Love Story in Bangla | গল্পঃ বৃষ্টি পুকুর | তাসফি আহমেদ
Love Story in Bangla | গল্পঃ বৃষ্টি পুকুর | তাসফি আহমেদ
Love Story in Bangla | গল্পঃ বৃষ্টি পুকুর | তাসফি আহমেদ
গল্পঃ বৃষ্টি পুকুর তাসফি আহমেদ
-কোথাও যাচ্ছেন?
কিছুটা চমকাতে হলো। চলতি পথে হঠাৎ এমন প্রশ্ন আসলে খানিকটা চমকাতেই হয়৷ সেই প্রশ্ন যদি কোনো মেয়ের স্বর হয়ে আসে তাহলে তো কথাই নেই৷ আমি পাশ ফিরে তাকালাম। রিক্সায় বসে একটি রূপবতী মেয়ে বসে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তার চেহারার রাজ্যের কৌতূহল। আমি হাসলাম। এই হাসির অর্থ আমি মেয়েটাকে চিনতে পেরেছি৷ আসলেই চিনতে পেরেছি৷ বললাম,
-বের হলাম একটু।
-কোথায় যাবেন আপনি?
-কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নেই৷ এদিক সেদিক ঘুরব৷
-আমার সাথে আসুন না৷ এক সাথে যাই।
-সমস্যা নেই৷ আমি যেতে পারবো।
-আমার সাথে গেলে কি কোনো সমস্যা হবে?
-না না৷ তা কেন হবে।
-তবে?
আমি খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না৷ মেয়েটা আবার বলল,
-আপনার তো কোনো কাজ নেই৷ আমারও নেই৷ একা একা ঘুরার চেয়ে দু'জন মিলে ঘোরাটা কি ভালো নয়?
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
-তা ভালো। তবে...
-কোনো তবে টবে নেই৷ চলুন টিএসসিতে যাই৷ চা খাওয়াবো আপনাকে।
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না আর৷ ওর সাথে রিক্সায় চড়ে বসলাম। বললাম,
-চা খাওয়া যায়৷
মেয়েটা হাসলো। কিছু বলল না৷ চেহারায় একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে সামনের দিকে তাকালো। তাকে ভীষণ খুশি খুশি দেখালো৷ চট করেই যেন মেয়েটার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ যেন হঠাৎ বেশ আনন্দের কিছু ঘটে গেছে। আমি আড় চোখে দেখলাম তাকে। মেয়েটাকে যে আজ অসাধারণ লাগছে তা কি সে জানে?
এই মেয়েটাকে আমি অনেক আগ থেকেই চিনি৷ আজ প্রায় মাস ছয়েক হবে৷ চিনি বলতে তেমন জানাশোনা নেই৷ তার সাথে দেখা হতো রুদ্ধদের বাসায় গেলে। রুদ্ধ আমার স্টুডেন্ট। ওকে পড়াতে গেলেই এই মেয়েটার সাথে দেখা হতো৷ তার নাম নিশি। নিশির সাথে মেক্সিমাম সময় লিফটের কাছেই দেখা হতো আমার৷ প্রথম প্রথম আমরা কেউই কোনো কথা বলতাম না৷ এরপর ধীরে ধীরে আলাপালোচনা শুরু হয়৷ তবে সেটা হাই হ্যালো এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেমন আছি, দিনকাল কেমন যাচ্ছে এই টাইপ প্রশ্ন গুলোই হতো আমাদের মাঝে। ফর্মাল আলাপালোচনা। আমি তেমন কিছু বলতাম না৷ অপরিচিত মানুষদের সাথে মিশতে আমার কিছুটা সময় লাগে৷
নিশিদের বাসা ছিল রুদ্ধদের বাসার অপজিটেই৷ তাই দেখা সাক্ষাৎ একটু বেশিই হতো৷
আমি বললাম,
-কই গিয়েছিলেন?
নিশি হাসলো৷ বলল,
-আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায়। আপনাদের এদিকেই থাকে। নাম রুমা।
-আচ্ছা৷
আমি আর কিছু বললাম না। চুপ করে গেলাম। আসলে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। কথাই খুঁজে পাচ্ছি না যেন৷ কিছু সময় বেশ নীরবতায় কেটে গেল। নিশি বলল,
-আচ্ছা আমি আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম না তো?
-না। বিরক্ত করেননি।
-আপনি কি সব সময়ই এমন চুপচাপ থাকেন?
-জি না।
-তাহলে? এখন যে এতো চুপচাপ হয়ে আছেন?
-আমি চট করেই কারো সাথে মিশে যেতে পারি না। একটু সময় লাগে৷
-বেশ। তবে আমাদের কিন্তু আগে থেকেই কথা হতো৷
-হতো। তবে এতোটা গাঢ় নয়৷
-তা ঠিক। আসলে আমি নিজেও কারো সাথে চট করেই মিশে যেতে পারি না৷
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না৷ আমাদের মাঝে আরো কিছু সময় বেশ নীরবতায় কেটে গেল।
তবে এতোক্ষণে মেয়েটার একটা সমস্যা আবিষ্কার করা গেল। খুবই মারাত্মক একটা সমস্যা৷ এই মেয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে৷ একদম চোখে চোখ রেখে। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। সে এমন তাকালেও বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠে৷ কী জানি অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়৷ তাছাড়া কেউ যদি আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলে তবে আপনি তখন তার দিকে তাকাতে পারবেন না৷ তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবেন না৷ আপনাকে কথা বললে আশপাশে তাকিয়ে বলতে হবে৷ আমার ক্ষেত্রেও সেটা হচ্ছে৷ আমি মেয়েটার দিকে তাকাতে পারছি না৷ আমাকে অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হচ্ছে৷ এই ব্যাপারটা ওর টের পেয়ে যাওয়ার কথা৷ ছেলেদের অতি সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ব্যাপার গুলো মেয়েরা টের পেয়ে যায়৷ সত্যি বলতে ছেলেরা চাইলেও সব সময় সব কিছু মনের ভেতর লুকিয়ে রাখতে পারে না। মেয়েরা ঠিক সেটা বুঝে নেয়৷ এটা সৃষ্টা প্রদত্ত তাদের প্রতি উপহার স্বরূপ।
নিশি চট করেই বলে উঠলো,
-কয়েক দিন ধরে টিউশনিতে যাচ্ছেন না মনে হয়৷
-জি।
-কেন?
-টিউশনটা ছেড়ে দিয়েছি।
-কেন? ছেড়ে দিলেন কেন?
মেয়েটা যেন আকাশ থেকে পড়লো৷ তার চেহারায় রাজ্যের অবাক ভাব এসে জড়ো হলো৷ চট করেই চেহারাটা কেমন জানি হয়ে এলো৷ আমি বললাম,
-বাচ্চাদের পড়াতে আর ভাল্লাগে না৷
নিশি আমার দিকে চেয়ে থাকলো কিছু সময়। তারপর মাথা নিচু করে বলল,
-ও।
আর কোনো কথা বলল না৷ চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ তার চেহারার উজ্জ্বলতা যেন বিলীন হয়ে গেল৷ যেমন প্রচণ্ড রোধের মাঝে হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যায়! তেমন। নিশির আকাশে মেঘ করেছে। তার সকল উজ্জ্বলতা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। নিশির কি খুব মন খারাপ হয়েছে? হঠাৎ কি ওর চোখে পানি চলে এলো? সে জন্যেই কি সে মাথা নিচু করে আছে? আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম ভালো করে৷ তার চেহারা কেমন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে৷ খুব কষ্ট পেলে যেমন হয় তেমন। আমি কি তাকে খুব কষ্ট পাবে এমন কোনো কথা বলেছি? কই আমার তো তা মনে হয় না!
আমি নিশির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। রোদের তাপটা কেমন মরে এসেছে। মিষ্টি মিষ্টি লাগছে৷ ঠান্ডা একটা বাতাস চট করেই আমার গা ছুঁয়ে গেল। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো৷ আমি উত্তর আকাশের দিকে তাকালাম। সে দিকের আকাশটা বেশ কালো হয়ে আছে৷ সেদিকে বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়৷
আমার মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। বৃষ্টি এলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়৷ যেন রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে আসে বৃষ্টিরা৷ এতো ভালো লাগে! আমার খুব ভিজতে ইচ্ছে হয় তখন৷ সময়-সুযোগ হলে ভিজিও৷ সুযোগ থাকলে ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখতে নেই৷ আমি আকাশের দিকে চেয়ে বললাম,
-বৃষ্টি হবে৷
নিশি কিছু বলল না। সে আগের মতোই চুপচাপ থাকলো। আমি বললাম,
-আপনার কি বৃষ্টি পছন্দ?
সে মাথা নাড়ালো। তার বৃষ্টি পছন্দ৷ আমি বললাম,
-আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ?
-জি৷
-কেন? মন খারাপ কেন?
-বৃষ্টি আসার আগে আমার মন খারাপ হয়৷
-বৃষ্টি না আপনার পছন্দ?
নিশি আমার দিকে তাকালো৷ আমার চোখে চোখ রাখল। বলল,
-হ্যা৷ পছন্দ। পছন্দের জিনিস আসছে শুনলেই কেমন মনটা খারাপ হয়ে যায়৷ একটা সময় যে অপেক্ষাটা আমি করতাম সেটা এখন আর আমাকে করা লাগবে না। বছরের প্রথম বৃষ্টি হয়েই যাবে। শুনুন, অপেক্ষার মাঝেও তীব্র একটা আনন্দ আছে৷ নেশা আছে৷ চট করেই সেই আনন্দ কিংবা নেশা কেটে গেলে মন খারাপ হয়৷ সেই অপেক্ষার আনন্দটুকু পাবো না বলে মন খারাপ হয়। আমারও তাই হচ্ছে৷ বুঝতে পেরেছেন?
আমি ওর দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। বললাম,
-জি৷
হঠাৎ আমাকে কেমন নীরবতা চেপে ধরলো৷ চোখের উপর নিশির চট করেই তাকিয়ে থাকাটা ভাসতে থাকলো৷ তার চোখ দুটো আমি দেখছি। কী তীব্র বিষাদ সেখানে৷ কী ভীষণ কালো তার বদন৷ যেন অন্তরে অন্তরে কোনো গোপন ব্যাথা তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছে৷ আশ্চর্য ব্যাপার৷ এই ব্যাপারটা নিশির মাঝে আগে কখনও দেখিনি৷ আজ দেখলাম। কেবলই আজ দেখলাম। হঠাৎই আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠলো৷ কেমন অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব হলো৷ মনে হলো আমি মেয়েটার ব্যাথা অনুভব করতে পারছি৷ খুব কাছ থেকেই পারছি৷
আমরা টিএসসিতে বসলাম। ততোক্ষণে এদিকের আকাশটায় মেঘ জমে গিয়েছে৷ মিষ্টি একটা বাতাস চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই ছুঁয়ে দিচ্ছে৷ নিশি চায়ের কাপ আমার দিয়ে বাড়িয়ে দিলো। আমি কাপটা নিয়ে বললাম,
-আপনি ওটা অনুভব করছেন?
-কোনটা?
-মিষ্টি একটা বাতাসে৷ গায়ে লাগলেই ভীষণ আরাম লাগে৷ আমি কি সেটা অনুভব করছেন না?
-করছি৷
-তারপরও আপনার মন খারাপ হয়ে আছে?
-একটু একটু৷
-আরেকটু অনুভব করুন৷ দেখবেন মনটা ভালো হয়ে যাবে। এই বাতাসটাই এমন৷ বৃষ্টি আসার পূর্বে সে নিজে এসে জানিয়ে যায় এখন বৃষ্টি হবে৷ তার প্রতিটি স্পর্শই তাই বলে৷ আর তার এই স্পর্শটাই অনিন্দ্য। ভ্যাপসা গরমের মাঝে কেমন শীতল শীতল মিষ্টি এক অনুভূতি জাগায় মনের ভেতর৷
নিশি চুপ করে থাকলো৷ কিছু বলল না৷ সে এক মনে চা পান করছে৷ তার দৃষ্টি মেঘ ভর্তি আকাশের দিকে। চোখে মুখে যেন তীব্র অভিযোগ। ভীষণ বিষাদ৷
চা খাওয়ার পর আমরা আরো কিছু সময় সেখানে বসে থাকলাম। আকাশ তখন প্রথম বারের মতো গর্জন দিলো৷ ঠিক সে সময় নিশি বলল,
-আমার সাথে এক জায়গায় যাবেন?
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
-কোথায়?
-আছে একটা জায়গা৷ আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা৷ যাবেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-যাওয়া যাক৷
আমাদের রিক্সা নিশির প্রিয় জায়গাটির দিকে ছুটে চলল। আকাশ তখন আরো মেঘলা হয়। চারদিকের আলোটা কেমন কমে এলো। বৃষ্টি আসার প্রস্তুতি আরো গাঢ় হলো৷ আকাশ আবারো দু'একটা গর্জন দিলো৷ সেই গর্জন আমার পাশের মেয়েটির মাঝে প্রভাব ফেলছে না৷ সে চুপচাপ বসে আছে৷ কোনো অভিমানী রমনীর মতো। কিংবা সে-ই সেই অভিমানী রমনী৷ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মেয়েটির মাঝে আজ কোনো কিছুই প্রভাব ফেলবে না। কোনো প্রকার প্রভাবকও তাকে প্রভাবিত করতে পারবে৷ সে আজ ডুবে আছে৷ গভীর বিষাদে ডুবে আছে৷
বেশ কিছু সময় পর আমাদের রিক্সা থামলো৷ রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এদিকের রাস্তাটা সরু৷ চারদিকে ঘাস। রিক্সা যাওয়ার উপায় নেই৷ আমি বললাম,
-বৃষ্টি এলে পালাবার জায়গা পাবো?
মেয়েটি জবাব দিলো না৷ সে সামনের দিকে হেঁটে গেল। আমি তার পেছন পেছন গেলাম। অল্প কিছু পরেই আমরা একটা পুকুরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ছোটখাটো একটা পুকুর৷ ইট দিয়ে বাধাই করা একটা সিড়ি আছে। নিশি ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নামতে থাকলো৷ কিছুদূর নেমে বলল,
-আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
-না তো৷
-জায়গাটা পছন্দ হয়নি?
-বেশ হয়েছে।
-আমার সাথে নিচে নামবেন না?
-আপনি কি পুকুরে নেমে যাবেন?
নিশি কেমন করে যেন হাসলো৷ কিছু বলল না আর। নিচের দিকে নেমে গেল। শেষ সিড়িতে গিয়ে সে বসে পড়লো। পানিতে পা চুবিয়ে বসলো৷ এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-নামতে ভয় করছে?
আমি হাসলাম। বললাম,
-পুকুরকে আমি ভয় পাই না৷ সাঁতার জানি৷
-তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন যে?
আমি নিচের দিকে নামতে নামতে বললাম,
-আপনাকে দেখছিলাম।
-আমার মাঝে দেখার মতো তো বিশেষ কিছু নেই।
আমি হাসলাম। বললাম,
-অবাক হচ্ছি। আপনি জায়গার খোঁজ কীভাবে পেলেন?
নিশি মৃদু হেসে বলল,
-ভার্সিটির এরিয়াতেই পড়ে৷ মাঝে মাঝে আসা হয়।
আমি ওর পাশে বসে বললাম,
-প্রায়ই আসেন?
-যখন মন খারাপ থাকে তখন৷
-এসেই এভাবে পানিতে পা চুবিয়ে বসে থাকেন?
-জি।
-এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগে?
-খুব ভালো লাগে৷
-চারপাশটা যেন এতো নীরব তারউপর আজ এমন অন্ধকারভাব, আপনার কী ভয় করছে না?
-মাঝে মাঝে মনের ব্যাথাটা ভয়ের চেয়ে তীব্র হয়৷ তখন এমন ভয় গায়ে লাগে না।
-আপনার মন খারাপ কেন?
নিশি মাথা নিচু করে নিলো৷ অনেকক্ষণ কিছু বলল না৷ আমি বললাম,
-একটু আগেও ঠিক ছিলেন৷ হঠাৎ করেই দেখলাম কেমন জানি হয়ে গেলেন৷ কী হয়েছে?
নিশি এবারেও চুপ থাকলো। আমি আবার বললাম,
-এই যে এই আবহাওয়াটা দেখছেন না? চারদিক কেমন আবছা আবছা অন্ধকার, কেমন দমবন্ধকর নীরবতা, আমার কী মনে হয় জানেন? আমার মনে হয় আমি গত আধঘন্টা ধরে এই অভিমানী আবহাওয়াটাকে আমার সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি৷
নিশি আমার দিকে ফিরলো৷ তার চেহারায় সেই বিষাদ। চোখ দুটো কী ভীষণ শূণ্য হয়ে আছে৷ আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
-নিশি?
সে আমার দিকে আরেকটু ভালো করে তাকালো৷ আমি বললাম,
-আমাদের ওইদিকে রুমা নামে আপনার কোনো বান্ধবি নেই তাই না?
নিশির চোখ দুটো কেমন শক্ত হয়ে এলো৷ ভ্রুটা কুচকে এলো৷ সে চেহারায় রাজ্যের অবাক মেখে আমার দিকে চেয়ে থাকলো৷ ঠিক এমন সময় বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল। বড় বড় ফোটা পুকুরে পড়তে থাকলো৷ কিছু এসে আমাদের গায়ে আছড়ে পড়লো৷ আমি আবার বললাম,
-আপনি আমার জন্যে এখানে এসেছেন তাই না?
নিশি মাথা নিচু করে নিলো৷ অল্প কিছু পরেই বলল,
-ভেতরটায় ভীষণ হাসফাস শুরু হয়ে গিয়েছিল।
নিশি থামলো৷ আমি তার দিকে চেয়ে থাকলাম। তখন মুশলধারায় বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে৷ আমরা দু'জন ভিজে যাচ্ছি৷ অথচ আমাদের কোনো খবর নেই৷ বৃষ্টির আনন্দের চেয়ে আমার এই মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছে৷ তার চোখের শূন্যভাব আমার ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে৷ কারণ আমি জানি শূন্যভাবটা আর কিছু না৷ এটা কেবল আমিই৷ নিশি বলল,
-সেই প্রথম থেকেই আমি আপনার প্রতি উইক ছিলাম। আপনি ভাবছেন আপনার সাথে প্রায়ই কাকতালীয় ভাবে আমার দেখা হয়৷ এটা আপনার ভুল ধারণা। আপনার সাথে দেখা হবার প্ল্যান আগ থেকেই করা থাকে। প্রতিদিন প্ল্যান থাকে বাড়তি কিছু কথা বলার। কিছু জানতে চাওয়ার৷ কিংবা একদিন একসাথে কফি খাওয়ার আবদার৷ আপনার সাথে দেখা হতো ঠিকই তবে বাড়তি কোনো কথাই হতো না৷ কোনো কথাই আগাতো না৷
নিশি কেমন ফুঁপিয়ে উঠলো৷ আমি তার দিকে চেয়ে থাকলাম। সে কিছু সময় নীরব থেকে বলল,
-কতো প্র্যাক্টিস করলাম৷ আয়নায় দাঁড়িয়ে আমাকে আপনি বানিয়ে আপনার সাথে কতো কথা বলতাম! সকল চেষ্টা প্রতি বেলাতেই বৃথা গেল। আমার কষ্ট বাড়লো। বুকের ভেতরটা কেমন জানি করতো৷ জানেন, খুব ইচ্ছে হতো আপনাকে পাশে নিয়ে হাঁটি৷ আপনার চোখে চোখ রাখি। চুলে হাত বুলিয়ে দেই৷ ইচ্ছে গুলো তো দূরে থাক, আমি আপনাকে একটা কফির জন্যেও বলতে পারতাম না৷ আমার আপনাকে চাই, আমার আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন এই কথাটা না বলতে পারার যে পীড়াটা সেটা প্রতিবেলায় গিলতে হয়েছে আমাকে। মানুষটা একদম আমার কাছে৷ অথচ আমি তাকে ছুঁতে পারি না৷ তাকিয়ে দেখতে পারি না৷ এরচে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে বলুন৷
নিশি থামলো। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছলো৷ সে ভিজে একাকার৷ তার চোখের পানি বৃষ্টির পানি আজ এক হয়ে গিয়েছে৷ সে আবার বলল,
-এই যে একটু আগেই বলে ফেললেন, আপনি আর যাবেন না পড়াতে এটা শুনেই আমার ভেতরটা নড়ে গেল। কী এক কষ্ট দলাপাকিয়ে উঠল ভেতরটায়। আপনি জানেন না, আপনার জন্যে প্রতি বেলা কী তীব্র অপেক্ষা করি আমি। আপনি আজ এক সপ্তাহ যাচ্ছেন না। এই একটা সপ্তাহ আমি আপনাকে দেখিনি৷ আমার মনে হচ্ছে আমি যেন কোনো বিষাদ স্তুপে পড়ে গিয়েছি৷ মনে হচ্ছে খুব মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছি৷ আমার সবচে প্রিয় কিছু আমার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে৷ দূরে চলে যাচ্ছে৷ এটা যে কী বেদনার! কী এক কষ্টে কাটলো দিন গুলো৷ কী এক দমবন্ধকর সময়! কী তীব্র ব্যাথা৷ আপনাকে বোঝাই কী করে? আমি তো কিচ্ছু বলতে পারি না৷ বোঝাতে পারি না৷
নিশি এবার শব্দ করে কান্না করলো৷ দু'হাত দিয়ে মুখ চেপে সে কান্না করতে থাকলো৷ তার কান্নার শব্দ আর বৃষ্টির শব্দ মিলে কী এক অনবদ্য সুর তুলল। কী মোহময় সেই সুর! আম তার দিকে আরেকটু চেপে গেলাম। স্বল্প যে গ্যাপটুকু ছিল সেটা পূরণ করে বসলাম৷ বললাম,
-টিউশনিটা ভালোই ছিল৷ মোটা অংকের বেতন পেতাম। কিন্তু আপনার জন্যে সেটা ছাড়তে হলো৷
নিশি মুখ থেকে হাত সরিয়ে কোলের উপর রাখলো৷ চোখ ভরা পানি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমার জন্যে কেন?
আমি মৃদু হাসলাম। তার ডান হাতটা আমার হাতের ভাঁজে নিলাম। কী নরম তুলতুলে হাত৷ কেমন শীতল হয়ে আছে। আমি বললাম,
-আমি যে বাসাতে পড়াই সে বাসাতেই আমার প্রেমিকা থাকে - এই ব্যাপারটা আমার জন্যে বড়ই অস্বস্তিকর। লোকে পরে বলবে মাস্টার পড়াতে আসে না৷ প্রেম করতে আসে। ব্যাপারটা শুনতেই কেমন জানি লাগে৷ তোমার লাগে না?
নিশির গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছিল বোধহয়। ঠিক বোঝা গেল না৷ বৃষ্টির পানিতে তার মাথার চুল গুলো সামনের দিলে লেপ্টে আছে৷ আমি সে গুলো এক পাশে সরিয়ে দিয়ে বললাম,
-তোমাকে আমি আগ থেকেই লক্ষ্য করছিলাম। তোমার প্রতি আমার অন্য রকম দূর্বলতা ছিল৷ তোমাকে দেখার পর মনে হয়েছে আমার এই মেয়েটাকে চাই৷ কেবল এই মেয়েটাকেই চাই। নিশি তুমি জানো না তোমার চোখ কতো গভীর৷ তুমি একবার আমার দিকে তাকালে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে। বুকের ভেতর ধপ ধপ শব্দটা কেমন যেন বেড়ে যায়৷ আমি প্রথমে এসব ঠিক ভাবে অনুভব করিনি৷ যখন অনুভব করলাম তখন মনে হলো এবার একটা শুরু করা যায়৷ আর কতোকাল একা থাকবো৷ এবার একটা প্রেম করাই যায়৷ সে জন্যেই আমি টিউশনটা ছেড়ে দেই৷ এবং সত্যি বলতে আজ তোমাদের বাসার উদ্দ্যেশ্যেই আমি বের হয়েছিলাম। তোমাদের এলাকাটা ঘুরে আসবো৷ এর ফাঁকে মহারানীর দেখা মিলে যায় তবে তো কথাই নেই৷ কিন্তু হলো উল্টোটা। দেখলাম তুমি নিজেই এসেছ। তোমার কোনো বান্ধবির বাসায়৷ তখন আসলে ব্যাপারটা ধরে ফেললাম। শুনুন মিস নিশি, আপনার সম্পূর্ণ বায়োডাটা আমি ঘেটে ফেলেছি৷ আপনি কোথায় যান, কী করেন, কার সাথে মিশেন এই সব কিছুই আমার জানা৷ তাই এই বান্ধবির গল্পটা সহজেই ধরা ফেললাম৷ আমার জানা মতে এদিকে আপনার কোনো বান্ধবি তো দূরে থাক, কোনো দূর সম্পর্কের আত্মিয়ও নেই৷ একটু দ্রুত ভাবতে হলো৷ এরপর টিউশন ছাড়ার কথা শুনে আপনার চেহারার মেঘবর্ণ হাল দেখেই সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম যে তিনি আমাকে ভালোবাসেন। বাসেন না?
নিশি এখনও আমার দিকে চেয়ে আছে৷ তার চোখে জল। চেহারায় অবাক ভাব৷ অথচ চেহারার মেঘটা কেটে গিয়েছে৷ চেহারাটা কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷ কী প্রশান্তি সেখানে। আহা! কী মুগ্ধকর দৃশ্য। কী অনিন্দ্য! নিশি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমি কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমি হাসলাম। বললাম,
-নিশি আমার তোমার সাথে বৃষ্টি ভেজার ভীষণ সখ ছিল। তোমার হাত শক্ত করে ধরে রেখে একসাথে বৃষ্টি দেখার সখ ছিল৷ আজ কাকতালীয় ভাবে আমার সখ গুলো পূরণ হয়ে গেছে৷ আমি চাই এটা চলতে থাকুক৷ আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলতে থাকুক৷ আমরা একে অপরের সখ-আহ্লাদ পূরণের সঙ্গি হয়ে থাকবো৷ আজীবন থাকবো৷ নিশি তুমি কি আমার সঙ্গি হবে? আমার বাকি জীবনের একমাত্র সঙ্গি?
নিশি কিছু বলল না৷ জড়িয়ে ধরলো আমায়৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো কেবল। বলল,
-আমি তোমার বাকি জীবনের একমাত্র সঙ্গি হতে চাই৷ আমাকে গ্রহণ করো৷ গ্রহণ করো৷ গ্রহণ করো৷
আমি মৃদু হাসলাম। কিছু বললাম না৷ তাকে আরেকটু জড়িয়ে ধরে রাখলাম কেবল।
গল্পঃ বৃষ্টি পুকুর৷
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
-তাসফি আহমেদ।