Bangla Golpo: মা । গল্প - ৮

Bangla Golpo Bangla new golpo Bangla choto golpo Bangla Valobasar Golpo Bangla Love Story বাংলা গল্প



Bangla Golpo: মা


সাদ আহম্মেদ


পানের পিক যেখানে সেখানে ফালাতে রহিমা বেগম খুব পছন্দ করেন। তার মনে আজকে রঙ লেগেছে। তাই একের জায়গায় দুটি পান একসাথে মুখে পুরে তিনি আনন্দে চিবোচ্ছেন। উদ্দেশ্য মেম্বারের বাড়ির দেয়ালে ইচ্ছেমত পিক ফেলে নোংরা করা। আশেপাশের লোকজন সবাই খুব বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ শুক্রবার পবিত্র জুমা্র দিনে মেম্বার সাহেবের বাড়িতে তাকে নিয়ে বৈঠক বসেছে। কেউ কথা বলছেনা। সবাই অপেক্ষা করছে কখন মেম্বার আক্কাস ব্যাপারী কথা বলবে।

ভরদুপুরে মেম্বারসাব তার ভাঙ্গা চেয়ারে বসে বাচ্চাদের মত পা দুলাচ্ছে। নাকে ময়লা জমেছে। পরিষ্কার করা যাচ্ছেনা। সে এখন গ্রামের মানুষের কাছে সম্মানিত ব্যক্তি। এমন ব্যক্তিবর্গ নাকে হাত দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করবে ব্যাপারটা খবই দৃষ্টিকটু। গলায় কফ পরিষ্কার করাটা অবশ্য জায়েজ আছে। কিন্তু সেটা হুংকার দিয়ে আদাবের সাথে করতে হবে। সামনে চেয়ারম্যান ইলেকশন, তাই এতো সাত পাঁচ ভাবা আর কি।

সবার দিকে তাকিয়ে গলাটা খাকারি দিয়ে মেম্বারসাব রহিমাকে বললেন, "তুমি পাগল ছাগল মেয়ে। কি জন্যে ইউএনও সাহেবের সামনে এমন বেফাস কথা বললে? তুমি কি আসলেও জানো ওই ছেলের মা কে?"

রহিমা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, "মিথ্যা কমু ক্যান? আমার বইনের পোলা। বড় বইন। তোমরা যহন ন্যাংটা হয়ে ঘুইরতা তখন ওর বাচ্চাটা হয়েছিলো। এরপর পালতে পারেনাই, বিদিশীগো দিইয়ে দিছে। আমি কি তোমার মত ইলেকশন খাড়াবো যে মিছা কথা কয়ে ভোট চামু?"

মেম্বার মুখটা সহজ রাখে। সে রাগ দেখালে গ্রামের লোক ভাববে পাগল মহিলার কথায় তার কিছু যায় আসে। সে বুঝতে পারছে রহিমার মতলব। ওই বিদিশী ছেলের কাছ থেকে রহিমা টাকা পয়সা পাবে এই লোভে রহিমা এই কাজটা করেছে। মেম্বারের তাতে কিছু যায় আসেনা। তার টাকা পয়সা অঢেল। দুই ছেলে আবুধাবী থাকে। এক ছেলে সৌদিতে ব্যবসা করে, মোবাইলে ফোনের ব্যবসা। তার টাকার সমস্যা নাই। মিথ্যা কথাতে সমস্যা। মেম্বার কিছুই হয়নাই এমন ভাব ধরে বললো, " তা তোমার বোনরে তো গেরামের কেউ কখনো দেখছে বলে মনে করতে পারতেছেনা। তুমি যে সত্যি কথা বলতেছো কিভাবে বুঝবার পারি?"

রহিমা তার মাথার ঘোমটা ঠিকমত তুলে দিয়ে বলে, "সে অনেক আগের কথা। তোমরা ভুলি গেছো। আইজকাল জীবিত আদমীর কথাই মানুষ মনে রাখেনা আর আমার বইনটাতো মারা গেছে আজ প্রায় চল্লিশ বছর হইয়ে গেছে। আমার এখন কাজ আছে। পাক শাক করতে হবে। ছেলে বিলাত থেকে আসছে, কিছু খাওয়াই দিতে হবে।আর কিছু বলবা?"

মেম্বার ভেবেছিলো আজকে রহিমা বেগমকে নিয়ে একটু প্যাচ করে সময় কাটাবে। কিন্তু পাগল মহিলাকে আটকায় রাখা যাচ্ছেনা। এভাবে ছেড়েও দেয়া যাচ্ছেনা। তার তো একটা সম্মান আছে। চোখের ইশারায় সে মিজানকে ডাকে। তারপর বলে, "মিজান তুমি উনারে ৫০০টা টাকা দিয়া দাও। বিলাতি ছেলে সব খেতে তো পারবেনা।গঞ্জ থেকে মাছ কিনে খাওয়াইতে বলো"।

তারপর মেম্বার রহিমা বেগমের দিকে তাকায় বললো, "ছেলে তো আসবে রাতে। সময় আছে। তুমি যে আমাকে নিয়ে একটা বেফাস কথা বললা এইটার তো একটা শাস্তি দরকার আছে নাকি?"

মেম্বার সবার দিকে তাকায়। কেউ কিছু বলেনা। বাচ্চাদের চোখ এখন কচকচ করছে। তাদের বড় মানুষদের শাস্তি দেখতে ভালো লাগে। মুরব্বীরা চিন্তায় পরে গেছে। ষাট বছরের বুড়িকে কি শাস্তি দিতে পারে এটা নিয়ে তারা একটু পেরেশান। মেম্বার আবার মিজানের দিকে তাকায় বলে, "ঘরের পিছে আমার একটা পুরানো চটি জুতা আছে। ওটা নিয়ে আসো। বেশি শক্ত না ওটা। তা দিয়ে রহিমাকে ৫০টা বাড়ি দেবে। মহিলা মানুষ, বয়স বেশি তাই আদাবের সাথে দেবে। আমি মেম্বার, গ্রামের ভালো মন্দ দেখতে হয়। কেউ ভুল করলে, মানী ব্যক্তির অসম্মান করলে তাকে ছাড় দেয়ার আইন তো দেশে নাই, নাকি?"

ভর দুপুরে ৫১ জুতার বাড়ি আর ৪৮০ টাকা নিয়ে রহিমা বেগম বাজারে যায়। ২০ টাকা মিজান রেখে দিয়েছে সালামী হিসেবে। অতিরিক্ত ১টা জুতার বাড়ি মেম্বার নিজেই দিয়েছে। রাগ মেটাতে। রহিমা বেগমের তাতে কোন যায় আসেনা। তার মন দুদিন ধরে বেশ ভালো। ইউএনও সাহেব সেদিন হঠাৎ গ্রামে এসে বললো, এই গ্রামের এক গরীব পরিবার খাওয়াতে না পেরে ৭১ এর পর তাদের ছেলেকে দত্তক দিয়েছিলোসেই ছেলে পরবর্তীতে বিলাত দেশে পড়াশোনা করে কিছুদিন আগে গ্রামে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছে। সে আসবে তার দুধ মায়ের সাথে দেখা করতে। এই খবর শোনার পর থেকে রহিমার চোখ জ্বলজ্বল করছে। গ্রামের দুষ্টু লোকে বলছে টাকা পাবো এই উদ্দেশ্যে নাকি বিলাতী ভদ্রলোককে রহিমা ছেলে বলে দাবী করছে। ওদের দোষ দিয়ে কি লাভ। রহিমা বেগমের আসলেও খুব খারাপ দিন যাচ্ছে। ভিক্ষা করে চলতে হয়। দুইবেলার খাবার ঠিকমত কেউ তাকে দেয়না।

সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে বিলাতী ছেলে ম্যাক্স ঘাটে এসে পৌছালো। তাকে নিতে পুরা গ্রামের সবাই এসেছে। রহিমার পাশে জোহরা দাঁড়িয়ে ছিলোরহিমাকে সে ফিসফিস করে বলে, "খালা তোমার বোনের গায়ের রঙ অনেক ফরসা আছিলো, না? ছেলে তো পুরাই টকটকা। তোমারে চিনবে?"

রহিমা বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলে, "কি সব বকবক করিস। ওর ১ বতসর হওয়ার আগেই আমার বোন দিয়ে দিছিলো বিলাতিগো। ও কি আর মনে রাখবে খালারে!"

সবাই ম্যাক্স এর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রাইমারীর মাস্টার জহিরুল বাবু, চেয়ারম্যান, মেম্বার, ইউএনও এদের পাশে দাঁড়িয়ে ম্যাক্সকে বরণ করে নিতে এসেছে। বাবু মাস্টার খানিকটা ইংরেজী জানে, তাই তাকে এখানে উপস্থিত থাকার সম্মান দেয়া হয়েছে। লোকে তাকে কেন যে মশকরা করে হাবু মাস্টার বলে সে বুঝেনা। এখন গ্রামের মূর্খরা ঠিকঠিক তার সম্মান বুঝবে। সে ম্যাক্স এর দিকে দৌড়িয়ে যেয়ে বললো, "ওয়েলকাম ওয়েলকাম। সো হেপি, ভেরি হেপি। আউয়ার ভিলেজ বয়, ভেরি গুড"।

এর বেশি ইংরেজী সে উত্তেজনায় বলতে পারছেনা ।

রাতে ম্যাক্স তার খালা রহিমা বেগমের বাসায় যেয়ে একটা চেয়ারে বসে সবকিছু তাকিয়ে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে দেখছিলো। তার সাথে গ্রামের অন্যান্য মুরব্বীরাও আছে। খাওয়ার সময় হলে এরা চলে যাবে। শুধু বাবু মাস্টার আর রহিমা বেগম থাকবে। ম্যাক্স একটু পরেই চলে যাবে। তার অনেক কাজ আছে। সে খুব আস্তে আস্তে ইংরেজীতে কথা বলছে। বাবু মাস্টার সেটা বাংলা করে রহিমা বেগমকে বোঝাচ্ছে।

ম্যাক্স কুড়েঘরের আশেপাশে তাকিয়ে বললো, "আমার মায়ের কোন ছবি নেই আপনার কাছে বা আমার বাবার?"

শিক্ষক বাংলা করে বুঝালে রহিমা বেগম বলে, "না আমরা গরীব মানুষ। ছবি তোলাতো বুঝতামনা তহন। তয় তোমার মায়ে দেখতে খুব সুন্দর আছিলো। পরীর মতন। তোমারে খুব আদর করতো। তোমারে দিয়া দেওনের সময় খুব কানছে। কিন্তু তোমার বাপে মারা গেছিলো। খাওন দিতে পারতোনা। হের খুব অসুখ আছিল। বুকে পাত্থর বাইন্ধ্যা তোমারে দিয়া দিছে"।

ম্যাক্স কিছু বলেনা। তার হাতে একটা প্লেটে অল্প করে গরুর মাংশ আর একটু ভাত। সে ওটা খেতে পারছেনালবণ হয়নি এটা সমস্যা না, অনেক ঝাল লাগছে। তার ঝাল খেতে সমস্যা হয়।সে হাত থেকে খাবার থালা নামিয়ে বাবু মাস্টারকে বললো, "উনাকে বলেন আমার মায়ের উপর অনেক রাগ ছিলো। এখন আর নাই। আমি বুঝতে পারি উনারা কতটা দরিদ্র ছিলেন। আমি আগে এটা বুঝতামনা। আমি উনার ভালোবাসা আদর পেলামনা এটা ছাড়া আর কোন আফসোস আমার নাই"।

বাবু মাস্টার অনেক চিন্তা করে নানান শব্দে রহিমা বেগমকে কথাগুলো বুঝিয়ে বলে। তার বেশি মনোযোগ খাবারের প্লেটে। সারাদিন সে ক্ষুধার্ত ছিলো। মানুষের জন্য খাবার হলো মৌলিক চাহিদা। খাবার ছাড়া জীবন বড়ই বিস্বাদ।

রহিমা বেগম কি বুঝলেন কে জানে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "আল্লায় যা করে ভালোর জন্য করে। তুমি এহন বিলাত থাকো। কি সুন্দর হইছে চেহারা। শিক্ষিত হইছো। হাতে মোবাইল আছে। আল্লা তোমার আরো উন্নতি করুক বাবা"।

ম্যাক্স যাওয়ার আগে রহিমা বেগমকে একটা ঘড়ি আর ২১হাজার টাকা দেয়। রহিমা বেগম তো খুশিতে আটখানা। ১ বতসর তার আর খাওয়ার চিন্তা করতে হবেনা। সে ঘড়ি পড়ে বোনের ছেলেকে বিদায় দিতে ঘাটে যায়।মেম্বার সাহেবও এসেছেন। তার প্ল্যান আছে যেই টাকা রহিমাকে দিয়েছে সেটা কোন একভাবে রহিমার থেকে নিয়ে গ্রামের অন্যান্য দুস্থদের দিয়ে দেয়া। পাগল মহিলা এত টাকা দিয়ে কি করবে। তার থেকে তার চাচার ঘরের টিন পড়ে গেছে। ওটা একটু ঠিক করে দিলে আরো ভালো হয়।

ম্যাক্স যখন নৌকায় উঠে তখন রহিমা বেগমের চোখ পানিতে ভরে যায়। ম্যাক্সের নৌকায় উঠার অভ্যাস নাই। তাই একটু ভয়ে ভয়ে আছে। সে নৌকায় বসে দেখে রহিমা বেগম তার দিকে দৌড়িয়ে আসছে। পানিতে ঝাপ দিয়ে রহিমা বেগম তার কাছে এসে পাগলের মত কাঁদতে থাকে। তাকে দেয়া ২১ হাজার টাকা রহিমা বেগম জোর করে ফিরিয়ে দেয়। এরপর মাথায় আর গালে আদর করে বলে, "বাজানরে আমারে মাফ কইরা দিস। খাইতে না পাইরা তোর বুবু, আমার বড় মাইয়্যাটা মইরা গেছিলো। তোরে না দিলে উপায় ছিলোনা বাঁচানোর। বাজানরে, আমার বাজানরে। লজ্জায় তোরে আমার পরিচয়টাও দিতে পারলাম না। আমারে মাফ কইরা দিস। ও আদরের বাজানরে"!

ম্যাক্স কিছু বুঝে উঠেনা। কিন্তু তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিভাবে যেন তার চোখেও পানি এসে পড়লো। সে রহিমা বেগমের হাত হাত রেখে বললো, "আমি আবার আসবো"।

রহিমা বেগম কিছু না বুঝে দাঁড়িয়ে থাকে। ম্যাক্সের নৌকা দূর দূর চলে যায়। সে তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষা করে, যেমনটা অপেক্ষা করেছে সে গত ৪১ বছর ধরে। নদীর পানিতে ছলাত ছলাত শব্দ ওঠে, রহিমার কান্নার আওয়াজ তাতে থেমে যায়। তার চোখ জুড়ে নানান ভাবনা, তা কেউ দেখার বা বোঝার নেই।

ম্যাক্স শহরে পৌছালে তার স্ত্রী ক্যাথরিন তাকে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে, "তোমার খালা তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে মনে হলো"।

ম্যাক্স কিছু বলেনা। গাড়িতে উঠে এন্ড্রিউ জি গ্রেসের "সিনেম্যাটিক" চালিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে কাউকে না শুনিয়ে বলে, "আমি মায়ের চোখ চিনি। খুব সুন্দর। ঠিক আমার মত"।

সাদ আহম্মেদ


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url