গল্পঃ অনু কাঁদছে


বাংলা গল্প| Love Stories Bangla Choto Golpo | Bangla Valobashar Golpo| Bangla Golpo.

গল্পঃ অনু কাঁদছে


চাঁদ টা বড় নয়।অর্ধেক। তাই পুরোপুরিভাবে আলো দিতে পারছে না।তবে যা আলো দিচ্ছে তা একেবারেই কম নয়।গায়ে মাখার মত।মাঝে মাঝে মৃদু হাওয়া এসে মনটা ভরিয়ে দেয়।খুব ভালো লাগে, যখন একটি জোনাকিপোকা এসে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।এক সময় তার আলোটা আর দেখা যায় না।
পাশে দাঁড়িয়ে আছে অনু।গায়ে সাদা একটা জামা।এই রকম জামা আমি কখনই দেখি নি।তাই এর নামও জানি না।পুরো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি যে তার পাশে আছি, সেদিকে ওর কোন খেয়ালি নেই।এক চোখে শুধু চাঁদটা দেখছে।
ছাদের নিচ থেকে কিংবা আসেপাশের কোন বিল্ডিং থেকে দেখলে সবাই বলবে ভূত।পালাবে সবাই।
কিছুক্ষন পর ও বলল,
জানিস! রোহান এতই পাগল ছিল যে রাতে আমাদের এই বাসার ছাদে চলে আসত।যখনি চাঁদটা খুব বড় হত তখনই ও চলে আসত।দুজনেই এক সাথে চাঁদ দেখার জন্যে।আমি ওকে খুব বারণ করতাম।কিন্তু কে শুনে কার কথা।ও আসতই।আমারো যে খারাপ লাগত তা নয়।বেশ ভালোই লাগত।কি আর করার।দুজনেই বসে বসে চাঁদ দেখতাম। তবে বেশিক্ষণ না।
প্রতিদিন সকালে ওর ছোট মেসেজ গুড মর্নিং পেতাম । তারপর যখনি আমি রিপ্লাই দিতাম সাথে সাথে ও ফোন দিত।
:মহারানি কি জাগ্রত হয়েছেন?
:জি সাহেব।আপনি কখন উঠিয়াছেন?
আমি একথা বললেই রোহান খুব হাসত।ওর সেই হাসিটা এখনো আমার কানে বাঝে।
ও যখন হাসত তখন আমি বলতাম
:এই! আমি কি হাসার কথা বলেছি?
:না ঠিক তা নয়। তবে তোমার মুখে এমন একথা শুনলে আমার কেমন জানি হাসি পায়।
এই বলে ও আবার হাসে।খুব রাগ হয় আমার।আমি বলি,
:এই একদম হাসবা না।হাসবানা বলে দিচ্ছি।তা না হলে ফোন কেটে দিব কিন্তু।
:আচ্ছা ফোন কাটতে হবে না।আর এখন রাগারও দরকার নেই। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আমাকে ফোন দিবা।ঠিক আছে?
:আচ্ছা ঠিক আছে।তুমিও নাস্তা করে নাও।
:তুমি নাস্তা না করলে কি আমি নাস্তা করি?
:আচ্ছা তুমি কি পাগল হুঁ?
:তোমার জন্যে একটু পাগল হলে আমার খুব ভালো লাগে বুঝলে?
:হুঁ বুঝেছি। দাড়াও আমি ফ্রেশ হয়ে নি।দুজনেই এক সাথে নাস্তা করব।
:কি ভাবে?
:কেন ভিডিও কলে?
:যদি তোমার আপু দেখে যায়?
:আরে দেখবে না।আমি নাস্তা রুমে নিয়ে আসব।তাহলে আপু আর দেখবে না।
:আচ্ছা ঠিক আছে পাগলি।
:এখন রাখি পাগলা।
:ওকে বাই।
আমি খুব তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতাম। কারন রোহান এখনো নাস্তা করে নি।ফ্রেশ হয়ে দুজনেই এক সাথে নাস্তা করতাম।
আমি নাস্তা করে কলেজে যেতাম।আর ও যেত ভার্সিটি তে।আমি ছিলাম ইন্টার ২য় বর্ষে। আর ও ছিল মাস্টার্স শেষ বর্ষে। আমি ওর বাড়ি এখানেই।নোয়াখালীতে।কিন্তু পড়ে ঢাবিতে।
কলেজে যাওয়ার পথে আমি ওকে ফোন দিতাম।দুজনেই কথা বলতে বলতে যেতাম।কলেজ থেকে ফেরার পথেই একই ভাবে ওর সাথে কথা বলতাম।তবে মাঝে মাঝে কথা হত না।ওর ক্লাস থাকত।
'
সন্ধায় রোহান ফোন দিত।কিছুক্ষন কথা বলার পর রেখে দিতাম।পড়ালিখা শেষ করে রাত ঠিক এগারোটায় ও ফোন দিত।
রাতে কথা বলে ঘুমিয়ে যেতাম।
দুই বছর পাঁচ মাস ঠিক এভাবেই চলছিল। বড় অদ্ভুত বেপার হল কোনদিনই এই রুটিনের ব্যাতিক্রম হত না।
দুজনের প্রতি দুজনের কেয়ারিং খুব ভালো ছিল।
প্রতি ভালোবাসা দিবসে ওর সাথে আমার দেখা হত।
তাসফি তুই বিশ্বাস করবি কি না জানি না।তবে এটাই সত্যি যে ও যেদিন ঢাকা থেকে আসবে আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহ এর কাছে দোয়া করতাম যেন ও ঠিক ভাবে নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছাতে পারে। এমনটা করতাম ও যত বার ঢাকা হতে আসত।
ওর সাথে আমার প্রতিটা দেখাতে আমি ওর জন্যে টিপিন বক্সে করে ওর পছন্দের খাবার নিয়ে যেতাম।
নিজের হাতে খাইয়ে দিতাম। মাঝে মাঝে ও কান্নাও করে দিত।
আবার আমি যেদিন দুপুরের কিংবা রাতের খাবার না খেতাম, ও নিজেও তখন খেত না।পরে আর কি করার, অগত্যা খেতেই হত।
জানিস আমাদের ভালোবাসার মাঝে কোন নোংরামি ছিল না।ছিল শুধু পবিত্রতা।
এতটুকু বলে অনু থামল। অবাক করা ব্যাপার হল এতক্ষন যে ও আমাকে এগুলো বলল একেবারে আমার দিকে না তাকায় না।।চাঁদের দিকে তাকিয়েই কথা গুলো বলল।আমি বললাম,
:তারপর???
অনু বলল,
:তারপর হঠাৎ করেই পরিবর্তন দেখা দেয় ওর মাঝে।যা আমি মানতেই পারি নি।প্রতিদিনকার সকালের মেসেজ আসত দুই তিন দিন পর। প্রতিদিন আর ফোন দিত না ও।খুব মিস করতাম।
.
যখন আমি ওকে বলতাম তখন ক্ষমা চাইত।আমি ওকে ক্ষমা করে দিতাম।আবার কয়দিন ঠিক ভাবে চলত।তারপরে আবার সে আগের মত।ওর এমন পরিবর্তন আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।তারপরেও আমি ওকে ফোন দিতাম।অনেক ফোন দিতাম।
একদিন ফোন ধরেই আমাকে বলল,
:এই তোমার সমস্যা কি হুঁ?এত ফোন দাও কেন?
:কেন তোমাক ফোন দিতে কি বারন আছে নাকি?
:হুম বারণ আছে।তুমি আর আমাকে ফোন দিবা না।তোমার জন্যে আমার পড়ালিখায় অনেক ক্ষতি হয়েছে।তুমি আর ভুলেও আমাকে ফোন দিবা না।ফালতু মেয়ে।আমার লাইফটা শেষ করে দিল।
:এই তুমি কি বলছ এগুলো। আমি তোমার লাইফ শেষ করে দিয়েছি?
:হুঁ।তুমিই শেষ করেছ।রাখো???
সেদিন এই বলেই ফোনটা রেখে দিল ও।আমি অনেক বার চেষ্টা করেছি।ফোন ধরত না।তারপর এক সময় বিরক্ত হয়ে সিমটাই বন্ধ করে দিল।
জানিস প্রথম সেদিন আমি কাঁদলাম। খুব কাঁদলাম। কেউ দেখি নি।কেউ কিছুই বলে নি।তবে ও কেন আমার সাথে এমন করল তা আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারি নি।
প্রথমে কষ্ট হলেও পরবর্তিতে নিজেকে সামলে নিলাম।আমি হাসতাম। না হাসতাম না।হাসার চেষ্টা করতাম। আমি হাসলেও সে হাসির মাঝে প্রান ছিল না।
আমার একটাই ভুল ছিল।একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এটাই হয়ত তার শাস্তি।
বেশ কিছুদিন পর,
১৪ই ফেব্রুয়ারি! ভালোবাসা দিবস! সবাই এই দিনে হাসবে।প্রেয়সী কে নিয়ে ঘুরবে। আনন্দ করবে ।মজা করবে।শেষ বিকেলে একে অপরের হাত ধরে হাঁটবে।আর আমি! আমি শুধু ঘরে বসে কান্না করব।পুরনো সৃতি গুলো আবার মাথায় নাড়া দিবে।সেগুলো ভেবেই আমি ভালোবাসা দিবস পালন করব।আমি এমনি ভেবে রেখেছিলাম।
রাত ১১:২২।আমি বসে আছি। মন খারাপ।আর কিছুক্ষন পরে প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরকে উইস করবে।এক সময় আমারো এমন মেসেজ আসত।কিন্তু আজ আসবে না।তবুও ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছি।
প্রায় আট মিনিট পার হয়ে গেল। হঠাৎ রোহানের নাম্বার থেকে ফোন আসল।অবাক হলাম! খুব অবাক হলাম! এতটাই অবাক হলাম যে ওর দুই তিনটা কল চলে এসেছে সেদিকে আমার খবর নেই।শুধু মোবাইলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।
জানিস সে রাতে ও এসেছে আমাদের বাড়ির সামনে। শুধু একটা বার দেখা করতে চাইছিল ও।নিজের ভুল গুলোকে তুলে ধরে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল।
অনেক অনুরুধ এর পর ওর সাথে সেই রাতে দেখা করলাম।আমি যখনই আমাদের গেট খুলে ওর সামনে গেলাম ও সোজা আমার পাঁয়ের নিচে চলে গেল।দুই পাঁ ধরে আমার কাছে ক্ষমা চাইল।
নাহ! আমি পারিনি।সেদিন ওর কান্নার কাছে নিজের রাগ অভিমান গুলোকে খুব নগন্য মনে হয়েছিল।তাই ক্ষমা করে দিলাম।
আবার শুরু হল আমাদের নতুন করে পথ চলা।ভালোই যাচ্ছিল।
এদিকে আমার এক্সাম প্রায় শেষ। আর দুইটা ব্যাবহারিক পরিক্ষা বাকি ছিল।
বাড়িতে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল।পাত্র ভালো হওয়াতে বাবা-মা প্রায় বিয়ে এক প্রকার ঠিক করেই পেলেছিল।তবে মতামত তাদের জানায় নি।মতামত টা পরে জানাবে এমনটাই তাদের বলেছিল।
এই বিষয়ে রোহানকে জানালাম। ও বলল,
:তুমিকি আমার সাথে পালাতে পারবে?
আমরা দুজনে বিয়ে করে নিব।পরে জানা জানি হলে বাবা- মা এমনিতেই মেনে নিবে।
আমি সেদিন নির্ভয়ে বলে দিলাম,
:হ্যাঁ তোমার সাথে আমি পালাতে পারব।তোমার হাতে হাত রেখে জিবন চলার অঙ্গিকার করেছে।তোমার পাশে থাকার অঙ্গিকার করেছি আমি।তোমাকে আমি হারাতে চাই না।তুমি যখন বলবে তখনি আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি।
আমিও খুশি আর সেও খুশি। দুটি পবিত্র ভালোবাসার মিল হবে।এটা তো খুশির খবরই।
.
পরিক্ষা শেষ।খুশিতে কাটছিল দিনকাল।
ডাটা অন করতে না করতেই মেসেঞ্জার এ টকিং টকিং করে কয়েকবার আওয়াজ করল।
রোহানের মেসেজ।কিছু বলতে চাচ্ছে ও আমাকে।
:আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।
তুমি তোমার বাবার-মায়ের দেখা ছেলেকে বিয়ে করে খুশিতে থাক।আর আমাকে ডিস্টার্ব করবে না।বাই।
মেসেজটা দেখে আমার যে কি হয়ে গিয়েছিল আমি বলে বুঝাতে পারব না।
সাথে সাথে ফোন দিলাম। ধরল না।আবার দিলাম।না এবারেও না।ধরছে না।কয়েকবার দেওয়ার পর যখন দেখলাম ধরছে না তখন মেসেজ দিলাম যে প্লিজ আমার ফোনটা ধর।আর কখনই ফোন দিব না।প্লিজ ধর।
এর পর ফোন দিলাম।হুম! সে ফোন ধরল।ওর কাছ থেকে সেদিন কারন জানতে চেয়েছিলাম। কেন সে আমার সাথে এমন করল? জবাবে সে বলল,
দেখ তোমাকে বিয়ে করলে আমার পরিবার কিংবা বাবা- মা কেউই মেনে নিবে না।তোমাকে তারা কেউই মেনে নিবে না।
পরিবার নামক একটা অজুহাত উঠিয়ে দিয়ে সে আমার কাছ থেকে চির বিদায় নিল।
ওর কাছ থেকে বিদায় এর পর আমি পুরোই পাল্টে যাই।বাবা-মায়ের সাথে অকথ্য ভাষায় কথা বলা শুরু করে দেই।আমার এ রুপ ব্যাবহার তারা হয়ত আসা করে নি।তাই তারা দুজনেই আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল।আর আমি পাগল এর মত হয়ে গিয়েছিলাম। নিজের চুল নিয়েই ছিঁড়ে ফেলতাম। নিজের হাত নিজেই কামড়ে রক্ত বের করতাম। আশ্চর্য বেপার হল কোন কষ্টই অনুভব করতে পারতাম না।এমন করে বেশ আনন্দই পেতাম।আমার এমন অবস্থা দেখে আমার বড় বোন আমাকে কক্সবাজার নিয়ে যায়।আমার এই রোগের এখন এই একটাই চিকিৎসা ছিল। আমার এই অবস্থা হতে কেটে উঠতে আমার বোন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
শেষমেষ বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম।
বাবা খুশি! মা খুশি! বোন খুশি! ভাই খুশি! আমি খুশি! তবে তা ছিল উপরে। ভিতরে হাহাকার।
একটা জিনিস আমি খুব লক্ষ্য করলাম,
আমার এই অবস্থার কারল সম্পর্কে বাবা বা মা কেউই কিছুই জিজ্ঞেস করে নি।
তবে আমার বড় বোন জানত আমাদের রিলেসন সম্পর্কে। তিনি হয়ত বাবা মাকে অন্য কিছু বুঝিয়েছে। কিন্তু তারা জানে না তাদের মেয়ে এখনো ভালো নেই।ভালো নেই।
বিয়ের দিনকাল এখনও ঠিক হয় নি।তবে হবে।বেশি দেরি নেই।
জানিস তাসফি। আমি এতটা আশ্চর্য জিবনে হই নি।পৃথিবী অষ্টম আশ্চর্য হয়ত এটাই হত।আমার তা মনে হয়েছিল।রোহান! যেকিনা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে একেবারেই। সে এখন আবার আমার লাইফে ফিরে আসতে চাইছে।আমি সত্যিই সেদিন খুব অবাক হই।খুব!! আমি তাকে বলি,
যে আমাকে একবার না কয়েকবার আমার হাতটা ছেড়েছে সে আর যাই হোক এই হাতকে আর ধরার ক্ষমতা রাখে না।ভালো থেকে।
এই বলে আমি ফোন রেখে দেই। এই নাম্বারটাও ব্লক লিষ্টে রেখে দেই।ওর যে কত নাম্বার এমন করেছি তা বলাই বাহুল্য। কিন্ত তারপরেও ও আমার সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে।ক্ষমা চায় সে।এখন আমার কি উচিৎ ওর কাছে আবার ফিরে যাওয়া?
অনুর এমন কথা শুনেই আমার মুখ দিয়ে আপনা আপনি বের হয়ে গেল,
:না।তোর আর উচিৎ হবে না ওর কাছে ফিরে যাওয়া।ও যতই ওর দোষ বুঝুক ওর কাছে আর ফিরে যাবি না।কেননা সে তোকে কয়েকবার ধোকা দিয়েছে।পরের বার যে দিবে না সে নিশ্চয়তা কি আছে।সে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেই নি। এবার বুঝুক দাঁতের মর্যাদা কতটুকু।
অনু শুধু বলল,
হুঁ।।
আমি আর কিছু বললাম না।অনুও কিছু বলল না।দুজনেই চুপ।পুরো প্রকৃতি চুপ।কোন শব্দ নেই।এর পরে আর কোনো শব্দ থাকে না।
হ্যাঁ অনু কাঁদছে।কাঁদুক।কষ্ট গুলো ঝরুক।
------------সমাপ্ত ---------------

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url