Bangla Golpo: অপরিচিতা

Bangla Golpo: অপরিচিতা

তাসফি আহমেদ
.
আমি কখনই ভাবিনি ভালোবাসা আমার কাছে এভাবে আসবে।এভাবে আমার হৃদয় স্পর্শ করবে।কখনই না।আমি ভেবেছিলাম কোন এক গৌধুলি লগ্নে অস্ত যাওয়া রক্তাক্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা কোন এক রমনিকে দেখে আমি মুগ্ধ হব। ভোরে প্রচন্ড কুয়াশার মাঝে ভেজা ঘাঁসের উপর খালি পায়ে নুপুরের ঝনঝনে আওয়াজ তুলে হাঁটতে থাকা কোন নারীকে দেখে তার প্রেমে পড়ব।মুগ্ধ হব।তার মায়া ভরা চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকব।ভালোবাসব ভীষণ।কিন্তু আমার সাথে তেমন কিছুই হয় নি।বিধাতা ভিন্ন কিছু লিখে রেখেছিলেন হয়ত আমার কপালে।
.
সেদিন ছিল সোমবার। ফেব্রুয়ারি মাস।মেলা চলছে। বই মেলা।হাজারো লোকের সমাগম। ভীড় ভেঙে এগিয়ে চলছি আমিও।কয়েকটা বইয়ের প্রয়োজন ছিল।আমি একা!বন্ধুরা কেউই আসে নি।ওরা অবশ্য খুব একটা বই পড়ে না। বইয়ের দোকে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম বই।বই পছন্দ করছিলাম।এমন সময় কানে একটা মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এল।একটা মেয়ের কন্ঠ।সে তার বান্ধুবিদের সাথে হেসে কথা বলছে।তার কোকিল কন্ঠ একেবারে আমার কোমল হৃদয়ে এসে তীক্ষ্ণ তীরের মত বিঁধল। হঠাৎ একটা শিহরন অনুভব করলাম আমি।শান্ত,কোমল,মায়া ভরা এক শিহরন। মেয়েটা আমাকে ক্রস করে চলে যাচ্ছিল পাশের দোকানের দিকে।আমি গাঁড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালাম।ঠিক তখনই আমি অদ্ভুত ভাবে মেয়েটাকে আবিষ্কার করলাম।অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটি। চোখে রাজ্যের মায়া।সে হাসলে যেন তার চোখ জোড়াও হাসে।চেহারাটও প্রচন্ড মায়া বিন্যাসিত।আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম কেবল।ভীষণ মুগ্ধ হলাম।তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়।কোন এক ব্যাপার নিয়ে সে এবং তার তিন বান্ধুবি হাসছে।মেয়েটার হাসিটাও খুব সুন্দর। হাসার সময় কানের পাশে গুঁজে রাখা চুল গুলো সামনে চলে আসে।সে আবার সুন্দর করে সেগুলো কানে পাশে গুঁজে দেয়।আমি আবারো ভীষন মুগ্ধ হই।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।ওর পাশের তিনটা মেয়েও তো হাসছে কিন্তু আমার চোখ কেন বার বার ওর দিকেই যাচ্ছে।কেন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে বারবার।মেয়েটি চলে যায়।মেলার ভীড়ে আমি অপরিচিতাকে হারিয়ে ফেললাম। তন্নতন্ন করে খুঁজলাম তাকে।পেলাম না আর।ক্লান্ত হয়ে বই না কিনেই বাড়ি চলে আসি।
.
কোন রকম রাতের খাবারটা খেয়ে চলে আসলাম রুমে।মেলা থেকে আসর পর থেকেই আমি অনুভব করলাম আমি জানি হয়ে যাচ্ছি।প্রচন্ড আনমনা হয়ে যাচ্ছি।বিকেলে বন্ধুদের আড্ডায়ও যাই নি।রুমেই বসে ছিলাম।খাবার টেবিলে বাবা মাও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে।আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কি হচ্ছে আমার সাথে।কি হতে চলেছে।সব এলোমেলো লাগছে।সকাল চিন্তা ভাবনা মাথা হতে বিদায় নিয়েছে।কেবল অপরিচিতা ছাড়া।তার মুগ্ধকরা চোখ যুগল ছাড়া। কানের পাশে চুল গুলো সুন্দর করে গুঁজে দেওয়ার দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভাসতে থাকল।যেন আমি এখনো অপরিচিতা কে দেখছি।সে ঠিক আমার সামনে বসে আছে।আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।মাঝে মাঝে মৃদু আওয়াজ করে হাসছেক।রাতে আমার চোখ যুগল আর এক হয় নি।অপরিচিতার চোখ যুগল আমায় পুরো রাত তাড়া করেছে।ঘুমাতে দেয় নি আমাকে।
.
পরের দিন আমি আবার মেলায় গেলাম।অপরিচিতা কে খুঁজতে থাকলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ওকে আজও খুঁজে পাব।ওকে আজও দেখতে পাব।তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকলাম।নাহ! আমি তাকে পাই নি আর।এত খোঁজা খোঁজির পরেও অপরিচিতার খোঁজ পেলাম না।
.
আমি অদ্ভুত ভাবে নিজের মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।আমি প্রচন্ড ঘুম কাতুরে ছেলে ছিলাম। যখনই সময় পেতাম একটু ঘুমিয়ে নিতাম।এখন আর তেমন হয় না।আমি আর ঘুমাই না।শুয়ে থাকি কেবল।মাথায় কেবল একটাই চিন্তা।একটাই ভাবনা।অপরিচিতা! দুটো চোখ! কানে চুল গুঁজে বইয়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা একটি দৃশ্য। আমাকে যেন বারবার তার প্রেমে ফেলতে বাধ্য করছিল।আমি যতই চাইতাম অপরিচিতা কে এড়িয়ে চলতে সে ততই আমার হৃদয়ের ঘভিরে স্থান করে নিতে থাকল।কল্পনায় ভাসতে থাকল।আমি মুগ্ধ হয়ে অপরিচিতাকে কল্পনায় অনুভব করতে থাকলাম কেবল।ঘুম,আড্ডা বাদ পড়ে গেছে আমার জিবন থেকে।অফিসে গেলেও কাজে মন বসে না।যে ছেলেটার প্রশংসা করা হত এক সময় এখন আর তার প্রশংসা করা হয় না।দৈনিক বসের ঝাড়ি খেতে হয়।আমি কিছুই মনে করি নি।যেন আমার গায়ে লাগে না।সবাই ভীষণ আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমাকে ভালো ভাবে পরক্ষ করে।কেউ কেউ এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন তারা আমাকে আজ প্রথম দেখছে।কিংবা আমি এখন চিড়িয়াখানায় আছি আর তারা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।যেন আগে কখনও "তাসফি" নামক এই প্রানিটাকে দেখে নি।আজই প্রথম দেখছে।আমি মাঝে মাঝে ভীষন অস্বস্তিতে পড়ে যাই।এড়িয়ে যাই।
.
আজকাল খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গে আমার।ঘুম থেকে উঠেই বসে থাকি।বাইরে বের হই না।প্রচন্ড শীত বাইরে।বারান্দায় গিয়ে দেখলাম ভোরের কুয়াশাচ্ছান দৃশ্য।অনেক দিন পর আমি আজ আবার মুগ্ধ হলাম।প্রকৃতির প্রেমে পড়লাম।লোভটা সামলে উঠতে পারি নি।সুয়েটারের উপর কোমল চাদুরটা জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম কুয়াশা উপভোগ করতে।পৃথিবীতে হয়ত আমিই একমাত্র মানুষ যে কুয়াশা ভীষন পছন্দ করে।ঘন কুয়াশা খুব ভালো লাগে।চাদুর জড়িয়ে ভাবলেশহীন ভাবে হাঁটতেছি।পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে কুয়াশার বাতাস বয়ে যায়।হিম শিতল বাতাস।আমি মুগ্ধ হই।সামনে এগিয়ে যাই।কয়েকজন পঞ্চাশ উর্ধ লোক আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে যায়।আড় চোখে আমাকে দেখে।ওরা মর্নিং ওয়াক করছে।
আর আমি ভাবলেশহীন ভাবে হাঁটছি।ওরা হয়ত আমাকে দেখে ভীষন অবাক হচ্ছে।হোক! তাতে আমার কি।আমি আমার গমন পথ পরিবর্তন করলাম।অন্য পথে হাঁটতে থাকলাম।এদিকে মানুষ খুব একটা আসে না।একটা শান্ত পরিবেশ এখানে।একা একা হাঁটতে থাকলাম।সামনে কুয়াশা।ভীষন কুয়াশা। কুয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকলাম আমি।ঠিক তখনই আমি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলাম।একটা মেয়ে। মাথার চুল গুলো বেন্ড দিয়ে টাইট করে বাধা। গায়ে মর্নিং ওয়াকের ড্রেস।কানে ইয়ার ফোন গুঁজে আমার দিকে আসছে।আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কেবল।নিজেকে ঠিক বিশ্বাস করাতে পারছি না।আমি কি সত্যিই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া অপরিচিতাকে দেখছি? এই কি সেই অপরিচিতা? মেয়েটা আমাকে ক্রস করে চলে যেতে লাগল।আমি কেবল তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আগে যদি জানতাম ওকে এখানে পাব তাহলে প্রতি রাতে আমি এখানে ঘুমাতাম। খুব ভোরে ঘুম ভাঙত।আমি সকাল সকাল তার চেহারা দেখে মুগ্ধ হতাম।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম কেবল।সত্যিই আমি ভীষণ অবাক হলাম ওকে এখানে দেখে।
আর দাঁড়ালাম না।অপরিচিতার পিছু নিলাম।ও ধীর পায়ে দৌড়াচ্ছে।আমি ও পিছন পিছন আসতে থাকলাম।কিছু দুর যাওয়ার পর দেখলাম সে একটা বেঞ্চিতে বসেছে।হাতে থাকা পানির বতল হতে পানি খেল।তারপর চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকল।মোবাইলটা বের করে কি জানি করল।তারপর উঠে যে পথে এসেছে সেই পথে দৌড়াতে লাগল।আমি ওর পিছন পিছন যেতে থাকলাম। আমাকে যে করেই হোক এই অপরিচিতার পরিচয় জানতেই হবে।মেয়েটার সাথে যে করেই হোক কথা বলতেই হবে।তা না হলে আমি যেম দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।খুব অস্থিরতা দেখা দিল আমার মাঝে।
.
চলবে...
.
ভুলত্রুটি মার্জনীয়
তাসফি আহমদ





Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url