট শেষ হওয়ার অপেক্ষা করি৷ মিহিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তার চেহারা মলিন হয়ে আসে৷ চেহারার কাঠিন্যতা যেন কুয়াশায় মিলিয়ে যায়৷ সে চট করেই বলে উঠে,
'আমারও পাঁচ মিনিট চাই। আমি চাই আমি যা বলবো তুমি সবটা মন দিয়ে শুনবে। যা বলবো তুমি তা করবে৷'
আমি কিছু বলি না। মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকি কেবল। মিহিন বলে,
'শোনো, আমার একজন গুপ্তচর আছে। যে লেখক সাহেবের নানান তথ্য আমাকে দেয়৷ এটা খুবই অন্যায়৷ লেখকের জন্যে গুপ্তচর রাখাটা৷ তবে আগ থেকেই নিরাপদ থাকাটা বিশেষ প্রয়োজন৷ আমি আমার মানুষটাকে আগলে রাখতে চাই৷ সে জন্যেই এই গুপ্তচর রাখা।'
আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাই। কিছু বলি না৷ সে বলে,
'গুপ্তচর আমাকে মাঝে মাঝে খবর পাঠায়৷ লেখক কী করছে না করছে এসব৷ একদিন খবর আসে, লেখক একটা মেয়ের সাথে বেশ ঝগড়া করেছে৷ কিছু কঠিন কথা বলেছে৷ এমন তথ্য পেয়ে আমি হাসি। আমার লেখক ঝগড়া করতেও জানে!'
মিহিন মৃদু হাসে। বলে,
'যখন জানতে পারি চিত্রা মেয়েটি আমার মানুষটাকে প্রপোজ করেছে, তাকে বেশ জ্বলাচ্ছে, তখন আমি আসলেই রেগে যাই৷ এখানে যে কোনো মেয়ে-ই রেগে যাবে৷ সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক।'
'আমার খুব মন খারাপ হয়। লেখক আমাকে অন্তত চিত্রার ব্যাপারটা বলতো৷ আমি তাকে বোঝাতাম মিহিন কি জিনিস৷ অথচ সে আমাকে বলেনি। এতো বড় ব্যাপারটা আমার কাছে গোপন রেখেছে। আমার মন খারাপ হয়৷ কান্না পায়৷ আশ্চর্য! মানুষটা কীভাবে না বলে থাকতে পারলো?'
মিহিন থামে। তার চেহারা মলিন হয়ে আসে৷ আমি মনে মনে হাসি। বলি,
'পাঁচ মিনিট প্রায় শেষ!'
মিহিন হঠাৎ রেগে যায়৷ কঠিন দৃষ্টি আমার দিকে তাকায়৷ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
'এতো তাড়া কিসের তোমার হু? চিত্রার কাছে যাবা তাই না? পাঁ ভেঙ্গে ফেলবো একদম। পাঁচ মিনিট কেন? যদি তোমাকে আমি এখানে সারাজীবনও বসে থাকতে হয় তুমি এখানে থাকবে৷ থাকতেই হবে।'
আমি মৃদু হাসি। সে অবাক হয়,
'হাসছো কেন? হাসির কী বলেছি আমি?'
আমি কিছু বলি না চুপ থাকি। সে বলে, 
'চুপচাপ বসে থাকো। যা বলছি শোনো৷'
আমি তার কথা শুনি,
'আমার গুপ্তচরের কাজ কর্ম এতো দ্রুত নয়। সে সব তথ্য দেরিতে হয়৷ মূলত তথ্য জোগারে তার দেরি হয়ে যায়৷ সেদিন সে হঠাৎ জানালো আমার লেখক চিত্রাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়েছে৷ আমার মাথায় বাড়ি পড়ে যেন৷ আচমকা আমি পাগলের মতো হয়ে যাই৷ মেয়েটা সেদিনই তো প্রপোজ করলো৷ এতো দ্রুত তাদের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কী ঘটলো? আর লেখক কীভাবে গেল তার সাথে? ওই মূহুর্তে আমি একদম দিশেহারা হয়ে যাই৷ হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বের হই৷ লেখককে বার বার ফোন দেই৷ সে ফোন ধরে ন৷ হঠাৎ ফোন রিসিভ হয়৷ আমি কিছু বলার আগে ওপাশ থেকে চিত্রার স্বর শোনা যায়৷ আমি এতো রেগে যাই যে রাস্তার মাঝে আমার চিৎকার দিতে ইচ্ছে হয়৷ ইচ্ছে হয় কাউকে খুন করে ফেলি। রাগে গা'টা জ্বলে যায়৷ রেস্টুরেন্টে তাদের দু'জনকে এক সাথে দেখে আমি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারাই নিজের উপর। ফল স্বরূপ লেখকের সাথে আমার সাময়িক বিচ্ছেদ হয়৷ আমার তীব্র রাগ আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। যার দরুণ আমি লেখককে চড়ও মারি। সেই অপরাধবোধ আজ আমায় ভীষণ ভোগায়৷ কান্না পায়৷ দুটো দিন আমার উন্মাদের মতো কাটে। পাগল পাগল লাগে৷ তৃতীয় দিন গুপ্তচর খবর পাঠায়, চিত্রার সাথে আসলে লেখকের কোনো সম্পর্ক নেই৷ লেখক তাকে কেবল বোঝানোর জন্যেই রেস্টুরেন্টে ডেকে নেয়৷ কথা বলে সব মিটমাট করতে চায়৷ এই খবরটা পাওয়ার পর আমি সম্পূর্ণরূপে হতাশ হই৷ আমার লেখকের উপর আমি কীভাবে এমন অন্যায় করতে পারি তা ভেবে কান্না পায় আমার। নিজের বোকামির জন্যে রাতভর কাঁদি৷ অদ্ভুত এক কষ্ট আমায় পাগল করে তোলে। অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়৷ এই যে আমাকে দেখছো না, আজ পুরো রাত ঘুমাইনি আমি। ঘুম আসে না। চোখ বুঁজে ঘুম আনতে যেন ভুলে গিয়েছি লেখক। ভোর হওয়ার আগেই ইচ্ছে হলো সাজবো। লেখকের কথা অনুযায়ী সাজবো৷ শিউলি তলায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবো৷ তারপর পুরোটা সময় জুড়ে প্ল্যান করবো কীভাবে লেখকের কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়৷ কিন্তু এখানে আসার সময়ই মনে হলো তুমি আশেপাশেই আছো৷ একটু পর কাছে আসবে। এমনটা কেন মনে হলো জানি না৷ তবে মনে হলো। আমি এখানে এসে বসতেই তুমি এলে। আমি অবাক হই৷ কী করবো ভেবে পাই না৷ হঠাৎ ইচ্ছে করে রাগ দেখাই।  ভাবি তোমাকে এখন কোনো ভাবে তাড়িয়ে দেবো৷ তারপর আয়োজন করে ক্ষমা চাইবো। অথচ তা হলো কই? তুমি তো নাছোড়বান্দা। লেগেই থাকলে। শেষে এমন ভাবে আমার দিকে তাকালে, এমন ভাবে কথা বলতে থাকলে যে আমার এক মূহুর্তের জন্যে মনে হলো তুমি আজ এখান থেকে চলে গেলে তোমাকে আর পাবো না আমি। একদম হারিয়ে ফেলবো৷ আমি ভয় পেয়ে যাই। বুকের ভেতর ধক করে উঠে। এক দলা কষ্ট এসে জমাট বাঁধে বুকের কাছে৷ কী করবো ভেবে পাই না৷ দ্রুত মন খারাপ হয় আমার। কিছু না ভেবেই শেষমেশ আমি তার কাছে পাঁচ মিনিট চাই৷ এবং পাঁচ মিনিটের কথা বলে দশ মিনিট কথা বলি।'
এতটুকু কথা বল্ব মিহিন থামে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে একমনে। আমি অবাক ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ কী অদ্ভুত মেয়ে। মনের ভেতর তার কতো কথা, কতো টান। অথচ প্রথমে এমন রাগ দেখালো যে আমি নিজেও বেশ ঘাবড়ে যাই৷ 

মিহিন চুপচাপ থাকে। মাথা তুলে তাকায় না৷ আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি৷ কিছু সময় পর সে ধীরে ধীরে মাথা উঠায়৷ একটু তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়৷ লজ্জাময় হাসি হাসে৷ কেমন কোমল স্বরে বলে,
'এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আমার লজ্জা লাগে৷'
সে হাসে৷ আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। সে আমার একটু কাছে সরে আসে। আমাদের দূরত্ব কমে যায়৷ সে বলে,
'আমাকে তো তাকাতে দাও৷ তুমি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি তাকাতে পারি না।'
আমি চুপচাপ থাকি। তার পাশে আরেকটু সরে বসে। সে আরেকটু কাছে এসে আমার সাথে মিশে যায়৷ অনেকক্ষন পর আমার চোখে চোখ রাখে৷ আমি খুব কাছ থেকে, খুব কাছ থেকে তার কাজল দেখি৷ কাজল কালো চোখ দেখি। কী মায়া! কী ভীষন মায়া এই চোখ দুটিতে৷ আমি মুগ্ধ হই৷ ভীষণ মুগ্ধ হই। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার চোখে মায়া করে৷ ঘোর ধরায়৷ আমি ঘোর ধরা দৃষ্টিতে তাকে দেখি। সে কাছে আসে৷ আমাকে টেনে নেয়৷ তার নিশ্বাসের উত্তপ্ততা অনুভব করি আমি৷ সে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
'কোন গালটায় চড় মেরেছিলাম হু?'
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি। কী বলব ভেবে পাই না৷ কেবল তাকে ডান গালটা দেখিয়ে দেই৷ সে তার মুখটা আমার গালের কাছে নিয়ে আসে। ডান হাত দিয়ে আমার গাল স্পর্শ করে প্রথমে। তার শীতল হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠি আমি। আমার চোখ যেন আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসে৷ সে আলতো করে আমার গালে চুমু খায়৷ তারপর তার ঠোঁট সেখান থেকে টেনে এসে আমার ঠোঁটের ভাঁজে রাখে। আমি শিউরে উঠি। গা কেঁপে উঠে আমার। অদ্ভুত, অদ্ভুত আনন্দঘন এক অনুভূতি! মিহিন চট করেই আমায় জড়িয়ে ধরে। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
'সরি৷ এক্সট্রিমলি সরি লেখক।'
আমি মৃদু হাসি৷ কিছু বলি না৷ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখি কেবল। সেদিন পর, সেদিন ঝগড়ার পর, আজ আমি অনেকটা নিশ্চিত এবং প্রান্তবন্ত অনুভব করি৷ প্রশান্তি অনুভব করি৷ এমন প্রশান্তি হয়তো আর কোথাও নেই৷ কোথাও নেই৷ 
.
গল্পঃ মিহিন এবং শিউলি ফুল
লেখকঃ তাসফি আহমেদ।
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ। 

(গল্পের শিউলি ফুল এবং শিউলি তলার থটটা আসলে আমার না। এটা আমাকে কেউ একজন জানিয়েছেন। তখনই ভালো লেগে যায়। এবং সিদ্ধান্ত নেই যে এটা নিয়ে একটা গল্প লিখব। আজ সেটা লিখে ফেলি। অনেক দিন পড় লেখলাম। ভুল টুল থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন। যিনি এই থট দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।)
Next Post Previous Post
12 Comments
  • Unknown
    Unknown ১৩ নভেম্বর, ২০২০ এ ১:৫৪ AM

    অসাধারণ 🥰🥰

    • Author
      Author ১৩ নভেম্বর, ২০২০ এ ২:১৯ PM

      ধন্যবাদ

  • Shawal Hossain Tamim
    Shawal Hossain Tamim ১৩ নভেম্বর, ২০২০ এ ২:০৯ AM

    amazingbrother 💛

    • Author
      Author ১৩ নভেম্বর, ২০২০ এ ২:১৯ PM

      ধন্যবাদ

  • Unknown
    Unknown ১৩ নভেম্বর, ২০২০ এ ৭:১১ PM

    ভাই গল্পটার মাঝে একটু মুভি মুভি ভাব আছে। এটা না থাকলে চমৎকার হতো। তবুও আপনার লেখা আসাধারণ লাগে। ❤️

  • Emon Albie
    Emon Albie ১৮ নভেম্বর, ২০২০ এ ৮:২৮ AM

    অনেক সুন্দর!❣️❣️

  • Emon Albie
    Emon Albie ১৮ নভেম্বর, ২০২০ এ ৮:২৮ AM

    অনেক সুন্দর!❣️❣️

    • Author
      Author ১৯ নভেম্বর, ২০২০ এ ৩:৪০ PM

      ধন্যবাদ

  • Unknown
    Unknown ১৮ নভেম্বর, ২০২০ এ ৯:৪৭ PM

    অসাধারণ, কোথাও হারিয়ে গিয়েছি মনে হচ্চিলো💜 যেন আমার সাথেই ঘটে চলেছে এসব💜💜

    • Author
      Author ১৯ নভেম্বর, ২০২০ এ ৩:৩৭ PM

      ধন্যবাদ ভাই

  • Didar's Diary
    Didar's Diary ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ এ ১২:৫৫ AM

    আহ কি চমৎকার, সত্যিই দারুণ 💚

  • Meharab786
    Meharab786 ১৭ মার্চ, ২০২১ এ ৯:১৬ PM

    লোখক সাহেব অসাধারণ লাগলো

Add Comment
comment url