গল্পঃ ফিরে তাকানো হয়নি আর

বাংলা ছোট গল্প| Bangla Love Stories| Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.

গল্পঃ ফিরে তাকানো হয়নি আর

তাসফি আহমেদ


বেশ ঝাকঝমক ভাবেই আমার আর কাবেরির বিয়ে হয়েছিল।অসাধারণ রূপবতী কাবেরি।যেদিন ওকে প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনই ওর প্রেমে পড়ে যাই আমি। ঘন কাজলে
ঘেরা  দু'চোখ, ঠোটে লালচে কালারের লিপস্টিকের আবরন, মুখে সামান্য মেকাপের প্রলেপ দেওয়া, মেরুন কালারের শাড়ি পরিহিতা মেয়েটাকে দেখে আমি যেন কোন ভাবেই চোখ ফিরাতে পারছিলাম না। আমি তখন আমার "আমি" কে হারিয়ে ফেলি। খুঁজে পাই আমার 'তুমি' কে। কি এক ঘোরে যেন আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম। অদ্ভুত! সেই ঘোরে প্রচন্ডরকমে আনন্দ  মিশে ছিল। আমি যখনই তার কথা ভাবতাম তখনই অনুভব করতাম আমি ভীষণ খুশি। আমার চেয়ে খুশি এই মহা বিশ্বে আর কেউ নেই। থাকতে পারে না। আমি নিজেকে আনন্দের সাগরে ডুবিয়ে রাখতাম তাকে ভেবে। তারপরেও যা যুগ পড়েছে! তাই ভালো করে খবর নেই আমি। তখন ভাগ্য যেন আমার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল। ওর প্রতিটা পজেটিভ খবর আমাকে ওর প্রতি আরেকটু আকৃষ্ট করেছে।আরেকটু নমনীয় করেছে আমার হৃদয়টাকে।আমি কোন খুঁতই পাই নিই বিয়ে 'না ' করার। আর তাছাড়া কোন মেয়েই সব দিক দিয়ে পার্ফেক্ট নয়।কোন বা কোন দিক দিয়ে কম তো আছেই।এটা বিধাতার নিয়ম।বিধাতা কাউকে ঠকায় না।
.
বিয়ের আগে ফোন দিতাম। "কেমন আছো?" জিজ্ঞেস করতাম কেবল।
সে ওপাশ থেকে মৃদু স্বরে হাসত। বেশ কোমল গলায় বলতো, "ভালো আছি। আপনি?" ব্যাস এতটুকুই!এতটুকু শুনার পরেই আমার হৃদয়টা কেন জানি জুড়িয়ে যেত।ওর কোমল স্বরের কন্ঠটা আমার হৃদয়ের দ্বার ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে।ঝড় তুলে সেখানে। আনন্দের ঝড়। সত্যিই তখন এক অন্য রকম অনুভুতি হত আমার। ফোন দিলে বেশি কথা হত না। একটুও না! লজ্জা পেতাম।দুজনে ভীষণ লজ্জা পেতাম।আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতাম, "কেমন আছ? " ও পাশ থেকে ভেসে আসত সেই স্বরটা।ফোনের স্পিকার ভেদ করে কানে পর্দা অতিক্রম করত সেই মধুর বানি খানা।"ভালো।আপনি? "  আমি আর কথা বলতে পারতাম না। কথা আর সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না আমার।টুপ করেই কলটা কেটে দেই। আবার কল দেই।আগের নিয়মে চলতে থাকে।সেই জায়গাতে এসে আবারে ফোন কেটে দেই।এভাবেই খেলতে থাকি আমরা।অদ্ভুত খেলা। যে খেলাতে হার জিত নেই। ভালোবাসা থাকে।
 আমার  মন চাইত সারাদিন ওর সাথে কথা বলি।
কিন্তু কোন এক জড়তার কারনে তা আর ঠিক হয়ে উঠে না।
.
বাসর রাত কেমন তা আমি জানি না।কি করব,কি বলব ওর সামনে গিয়ে, খুব টেনশনে হচ্ছিল।একগাদা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল।খুব ঘামিয়ে যাই আমি। চিন্তায়, লজ্জায় একাকার। আমার এ নির্মম অবস্থা দেখে কত তামাসাই না করেছে ভাবি আর আন্টিরা।সে আর বলতে।হাসতে হাসতে যেন গড়িমসি অবস্থা। সেই রাতে ওকে সর্ব প্রথম একটা কথাই বলেছিলাম,
"তোমার যা চাই আমি তোমায় তাই দিব। তোমার সব চাওয়া পূরণ করব। কিন্তু আমার মা-টাকে কখনও  কষ্ট দিওনা। একটুও না। উনার কষ্ট আমি একদম সহ্য করতে পারি না।"
সে সেদিন মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। মৃদু স্বরে বলে,"আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।" আমি মৃদু হাসি। তার এমন উত্তরে তার প্রতি আমার ভালো লাগা এবং ভালোবাসা উভয়ই সমপরিমানে বাড়তে থাকে।
.
খুব ভালোই ছিলাম আমরা। এই বেশি ভালো থাকাটাই হয়ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার জন্যে এত আয়োজন সেই-ই আয়োজনের মঞ্চ ত্যাগ করে। আমার মা মারা যায়।বিদায় নেয় আমাদের ছেড়ে যায়। পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে।খুব ভেঙ্গে পড়ি। একগাদা কষ্ট চেপে ধরে আমায়। একটা মা ছিল আমার। যাকে ছাড়া আমার এই জগৎ সংসারে। যাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত কাটে নিই আমার। যে আমার অবসরের বন্ধু ছিল। আমি তাকে হারাই। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট তীব্র হয়। আমি সেই তীব্র কষ্টের জ্বালায় ভুগছিলাম। ঠিক সেই সময় আমার পাশে দাঁড়ায় কাবেরি। আমার হাতে হাত রাখে। ছায়া হয়ে দাঁড়ায় আমার পাশে। 
 . 
কাবেরি আমাকে অনেকটাই স্বাভাবিক করে তুলে।
কষ্ট গুলো ভুলে যেতে সাহায্য করে। আমি আর কাবেরি প্রায়ই বিকেলবেলা পার্কে যেতাম।ও আমার কাঁদে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। গোধুলী দেখতাম আমরা। গৌধুলির রক্তিম আলো ওর মুখটায় পড়ে। ফর্সা মুখটা কিছুটা লালছে হয়ে যায়। আমি কেবল বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও লজ্জা পায়। কাঁদের উপর মুখ গুঁজে লুকায় ও। এই দৃশ্য দেখে আমি কেবল হাসতাম। আস্তে করে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নিতাম।
.
চাঁদনি রাতে দুজনেই ছাদে যেতাম।শুধু আমরা আর আমাদের ছায়া মূর্তি থাকত পাশে। নিস্তব্ধ থাকত রাত।মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ আসত।সাই করে চলে যেত একটা গাড়ি।তারপর আবার সব নিরব।নিস্তব্ধ ।ও থাকত আমার বাহুতে মাথা রেখে।খুব শক্ত করে ধরে রাখত। আমি শুধু তাকে দেখতাম। হাজার বছর বাঁচলেও আমি শুধু তাকেই দেখতাম।শুধু তাকেই দেখে যেতাম।জানি না! ওর ওই দু'চোখে কি আছে। ওর চেহারার মাঝে কী লুকিয়ে আছে আমি সত্যিই জানতাম না। কোন কিছু না জেনে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।  কেবল তাকেই দেখে যেতাম।তবে একটা জিনিস আমি বেশ বুঝতে পারতাম যে ওর মাঝে কিছু একটা আছে যা আমাকে ওর প্রতি আকৃষ্ট করে।ওর প্রতি ভালোবাসা যোগায়। জানি সেই জিনিস কি। তবে কিছু একটা ওর মাঝে ছিল। সেটা হয়তো মায়া বা অন্য কিছু।মাঝে মাঝে খুব রাগও করত কাবেরি।বেশ লজ্জা মিশ্রিত স্বরে বলতো,
"এভাবে তাকিয়ে থেকো না প্লীজ। আমার লজ্জা করে ভীষণ।"
আমি ওর কথা শুনে কি বলব বুঝতে পারি না।কথা আসে না মুখ দিয়ে।কেবল তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয়।ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না।  
.
ও কখনও ঘভির রাতে বলে নি আইস্ক্রিম  খাবে কিংবা দুজনে মিলে রাস্তা বের হবো ফুসকা খেতে। এমন চাওয়া পাওয়া ছিল না ওর।শুধু একটা অতি সামান্য অনুরুধ করেছিল কেবল। একদিন বলেছিল, "চাঁদ দেখব।"আমিও নিয়ে যেতাম।না করতাম না। ভালো লাগত আমার। ও বিছানা থেকে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকত।একটুও নড়ত না।অন্যদিকে তাকিয়ে কিছুটা আহ্লাদী হয়ে বলত,
:পাঁ টা না একদম অবশ হয়ে আছে।সারাদিন তোমার সংসারের কাজ করতে হয়। এ ঘর ও ঘর দৌড়াতে হয়।আমার পাঁ ব্যাথা হয়ে যায় না?"
ওর এমন কথা শুনে আমি মৃদু হাসতাম কেবল।কিছু বলতাম না।
কোলে তুলে ছাদে নিয়ে যেতাম।
.
আহা! কত সুন্দরই না ছিল দিন গুলো। বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের পূর্বেমার সুন্দর দিন গুলোর কথা গুলো ভাবছিল সাদিক। তখন ওর গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। ও হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে পানি গুলো মুছলো।খুব নোনতা পানি গুলো। অব্যক্ত কিছু কষ্ট লেগে আছে সেখানে। যা কখনই জানতে পারে নি কাবেরি। কখনো পারবেও না। 
.
ওই তিন মাস খুব ব্যাস্ত ছিলাম।কিন্তু তাই বলে এমন হবে?বিধাতা এমন অবিচার করবে আমার প্রতি?কাবেরিও বা কি। আমার ছোট ছেলেটার কথাও কি ও একবার ভাবলো না? কেন ও এমন হয়ে গেল?কেন?
বেশি ভালোবেসেছি। তাই বলে এমন শাস্তি? এমন শাস্তি পেতে হবে? কাঁদতে কাঁদতে বারান্দার দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল সাদিক।কিছুক্ষণ খুব কাঁদলো। শব্দহীন ভাবে কাঁদলো। এরপর উঠে গিয়ে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে আসল।বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয় ও।চিঠি লিখবে এখন ও। চিঠি!!
.
যথারিতি অফিস থেকে আসে সাদিক। প্রচন্ড গরমে গা ভিজে একাকার। তারউপর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে। অনেকটা হাঁফিয়ে গিয়েছে ও। বাসার দরজার কাছে এসেই কলিংবেল বাজালো। একবার না,দুই বার না বেশ কয়েকবার বাজালো। কিন্তু তারপরও কাবেরি দরজা খুলে না। কোন আওয়াজ পাওয়া যায় না ওপাশ থেকে। সাদিক ডাক দেয়। দরজায় বেশ কয়েকবার শব্দ করে। না! কাবেরি দরজা খুলে না। আশ্চর্য! এত দেরি করছে কেন ও? এমন করছে কেন? কি হয়েছে? আজকাল প্রতিদিনই দেরি করে দরজা খোলে। কাহিনি কি? সাদিক কিছু বলে না আর। চুপ করে থাকে। হয়তো প্রচন্ড ভালোবাসে বলে কারন জানতে চায় না। অনেক্ষণ পর দরজা খুলেই সাদিকের দিকে না তাকিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল যায় কাবেরি। ওর ছেলে রোহান দৌড়ে বাবার কোলে আসে।এসেই বলে,
"বাবা আমার চোকলেট কই?"
সাদিক বলে,
"ওহ বাবা সরি।বাবা আনতে ভুলে গেছি।
"
রোহান কিছু বলে না আর।মন খারাপ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না করবে সে। ঠিক তার আগেই ওকে চকলেট গুলো দিয়ে দেয় সাদিক। ওর এই মন খারাপের মুড টা দেখলেই ভালো লাগে ওর। ভীষণ ভালো লাগে। ঠিক ওর মায়ের মত। তাই ওর সাথে এমন করি।
চকলেট গুলো পেয়ে খুব খুশি হয় রোহান। সাদিককে জড়িয়ে ধরে বলে,
"তুমি আমার ভালো বাবা।"
তারপর গালে একটা চুমু দিয়ে পালায়।
এ সময়টা বেশ ভালো কাটে সাদিকের। বাকি সময়টা প্রচন্ড অসহ্য এবং অস্বস্তিতে কাটে। কি এক ভাবনায় যেন তলিয়ে যায় সাদিক। আশ্চর্য!  আমার কাবেরি এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? এমন কেন হয়ে যাচ্ছে? কি হয়েছে ওর?
রাতে ঘুমানোর সময় সাদিক কাবেরি কে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।  যথারিতি সেদিনও ওকে জড়িয়ে ধরে সাদিক। কিন্ত ওকে জড়িয়ে ধরার পর সাদিক হঠাৎই অন্য কিছু আবিষ্কার করলো। অন্য কারো গায়ের গন্ধ পায় ও। যে গায়ে ওর গায়ের গন্ধ মিশে থাকতো আজ সেখানে অন্য কেউ? আশ্চর্য!  এমন কেন হবে? চট করেই কাবেরি কেমন জানি করে উঠল। যার দ্বারা বুঝা যায় ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। সাদিক ওকে ছেড়ে অন্য পাশে তাকায়। কাবেরি তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যা বুঝায় "উফফ!যাক বাবা বাঁচা গেল "।
সাদিক ওর সাথে এতটা জড়িয়ে গিয়েছি যে,ওর শরিরের গন্ধটাও সাদিকের বেশ জানা আছে।একদিন, দুইদিন, তিনদিন নয় পুরা এক মাস ওর গায়ে অন্য কারো গন্ধ পায় সাদিক। অদ্ভুত এক ভয়ে আঁৎকে উঠে ও।  এই গন্ধটা ওর কেন জানি খুব পরিচিত লাগলো। কিন্তু কার তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছলো না ও।গন্ধটা যত তিব্র হচ্ছে সাদিক ওর থেকে তত দুরে সরে যাচ্ছিল।যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। কোন এক অন্ধকার গহ্বরে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। কাবেরির মাঝে আর নিজেকে খুঁজে পাই না সাদিক।একদম না।অন্য কাউকে পায়।ওর চোখে অন্য কেউ খেলা করে।অন্য কারো ছায়া ভাসে। কেউ ওর ভেতরে প্রবেশ করে বসে আছে যেন। যা সাদিক একদমই সহ্য করতে পারে না।একটুও না। আজকাল ওদের মাঝখানে রোহান ঘুমায়। খুব কষ্ট হয় সাদিকের।কিন্তু কি পোড়া কপাল ওর,ওদের সামনে কাঁদতে পারতো না।কাঁদার সময়ই পেতো না।অফিসে কাঁদা যায় না।বাড়িতে ওদের সামনেও কাঁদতে পারে না ও।
একটু কান্না করে যে নিজেকে হালকা করবে সে উপায়ও নেই। ভিষন এক লাগতে শুরু করে ওর। ওর মায়ের নিষ্পাপ মুখখানা বারবার ভেসে উঠে ওর দু'চোখে। 

কিছুদিন পর,

অফিসের কাজে মন বসছিল না সাদিকের।তাই একটু তাড়াতাড়িই বাড়ির পথে রওনা হয় ও। সাদিক জানে এই সময় কাবেরি রোহান কে স্কুল থেকে আনতে যায়। বাসা খালি থাকে। তাই এত তাড়াতাড়ি যাওয়াটা ঠিক হবে না বলে মনে হলো ওর। তাই আস্তে আস্তে হাঁটছিলো। কিছুদূর যেতেই একটা রিক্সা নেয় ও। বাড়ির মাঝামাঝি পথে আসার পরই হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে হয় ওর। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ফুটপাতে কেউ একজন তার প্রেয়সীর হাত ধরে হাটছে।ওদের দেখে খুব ভালো লাগল সাদিকের। হঠাৎই অতিতের কথা মনে পড়ে গেল ওর। সাদিক আর কাবেরিও এমন হাঁটতো।কাবেরির কথা মনে হতেই মেয়েটার শাড়ির দিকে নজর গেল সাদিকের।খুব চেনা মনে হলো ওর। সেবার কাবেরি কে এমন গোলাফি কালারের একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল ও। কি খুশিটাই না হয়েছিল সেদিন। সাদিক চট করেই মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। তাকাতেই যেন গা টা জ্বলে উঠলো। ওর চামড়াটা যদি কেউ টান দিয়ে ছিড়ে ফেলত তবুও ও এতটা কষ্ট পেতো না যতটা কষ্ট পেলো ওদের দেখে।পুরো গা যেন জ্বলে যাচ্ছিলো।কেউ যেন পেট্রল ঢেলে ওকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।অভি! ওর খুব ভালো বন্ধু। বন্ধু বললেও ভুল হবে। ওর ভাই বলা যায়।যার রক্ত ওর শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে।যে সাদিককে একদিন রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে!সেই অভি কাবেরির হাত ধরে হাঁটতেছে! অভিকে কাবেরির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো কয়েক মাস আগে।তারপর থেকেই কি...? তারপর থেকেই হয়তো সাদিক নিজেকে ওর মাঝ থেকে হারিয়ে ফেলেছে।
অভি কে খুব বলতে ইচ্ছে হলো ওর, "কেন বাঁচালি আমায় সেদিন? কেন? এই দৃশ্য দেখার জন্যে?"
ছিঃ কতটা নিষ্ঠুর তুই।
.

চিঠি দুটো লিখা শেষ। একটা কাবেরির জন্যে আরেকটা অভির। তারপর চোখ দুটোর পানি মুছলো ও। উঠে দাঁড়ায়ে বারান্দার লাইটটা নিভিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে রুমের ভেতর ঢুকে।
.
কাবেরির জন্যে চিঠিঃ

"প্রিয় বলাটা ঠিক হবে কিনা জানি না।তবুও যেহেতু আমি এখনো তোমার স্বামি তাই প্রিয় বললাম।অন্যথায় ক্ষমা করে দিও।আমি বেশ কিছুদিন যাবত তোমার মাঝে অনেক পরিবর্তন দেখতে পারছি। কিন্তু শেষ পরিবর্তন টা না আমি একদমই মানতে পারি নি।কিছুতেই না।তুমি বাবুকে কারনে অকারনে মারতে।যা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।এতটা নিষ্ঠুর তুমি? কিভাবে পারলে তুমি? আমি সত্যিই সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আজ চলে যাচ্ছি কোন এক অজানা নিড়ে।খুব ভালোবাসাতাম তোমাকে আমি।এটাই হয়ত তার মূল্য। সবাই বলতো ভালোবাসার মানুষ যদি তাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে সুখি হয় তাহলে তোমার উচিৎ তাকে তার ভালোবাসার কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু আমি তোমাকে অভির হাতে পৌঁছে দিব যে সেই ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেন নি।আমি কিছুতেই সেটা করতে পারবো না। তাই পারলাম না।ক্ষমা চাচ্ছি তার জন্যে। সুখে থেকো তোমরা।শুধু একটা প্রশ্ন আমার মাঝে আজও রয়েই গেল,
আমি কি তোমাকে ভালোবাসতে পারি নি?আমি কি..."

ওর বাকি লিখা গুলো বুঝা যাচ্ছে না।কাগজের নিচের দিকটা ভিজে আছে। হয়তো কারো চোখের জলে।
কাবেরিও আর পড়তে পারছে না।চোখ গুলো ঝাপসা হয় ওর। ছলছল করে উঠল ওর
চোখ। চারপাশ থেকে বিন্দু বিন্দু জল জমা হতে থাকলো।এই পড়বে বলে।

.

"কি হল জান কথা বলছ না কেন? কি হয়েছে তোমার? সেই কখন থেকে কান্না করে যাচ্ছ তুমি।কিছুতো বল..."

হস্তদন্ত হয়ে কথা গুলো বললো অভি।কাবেরির জবাব না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
:অ্যাই। কি হয়েছে তোমার?অ্যাই কাবেরি? 
কাবেরি কাঁপা কাঁপা হতে একটা চিঠি অভি কে দিল।তার উপরে লিখা, "শুধু তোর জন্যে অভি "এই হাতের লিখাটা খুব করে চিনে অভি।কোন এক প্রিয় বন্ধুর হাতের লিখা ওটা।হ্যাঁ মনে পড়েছে।সাদিকের হাতের লিখা এটা।সাদিকের? অভি খামটা খুলে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করে।
অভির জন্যে চিঠিঃ
ভাই অভি,
তোকে আমি নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম।আমার তো ভাই ছিল না।তুই তার অভাব পূরন করছিলি একদিন।এই পৃথিবীতে আমার মাত্র তিনজন আপন জন আছে।কাবেরি,রোহান, আর তুই। তুই তোর রক্ত দিয়ে আমার জীবন বাঁচিয়েছিস একদিন।মনে আছে সে কথা তোর। একদিন আমাকে ভার্সিটিতে আরিফ মেরেছিল। আর সেদিন আমাকে মারার কারনে তুই  আরিফকে মারলি।এত মারলি যে ও এক মাস হাসপাতালেই ছিল।তোর ভয়ে আমাকে ভার্সিটির কেউই কিছুই বলত না।মনে পড়ে সে কথা গুলো। মনে পড়ে সেদিন তুই ক্যাম্পাসে চিৎকার দিয়ে বলেছিস "সাদিক আমার ভাই।আমার ভাইয়ের গায়ে হাত দিলে খবর ভালো হবে না বলে দিলাম।" জানিস সেদিন কি যে ভালো লেগেছিল! এতেই আমি খুব খুশি। তবে আমার একটা রিকুয়েস্ট প্লিজ না করিস না।তুই আমার কাবেরি কে সুখে রাখিস। আমি তো রাখতে পারলাম না।তাই তুই একটু দেখে রাখিস।ওর যেন কোন ভাবে ক্ষতি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখিস।আর শুন তুই তো উকিল।প্লিজ ডিবোর্স লেটার টা খুব জলদি পাঠিয়ে দিস।আমি আমার ই-মেইল দিয়ে দিয়েছি।আমাকে খোঁজার না চেষ্টা করলেই খুশি হব।ওকে নিয়ে খুব ভালো থাকিস।

ইতি

সাদিজ

.
সাদিক তার নিজের গ্রামের বাসায় উঠেছে।নিজের ট্রান্সফার করায় এখানকার উপজেলায়। ট্রান্সফারটার জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করছিল ও। তাই ওটা হয়ে যেতেই চলে আসে ওই শহর থেকে। কষ্টের শহরে আর থাকতে ইচ্ছে হয় নি ওর।

সাদিকের দিনকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না।রোহানটা শুধু ওর মাকে দেখতে চায়।কিন্তু ওকে যে কি করে বুঝায়?নিজে রান্না করে খায়।সব কিছু নিজেই করে।নিজের পুরোন বাড়িটাতে এসেছে তারা।অনেক সৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।গ্রামের মানুষ খুব ভালোবাসত ওর বাবা কে।সেই সূত্রে সাদিকও ভালো সন্মান পায় তাদের থেকে।এখানে রোহানের কিছু বন্ধু হয়।অবশ্য তাদের সাদিকই জুটিয়ে দেয়।কিন্তু তারপরও প্রায় ওর মন খুব খারাপ থাকত।
ভিষন খারাপ থাকত।
.
প্রায় মাসতিনেক পরের কথাঃ

সাদিক যথারিতি অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে।রোহান আরো আগেই আসে ওর এক বন্ধুর সাথে।স্কুলটাও বেশি দূরে নয়। আর বাসায় কাজের জন্যে লোক রাখা হয়েছে। মিনুর মা থাকেন এখানে। রোহানের দেখাশোনাও উনি করেন। তাই সাদিক আজকাল টেনশন ফ্রি থাকে। বাসার সামনে এসেই  দরজায় নক করে সাদিক।দরজা খোলা মাত্রই অন্য কারো মুখ ভেসে উঠে। খুব চেনা সে মুখ।কাবেরি! হ্যাঁ এটা কাবেরিই?কি হাল হয়েছে ওর চেহারার।বুকের কষ্ট আর বিষন্নতা আড়াল করে বললাম,
"আরে কাবেরি?কি অবস্থা তোমার?? অভির কি..."
আর পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলো অভিকে।
"আরে অভি তুই এখানে?খবর কিভবে পেলি?কিভবে আসলি এখানে?"
সাদিক কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজনে হঠাৎ আমার পাঁয়ের উপর পড়ে।সে কি কান্না ওদের।

সাদিক ওদেরকে বুকে তুকে নেয়।তারপর সোফায় বসে বলে,

"বল কি অবস্থা তোদের?কবে বিয়ে করলি?"

অভি বলে,
"আর কত নিজে কষ্ট পেয়ে অন্যকে আনন্দ দিবি বল।সে বারো তেরো বছর হতেই দেখে আসছি তুই সবার কথা ভাবিস।বিনিময় তুই কষ্ট পাস।কেন?তুই এমন কেন বল?"

সাদিক বলে,

"সেটা তুই আমার থেকে ভালোই জানিস। এখন বল তোদের বৈবাহিক জীবন কেমন যাচ্ছে?"

ও বলে,

"এ নিয়ে আর একটা কথা বললে তোকে আমি খুন করব।আরে আমি না হয় ভুল পথে যাচ্ছিলাম, তোর তো উচিৎ ছিল আমাকে একটা চড় দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যে আমি ভুল পথে যাচ্ছিস।আমাকে না হয় নাই বললি কাবেরি কে তো বলতে পারতি?"
সাদিক বলে,
"তোরা দুজনেই সুখি থাকবি।তাই তোদের সুখের কথা চিন্তা করে আমার এই পথে আসা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল আমি তোদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি।"
হঠাৎ-ই রোহান আসলো।দৌড়ে গিয়ে ওর মাকে সরি কাবেরিকে আম্মু বলে জড়িয়ে ধরল। সাথে হাজারো প্রশ্ন।কাবেরিও ওকে জড়িয়ে ধরল।পরম মায়ায়।একজন মায়ের মত।যেন কত দিন পর ফিরে পেল তার শান্তিকে।তার ছেলেকে।আমি উঠে গিয়ে কাবেরির কাছ থেকে ওকে নিয়ে নিলাম।কাবেরি এমন ভবে তাকাল যেন এটা যে আমি করতে পারি না।

আমি রোহান কে বললাম,

"বাবু উনি তোমার আম্মু নয়। আন্টি! আন্টি বলে ডাক উনাকে?"
ওরা দুজনেই আমার দিকে কেমন করে জানি তাকাল।মনে হচ্ছে এ আমি বলতেই পারি না।এমন কি রোহানও।রোহান কিছু বললো না। মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।ছেলেটা আজকাল কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।দরজা থেকেই দেখা যায়,উঠনে সবাই খেলছে।আর আমার ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে।বড্ড খারাপ লাগল আমার। সাদিক কথা গুলো ভাবলো। তারপর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে অভিকে বলল,
"কই ডিবোর্স পেপার দে। আমি সই করে দেই।"
অভি সাদিকের পাঁয়ের উপর এসে বলল,
"প্লিজ ভাই আমি তোর কথা রেখেছি।নিজের সবটা দিয়ে ওকে আগলে রেখে আমি তোর কাছে এনেছি।ওকে আমি সেদিন এরপর থেকে আমার হাত ওর শরিরে লাগাই নি।বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে একা একা।প্লিজ তুই ওকে মেনে নে।প্লিজ আমার এই রিকুয়েস্টটা রাখ।"
"কি যা তা বলছিস।এটা কোনভাবেই সম্ভব না।অভি! কোন ভাবেই না।"

"কেন সম্ভব না?"

"তোরা দুজন দুজনকে ভালোবাসিস। ভীষণ  ভালোবাসিস।"

"রাখ তোর ভালোবাসা।এটা কোন ভালোবাসাই নয়।আমরা আবেগের বসে ভুল করে ফেলেছি।তুই আমাদের ক্ষমা করে দে প্লিজ।প্লিজ ক্ষমা করে দে।"

"তোর বয়স যদি এখন আঠারো কিংবা বিশ হত তাহলে আমি মেনে নিতাম এটা আবেগ।কিন্তু এখন কোন ভাবেই এটা মানা যায় না যে তুই আর ও এটা আবেগের বসে করেছিস।"

"প্লিজ দোস্ত।এমন বলিস না।"

"ডিবোর্স পেপার তুই আনিস নি? না আনলে থাক।আমি নিজেই নিয়ে নিব।"

"তুই আমাকে বিশ্বাস কর প্লিজ..."
এবার সাদিক খানিকটা কড়া স্বরেই বলল,
"প্লিজ! জাস্ট স্টপ ইট। আমি যা বলছি তাই সই।"
এবার কাবেরি এগিয়ে এলো।হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইলো। অনেক আকুতি করলো। শব্দ করে কাঁদতে থাকে ও। বারবার নিজের ভুলের ক্ষমা চায়। নিজে যে অন্যায় করেছে তার জন্যে ক্ষমা চায়। শাস্তি পেতে চায়। সাদিকের কেন জানি মন গলে না। ওদের দুজনের কান্নায় ওর একটুও কষ্ট হয় না৷ খারাপ লাগে না। অসহ্য লাগে। মনটা যেন আরেকটু শক্ত হয়। অথচ এই কাবেরিই একদিন সাদিকের সব ছিল। সাদিকের দিনরাত ছিল। সে একটু কান্না করলেই সাদিকের মনের মাঝে কি ঝড় বইতো, কষ্ট হতো, আজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। বরং যেন আরেকটু শক্ত হলো। সে আরেকটু কঠোর হয়ে বসে থাকলো। বেশ কড়া স্বরে বলল,
"আমি তোমাকে এখানে আর এক মূহুর্তের জন্যে দেখতে চাচ্ছি না। প্লিজ! তুমি থাকলে আমার অসহ্য লাগে।"
.
যাকে একবার মন থেকে বিয়োগ করে দেওয়া হয় তাকে আর কখনই খুব সহজে যোগ করা যায় না। যোগ করলেও সেটা আগের মতো থাকে না।যে জায়গাতে যোগ করা হবে সে জায়গা আজীবন ফুলেই থাকবে। বুঝা যাবে যে এটা জোড়া লাগানো হয়েছিল। হয়তো জোর করে কিংবা কারো অনিচ্ছায়। আর কাবেরিকে দ্বিতীয়বার নিজের করে পাওয়ার কোন আকাঙ্ক্ষাই সাদিকের ছিল না। সে কাবেরিকে নিজের মন থেকে অনেক আগেই বিদায় করে দিয়েছে। তাকে আর মেনে নেওয়া সহজ না।
.
রিপোস্ট। তবে অনেকটা চেঞ্জ করে দিয়েছি। শেষের কাহিনী পালটে দিয়েছি। ভাবছি আরেক পার্ট লিখবো নাকি! দেখি কি হয়! 
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয় 
-তাসফি আহমেদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url