গল্পঃ অবেলায় ভালোবাসা
তাসফি আহমেদ
আমি আজ যেমন চুপচাপ, আগেও তেমন চুপচাপ ছিলাম।কলেজে গেলেও তেমন কথা বলতাম না।একটা মাত্র বন্ধু ছিল আমার আরাফাত। ওর সাথেই যা কথা হত,দুষ্টামি হত ওর সাথে।আমি শুধু মজা করতাম ওর সাথেই।আরাফাতও ছিল আমার মত।কারো সাথে তেমন কথা বলত না।যা বলত আমার সাথে।আমরা একসাথে কলেজে আসতাম এবং একসাথে বাড়ি যেতাম।আমাদের দুজনের বেশ মিল ছিল।কারন আমরা দুজনেই ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের।আমি পড়া লিখা নিয়ে তেমন ইন্টারেস্টেড ছিলাম না।কিন্তু এই আরাফাত আমাকে পড়ালিখার প্রতি মনযোগী করেছে।ও বুঝিয়েছে যে আমরা গরিব। আমাদেরকে পড়ালিখা করে মানুষ হতে হবে।তারপর থেকেই আমরা দুজন একই সাথে, খুব মনযোগীতার সাথে পড়ালিখা শুরু করি।
গল্পে আরেকটা চরিত্র রয়েছে।আমাদের সাথেই পড়ে।আমার খালাত বোন।খুব স্মার্ট ছিল মেয়েটি।চঞ্চল টাইপের।।। আমার খালাত বোন তবে আমার সাথে কোনদিনই কথা হয় নি।কিন্তু আমার কেন জানি মেয়েটাকে খুব ভালো লাগত।আমাত স্বপ্নের রানির মত।যে হাসিটাকে আমি খুব খুঁজেছি। খুব!!! কোথাও পাই নি।যখনি অনিকা কে দেখলাম তখনি আমার কেন জানি মনে হল হ্যাঁ এই মেয়ের মাঝেই আমি আমার সেই স্বপ্নপরি কে খুঁজে পেয়েছি।ওকে আমি খুব দেখতাম! খুব!! এই কথা আমি আরাফাত কে জানাই নি।কারন ও শুনলে নেহাত হাসবে।খুব হসবে!!! তারপর কয়েকটা নিতি বাক্য শুনিয়ে বলবে ভালো করে পড়া শুনা কর।
তাই আর ওকে বলা হয় নি।
.
কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি ভর্তি হলাম।পড়ালিখার সুবাদে কিংবা ওর সেফটির জন্যে ওর মা চাইত আমি আর ও একসাথে যাই । যে অবস্থা এখন দেশের।আরোও অনিকা ছিল ভয়ংকর সুন্দরি।
খুব ভালো বন্ধুত্ব হয় ওর সাথে আমার।তারপর ওকে আমি আরাফাত এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।এখন তিন বন্ধু আমরা। খুব ভালোই যাচ্ছিল দিন গুলো।যেমন আড্ডা মারতাম তেমন পড়াশুনাও করতাম আমরা।আমার বাবা মা তো আমাদের ( অনিকা আর আমার) মধ্যে এমন মিল দেখে তারাও অবাক।এখন প্রাই অনিকা আমার বাসাতে আসে।আগে তো সময়ই হত না আসার।আর এখন প্রাই আসে।।এসে কি সব পাগলামি শুরু করবে
এই যেমন আমি ঘুমে থাকলে ও আসবে।এসে আমার কানের ভিতরে ছিকুন কিছু দিয়ে কাতুকুতু দিবে।বা বাঁসি দিয়ে আমার কানের পর্দা নাড়িয়ে দিবে।আমি আগেই বলেছিলা ও ছিল একটু চঞ্চল টাইপের।তাই ও শুধু দুষ্টামি করে ।তারপর তো ঘুরতে যাওয়া আছেই।
আমার আসে পাশে কোন মেয়ের দিকে তাকালেই ও যে খুব রাগত তা ও আমার থেকে এড়াতে পারে নি।।কাল রিয়ার সাথে কথা বলা দেখে সেকি অবস্থা তার।
রাগে একেবারে লাল হয়ে গিয়েছে।তবুও নিজেকে সামলে নিল ও।
আমাকে শুধু বলেছে "লুল পোলা "।আমি কিছুই বললাম না।পরের দিন ভার্সিটি গেলাম।রিয়ার কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিট আছে যা আমার খুব দরকার।তাই আমি আজও ওকে ডাক দিলাম।কিন্তু আজিব বেপার হল আমি যখন ওকে ডাক দিলাম তখন ও এমন এক ভাব করল যেন আমাকে চিনেই না।আবার ডাক দিলাম। এবার না তাকিয়েই হেঁটে চলে গেল।তাই আমি ওর পিছু পিছু গেলাম। ওর হাত ধরে থামালাম। ও এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।আমি বললাম,
কিরে কি হয়েছে,,,,?
ও বলল,
দেখ তোর সাথে আমি আর কথা বলব না।
আমি বললাম,
কেন,,,,?
ও বলল,
জানিস না। নাকি ন্যাকামি করেছিস।
আমি বললাম,
ন্যাকামি কেন করব।কি হয়েছে সেটা বল।
ও যা বলল তা শুনে আমি পুরা বেকুব হয়ে গেলাম।ওর সরি বলে নিলাম।তারপর অনিকা কে খুঁজতে শুরু করলাম।পেয়েও গেলাম।আমি সরাসরি ওর কাছে গিয়ে বললাম,
:কিরে তুই রিয়া কে মারলি কেন,,, ?
:তা কি তোকে বলতে হবে নাকি?
:হুম অবশ্যই আমাকে বলবি।কারন আমার জন্যেই তো বেচারি তোর হাতে মার খেল।এখন বেশি বনিতা না করে বল মারলি কেন?
:ও তোর সাথে কথা বলবে কেন?আরো হাসা হাসি করে?
:কেন,,,? তাতে তোর সমস্যা কি?
:সেটা তোর মত হাদারাম বুঝবে না।
:বুঝাই বল
:পারব না
:তা হলে আমি মেয়েদের সাথে আরোও বেশি করে কথা বলব।
:খুন করে ফেলব,,,!তুই শুধু আমার! শুধু আমার,,!অন্য কেউ তোর সাথে কথা তো দুরে থাক তাকাতেও পারবে না এমন ব্যাবস্থা করব।
ও একটু থামল।রাগটা খুব বেড়ে গেছে।সাপ যেমন ফোস ফোস করে আওয়াজ করে তেমন করে ওর ভিতর থেকেও আওয়াজ আসছে। আমি কিছু বলছি না।বলতে পারছি না।শুধু তাকিয়ে আছি ওত দিকে। ও অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পর ও বলল,
:এই তুই বুঝিস না আমি এমন কেন করছি।বুঝিস না।এই তোকে মানুষের মাঝে মিশতে কে শিখিয়েছে হ্যাঁ??? কেন,,,,?তোকে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছি কেন,,,,?তোর মাঝে শুধু আমি আমাকেই ঢুকিয়েছি কেন,,,,জানিস,, ?
আমি হুট করেই বলে ফেললাম,
:খুব ভালোবাসিস তাই না।
:আর কি ভাবে তোকে বুঝাব হ্যাঁ,,,,?যেদিন থেকে শুনেছি তুই শুধু আমার হবি সেদিন থেকেই আমি তোর হয়ে গিয়েছি।শুধুই তোকেই চেয়ে এসেছি আমি।কারন ওই একটাই আমি তোকে ভালোবাসি।
ওই কথা বলার সাথে সাথে কয়েক ফোটা জল ওর গাল বেয়ে পড়ল। নাহ!!!আমি জল গুলোকে পড়তে দিলাম না।হাতের মুঠোয় ভরে নিলাম। চোখের অবাধ্য জল গুলো মুছে দিলাম।তারপর আরকি সেই অনাকাংক্ষিত প্রপোজ। আমি ভাবতেই পারি নি।এই আমি কোন একদিন কাউকে প্রপোজ করব।এর সব কিছুই আমি আরাফাত এর অগোচরেই করলাম। হাহ কি বন্ধুই না আমি।শালা আমি কোনদিনই ওর ভালো বন্ধু হতে পারব না।
পরের দিন আমি ওকে বিষয়টা জানালাম। কিন্তু ও অবাক হয় নি।এমন আশ্চর্যও হয় নি।ও বোধ হয় জানত যে এমন কিছুই হবে।সেদিন ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল,
রিয়াকে আমার খুব ভালো লাগে।রিয়াও আমাকে খুব ভালবাসে। কিছুদিন আগে মেয়েটাই আমাকে প্রপোজ করল।তারপর যখন শুনলাম তোরা দুজন খুব ক্লোজ হয়ে যাচ্ছিস তখন ভাবলাম আমিও না হয় ওর সাথে ক্লোজ হয়ে যাই।তাই সেদিনই ওর প্রপোজাল টা একচেপ্ট করে নেই।আর না করারও কোন উপায় ছিল না।মেয়েটা এমন ভাবে বলল।
সেদিন ওর গলার আওয়াজ টা ছিল খুব ভারি।ঠিক কেমন জানি। আমি সেদিকে খেয়াল না করে বললাম,
:তলে তলে এত দুর,,, না,,,,,!
:তুইও তো তলে তলে খুব এগিয়ে গেলি।
আমি আর কিছুই বললাম না।আরাফাত ও কিছুই বলল না।কিন্তু আমি স্পষ্ট ওর চোখে জল দেখলাম।যে জলের কারন আমার অজানা।কিন্তু ওর জল আমাকে আর শান্তি দিল না।মাঝে মাঝে খুব অশান্তিতে ভুগতাম আমি এউ ব্যাপারটা নিয়ে.
"""""""
তারপর আর কিছুই লিখানেই ডাইরিতে।বাকি পৃষ্ঠা গুলো সাদা। আর লিখা হয় নি।হবে কি ভাবে,,,ডায়েরির যে দুই চরিত্র তারা দুজনেই যে এই। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওপাশের জগৎ-এ পাড়ি জমিয়েছে।কোন এক দুর্ঘটনায় প্রান হারায় এই দুটি প্রান।শুধু রেখে যায় একটি ডায়েরি আর হাজারো সৃতির মেলা।
আরাফাত ডায়েরি টা পড়ে শেষ করে। হাতের ঊল্টা পিঠ দিয়ে চোখ দু'টো মুছে নেয় ও।সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়েছে। সূর্য প্রায় ডুবে গিয়েছে।আরাফাতের খুব বলতে ইচ্ছে করছে যে,
তোর উত্তর টা আমার কাছে আছে অন্তর। যা তোকে অশান্তিতে ভোগাত। জানিস যখন জানলাম তুই আর অনিকা খুব খুব ক্লোজ হয়ে গেছিস সেদিন থেকেই অনিকার জন্যে তৈরি হওয়া প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি স্বপ্ন নিজের হাতে মেরে ফেললাম।নিজের ভিতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছি।তবুও তোদের সামনে ঠিকই হেসেছি।তোরা বুঝিস নি রে।তোরা বুঝিস নি।জানিস মাঝে মাঝে মনে হত আমার মত একজন অভিনেতা পৃথিবীর কোথাও নেই।
জানিস আমার মৃত অনুভূতি গুলো কে আবার সজিব করে তোলে রিয়া নামক মেয়েটা। তবুও কোথাও যেন অনিকার অভাব দেখতে পেতাম আমি।তবে এখন আর তেমন হয় না।তোদের খুব মিস করি রে! খুব খুব খুব মিস করি।যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। ও হ্যাঁ।জানিস রিয়া না আমাকে খুব খুব ভালোবাসে।
আরাফাত আবারো নিজের চোখ দু'টো মছে নিল।নাহ,,!!!!চোখের জল আর বাধা মানছে না।পড়বে! খুব পড়বে।নাহ আজ আর সেই জল কে বাধা দিবে না আরাফাত। পড়ুক। খুব করে পড়ুক।
আজ অন্তর আর অনিকার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। তাই ডায়েরি টা দেখল আরাফাত। তবে এই পর্যন্ত অনেক বার পড়া শেষ হয়ে গেছে এই ডায়েরি টা। তবুও পড়ে।এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ডায়েরিটা পড়বে আরাফাত আর চোখের জল ফেলবে।
রুম থেকে দেখে আরাফাত কান্না করছে। রিয়া জানে কেন কান্না করছে। আর ও যতক্ষণ না জড়িয়ে ধরবে ততক্ষণ ওর কান্না থামিবে না।আরাফাত এর কান্না সহ্য হয় না রিয়ার।তাই দৌড়ে গিয়ে জোড়িয়ে ধরল আরাফাত কে। আরাফাতও গভির মায়ায় জড়িয়ে ধরল ওকে।
সমাপ্ত
ভুলত্রুটি মার্যনীয়
-তাসফি আহমেদ