গল্পঃ অনাথ অনুভূতি

বাংলা গল্প Love Stories Bangla Choto Golpo  Bangla Valobashar Golpo Bangla Golpo (1)


গল্পঃ অনাথ অনুভূতি

তাসফি আহমেদ


আমি একটু ভালো করে মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেই আমার শরির হঠাৎ-ই বিদ্যুৎ বেগে নড়ে উঠল।পুরো শরিরের প্রতিটা কোষ যেন নড়ে উঠল। যেন সবগুলো কোষ কিংবা রক্ত কনিকা তরঙ্গায়িত হল।দেখলাম মেয়েটা আমার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে।কিন্তু আমি তাকাতেই আমার শরিরের এমন নড়ে উঠার কারন কি?যুক্তিসংগত কোন উত্তর পেলাম না।আমি আবার আমার হাতে থাকা বইটার দিকে তাকালাম। গাছের নিচে বসে আছি।একটু ছায়া আছে এখানে।সাথে খানিকটা মিষ্টি বাতাস।বেশ ভালোই লাগছিল।মেয়েটা ঠিক আমার থেকে বেশ কিছুটা দুরে আরেকটা গাছের নিচে বসে আছে।তবে সেটার ছায়া মেয়েটার গায়ের উপর পড়ছে না।ওর গায়ে রোদ লাগছে।কটকটে রোদ।যেন গা জ্বলে যায়।অদ্ভুত ভাবে মেয়েটা সেটা সহ্যও করছে।কিন্তু মেয়েটা সহ্য করছে কিভাবে? বেশিক্ষন থাকলে তো অজ্ঞান হয়ে যাবে! কেমন জানি খারাপ লাগল আমার।কিন্তু আমার খারাপ লাগল কেন মেয়েটার জন্যে? মেয়েটা আমার কে? ঠিক মত চিনিও না।শুধু এতটুকু  জানি যে ও আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে।কিসে পড়ে, কোথায় থাকে, নাম কি ইত্যাদি এসবের কিছুই জানি না।তাহলে? 
.
বেশ কয়েকদিন ধরেই দেখছি ভার্সিটি আসলে মেয়েটা আমার আশেপাশে কিংবা দুরে দুরে থেকে আমাকে দেখছে।কিন্তু এতগুলো দিন হয়ে গেল, মেয়েটা আমার সাথে একটু কথা বলতেও এল না।কি অদ্ভুত!
নাহ্! মেয়েটার রোদ লাগছে।ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন জানি লাগল।মেয়েটার জন্যে মায়া হল।তাই আমি উঠে গেলাম সেখান থেকে।কিছুদুর গিয়ে একটা ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি বেঞ্চে বসলাম।বেঞ্চটার পিছনে ইটের গাঁথুনির তৈরি একটা বড় দেয়াল।পুরো ক্যাম্পাসের চারপাশ এমনভাবে বাউন্ডারি করা।আমি যেখানে বসেছি সেটা ঠিক আমাদের ক্যাম্পাসের শেষ সীমানা।দেয়াল থেকে হাত দুয়েক দুরে দুরে এমন বেশ কয়েকটা বেঞ্চ তৈরি করা আছে।একেবারে এক সারিতে। আমি যেখানে এসেছি সেখানে ততটা রোদ নেই।তাই আস্তে করে বসে বইটার দিকে নজর দিলাম।আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি সে এখনও একই জায়গায় চুপচাপ বসে আছে।বিন্দুমাত্র নড়ছেও না।শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ওর এমন চাহনি দেখে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম।আমি বইয়ের দিকে নজর দিলাম।কিছু সময় কোনদিকে তাকালাম না।বইয়ের পড়ার দিকে নজর দিলাম।ঠিক পড়া শেষ হওয়ার পরই আমি চোখ তুললাম এবং চোখ তুলে মেয়েটা পূর্বে যে জায়গায় ছিল ঠিক সেদিকেই তাকালাম।জায়গাটা খালি পড়ে আছে।কেউ নেই সেখানে।আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা ঠিক আমার বেঞ্চের সারি বরাবর একটা সারিতে বসে আছে।ঠিক আমার দিকে মুখ করে।যেন এই প্রথম আমাকে দেখছে।অথচ দু'মাস যাবত আমাকে দেখছে মেয়েটা।আজকাল আমারও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।খুব দেখতে ইচ্ছে হয় ওকে।রাতে স্বপ্নেও ওকে দেখি।ঘুমানোর আগে খুব ভাবি মেয়েটাকে নিয়ে। মেয়েটাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন চিন্তায় ডুবে থাকি।অথচ আমি আগে কোন মেয়ের দিকে এমন ভাবে তাকাই নি।ঘুমানোর আগে কখনও কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবিও নি। কখনও স্বপ্নেও দেখি নি।আমার এমন কোন ইচ্ছে ছিলও না।আমি কখনই চাই নি কোন পমেয়েকে নিয়ে আমি ভাবব।কোন মেয়ের দিকে এভাবে তাকাব সেটা আমি ভাবতেও পারি নি। কিন্তু এই মেয়েটা ওর দু'চোখ দিয়ে অদ্ভুতভাবে আমাকে বশ করে নিয়েছে।নিজেকে আমার ভিতরে এমন ভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে আমার চিন্তাভাবনায় সব সময় ওই নিজেই থাকে। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে ওর দুচোখের প্রেমে আমাকে পড়তেই হল। এছাড়া হয়ত আর কোন উপায়ন্তও ছিল না।শেষমেশ আমাকে মেয়েটার প্রেমের ফাঁদে পাঁ দিতেই হল।আচ্ছা! এ কেমন ফাঁদ? এভাবে কেউ কারো প্রেমে পড়েছে? আমি সত্যিই জানি না।তবে অদ্ভুত ভাবে আমিই সেই ফাঁদে পাঁ দিয়ে দিয়েছি।এখন এখান থেকে বের হওয়াও বেশ কষ্টকর ব্যাপার। জানি না কি হচ্ছে আমার সাথে এগুলো।আর কেনই বা হচ্ছে।
'
আমি উঠে দাঁড়ালাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর সাথে গিয়ে কথা বলি।কিন্তু আমার সেই সাহস নেই।কেন জানি ওর সামনে যেতেই ভয় লাগছে।তবুও ধির পায়ে আমি ওর দিকে এগুলাম।আমি দুর থেকেই দেখলাম মেয়েটার মুখটা কেমন জানি উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কেমন জানি খুব খুশি হল।যা আমি ওর চোখ দেখেই বলে দিতে পারছি।মেয়েটার ঠিক সামনে যেতেই আমার সকল সঞ্চিত সাহস যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।এখন ওর দিকে তাকানোর বিন্দু মাত্র সাহস আর বাকি নেই। আমি আর সেদিকে তাকালাম না। ওর সামনে দিয়ে সোজা হেঁটে চলে এলাম।কিছুদুর এসে একবার পিছন ফিরে চাইলাম।দেখলাম মেয়েটা আমার দিকে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে।ওর ফর্সা মুখটায় যেন রাজ্যের মেঘ এসে জমেছে।এই ঝরবে বলে।নাহ্। আমি সেই বর্ষন দেখতে চাই না। ওর চোখের জল আমি দেখতে চাই না।অবশ্য কখনও দেখি নি।তবে ও কান্না করবে কথাটা মনে হতেই আমার কেমন জানি খারাপ লাগল।খুব খারাপ লাগল।নিজের মনটা হঠাৎ ই ওর জন্যে কেঁদে উঠল।আমি আর দাঁড়ালাম না সেখানে। সোজা বাড়ি ফিরে এলাম।সত্যিই আমার দ্বারা কিছুই হয় না।আর হবেও না।আমি সত্যিই এই দিক দিয়ে খুব দুর্বল।
'
পরের দুইদিন আর ভার্সিটি গেলাম না।মেয়েটাকে ভুলে যাওয়ার এক অদম্য চেষ্টা করলাম এই দুই দিন।নিজের ভিতর থেকে মেয়েটাকে বের করতে চাইলাম।কিন্তু মেয়েটাকে আমার ভিতর থেকে বের করে দেওয়া তো দুরের কথা, মেয়েটা যেন আমার ভিতরে আরেকটু স্থান করে নিল।নিজেই আমার হৃদয়ের সকল জায়গা দখল করে নিল সে।সব কিছু গুছিয়ে নিল।আমি বাধা দিতে গেলেও পারলাম না।আমার হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে মেয়েটা স্থান করে নিয়েছে অদ্ভুত ভাবে।কি আজিব! মাস দুয়েকের দেখায় কত কিছু হয়ে গেল।আর জানি কত কিছু হওয়ার বাকি আছে?
'
ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে।কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কার জন্যে? আমার জন্যে? ওইত মেয়েটা আমাকে দেখতে পেয়েছে।দেখা মাত্রই মেয়েটার মুখটা সেদিনের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে গেল।ঠোটের কোনে মৃদু একটা হাসি ঠাই পেল।আমি পাত্তা দিলাম না।অনেকটাই এড়িয়ে চললাম ওকে।একেবারে ক্লাসে চলে গেলাম।আজ আর বই নিয়ে গাছ তলায় গেলাম না।মেয়েটাকে আড়াল থেকে দেখলেও কখনো ওর সামনে ধরা দিতাম না।দুইদিন এমন করলাম।এই দুই দিনেই দেখলাম মেয়েটা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে।কিছু একটা কে আটকে রাখার অদম্য চেষ্টা করছে।সেটা যেন বেরিয়ে আসার জন্য পাগল কিন্তু মেয়েটা জোর করে সেটাকে ভিতরে বেঁধে রাখছে। খুব সাবধানে! যেন ভুলেও বেরিয়ে না যায়।কিন্তু তৃতীয় দিন আমি অন্য কিছু টের পেলাম।বুঝলাম মেয়েটার খুব কষ্ট হচ্ছে।কথাটাকে আঁটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।
'
আমি সুমার সাথে একটা গুরুত্ব পুর্ন কথা বলছিলাম।মেয়েটা খুব ভালো।বেশ মেধাবিনীও।একটা টপিক নিয়ে আলোচনা করছিলাম।ঠিক তখনই মেয়েটা আমাদের সামনে আসল। ও হ্যাঁ! ওর নামটা জানা গিয়েছে।নাম নিরুপমা। আমি ছোট করে রাখলাম নিরু।হঠাৎ ই নিরু আমার শার্টের কলারটা ধরে টানতে টানতে  নিয়ে গেল। সুমা কিছুটা হকচকিয়ে গেল।ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে।আমি সুমার দিকে ফিরে চোখ টিপলাম। ও মৃদু হেসে চলে গেল।
'
দুজনেই বসে আছি।কেউ কথা বলছে না।মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে।আমার ওর সাথে বসে থাকতে কেমন জানি লাগছে।কখনই এমন পরিস্থিতির স্বীকার আমি হই নি।কি রকম অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে।ভালোলাগার অনুভুতি হচ্ছে আমার।আমি ওর চুপ থাকা দেখে বললাম,
:কি ব্যাপার? কিছু বলবেন নাকি চলে যাব!
ও ভ্রু কুছকে আমার দিকে চাইল।বলল,
:বাড়িতে কি বউ বাচ্চা আছে নাকি? যাওয়ার জন্যে এত উতালা হয়ে যাচ্ছেন যে?
আমি কিছু বললাম না।তবে বুঝতে পারলাম মেয়েটা ভিশন। এখন না কথা বলাই শ্রেয়। কিছু সময় পর নিরু অভিমানি কন্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
:জানেন তখন খুব কষ্ট হয়, যখন খুব কাছের মানুষ গুলো কষ্ট দেয়।যা একেবারেই সহ্য করা যায় না। 
আমি কিছু সময় নিরুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম কেবল। ও কিছুটা সংকুচিত হয়ে আবার বলল,
: এই কয়দিন আমাকে এড়িয়ে চলছিলেন কেন?জানেন কতটা কষ্ট হয়েছে আমার? 
আমি হুট করেই বলে ফেললাম।কারন এর উত্তরটা আমার জানা আছে।বললাম,
:যে কাউকে নিজের বলে দাবি করতে পারে না,নিজের অব্যক্ত কথা গুলো বলতে পারে না সে নিজেকে আড়াল করে রাখাটাই বেশ শ্রেয় বলে আমি মনে করি।
:তাই বলে আপনি আমাকে কষ্ট দিবেন?
:আমি জানতাম না যে আমি কারো আপন? আমি জানতাম না আমি কারো খুব কাছের কেউ।
ও হুট করেই আমার শার্টের কলার ধরে টেনে আমার মুখটা ওর দিকে ফিরাল।আমি ওর রাগে লাল হয়ে যাওয়া গাল দুটো খুব কাছ থেকে দেখলাম।কান্নার কারনে লাল হয়ে যাওয়া নাকটা দেখলাম আমি।খুব অদ্ভুত এক শিহরন বয়ে গেল হৃদয়ে। আনন্দের শিহরন। ভালোবাসার শিহরন। ও বলল,
:আপনি কি সত্যিই জানতেন না আপনি আমার সৃতির পাতায় লিখিত গল্পের  নায়কের চরিত্র? বলেন জানতেন না আপনি?
আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম,
:আমি না হয় একটু কম বুঝতাম।কিন্তু আপনি কি জানতেন না যে আপনি আমার সৃতির পাতায় লিখিত গল্পের নাইকা?
ও কিছু বলল না।শুধু আমার দিকে চেয়ে থাকল।আমিও তাই করলাম।ওকে খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলাম।একটু নিরাবতা নেমে এল আমাদের মাঝে।কেউ কারো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয় নি। কিছু সময় পর নিরু একটু নড়ে উঠল।ঊঠে এসে আমার পাশে বসল।আমার চোখের দিকে তাকাল।আমার চোখ থেকে কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছে।মনের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে।কি বুঝল সেটা আমি ঠিক জানি না।তবে আমি ওর চোখ দেখে বুঝলাম যে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলা হয়ত আর হবে না।নিরু আলত করে আমার হাতটা ধরল।বলল,
:কাল থেকে আর এমন করবা না।আর আমাকে এড়িয়ে চলবা না।ঠিক আগের মত সব কিছু ঠিকঠাক চলবে।শুধু একটা জিনিস পরিবর্তন হবে।
আমি চট করেই বলে ফেললাম,
:কি? 
ও মৃদু স্বরে বলল,
:কেউ আর দুরে দুরে বসবে না।দুজনেই একসাথে বসবে।কাছাকাছি বসব।গল্প করব।আর...
:আর...?
:আর আমরা চুটিয়ে প্রেম করব।ঠিক আছে?
আমি কিছু বললাম না।ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।ক অদ্ভুত মায়া খেলা করে ওর চোখে।ডুবে থাকতে ইচ্ছে হয় আমার।নিরু আমার চোখের দিকে তাকাল।কিছু একটা বুঝে নিল ও। তারপর আস্তে করে আমার কপালে একটা চুমু দিল।চুমু দেওয়ার সাথে সাথে আমার শরির যেন তরঙ্গায়িত হল। অজানা শিহরন বয়ে গেল হৃদয়ে। শান্তির শিহরন। হাজারো দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকা যায় এমন একটা চুমুর স্পর্শ পেলে।সত্যিই অসাধারণ অনুভুতি।ও আমার মাথার অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে আমার বাহুতে মাথা রাখল।বলল,
:আর কোন দিন এমন করবা না আর কোন মেয়ের দিকে তাকাবাও না।সুমা আপুর সাথেও না।আমার কাছে ধরা পড়লে কিন্তু পার পাবা না মি.তাসফি।তুমি আমার তাসফি! শুধু আমার।
আমি এতক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে এটাই দেখছিলাম।যেন আমি ঠিক ওর চোখের ভাষা পড়তে পারছি।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছি আমার আর কোন মেয়ের দিকে তাকানো হবে না।হলে নির্ঘাত শাস্তি আছে।খুব শাস্তি পেতে হবে আমাকে।
'

ভুলত্রুটি মার্জনীয়
তাসফি আহমদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url