গল্পঃ মেয়েটি ফিরে এসেছে
পিয়নের কথাটা শুনে একটু অবাকই হলাম। আমার সাথে কেউ দেখা করতে আসবে? বিশ্বাস হয় না। এই ইটপাথরের শহরে আমার সাথে দেখা করার মত তেমন কেউ নেই। অন্তত অফিসে এসে দেখা করার মতো তো না-ই। আমি নিতান্তই বেশ ছোট প্রকৃতির একটা ছেলে। কারো সাথে তেমন বন্ধুত্ব নেই আমার। যারা ছিল তাদের কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। নিজে একা থাকি। সাথে থাকে ভালো-খারাপ লাগার মতো কিছু স্মৃতি। এইতো। দিন বেশ ভালোই চলে যাচ্ছে আমার। সেটা চিন্তার বিষয় না। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে আমার সাথে কে দেখা করতে আসলো। আমি বললাম,
-আমার সাথেই দেখা করতে এসেছে?
সে হাসল। বলল,
-জ্বী স্যার। আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছে। বসতে বলবো?
আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আশ্চর্য কে আসবে আমার সাথে দেখা করতে। কে আসবে? ঠিক তখনই আমার কালকের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। এনি আসে নি তো? এই মেয়ের বিশ্বাস নেই। চলে আসতে পারে। আর ওর সাথে দেখা করলে যে কি হবে সেটা আল্লাহই ভালো জানে। আমি জলদি করে ফোন বের করে পিয়নকে এনির একটা ছবি দেখালাম। উনি এক গাল হেসে বলল,
-হ্যাঁ! ইনিই এসেছে।
আমি কেবল স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এনি চলে এসেছে? আমার অফিসে চলে এসেছে? এই অফিসের খোঁজ পেয়ে গেছে ও? হায় হায়! এখন? এখন কি হবে? কি করবো এখন আমি? ধুর! নিজের উপরই রাগ হচ্ছে এখন। কেন যে কাল ধানমন্ডি গেলাম! ধ্যাত!
আমি পিয়নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আরে! ইনি হাসছেন কেন? কেন হাসছেন? আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম,
-বসতে বলুন। আমি আসছি।
আমি ভাবলাম এই কথা শুনার পর উনি চলে যাবেন। আশ্চর্য! উনি গেলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন কেবল। চরম অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। আমি মরছি আমার জ্বালায় আর উনি মহাশয় হাসছেন! আমি আরেকটু কড়া স্বরে বললাম,
-কি ব্যাপার যাচ্ছেন না কেন?
উনি আমার কথার কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না। উল্টো উনি হাসলেন। জিজ্ঞেস করে বসলেন,
-বউ নাকি গার্লফ্রেন্ড?
আমি এবার চরম পর্যায়ে অবাক হলাম। বললাম,
-সেটা জেনে আপনি কি করবেন? আপনাকে যা বলেছি তা করেন। যান।
আমার মেজাজটাই এবার খারাপ হয়ে গেল। আরে ভাই আমার বউ হোক বা গার্লফ্রেন্ড হোক তাতে উনার কি প্রব্লেম। কেন উনি এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করল? উনি তখনো যান না। মুচকি হেসে বললেন,
-সম্পর্কে একটু আধটু প্রব্লেম হবেই। তাই বলে রাগারাগি করে,মন খারাপ করে থাকা কিন্তু ঠিক না।
আমার রাগটার তীব্রতা এবার লিমিটের বাইরে যেতে থাকল। কোন রকমে নিজেকে কন্ট্রোল করে বললাম,
-চাচা, উনি আমার আগের অফিসের বস। তেমন কেউ না।
উনার মুখের হাবভাবটা এবার চট করেই পাল্টে গেল। বলল,
-ও আচ্ছা। আমি দুঃখিত। আমি ভাবলাম...
-থাক। বাদ দিন। এখন যান। তাকে গিয়ে বসতে বলেন। চা টা দিন।
পিয়ন চলে গেল। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। মাথার মাঝে যেন একশো কেজি ওজনের কোন পাথার চাপা পড়ল। কিভাবে যে ও আমার খোঁজ পেয়ে গেল? কিভাবে পাবে? আমার জন্যেই পেয়েছে। আমার জন্যেই। দোষটা আমারই। কি দরকার ছিল কাল ধানমন্ডি যাওয়ার।কোন দরকারই ছিল না যাওয়ার। না গেলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হতো না। কিন্তু অফিসের কাজ বলে কথা। যেতেই হয়েছে। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। ঠিক তেমনটাই ঘটল। অবশ্য আমার মাঝেও খানিকটা ভয় কাজ করছিল কারন এনিদের অফিস ওই দিকেই। তবুও বেশ সতর্ক ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। আমাদের অফিসেরই গাড়ি। ড্রাইভারকে নামিয়ে দিয়ে আমি নিজেই ড্রাইভ করে আসলাম। । সাথে শফিক ভাই ছিলেন। যখন ঘটনাটা ঘটল তখন রাস্তায় বেশ জ্যাম ছিল।আমাদের গাড়িটা রাস্তার একেবার পাশে ছিল।পাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি গুলো বিপরিত দিকে সাঁই করে চলে যাচ্ছে|এটা টু ওয়ে রোড|একদিক দিয়ে যায়|অন্যদিক দিয়ে আসে|আর জ্যাম লাগলেও বেশিক্ষণ থাকে না|আমি জ্যাম ছাড়ার অপেক্ষায় করছিলাম|মনে খানিকটা ভয় কাজ করছে|ভুলেও যদি এনির সাথে একবার দেখা হয়ে যায় তাহলে আর লুকিয়ে থাকা যাবে না|মেয়েটা আমাকে আর লুকিয়ে থাকতে দিবে না|ঠিক ঠিক খুঁজে নিবে|ওকে চেনা আছে আমার|অবশ্য এত মানুষের ভীড়ে আমাকে খুঁজাটা একটু কঠিনই হবে|সেটা নিয়ে ভয় নেই|ভয় কেবল এই জন্যে যে ও যেন আমাকে দেখে না ফেলে|দেখলেই আমার এত দিনের লুকিয়ে থাকার ফল বৃথা যাবে|আমি মনে কিঞ্চিত ভয় নিয়ে বসে বসে কথা গুলো ভাবতে থাকলাম| ঠিক তখনই দেখলাম একটা মেয়ে হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে|মেয়েটা গাড়ির গ্লাসে টোক দিল|আমি অপেক্ষা করলাম না|গ্লাস খুলে দিলাম|ধানমন্ডির এই রোডে আসলেই এমন কয়েকটা ছেলে মেয়েকে দেখাটা আমার প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে গিয়েছিল|এনির সাথে আসলে ও প্রায়ই ছেলে-মেয়ে গুলোর কাছ থেকে গোলাপ নিত|আমি যত দিন দেখেছি ততদিন ওকে এক তোড়া গোলাপের দাম পাঁচশ টাকার কমে দিতে দেখি নি|ওর এই ব্যাপারটা আমার খুবই ভালো লাগত|আমি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখতাম|ছোট্ট মেয়েটা বলল,
-স্যার গোলাপ নিবেন?
আমি হাসলাম কেবল|পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে ওকে দিয়ে গোলাপের তোড়াটা হাতে নিলাম|মেয়েটা খানিকটা অবাক হয়ে মুখ মলিন করে নোটটার দিকে তাকাল|আমি মৃদু হেসে বললাম,
-পুরোটা রেখে দাও|
মেয়েটার মুখটা যেন চট করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল|একটু হাসল|তারপর এক দৌড় দিল|কাজটা করে আমি সত্যিই খানিকটা আনন্দ পেলাম|যাক এনির একটা সখের কাজ করতে পেরেছি|কে জানি ও এখন এসব করে কি না|জ্যাম ততক্ষণে একটু একটু ছাড়তে শুরু করেছে|আমি গাড়ির গ্লাস উপরে উঠাতে যাব ঠিক তখনই চোখ গেল পাশের রাস্তাটার দিকে|চমকালাম! কালো রঙের একটা কার দাঁড়িয়ে আছে|কারটাকে চেনা চেনা লাগল আমার|গাড়ির পিছনের সিটের গ্লাসটা চট করেই খুলে গেল|ঠিক তখনই একটা চেনা মুখ দেখতে পেলাম|আমার বুকের বাঁ পাশটা যেন একটু কেঁপে উঠল|কি করব ঠিক ভেবে পেলাম না|এনির মুখটা মলিন হয়ে ছিল|যেন চাপা কোন কষ্টে ভুগছে ও|ও সরু চোখে আমাকে একটু দেখল|আমিও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।আমার সাথে ওর চোখচোখি হতেই আমি খানিকটা কেঁপে উঠলাম। পুরো গা যেন শিরশির করে উঠল।হায়! মেয়েটার চেহারার এই অবস্থা কেন? একটু যত্নও নেয় না নাকি! কিছু সময় পার হতেই দেখলাম ও গাড়ির দরজা খুলছে ঠিক তখনই আমি গাড়ি সামনে নিতে থাকলাম|জ্যাম অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছে|আমার গাড়ির পিছন থেকেও অন্য গাড়ি গুলোর হর্ন আসছিল|অনেকে তো গালাগালি শুরু করে দিয়েছিল|আমি আবার এনির দিকে তাকালাম|মেয়েটা রাস্তায় নেমে পড়েছে|খানিকটা দৌড়ে এল আমাদের গাড়ির দিকে|আমি সামনের দিকে তাকালাম|গাড়ির স্পীড বাড়ালাম|এনি আমার নাম ধরে ডাকল|এত গাড়ির আওয়াজ থাকার সত্বেও আমি এনির কোমল কন্ঠটা ঠিক শুনতে পেলাম| বুকটা যেন আবার কেঁপে উঠল। কত দিন ওর কণ্ঠ শুনি না! অদ্ভুত সুন্দর এনির কন্ঠ|আমার খুব ভালো লাগে|আমি গাড়ির গ্লাসটা উপরে উঠালাম|এবার হাজার ডাকলেও আমি ওর ডাক শুনবো না|ওর ডাক শুনলে আমি না যেয়ে থাকতে পারবো না|অদ্ভুত একটা আকর্ষন যেন আমায় সেদিকে টেনে নেয়|লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলাম|এনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে|মুখ মলিন| কাছে থাকলে নিশ্চিত ওর চোখে জল দেখতাম|ওর গাড়ি রাস্তায় থামাতে একটু জ্যাম বেধে গিয়েছে|লোকজন বকাঝকা করছে এজন্যে|ওকে দেখলাম একদৃষ্টিতে আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে|মেয়েটা একটু পাগল টাইপের|আমি নিশ্চিত,যত যাই হোক আমার গাড়ি চোখের আড়াল হওয়া ছাড়া ও ওর অবস্থান থেকে একটুও নড়বে না|মোটেও না|এটা আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি|আমি দ্রুত গাড়ি চালালাম|আর লুকিং গ্লাসে দেখতে থাকলাম|মেয়েটার জন্যে সত্যিই খুব খারাপ লাগছে|ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি|সব ইচ্ছে পূরণ হয় না|এটাও হবে না| আমি জানি হবে না এবং হয়ও নি।
ওই ঘটনার পর থেকেই আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আমার আর লুকিয়ে থাকা হবে না। এনি ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করে নিবে। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে তা আমার কল্পনায় ছিল না। সত্যি বলতে আমি ভাবতেও পারি নি। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। কি করা যায় সেটা ভাবছিলাম। অনেক ভেবে বসের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। শরীর খারাপের বাহানা করে ছুটি নিয়ে নিলাম। আসার সময় পিয়নকে বললাম যে উনাকে বলে দিয়েন যে আমি উনার সাথে দেখা করবো না। উনি যেন চলে যায়। এই বলে অফিসের পিছনের দরজা দিয়ে চলে এলাম। আমার কেন জানি ভালো লাগছিল না। মেয়েটাকে একা রেখে চলে আসতে আমার মোটেও ভালো লাগে নি। আর যাই হোক এক সময় তো আমার বস ছিল। এটা ঠিক হয় নি। তবে অন্য দিক দিয়ে এটা ঠিকই হয়েছিল বলে আমার মনে হয়। আমার মনে সুপ্ত একটা অভিমান ছিল। সেই অভিমানের জোরেই বলছি ওর সাথে আমার দেখা করা ঠিক না। আমি কেন তার সাথে দেখা করবো? কে হয় সে আমার? সে আমার কে হয় সেটা সেদিন তার বাবাই আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। অথচ এনির বাবার সাথে আমার কি ভালো সম্পর্কটাই না ছিল। সে সময় তিনি আমাদের বস ছিলেন। এনি তখনো জয়েন করে নি। স্যার আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। সেটা কোন কারনে তা আমি ঠিক জানি না। হয় আমার কাজের উপর খুশি হয়ে আর না হয় আমার ব্যাপারে সব তথ্য জানতে পেরে। আমার মা বাবা কেউ নেই। অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি এসব শুনে হবে হয়তো। তবে স্যার আসলেই আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই ভালোবাসা আর থাকলো না। আমি অফিসে কারো সাথে খুব একটা মিশতাম না। সত্য বলতে আমি কারো সাথে মিশতেই পারতাম না। এনির সাথেও আমি মিশতে পারি নি। বরং তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছি। কাজের সময় গিয়ে কেবল কাজ করেছি। ওর দিকে কখনো তাকাইও নি ঠিক ভাবে। তবে একটা জিনিস কি, ওর সামনে গেলে আমার বুকের ভেতর কেমন জানি করতো। ওর সামনে গেলেই বুকের বাঁ পাশের ধপ ধপ শব্দটা বেড়ে যেতো। আর যখন ওর সাথে আমার একবার চোখাচোখি হতো তখন আমার সমস্ত শরীর যেন কেঁপে উঠত। অদ্ভুত আনন্দময় একটা শিহরণ অনুভব করতাম আমি। এখনো করি। ওর শূন্যতায় সেই অনুভূতি জাগ্রত হয় আমার। সাথে একগাদা কষ্ট যেন ফুলে উঠে।এনির সাথে আমার প্রথম কথা হয় একটা কাজের দরুন। একদিন অফিসের কাজে ওকে আর আমাকে সাইটে যেতে হয়। সেদিনই প্রথম দেখি ও ওই বাচ্চা ছেলেমেয়ে গুলোর কাছ থেকে ফুল নিচ্ছে। এই ব্যাপারটা আমার এত ভালো লেগেছিল যে বলে বুঝাতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম বড়লোক বাবা মেয়ে, তাই ভাব একটু বেশিই হবে। ভাব ধরে থাকবে।কিন্তু মেয়েটা আসলে তেমন না। একদম ভিন্ন। ওর ফুল নেয়ার দৃশ্য দেখে কিছু সময় ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ও হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। তাই মাথা নিচু করে বলল,
-আসলে এই বাচ্চা গুলোকে দেখলে আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। যে বয়সে ওরা স্কুলে থাকার কথা সে বয়সে তারা জীবিকার জন্যে ছুটে বেড়াচ্ছে। কতটা খারাপ একটা ব্যাপার হলে এটা হতে পারে। জানেন, আমার খুব ইচ্ছে ওদের জন্যে কিছু একটা করি। কিন্তু ঠিক সময় করে করা হয়ে উঠে না।
কথাটা বলে ও মাথা নিচু করে রাখল। আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। আসলে আমারও খারাপ লাগছিল। অতিত কিছু কথা মনে পড়ে গিয়েছে চট করেই। অনাথালয়ের সেই দেয়াল ভেদ করে যখন এই মুক্ত পৃথিবীকে দেখতে বেরিয়েছিলাম ঠিক সেদিনই বাজে লোকের খপ্পরে পড়ে আমাকেও ফুল বিক্রি করতে হয়েছিল। কিছু বাজে কাজে যুক্ত হতে হয়েছিল আমায়। চরম পর্যায়ে কিছু অভিজ্ঞতা হল আমার। পরে অবশ্য এই সুন্দর পৃথিবী দেখার সকল আশা বাদ দিয়ে আমি আবার সেই অনাথালয়ে ফিরে যাই। মেয়েটি তখনও চুপ করে ছিল। আমার মনে হলো কিছু বলা উচিৎ। তাই খানিকটা কাঁপা স্বরেই বললাম,
-হ্যাঁ। আসলেই খারাপ লাগে। এদের জন্যে কিছু করতে পারলে আমারো ভালো লাগতো।
এনি হাসল এবার। কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,
-আচ্ছা আপনি এমন কেন? এত চুপচাপ থাকেন কেন?
আমি হাসলাম। বললাম,
-এমনিই।
-এমনি কেউ চুপ করে থাকে! এত গম্ভীর থাকে!
আমি করে থাকলাম কিছু সময়। তারপর খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বললাম,
-আসলে কারো সাথে মিশতে শেখায় নি কেউ। আমি অনাথালয়ে বড় হয়েছি।
ও চট করেই বলে ফেলল,
-আপনার বাবা মা?
-নেই। মারা গেছে খুব ছোট বেলায়। তারপর মামা এখানে রেখে যায়। সেই মামাও আর আসে নি কোন দিন।
মেয়েটির মুখটা খানিকটা মলিন হয়ে গেল। বেশ কোমল কন্ঠে বলল,
-সরি।
আমি হাসলাম। বললাম,
-বাদ দিন।এসব অতিত হয়ে গিয়েছে। এসব মনে না করাই ভালো। যে অতিত কেবল আপনাকে দুঃখই দেবে সে অতিত মনে রেখে কি লাভ আছে?
সেদিনের পর থেকে আমাদের কথাবার্তা বাড়তে থাকে। একটু একটু করে মেয়েটা যেন আমার ভেতর প্রবেশ করছিল। আমাকে একদম পালটে দিয়েছিল। আমাকে নিজের মত সাজিয়ে দিয়েছিল। এখন আমি চাইলেই খুব সহজে কারো সাথে মিশতে পারছি। তখন নিজেকে বেশ অন্য রকম লাগছিল। অন্যরকম অনুভূতি হতে থাকল আমার। মেয়েটা আমার মাঝের সকল অপূর্ণতাকে নিজেকে দিয়ে পূর্ন করে দিয়েছে। জীবনের এই সময়টাতে এসে আমার কেউ একজনকে তীব্রভাবে চাওয়ার ইচ্ছে জাগলো। যে আমার ভেতরে থাকবে। আমাকে পরিবর্তন করবে। আমার ভুল ধরিয়ে দিবে। আমাকে বকবে,শাসন করবে, আদর করবে। আমাকে ভালোবাসবে যে। এমন কাউকে চাইতে থাকলাম আমি। অথচ সে আমার সামনেই ছিল এবং আমি ভুল করে তাকেই তীব্রভাবে চেয়েছি। বলাবাহুল্য সে নিজেও আমাকে মনে মনে চাইছিল। এটা আমি তার চোখ দেখেই বুঝতে পারতাম। তার দু'চোখে আমাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। তীব্র ভালোবাসা জমে ছিল তার চোখ দুটোয়৷ আমি বেশ অবাক হতাম। কারো চোখের মায়ায় আমি এমন ভাবে পড়ব সেটা আমার জানা ছিল না। কাউকে মনে মনে ভালোবাসবো এটা আমার ভাবনায় ছিল না। কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে। তবে ওকে ভালোবাসি বলে মনের মাঝে আমার সুপ্ত একটি ভয় লুকিয়ে ছিল।ভয়টা ছিল ওর বাবা। ওর বাবাকি আমাদের মেনে নিবেন? আমার মত অনাথ একটা ছেলের কাছে নিজের মেয়েকে দিবে? যেখানে আমি তার অফিসের ক্ষুদ্র একজন এমপ্লয়ি। এই ভয়টা আমার তীব্রভাবে বাড়তে শুরু করে দিয়েছিল যখন দেখলাম এনির বাবা আফজাল সাহেব আমার সাথে এখন আর ভালো ব্যবহার করছেন না। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম এটা নিয়ে৷ তবুও লোকের কটু কথা কিংবা আফজাল সাহেবের আমাকে সহ্য না করার মাঝ দিয়ে আমাদের দিন গুলো বেশ ভালোভাবেই যাচ্ছিল।ঠিক ভালো দিন গুলোর মাঝেই খারাপ দিনটা এসে হাজির। সেদিন অফিসে আসার পরই এনির ফোন পাই। ফোন দিয়ে বেশ ফুরফুরে কন্ঠে বলে,
-কোথায় তুমি?
-এইতো অফিসে!
-চলে আসছো?
-হ্যাঁ।কেন? কি হইছে?
এনির হাসির আওয়াজ পেলাম। বলল,
-শুন,এখন সোজা বাসায় যাবা। আর গোলাপী কালারের যে পাঞ্জাবিটা আছে না, ওটা পরে আমাদের পরিচিত পার্কটায় আসবা।
-আরে, কেন? কি হয়েছে বলতো!
-কিছু হয় নি। তবে হবে। যা বলছি করো। যাও।
ফোন কাটা গেল। এনির বাবার ব্যবহারে আমার অস্থির হয়ে থাকা মনটা চট করেই যেন অদ্ভুত একটা আনন্দে ভরে উঠল। অদ্ভুত শান্তির একটি আবেশ আমি নিজের মাঝে লক্ষ্য করলাম। বেশ ভালো লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আজকের পর থেকে আমার আর সিঙ্গেল থাকা হবে না। আমার কেউ একজন হবে। আমাকে জানবে সে। ভীষণ ভালোবাসবে। আমার অতিত কষ্ট গুলো আর থাকবে না। এক মূহুর্তের জন্যে আমি নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখি মানুষ ভাবছিলাম। ঠিক তারপরেই সেরা দুঃখি মানুষ ভাবতে হয়েছে আমার। রেডি হয়ে এনির সাথে দেখা করার জন্যে যাচ্ছিলাম।বাসা থেকে বের হবো ঠিক তখনই আমার ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে এনির বাবার নাম্বার দেখেই আমার সেই লুকিয়ে থাকা ভয়টা নেড়ে উঠল। আমি কাঁপাকাঁপা হাতে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে স্যার বললেন,
-এনির সাথে দেখা করতে যাচ্ছো?
আমি বেশ অবাক হলাম।উনি জানলো কিভাবে? একটু লজ্জা হলো আমার। বললাম,
-জ্বী স্যার।
উনি হাসলেন। বললেন,
-আচ্ছা যেও। যাওয়ার আগে আমার সাথে একটু দেখা কর।
আমি কিছু বললাম না। আসলে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। উনি আবার বললেন,
-আমি গাড়ি পাঠিয়েছি। এতক্ষণে তোমার বাসার সামনে গাড়ি চলে গিয়েছে হয়তো। চলে আসো।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কেবল চুপ করে থাকলাম। বাসা থেকে নেমেই দেখলাম উনার কারটা দাঁড়িয়ে আছে গেইটের সামনে। আমি আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
.
এনির বাবার সাথে দেখা হলে উনি সব সময় আমি কেমন আছি,দিন কাল কেমন যাচ্ছে এসব জিজ্ঞেস করতেন।কিন্তু আজকাল উনি তেমন করেন না আর। সেদিনও করেন নি। আমাকে দেখেই বসতে বললেন কেবল। তারপর নিজে বসে সিগারেট ধরালেন। তারপর বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
-এনি একটু আগেই বেরিয়েছে। বেশ সেজেছে তোমার জন্যে। তা কেন দেখা করা হচ্ছে আজ?
আমি বেশ শান্ত স্বরেই বললাম,
-আমি ঠিক জানি না। আমাকে কেবল আসতে বলেছে ও।
-ও আচ্ছা। আচ্ছা আমাকে একটা জিনিস ক্লিয়ার করে বলতো! তোমাদের দুজনকেই আজকাল একসাথে পাওয়া যাচ্ছে বেশি। এক সাথে থাকোও। অফিসে বেশ গুজব ছড়াচ্ছে। ব্যাপারটা কি বলতো!
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম কেবল। আমার এমন নীরাবতা দেখে উনি বললেন,
-কি ব্যাপার। কথা বলছো না কেন?
-আসলে স্যার! তেমন কিছু না।
-তেমন কিছু না! তাহলে এত মেশামেশি কেন?
আমি কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে বসে থাকলাম।উনি বললেন,
- শুন,তুমি ভালো ছেলে। এটা আমি জানি। তুমি আমার মেয়ের যোগ্য হও বা না হও তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। তবে আমি আমার মেয়েকে কখনই এমন কোন ঘরে পাঠাবো না যেখানে কোন পরিবারই নেই। কোন মহিলা নেই। একটা ভালো পরিবার চাই আমি আমার মেয়ের জন্যে । কোন অনাথ ছেলেকে নয়।
আমি ঠায় রোবটের মত বসে থাকলাম। মনের ভেতর তখন যেন ঝড় বইছিল। অদ্ভুত ভাবে কষ্ট গুলো চারদিক থেকে সুক্ষ্ণ তীরের মতো হৃদয়ে বিধতে লাগল। প্রতিটি তীর আমার কোমল হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল যেন।আমি এক প্রকার চাপা কষ্ট নিয়ে চুপচাপ জড়সড় হয়ে বসে থাকলাম।উনি আবার বললেন,
-কি বলেছি বুঝতে পেরেছো?
আমি খানিকটা ভাঙ্গা স্বরে বললাম,
-জ্বী-জ্বী-জ্বী স্যার।
আমার মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও এল না। আমি যেন রোবট হয়ে গেলাম।আস্ত একটা মূর্তি হয়ে বসে থাকলাম,যেখানে আমার এখন প্রতিবাদ করা উচিৎ, নিজের মনের কথা বলা উচিৎ। অথচ আমি তা করছি না। কেবল চুপ করে আছি, যেখানে আমার প্রেয়সীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে,যেখানে আমাকে ছোট করা হচ্ছে,অথচ আমি কাপুরুষের মতো তা কেবল দেখে যাচ্ছি। হায়! এখন কি হবে আমার। আমি কি করবো? উনি একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-এটা তোমার নতুন চকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার। এখানে জয়েন করবে কাল পরশুর মধ্যে। তবে শর্ত হচ্ছে তুমি কখনই আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। দেখা তো না-ই। নতুন বাসা খুঁজতে হবে না। অফিসের পাশেই তোমার বাসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর বসচেয়ে বড় যেটা সেটা হলো নতুন নাম্বার নিবা। ঠিক আছে?
আমি মনে মনে হাসলাম। সব ঠিকই ছিল। এখন উনি সব ধ্বংস করে দিয়ে বলছে 'ঠিক আছে?'। মানুষ বড়ই অদ্ভুত! উঠে চলে এসেছি সেদিন। লেটারটা না নিয়েই চলে এসেছি। এতটা নিচু আমি নই। পড়ালিখা এবং যোগ্যতা আমার আছে। সেই বলেই চাকরি পেয়েছি এবং বেশ শান্তিপূর্ণ ভাবেই চাকরি করছিলাম। কিন্তু এখন এই মেয়েটা এসে সব বিগড়ে দিল। একেবারে সব। এখন আবার নতুন চাকরি খোঁজতে হবে,নতুন বাসা খোঁজতে, সব আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। এত বেড়াজালি আর ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সব যেন প্যাঁচিয়ে গিয়েছে। কোন কিছুই খেলছে না মাথায়। মাথাটা বড্ড ভার হয়ে আছে। আর পারছি না। এত চাপ নিতে পারছি না। নাহ! এই শহরেই আর থাকবো না। কালই এখান থেকে বিদায় হবো। এই দুর্বিষহ, কষ্ট ময়,বিষন্ন শহর আর ভালো লাগছে না আমার। এই শহরটা যেন আমার ভেতরের কষ্ট গুলোকে বিষিয়ে তুলছে। যা সহ্য করা আমার জন্যে বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
বেশ রাত হয়েছে। বাইরে আর থাকা উচিৎ হবে না। কাল আবার সব ঠিকঠাক করতে হবে। বিদায় নিতে হবে এই কষ্ট পল্লি থেকে। আমি এলোমেলো পাঁয়ে বাসার দিকে এগুলাম। আকাশে তখন রুটির মত গোল হয়ে থাকা রুপালী চাঁদটা শুভ্রতা ছড়াচ্ছে। আজকাল এই কোমল আলোও আমার বেশ অসহ্য লাগে। নিজেকে বড্ড একা লাগে আমার। আমাকে নিঃসঙ্গ পেয়ে কষ্ট গুলো একেবারে চেপে ধরে। আমি চুপ করে থাকি। কষ্ট আমাকে গিলে খায় অথচ আমি কিছুই করতে পারি না। কেবল চোখের জল বাধাহীন ভাবে পড়ে,আবার কখনো সেও অভিমান করে। কি এক বেদনায় জীবন পার করছিলাম আমি সেটা এই মস্ত বড় পৃথিবীর কেউ জানে না। কেউ না। কেউ এই অনাথের খবরই রাখে না। সত্যি বলতে আজকাল নিজেকে সত্যিই অনাথ মনে হচ্ছে। আমার আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় যে আমি অনাথ। আমি অনাথ। এই পৃথিবীতে আমি মস্তবড়ো একা।কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই লিফট থেকে নামলাম। আনমানা হয়ে ধীর পাঁয়ে হাঁটতে থাকলাম নিজের প্লটের দিকে। ঠিক কিছুদূর গিয়ে আমি বেশ অবাক হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার সব যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে পারছিলাম না৷ অহেতুক চোখ দুটো যেন ঘেমে উঠল। বিন্দু বিন্দু জল জমতে থাকল। আমি যেন বাসার দরজার সামনে জ্বলতে থাকা লাইটের আলোয় কোন এক হুর পরী কে দেখলাম, যাকে দেখে আমার প্রচন্ড কষ্টে কান্না আসতে থাকল। আমি নিজেকে সংযত রাখা চেষ্টা করলাম।ধীর পাঁয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। এনি তখন কান্না মিশ্রিত একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যেন অমূল্য কিছু সে চট করেই ফিরে পেয়েছে। আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। এনি তখন একটু জোরেই কান্না আরম্ভ করল। আমি বেশ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
-কে-কেমন আছো?
এনির কান্নার গতি আরেকটু বাড়লো। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।আমার যেন একটু মায়া হলো এই মেয়েটার জন্যে। দেখেই মনে হচ্ছে কত কেঁদেছে একটা অনাথ ছেলের জন্যে। যেন হন্য হয়ে খুঁজেছে, অথচ পায় নি। এটা ভেবে আশ্চর্য হলাম যে ও আমার বাসাতে চলে এসেছে এবং এতক্ষণ আমার জন্যে বসে বসে অপেক্ষা করেছে। আমি যতটা না অবাক হলাম তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম। একটা শান্তির আবেশ যেন চট করেই আমাকে আবেশিত করে ফেলল। আমি আবার বললাম,
-আরে! কি হয়েছে! এমন কান্না করছো কেন?
ও কাঁদতে কাঁদতে বেশ রাগতো স্বরে বলল,
-তো কি করবো আমি।হাসবো। কষ্ট পেলে কি কেউ হাসে! গাধা!
ওর মুখে গাধা শব্দটা শুনে আমার কেন জানি বেশ আনন্দ হলো। আমি বললাম,
-দেখো,আশেপাশের সবাই ঘুমাচ্ছে।ডিস্টার্ব হবে ওদের। প্লিজ কান্না -দেখো,আশেপাশের সবাই ঘুমাচ্ছে।ডিস্টার্ব হবে ওদের। প্লিজ কান্না থামাও।
ও কান্না থামায় নি তখনো। আমি আবারো বললাম,
-প্লিজ এনি!
ও বেশ দ্রুত বলল,
-দরজা খুলো।
আমি বললাম,
-কেন?
ও কেমন করে জানি আমার দিকে তাকালো। ততক্ষণে আমার মনে হলো হায় আমি এ কি বললাম। এটা বলা তো উচিৎ হয় নি। আমি দ্রুত দরজা খুললাম। এনি বেশ দ্রুতই ঢুকল। আমি বেশ অবাক হলাম। রুমে ঢুকে ও সোফায় গিয়ে বসল। আমিও গিয়ে ওর বরাবর বসলাম। বললাম,
-কি খাবে বলো!
-তোমার খাওয়া ছোটাচ্ছি আমি দাঁড়াও।
এই বলে ও দ্রুত আমার দিকে তেড়ে আসলো। এসেই আমার গলা চেপে ধরে বেশ রাগতো স্বরে বলল,
-আমায় যে একা ফেলে এসেছিস কষ্ট লাগে নি তোর। খারাপ লাগে নি। একবারও কি আমার কথা মনে হয় নি। একবারও কি মনে হয় নি যে আমি তোর জন্যে বসে আছি পার্কে। জানিস কতক্ষণ বসে ছিলাম আমি? বল আমাকে,আমাকে কষ্ট দিতে কি তোর ভালো লাগে।
আমি তখন অন্য কিছু বললাম,
-মেরে ফেলো আমায় এনি, মেরে ফেলো। আমার বাঁচতে ইচ্ছে হয় না। এই পৃথিবীটা আমার কাছে বড় নশ্বর মনে হয়। এখানে থাকতে চাই না আমি। তোমার হাতে মরতে পারলে অন্তত একটু শান্তি তো পেতাম।
আমার চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ল। এনি চট করে গলা ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমি বললাম,
-কি হলো? থেমে গেলে কেন? মেরে ফেলো না৷ আমার আর এখানে সত্যিই ভালো লাগছে না।
-কেন? কেন ভালো লাগছে না। এই পৃথিবীকে তোমার ভালো না লাগুক।আমাকে তো লাগে? নাকি আমি ভুল ছিলাম। আমাকে তোমার ভালো লাগে না। কোনটা?
আমি এনির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চোখ ঘেমে উঠছিল ততক্ষণে। আমি বললাম,
-তোমাকে সে কবেই আমি আমার আমিকে দিয়ে দিয়েছি। নিজের সমস্ত কিছু তোমার মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি।অথচ আমার তখনো জানা ছিল না যে আমি একটি অনাথ ছেলে, যার কোন পরিবার নেই। যার জন্মস্থান কোথায়,কিংবা মায়ের নাম কি সেটা সে জানে না। এমন ছেলে কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত?
-উপযুক্ত নয় কেন? আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি। নিজের চেয়ে ভালোবাসি৷ তোমাকে আমি চাই। তাহলে এখানে উপযুক্ত কিংবা অনুপযুক্তের কি আছে।
-আছে এনি। অনেক কিছু আছে। তুমি বুঝবে না। বাসায় ফিরে যাও। তোমার বাবা কি করবে কে জানে?
-আমি শিশু না বুঝেছো। সব বুঝি আমি। আর আমাকে যেতে বলছো। যাবো না আমি। দেখি তুমি কি করতে পারো!
-দেখো এনি, পাগলামো করো না। বাসায় ফিরে...
-পাগলামোর কি দেখেছো তুমি হু। কিছুই দেখো নি। অনেক কষ্টের পর তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। তোমাকে খুঁজেছি হারাবার জন্যে নয়। নিজের সাথে জড়িয়ে নেবার জন্যে। এত সহজে তোমাকে ছাড়ছি না আমি।
-এত খুঁজেছো কেন? তোমার বাবা কিছু বলে নি?
-আমি তো ভালোবেসেছি। তাই খুঁজেছি। আমি তো আর কাপুরুষ না যে কারো ভয়ে নিজের প্রিয় বস্তুটিকে ফেলে আসবো।আমি তোমার মতো না হুহ।আর বাবার কথা বাদ দাও। সে নিজেও এখন তোমাকে হন্য হয়ে খুঁজছে।
আমি বেশ অবাক হলাম।বললাম,
-আমাকে খুঁজছে?
-হ্যাঁ।নিজের মেয়ের জামাইকে তাড়িয়ে দিয়ে এখন আবার পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে।
-কেন?
এনি চোখ দুটো ছোট করে বলল,
-কেন বুঝো না।
-আমি সত্যিই বুঝি না।
-দাড়াও। আগে তোমাকে হালাল করে নেই। তারপর বুঝাবো।
-হালাল মানে?
ঠিক তখনই বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। এনি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম যে আমার হবু শশুর আব্বা দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে পাঞ্জাবি টুপি ওয়ালা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। খাল কেটে কুমির আনতে সবচেয়ে বেশি অবদান এই ব্যক্তির। আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।হায় হায়! হচ্ছে কি এসব।এনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-বাবু,আর একটু অপেক্ষা। তারপর তোমাকে বোঝাবো এই এনিকে কষ্ট দেওয়ার ফল কেমন।আমাকে কষ্ট দিয়েছো না! বুঝবে এবার।
আমি ডোক গিললাম। আরেহ! এই মেয়ে আবার কি বোঝাবে? আল্লাহ আমারে বাঁচাও। কি হচ্ছে এসব। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না কিচ্ছু। কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না।
সমাপ্ত।
ভালো লাহলে কমেন্ট করে জানাবেন এবং শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ।
Just awsome
বরাবরই সুন্দর লাগে।।।